গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -২৮+২৯+৩০+৩১+৩২

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৮

“হ্যাঁ, এটা তো অভিরূপের রুম। বাট আপনাকে তো চিনলাম না আঙ্কেল।”

রাশেদ সাহেব প্রশস্ত হাসেন। ভরাট গলায় বলে উঠলেন,
“তুমি নোমান তাইতো? অভিরূপের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু?”

নোমান কিছুটা হতবাক হলো। সে আবারও রাশেদ সাহেবকে মনোযোগের সহিত দেখে নিল। সে তো চেনে না লোকটাকে। তবে লোকটা বেশ স্মার্ট। কথাবার্তা এখনো বেশ স্পষ্ট আর অন্যরকম ঝাঁঝ রয়েছে। রাশেদ সাহেব নোমানের দৃষ্টি দেখে বুঝে নিলেন সে কী ভাবছে। তিনি তৎক্ষনাৎ আগের সুরেই বললেন,
“আমি অভিরূপের বাবার বন্ধু। আমাকে দেখে কি সন্দেহ করছো? আবার নতুন বিপদের আগমন নিয়ে আসা ব্যক্তি ভাবছো?”

নোমানের স্মরণে এলো এবার। গতকাল নাদিম সাহেবের সাথে তার কথা হয়েছিল। তিনি রাশেদ সাহেবের কথা বলেছিলেন। নোমান ঘুমের ঘোরে তা ভুলে গিয়েছে। দ্রুত দরজার সাইডে দাঁড়ালো সে। পথ ছাড়লো। সৌজন্যমূলক হাসি হেঁসে বলে উঠলো,
“সরি আঙ্কেল। আমার আসলে খেয়াল ছিল না। এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ভেতরে আসুন, প্লিজ।”

রাশেদ সাহেব ভেতরে প্রবেশ করলেন। নরম সুরে বললেন,
“ইটস ওকে। এমনিতে যত বড় ঝড় তোমাদের উপর দিয়ে গিয়েছে এমন সতর্ক থাকা ভালো। আমি বোধহয় সকাল সকাল এসে পড়েছি।”

“না, না আঙ্কেল। আপনি ঠিক সময়ে এসেছেন।”

“সেটা তোমার মুখ দেখেই বোঝা গিয়েছে। আর ঘুমন্ত অভিরূপকে দেখেও বুঝতে পারছি।”

নোমানের চোখ এবার চলে যায় অভিরূপের দিকে। ছেলেটা এখনো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। কোনোরকম হুঁশ নেই তার। নোমান নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলো,
“আপনি বসুন। আমি ওকে উঠাচ্ছি। ও একটু অলস ধরনের। তার উপর সারাদিন জার্নি। তাই এখনো ঘুমাচ্ছে।”

রাশেদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে বসেন। নোমান বিছানার দিকে ধাবিত হয়। হাত দিয়ে অভিরূপকে ঠেলে বলে ওঠে,
“এই অভি! সকাল হয়েছে উঠে পড়। রাশেদ আঙ্কেল এসেছেন।”

অভিরূপ হাত দুটো ছড়িয়ে শরীর টানা দিয়ে নোমানের কথায় কোনোরূপ পাত্তা না দিয়ে অন্যদিক ফিরে আবারও নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে থাকল। এই ছেলের ঘুম ভাঙ্গানো বেশ দায়ের। আবার ঘুমের মাঝে নিজের আর নোমানের ইজ্জতের ফালুদা না করে দেয়। নোমান একটু ঝুঁকে হিসহিসিয়ে বলে,
“অভি! একটু চোখ মেলে দেখ। আঙ্কেল এসেছে। রাশেদ আঙ্কেল তোর সাথে দেখা করতে এসেছে। আর তুই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস।”

অভিরূপ এবার সোজা হয়ে ফিরে। স্ট্রেইট শুয়ে আলতো করে চোখ মেলে। নোমান স্বস্তি ছাড়ে এই ভেবে এট লাস্ট ছেলেটা কোনোরকম কান্ড না করে ঘুম ভাঙ্গানো গেল। সে সরে আসার আগেই ফট করেই তার গাল চেপে ধরল অভিরূপ। থতমত খেলো নোমান। চোখটা কপালে উঠে গেল। অভিরূপের চেহারায় কেমন যেন অন্যরকম ভাবসাব। একদম সুবিধার নয়। সে আবার চোখ বুঁজেছে। কেমন যেন মিটিমিটি হাসছে। নোমানকে আরেক দফা চমকে দিয়ে অভিরূপ বেশ মুগ্ধতার সাথে বলল,
“সেই চোখ‌! সেই লুকিয়ে রাখা মুখ। মুগ্ধতায় ঘেরা।”

ঢক গিলে নেয় নোমান। কীসব বলছে এই ছেলে? মাথায় তো কাজ করছে না নোমানের। কার কথা বলছে? অভিরূপ থামে না। আবারও ঘুম জড়ানো কন্ঠেই বলে,
“তুমিই বলো! এটা কি লাভ এট ফার্স্ট সাইট? তুমি কি এসবে বিশ্বাস করো? আমি কিন্তু করি না। তাহলে এটা কি লাভ না অ্যাট্রাকশন?”

নোমান চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে। লজ্জায় পড়ে গেছে। উপর থেকে দড়ি পড়ে না কেন? আর এজগতে থাকতে মন চাইছে না। এই চোখ দিয়ে আর রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাতেও পারবে না। ঠোঁট কামড়ে নিজের রাগ আর লজ্জা দুটোই লুকানোর চেষ্টা করে। অলরেডি ইজ্জতের দফারফা শেষ। নিশ্চয় আঙ্কেল ভাবছে, যে ছেলে ছেলের প্রতি লাভ বা এট্র্যাকশন কি করে হয়? কী বিশ্রী কান্ড! সঙ্গে সঙ্গে কোনোরকম ভাবনাচিন্তা ছাড়াই নোমান তাড়াহুড়ো করে এক থাবা মেরে সরে গিয়ে জোরে বলে ওঠে,
“এই শালা লাভ অ্যাট্রাকশনের বাচ্চা কী শুরু করেছিস কাল থেকে আমার সাথে? চোখ মেলে একবার তাকা। আমি তোর লাভ না অ্যাট্রাকশন বুঝতে পারবি।”

এতো জোরালো কন্ঠ শুনে আর ঘুমে মগ্ন থাকা হয়ে উঠল না। চোখ মেলতে অভিরূপের চোখের সামনে থেকে যেন সেই সাহসী দৃষ্টি হারিয়ে গেল। সেই লুকিয়ে রাখা অপরূপ চেহারাটি কোথাও গা ঢাকা দিল। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে কিছু বুঝতে না পেরে তাল না পেয়ে বলল,
“লাভ অ্যাট্রাকশন? কোথায় লাভ অ্যাটেনশন?”

