গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -৩৩+৩৪+৩৫+৩৬+৩৭

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৩

নীল আকাশের মাঝে ঘন কালো মেঘ জানান দিচ্ছে বৃষ্টির আগমন। কখন যেন শান্তিময় বৃষ্টি নিজ ইচ্ছায় পতিত হয়ে এই সম্পূর্ণ ভুবনটাকে শীতলতায় মাখিয়ে দেবে। শুষ্ক গাছপালা, যারা পানির জন্য ব্যাকুল তাদের খুশি হয়ে নামবে। অবশেষে কালো মেঘগুলো একসাথে হয়। আকাশ থেকে গুঁড়গুঁড় আওয়াজ পাওয়া যায়। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির বিন্দুগুলো পিচ ঢালা রাস্তা আধভেজা করে দেয়। সেই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষগুলোর মাঝে নিজেকে বৃষ্টি থেকে বাঁচানোর প্রবণতা দেখা দেয়। সকলেই ছুটোছুটি করতে থাকে। এই প্রচন্ড ভ্যাপসা গরমের মাঝে হুটহাট বৃষ্টি হওয়া এবং সেটা গায়ে লাগা মানে অসুখ করা। তাই সকলে এতটা ব্যতিব্যস্ত। এই ছুটোছুটির মাঝে ছিল নয়নতাঁরাও। দ্রুত পা চালিয়ে এক বন্ধ চা স্টলের ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয় সে। তার ছোট চুলের মাথায় পড়া পানি একহাতে ঝাড়তে থাকে। গোলাপি স্কার্ফ দিয়ে মুখটা ভালোভাবে মুছে আশেপাশে তাকায়। যদি কোনো গাড়ি পাওয়া যায়? একবার রাস্তার এদিকে আরেকবার ওদিকে চায় মলিন চাহনিতে। বৃষ্টিতে যানবাহনের সংখ্যা আরো কমেছে। ফাঁকা গাড়ি না পেয়ে বিরক্তির সুর করে সোজা দাঁড়িয়ে থাকে সে। অতঃপর আফসোসের সাথে বলে,
“আজকেও উনার সাথে দেখা হলো না। মাই ব্যাড লাক। আমি দেখতে আসার আগেই হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দিল উনাকে। এখন কোন বাহানায় উনার সাথে দেখা করব? ওহ গড, একটা মিরাকল ঘটিয়ে দাও।”

কথার ভান্ডার শেষ হওয়ার মাত্র নয়নের অনেকটা পাশ কাটিয়ে ফুল স্পিডে একটা বাইক চলে যায়। হকচকিয়ে উঠে নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই নিজের শরীরে ভেজা কিছু অনুভব করে নয়নতাঁরা। মাথা নিচু করে নিজের পোশাকের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখে তার পুরো পোশাকে কাঁদা ভরে গিয়েছে। চোখটা কপালে উঠে যায় তার। কালো রঙের এই পছন্দের জামা তাকে তার ভাই নির্জন জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল। গতকালও বৃষ্টি হওয়ায় পানি বা কাঁদা কোনোটাই ভালোভাবে শুকিয়ে যায় নি। কান্না এবং রাগ একসাথে অনুভূত করে ওঠে। পুরুষালী কণ্ঠে দাঁত কিড়মিড় করে তাকায়। একটা বাইকে তিনজন ছেলে। সামনে যে ছেলেটি বসে ছিল সে বেশ হেসে বলে ওঠে,
“সরি গার্ল। তোমার এখানে দাঁড়ানো উচিত ছিল না। সো স্যাড!”

ছেলেটির এই কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। নয়নতাঁরার রাগটা এবার দাবানল স্বরূপ হয়ে উঠল। ছাউনির নিচ থেকে বেরিয়ে পায়ের নিচে থাকা বড় পাথর হাতে তুলে কোনো কিছু না ভেবেই নিক্ষেপ করল বাইকের দিকে। চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“স্টুপিডের দল। বাইক যে রাস্তায় কীভাবে চালাতে হয় সেটাও জানে না।”

পাথরের আ’ঘাতে বাইকের পেছনের লাইট ভেঙে গেল। ছেলেগুলো এমনিও ভালো ছিল না। হতে পারে বড়লোকের বাপের বখে যাওয়া ছেলে! সঙ্গে সঙ্গেই বাইক থেকে নেমে তেড়েফুঁড়ে এলো তারা। বৃষ্টিতে আধভেজা হয়েছে নয়নতাঁরা। কোঁকড়ানো এবং ফোলা চুলগুলো নেতিয়ে পড়েছে। চুল দিয়ে টপটপ করে বেয়ে পড়ছে পানি। সমস্ত শরীর ভিজে গিয়েছে। তিনজন ছেলেই তার সামনে ঘিরে দাঁড়িয়ে বাইকের মালিক চেঁচিয়ে বলল,
“হাউ ডেয়ার ইউ, ইডিয়ট! আমার গাড়ি ভাঙার সাহস তুমি পাও কই থেকে?”

“যেখান থেকে আপনারা আমাকে হেনস্তা সাহস পান। লজ্জা করে না এসব কাজকর্ম করতে?”

“না করে না। ইভেন এখন সবার সামনে তোমায় ধরে…”

বলেই ঠোঁট কামড়ে বিশ্রী হাসে ছেলেগুলো। তারপর একে অপরের দিকে তাকায় তারা। অতঃপর সবাই মিলে নিজের দৃষ্টি দ্বারাই যেন তীক্ষ্ণ নজর দিতে থাকে নয়নতাঁরার দিকে। যেন তাদের চিলের ন্যায় দৃষ্টি এক খাবারের দিকে লক্ষ্য করছে। নয়নতাঁরার ভেতরটা ঢিপঢিপ করে। এমন দৃষ্টিতে সেঁটে যায়। পায়ের আঙ্গুল দ্বারা বৃথা চেষ্টা করে জুতো খিঁচে ধরার। চোয়াল শক্ত হলো। দৃষ্টি নিচে পরে তখন। আগপাছ না ভেবে রাস্তার পাশে জমে থাকা কাঁদা দুহাতে তুলে ইচ্ছেমতো ছুঁড়ে মা’রতে থাকে ছেলেগুলোর দিকে। ছেলেগুলোর চোখেমুখে কাঁদা লেগে যাওয়ায় রীতিমতো সব অস্পষ্ট হলো। রাস্তার আশেপাশে ছাউনির নিচে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের সরগম বাড়ল। সবাই আশ্চর্যের সাথে দৃশ্য দেখতে থাকল আর মজা লুটতে থাকল। এছাড়া পাব্লিকের কাজ কী?

নয়নতাঁরা কিছুটা ক্ষ্যান্ত হতেই রেগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে ছেলেগুলো। একজন ক্ষিপ্র বেগে এসে দাঁত কটমট করে বলে,
“দিন বলেই এতো সাহস পাচ্ছিস রাত হলে বুঝিয়ে দিতাম! নাকি পাব্লিকের সামনে নিজেকে অসম্মানিত করতে চাস?”

অন্যজন তো ক্ষিপ্ত বেগে ধেয়েই আসে। মনে যেন অসৎ উদ্দেশ্য। কাঁদা মাখা চোখমুখটায় ফুটে উঠেছে অসম্ভব রাগ আর কুদৃষ্টি। নয়নতাঁরার ভিজে যাওয়া শরীরকে খুঁটিয়ে দেখার একটা সুযোগও ছাড়ে না তারা। নয়নতাঁরা বুঝতে পেরেছে ছেলেগুলো খুব একটা সুবিধার নয়। কিন্তু সে পিছপাও হবে না। ফট করে ছেলেটির হাত স্কার্ফে পড়তেই দূরে থাকা সমস্ত পাব্লিক এবার ক্ষেপে ওঠে। নয়নতাঁরার মুখে নীল বর্ণ ধারণ করে। তীব্র শব্দ কানে আসে গাড়ি এসে থামার। পাওয়া গেল এক কন্ঠের উগ্র সুর। অতি চেনা এবং আপন লাগল সেই কন্ঠ। নয়নের মনে হলো তার ভ্রম। যেই ভ্রম সে প্রতিদিন নিয়ম করে দেখে।
“কী হচ্ছে এখানে? কী করছেন আপনারা মেয়েটার সাথে?”

নয়নতাঁরা চোখ উঠিয়ে দেখে ছেলেগুলো যেন হাওয়ার বেগে কতটা দূরত্বে সরিয়ে দাঁড়িয়েছে! এই উগ্র সুরের এতো জোর? এতো ক্ষমতা? তার মানে নিশ্চয় ভ্রম নয়! এটা দৃঢ় সত্যি! নয়নের ইচ্ছে করছিল না পিছু ফিরে দেখতে। যদি আবার কর্পূরের ন্যায় উড়ে যায় সেই কন্ঠের মালিক? কিছুটা নিজের উপর জোর খাটিয়ে পিছু ফিরতেই যখন পুলিশের ফর্মাল ইউনিফর্ম পরা সেই সুপুরুষ সত্য সত্যই দৃশ্যমান হয় নয়নের ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে মানুষটার আলিঙ্গনে দাঁড়াতে। এটা তো সত্যিই মিরাকল!

নয়নতাঁরা ভাবনায় অন্ত ঘটে ছেলেগুলোর উচ্চস্বরে। বাইকের মালিক তড়তড় করে বলে,
“স্যার, মেয়েটা আমার বাইকের ক্ষতি করেছে। পেছনের দিকটা ভেঙে দিয়েছে তাও বড় পাথর দিয়ে। আমাদের রাগাটা কি অস্বাভাবিক নয়? আমরা তবুও ওকে সাবধান করছিলাম। কিন্তু সে আমাদের গায়ে কাঁদা ছুঁড়তে থাকে। মাথায় মনে হয় সমস্যা আছে তার।”

রায়ানের মাথায় ছাতা ধরে আছে শেখর। আঁড়চোখে তাকিয়ে রায়ানের প্রতিক্রিয়া দেখার চেষ্টায় আছে সে। রায়ান এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। তবে কাজ পিছু ছাড়ে না। কাজের জন্য অফিসে যাচ্ছিল সে। রাস্তার মাঝেই এমন কান্ড দেখে বিষয়টা বুঝতে গাড়ি থামানো হয়। নয়নতাঁরার দিলে একপলক তাকালো সে। বোঝার চেষ্টা করল তার চোখের ভাষা। গোল গোল চোখে তখন একটা সূক্ষ্ম আশা দেখা গিয়েছিল। রায়ানকে পেয়ে এক সূক্ষ্ম আলোর মতো আশা! রায়ান সেই আশাকে বৃথা যেতে দিল না। নারীকে অসম্মান তার বড়ই অপছন্দ। নারী মায়ের জাত। সেখানে সে নিজ চোখে দেখেছে মেয়েটার স্কার্ফে রূঢ় ভাবে স্পর্শ করতে। তবুও রায়ান শান্ত থেকেই বলল,
“তোমাদের সাবধান করার ধরণ বুঝি কোনো মেয়ের স্কার্ফ ধরে টানাটানি করা?”

ছেলেগুলো থতমত খেল এবার। বুঝতে পারল নিজের বলা ক্ষীণ মিথ্যেগুলো ইন্সপেক্টর রায়ান ধরে ফেলেছে। রায়ান আরো একবার তাকালো নয়নের দিকে। মুখটা ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে মেয়েটির। যা স্বাভাবিক। ছেলেগুলোর ক্ষিপ্র আচরণে সে নির্জীব হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির বেগ আস্তে আস্তে বাড়ছে। একটু পর পর কেঁপে উঠছে তার সমস্ত শরীর। রায়ান এবার এগিয়ে গেল নয়নের দিকে। শেখরের হাত থেকে ছাতাটা নিল। নয়নতাঁরার মাথার উপরে ধরতেই নিষ্পলক দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রায়ানের দিকে। মানুষটা আশেপাশে থাকলে নিজের মাঝে সজীবতা নতুন করে খুঁজে পেতে সহজ হয় নয়নের। আস্তে আস্তে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলে পরমূহুর্তেই। রায়ান জিজ্ঞেস করে,
“ওরা যা বলছে সেটা কি ঠিক? ফুল স্টোরি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই আমি।”

নয়নতাঁরা এক আলাদা আশ্বস্ত খুঁজে পায় রায়ানের কন্ঠে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সাবলীল ভাবে বলতে শুরু করে,
“পুরোপুরি সঠিক নয়। ওরা আগে অন্যায় করেছে। ইচ্ছে করে আমার পাশ দিয়ে বাইক নিয়ে গিয়েছে যাতে আমার গায়ে কাঁদা পড়ে। আমি রাগ সামলাতে পারিনি তাই…”

রায়ানের শান্ত নেত্রপল্লবের দৃষ্টি এবার পড়ে ছেলেগুলোর উপর। পোশাক-আশাকে স্পষ্ট ছেলেগুলো ভালো ঘরের। সমস্যা একাই! মানুষ করতে পারেন নি তাদের মা-বাবা। রায়ানের শান্ত দৃষ্টিতে মিশে থাকা চাপা ক্রোধের আগুন ছেলেগুলোর চোখে ঠিকই ধরা পড়ল। থমথমে সুরে রায়ান বলল,
“সাবধানে চলাফেরা করো তোমরা। ফের আমার নজরে এলে তোমাদের ক্ষমতাশালী কারোর কিছু মানব না। সোজা থানায়। ইটস্ মাই ফার্স্ট অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং বয়েজ্! আর ইন্সপেক্টর রায়ান নিজের কথা মাটিতে পড়তে দেয় না।”

নয়নতাঁরার বিস্ময়ে পরিপূর্ণ আঁখি দুটো যেন সদ্য জন্মানো গোলাপের ভেতরের রেণু। যাকে আবৃত করে রেখেছে গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঘন চোখের পাপড়ি। ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দু তার সেই আঁখিতে পড়লেও পলক ফেলার নামও নেয় না সে। তার নিকটে থাকা এক শান্ত পুরুষকে দেখার কোনো মূহুর্তে বাদ দেওয়া যাবেই না। এক শান্ত পুরুষ যার শান্ত রাগ দ্বারা শত শত্রু পরাজিত হতে পারে! নয়নের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায় চোখের পলক অবশেষে পড়েই যায় রায়ানের কথায়।
“আপনাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি। কাইন্ডলি আমার সাথে আসুন।”

ভদ্রতার সহিত নয়নকে গাড়ির দিকে যেতে ইশারা করে রায়ান। নয়নতাঁরার কাছে তো এটা মেঘ না চাইতেই জল! নেচে নেচে গাড়িতে বসার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠলেও সেই প্রবণতাকে চাপা দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। পাশাপাশি ছাতা নয়নের উপরে ধরে হাঁটতে থাকল রায়ান। মেয়েটার গায়ের জামা লেগে গিয়ে শরীরের প্রতিটা ভাঁজ স্পষ্ট। লোকজনের নজর এড়াতে কিছু একটা ব্যবস্থা অন্তত করা দরকার!

গাড়িতে বসতেই পেছনের সিটে নয়নতাঁরা পাশে রাখা কালো কোটটা নয়নের হাতে ধরিয়ে দিল রায়ান। আর বলল,
“এটা রাখুন আপনার কাছে। আর পড়ে নিলে ভালো হয়।”
নয়নতাঁরা দেরি করল না। নিজের এমন বিশ্রী অবস্থা দেখে লাজুক ভঙ্গিতেই জড়িয়ে নিল কোট গায়ে। মনে মনে একটা কথার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকল, ‘বিপদে পড়ে যদি এই মুগ্ধকর মানুষটার সঙ্গে বারংবার দেখা পাওয়া যায় তবে হাজারবার সে আনন্দের সহিত বিপদে পড়তে রাজি!”

ভুবনে নেমে আসা তীব্র বেগের বর্ষণ দুচোখ ভরে দেখছে কোহিনূর। ছোট্ট জানালার জমা হয়েছে সেই বষর্ণের ক্ষুদ্র জলবিন্দু। এই বষর্ণের তীব্র শীতল হাওয়া কোহিনূরের গা ছুঁইয়ে গেলেও মনটাকে ছুঁতে পারল না। প্রকৃতিতে তো কিছুক্ষণ আগে এই বষর্ণের সৃষ্টি হলো! তবে তার মনে যে টানা কয়েকদিন বর্ষণ চলছে? তার কী হবে? সেই বর্ষণে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে মনের প্রতিটা কোণ। মনের অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত কথা উগলে দিতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। তবে এই ইচ্ছের বিরুদ্ধে লড়তে থাকা সেই জলোচ্ছ্বাসের মতো ভয়টা বার বার জিতে যাচ্ছে। কোহিনূরের নিজের উপরেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে ফেলে। আপনমনে আওড়ায় কিছু কথা!
“নির্জন আহমেদ কোহিনূর! যার জীবনের ডিকশনারিতে ভয় নামক শব্দ ছিল না। কোনো মৃ’ত্যুভয় অবধি ছুঁতে পারে নি তাকে। কিন্তু আজকে এমন দিন এলো যে একটা নারীকে তার সংলগ্নে রাখার জন্য, তাকে হারাবার ভয়ে শতশত মিথ্যে বলে যাচ্ছে। অনেক কথা লুকিয়ে যাচ্ছে। সেই নারীকে অদূরে হারিয়ে ফেলার ভয়টা রাতের ঘুম কেঁড়ে নিয়েছে। ভয় বুঝি এভাবে হৃদয়টাকে আঁকড়ে ধরে?”

নিজের বলা কথাগুলো বুঝে উঠে নিজেই হয়রান হয় কোহিনূর। মেঘলা সেই আকাশের গুড়গুড় শব্দ কর্ণকুহরে এসে পৌঁছালো তার। তৎক্ষনাৎ আকাশের ভয়ানক গর্জন ভুবনকে কাঁপিয়ে তুলল। কোথাও বাজ পড়ল। কোহিনূরের মনের কোণে একটা ক্ষুদ্র প্রশ্ন জমা হলো! কোহিনূরের আসল পরিচয় যদি রাগিনী জেনে ফেলে তাহলে বুঝি এই আকাশের গর্জনের মতোই অবিশ্বাস নামক ছোট্ট শব্দটি তাদের নামহীন এই মিষ্টি সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে? না চাইতেও অবাধ্য দুটো চোখ গিয়ে আবারও পড়ল দরজায়। দরজার কাছে সেই চেনা চেহারা যদি ভেসে ওঠে? যদি সেই প্রগাঢ় মায়াবী চোখের দেখা পাওয়া যায়? সে তো চোখ নয় যেন আস্ত কাজলদিঘী! চিকন করে কাজল লাগায় রাগিনী মেয়েটা। তবুও যেন মনে হয় সেই আঁখিতে ভাসে স্বচ্ছ এক গোপনীয় সমুদ্র। যাকে কাজল দিয়ে ধরে বেঁধে রাখা হয়েছে। দরজায় কারোর উপস্থিতি না পেয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল কোহিনূর। নিজে নিজেকে সামলাতে বিরবির করে বলল,
“এতো বিচলিত কীসের তাড়নায়? এতো ব্যাকুলতা কেন? কোহিনূর তো আগে এমন ছিল না। সে এভাবে কারোর জন্য ব্যাকুল হয়নি। আজকাল কী হয় তার? এই উচাটন সামলে উঠতে পারছি না কেন আমি?”