এবার নোমানের ইচ্ছে করে নিজের কপাল ঠুকতে। দাঁতের কিড়মিড় করে ইশারায় দেখিয়ে দেয়,
“ওই যে তোর লাভ অ্যাট্রাকশন।”

চোখ দুহাতে ডলে সামনে তাকায় অভিরূপ। সোফায় বসে থাকা অর্ধবয়স্ক লোককে দেখে মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আরে এটা কেমন লাভ অ্যাট্রাকশন। দেখে তো মনে হচ্ছে উনি লাভ অ্যাট্রাকশনের শ্বশুর।”

কথাটা নোমানের কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্র দ্রুত অভিরূপের মুখ চেপে ধরে। চাপা সুরে বলে ওঠে,
“চুপ, চুপ। মাথাটা কি তোর একেবারেই গিয়েছে?”

নোমান নিজের দৃষ্টি রাশেদ সাহেবের দিকে আনার চেষ্টা করলে রাশেদ সাহেব তাদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেঁসে বলে ওঠেন,
“ইয়াং ম্যান, কোনো স্বপ্ন দেখছিলে বুঝি? নিশ্চয়ই নোমান ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে তোমার স্বপ্নে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে?”

অভিরূপ এবার ভালো করে বোঝার চেষ্টা করলো। রাশেদ সাহেবকে চেনার চেষ্টা করল। মস্তিষ্কে কিছুটা চাপ পড়তেই তার মনে পড়লো। অনেক আগে একবার রাশেদ সাহেবকে দেখেছিল সে ভিডিও কলে। চেহারা তার এখনো মনে রয়েছে। অভিরূপ দেরি না করে তাড়াতাড়ি ব্ল্যাঙ্কেট রেখে দাঁড়িয়ে নিজের এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে বলল,
“আই এম এক্সট্রিমলি সরি, আঙ্কেল। কী বলতে কী বলে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না। আই নো, আপনি কিছু মনে করতেই পারেন না। দরকার হলে ভেবে নেবেন আপনার কাছে প্রতিদিন যত মানসিক রোগী আসে আমিও ঠিক তেমনি একটা রোগী।”

রাশেদ সাহেব এবার শব্দ করে হেঁসে উঠলেন। অভিরূপের এবার ভালো লাগছে। অন্তত প্রসঙ্গ ঘুরাতে সক্ষম হয়েছে। হাসতে হাসতে রাশেদ সাহেব জবাব দিলেন,
“তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। নো চেঞ্জ।”

অতঃপর তিনি নিজের পাশে বসালেন অভিরূপ এবং নোমানকে। গল্পে মেতে উঠলেন।

আজকের আকাশটা মেঘলা। সাদা আকাশে কালো রঙের এক ধরনের স্নিগ্ধ মেঘের আনাগোনা। আকাশটা থম মে’রে আছে। কখন যেন ঝুম বৃষ্টি নামবে। হঠাৎ করেই বয়ে যাচ্ছে দমকা হাওয়া। জানালার পাশে থাকা চারকোনা টেবিল থেকে সাদা রংয়ের স্বচ্ছ কাগজটি নিচে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একরাশ বিরক্তি জমা হলো কোহিনূর ওরফে নির্জনের মুখে। নিজের ঝুঁকে কাগজটি তুলে নিয়ে হাতে কলম নিয়ে বসলো। প্রায় আধঘন্টা ধরে কালো মেয়ের কালি সে স্বচ্ছ কাগজে লাগানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে মনে আসছে না শব্দ। হাতে পাচ্ছে না জোর। এই পরিকল্পনাটি নয়নতাঁরার। মেয়েটা ছোট হয়ে স্পষ্ট নির্দেশ করেছে যেভাবেই হোক রাগিনীকে সবটা জানাতে। কিন্তু মুখে বলতে গেলে এ জীবনে হয়তো কখনোই তা বলে উঠতে পারবে না কোহিনূর। তাই নয়নতাঁরার বুদ্ধি অনুযায়ী একটা পৃষ্ঠা এবং কলম নিয়ে বসেছে। মেয়েটা মাথামোটা হলেও একটু তো বুদ্ধি বের করতে পেরেছে এটা ভেবেই কোহিনূর আপ্লুত। অনেক ভেবে কলমটা পৃষ্ঠায় ঠেকিয়ে লিখতে শুরু করল কোহিনূর।
‘হয়তো আমি তোমার বিশ্বাসের যোগ্য নই। আমি মানুষটা খুব একটা সুবিধার নই। এই অসুবিধাজনক মানুষ ভয়া’বহ অন্যায় করে ফেলেছে তোমার সাথে। তবে আমার উদ্দেশ্য তোমাকে ঠকানো ছিল না। বিলিভ অর নট! আমি চেয়েছিলাম…”

হাতটা থেমে গেল। অনবরত কাঁপতে থাকলো। কোথাও একটা তোলপাড় সৃষ্টি হলো। মনে হলো এই সামান্য চিঠি দূরত্বের মতো ভয়া’বহ অ’স্ত্র দ্বারা ক্ষ’তবি’ক্ষত করে দেবে এই সুন্দর সময়গুলোকে। বিলীন করবে তার জীবন্ত কাঠগোলাপের হাসিমাখা মুখটাকে।

“কী করছেন আপনি ওখানে সকাল সকাল, কোহিনূর সাহেব?”

বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় চমকে উঠল কোহিনূর। সর্বাঙ্গে যেন তড়িৎ বয়ে গেল। কাগজে নিজের ছোট ছোট লেখাগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। রাগিনীর কাছে এগিয়ে আসার শব্দ তীব্র হচ্ছে। মূহুর্তেই হাতে দুমড়েমুচড়ে ফেলল কাগজটি কোহিনূর। রাগিনী ততক্ষণে টেবিলের বেশ নিকটে। কোহিনূরের এমন কাজে সে বিস্ময় নিয়ে বলল,
“কী করছেন? কী আছে কাগজে?”

চোর চুরি করতে ধরা পড়লে যেমন মুখের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনই এক প্রতিক্রিয়ার ছাপ পড়লো কোহিনূরের মুখে। ভয়ার্ত স্বরে বলল,
“কিছু না। তুমি এতো সকাল সকাল?”

“সকাল সকাল কোথায়? আমি তো এই সময়েই আসি। আপনার হাতে কীসের কাগজ?”

“বললাম তো তেমন কিছু না।”

রাগিনীর মনের খচখচানিটা কমে না। কোহিনূরের চোখমুখে স্পষ্ট এক সংকোচবোধ। সে দেখাতে চাইছে না। তবে রাগিনী দেখবে। দ্রুততার সাথে সে কোহিনূরের হাতের মুঠো থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ফলাফল শূন্য। কোহিনূর নিজেকে সামলাতে না পেরে আবারও ধপ করে বসে পড়ে। হাতটা জোরে মুঠো করে থাকলো। কন্ঠে কাঠিন্য এনে বলল,
“এতো জেদি কেন তুমি, রাগিনী?”

“আশ্চর্য! জেদ আপনি করছেন আর আমাকে বলছেন আমি জেদ করছি। কী এমন আছে কাগজে?”