করিডোরের কাছে এসে বিভিন্ন ছাতা মেলিয়ে রাখা দেখল রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ধরে রাখা ছাতাটাও রেখে দিল সে বৃষ্টির পানি ঝরতে। আজ আসতে তার দেরি হয়েছে বটেই। দেরি হবে না কেন? বাড়িতে যা কান্ড ঘটল! উর্মিলা জ্ঞান আসার পরপরই সেখানে আর থাকেনি সে। জেদ ধরে বসেছিল নোমান যেখানে আছে সেখানে আর এক মূহুর্ত থাকবে না। তাই রাগিনীও তড়িঘড়ি করে খাবার রেডি করে উর্মিলার সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। উর্মিলাকে তার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে নিজের গন্তব্যে এসেছে। এরমাঝে অভিরূপের সঙ্গে কোনোরকম আলাপ করার সময় আর হয়ে ওঠেনি। তবে ছেলেটাকে বেশ অদ্ভুত লেগেছে তার। যতক্ষণই চোখের সামনে থেকেছে গোল গোল করে চোখ পাকিয়ে থেকেছিল নয়ত নোমানের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিল যেন উচ্ছ্বাসের সাথে। রাগিনীর কিছুটা হাসি পেলেও তা দমিয়ে রেখে নিজের কাজ করে গিয়েছিল।

এসব আগপাছ ভাবতে ভাবতেই আনমনেই কোহিনূরের ঘরের ভিড়িয়ে দেওয়া দরজাটা ঠেলে দিয়ে শান্তভাবে একপা রাখল সে। তৎক্ষনাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যেতে হলো তাকে। আরেকটু হলেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতো রাগিনী। দরজার একদম কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল কোহিনূর। রাগিনীর এমন প্রতিক্রিয়ায় তার স্বভাবসুলভ হাসিটা আরো বাড়ল। বড় একটা শ্বাস নিল রাগিনী। তেত উঠে বলল,
“এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে দরজার কাছে? ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন?”

“কী করব বলো? তোমার মতো একজন যুবতী, কুমারী মেয়ে এভাবে রুমে নক না করেই ঢুকে আসে। তোমরা মেয়েদের রুমে হুটহাট করে কোনো ছেলে নিশ্চিত মানহানির মামলা করে দেবে। আর আমাদের ছেলেদের রুমে তোমরা দেখি যখন ইচ্ছে তখন ঢুকে পড়ো। আমাদের ছেলেদের আইন নেই বলে এমন শান্ত নির্যা’তন করবে?”

রাগিনী এখনো অবধি কোহিনূরের ঘরে ঢুকতেও পারেনি। সবেমাত্র মানুষটার চেহারা দেখল। তাতেই শুরু! মাথায় এলো একটা সূক্ষ্ম প্রশ্ন। শান্ত নি’র্যাতন আবার কোন ধরণের নির্যা’তন? এটা আদেও কোনো বাংলা ডিকশিনারিতে আছে? অতঃপর সে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“আমাকে জ্বালিয়ে কী পান আপনি?”

এবার দরজার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায় কোহিনূর। রাগিনী হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে। আগের মতোই টিফিনবক্স টেবিলে রাখতেই কোহিনূরের কথায় পিছু ফিরে তাকায় সে।
“এইযে তোমার ঝাঁঝালো দৃষ্টি যা আমার অস্থির মনকে শান্ত প্রতিষেধক। তোমার রাগভরা কন্ঠ আমার কাছে এক মাধুরী মেশানো রূপকথার কোনো সুর। যেই সুরে মনটা তাল মিলিয়ে যায়। আমাকে এতো কিছুর থেকে এতক্ষণ মিস করানোর জন্যই তোমাকে রাগিয়ে দেওয়া।”

কথার মাঝে দম নেয় কোহিনূর। নিকটে আসে রাগিনীর। রাগিনী খুব করে চায় সামনে থাকা এই মুখোশধারী ব্যক্তিকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে জোরপূর্বক জিজ্ঞেস করতে, কে সে? জানে, এর কোনোরকম উত্তর পাবে না তাই চুপ করেই থাকল সে। ভেতরে থাকা অবিশ্বাসের এক তীব্র আগুন এই কোহিনূর রত্নের সংলগ্নে আপনা-আপনি বুঝি নিভে যায়? কেন মনটা এমন ইঙ্গিত দেয় যে এই মানুষটিই তার নিরাপত্তা? অথচ তাকে সন্দেহ করার হাজার হাজার কারণ খুঁজে বের করেছে রাগিনী। আবারও কোহিনূরের জবান খুললে চকিতে তাকায় সে।
“তাছাড়া রাগিনী নামটাকে তো সার্থক করতে হবে!”

রাগিনী এবার পাশ কাটিয়ে সরে যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে বিছানায় ধপ করে বসে বলে,
“আপনার মুণ্ড! দ্রুত খেয়ে নিন। আমরা এক জায়গায় যাব।”

“আবার একটা জায়গা? কোথায়?”

“সারপ্রাইজ!”

একটা উদ্ভট হাসির সাথে বলল রাগিনী। কোহিনূরের কিছুটা অদ্ভুত লাগল তবুও কিছু বলল না। এসে বসল খেতে। বেশ খিদে পেয়েছিল। কাল কাজের যা চাপ ছিল! খাওয়ার সুযোগটাই হয়নি ঠিকমতো।

ঢাকা শহর একপ্রকার বিখ্যাত ট্র্যাফিক জ্যামের কারণে। যেখানে সেখানে যানবাহনের ভীড়। ঘন্টার পর ঘন্টা যে হারে জ্যাম লেগে থাকে সেটুকু সময়ে একটা দম্পতির বিয়ে থেকে শুরু করে সংসার পাতা অবধি হয়ে যাবে। ঠিক সেরকম জ্যামে আটকা পড়েছে রাগিনীর গাড়ি। হুটহাট করে একটু একটু এগোচ্ছে আবারও থেমে যাচ্ছে গাড়ির চোটে। রাগিনী বিষয়টাতে বিরক্ত! চট্টগ্রামেও এমন হয় তবে এতোটা সমস্যা হয় না। সিটে ঠেস দিয়ে বসে রাগিনী। কন্ঠে বিরক্তি টেনে বলে,
“উফফ… জ্যাম কখন ছাড়বে কে জানে! একে তো দূরের রাস্তা তার উপর এই অবস্থা। পৌঁছাতে পৌঁছাতেই তো সন্ধ্যা।”

“বৃষ্টি থামছে তো তাই সবাই তাড়াই আছে। মনে হয় তাড়াতাড়ি ছাড়বে।”

ড্রাইভারের কথায় তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে রাগিনী। সঙ্গে সঙ্গে নীরব কোহিনূর বলে,
“হ্যালো, মিস! আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?”

“উঁহু, সারপ্রাইজ।”

কোহিনূর সরু চোখে তাকায়। আলতো ধাক্কা দিয়ে ক্ষীণ সুরে বলে,
“এবার আমার সন্দেহ হচ্ছে।”

“কীসের?”

“উহুম! আমাকে একা পেয়ে আবার এডভান্টেজ নিতে চাইছো না তো?”

সোজা হয়ে নড়েচড়ে বসে রাগিনী। কোহিনূরকে আঁড়চোখে দেখে নেয় সে। কড়া সুরে এবার ঠোঁট সরু করে বলে,
“আপনার মতো দানব টাইপ লোকদের থেকে এডভান্টেজ?”

“করলে তো ইনসাল্ট?”

“করলাম! ইনসাল্ট হওয়ার জন্য নিজেই এগিয়ে এসেছেন।”

কোহিনূর এবার রাগার বদলে মুখ টিপে হাসে। তার হাসির রহস্য উদ্ধার করতে পারে না রাগিনী। কোহিনূর হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে হাসিটা আরো প্রগাঢ় করে বলে,
“শুনেছিলাম সুন্দরীদের কাছ থেকে ইনসাল্ট হওয়ার টেস্ট দারুণ। টক, ঝাল, মিষ্টি! আজকে ফিল করলাম। আসলেই সুন্দরীদের কাছে ইনসাল্ট হতে খারাপ লাগে না। আর যদি সেটা হয় রাগিনী তাজরীন তাহলে তার শত ইনসাল্ট, তার শত আ’ঘাত, তার শত শা’স্তি আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।”

রাগিনীর আঁখি স্থির হলো কোহিনূরের আঁখিতে। গভীরভাবে মনোনিবেশ করল সেই আঁখিতে। লোকটার কন্ঠে কিছু আছে যা প্রতিটা সাধারণ অক্ষরও আকর্ষণীয় করে তোলে। তার চোখে কিছু অব্যক্ত ভাষা রয়েছে যা যেন রাগিনীকে খোঁজার নির্দেশ দেয়। এ যেন কোনো মানুষ নয় আস্ত এক গুপ্ত রহস্যের ভান্ডার। যা উদ্ঘাটন করতে পারলে আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার হবে! যেটা রাগিনীর কাছে অভাবনীয়।

আজকে রিলিজ দেওয়া হবে হামিমকে। হামিম হচ্ছে সেই ছোট ছেলে যাকে রাগিনী রেসকিউ করেছিল। তাকে বিদায় দিতেই এসেছে ফাহমিদ নিজে। অবশ্য রাগিনী তাকে বলেছিল আসতে। কারণ রাগিনী নাকি আজ ব্যস্ত থাকবে। অন্যদিকে ছেলেটার কাছে রিলিজের দিন না এলেই নয়। তাই ফাহমিদ এলো হসপিটালে। ফাহমিদকে একা দেখে হামিমের মা প্রশ্ন করে উঠলেন,
“ম্যাডাম আজ আসেন নাই?”

ফাহমিদ মৃদু হেঁসে নিচু সুরে জবাব দিল,
“না। আসলে ও নাকি একটু ব্যস্ত আজ। তাই আমি এলাম। কেন? আমি থাকলে হবে না বুঝি?”

“না, না। সেটা বলি নাই। আপনেও তো আমার পোলাডার জন্য কম করেন নাই। শুনলাম আপনে র’ক্ত দিছেন ওরে। এইডাই বা কয়জন করে? আপনে সত্যিই ভালা মানুষ।”

“এসব বলে লজ্জা দিচ্ছেন কিন্তু। আর ছেলেকে এভাবে রাস্তায় ইন’কাম করতে পাঠাবেন না। ভালো করে পড়াশোনা করান। ভবিষ্যৎ সুন্দর হবে।”

হামিমের মায়ের মুখ মলিন হলো। হাসোজ্জল মুখটায় নেমে এলো একটা আঁধার। কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তাছাড়া কী আর করমু? পোলাডার বাপের ক্যান্সার আছিল। এই ম’রণব্যাধি উনারে বাঁচতে দেয় নাই। সে থাকলে কি আর এতো কাম করতে দিতো? কলিজার মধ্যে রাইখা দিতো হামিম রে। ছোডুবেলায় অনেক ভালা পাইতো হামিমরে। বাপ নাই তো কিছুই নাই। সর্বহারা।”

ফাহমিদের মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গেল পরক্ষণেই। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের রাগে ভরা দৃষ্টি দমিয়ে রাখার চেষ্টা করতেও বেরিয়ে এলো এক ক্রোধে ভরা চোখ। চোখ নামিয়ে নিলো সে। ঢক গিলে হিসহিসিয়ে বলল,
“সব বাবা ভালো হয় না। কিছু বাবা থাকার থেকে না থাকাই ভালো। কিছু বাবা সন্তানকে কলিজায় ঢুকিয়ে আগলে রাখে না। কিছু বাবা সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করে নিজহাতে। সব বাবা বটগাছের মতো সন্তানকে আগলায় না। বরং ঠেলে দেয় বিপদের দিকে।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৪

রায়ানের গাড়িটা এসে থামল ঠিক ‘আহমেদ মেনশন’ নামক সাধারণভাবে সুসজ্জিত বাড়ির সামনে। গাড়িটা স্থির হওয়ায় সামনের সিটে সোজা হয়ে বসে থাকা রায়ান ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। বাম জানালার কাঁচে গুটিশুটি মে’রে বসে আছে নয়নতাঁরা। চোখ দুটো বন্ধ। ভেজা ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে গিয়েছে। তবে কাঁপুনি কমেনি বিন্দুমাত্র। মাথার চুলে এখনো পানিতে নেতিয়ে আছে। যত পানি বসবে আরো ঠান্ডা লাগবে। তাই রায়ান ডাক দিয়ে ওঠে।
“মিস. নয়নতাঁরা!”

নয়ন নড়েচড়ে ওঠে। তবে চোখ মেলে তাকায় না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে জানালার পাশ ঘেঁষে মাথা রেখে দুহাতে মুখ ঢেকে বাচ্চাদের মত কাঁচুমাচু মে’রে বসে থাকে। রায়ান তাকে কীভাবে ডাকবে ভেবে উঠতে পারছে না। সে নিজে উসখুস করে আবারও ডাকল,
“হ্যালো! মিস নয়নতাঁরা। আমরা আপনার বাড়ির সামনে এসে গিয়েছি।”

এবার কথাটা নয়নের কান অবধি পৌঁছালো। রায়ান নয়নের বাড়ি চিনলো কীভাবে? নয়ন তো রায়ানকে বলেনি। প্রশ্নটা মস্তিষ্কে খেলে যেতেই নয়নতাঁরা এক ঝটকায় উঠে বসল। হুড়মুড়িয়ে জানলার বাহিরের দিকে নিজের বাড়িটার দিকে তাকাল। আরে হ্যাঁ, এটা তো তারই বাড়ি। এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে রায়ানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই রায়ান বুঝে গেল নয়নের এই চাহনিতে লুকিয়ে থাকা প্রশ্ন। তাই সে সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
“আমি জানি আপনি কী ভাবছেন। আপনি ভাবছেন আমি আপনার বাড়ি চিনলাম কীভাবে। উত্তরটা খুব সহজ মিস. নয়নতাঁরা। সেদিন এয়ারপোর্টে যখন আপনাকে দেখেছিলাম এবং আপনি আপনার নাম বলেছিলেন তখন আপনাকে আমার চেনা চেনা লেগেছিল। আপনার নামের সঙ্গে আহমেদ টাইটেলটা আমার সন্দেহ প্রগাঢ় করেছিল। পরে জানতে পারি আপনি অফিসার নির্জন আহমেদের একমাত্র বোন। অফিসার নির্জনের সাথে আপনাকে আমি একটা ইভেন্টেও দেখেছিলাম অনেক আগে। আমার স্মরণ শক্তি এতটাও দুর্বল নয়।”

নয়নতাঁরার চোখ এবার কপালে। রায়ান নামক ব্যক্তিটিকে সে যতই ভোলাভালা ভাবুক, আসলে লোকটা সাংঘাতিক সেই সাথে বুদ্ধিমান। এখন কি তার ভাইয়ের মতো এই লোকটাও সব সময় খবরদারি করবে? সব খবরদারি করা লোকজন কেন তার কপালেই জোটে। অবশ্য রায়ানকে তো সে ইচ্ছে করে জুটিয়েছে। কী আর করার সত্যিকার অর্থেই যে মানুষটা এতটাই মনোমুগ্ধকর। নয়ন নিজেকে ধাতস্থ করে উত্তর দেয়,
“এই নিয়ে তিনবার আমায় বিপদ থেকে বাঁচালেন আপনি। আপনি মানুষটা এত বিপদের সাথে জড়িত থাকেন কেন? এত বিপদ নিয়ে থাকলে আপনার কাছে কেউ আসবে? আমি নেহাত ভালো মেয়ে তাই আসি।”

রায়ান এবার হতবাক হয়। তার জানামতে সে দুইবার মেয়েটাকে বাঁচিয়েছে। আরো একবার কখন তার সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে? নয়নতাঁরা রায়ানের কোট খুলতে শুরু করে। তা দেখে রায়ান তড়িঘড়ি করে বলে ওঠে,
“খুলতে হবে না আপনাকে। আপনার কাছে রাখুন।”

কোনোরকম বিলম্ব না করেই কোট পুনরায় নিজের গায়ে জড়িয়ে নেয় নয়ন। যেন সেই কোট পেয়ে সে খুশিতেই আটখানা। অতঃপর গাড়ি থেকে নেমে জানালা দিয়ে নয়ন রায়ানকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আরেকটু সময় দাঁড়াবেন প্লিজ? আমি এক্ষুনি আসছি।”

বলেই মেয়েটা তার বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। রায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকে। হাঁটার মাঝে বিরতি নিয়ে নয়ন ফের পিছু তাকিয়ে মিষ্টি হেঁসে বলে,
“ওয়েট করবেন কিন্তু।”

রায়ান হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইল তার কোট পরিহিত মেয়েটির দিকে। তার ভেজা চুলগুলো হাঁটার তালে তালে দুলছে। মেয়েটার মনটা এখনো বাচ্চাদের মতোই। বাচ্চা ভাবটা এখনো কাটেনি। না কাটানোই স্বাভাবিক। নির্জনের একমাত্র বোন সে। নির্জনের এই একটাই দুর্বলতা! নয়নতাঁরা। তাকে যেভাবে আগলে রাখার কথা তাতে বাচ্চা ভাবটা কাটবেই না। এসব মনে মাঝে একটু একটু ভাবতে ভাবতে নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় রায়ানের। কতদিন মায়ের সাথে কথা হয় না! মানুষটা কেমন আছে জানা হয় না। চিকিৎসা কতদূর জিজ্ঞেস করা হয় না। ফ্রি হয়ে দ্রুত কথা বলতে হবে।

ভাবনার মাঝে ব্যাঘাত ঘটাল সেই চিকন মেয়েলি সুর। চোখ দুটো নিমজ্জিত হওয়া আবারও পিটপিট করে তাকালো ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নয়নের পানে। ফুল দেখে উসখুস করে উঠল রায়ান। গলা খাঁকারি দিয়ে গাম্ভীর্য রূপটা ধারণ করার চেষ্টা করল। নয়নতাঁরা ফুলটা রায়ানের মুখের সামনে ধরে বলল,
“আমাদের গাছের ফুল। এটা নিন।”

“কেন?”

“ফুল কেন দেয় একটা মানুষ আরেকজন মানুষকে? উপহার হিসেবে? পুরষ্কার হিসেবে? আবার ভালোবাসা প্রকাশ্যে। এরমধ্যে যেকোনো একটা ধরে নিলেই পারেন।”

নয়নতাঁরা এমন উত্তরে এবং কন্ঠস্বরে রায়ান বুঝল মেয়েটা তার করা বোকা প্রশ্নে চটে গেছে। ফুলটা নেওয়া উচিত হবে কিনা সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। তবে মেয়েটার চোখে স্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা দেখে ঢক গিলে দুটো আঙ্গুলে ফুল ধরল রায়ান। নয়নতাঁরার হাসির ঝলকে যেন মুখরিত হয়ে উঠল আশপাশ। মেয়েটা এতো ছোট ব্যাপারে খুশি হয়ে গেল কেন? মেয়েটা আর দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে পিছু ফিরে হাঁটা দিল। কিছুদূর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
“ফুলটা কিন্তু আমি আমার বলা লাস্ট রিজনের জন্যই দিয়েছি মিস্টার!”

সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে গেল রায়ানের। মেয়েটা এক চোখের পলকে কোথাও যেন উধাও হলো। লাস্ট রিজন মানে? ভালোবাসা প্রকাশ্যে? এতটুকু ভাবতেই গলা শুঁকিয়ে এলো রায়ানের। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কান গরম হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে। নয়নের দেওয়া ফুলটি গোলাপ। বারোমাসি গোলাপ যাকে বলে। তবে বেশ স্নিগ্ধ ভাবে ফুটে রয়েছে। শেখরের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙ্গে তার।
“স্যার, অফিসার নির্জনের বোন কী বলে গেল ওসব?”

রায়ান থতমত খেয়ে গম্ভীর ভাবে জবাব দেয়,
“কিছু না। তুমি গাড়ি স্টার্ট দাও।”

রাস্তার আশেপাশে কিছু গ্রামীণ দৃশ্য দেখে বেশ ভাবনায় পড়ে গেল কোহিনূর। রাগিনীর বিশেষ চমকটা কী সেটা বুঝে উঠতে পারল না। এবার ধৈর্যহারা লাগছে নিজেকে। শেষমেষ রাগিনীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আপনার সারপ্রাইজটা কি আজকের মধ্যে দেখতে পাব তো ম্যাডাম?”

রাস্তার দুপাশে ধানের ক্ষেত বিমোহিত হয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল রাগিনী। বেশিক্ষণ টিকলো না তার মুগ্ধতা। কোহিনূরের কথায় সোজা হয়ে বসে আঁড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিল,
“অবশ্যই আর বেশিক্ষণ নয়। সামনেই আপনার সারপ্রাইজ ওয়েট করছে।”

রাগিনীর কথাবার্তা আজ ঠিক সুবিধার মনে হচ্ছে না কোহিনূরের। মেয়েটা অদ্ভুত ভাবে কথা বলছে। তার প্রতিটা কথায় যেন সাসপেন্সে ভরা। কীসের দৌলতে ঠিক এত সাসপেন্স সেটা বুঝে উঠতে পারছে না কোহিনূর। গাড়ি থামতেই ভাবলেশহীন হয়ে সামনে তাকায় কোহিনূর। জায়গাটা ঠিক তার চেনা নেই। তবে রাগিনী গাড়ি থেকে নেমে কাউকে কল লাগালো প্রথমেই। কোহিনূরও তার দেখাদেখি নেমে দাঁড়াল বাহিরে। গ্রামের পরিবেশ মানেই এক অন্যরকম স্নিগ্ধতা। শীতল বাতাস মন অবধি ছুঁইয়ে দেয়। খোলা মাঠে ধানগুলো দেখে মনে হয় কোনো সবুজ রঙের দীঘি। রাস্তার দুইপ্রান্ত সারিতে লাগানো বড় ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর পাতা দুলছে। পাখিরা যেন সুর তুলে আওয়াজ করতে পারে এখানে। কোহিনূর প্রাণভরে একটা নিশ্বাস নিল। অতঃপর গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“সারপ্রাইজটা কিন্তু দারুণ। সো ন্যাচরাল। আই এম ইম্প্রেসড, রাগের রানী!”

গাড়ির ওপ্রান্ত দাঁড়িয়ে থাকা রাগিনী কানে ফোন ধরে একটা উদ্ভট হাসি দিল। যেন মনে হচ্ছে মেয়েটার এই হাসিতেও লুকিয়ে রয়েছে গভীর রহস্য। সেই রহস্য উদ্ঘাটন করার বহু চেষ্টা করেও সফল হলো না কোহিনূর। রাগিনী হাসিমুখেই বলল,
“এটা তো শুরু। আসল সারপ্রাইজ এখনো বাকি।”

কথাটা শেষ করেই ফোনে মনোযোগ দিল পুরোটাই। ফোনের ওপাশে কে কী বলল তা কোহিনূরের কান অবধি পৌঁছাল না। তবে তার উত্তরে রাগিনী যা বলল কান খাঁড়া করে শুনল সে।
“আপনি ঠিক কোথায়? হ্যাঁ, গাড়িটা আমারই। আপনি কোথায় বলুন? আশেপাশে…”

কথাগুলো সম্পূর্ণ করতে চেয়েও করতে পারল না রাগিনী। সম্পূর্ণ এক বাক্য হতে আটকালো তার হাঁচি। জোরে একটা হাঁচি দিতেই গোছানো চুলগুলো মুখের সামনে এসে পড়ল তার। আগের মতো একহাত দিয়ে চুল পেছনে দিতে ব্যর্থ হলো সে। বাতাস তাকে সফল হতে দিল না। হুরহুর করে বাতাস চোখেমুখে আরো চুল ছিটিয়ে দিতেই চুলের উপরই যেন রাগল সে। কিছুহাত দূরে দাঁড়িয়ে কোহিনূর তার এমন তুচ্ছ রাগের কারণে মিটমিটিয়ে হাসতে থাকল। তবে সে খেয়াল করছে রাগিনীও আসার পর থেকে বেশ কিছুবার হাঁচি দিয়েছে। মাঝে মাঝে নাক ঘষছে। চোখটাও কিছুটা ফুলে গিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। তাহলে তারও কি ঠান্ডা লেগেছে কোহিনূরের মতো? অবশ্য খারাপ কী? কথায় বলে না? হাম জিতে হায় তো একসাথ, মারতে হায় তো একসাথই। তাহলে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজে একসাথে ঠান্ডা লাগার লজিকটাও ভুল কিছু নয়। এসব উল্টোপাল্টা ভেবেই মাথা ঝাঁকাল কোহিনূর। তার চোখের উপর অন্য কেউ হাত ঝাঁকাতেই দৃষ্টি স্থির হয় তার। রাগিনী বলে,
“কোথায় হারিয়ে যান?”

কোহিনূর মৃদু হেঁসে সহজ উত্তরে বলে,
“আমার প্রেমিকার সঙ্গে এক ভালোবাসার সাগরে।”

সামান্য বাক্যটা শুনে শিরদাঁড়া ঠান্ডা হলো রাগিনী। এই প্রেমিকা নামক শব্দটি শুনলে মনের মাঝে মিশ্র অনুভূতি কাজ করে শুধু। পৃথিবীর অন্যসব ভাবনা বাদ দিয়ে কোহিনূরের বলা এই প্রেমিকা শব্দটির গবেষণা করতে মন চায়। কী এমন অমৃত লুকায়িত আছে এর মাঝে? নাকি এটা শুধু কোহিনূরের কন্ঠে শোনা বলে এতোটা শ্রুতিমধুর? কিছু নীরব থেকে রাগিনী নিচু সুরে বলে,
“এইযে সামনে ধানের মাঝে এই সরু রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন এখান দিয়ে আমাদের কিছুদূর হাঁটতে হবে।”

“কেন? আবার কোথায় যাব?”

“ভয় পাচ্ছেন বুঝি?”

“ভয় শব্দটা আমার ডিকশনারিতে নেই। যদি থেকে থাকে সেই ভয়টার নাম তুমিময় একটা ভয়। সেখানে নিজের ক্ষতি, আ’ঘাত পাবার ভয় নেই কোথাও! শুধু রয়েছে রাগিনী নামক মেয়েটিকে মাঝরাস্তায় হারিয়ে ফেলার ভয়।”

নিজেই তাজ্জব বনে গেল রাগিনী। গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইল। মানুষটা যে মাঝে মাঝে কী বলে সেটা বুঝতে সময় লেগে যায় বেশ। যদিও বুঝে ফেলে তখন উত্তর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ মস্তিষ্কে আসে না। মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ে। হৃদয় নিজ তাগিদে সরগম সৃষ্টি করে। কী বিশাল যন্ত্রণা!

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে রাস্তার নিচে সেই ধানের মাঝে সরু রাস্তায় নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে রাগিনী। বরাবরের মতোই রাগিনী পায়ে মাঝারি সাইজের উঁচু হিল পড়ে। আর বৃষ্টি হওয়ায় পুরো জায়গায়টা যে পিচ্ছিল ছিল সেটা ধারণাতে আসেনি তার। ফলস্বরূপ পা পিছলে যায়। রাগিনী ব্যালেন্স হারায়। এই বুঝি সব শেষ। অঘটন ঘটার অন্তিম পর্যায়ে রাগিনীর কোমড়ে এক প্রশস্ত এবং শক্ত হাতের স্পর্শ অন্যহাত রাগিনী হাতে আবদ্ধ হয়। মৃদু চিৎকার দিয়ে চোখমুখ খিঁচে নেয় পড়ে যাবার ভয়ে। ফিসফিসিয়ে বলা কথা এবার কানে বেজে ওঠে রাগিনীর।
“এই কোমলিনীর হাতটা যতক্ষণ আমার হাতে আবদ্ধ ততক্ষণ সে এই কোমলিনীকে পড়তে দেবে না।”

আস্তে করে তাকাল রাগিনী। তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রাখা ব্যক্তিটিকে দেখেই কেমন যেন হৃদয়ের তরঙ্গ নিজ ছন্দে মেতে ওঠে। মানুষটার স্পর্শ সে পেতে না চাইলেও পেলে এতোটা উতলা হয় কেন সে?

কাজের ফাঁকে একটু বিরতি নিয়েছেন রাশেদ সাহেব। শরীরটা যেন দিন যাচ্ছে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। আর আগের মতো একাধারে বসে পেশেন্টের সাথে কথা বলতে পারেন না। ক্লান্ত বোধ করেন। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে চশমাটা খুলে চোখ বুঁজে নীরবে বসে রয়েছেন। বুকটা হালকা হালকা ব্যথা করছে। গতকাল ঔষধ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। হতে পারে এটা তারই ফল। চিনচিন করছে বুকের ভেতরে। এই সময়ে ফোন বেজে ওঠায় খানিকটা বিরক্ত হন তিনি। ফোন ধরবেন না বলে ঠিক করলেও অনিচ্ছায় চোখ মেলে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেন বাড়ির ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন আসছে। এখান থেকে একমাত্র সৈয়দই ফোন করে। তাই দেরি না করে রিসিভ করলেন তিনি। আর গম্ভীর গলায় বললেন,
“হ্যালো, সৈয়দ! অসময়ে ফোন দিলে যে। কোনো সমস্যা?”

ওপাশ থেকে নরম সুর ভেসে এলো সৈয়দের।
“তেমন কোনো সমস্যা না স্যার। দুঃখিত এই সময় ফোন করার জন্য। কিন্তু কিছু জানার ছিল তাই বাধ্য হয়ে কল দিলাম। বলতেছিলাম, বাড়ির মেহমানদের জন্য কী কী খাবার হবে সেটা যদি বলে দিতেন। এনারা তো আবার সব কিছু খায় না। সকালে অভিরূপ বাবাকে তুলসি দিয়া চা করে দিছিলাম। খাইছে। দুপুরের জন্য কী করব?”

“রাগিনীর থেকে জেনে নিতে। রাগিনী তোমায় বলেনি?”

“রাগিনী মা তো বাড়িতে নাই, স্যার। সেজন্যই তো আপনারে কল দিলাম।”

এবার টনক নড়ে রাশেদ সাহেবের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান হয়ে জানতে চান,
“মানে? বাড়িতে অভিরূপ আর নোমান আছে। ওদের রেখে রাগিনী কই গিয়েছে? বাড়িতে কেউ না থাকলে তো সমস্যা।”

“টিফিনবক্সে খাবার নিয়া বাকি দিনগুলার মতো ওই পাগলটার কাছে গেছে আজকেও।”

মিনমিন করে জবাব দিলো সৈয়দ। রাশেদ সাহেবের বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। কেমন যেন হতাশ বোধ করছেন। শান্তভাবে বললেন,
“মাটন বিরিয়ানি কর, সাথে কষানো মাংস, ডাল আর আমরা বাঙালিদের যে যে খাবার দ্বারা আপ্যায়ন করি সেসবই করো। তবে মনে রাখবে ঝাল কম দেবে। অভিরূপ ঝাল খেতে পারে না। আর কিছু মিষ্টি জিনিস বানিয়ে রাখো। আমি রাখছি।”

বিলম্ব না করে কল কাটেন রাশেদ সাহেব। আরো একবার বড় শ্বাস ফেলে নিজের টেবিলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকান। মেয়েটা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। আগে তো এমন ছিল না। রাশেদ সাহেব তো একবার বলেই দিয়েছিলেন কোহিনূরের কাছে কম যাওয়া-আসা করতে। তবুও কি মেয়েটা কথাটাকে সেভাবে নেয়নি? উনার মেয়ে তো উনার কথা কখনো ফেলেন না। আজ শুধুমাত্র একটা পাগল ছেলের জন্য মেয়েটা এমন আচরণ করা শুরু করেছে? রাগিনীর ভরসাতেই তো অফিসে এসেছিলেন রাশেদ সাহেব। তিনি ভেবেছিলেন রাগিনী ওদিকে সব সামলে নিবেন। কিন্তু তার মেয়েটার এভাবে বোধবুদ্ধি লোপ পাবে ভাবতে পারছেন না। তবে কি ওই ছেলের প্রতি রাগিনীর কোনো অনুভূতি…?
আর ভাবতে পারলেন না রাশেদ সাহেব। এর বেশি ভাবতে চান না। বুকের ব্যথা কিছুটা তীব্র হলো। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন বার বার।

অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনেই একটা লম্বা সিঁড়ি আবিষ্কার করল কোহিনূর। সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে কাঠ দিয়ে বানানো একটা খোলা ঘরের মতো। নিজের হাতটা দিয়ে শক্ত করে রাগিনীর হাতটা ধরে রেখেছে সে। রাগিনী এবার সাবধানে হেঁটে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,
“এবার তো ছাড়ুন। আমি ঠিকঠাক হাঁটতে পারব।”

রাগিনীর কথা কানেই নিল না কোহিনূর। বরং হাতটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“কোনো রিস্ক নিতে পারব না। দেখা যাচ্ছে পড়ে টড়ে যাবে তারপর পা বা কোমড় ভাঙবে। আর এতোখানি রাস্তা আমাকে তোমায় মতো একটা সত্তর কেজি ওজনকে নিয়ে পাড়ি দিতে হবে হেঁটে। না না বাবা। আমি ওসবে নেই। সেফটি ফার্স্ট।”

“মোটেও আমি সত্তর কেজি ওজনের না। আপনার মতো মনে করেন নাকি আমাকে? মাত্র পয়তাল্লিশ কেজি ওজন আমার।”

রাগে ফুঁসে উঠে জবাব দেয় রাগিনী। নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতেই কোহিনূর বলে,
“তোমরা যে এই হিল পড়ে কী মজা পাও বুঝিনা।”

রাগিনী এবার কথায় পাত্তা না দিয়ে একটা ভেংচি কেটে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল একমনে। কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে কোহিনূরও পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। শেষ সিঁড়িতে পা রেখে সামনে সেই কাঠের ঘরের মাঝে সাইড ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা একটা চেনা ব্যক্তিকে দেখেই কম্পন ধরে গেল কোহিনূরের। সে কী ভুলভাল দেখছে? হঠাৎ এই ইডিয়ট কোত্থেকে আসবে? নিজের চোখটা ভালোমতো ডলে আবারও একই ব্যক্তি দেখে মাথাটা ঘুরে ওঠে কোহিনূরের। পা দুটো সেখানেই থেমে যায়। দৃঢ় শক্ত চাহনি দিয়ে যেন চোখ দিয়েই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, ‘ইডিয়ট মেহরাজ, এই ছিল তোমার মনে? তোমার ব্যবস্থা হচ্ছে।’

অন্যদিকে মেহরাজের করুণ দৃষ্টি। সে যেন বলতে চাইছে, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।’
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৫

“কী হলো দাঁড়িয়ে পড়লেন যে! আসুন।”

কোহিনূরের হাতে ঝাঁকুনি অনুভব করতেই তার শক্ত দৃষ্টি সরিয়ে থমথমে মুখে রাগিনের দিকে তাকাল। শেষ রক্ষা হলো না বোধহয়। কোহিনূর রাগিনীকে তার সম্পর্কে কিছু বলে উঠার আগেই রাগিনী হয়তো সব জেনে নিয়েছে। এই ভেবেই শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল তার। না চাইতেও নিজের শুকনো মুখটা কোনোরকমে লুকিয়ে বাকি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো। কোহিনূর যতই এগিয়ে গেল মুখচোখের রঙ পাল্টে ফ্যাকাশে হতে থাকল মেহরাজের। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কোহিনূরকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতেই রাগিনী মেহরাজের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আপনি মি. মেহরাজ?”

“হ্যাঁ। আমিই মেহরাজ। আমাকে দেখা হয়ে গিয়েছে ম্যাডাম তাহলে আমি যাই?”

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেই তড়িঘড়ি করে চলে যাওয়ার উদ্যেগ নিলো মেহরাজ। এ যেন জ্যান্ত বাঘের কবলে পড়েছে। একটা থাবা মা’রলে দেহ থেকে প্রাণ বেরিয়ে যাবে। তবে রাগিনী তাকে আটকে বলল,
“আরে, আশ্চর্য লোক তো আপনি। ফোনেও কীসব উল্টাপাল্টা বলছিলেন এখনো উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছেন। আমি কি আপনাকে দেখার জন্য ডেকেছি? আমি কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে এসেছি আপনার সঙ্গে উনার বিষয়ে।”

বলেই কোহিনূরের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিলো রাগিনী। মেহরাজ ঢক গিলে একবার কোহিনূরের দিকে তাকিয়েই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো। তারপর স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,
“আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। বসে কথা বলি?”