জেদি সুরে বলে উঠল রাগিনী। নিজের চোখটাও সুদৃঢ় ভাবে রাঙালো। মূহুর্তেই দারুণ লাগলো কোহিনূরের কাছে সেই চাহনি। তবে রাগিনীর এতো সময় নেই। সে জোর কদমে ছাড়িয়ে চলেছে কোহিনূরের হাতের মুঠো। কাগজটা দেখতে হবে মানে দেখতেই হবে। তবে কোহিনূরের সামান্য এক হাতের জোরে কি রাগিনী পারে? পুরুষ মানুষের হাতের জোর সবসময়ই বেশি। অস্বাভাবিক কিছু না। ইতিমধ্যে বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সূচনা হয়েছে। কোহিনূর হাতটা আরো শক্ত করে মুঠো করতেই ক্লান্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রাগিনী। কোহিনূর মৃদু হেঁসে বলে,
“এতো আগ্রহ কেন তোমার?”

“আপনার চোখে ভয় দেখেছি তাই।”

রাগিনীর অকপটে উত্তর। কোহিনূর হাসি প্রসারিত করে নিচু সুরে বলে,
“এটা প্রেম ভয়, মিস. রাগিনী!”

রাগিনীর চোখমুখ কুঁচকে যায়। কথাটা প্রথমেই বোধগম্য হয় না তার। পরক্ষণেই চোখেমুখে নেমে আসে কিছু লজ্জার আঁধার। কেমন যেন থম মেরে যায়। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল,
“প্রেম ভয়? মানে?”

“এই কাগজ পড়লে আমার সর্ব’নাশ হয়ে যাবে।”

“কেন?”

“কারণ এখানে জম্পেশ একটা প্রেমপত্র লিখেছি।”

বেশ উৎসুক হয়ে উত্তরে বলল কোহিনূর। আগ্রহী হলো রাগিনীর প্রতিক্রিয়া জানতে। রাগিনীর মুখশ্রী দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ কঠিন ভাবনায় ডুবেছে। মুখটায় তাজ্জব ব্যাপারটা এসেছে। কিছুক্ষণ সে মৌনতা অবলম্বন করার পর বলল,
“আপনার প্রেমিকা ছিল বুঝি?”

রাগিনীর ব্যথিত সুর। কোহিনূর যেন আরো দ্বিগুন ব্যথিত সুরে বলল,
“ছিল না। আছে বর্তমানে। খুব নিষ্ঠুর সে। একেবারে হৃদয়হীনা।”

“হৃদয়হীনা কেন?”

কিছুটা মলিনতা কণ্ঠে থাকলেও যোগ হলো বিস্ময়। কোহিনূর কিছু বলতে চাইতেই রাগিনী আগেই দম ফেলে বলে দিল,
“থাক। শুনবো না আর। আপনার প্রেমিকার কথা প্রাইভেট রাখুন।”

“কেন কেন? এক্ষুনি তো শুনতে চাইছিলে।”

রাগিনীর মলিনতায় পরিপূর্ণ মুখটার দিকে একনজরে চেয়ে জিজ্ঞেস করল কোহিনূর। রাগিনী কিছুটা তেতে জবাব দিল,
“অন্যের প্রেমিকার কথা শোনার ইচ্ছে নেই।”

বৃষ্টিটার গতি জোরালো হয়েছে। এই ভ্যাপসা গরমে হুটহাট বৃষ্টি একটু হলেও মনে শান্তি জাগায়। বর্ষার সময় অথচ বৃষ্টির নামগন্ধও ছিল না এতোদিন। এখন বৃষ্টি পেয়ে যেন আনন্দে মেতেছে প্রকৃতি। তৃষ্ণার্ত শহর ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে। সেখানকার এক নামি-দামি দালানকোঠার এক ছোট্ট ঘরে বসে থাকা নারীটির মনের আকাশেও নেমে এসেছে কালো রঙয়ের মেঘ। সেই মেঘের প্রতিটি অণুতে সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত অভিমানের। যার কোনো অর্থ নেই। কিছু জিনিস অর্থহীন তবুও মনের মাঝে জমে থেকে যায়।

কোহিনূর হাতের মুঠো আস্তে আস্তে করে খুলল কাগজটার অবস্থা করুণ। তবে এখনো ছিঁড়ে যায়নি। রাগিনীর আর হেলদোল নেই কাগজের প্রতি। সে বিছানায় বসেছে স্থির হয়ে। জানালায় তাকিয়ে আছে তো আছেই। অন্যকোনো দিকে তার ধ্যান নেই। মুখে নেই উচ্ছ্বাস। কোহিনূর আর কিছু না ভেবেই জানালার দিকে ছুঁড়ে মা’রল কাগজটি। নিশ্চয় বৃষ্টিতে কাগজটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!

রাগিনীকে উঠে দাঁড়াতে দেখে চকিতে তাকায় কোহিনূর। বরাবরের মতো টিফিনবক্স এগিয়ে দিয়ে গম্ভীর সুরে বলে,
“খেয়ে নিন। চিন্তা করবেন না আজকে দশ পদের খাবার নিয়ে আসিনি।”

রাগিনী বাহিরের দিকে পা বাড়ায়। কোহিনূর পিছু ডেকে অস্থিরতার সাথে বলে,
“কোথায় যাচ্ছো? বাহিরে তো বৃষ্টি।”

“বৃষ্টি দেখতেই তো যাচ্ছি। বৃষ্টি নাকি সবকিছু মুছে দেয়। নিশ্চয় অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসগুলোও মুছে দিতে পারবে।”

আর বিলম্ব করলো না রাগিনী। প্রস্থান ঘটল তার। তার আক্রোশ ভরা কন্ঠ অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিয়ে গেল কোহিনূরকে। মেয়েটা এমন করলো কেন? ‘প্রেমিকা আর প্রেমপত্র’ এই দুটো শব্দটিতে বুঝি তার অভিমানের সৃষ্টি হয়েছে? হলেও বা কেন হলো? কিছুক্ষণ নিরব থেকে স্মিত হাসলো কোহিনূর।
“এতো কীসের অভিমান আমার উপর তোমার মিস. রাগিনী? দিন দিন বড্ড অভিমানিনী হয়ে চলেছো তুমি। অভিমান ভাঙানোর দায়িত্ব বুঝি একান্ত আমায় দিয়ে রেখেছো?”

চায়ের টঙ এর সামনের ছাউনির একটা ছোট্ট সিটে বসে রয়েছে রাগিনী। চাওয়ালা চা বসিয়েছে। রাগিনী ছাড়া বর্তমানে কোনো কাস্টমার নেই। কানে ভেসে আসছে বৃষ্টির পড়ন্ত শব্দ। ভুবন জুড়ে যেন শীতলতার ছায়া। রাস্তাটা জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। হুটহাট করে বড় বাস বা ট্রাক চলে যাচ্ছে শাঁই শাঁই করে। রাগিনী নিরব রাস্তায় পানে চেয়ে। মনে লেগেছে বিষণ্ণতার ছোঁয়া। সেই বিষণ্ণতা কাটানোর মতো নয়। চির বিষণ্ণতা যেন কাটে না। কারণ এই মূহুর্তে তার কোনোরকম প্রতিষেধক তৈরি হয়নি। হয়তবা হবারও নয়। চাওয়ালার কন্ঠে ধ্যান ভাঙে রাগিনী। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“চা কি এখনি দিমু?”