বলেই আগেই মেহরাজ তার পাশে থাকা চেয়ারটা বেশ বিনয়ের সঙ্গে এগিয়ে দিতেই খপ করে কোহিনূর কৌশলে মেহরাজের চেয়ারে রাখা হাতটা ধরে জোরে চাপ দিতেই আঁতকে উঠে চিৎকার দিতে গেলেও থামল সে। ঠোঁট চেপে কাঁদো কাঁদো হয়ে কোহিনূরের দিকে তাকালো। মানুষটা অন্যকে টাইট কী করে করতে হয় খুব ভালো করে জানে। অতঃপর নির্বিকার ভঙ্গিতে পায়ে পা তুলে বসল কোহিনূর। রাগিনীর দিকেও চেয়ার এগিয়ে দিতেই রাগিনী বসার পরে মেহরাজও ভয়ে ভয়ে বসল। ঠোঁট চেপে বিরবির করে নিজে নিজেকে বলল,
“বসার চেয়ে না বসাই বোধহয় ভালো ছিল। কখন কোথায় ছুট লাগাতে হয় কে জানে! শুধুমাত্র সিংহের গর্জনের অপেক্ষা!”

“কিছু বললেন?”

রাগিনীর প্রশ্নে হকচকিয়ে মেহরাজ উত্তর দেয়,
“না না। আমি আর কী বলব?”

“আপনি উনাকে নিশ্চয় চেনেন?”

রাগিনী এবার ইশারা করে কোহিনূরকে দেখিয়ে দিতেই মেহরাজ কেশে উঠে বলল,
“চিনব না আবার? ক্ষ্যাপা ষাঁড়… থুরি মানে ক্ষ্যাপা পেশেন্ট। আই মিন মেন্টাল পেশেন্ট? আগে তো প্রতিবেশি ছিল আমাদের। অসুস্থ হলো এ’ক্সিডেন্টের পরে তারপরেই তো আপনাদের হসপিটালে রেখে আসলাম!”

“হ্যাঁ সেখান থেকেই আপনার নম্বর পেয়েছি। উনি ঠিক কখন থেকে অসুস্থ বা আপনি কখন থেকে উনার মাঝে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন বলতে পারবেন?”

“আমি তো উনার সাথে কাজ করার পর থেকেই থুক্কু মানে উনার এ’ক্সিডেন্টের পর যখন সুস্থ হয়ে হসপিটাল থেকে ফিরলেন তারপরেই তো বুঝলাম।”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“উনার পাগলামি আচরণ! মাঝে মাঝেই তো একেবারে অ…অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলে। ওইতো ক্ষ্যাপা ষাঁড় বললাম না?”

আটকা আটকা গলায় কথাগুলো বলতে গিয়েই চেয়ারের হাতলে এক থাবা মে’রে বসল কোহিনূর। হকচকিয়ে উঠে কোহিনূরের পানে তাকালো রাগিনী আর মেহরাজ দুজনেই। ভয়ের চোটেই দাঁড়িয়ে গেল মেহরাজ। তোতলানো কন্ঠে বলল,
“দেখুন, দেখুন! এখনি যেভাবে তাকিয়ে আছে। পাগলকে পাগল বলেছি তাই তো ক্ষেপে গিয়েছে।”

কোহিনূরের পক্ষে এবার আর চুপচাপ থাকা সম্ভব হয় না। সে বেশ বুঝতে পারছে এই মেহরাজ সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। পেটে পেটে শয়তানি ভালোই জমে রয়েছে তার। হাত মুঠো করে দাঁড়াতেই দুই ধাপ পিছিয়ে যায় মেহরাজ। কোহিনূর দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,
“ইউ…”

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই মেহরাজের দিকে তেড়ে যেতেই মেহরাজকে আর পায় কে! সিঁড়ি সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে থাকায় ফট করেই সিঁড়ির কাছে গিয়ে জোর গলায় বলে,
“ওরে বাবারে! পাগল ক্ষেপেছে।”

ব্যাস! মেহরাজ রাগিনীর সব জেরা থেকে বাঁচার সুযোগ পেয়ে যায়। আর সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়? নাহ, একদম নাহ। সে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে লাগায় এক ছুট। রাগিনী চেয়েও থামাতে পারে না তাকে। পিছু ডাকে বেশ কয়েকবার। কোহিনূরও ইচ্ছাকৃতভাবে মেহরাজকে ধাওয়া করতে গেলেই রাগিনী গজরাতে গজরাতে বলে,
“থামুন, কোহিনূর? কী শুরু করেছেন?”

হাফ ছেড়ে বাঁচে কোহিনূর। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মেহরাজও যে তার কাজ এতো সহজে করে দেবে সে ভাবেনি। আপনমনে নীরবে আওড়ায়, ‘যাক স্টুপিড টার বুদ্ধির উন্নতি ঘটেছে। নির্জন আহমেদের সাথে কাজ করে বলে কথা! তাই গোবরের বদলে খানিকটা বুদ্ধির উদয় হয়েছে মনে হয়।’

ভাবনা থেকে ফিরে পিছু ফিরে তাকায় কোহিনূর। বড় শ্বাস নিয়ে রাগিনীর কথার জবাবে বলে,
“দেখলে না ও আমাকে কীভাবে কন্টিনিউয়াসলি পাগল বলে যাচ্ছে? আমি পাগল? আমাকে দেখে পাগল মনে হয়?”

রাগিনীর মেজাজ চড়ে গিয়েছে। সে ভাবেও নি এমন কান্ড ঘটবে। তবে মেহরাজের বেশ কিছু কথা তার মস্তিষ্কে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে। সাইকোলজি পড়ে এতটুকু যে বোঝার ক্ষমতা রাখে কে কেমন মানুষ সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির কথাবার্তা দেখে। রাগিনী বুঝেছে মেহরাজ নামক ব্যক্তিটির একটা সমস্যা হচ্ছে কথা চেপে রাখতে না পারা। কিছু মানুষ আছে যাদের পেটে কোনোরকম কথাই থাকে না। এসব মানুষকে নিজের সিক্রেট বলা বিপদজনক। মেহরাজও ঠিক সেরকমই একটা মানুষ। তবে তার সঙ্গে আরো একটু ডিসকাস করতে পারলে হয়ত ভালো হতো। তা আর হলো কই? রাগিনী অনেকটা ভেবে বলল,
“আপনিই তো একদিন আমায় বলেছিলেন আপনি পাগল? তাহলে কেন রাগছেন উনার কথায়?”

“ওই পাগল আর এই পাগল তো এক নয়, রাগের রানী। কারোর আসক্তিতে আসক্ত হওয়া পাগল আমি। কারোর নেশায় উন্মাদনা হওয়া পাগল আমি।”

রাগিনী মূহুর্তেই মিইয়ে গেল। চোখমুখে যেন ঝলক লেগে মুখ নিচু করে নিলো। অথচ এই লজ্জা, এই সংকোচের কোনো কারণ নেই। কারণ বিহীন লজ্জা কেন আসে? কে জানে! আবারও উৎসাহিত হয়ে কোহিনূর বলল,
“আকাশটায় আবার মেঘ করেছে। এবার বৃষ্টি আসলে মনে হয় না থামবে বলে।”

রাগিনী একবার কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কোহিনূরের দিকে। তারপর জোর বেগে হাঁটা ধরল। কোহিনূরের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে জোরে জোরে নেমে গেল। কোহিনূর বুঝল রাগিনীর রাগের কারণ। মেয়েটা চেয়েছিল মেহরাজের সঙ্গে ডিটেইলি কথা বলতে। কিন্তু তা তো কোহিনূর হতে দেয়নি এবং হতে দেবেও না।

বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে আগে আগে হাঁটছে রাগিনী। গ্রামের কাঁদামাখা পথে রাগিনীর হাঁটতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তার হিল জুতো বসে যাচ্ছে। তবুও থামছে না সে। পেছন পেছন হেঁটে রাগিনীর সাথ ধরতে পারছে না কোহিনূর। এটা মেয়ে নাকি ধানিলঙ্কা কে জানে! একবার চটলে একদম ভেতরের ঝালগুলো বেরিয়ে শ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার উপক্রম করে দেয়। হাঁটার গতি ধীরে করে কোহিনূর বলে,
“আরে ওয়েট, ওয়েট! অলিম্পিক রেসের প্রস্তুতি নিচ্ছো নাকি তুমি? একটু তো দাঁড়াও। এবার পড়ে যাবে সত্যি!”

সামনে হাঁটা রাগিনীর মুখ থেকে কোনো জবাব এলো না। সে আপনমনে হেঁটেই চলেছে। যেন মৌনব্রত পালন করছে সে। কোহিনূর তার জবাব না পেয়ে আবারও জোর গলায় বলে,
“রাগিনী! এবার পড়ে গেলে কিন্তু আমি ধরতে পারব না। অন্তত একটু ধীর হাঁটো। যাতে পড়ে যেতে নিলে আমি ধরতে পারি।”

“আপনি যা বলবেন সব মানতে হবে নাকি? আমার যেভাবে ইচ্ছা আমি সেভাবে হাঁটব। আপনি…”

রাগিনী দিয়ে ফেলল হাঁচি জোরে। কোহিনূর হাসতে গিয়েও তারও হাঁচি পড়ল। দিনটা যেন হাঁচিময়! হাঁচি শেষে আবারও হাঁটতে আরম্ভ করল রাগিনী। হতাশ মনে কোহিনূরও পিছু নিলো তার। হাঁটার মাঝে বিরবির করে রাগিনী বলল,
“একে আমার প্ল্যান নষ্ট করে এখন দরদ দেখাচ্ছে। উনাকে নিয়ে আসাই উচিত হয়নি। যদিও উনাদের দুজনের মানে মি. মেহরাজ আর কোহিনূরের দেখা হওয়ার পর রিয়েকশনটা অদ্ভুত ছিল। দুজনে যেন চোখে চোখে কথা বলছিল। এটা আমার চোখ এড়ায়নি।”

“এই ভোমরা!”

কোহিনূরের হঠাৎ এমন চিৎকারে হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। ভোমরার কথা শুনে লাফিয়ে উঠতেই নিজেকে সামলানো আর সম্ভব হয় না। ওড়নাটা তার পায়ের জুতোর নিচে পড়তেই অবস্থা বেগতিক হয়। চিত হয়ে সোজা পড়ে একেবারে সবুজ ধানের ক্ষেতে। এবার আর কোহিনূরের পক্ষে ধরা সম্ভব হয় না তাকে। তাকে ধরতে গিয়ে নিজেই হতভম্ব হয়ে যায় কোহিনূর। চিত হয়ে ধানের ক্ষেতে পড়ে চোখমুখ থেকে শুরু করে জামাকাপড়ে যেন রাজ্যের সকল কাঁদা আশ্রয় নিয়েছে। চোখমুখ খিঁচে কাঁদো কাঁদো করে রেখেছে রাগিনী তার মুখশ্রী। কাঁদার ঠান্ডা যেন শিরশির করে শরীরে ঠেকছে। এই অবস্থাতেই সে বলল,
“ভোমরা? কোথায় ভোমরা?”

কোহিনূর আশেপাশে তাকাল। না জানার ভান করে বলল,
“কীসের ভোমরা? কই ভোমরা?”

“আপনি যে এখনি বললেন ভোমরার কথা? চিৎকার দিয়ে উঠলেন?”

এবার কোহিনূরের ঠোঁট কামড়ে হাসি দেখে চোখ দুটো সরু হয়ে আসে রাগিনীর। বেশ বুঝতে পারছে কোহিনূর মিথ্যে বলেছে। এবার তার ইচ্ছে করছে লোকটার মাথা ফা’টিয়ে দিতে। হাতে কিছুটা ব্যথাও পেয়েছে সে। দাঁত কিড়মিড় করে রাগিনী বলল,
“আপনি মিথ্যে বললেন কেন? আপনাকে আমি…”

“ভালোবাসবে?”

রাগিনীর দিকে খানিকটা ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করেই বসল কোহিনূর। তার দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকানোর শক্তি না পেয়ে রাগিনী নিচে তাকিয়ে বলল,
“মে’রে দেব আপনাকে। বাজে লোক। মিথ্যে বলে শুধু!”

“আমি মিথ্যে কখন বললাম? সত্যিই তো ভোমরা ছিল। আমার প্রাণভোমরা যেটা নিয়ে তুমি গড়গড় করে হেঁটে চলে যাচ্ছিলে!”

রাগিনীর রাগ যেন গরমে আইসক্রিমের ন্যায় নিমিষে গলে গেল। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মানুষটার কথায় কী এমন আছে যা মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়? ভাবনায় অন্ত ঘটালো দূর থেকে ভেসে আসা এক চিৎকার। হতবিহ্বল নয়নে ক্ষেতের ওপারে চাইল রাগিনী। একটা লোক হাত উঁচিয়ে ছুটে আসছে। কিছুক্ষণ ভাবতেই মনে হলো এই ক্ষেতটা ওই লোকের। আর রাগিনী নিজে সেই ক্ষেতের মাঝে পড়ে অনেকটা ধানের গাছ নষ্ট করে দিয়েছে। বুঝতে সময় লাগল না তার খবর খারাপ আছে। আবার লা’ঠিপে’টা করবে না তো? কী ভয়ানক ব্যাপার স্যাপার! কোহিনূর সেই কৃষকের ছুটে আসা দেখেই ভয়ে লাফিয়ে বলল,
“যদি বাঁচতে চাও তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। পালাতে হবে এখনি। নয়ত নিস্তার নেই।”

কোহিনূর এবার বিলম্ব না করে রাগিনীর হাতটা শক্ত করে ধরে টেনেই তুলল রাগিনীকে। নিজের কাঁদা মাখা গা ঝাড়তে চেয়েও পারল না সে। কোহিনূর হাত ধরে টান দিয়ে লাগায় এক দৌড়। রাগিনীর তাল মিলিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেও মাঝপথে থামে সে। হাঁপিয়ে উঠে বলে,
“দাঁড়ান! এই হিল পায়ে দৌড়ানো যায় নাকি? একটু ওয়েট করুন আমি জুতো খুলে নিই।”

“তোমার জুতো খোলার চক্করে দুজনের হাল খারাপ না হয়ে যায়! ফাস্ট ফাস্ট!”

জুতো খুলতে খুলতেই মেঘ ফুঁড়ে যেন ভুবনকে আরো শীতলতম করতে ধেয়ে নেমে এলো বৃষ্টি। তাও ধীরে নয় ঝুমঝুম করে। মূহুর্তেই রাগিনীর মাথার উপর দুহাত তুলে রাগিনীকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে তবুও বৃষ্টির ফোঁটা একের পর এক ছুঁয়ে যায় রাগিনীকে। জুতো খুলে হাতে নিয়েই অবাক পানে কোহিনূরের দুটো হাতের দিকে তাকায় রাগিনী। মানুষটাকে যতই দেখে বিস্ময়ের অন্তিম যেন ঘটতে চায় না। নিজে ভিজে চুপসে যাচ্ছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। অথচ হাত দিয়ে কোনো কাজ হবেনা জেনেও মানুষটা কীভাবে আগলে ধরার চেষ্টা করছে! এজন্যই বোধহয় রাগিনীর মনের আস্তাকুঁড়েই পড়ে থাকে সন্দেহগুলো। সেগুলোকে উদ্ধার করা হয় না। আর মনের রাজপ্রাসাদে রাজার হালে বসে থাকে কোহিনূর নামক ব্যক্তিটির যত্ন এবং অব্যক্ত অনুভূতি। আচমকা হাতে হেঁচকা টান অনুভব করল রাগিনী। খেয়াল করে সেও কোহিনূরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। মুখের কোনে ফুটে উঠল আপনাআপনি এক হাসির রেখা। না চাইতেও মন খুলে আনন্দে চিৎকার করতে মন চাইছে এই বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে তার হাত ধরে রাখা মানুষটিকে নিয়ে। অনুভূতিগুলো যেন মনে কী সুন্দর খেলা শুরু করে দিয়েছে! উল্লাসেই যেন আর দ্রুত ছুটতে শুরু করে রাগিনী। রাগিনীর এমন বেগে কোহিনূর হতভম্ব! তবুও মুখ ফুটে কিছু বলা হয়ে উঠেনা তখন।

ক্ষেতের রাস্তা পেরিয়েই দেখা মিলল একটা খোলা মাঠের। পেছন পেছন আর ওই কৃষককে দেখা যাচ্ছে না। রাগিনী দৌড়ানোর মাঝে বেশ কয়েকবার থেমে হাঁচি দিয়েছে। আবারও কেশেছে। কোহিনূরের মনে হলো মেয়েটার বৃষ্টিতে ভেজা আর ঠিক হবে না। এই মাঠ পেরিয়ে আরো একটা ক্ষেত পেরিয়ে তবেই মেইন রাস্তা। এতোদূর যেতে যেতে রাগিনীর অবস্থা আরো বেগতিক হলেও হতে পারে! অন্তত কিছুক্ষণ থামা প্রয়োজন। আশেপাশে চেয়ে একটা ঠেলাগাড়ি নজরে পড়ল কোহিনূরের। ঠেলাগাড়ির উপর রাখা নীল রঙের মোটা প্লাস্টিকের পলিথিনও ভিজছে একাধারে। দেরি না করে রাগিনীকে নিয়ে ঠেলাগাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল সে। ঠেলাগাড়ির উপুড় হয়ে থাকা প্রান্তে ভালো করে পলিথিনটা উপরে দিয়ে দিল সে। অতঃপর নিচু হয়ে ঢুকে গেল ঠেলাগাড়ির ঠিক নিচে। ভেতরে ঢুকেই মাথা বের করে দেখল রাগিনী উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে। কোহিনূর রাগিনী না বলা প্রশ্নের জবাব দিয়ে বলল,
“আর কতটা দৌড়াব? একটু রেস্ট নিই এসো।”