“হ্যাঁ দেন।”

বলেই আবারও মৌনতা রাগিনীর। কোন যেন বইয়ে পড়েছিল বৃষ্টিভেজা দিনে এক চায়ের টঙে বসে মাটির চায়ের ভাঁড়ে বসে হালকা চায়ের চুমুক এবং পাশে প্রিয় মানুষ থাকা মানে এক অদ্ভুত সুখানুভূতি। রাগিনীর কাছে সবটাই উপস্থিত। শুধুমাত্র প্রিয় মানুষটি বাদে।

রাগিনীর পাশে চায়ের ভাঁড় রেখে গেল চাওয়ালা। রাগিনীর হেলদোল হলো না। মুখে এসে বৃষ্টির পানির ছিটা লাগতেই চোখমুখ বন্ধ করে নিল সে। মুখে ভরে গেল বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটায়। চোখ খুলে চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে একটা চুমুক দিল সযত্নে। হঠাৎই ঘটল এক আগন্তুকের আগমন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছুটে এসে রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসল সেই আগন্তুকটি। আধভেজা বাহুর ছোঁয়া লাগতেই হকচকিয়ে উঠল রাগিনী। মূহুর্তেই তার হাত থেকে ছোঁ মে’রে কেঁড়ে নিল চায়ের ভাঁড়। দেরি না করে চটপট নিজের ঠোঁট লাগলো চায়ের সেই ভাঁড়ে। সেই চেনা আগন্তুকটির হাত থেকে চায়ের ভাঁড় তড়িঘড়ি করে নিলো রাগিনী। এক নিঃশ্বাসে বলল,
“কী করছেন? আমি মুখ লাগিয়েছিলাম এতে।”

মানুষটি বিস্তর হেঁসে জবাব দিল,
“ওহ হো! সেকারণেই বোধহয় চায়ে বেশি মিষ্টি লাগলো। আমার ডায়বেটিস হওয়ানোর পরিকল্পনাও করে ফেলেছো তুমি? কী ভয়ানক!”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯

“আমি তো আপনাকে আগ বাড়িয়ে চা খেতে বলিনি। আপনি স্বেচ্ছায় আমার মুখে দেওয়া এঁটো চায়ের ভাঁড়ে মুখ দিলেন।”

কোনমতে রাগটা দমিয়ে গমগমে সুরে বলে উঠলো রাগিনী। তার কথার ধরন বেশ ঝাঁঝালো বুঝে কোহিনূর মুচকি হাসলো। এত রাগ কেন করছে মেয়েটা? নাকি এটা অভিমানের প্রতিচ্ছবি? যদি তাই হয় মেয়েটিকে তো আরো বেশি করে অভিমানিনী করতে হবে। তারপরে ঝট করে ভেঙে দেবে সেই অভিমান। হুট করে বরফের ন্যায় গলে যাবে সেই পাহাড় সমান অভিমান। বিষন্ন মুখশ্রীতে যখন ফুটে উঠবে আকাশ সমান বিস্ময়। কোহিনূরের কাছে অসামান্য এবং অষ্টম আশ্চর্যের মতো লাগবে দৃশ্যটি। বিমোহিত হয়ে চেয়ে থাকবে সেই মুখের দিকে। বৃষ্টির ঝাপটা আবারও ছুঁয়ে গেল রাগিনীকে। সামান্যতম হেলদোল হলো না তার। কোহিনূর ঠেস মেরে বলল,
“এত সুন্দর চায়ের লোভ সামলাতে পারিনি। কে জানতো তুমি আমাকে ডায়াবেটিস ধরানোর প্ল্যানিং করে রেখেছো!”

“আজেবাজে বকবেন না। আপনাকে এখানে আসতে কে বলেছে?”

“কেউ আসতে না বললে বুঝি আসতে পারব না?”

রাগিনীর গা জ্বালিয়ে দিচ্ছে এবার কোহিনূরের প্রতিটা কথা। কাঁটার মতো এসে খোঁচাচ্ছে কথাগুলো। তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় সে। চাপা রাগি সুরে বলে ওঠে,
“কেন পারবেন না? তবে আমার পাশ ঘেঁষে বসবেন না খবরদার। থাকুন আপনি। এখানেই বসে থাকুন। আমার পিছু পিছু আসবেন না বলে দিচ্ছি।”

কথাটুকু বলে আর দেরি করলো না রাগিনী। হনহনিয়ে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝেই অগ্রসর হলো সে। কোহিনূর কোনোরূপ অস্থিরতা না দেখিয়ে বড্ড শান্ত গলায় বলে উঠলো,
“চা কি আমার জন্য দিয়ে গেলে? নো প্রবলেম, এই মিষ্টিটা আমার পছন্দ হয়েছে।”

ঘাড় ঘুরিয়ে ঝাঁঝালো দৃষ্টিতে তাকালো রাগিনী। তখনই পিছে ফিরে এসে কোহিনূরের হাত থেকে চায়ের ভাঁড় একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
“লজ্জা করে না অন্য মেয়ের এঁটো জিনিস খেতে?”

“ওমা লজ্জা করবে কেন? এমনিতে ছেলেদের লজ্জা একটু কমই হয়। উপরন্ত কোহিনূর সাহেবের লজ্জা আরো কম।”

“আসলেই আপনি একটা লজ্জাহীন মানুষ। তার সাথে ঠকবাজও। একে তো এখানে আমার চায়ের এঁটো খাচ্ছেন তার উপর আপনার প্রেমিকাকে প্রেমপত্র লিখছেন‌।”

কোহিনূর কোনোমতে নিজের হাসি চেপে রাখলো। ঠোঁট টিপে বাধ্য ছেলের মত কথাগুলো শুনলো। রাগিনী আবারো কড়া কন্ঠে ঝেড়ে উঠলো,
“আপনি অন্য মেয়ের পাশ ঘেঁষে বসছেন। তার মুখ লাগানো খাবার খাচ্ছেন এটা জানলে আপনার প্রেমিকার খারাপ লাগবে না?”

নিরব রইলো কোহিনূর। বৃষ্টির ঝাপ্টা ছুঁয়ে গেল দুজনকেই। কোহিনূর নিজের হাত দুটো আড়ষ্ট করে বলল,
“অবশ্যই খারাপ লাগবে। কিন্তু যেই নারীর চায়ের চুমুকে আমি চুমুক দিয়েছি সে-ই নারীই যদি কাঙ্ক্ষিত প্রেমিকা হয় তবে আমার মনে হয় তার থেকে দ্বিগুন ভালো লাগবে।”

রাগিনী সরু চোখে তাকালো। কথাটা যেন মাথায় উপর দিয়ে গেল। প্রথমেই বোধগম্য হলো না। কিছুটা সময় নিয়ে ভাবতেই যেন রাগিনীর মাথা থেকে পা অবধি এক অসামান্য তরঙ্গ বয়ে গেল। তার কান কি ভুল শুনেছে? নাকি সে আবারও হ্যালুসিনেট করছে? তার চোখের একদম কাছে হাতের চুটকি বাজতেই হকচকিয়ে উঠলো রাগিনী। কোহিনূর ইতিমধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার থরথর করে কেঁপে ওঠে রাগিনী। মানুষটির চোখের দিকে তাকানো মুশকিল হয়ে যায়। সামান্য কিছু কথা! সামান্য কয়েকটা শব্দ তার মনের সব রাগ-ক্ষোভ, অভিমানের পাহাড় মূহুর্তেই লজ্জার এক পুরো শহরে রূপান্তরিত করে ফেলেছে। তবে কি এই মানুষটাও তাকে নিয়ে ভাবে? মানুষটার মনের মধ্যে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছে? তবে তার রূপ নিয়ে যে সন্দেহ? সেটার কী হবে? সন্দেহ করা কি বৃথা? সে কি ভয়ানক ভুল করছে? হতে কি পারে না সামান্য ট্রিটমেন্ট আর মেডিটেশনে ইমপ্রুভ? উহ্, না। রাগিনী যে ফাইলে পড়েছিল এমন পেশেন্টদের সুস্থতা অনেকটা পরের কথা!
“ওহ হ্যালো ম্যাডাম! এতোক্ষণ রেগেমেগে মুখে যা আসছিল তাই তো বলে যাচ্ছিলেন। এখন একদম সাইলেন্ট মুডে চলে গেলেন? আর শুধু শুধু বেচারা চায়ের ভাঁড়টা হাতে ধরে রেখেছেন। খাবেন না তো আমার হাত থেকে নেওয়ার কী দরকার ছিল? দেখিই আমি খেয়ে উদ্ধার করে ফেলি!”

বলেই চায়ের ভাঁড় আবারও ছোঁ মে’রে নিয়ে নিলো কোহিনূর নিজের কবলে। এতটুকু সময়ের এই ঠান্ডা মরশুমের দৌলতে চা প্রায় ঠান্ডা। মুখে দিয়ে এক ঢকে চা শেষ করল কোহিনূর। রাগিনী তখনও নিরব। সামান্য কিছু কথা যে একটা অগ্নিকান্ডকে এভাবে বরফের ন্যায় শীতল করে তুলবে সেটা ভাবনায় আসেনি কোহিনূরের। হঠাৎই নিরবতা ভেঙে তাকে চমকে দিয়ে রাগিনী বলল,
“একটু আগে যা যা বলেছিলেন সেটা কি আপনি ভুল বলেছেন? নাকি আমি ভুল শুনেছি?”

নিজের ছোট দাড়িভর্তি গালে হাত রেখে রাগিনীর সমান হতে একটু নিচু হয়ে বলল,
“আপনি তো ঠিক কথা বলেছি। তুমি কানে ভুল শুনেছো কিনা সেটা তো আমি জানি না।”

“আপনি মানুষটা বড্ড হেয়ালি করেন? এতো হেয়ালি কীসের?”

“তোমার কি মনে হয়? আমার মতো এতো জটিল, কঠিন, অসহ্য লোক যে অন্যকে জ্বালাতে এক ইঞ্চিও ছাড় দেয় না তাকেও কেউ ভালোবাসতে পারে? তারও কোনো প্রেমিকা থাকতে পারে?”

“সে যদি চায় তাহলে থাকতেই পারে। কোনো উদ্ভট মেয়ে তার প্রতি মুগ্ধ হতেই পারে। হতেও তো পারে এই জ্বালিয়ে রাখা আচরণটাই সেই মেয়েটির বড্ড প্রিয়!”

কোহিনূর সোজা হয়ে দাঁড়াল। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ল। নিচু সুরে জবাব দিল,
“কেন? এটাও বুঝি কারোর পছন্দ হতে পারে? তোমার বিরক্ত লাগে না? অসহ্য লাগে না আমায়? কখনো মনে হয় না? যে তোমার মতো হুবহু দেখতে কেউ থাকলে তাকে তোমার জায়গায় আমায় সামলাতে পাঠিয়ে দিতে?”

শেষ কথাগুলো অদ্ভুত লাগলো রাগিনীর কাছে। বৃষ্টির থামাথামি নেই। ইতিমধ্যে সে কাকভেজা। নিজের ক্রোধে নিজেই ডুবে বৃষ্টিতে ভিজেছে। কোহিনূর চেয়ে রয়েছে তার উত্তর পেতে চাতক পাখির মতো। সে যে কৌশলে রাগিনীর জমজ কোনো বোনের কথা জানতে চাইছে সেটা রাগিনী বুঝেছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাগিনীর অদ্ভুত লাগলেও খুব একটা বেশি গভীরে নিয়ে গেল না ব্যাপারটাকে। কারণ মানুষটার অদ্ভুত সব প্রশ্নের সম্মুখীন তো প্রথমবার হয়নি। নিজেকে ধাতস্থ করে কিছুটা শক্ত গলায় বলল,
“আপনি রাগিনী তাজরীনকে আপনার সামনে দেখতে চান? নাকি রাগিনী তাজরীনের মতো যে কাউকে?”

রাগিনীর কাছে পাল্টা প্রশ্ন শুনে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে রইল কোহিনূর স্থিরভাবে। মেয়েটার মুখে যেন সোজা কোনো কথা আসেই না। তবে উত্তর দিতে দেরি করল না কোহিনূর। অনর্গলভাবে বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীন তো আর পৃথিবীতে দুটো নেই। সে একজনই। তার এই কোমল চোখের দেখা অন্য কোনো নারীর চোখে মিলবে না। তার অন্তরে থাকা সেই নম্র মন আমার কাছে এতোটাই মূল্যবান যে তার কাছে সব ফিকে পড়ে যায়। তার সেই ফিক করে হাসিটাও যেন সমস্ত অপরূপ গোলাপের মাঝে থাকা এক অপরূপা গোলাপ। যেটা মেলে ফুটলে নেত্রপল্লব সেখানেই স্থির হয়ে যায়।”

বলে কথার মাঝে থামে কোহিনূর। একটা বড় শ্বাস নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। এতোক্ষণ বিমোহিত হয়ে কথাগুলো শুনলেও কোহিনূরের এমন দুষ্টু মাখা হাসিতে চোখ ছোট করে তাকায় রাগিনী। কোহিনূর আবারও বলে ওঠে,
“সবথেকে বড় ব্যাপার যেটা রাগিনী তাজরীন ছাড়া অন্য কারোর মধ্যে থাকতেই পারে না। সেটা হচ্ছে, কাউকে সুনিপুণ এবং যত্নসহকারে খাইয়ে মা’রার পরিকল্পনা। যেটা রাগিনী তাজরীনের মাথা ছাড়া অন্য কারোর মাথায় এই জটিল বুদ্ধি আসতেই পারে না।”

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো রাগিনী। আর কত খোঁটা দেবে এই পাঁজি লোক? ভয়ানক এক চোখ রাঙানি দিয়ে খানিকটা তেড়েফুঁড়ে যেতেই কোহিনূর আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ঝুম বৃষ্টির মাঝেই ছুট লাগালো মাঝ রাস্তায়। রাগিনীও কম যায় কীসে? সে চিল্লিয়ে বলে উঠল,
“দাঁড়ান বলছি! ওখানেই দাঁড়ান! ভালো হবে না কিন্তু।”