দেরি না করেই রাগিনীর হাত টেনে তাকেও নিজের কাছে বসিয়ে দিল কোহিনূর। এবার সব পানি পলিথিনের উপরেই পড়ছে। কেমন যেন শব্দ করে উঠছে পলিথিনের গায়ে পড়লে। ঝুম বৃষ্টিতে আকাশ দেখাচ্ছে বিজলির খেলা। আসলেই ভালো লাগছে এবার। খানিকটা ঠান্ডা লাগলেও পাশ ঘেঁষে হাঁটু উঁচু করে থাকা সেই মানবটির উষ্ণতা যেন এসব ঠান্ডার কাছে তুচ্ছ। রাগিনীর শরীর ও মন জুড়ে বয়ে যায় প্রশান্তির বাতাস। অপলক দৃষ্টিতে উৎসুক হয়ে দেখতে থাকে প্রকৃতির এই খেলা। আর কী চাই? সুন্দর প্রকৃতি, ছোট্ট একটা জায়গা, পাশ ঘেঁষে বসে থাকা প্রিয় মানুষ! আসলেই কি প্রিয় মানুষ? নাহলে আবার কী? জানা নেই রাগিনীর। মনে চলতে থাকা জটিল এই প্রশ্নের সমাধান করতে করতে মাথাটা নুইয়ে পড়ল কোহিনূরের কাঁধে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কোহিনূর। খুব ইচ্ছে করে রাগিনীর মাথায় একটু চুমু খেতে। তবে ইচ্ছেটাকে চাপা দিয়ে বড় শ্বাস নিয়ে প্রশান্তির এক শ্বাস নেয় সে। মনে মনে বলে, ‘এবার যে করেই হক তোমায় আমার বিষয়ে সব জানাব। দরকার হলে না হয় কঠিন কোনো শাস্তি দিও। তবুও নিজের করে যত্নে সাজিয়ে রাখব তোমায়।’

আজ কাজ সেরে সন্ধ্যার মধ্যে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে পেরেছে রায়ান। ঘরে ঢুকেই দ্রুত ফ্রেশ হয়ে নিল সে। মায়ের সাথে অনেকদিন কথা হয় না। মাকে ভয়ানক ভাবে মিস করছে। বিশেষ করে তার মায়ের হাতের রান্নাগুলো। দৈনিক সার্ভেন্টের হাতে রান্না খেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। দিনশেষে কাজ সেরে বাড়িতে এসে মায়ের সঙ্গে দু’দণ্ড কথা বলার মুহূর্তগুলো মিস করে সে। তবে ভিডিও কলে মাকে দেখে কিছু কথা বলা ছাড়া যে আর কোন কিছুই করার নেই। রায়ানের মা মিসেস. রমিলার মারন ব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়েছে। উন্নত মানের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর অবস্থান করছেন। মিসেস. রমিলা খুব করে চেয়েছিলেন ছেলেকেও নিজের সাথে নিয়ে যেতে। কিন্তু ছেলে যে নিজের আদর্শ ভোলে না। তার জীবনে ঘটে যাওয়া বাবাকে নিয়ে ঘটনা তাকে আরও বেশি আদর্শবান করে তোলে। সে চায় না নিজের বাবার মতো একটা খারাপ পুলিশ অফিসার হতে। রায়ান শান্তশিষ্ট হলেও ভীষণ জেদি ছেলে। একবার যা ভাববে তা করবেই। তাই তার মাও তাকে জোর জবরদস্তি করেন নি।

ডিভানে বসে গলায় টাওয়াল জড়িয়েই মাকে ভিডিও কল লাগায় রায়ান। অতঃপর কিছুক্ষণের মাঝেই ফোন কল রিসিভ হলো। ভিডিও কলে দেখা গেল একজন শ্যামল মায়াবী অর্ধবয়স্ক মহিলাকে। উনার মুখ চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে ছেলেকে দেখে কতটা খুশি। রায়ান মনোযোগ দিয়ে এক পলক মায়ের দিকে চেয়ে থাকল। তার মায়ের চুলগুলো কেমন যেন পাতলা হয়ে গিয়েছে। মুখশ্রীতে স্পষ্ট একটা দুর্বলতা ধরা দেয়। মায়ের কণ্ঠে চকিতে তাকায় রায়ান।
“হেই বিজি ম্যান! অবশেষে ব্যস্ততা কাটলো তবে? মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় হলো?”

“পিঞ্চ করছো আমাকে?”

“আরে ধুর! ইন্সপেক্টর রায়ানকে পিঞ্চ করবে তাও সাধারণ রমিলা? এত সাহস আছে নাকি তার?”

রায়ান গালে হাত দিয়ে বসে বসে মায়ের বলা কথা শুনছে। অতঃপর নীরবতা ভাঙ্গে রায়ানের। স্মিত হেঁসে জবাব দেয়,
“আছে তো একজনের সাহস। রায়ানের গর্ভধারিনী মায়ের।”

মিসেস. রমিলা মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। ছেলেটার সকলকে মুগ্ধ করার অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বলেন,
“তারপর বলো, ওখানকার কী‌ অবস্থা? সব ঠিকঠাক তো?”

“আর ঠিকঠাক! দেশে যা হচ্ছে তা শুনলে যে কারোর গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাবে। কিছুই ঠিক নেই।”

“তুমি কি টে’রোরি’স্ট হাম’লার কথা বলছো?”

রায়ান মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। রমিলা চিন্তিত সুরে উত্তর দিলেন,
“আমিও আর্টিকেল আর নিউজে বেশ কিছু খবর পড়েছি। শুনলাম অভিরূপ চৌধুরী গিয়েছে। তাকে নিয়েও তো রাজ্যের বিপদ।”

“সে আর বলতে? কিছু মানুষ আপনা আপনি বিপদের দিকে ধেয়ে আসে। আমার মনে হয় এই অভিরূপ চৌধুরী ঠিক সেরকমই মানুষ। আমি যদি প্ল্যানিং করে ভুল গাড়ির ইনফরমেশন না দিতাম তাহলে নিশ্চিত সব শেষ হয়ে যেত।”

“এসব করতে গিয়ে তো নিজেকেও প্রায় শে’ষ করে দিচ্ছিলে। নিজের একটু খেয়াল রাখো। তুমি কখনো ভাবো না তাই না যে তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হবে!”

রায়ান খানিকক্ষণের জন্য চোখ বুঁজে নেয়। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলে এই এক সমস্যা‌। কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে পড়ে। রায়ান কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়,
“মা প্লিজ স্টপ। কিছু তো হয়নি আমার। লুক, আমি একেবারে ফিট আছি। অফিসার নির্জন তো বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন সেদিন আমায়।”

“হ্যাঁ, একমাত্র নির্জনের থেকেই আমি তোমায় একা রেখে আসার ভরসা পাই। ছেলেটা সঠিক সময় সঠিক জায়গায় উপস্থিত হতে পারে। আর অফিসার অফিসার কি বলছো? এমন হাবভাব করছ যেন তোমার সঙ্গে ওর শুধু কাজের সূত্রের সম্পর্ক।”

রায়ানের মুখে ধরা দেয় মলিনতা। তারও যে নির্জনকে অফিসার বলে সম্বোধন করতে ভালো লাগে সেটাও না। কিন্তু নিজের মাঝে যে জড়তা বাসা বেঁধেছে সেটাও তো কাটিয়ে ওঠার মতো নয়। রায়ান মলিন গলায় বলল,
“তুমি যাকে ভরসা করে আমায় এখানে রেখে গিয়েছো তার সঙ্গে দুই দন্ড সামনাসামনি হলেই রেষারেষি লেগে যায়। পারলে যেন আমাকে চিরদিনের মতো নিজের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে ফেলে। সেই সম্পর্কটা ছোটবেলার মতো নেই মা।”

রমিলা হালকা হেসে বলেন,
“তুমি তাকে এখনো চিনতে পারোনি। সে অন্যদের মতো দেখিয়ে দেখিয়ে কেয়ার করে না মানুষের। সে মানুষকে লুকিয়ে ভালবাসতে পছন্দ করে। যদি সে তোমাকে চিরদিনের মতো তার সামনে থেকে সরিয়ে দিতে চাইতো তাহলে সেদিন তোমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতো না। তুমি অসুস্থ বলে সে সব ছেড়ে এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছিল। তুমি তো আমাকে এটাও বলেছ যে মাঝরাতে হসপিটালে সে তোমার খবর নিতে আসতো। ছোটবেলার বন্ধুত্বের টান এতো সহজে ছিঁড়ে যাওয়ার নয়।”

“আমি জানি তুমি আমার ঠিক যতটা কেয়ার করো ততটাই নির্জনের কেয়ার করো।”

“বাধ্য হয়ে এক প্রকার কেয়ার করি। তার মাঝে এমন কিছু আছে যা কোনো মানুষকেই মুখ ফিরিয়ে রাখতে দেবে না। সে যেখানে অবস্থান করে সেই জায়গাটা মাতিয়ে রাখে। এমনই হচ্ছে নির্জন আহমেদ কোহিনূর।”

রায়ানের মুখে আপনা আপনি মুগ্ধ হয়ে যাওয়া হাসি চলে আসে। সে জানে না মুগ্ধ হওয়ার কারণ। জানার ইচ্ছেও নেই। রমিলা আবারও বলে ওঠেন,
“নিজের খেয়াল রাখার সাথে সাথে নির্জনেরও খেয়াল রাখবে। তার যেকোনো সমস্যায় তোমাকে আমি তার পাশে দেখতে চাই।”

রায়ান বাধ্য ছেলের মতো মাথা ঝাঁকায়। আরো অনেক কথা হয় মা আর ছেলের মধ্যে।

পরদিন সকাল সকাল ট্রেনিং রুমে এসেছে নির্জন। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই এখানে হঠাৎ করে উপস্থিত হয় সে। এখন সেখানে কেউ নেই। ফোন দিয়ে ডাক পাঠিয়েছে মেহরাজকেও। টেবিলে থাকা রি’ভলবার হাতে তুলে নিয়ে সামনে থাকা গোল করা নিশানাগুলোর দিকে তাকাল সে। টার্গেট নিয়ে একচোখ বন্ধ করে একধারে কয়েকবার ট্রিগার চাপলো। রি’ভলবার থেকে বে’র হওয়া বুলে’ট গিয়ে সরাসরি একেবারে নির্দিষ্ট নিশানায় লাগতেই বাঁকা হাসলো নির্জন। দরজা ঠেলে কেউ কাঁপা পায়ে ভেতরে ঢুকল। নির্জনের ভাবান্তর হলো না। সে নিজের কাজে ব্যস্ত। মেহরাজের কন্ঠ কাঁপছে। গতকাল সে যা যা বলেছে সেসব মাথায় এলেই তওবা কাটছে। নির্জনের ভ্রুক্ষেপ নেই দেখে সে অবশেষে বলেই ফেলল,
“স…স্যার!”

নির্জন নিজের হাতের রিভ’লবার রেখে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিয়ে বলে,
“ওয়েলকাম মি. মেহরাজ! ওয়েলকাম।”

“আই এম সরি স্যার। আই এম রিয়েলি সরি।”

“কীসের সরি?”

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল নির্জন। টেবিলের উপর বসে দুটো অ্যাপেল পড়ে থাকা দেখে একটা হাতে নিয়ে কামড়ে খেতে লাগল। মেহরাজ ঢক গিলে জবাবে বলল,
“কালকের জন্য। ওইসব ক্ষ্যাপা ষাঁড়, পাগল আরো…”

“আমি তো ওসব মনেই রাখিনি তুমি কেন মনে রেখে দিয়েছো?”

মেহরাজের মুখে রাজ্যের হাসির ঝিলিক চলে আসে। আবেগে আপ্লুত হয়ে বলে,
“সত্যি স্যার? আমি জানতাম আপনি অনেক দয়ালু।”

নির্জন আবারও হাসে। অ্যাপেলে দ্বিতীয় কামড় দিয়ে বলে,
“অ্যাপেল খাবে?”

“না স্যার। বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করে এসেছি।”

তবুও মানে না নির্জন। পাশে থাকা আরেকটা অ্যাপেল হাতে নিয়ে ছুঁড়ে দিল মেহরাজের দিকে। তৎক্ষনাৎ মেহরাজ ক্যাচ করল সেটা। নির্জন নেমে দাঁড়াল। নিজের কোটের গলা ঠিকঠাক করে রি’ভলবার হাতে নিলো। অতঃপর বলল,
“গুড ক্যাচ! এখন ভদ্রভাবে অ্যাপেলটা মাথায় রেখে আমার সামনে দাঁড়াও।”

মূহুর্তেই হাসিটা গায়েব হলো মেহরাজের। মুখটা জড়িয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
“আই এম সরি তো স্যার।”

“জাস্ট সরি? ওকে দেন, আমিও তোমার মাথায় একটা একটা করে বু’লেট ঢুকিয়ে দিয়ে বলব, আই এম সরি মেহরাজ। ওকে?”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৬

“আমি ক্ষ্যাপা ষাঁড়? আমি পাগল?”

“না স্যার একদম না। আপনি কেন পাগল হতে যাবেন? এতো বুদ্ধিমান মানুষ আপনি। আর ক্ষ্যাপা ষাঁড় বলে তো আমি আপনার প্রশংসা করেছিলাম। আই মিন, সবাই আপনাকে দেখে ভয় পায়। তটস্থ থাকে। তাই জন্যই তো ওই কথা বলছিলাম। স্যার আমাকে দিয়ে প্লিজ এই ডে’ঞ্জারাস কাজ করাবেন না। যদি একটুখানি এদিক থেকে ওদিক হয়ে যায় আমাকে প্রা’ণ বেরিয়ে যাবে।”

নির্জন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজের রিভ’লবা’র তাক করে মেহরাজের দিকে। আর ব্যস্ত সুরে জবাব দেয়,
“কেন মেহরাজ? আমার টার্গেটের উপর ভরসা নেই তোমার?”

“টার্গেটের উপর তো ভরসা আছে একশো পার্সেন্ট। কিন্তু আপনার উপরে ভরসা একদম জিরো পার্সেন্ট। কখন অ্যাপেলকে টার্গেট করতে গিয়ে মন বদলে যাবে আর টার্গেট আমি হয়ে যাব তার তো ঠিক নেই।”

“কিছু বললে, মেহরাজ?”

ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁটে সুক্ষ্ম হাসি দিয়ে এক চোখ বন্ধ করে নির্জন। রি’ভলবা’র মেহরাজের মাথায় থাকা অ্যাপেলের দিকে তাক করতেই মনে মনে দরুদ পড়া শুরু করে দিল মেহরাজ। টেনশনের চটে কপাল ঘেমে গিয়েছে একেবারে। কাঁপা কাঁপা সুরে জবাব দিল,
“আমি আর কী বলব স্যার। আমার মুখ মনে হয় আজ আজীবনের মতো বন্ধ…”

বিকট শব্দ হলো। মেহরাজ মুখের কথা আর পুরোটা শেষ করতে পারল না। বুঝতে পারল বু’লে’ট অলরেডি রি’ভল’বার থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। সে কি ম’রে গিয়েছে? চোখ খুললে কি সব অন্ধকার দেখবে? বন্ধ করে থাকা চোখ কি খোলা উচিত? নির্জনের গম্ভীর কন্ঠ কানে আসে এবার।
“মেহরাজ! ইউ আর স্টিল অ্যালাইভ।”

মেহরাজ এবার উচ্ছ্বাসের সাথে চোখটা খুলে প্রশান্তির শ্বাস ফেলে নেয়। অ্যাপেলটা নিচে পড়ে আছে। মেহরাজ খুশিতে উৎফুল্লতার সাথে বলে,
“থ্যাংক ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ।”

“থ্যাংকস্ দেওয়ার কিছুই নেই। পরেরবার উল্টাপাল্টা বকলে আমার রি’ভলবা’রের সব বু’লেট তোমার মাথার মধ্যেই যাবে।”

“ভুলেও না স্যার। এবার জোর করলেও এই চরম সত্যি কথাগুলো কেউ কথা বের করতে পারবে না। আই প্রমিস।”

মেহরাজ এমন কথায় আবারও চোখ গরম করে তাকাল নির্জন। সঙ্গে সঙ্গে ঢক গিলে নিলো মেহরাজ। নির্জন টেবিলের উপর আয়েশের সঙ্গে বসে বলল,
“তারপর? ওইদিকের কী অবস্থা? মি. শাহ্ রাশেদ সাহেবের সম্পর্কে কী কী জানতে পারলে?”

মেহরাজ বেশ ভাবুক হয়ে উত্তরে বলল,
“উনার সম্পর্কে সন্দেহজনক কিছুই পাইনি। রাগিনী তাজরীন ম্যাডাম যেই হসপিটালে হয়েছিলেন সেখানে খোঁজ নেওয়া হয়েছে। ফাইলস্ চেক করা হয়েছে। কিন্তু টুইন বেবির নামগন্ধও পাইনি আমরা। একটাই বেবি হয়েছিল সেটা হচ্ছে রাগিনী ম্যাডাম।”

“আর ইউ সিউর? এটা কীভাবে হয়? কথায় বলে, পৃথিবীতে একই চেহারার সাতজন মানুষ এক্সিস্ট করে। কিন্তু বিষয়টা এতোটাও নয়। এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে রাগিনীর মতো আরেকজনও আছে। হতে পারে এটা প্রি-প্ল্যানড রাগিনীকে ফাঁসিয়ে নিজের পরিকল্পনা সফল করার। রাগিনীর মতো দেখতে মেয়েটা নিজেও চাইছে নিজের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাগিনী নামে কার্যসিদ্ধি করতে। যদি সেটা না হয় তাহলে চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনে দুটো রাগিনী তাজরীন নামে টিকিট কাটা হতো না। নিশ্চিত এটাও প্ল্যান করেই করা।”

“তাহলে এখন উপায় কী স্যার? কীভাবে ওই মেয়েটাকে ধরব আমরা?”

“সেটা জানি না মেহরাজ। কিন্তু মেয়েটা যতই রাগিনী সাজার চেষ্টা করুক। যতই রাগিনীর চেহারা নিয়ে ঘুরে বেরাক কিন্তু আমি আসল আর নকল এক মূহুর্তে ধরে ফেলতে পারব। অভিরূপ চৌধুরী এখন কোথায় আছে?”

মেহরাজ হতভম্ব হয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
“ওহ হো স্যার একটা কথা ভুলে গিয়েছি। অভিরূপ চৌধুরীর বাবার সঙ্গে রাগিনীর বাবার বেশ খাতির ছিল। সেকারণে শুনেছি এখন অভিরূপ রাগিনীদের বাড়িতে আছে। আই থিংক ওটা সেফ জায়গায় তার জন্য।”

কিছুক্ষণ নীরব রইল নির্জন। দৃষ্টি স্থির করে নিয়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর জবান খুলে বলল,
“আই ডোন্ট থিংক সো। আমার তো মনে হয় রাগিনীকে যেহেতু এতো চালাকির সাথে ফাঁসানো হচ্ছে সেহেতু ওই বাড়িতেই এমন কেউ আছে যে কিনা রাগিনীর নজর রাখতে পারে। আর সেই ইনফরমেশন সেই মেইন টিমকে জানানো হয়। তাই এটা ধরে নেওয়া যায় না যে রাগিনীর বাড়িটা সেফ।”

“তাহলে কি এখন রাগিনীর বাড়িতে সবার ফোন নম্বর ট্র্যাক করব স্যার?”