কে শোনো কার কথা। বৃষ্টিতে দুজনেই ছুটছে। কোহিনূর আগে নিজেকে চোখ রাঙানি থেকে বাঁচতে ছুটছে আর রাগিনী রেগেমেগে তার পেছন পেছন। এদিকে কংক্রিটের বানানো রাস্তা নেই। রাস্তা হয়েছে কাঁদায় পরিপূর্ণ। বেশি জোরে ছুটতে গিয়ে একসময় ধপাস করেই আলুথালু হয়ে পড়ল কোহিনূর। কাদায় মাখামাখি হলো তার শরীর। এখনি পড়তে হলো তাকে? একরাশ বিরক্তি নিয়ে যখন উঠতে যাবে তখন তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো যেন মোহনীয় হাসির সুর। মাথা উঁচু করতেই নেত্রপল্লবের মণি নামক অংশে যেন আঁটকে গেল সেই হাসির সুর সৃষ্টি করা মানবী। খিলখিল করে হাসছে রাগিনী। তার কাছে মনে হচ্ছে যেন কোনো আট-দশ বছরের বাচ্চা খেলতে গিয়ে লাফিয়ে কাঁদায় পড়েছে। কোহিনূরের মুখে না চাইতেও হাসি চলে আসে। জোর করে ঠোঁট যেন আপনমনে প্রসারিত হয়। বৃষ্টিতে ছিপছিপে গড়নের মেয়েটির গায়ে জামা লেগে গেলেও নিজেকে বেশ সামলে রেখেছে সে। ওড়না দিয়ে নিজেকে বেশ পেঁচিয়ে রেখেছে। লম্বা চুলগুলো চারিপাশে এলোমেলো হয়ে টপটপ করে পড়ছে চুলের আগা দিয়ে পানি। চিকন ঠোঁটে টপটপ করে পানি পড়তেই যেমন মনে হচ্ছে গোলাপি রঙের পদ্মফুলে পানির ছিটা এসে পড়ছে। এ যে কোহিনূরের কাছে নেশার চেয়েও ভয়ঙ্কর। এ নেশা কাটার নয়। এই নেশা দিন যাবে আরো আঁকড়ে ধরবে কোহিনূরকে। তিলে তিলে প্রগাঢ় হয়ে উঠবে।

“তাহলে? আমার বাড়িতে তোমরা দুজন যাচ্ছো ইটস ফাইনাল!”

চকিতে একে অপরের দিকে তাকায় নোমান এবং অভিরূপ। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। মুখচোখ ফুলে আছে নিশ্চিত। দুজনেই চোখ ঢলতে থাকল। অভিরূপ জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,
“এতো কষ্টের কী দরকার বলুন তো আঙ্কেল। আমরা আছি এখানে ভালোই। দরকার হলে প্রতিদিন আপনার সঙ্গে একবার করে দেখা করে আসবো। কিন্তু আপনাকে এতো কষ্টে ফেলতে চাই না।”

রাশেদ সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুচকি হাসেন। উনি বেশ বুঝতে পারছেন অভিরূপ যেতে চাইছে না। তার মূল কারণ হতে পারে ঘোরাফেরা! অভিরূপ ছেলেটা নিজের মতো চলছে স্বাচ্ছন্দ্যবোদ করে সেটা উনি তার বন্ধু নাদিমের থেকে শুনেছে। অভিরূপ হয়ত ভাবছে রাশেদ সাহেবের বাড়িতে গেলে ইচ্ছেমতো যখন তখন বের হতে পারবে না। রাশেদ সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
“আমার কষ্ট আর কীসে? আমি ব্যস্ত মানুষ। তোমাদের সঙ্গে সময় কাটানো হবেই মাত্র রাতের সময় আর সকালটা।”

“তাহলে আমরা দুজন গিয়ে একা একা আপনার বাড়িতে আঙ্কেল সারাদিন? তাছাড়া আপনি একা একটা মানুষ। আমরা গেলে আপনার প্রেশার পড়ে যাবে। তাই না?”

রাশেদ সাহেব থেমে থেমে বললেন,
“আমি একা আর কোথায়? তোমাদের সঙ্গী দেওয়ার জন্য আমার মেয়ে রাগিনীও আছে। ও থাকলে আমার কষ্ট কীসে?”

থমকে গেল অভিরূপ। কপাল কুঁচকে গেল। বোঝার চেষ্টা করলো সে সঠিক শুনলো নাকি ভুল? ‘রাগিনী’ নামটি বুঝি তার মনেই গেঁথে গিয়েছে? যে এখন রাশেদ সাহেবের মুখ থেকেও রাগিনী নামটি শুনতে পাচ্ছে? সে নিশ্চিত হবার জন্য আরো উৎসুক হয়ে বলল,
“আপনার মেয়ে রাগিনী?”

“হ্যাঁ। তুমি হয়ত ভুলেই গেছো। এমনিতেও আমাদের খোঁজখবর রাখো না। আমার মেয়ে তো আছেই। যদিও আর কয়েকদিনের জন্য। পরিক্ষার পর ছুটি পেয়ে বাবার কাছে চলে এসেছে। এখন তো বাড়িতেই আছে রাগিনী।”

মাথা টলমল করে ঘুরে উঠল অভিরূপের। মনে বাগড়া দিল টান টান উত্তেজনা। তৎক্ষনাৎ নোমানের দিকে হেলে পড়লো সে। ফিসফিস করে বলল,
“এই আমাকে একটু ভালোবেসে চিমটি কাট তো।”

নোমান আঁড়চোখে তাকায়। মাঝে মাঝে ছেলেটার ভাবভঙ্গি বোধগম্য হয় না। অভিরূপের হাত বাড়ানো দেখে সেও সুযোগ বুঝে জোরে দিয়ে ওঠে এক চিমটি। চোখমুখ জড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে হাত টেনে কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে অভিরূপ বলে,
“তোর ভালোবাসা এতো কঠিন কেন ভাই? মেয়ে জুটবে না তোর কপালে। মিলিয়ে নিস।”

“তখন তোর বউকে নিজের বউ বানিয়ে নেবো। নো প্রবলেম।”

সহজভাবে উত্তর দিয়ে সোজা হয়ে বসে নোমান। বিস্ফোরিত নয়নে অভিরূপ তাকাতেই রাশেদ সাহেবের কথায় তড়িঘড়ি করে নিজেকে সামলে সামনে তাকায় সে।
“তোমরা আমার বাড়িতে না গেলে আমার কাছে বিষয়টা অনেক দুঃখজনক হয়ে দাঁড়াবে। অনেক আশা নিয়ে এসেছি আজ।”

নোমান বাঁকা চোখে অভিরূপের দিকে তাকালো। সে তো প্রথম থেকেই যাবে না যাবে না করছে। নিশ্চয় ছেলেটা যাবেই না। তাই সে সিদ্ধান্ত নিলো রাশেদ সাহেবকে ভালো করে বোঝাবে। তাই নিজের ভাবনা মতো কিছু বলতে উদ্যত হতেই অভিরূপ তড়িঘড়ি করে একপ্রকার উল্লাস নিয়ে বলে ওঠে,
“আপনি আমার বাবার মতো হন। আপনাকে আশাহত কিছুতেই করতে পারি না আঙ্কেল। তাই আমরা অবশ্যই যাব। আপনার কথা ফেলতেই পারি না।”

নোমান হতবিহ্বল। মুখে কোনো ভাষা নেই। এই অভি কতবার নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টাবে? অভিরূপ আবারও বলল,
“তবে হ্যাঁ। আমরা রাতে যাব। একটু ঘোরাফেরা মানে বুঝছেন তো আঙ্কেল…”

বলেই ঠোঁট প্রসারিত করে হেঁসে বলল অভিরূপ। রাশেদ সাহেব মাথা নাড়িয়ে বলল,
“সবই বুঝলাম। বাট সাবধানে বাহিরে ঘোরাফেরা করো। এমনিতেই যা গেল তোমাদের উপর দিয়ে। আমি আসি। অলরেডি আই এম লেট। আপনাকে চেম্বারে যেতে হবে।”

কোনোরকমে নিজের উল্লাসটা চেপে রেখে রাশেদ সাহেবকে বিদায় জানালো অভিরূপ। দরজাটা লাগাতেই দৌড়ে এলো সে নোমানের দিকে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাতেই নোমানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো অভিরূপ। নোমানের গালটা ধরে একটা চুমু খেয়ে লাফিয়ে বলে উঠল,
“সুইটহার্ট, প্রে ফর মি! যেন সে-ই মেয়েটাই হয়।”

নোমান চোখমুখ জড়িয়ে তাকালো। হাতের কনুই দিয়ে অভিরূপকে গুঁতো মে’রে সরিয়ে নিজের গালটা সযত্নে দুহাতে মুছে বলল,
“অসভ্য! একে তো ব্রাশ করিস নি সেই মুখ আমার গালে লাগাস। ছি! কী গন্ধ! আমার বউ এসব শুনলে জীবনেও আর চুমু খাবে?”

নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে নোমানকে আবারও ফ্লায়িং কিস ছুঁড়ে মা’রল অভিরূপ। আর আনন্দিত হয়ে বলল,
“ওটা ভালোবাসার গন্ধ মনে করে নে।”

নোমান ফুঁসে উঠে জিজ্ঞেস করল,
“আর কোন মেয়ের কথা শুনে মনে গিটার বাজছে তোর? মানুষ থেকে বাঁদরও হয়ে গেছিস একেবারে।”

অভিরূপ বেশ ভাবুক সুরে উত্তর দিল,
“সেই মেয়ে! সেই চমৎকার সাহসী চাহনির মালকিন!”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০

চারিপাশ বিরাজ করছে নিরবতা। লোকজন থাকা সত্ত্বেও সকলে গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে রয়েছে সোজা হয়ে। জায়গাটা পুলিশ হেডকোয়ার্টার। নির্জন ওরফে কোহিনূরও সেখানে উপস্থিত। গায়ে জড়ানো বরাবরের ন্যায় কালো ইউনিফর্ম। চুলটা এখনো ভেজা। কপালে নেতিয়ে কপাল নামক অঙ্গটি পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে। মাঝে মাঝে নাক ঘষছে। এই ঘষাঘষির ফলে লাল টকটকে হয়েছে নাক। চোখ দুটো আগের থেকেই লাল। বদ্ধ ঘরে এসির ঠান্ডা বাতাস সহ্য হচ্ছে না। শুষ্ক ঠোঁটজোড়া তিরতির করে কাঁপছে। হাত দুটো মুঠো করে কোটের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছে। বড়সড় এই হলরুমে সকলের মুখে জড়তা। নির্জন খুব একটা এদিকটা আসে না। কিন্তু আজকে গোল টেবিল বৈঠক। সকল বড় বড় পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে সকলকেই ডাকা হয়েছে। নির্জনও তার মাঝে একজন। তার মাঝে নয়। সে-ই তো এখন এখানকার মূল আকর্ষণ। কারণ যে কেস নিয়ে বৈঠক হবে সেটা তো নির্জনের হাতেই রয়েছে। সকলের গাম্ভীর্যের সাথে তাল মিলিয়ে নির্জন নিজেও চুপচাপ থাকার চেষ্টা করলেও তা আর হয়ে উঠল না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করার পরেও উচ্চস্বরে হাঁচি দিয়ে উঠল সে। নাকের ভেতর যেন মনে হচ্ছে কেউ সুড়সুড়ি দিয়ে চলেছে। হাঁচি দিয়েই চোখ মেলতেই নির্জন দেখলো বর্তমানে সকলের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়েছে সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে সকলের দৃষ্টি নির্জনের দিকে স্থির। ঢক গিলে জোরপূর্বক হাসি দিতেই হলরুমের শেষ প্রান্তের দরজা খুলে প্রবেশ করল কেউ। সকলের দৃষ্টি তখনি সরলো নির্জনের থেকে। নির্জন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তবে যে এসেছে তাকে ধন্যবাদ দিলে মন্দ হয় না। এই কড়া কড়া দৃষ্টি থেকে বাঁচার আনন্দে ধন্যবাদ দেওয়াই যায়। সেও এবার সকলের মতো দেখতে দরজার পানে তাকালো কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দেখতে। দেখেই কপালে পড়ল পরপর তিনটে ভাঁজ। চোখ সরিয়ে হতাশা নিয়ে বিরবির করে বলল,
“তাকে আর ধন্যবাদ? ইম্পসিবল!”

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করতেই এসির ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা গায়ে লাগে রায়ানের। তার বাম হাতটা তার শেখর এসিস্ট্যান্ট অফিসার শেখর ধরে রেখেছে। রায়ানের পায়ের ক্ষতটা এখনো অনেকটাই তাজা। হাঁটতে গেলেই যেন একটা করে অভাবনীয় যন্ত্র’ণার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। তবুও দরকারি মিটিং! এখানে তাকে আসতেই হবে। এসপি স্যার নিজে কল করেছিলেন। তবে এটাও বলেছিলেন বেশি সমস্যা হলে আসতে হবে না। কিন্তু কেসটার সঙ্গে সে নিজেও জুড়ে আছে। তাই জোর করেই এসেছে একপ্রকার রায়ান। তাকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে রাখা নির্জনের পাশেই খালি চেয়ারে আস্তে করে বসিয়ে দেয় শেখর। ভালোমতো বসে রায়ান শেখরের উদ্দেশ্যে বলে,
“এখন যাও তুমি। আমার কোনো সমস্যা হবে না।”

শেখর সম্মতি জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান করে। আস্তে আস্তে করে রায়ানের পাশ ফিরে তাকায় নির্জন। চোখটা বড় করে রায়ানের পা থেকে মাথা পর্যবেক্ষণ করে কিছুটা খোঁচা মে’রে বলে,
“আপনি কাজকে ছাড়লেও কাজটা যেন কিছুতেই আপনাকে ছাড়তে চায় না ইন্সপেক্টর রায়ান।”

রায়ান স্মিত হাসে। নির্জনের কোনো কথা আর তেমন গায়ে লাগে না তার। অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ছেলেটা যেন এমনই। রায়ান হাসিমুখেই উত্তর দেয়,
“কী করবো বলুন? কাজের সাথে আমার গভীর কানেকশন আছে। যেমন আপনার সঙ্গে গভীর রাতের কানেকশন আছে ঠিক সেইরকম।”

টনক নড়ে নির্জনের। ভ্রু কুটি কুঁচকে যায়। বেশ উৎকন্ঠা হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“মানে? হোয়াট ডু ইউ মিন?”