প্রশ্নটা করে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মেহরাজ। নির্জন মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না। সেট করে আদেও কোনো লাভ আছে বলে আমার মনে হয় না। যে কাজটা করছে সে নিশ্চয় তার আসল সিমকার্ড দিয়ে ইনফরমেশন দেবে না। আর একটা কথা, আমার মনে হয় সময় হয়ে গিয়েছে এবার সরাসরি মি. শাহ্ রাশেদকে জেরা করার। এবার যা শুনতে হবে উনার মুখ থেকে শুনতে হবে। তাছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

“তাহলে কি উনাকে ডাকার ব্যবস্থা করব?”

“হুমম করে ফেলো। আর দেরি করা ঠিক হবে না। সময় যত যাবে ততই মানুষের প্রা’ণনাশের আশঙ্কা বাড়বে। বাট আমি তো সরাসরি কথা বলতে পারব না।”

মেহরাজ হতাশ মুখে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে থাকে।
“তা…তাহলে…”

“তাহলে আমি আপনাকে হেল্প করতে পারি, অফিসার নির্জন।”

মেহরাজের কথা কে যেন ছিনিয়ে নিলো। সে নির্জন নয়। ঘরে প্রবেশ করল ইন্সপেক্টর রায়ান। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে অপেক্ষা করল নির্জনের প্রতিত্তোরের। নির্জন রায়ানকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও পরক্ষণেই ধাতস্থ করে রায়ানকে খানিকটা পর্যবেক্ষণ করে নিল। তারপর মুখ ফিরিয়ে বলল,
“হোয়াট অ্যা প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ। ইন্সপেক্টর রায়ান যে। মেহরাজ, কি দেখছো চেয়ে? যাও যাও চা, কফি যা পারো নিয়ে এসো।”

“থাক। তার দরকার নেই। আমি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি। চা খেয়েই বাড়ি থেকে বের হয়েছি। আমি শুধু আপনার মতামত জানতে চাইছি। আপনার হেল্প করার সুযোগ দেবেন তো?”

নির্জন হেঁসে বলে,
“হঠাৎ আমার হেল্প করার জন্য আপনার মন উতলা হয়ে উঠল কেন?”

রায়ান ভাবলেশহীন হয়ে উত্তরে বলল,
“গিভ অ্যান্ড টেক! আপনি আমাকে হেল্প করেছেন সেদিন আমায় বাঁচিয়ে আজ না হয় সেটা ফেরত দেব!”

নির্জনের এবার বেশ রাগ হয়। রায়ান তাকে উপকার ফেরত দিতে চাইছে? নির্জন কি হেল্প ব্যাক পাবার জন্য তাকে হেল্প করেছিল নাকি? আশ্চর্য তো! নির্জন মুখটা ভার করে বলে,
“নো নিড। নির্জন আহমেদ হেল্প ব্যাক পাওয়ার জন্য হেল্প করে না।”

“আপনি আর চান আর না চান আমিই এই কাজটা করব। আমি শেখরকে দিয়ে মি. রাশেদের কাছে খবর পাঠাচ্ছি। চিন্তা করবেন না। সিসিটিভি ক্যামেরা আর রেকর্ডার দিয়ে আমার আর মি. রাশেদের কথোপকথন সবই শুনতে পাবেন। এখন আসছি। আমার কাজ আছে।”

রায়ান আর বিলম্ব করল না। নির্জনের জবাব না শুনেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। এখনো স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছে না রায়ান। সেটা নির্জনের দৃষ্টি এড়ায় না। নির্জন বিরবির করে বলে,
“ভাঙবে তবুও মচকাবে না। বাই দ্যা ওয়ে মেহরাজ, তার পায়ের সমস্যা সারতে কতদিন লাগবে?”

“এখন একটু একটু সমস্যা হবেই স্যার। তবে বেশিদিনও লাগবে না। গু’লি তো পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিল।”
নির্জন আবার নীরবতা পালন করে। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস।

মাথাব্যথায় চোখটা খুলতে পারছে না রাগিনী। কালকে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিতে ভেজা আর আনন্দে ছুটে ছুটে বৃষ্টিবিলাস করার ফল ভুগছে এবার। সর্দিতে নাক পুরোটাই বন্ধ। মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে তার। মাঝে মাঝে হাঁচি দিয়ে ফেলছে। ঘুমটা বেশ কিছুক্ষণ হলো ভাঙলেও চোখ বুঁজে শুয়ে আছে সে। রিও এর ডাকে আধো আধো চোখে তাকাল রাগিনী। রিওকে এগিয়ে আসতে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিল। রিও কেমন যেন করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। তার নিকটে এসে সামনের একটা পা দ্বারা স্পর্শ করল রিও তার গাল। তারপর মিউ মিউ শব্দ করে উঠল। রাগিনী বুঝতে পারল এই ছোট্ট ছানাও বুঝতে পেরেছে রাগিনী অসুস্থ। সেকারণেই তার এমন দৃষ্টি। রাগিনী দুর্বল কন্ঠে রিও এর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“খিদে পেয়েছে বুঝি?”

রিও কোনো শব্দ করল না। চোখ বুঁজে রাগিনীর গালের সাথে নিজের গাল ঠেকিয়ে শুয়ে পড়ল। বেশ আদুরে ভঙ্গিতে ডেকে উঠল। রাগিনীর হাসি প্রসারিত হলো যেন। ব্লাঙ্কেট থেকে একটা হাত বের করে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিল। দরজায় টোকা পড়ে তখন। দরজার দিকে তাকিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে শরীরের উপর জোর খাটিয়ে উঠে বসে রাগিনী। হয়তবা সৈয়দ কাকা এসেছে। এই ভেবে কিছুটা জোর সুরে বলে,
“ভেতরে আসুন চাচা।”

দরজাটা খুলল এবার। ছোট ছোট পায়ের ধাপ ফেলে প্রবেশ করল কেউ এবার। হাসি সহ জবাবে এলো,
“ইয়ে মানে আমি তো চাচা নই। আমার বয়স চাচা হওয়ার মতো হয়নি।”

সৈয়দের কন্ঠের বদলে অন্য কোনো পুরুষালি কন্ঠে পিটপিট করে তাকাল রাগিনী। অভিরূপকে দেখে চোখ দুটো কপালে উঠল তার। অভিরূপের হাতে একটা চায়ের কাপ। সেটা নিয়ে রাগিনীর বেডের দিকে এগিয়ে আসছে সে। তাকে দেখে রাগিনী অস্ফুটস্বরে বলল,
“আপনি?”

“হ্যাঁ আমি। সেকারণেই তো বললাম আমি চাচা নই।”

“আপনি কেন চাচা হতে যাবেন? আমি তো সৈয়দ চাচা ভেবেছিলাম। আসলে সকালবেলা খাবার দিতে আর খোঁজ নিতে উনি ছাড়া অন্যকেউ আসেন না তো তাই।”

অভিরূপ ফট করেই চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে স্থির হয়ে রাগিনীর বেডের সামনে দাঁড়াল। আর স্পষ্ট জবাবে বলল,
“অন্যকেউ থাকেনা তাই আসে না। এখন আছে তাই আসবে মিস. তাজরীন। আর কালকে থেকে তো আপনি ব্যস্ত! সকাল সকাল কোথায় বেরিয়ে গেলেন। আবার ফিরলেন বিকেলের দিকে। ফিরেই নিজের ঘরেই এসে বসে আছেন। কথা বলার সুযোগও হলো না।”

রাগিনী জোরপূর্বক হাসি দিয়ে নিচের দিকে তাকায়। তারপর একহাতে নিজের গাল, নাক, মুখ মুছতে থাকে। না জানি ঘুম থেকে ওঠার পর মুখে কত রাজ্যের তেল লেগে থাকে। তার উপর এলোমেলো চুল দেখে এই ফেমাস সিঙ্গার তাকে পেত্নী ভেবে যে পালিয়ে যায়নি এই অনেক। অপরদিকে রাগিনীর প্রতিত্তোর না পেয়ে কিছুটা ভড়কে গিয়েছে অভিরূপ। কারণ শেষবার তার সঙ্গে যখন দেখা হয়েছিল যে হারে ছেলেগুলোকে উত্তমমধ্যম দিয়েছিল তা মনে পড়লেই অভিরূপের মনে হয় কখন জানি মেয়েটা তার উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়ে। আচ্ছা হুটহাট মেয়েটার রুমে আসার অপরাধে আবার উত্তমমধ্যম দিতে শুরু করবে না তো? এই ভেবেই কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ায় সে। আটকা আটকা গলায় বলে,
“না সমস্যা নে…নেই। ক…কথা বলতে ইচ্ছে না ক…করলে কথা বলতে হবে না। আমি যাই হ্যাঁ?”

বলেই পিছু ফিরে দরজার পানে হাঁটতে লাগে সে। অভিরূপের এমন অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ায় নয়ন দুটো গোল গোল হয় রাগিনীর। লোকটা কি মাইন্ড করল?
“আই এম সরি। আমারই উচিত ছিল আপনাদের সঙ্গে ভালোমতো পরিচয় হওয়া। কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। আমি দুঃখিত তার জন্য।”

এবার পা দুটো থামে অভিরূপের। ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। মেয়েটা কেমন অনুতপ্তের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। এমন দুর্দান্ত সাহসী নারীও যে সরি বলবে এতো সহজে সেটাও ভাবতে পারেনি অভিরূপ। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“ইটস ওকে। বাট আপনি কি অসুস্থ? চোখমুখ অন্যরকম লাগছে। কালকে রাতে ডিনারের সময় একটু কাশছিলেন।”

“হ্যাঁ আসলে গতকাল বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে তো তাই খানিকটা সিক হয়ে পড়েছি।”

কথা বলতে বলতেই দুজনের কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে রিও আবারও ডেকে ওঠে। তার দিকে চেয়ে তার মাথায় হাত বুলাতেই অভিরূপ বিড়াল ছানা দেখে উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসে বলে,
“কিউট কিটি! হ্যালো…”

অভিরূপ বিড়ালের দিকে হাত বাড়াতেই রিও তার সামনের এক পা উঠিয়ে যেন ধমকে মিউ মিউ করে উঠল। অতঃপর আদুরে ভঙ্গিতে রাগিনীর কোলে ঢলে পড়ল। অভিরূপ হাতটা সরিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাল। নাহ হাত বাড়ানোই ভুল হয়েছে। বোঝা উচিত! মালিক যেমন হবে তার বিড়ালও তেমন হবে। রাগিনী ফট করে বলল,
“আসলে ও সবার কাছে যেতে পছন্দ করে না। আমার কাছেই বেশি কমফোর্ট ফিল করে।”

“নো প্রবলেম। একচুয়ালি আমি আপনার জন্য চা এনেছিলাম। কাল কাশছিলেন তাই গলার ভালোর জন্য তুলসী চা এনেছিলাম। টেস্ট করতে পারেন।”

বলেই টেবিল থেকে চায়ের কাপ নিয়ে রাগিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল অভিরূপ। মুখে রেখে দিল এক সুন্দর প্রশস্ত হাসি। তবে রাগিনীর প্রতিক্রিয়া দেখে আবারও ভড়কে গেল অভিরূপ। কীভাবে যেন চেয়ে থাকে মেয়েটা। শুধু মনে হয় এই বুঝি দিল একটা ঘু’ষি নয়ত থা’প্পড়! সঙ্গে সঙ্গেই চা সরিয়ে নিয়ে মুখের হাসি বিষিয়ে বলল,
“থাক থাক। খেতে হবে না।”

“আরে, এভাবে বলছেন কেন? আমি টেস্ট করব না কখন বলেছি? আসলে আপনি আমার জন্য চা নিয়ে এসেছেন। সেটাই ভাবছিলাম। আপনি আমাদের বাড়ির গেস্ট। তাও স্পেশাল গেস্ট। এসব আপনি কেন করছেন? এসব কোথায় আমার করা উচিত তা না করে বিষয়টা উল্টো হয়ে যাচ্ছে।”

অভিরূপ হাফ ছেড়ে বলে,
“এটা কোথায় লেখা আছে যে গেস্ট হলে শুধু তাদেরই সেবা পাওয়ার অধিকার আছে? সেবা দেওয়া অধিকার নেই! চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে টেস্ট করুন।”

রাগিনী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে হালকা হাসে। তার এখনো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে অভিরূপ চৌধুরী তার জন্য চা এনেছে। ভেবেই হাত-পা কেমন যেন কাঁপছে। কোনোরকমে চায়ের কাপে মুখ লাগালো সে। চা মুখে যেতেই মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো তার। অদ্ভুত স্বাদটা ভেতরে কাঁপিয়ে তুলল। এটা কীভাবে খায় মানুষ? অভিরূপ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন লাগলো?”

না চাইতেও জোরপূর্বক এক হাসি টেনে রাগিনী উত্তর দিল,
“গুড।”

“আমি তো প্রতিদিন সকালে খাই। গলা ভালো রাখে। বুঝতেই পারছো আমাকে গলা ভালো রাখতে হয়। সেকারণে নোমান আমাকে এক ফোঁটা ঠান্ডাও খেতে দেয় না। কী নিষ্ঠুর তার ব্যবহার।”

“আপনার ভালোর জন্যই তো দেয় না। গলা খারাপ হয়ে গেলে গানের সুর আসবে কীভাবে?”

“তার প্রশংসা করা বাদ দাও। সে যে কী জিনিস আমি জানি। বাই দ্যা ওয়ে, তুমি সেদিন ওভাবে পালিয়ে গেলে কেন? ইউ নো হোয়াট? আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম!”

রাগিনী এবার অভিরূপের কথায় স্মরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল কোন সময়ের কথা বলছে সে? হসপিটালের কথা? সেটাই হবে নিশ্চয়। কারণ এরপর তো কোথাও তাদের দেখা হয়নি। তাই সেটা মনে করেই সে আমতা আমতা করে বলল,
“সেদিনের জন্যও সরি আসলে আমি ভুল করে ওই কেবিনে ঢুকে পড়েছিলাম তো তাই…”

“উঁহু… ওইদিনের কথা বলিনি আমি। লাস্ট যেদিন দেখা হলো আমাদের। রিমেম্বার! ওই জঙ্গলে…”

কুঁচকে গেল রাগিনীর ভ্রুজোড়া। জঙ্গলে কখন, কবে দেখা হলো? ভেবে পেল না সে। তখনি দরজায় আবারও কড়া নাড়ে কেউ। দরজা খোলা থাকাতেই রাগিনীর চোখে পড়ে নোমানকে। রাগিনী বিনয়ের সঙ্গে বলে,
“আসুন ভেতরে আসুন।”

নোমান এমন সুন্দর সম্মতিতে ভেতরে প্রবেশ করেই অভিরূপকে দেখে বলে ব্যাঙ্গাত্বের সাথে বলে,
“বাবাহ্, সামান্য পানি খাওয়ার জন্যেই যেই ছেলে অন্যকাউকে অর্ডার করে তাকে কিনা সকাল সকাল দেখলাম হলরুমে চা নিয়ে সোজা রাগিনীর রুমে আসতে!”

তেতে উঠল অভিরূপ। এই নোমানের সব জায়গায় সব কথা না বললেই নয়। শুধু শুধু ফাঁসিয়ে দেওয়ার ফন্দি। দাঁত চেপে বলল,
“খবরদার বদনাম করবি না। নিজের অকাজগুলো আমার উপরে চাপানোর চেষ্টা করবি না।”

“ওহ হো, আমি তোমার উপরে চাপানোর চেষ্টা করি তাই না? আজকে সকালেই তো জাস্ট এসির টেম্পারেচার কমাতে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে ধা’ক্কা মে’রে ফে’লে দিয়ে বললি রিমোট নিয়ে টেম্পারেচার কমাতে। মনে নেই? আরো মনে করাবো?”

লজ্জায় যেন নাক কান কাটা যায় অভিরূপের। ইশশ… রাগিনী কী ভাবছে? কে জানে! এই নোমানকে থামাতে হবে। তাই সে রাগ মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলল,
“মনে করা। আরো মনে করা। এটাও মনে করা সেদিন হোটেলে তুই আর আমি…”

নোমান তৎক্ষনাৎ ঝাড়ি দিয়ে বলে,
“স্টপ। তোকে আর বলতে হবে না। এখানেই চুপ কর।”

বলেই অভিরূপের মুখে থাবা মা’রে নোমান। অভিরূপ মুখে হাত দিয়ে বুলাতে থাকে আর চোখ রাঙিয়ে তাকায় নোমানের দিকে। এবার নোমান তার অন্য হাতে থাকা চশমার বক্সটা রাগিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই ফ্যালফ্যাল করে তাকায় রাগিনী। নোমান ধীর কন্ঠে বলল,
“আসলে কালকে ওই মেয়েটা কী যেন নাম! উর্মিলা। গতকাল ওর সাথে প্রথমে রাগারাগি করলেও পরে আমি রিয়েলাইজ করি যে আসলেই ভুলটা কোথাও আমার ছিল। কারণ চশমাটা তো আমি ভেঙ্গেছি। আর যারা চশমা নিয়ে চলে তাদের অবশ্যই চশমার কিছু হলে খারাপ লাগবে স্বাভাবিক। আমি হয়ত ওভার রিয়েক্ট করে ফেলেছি। তাই কাল আমি মার্কেট থেকে খুঁজে কিছুটা একই ফ্রেমের চশমা আনায়। আর ভাঙ্গা চশমা আমিই কালেক্ট করেছিলাম পাওয়ার কত সেটা জানতে। না বলার জন্য সরি আর এটা তাকে দিয়ে আমার পক্ষ থেকে সরি বলে দেবে প্লিজ?”

নোমানের হাত থেকে চশমার বক্সটা নিলো রাগিনী। বক্স খুলে দেখল হুবহু একই ফ্রেমের চশমা। সেটা দেখে এক গাল হেঁসে বলল,
“আমার মনে হয় আপনারই সরি বলা উচিত। তাহলে বিষয়টা বেশি ভালো দেখাবে।”

নোমান কাতর সুরে বলল,
“কিন্তু আমি কীভাবে?”

“সরি মানুষ কীভাবে বলে? চশমাটা দেবেন আর সরি বলবেন। আমি না হয় ওকে আমার বাড়িতে ডেকে নেব।”

কথাটা শেষ করেই গলায় চাপ দিয়ে বেরিয়ে এলো কাশি রাগিনীর মুখ থেকে। তারপর চশমার বক্সটা ফিরিয়ে দেয় নোমানের দিকে। নোমান ভাবতে থাকে গতকাল যেই উড়নচণ্ডী মেয়েটার সাথে যা হলো মেয়েটা ঘুরেও তার দিকে তাকাবে কিনা ঠিক নেই। তাহলে সরি কীভাবে বলবে?

চেয়ারে হালকা ভর দিয়ে বসে আছে রায়ান। তার বৃদ্ধা আঙ্গুলটা থুঁতনিতে বুলিয়ে যাচ্ছে। শান্ত দৃষ্টিটা অবস্থান করছে রাশেদ সাহেবের দিকে। পরখ করে যাচ্ছে রাশেদ সাহেবের প্রতিটা প্রতিক্রিয়া। লোকটার অবস্থা খুব একটা ভালো মনে হচ্ছে না। বেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন রায়ান কোনোরকম প্রশ্ন না করতেই। কেমন যেন হাসফাস করছেন। তা দেখে রায়ান গ্লাসের পানি এগিয়ে দিল উনার দিকে। ভদ্রলোক বেশ কঠিন সুরে জবাবে বললেন,
“নো থ্যাংক্স, ইন্সপেক্টর। আমাকে এখানে কী কারণে ডাকা হয়েছে সেটা জানতে পারি? আমি কী করেছি?”

রায়ান সোজা হয়ে বসল। টেবিলে দুটো হাত রাখল। আর সহজ গলায় বলল,
“আপনি একজন নামি-দামি মানুষ। তাই আপনাকে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না আপনাকে। কিন্তু উপায় না দেখে আপনাকে জরুরী তলব করতেই হলো।”

“কিন্তু এর কারণটা কী?”

“তাহলে চলুন। আসল কথাতেই আসা যাক। আপনার স্ত্রীর নাম কী স্যার?”

রাশেদ সাহেব বুঝলেন না এমন অহেতুক প্রশ্নের কারণ। তবুও শান্ত থেকে জবাব দিলেন,
“মিসেস. নীলিমা।”

“আপনার মেয়ের নাম?”

“রাগিনী তাজরীন।”

রায়ান যেন একটা নামে সন্তুষ্ট হলো না। একটু দম নিয়ে বলল,
“এমন কি কোনো ঘটনা ঘটেছে যেখানে আপনার স্ত্রীর হয়তবা টুইন বেবি ছিল কোনো কারণে একটা বেবির মা’রা যাওয়ার খবর পান বা অন্যকিছু? আপনার যে একটাই মেয়ে এক্ষেত্রে আপনি কি নিশ্চিত?”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৭

“এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন ইন্সপেক্টর? আমার কয়টা সন্তান এই ব্যাপারে নিশ্চিত হবো না কেন আমি? আপনি আমাকে এসব অদ্ভুত প্রশ্ন করে বিব্রত করছেন।”

রাশেদ সাহেবের চটপটে কন্ঠ। বোঝাই যাচ্ছে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছেন উনি। সারা শরীরে অস্থিরতা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। রায়ান উনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“রিল্যাক্স, স্যার। আপনি আমার কথা অন্যভাবে নিয়ে নিচ্ছেন। এমন অনেক ঘটনা ঘটে আজকাল। দুটো বেবি হয় আর একজনের প্রবলেমের কারণে মা’রাও যায়। তাই আমি জিজ্ঞেসা করছি। আপনার জীবনে কি এমন কোনো ঘটনা আছে?”

“না নেই। আমার একমাত্র সন্তান রাগিনী। তার জন্মের সময় কোনো কমপ্লিকেশনস্ ছিল না। সে সুস্থ অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হয়েছিল।”

রায়ান এবার রাশেদ সাহেবের উত্তরে এক গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হলো। বৃদ্ধি আঙ্গুল দিয়ে কপালের ধার বুলাতে বুলাতে ভাবতে থাকল লোকটি আসলেই সত্যি কথা বলছে? নাকি সম্পূর্ণটাই মিথ্যে? আবার এমন নয় তো? যে নিজের অন্য মেয়েকে বাঁচাতে উনি নিজেও এসবে শামিল? মাথা ঝাঁকুনি দিল একবার রায়ান। কীসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা। তার সামনের মানুষটা তো যেমন তেমন মানুষ নয় যে অ’পরাধে জড়িয়ে যাবে আর নিজের মেয়েকেও সেই পথে চালনা করবে। উনি শাহ্ রাশেদ। ঢাকার কয়েকজন বিখ্যাত সাইকোলজিস্টের কথা বললে সর্বপ্রথম উনার নামই ওঠে। এমন মানুষের কী প্রয়োজন এমন ক্রা’ইমে জড়ানোর? রাশেদ সাহেবের কন্ঠে একটা একটা করে ভাবনার সুতো কেটে যায় রায়ানের।
“কিন্তু এমন উইয়ার্ড কুয়েশ্চন করার রিজন আমি জানতে পারি?”

রায়ান তপ্ত শ্বাস ফেলে জবাবে বলে,
“বিষয়টা অনেক জটিল। ঢাকায় যেই টে’রো’রিস্ট টিমের থা’বা পড়েছে সেটা সবাই জানে। আই গেস, আপনিও জানেন।”

“তার সঙ্গে এই প্রশ্নের কী সম্পর্ক ইন্সপেক্টর?”

রায়ান এবার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শেখরকে ইশারা করতেই শেখর তার দিকে একটা মোটা কাগজ এগিয়ে দেয়। রায়ান সেটা নিয়ে টেবিলে মেলে ধরতেই দৃশ্যমান হয় রাগিনীর আঁকা স্কেচ। তা দেখে নড়েচড়ে চশমা ঠিক করে বসেন রাশেদ সাহেব।
“এটা তো আমার মেয়ে।”

“আপনি সিউর? এটা আপনার মেয়ে?”

“আশ্চর্য! আমি সিউর হবো না কেন? আমার র’ক্তকে চিনতে আমার ভুল হবে কেন? আমি ওকে নিজের বুকের পাঁজরে রেখে বড় করেছি। আপনার কথাবার্তায় আর বিব্রত করবেন না আমায়।”

আবারও উত্তেজিত রাশেদ সাহেবকে রায়ান ঠান্ডা গলায় বলল,
“আপনি কি জানেন? এই স্কেচের মেয়েটার ব্যাগে বো’ম বানানোর মেটেরিয়ালস্ আর রি’ভলবা’র পাওয়া গিয়েছে?”

বিস্ময়ের সীমানা রইল না রাশেদ সাহেবের। মাথাটা কেমন যেন ভমভন করছে উনার। কথাগুলো যেন নেওয়া যাচ্ছে না আর। কন্ঠস্বর মিইয়ে গিয়েছে। তবুও বললেন,
“হোয়াট? কী বলছেন?”

“ঠিক বলছি। আপনার মেয়ে রাগিনী তাজরীন যেদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাতে ব্যাক করে সেদিন আপনার মেয়ের পরিচয়েই আরেকজন আপনার মেয়ের মতোই দেখতে হুবহু একজন ওই ট্রেনেই ছিল। আর সে টেরো’রিস্ট টিমেরই একজন।”

কী বলবেন বুঝে উঠতে পারলেন না রাশেদ সাহেব। সবটাই যেন একটা অবিশ্বাস্য কান্ড। যেটা বিশ্বাস করতে না পারলেও সত্য। পুলিশের লোক নিশ্চয় মিথ্যে বলবে না। মাথাটা ঠান্ডা করতে চাইলেন নিজের। কারণ এই বিষয়ে এখন খোলাখুলি আলোচনা করা প্রয়োজন। এটা উনার মেয়েকে নিয়ে প্রশ্ন। যাকে সবসময় উনি আগলে রেখেছেন। রাগিনী হলো উনার সাত রাজার ধন। তাকে হারাতে দেবেন না কিছুতেই। তাই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন,
“তার মানে আপনারা বলতে চাইছেন রাগিনীকে ফাঁসানো হচ্ছে?”

“ঠিক সেটাই। আসলে আমরা প্রথমে সন্দেহ করি আপনার মেয়েকেই। সেটা ধরে এগোতে থাকি। তাকে সরাসরি গিয়ে ধরতে পারছিলাম না উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ না পেয়ে আমরা হতাশ হই। পরে আস্তে আস্তে ধরা পরে আপনার মেয়ের মতোই অন্য একজন। যার সত্ত্বা ভিন্ন তবে চেহারা এক।”

“কিন্তু এটা কীভাবে পসিবল? আমার জমজ মেয়ে ছিল না। আমার আজও স্পষ্ট সেইদিনের কথা মনে আছে। আমার রাগিনীর জন্ম হলো। আমি খুশি ছিলাম। সেই খুশি ভাষায় প্রকাশ করার মতো ছিল না। ডক্টর কখনো আমাকে জমজ বেবির কথা বলেনি। আর রিপোর্টেও যতবার দেখেছি একটাই মেয়ে বাচ্চার কথা উল্লেখ ছিল।”

বলেই থামেন রাশেদ সাহেব। ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভাবেন। আশেপাশে তাকান। অন্য একটা কথা হুট করেই মাথায় খেলে যেতেই তিনি বিদ্যুতের গতিতে বলে উঠলেন,
“ওয়েট ইন্সপেক্টর! এটা ইম্পসিবল না। প্লাস্টিক সার্জারি বলেও একটা শব্দ আছে। এটা অসম্ভব কিছু না এখন। আর আমি শুনেছিলাম বিদেশ থেকে এখন নামি-দামি সার্জন আনা হয়। এরা খুব নিখুঁতভাবে চেহারা গড়িয়ে দিতে পারে।”

রায়ানের চোখমুখের ভাবমূর্তি এমন হলো যেন সে সোনার খনি খুঁজে পেয়েছে। হাত দুটো মুঠো করে কাঁপতে থাকল সে। উত্তেজনা চাপিয়ে রাখার চেষ্টা করে একটা বড় শ্বাস নিয়ে হেঁসে বলল,
“ব্রিলিয়ান্ট! এটা তো মাথাতেই আসেনি। ইউ আর রিয়েলি অ্যা ব্রিলিয়ান্ট স্যার।”

সিসিটিভিতে নিষ্পলক হয়ে মনোযোগ দিয়ে প্রতিটা দৃশ্য দেখছে নির্জন। রাশেদ সাহেবের প্রতিটা প্রতিক্রিয়াও তার চোখ এড়াতে দেয়নি। স্পিকার থেকে প্রতিটা শব্দ শুনেছে। একটাও মিস করেনি। আর শেষের কথোপকথনে এবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে তার। কোথাও একটা থমকে গিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে তার দুটো হাত। পাশেই মেহরাজও সব শুনেছে দেখেছে। সেও হতবিহ্বল হয়ে নীরবতা অবলম্বন করেছে। ব্যাপারটা এভাবে ঘুরে যাবে সে ভাবতেই পারেনি। গলা খাঁকারি দিয়ে নির্জনের মনোযোগ নিতে চাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো মেহরাজ। মিনমিন করে ডেকে উঠল,
“স্যার!”

“বাঁচার জন্য মানুষ কত ফন্দিই না করে। কিন্তু নকল সোনাকে নির্জন আহমেদ হাতের মুঠোয় দুমড়েমুচড়ে শে’ষ করে দেবে। অনেক হয়েছে লুকোচুরি খেলা। এবার সামনে আসতে হবে।”

মেহরাজ উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
“কীভাবে স্যার?”

“খুবই সহজ মেহরাজ। সেদিন ওই মেয়েটা আমাকে দেখেছে হসপিটালের বাহিরে। সে যেহেতু রাগিনীর দিকে সবসময় নজর রাখে তাই সে আমাকে চিনতো এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সেদিনের পর সে জেনে গিয়েছে আমি পুলিশের লোক। আর ইনভেস্টিগেশন করছি। তাই ইন্সপেক্টর রায়ানের মতো আমাকেও তাদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করা হবে এটাতেও আমি নিশ্চিত। আশা করছি খুব কম সময়ের মধ্যেই নকল রাগিনী তাজরীন ধরা দেবে। আই এম ওয়েটিং।”

সকাল সকাল সারা শরীরের ভীষণ ব্যথায় একপাশ হয়ে আধশোয়া হয়ে রয়েছে ছিপছিপে গড়নের নারী। পা দুটো মাঝে মাঝে দুলছে। মুখ দিয়ে চুইংগাম চিবিয়ে মাঝে মাঝে বেলুন ফুলাচ্ছে। ঘাড়ে হাতটা রেখে বুলিয়ে বেশ আক্রোশের সাথে বলে উঠল,
“হারা’মজা’দা গুলো যদি একা থাকত আর আমার হাতে ওই পি’স্তল! তাহলে বুঝতো রূপা কী জিনিস! শুধুমাত্র ওই অভিরূপের জন্য আমাকে ওদের শুধু কয়েকটা মে’রেই নিজের মনকে শান্তনা দিতে হলো।”

বলেই থামল সে। পরক্ষণেই ভেবে বলল,
“না। তার জন্য না। সে আমাকে হেল্প করেছে। জীবনে প্রথম যখন ভয় নামক শব্দটা উপলব্ধি করেছিলাম লোকটা যেন ম্যাজিকের মতো সামনে এলো। আর আমাকে…”

বলেই থামল রূপাঞ্জনা। উঠে বসল তড়িঘড়ি করে। নিজের হাত, বাহু, কোমড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল। এখানেই তো অভিরূপ ছুঁয়েছিল তাকে। কোলে তুলে নিয়ে সে কী দৌড়! দৌড়াতে পারে না পিছলে পিছলে যায় তবুও থামে না। ভাবলেই হাসি পায় রূপাঞ্জনার। আবার মনের দ্বারে অদ্ভুত একটা নতুনত্ব খুঁজে পায়। তাকে জীবনে এই প্রথম কোনো পুরুষ এভাবে রক্ষা করার স্বার্থে ছুঁয়েছে। সেই ছোঁয়ায় আ’ঘাত ছিল না। একটা আগলে রাখার মতো স্পর্শ ছিল। ডার্ক ম্যাক্সও তার হাত ছুঁয়েছে, গাল ছুঁয়েছে। কিন্তু এভাবে আগলে রাখার জন্য নয়। আ’ঘাত দেওয়ার স্বার্থে। যন্ত্রণা দেওয়ার চেষ্টায়। ঠিক একারণেই বোধহয় মনের মধ্যে নতুন অনুভূতি উদ্ভব হয়েছে। কারণ যাই হোক না কেন মানুষটা তাকে বাঁচিয়েছে। দরজায় টোকা পড়ল। ভাবনার মাঝে ডুবে থাকা রূপাঞ্জনার ভাবান্তর হলো না। সে জানে দরজার ওপাশে কে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল কবির। হাতে একটা টিফিনবক্স। রূপাঞ্জনা একবার কবিরের দিকে চাইতেই কবির মুখ খুলে বলল,
“বস! সব রেডি।”

“দ্যাটস গুড। এখন যা। আমি রেডি হবো।”

কবির মাথা ঝাঁকিয়ে বাহিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। হঠাৎ কিছু একটা মনে হতেই রূপাঞ্জনা তাকে পিছু ডেকে বলে,
“কবির শোন!”

“ইয়েস, বস!”

“ধর কেউ কখনো যদি তোকে একটা বড়সড় বিপদ থেকে বাঁচায়, তারপর তুই জানতে পারলি যে তোকে বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে তাকেই তোকে মা’রতে হবে। অর্থাৎ, যে তোর জীবন বাঁচিয়েছে তার জীবনটাই তার থেকে আলাদা করতে হবে। তখন কও তাকে মা’রতে তোর হাত কাঁপবে?”

কবির প্রশ্নটা শুনে মাথা চুলকায়। কী অদ্ভুত প্রশ্ন! এর উত্তর যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। দিশেহারা হয়ে উত্তরে বলে,
“কিন্তু বস আমাকে শ’ত্রুপক্ষ কেন বাঁচাতে যাবে? আর আমাদের তো এটা ছোটকাল থেকে শেখানো হইছে যে যেমনই হক যদি তাকে শে’ষ করা একমাত্র লক্ষ্য হয় তাহলে তাকে শেষ করা উচিত। আপনেই তো এটা বলছিলেন আমাদের।”

রূপাঞ্জনার মুখশ্রী যেন বেলুনের মতো চুপসে যায়। থতমত খেয়ে কোনোরকমে জবাব দিল,
“তুই এখন যা তো। আমার কাজ আছে।”

তার এমন ধমকানি খেয়ে ভ্যাবাচেকা খেল কবির। এক্ষুনি তো বস নিজেই তাকে দাঁড়াতে বলল। আবার হঠাৎ করেই ধমকে বলছে বেরিয়ে যেতে। কী আজব! মুখটা ভার করে বেরিয়ে যায় কবির। সে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে শপিং ব্যাগ থেকে একটা সালোয়ার কামিজ বের করল রূপাঞ্জনা। এমন ধরনের পোশাক পড়ার অভ্যেস নেই তার। ওড়না সামলে উঠতে হিমশিম খায় সে। ছোট্ট একটা স্কার্ফই তার থেকে বেশ সহজ সামলানো। কিন্তু কী আর করার। এটাই করতে হবে। রাগিনী তাজরীন হয়ে নাকি উঠতে হবে! নিজের আসল পরিচয় মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। হাতে ওড়না ধরল রূপাঞ্জনা। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের কন্ঠ শক্ত করে বলল,
“ঠিকই তো। এতো নি’ষ্ঠুর রূপার হাত কেন কাঁপবে কাউকে মা’রতে? কাঁপা তো উচিত নয়। কাঁপবে না তার হাত। আবার মেতে উঠবে ম’রণ খেলায়।”
সকাল থেকে একবার ঘরের জানালার কাছে যাচ্ছে তো একবার দরজার কাছে আসছে কোহিনূর ওরফে নির্জন। পা দুটোকে যেন শান্তি দিচ্ছে না। কখন যেন পা দুটোও অতিষ্ট হয়ে বলে উঠবে,’থাম ভাই। আমাদের আর এতো জ্বালাস না। তোর মনের আগুন ঠান্ডা করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ করে দিচ্ছিস কেন?’

কিন্তু কোহিনূর যে শান্তি পাচ্ছে না সেটা তো দুটো পা বুঝতে চাইছে না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কোহিনূর আপনমনে বিরবির করে ওঠে,
“মেয়েটা কালও এলো না। আজও এখনো আসছে না। ঠিক আছে তো? সে কি বোঝে না একবারও আমার মনের অবস্থা?”

আবারও চুপ থাকে কোহিনূর। হেঁটে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে উঁকি দেয় মেইন দরজার দিকে। মনে তীব্র আশা বেঁধে রয়েছে। মনে হচ্ছে এইতো রাগিনী এলো! এইতো দরজায় ঠেলে হাতে টিফিবক্স নিয়ে ভিতরে ঢুকল। তবে তেমনটা তো হলো না। এবার মুখ ভার করে বিছানায় গিয়ে বসল কোহিনূর। আপনমনে আওড়াল,
“সে যদি একবার জানতো সে আমার কাছে শীতল বর্ষণের মতো। যেই বর্ষণ না পেলে মনের রাজ্যে দুর্ভিক্ষ লেগে যায়। তাহলে হয়ত সে বর্ষণ কন্যা হয়ে সবসময় আমার সংলগ্নে উপস্থিত থাকতো।”

ফোনের ভাইব্রেশন উপলব্ধি করল কোহিনূর। নড়েচড়ে উঠে পকেট থেকে ফোনটা বের করল সে। মেহরাজ কল করেছে। নিশ্চয় কোনো জরুরি খবর! আর সেটা যদি না হয় তবে এবার আজেবাজে কথা বলার দরুন নিশ্চিত তার একমাসের জন্য হসপিটালে থাকা পাকা করে দেবে কোহিনূর। তবে এখানে কথা বলা যাবে না। যেকোনো মূহুর্তে রাগিনী এলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই ভেবে ফোন রিসিভ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে।

ঘরে ফিরে এলো কোহিনূর ঠিক মিনিট দশেক পর। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই যে কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সাক্ষাৎ পাবে এবং প্রথমেই দৃষ্টি তার দিকে পড়বে ভাবতে পারেনি সে। আনন্দের জোয়ারে যেন ভেসে গেল মনের রাজ্য। উতলা হয়ে উঠল তার নিকটে যেতে। রাগিনী বিছানায় বসে একমনে টিফিনবক্স খুলছে আর খাবার বের করছে। কোহিনূরকে খেয়াল করেনি এখনো অবধি। পা টিপে টিপে গিয়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কোহিনূর। কিছুটা ঝুঁকে পড়তেই যখন তার গরম নিশ্বাস আঁচড়ে পড়ল রাগিনীর কাঁধে তৎক্ষনাৎ চমকে উঠে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল রাগিনী। অতঃপর অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,
“আপনি? আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন।”

“তাই? তোমাকে তো ভয় পাওয়াতে ভালো লাগে আমার। ভীতু চোখমুখ দেখতে অসাধারণ লাগে।”

রাগিনী ব্যস্ত কন্ঠে জবাব দিল,
“তাই না? সব উদ্ভট জিনিসের ভালো লাগা আপনার।”

“কী করব বলো? আমি মানুষটাই তো উদ্ভট ভয়ানক।”

“এখন খেতে বসুন তো তাড়াতাড়ি। সময় নেই হাতে।”

বলেই কোহিনূরের হাতটা ধরতেই তীক্ষ্ণ চোখে রাগিনীর ধরা হাতের দিকেই তাকায় কোহিনূর। ফিচেল হাসি দিয়ে হাত মুঠো করে রাগিনীর সামনে বসে। রাগিনী খাবার এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। আজকের খাবারটা আমি বানিয়েছি। খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।”

কোহিনূর হাতে খাবারের বাটি নিয়ে প্রথমে গন্ধ নিয়ে প্রশান্তির সুরে বলে,
“গন্ধই বলে দিচ্ছে তুমি আমাকে মা’রার প্ল্যানিং করে রেখেছো মিস.।”

রাগিনী যেন থতমত খায়। মুখের বর্ণ বিবর্ণ হয়। ধূসর এক আবরণে মাখিয়ে যায় মুখশ্রী। ভীত সুরে বলে,
“মা…মানে?”

“আরে বাবা এতো সুন্দর স্মেল বের হচ্ছে খাবার থেকে যেন অমৃত। খেয়ে স্বাদের চোটে ম’রে টরে না যাই।”

বলেই হেসে দিল কোহিনূর। রাগিনীর মধ্যের প্রতিক্রিয়া অদ্ভুত মিশ্র। সেও হাসছে। তবে মন খুলে নয়। কোহিনূর এবার খাবারটা মুখে দিতে গেলেই হাত থেকে বাটি ফসকে খাবার সহ বাটি সবটা পড়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে রাগিনী। মুখটা কুঁচকে যায়। ফুঁসে বলে ওঠে,
“এটা কী হলো?”

“আই এম সরি রাগিনী। আমি তাড়াহুড়ো করে খেতে গিয়ে…”

রাগিনী দম ফেলে রেগেমেগে তাকে থামিয়ে বলল,
“থাক আমি বুঝেছি। সব ভেস্তে দিলেন আপনি, সব।”

বলেই ঝুঁকে বাটিটা তুলতে গেল রাগিনী। কোহিনূর ঘাড় কাঁত করে রাগিনীকে পর্যবেক্ষণ করা মাত্রই মুখভঙ্গি কঠিন হলো তার। চোয়াল শক্ত করে হাওয়ার বেগে তার পেছনে গিয়ে সরাসরি রাগিনীর গলায় হাত চেপে অন্যহাতটা রাগিনীর দুটো হাত আবদ্ধ করল সে। মূহুর্তেই মধ্যেই ব্যাপারটা মাথায় উপর দিয়ে গেল রাগিনীর। গলায় চাপ লাগায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও চোখ বড় বড় করে বলল,
“আবার পাগলামি শুরু করেছেন আপনি?”

“স্টপ ইউর লেইম ড্রামা। আমাকে মা’রার সব প্ল্যান ভেস্তে গেল তাই না নকল রাগিনী তাজরীন?”

ফ্যাকাশে হলো রূপাঞ্জনার মুখশ্রী। ধরা দিল মুখে ভয়। ছটফটিয়ে উঠল ছাড়া পাওয়ার জন্য। তখনি আরো জোরে মুচড়ে ধরল কোহিনূর। রূপাঞ্জনা আর্তনাদ করে উঠল। তবুও দম কমলো না তার। শাসিয়ে বলে উঠল,
“আমাকে ছেড়ে দে। নয়ত ফল ভালো হবে না।”

“আমি ভয় পাই না তোমার এই সামান্য শাসিয়ে বলা কথায়। অবাক হচ্ছো না? যে তোমাকে চিনলাম কী করে? এতো ঘটা করে রাগিনীর মতো সাজ দিয়ে এসেছো। চুলগুলোও বেঁধে এসেছো। তবুও ধরা খেলে সো স্যাড!”

রূপাঞ্জনা এবার প্রতিত্তোর দেয় না। চিৎকার দিয়ে ওঠে জোরেসোরে। তার চিৎকারে যেন কেঁপে ওঠে ঘর। এমনটা করার কারণ খুঁজে না পেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই দৃশ্যমান হলো বিষয়টা। দরজার কাছে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসা হলো আজিম আর পলাশকে। তাদেরকে দেখামাত্র হতবাক হলো কোহিনূর। ওদের তো আজ ছুটি দেওয়া হয়েছিল। তবে ওরা এখানে কী করে এলো? এমনকি এই হসপিটালের প্রতিটা পেশেন্টকে এতোক্ষণে পুলিশ টিমের সকলে সেফ প্লেসে নিয়ে যাওয়ার কথা পেছনের গেট দিয়ে। সেটাতেও কি ওরা সক্ষম হয়নি? প্রতিটা পেশেন্টকে এতোক্ষণে তার মানে এদের যতটা বোকা কোহিনূর ভাবছে ততটা বোকা তারা নয়। আটঘাট বেঁধে নেমেছে। রূপাঞ্জনার বাঁধন আলগা হয়ে আসতেই কোহিনূরকে ধা’ক্কা দিয়ে সরে আসে সে। কোহিনূর নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পকেট থেকে রি’ভলবার বের করে রূপাঞ্জনার দিকে তাক করল সে। রূপাঞ্জনা পেছনে ফিরেই ব্যাগ থেকে নিজের রি’ভলবার বের করে আজিম আর পলাশের তাক করল। সঙ্গে সঙ্গে জড়ো হলো পুলিশের লোকেরাও। তারাও প্রস্তুত হলো। তবে রূপাঞ্জনা বলে উঠল,
“আমাদের দিকে গু’লি চালিয়ে লাভ নেই। আমাদের এতোজনের প্রাণ গেলে এই দুইটা আর ওদিকে কতোগুলো মেন্টাল পেশেন্টদেরও প্রাণ চলে যাবে। যেখানে এতো প্ল্যানিং করে পেছনের গেট দিয়ে তাদের সেফ প্লেসে পাঠানোর চেষ্টা করছিলে সেই পেছনের গেট উল্টোদিক থেকে তালা মে’রে দেওয়া। এখন বিনাদোষে তাদের জীবনটা চলে গেলে বিষয়টা খুব খারাপ দেখাবে তাই না?”

“এটা করতে পারো না তুমি।”

মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কোহিনূর। রূপাঞ্জনা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
“আমি সব পারি। এখনি ওদের রি’ভলবার ওদের পকেটে রাখতে বল আর নিজেরটা নিচে ফেলে দে। নয়ত কেউ বাঁচবে না।”

কোহিনূর বুঝল আর উপায় নেই। সে সবাইকে ইশারা করল রি’ভলবার নামাতে। সঙ্গে সঙ্গেই সবাই নামিয়ে নিল সেটা। কোহিনূর নিজেরটা নিচে রেখে দিল। কোহিনূর এবার ধীর গলায় বলল,
“ওদের দুজনকে ছেড়ে দাও এখন। আর পেশেন্ট, ডক্টরস্ ওদেরকেও ছেড়ে দাও।”

“আগে আমাদেরকে যেতে দাও। এই পুলিশদের সরতে বলো।”

কোহিনূর আবারও তাদের ইশারা করে সরতে বলে। প্রথমে কেউ সরতে চায় না দরজা থেকে। লক্ষ্যের এতো কাছে এসেও সরে যেতে মন চায়? তবুও বাধ্য হয়ে সরে দাঁড়াল সবাই। রূপাঞ্জনার কড়া দৃষ্টিতে আজিম আর পলাশকে ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া ধরল তারা। হাতে রি’ভলাবার দিয়ে সবাইকে তাক করে রেখেছে এখনো। কোহিনূর আর কিছু বলল না। তারা বিদায় নিতেই কাছে থাকা চেয়ারে জোরে একটা লা’থি মে’রে হুংকার দিয়ে উঠল। ভয়ংকর রেগে উঠেছে আজ কোহিনূর। সকলের দৃষ্টি হয়েছে নত। কোহিনূর চিল্লিয়ে বলে,
“এই প্রথম লক্ষ্যের এতো কাছে থেকেও দূরে সরে আসতে হলো।”

বলেই দেয়ালে থাবা মা’রল কোহিনূর। তারপর বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকল। গলা বেয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে ঘাম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো জড়ো হয়ে টুপ করে থুঁতনিতে এসে থামল। নিজের রাগ সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল অতঃপর। হাফ ছেড়ে কোনোরকমে রাগ সংবরণ করে বলল,
“পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় এখানে টেরো’রিস্ট অ্যা’টাক হয়েছিল। কেউ না মানে কেউ না। কোনো ডক্টরও না। আর স্পেশালি একটা মাথায় রাখো আজিম আর পলাশ! আমি যে সিক্রেট অফিসার এটা যেন কারোর কানে না যায়। আমরা নিজেদের পরিচয় কারণ ছাড়া প্রকাশ করি না। তাই এটা যেন জানতেও না পারে। ডক্টররা বা বাকিরা কিছু জানতে চাইলে বলে দেবে পুলিশ ধারণা করেছিল এখানে টেরো’রিস্ট অ্যা’টাক করবে। তাই তাদের সেফ প্লেসে পাঠানোর চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল।”

কোহিনূরের কথায় আজিম আর পলাশ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত মাথা দুলায়। তাছাড়া আর উপায় কী? এখন পুলিশের লোক যা বলবে সেটাই করতে হবে।

চোয়াল শক্ত করে টেবিলে হাত রেখে সেই হাত মুখ দিয়ে ঢেকে রেখেছে কোহিনূর। রাগটা সংবরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেমন যেন আগুনের লাভার মতো উতলে উতলে উঠছে। আর ইচ্ছে করছে হাতের কাছে যা আছে সব ভেঙ্গেচুরে একাকার করতে। কিন্তু এখানে এসব করা যাবে না। ঘটনাটির এক ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে তবুও নকল রাগিনীকে হাতছাড়া করার বিষয়টা মাথা থেকে যাচ্ছে না তার। ক্রোধ নিবারণ না করেই হাত মুঠো করে শক্ত একটা আ’ঘাত করে বসল টেবিলে। নিজের হাতে ব্যথা পেল কিনা সেটা জানে না কোহিনূর। তবে হাতটা চিনচিন করছে। রায়ানকে ছু’রির আ’ঘাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তার হাতের যেই করুণ দশা হয়েছিল সেই কা’টা জায়গা সবেমাত্র শুকাতে শুরু করেছিল। আবারও যেন তা তাজা হয়ে উঠল। কিন্তু সেদিকে তো তার ধ্যান নেই।
“আর একটু ভালো প্ল্যানিং করতে পারলেই ওকে ধরতে পারতাম। আরো বুদ্ধি খাটাতে হতো আমায়। কিন্তু কে জানত আজকেই এতো দ্রুত সে আমাকে আ’ক্রমণ করতে আসবে!”

কথাগুলো আওড়ে নিজের হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে নেয় কোহিনূর। হাত দিয়ে উপরে ঠেলে দিতেই ফ্লোরে পড়ে থাকা তার রি’ভল’বার চোখে পড়তেই উঠে যায় সেটা তার নির্দিষ্ট স্থানে রাখতে। এতোকিছুর মাঝে এটার কথা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। যদি কারোর চোখে পড়ে হয়ত পজিটিভ ভাববে নয়ত নেগেটিভ। নেগেটিভ ভাবারই সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি। এটা ভাবতে ভাবতেই রি’ভলবার হাতে নিতে নিতে দরজা খোলার ক্যাচক্যাচ শব্দে সেটা হাত ফসকে পড়ে যায়। একটা অদ্ভুত শব্দের সৃষ্টি হওয়ার আগেই দ্রুত পা দিয়ে বেডের নিচে ঠেলে দেয় সেটা। রাগিনীকে দেখে নিশ্বাসটুকু ঘন হয়ে আসে। তড়তড়িয়ে চলতে থাকে হৃদকম্পন। আর একটু হলে কী হতে যাচ্ছিল? এবার বোধহয় লুকোচুরি খেলা ঠিক হচ্ছে না। কোহিনূর কী তবে জানাবে? এখনি জানাবে? ভাবতেই শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। গলার স্বরে দলা পাকালো তখনি। এভাবে চললে জীবনেও সে সক্ষম হবে না। রাগিনীর রিনরিনে কন্ঠে নড়েচড়ে তাকাল কোহিনূর।
“রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছেন যে!”

“ভাবছিলাম মহারাণীর এতো সময় পর ইচ্ছে করল তার প্রজাকে দর্শন দিতে।”

কোহিনূরের এহেন কথায় রাগিনীর খুব হাসি পায়। ঠোঁট টিপে চোখ ছোট করে কোহিনূরের পানে চেয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকে সে। তার এমন নীরব হাসিতেই যেন লুকিয়ে ছিল কোহিনূরের অমূল্য প্রাণ। এই হাসিতেই যেন আঁটকে ছিল তার আঁটকে যাওয়া নিশ্বাস। সে বড় একটা শ্বাস নিল রাগিনীর দিকে অপলক চেয়ে। মনে মনে বলে ফেলল,’চেহারা না হয় নকল করেই ফেলল। তবে সেই হাসি, সেই সরল দৃষ্টি সারাজীবন তপস্যা করলেও নকল করা সম্ভব নয়। সে আমার জীবন্ত কাঠগোলাপ যার শীতলতা ভরা আলাদা ঘ্রাণ আমি সবসময় নিতে পারি আমার সংলগ্নে থাকলেই। ভুল হবে না কখনো তাকে চোখ বুঁজেও চিনত।’

হঠাৎ করেই রাগিনী কেশে উঠল। তারপর বলল,
“কাল আসতে পারিনি। যা অবস্থা হয়েছিল সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার পর। তাই বাড়ির লোক আসতে দেয়নি।”

রাগিনীর কন্ঠ এখনো কিছুটা দুর্বল। কথা শেষ করে আবারও কাশছে সে। তা দেখে এগিয়ে এসে রাগিনীর কপালে হাত ছোঁয়াল কোহিনূর। অতঃপর নির্বিঘ্নে বলল,
“জ্বর তো এখনো আছে। তোমায় এই শরীর নিয়ে আসতে কে বলেছে?”

রাগিনী নীরব রইল কিছু সময়। তারপর হাসিমুখে জবাব দিল,
“আপনিই তো আমাকে মহারাণী বলে সম্মোধন করলেন। আর মহারাণী প্রজাদের কথা সবসময় ভাবে।”

কোহিনূর বুঝে গেল এই মেয়েটার সঙ্গে কখনোই পেরে উঠবে না সে। না কথার ক্ষেত্রে আর না মনের যু’দ্ধে। তার থেকে আগে থেকেই আত্মসমর্পণ করা ভালো হবে। কিছু বলতে উদ্যত হয় কোহিনূর। ফোনের ভাইব্রেশন অনুভূত করে থমকে যায় সে। ফোন ধরতে ইচ্ছে করে না। তবুও যদি জরুরি কোনো বিষয় হয়? তাই সে খাবারের দিকে তাকিয়ে ফট করে বলল,
“আমি এখনো ফ্রেশ হইনি। একটু ওয়েট করো।”

বিলম্ব না করে বাহিরে চলে যায় কোহিনূর। রাগিনী বিছানায় এগিয়ে এসে টিফিনবক্স খুলতে শুরু করে। আজকে সে খিচুড়ি এনেছে। যদিও নিজহাতে রান্না করা নয়। খাবার বের করে চামচ ব্যাগ থেকে বের করতে গিয়ে হাতের নাগালে আসে না তার। না পেরে ব্যাগটা ঝাড়তে গিয়েই চামচ টং শব্দ করে নিচে পড়ে যায় বিছানার কিছুটা নিচে। বিরক্তির শব্দ করে নিচে বসে সেটা হাত দিয়ে তুলতেই চোখে আটকায় চকচকে কোনো বস্তু। বিছানার অনেকটাই নিচে আছে তবুও দিনের আলোয় কিছুটা চকচক করছে। ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলবশত সেখানে হাতাতেই শক্ত একটা জিনিস হাতে আবিষ্কার করে সে। টেনে বের করে ফেলতেই সেটা আপনাআপনি হাত থেকে বের যায়। পেছনে কিছুটা দূরে সরে যায় হাওয়ার বেগে। নিজের চোখ কচলে আবারও দেখার চেষ্টা করে। নাহ, সে ভুল দেখছে না। ক্ষণে ক্ষণে বড় শ্বাস নিচ্ছে সে। মাথা ঘুরে উঠেছে। গলা দিয়ে ঢক গিলতে গিয়েও আঁটকে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে যে কাউকে প্রতিহত করার সবচেয়ে ভয়া’নক অ’স্ত্র। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“রি’ভলবার।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here