“মানেটা খুব সিম্পল! আপনি কি গভীর রাত ছাড়া অন্যসময় হসপিটালে আমাকে দেখতে আসতে পারেন না? আমি যখন ঘুমে মগ্ন তখন আপনার আবির্ভাব ঘটে। চোরের মতো উঁকি দিয়ে দেখেন আমার কেবিনে। অন্যসময় কি হসপিটাল নামক জিনিসটার সঙ্গে আপনার এলার্জি আছে?”

তব্দা লেগে হা হয়ে যায় নির্জনের মুখ। বাকহারা হয়ে নিষ্পলক চোখে চেয়ে থাকে রায়ানের দিকে। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলেও বিস্ময় কমে না তার। আশ্চর্য তো! রায়ান কী করে জানলো এইসব কথা? কী করে জানলো সে তাকে রাতে দেখতে যায়? সে যাতে না জানতে পারে সেকারণেই তো এমন চোরের ভঙ্গিমায় রাতে দেখতে যাওয়া। সে-ই কিনা ধরে ফেলল? এটা কি ঠিক হলো? মুখটা কাঁচুমাচু করে নির্জন কিছু না জানার ভঙ্গি ধরে উত্তর করে,
“রিয়েলি! আপনি দিন দিন ইনভেস্টিগেট করতে করতে নিজে গল্পও বানাতে শিখে গিয়েছেন। আই থিংক আপনার রাইটার হওয়ার উচিত ইন্সপেক্টর রায়ান!”

বলেই হু হা করে হাসার চেষ্টা করে সে। রায়ান মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু সুরে বলল,
“সেটাই হবে। আমার সঙ্গে ডক্টর নিজেও গল্প বানায় রাইট অফিসার? ডক্টরের কল্পনাতেও আপনি আসেন। এসে তার থেকে আমার এই পায়ের সিচুয়েশনের ডিটেইল নিতে নিতে একেবারে তাকে অসহায় বানিয়ে ফেলেন। নিশ্চয় ডক্টর হ্যালুসিনেট করে এসব আমায় বলেছে।”

কথাটা শোনামাত্রই কিছু একটা বিরবির করে চোখ বুঁজে ফেলে নির্জন। চোখেমুখে দেখা দিল যেন চুরি করার পর ধরা খাওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া। মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,
“ইডিয়ট ডক্টর!”

“কিছু বললেন?”

রায়ানের প্রশ্নে চোখ মেলে না চাইতেও একটা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায় নির্জন। ডিআইজি মারুফ হোসেন এবার মুখ খোলেন। বেশ গাম্ভীর্যের সাথেই বলেন,
“তাহলে শুরু করা যাক? যেহেতু যার অপেক্ষা ছিল আই মিন ইন্সপেক্টর রায়ান, সে তো এসেই গেছে। দেরি করে লাভ কী?”

আইজিপি অফিসার নীলয় সম্মতি জানিয়ে বলে,
“হ্যাঁ, দেরি যত করা হবে ততই ক্ষতি।”

কথাটা শেষ করার মাঝে থামলেন উনি। নির্জনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন এবার এবং বলে উঠলেন,
“অফিসার নির্জন!”

না চাইতেও উঠে দাঁড়াল নির্জন। বৃষ্টির মধ্যে কাঁদায় পড়ে নাকানিচুবানি খেয়ে সেই বেশরমের মতো হাসার ফলাফল পাচ্ছে বর্তমানে। হাঁটতে গেলে পায়ে লাগছে কিছুটা। তবুও স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গিয়ে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে একটা বড় দম নিয়ে বলল,
“আই এম অফিসার নির্জন। দ্যা হেড ওফ সিক্রেট টিম। যার দায়িত্বে বর্তমানের সবথেকে বড় আ’তঙ্কজনিত কেস রয়েছে। একটা টেরো’রিস্ট টিম যেটা কিনা চট্টগ্রাম নামক বড় শহরে আ’তঙ্ক ছড়িয়ে সবাইকে সংকেত দিয়ে এসেছে এবার তারা ঢাকায় আসছে। এসেছেও পড়েছে তারা। একের পর এক ধ্বং’সলীলা শুরু করে দিয়েছে। যার প্রথম টার্গেট ছিল এডিশনাল এসপি স্যার। তারা সক্ষম হয়েছে। তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির উপর দিয়ে আমরা যেতে পারিনি।”

অনর্গল কথা বলে এবার থেমে বড় শ্বাস নিলো নির্জন। টেবিলে পড়ে থাকা প্রজেক্টরের রিমোট হাতে নিয়ে পাওয়ার অন করতেই দেখা গেল একটা সিসিটিভি ফুটেজের ক্লিপ। সকলে দেখলো কিছুটা অস্পষ্ট দৃশ্য। এডিশনাল এসপি সাহেবের বাড়িতে একটা টুপি পড়া লোক ঢুকছে। গায়ে ডেলিভারি ম্যানের পোশাক। নির্জন সেটা দেখিয়ে বলা শুরু করে,
“আমরা যতদূর জানতাম খু’নিরা খুব কৌশলে বাড়ির সব অংশ শেষ করে দেওয়ায় কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পাশের বিল্ডিং থেকে এই ফুটেজ পাওয়া গেলেও এই ছেলেটা কে তা জানা যায়নি।”

মারুফ হোসেন কিছুটা চিন্তিত মুখ দিয়ে হতাশার সাথে বললেন,
“যা জানা গিয়েছে সেটাই বলো। যেটা জানা যায়নি সেটা বলে লাভ নেই। তুমি জানো না আমরা একেবারে বাঘের মুখে পড়েছি। মিডিয়া প্রশ্ন তুলছে! তার উপর অভিরূপ চৌধুরীর অসময়ে আগমন। সব ঘেঁটে দিল একেবারে।”

উনি থামতেই এসপি সাহেব বলে উঠলেন,
“আমি শুনেছিলাম একটা মেয়ে নাকি এমন কান্ড ঘটাচ্ছে? নাম কী যেন! রাগিনী তাজরীন। কথাটুকুর কতটা সত্যতা বের করতে পেরেছো?”

“স্যার, আই উইকনেসের স্কেচ অনুযায়ী আর বাকি যেদিন এসব ঘটনা ঘটেছিল সেসব দেখে মনে হয়েছিল হ্যাঁ সত্যিই সেই মেয়েটার যোগসূত্র থাকতে পারে। ফোনের লোকেশনটা সবসময় নজরে রাখা হচ্ছিল। কিন্তু দিন যায় ধারণা পাল্টায়।”

নির্জনের কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে রায়ানের। সে নিজেও রাগিনীর মতোই হুবহু কাউকে দেখেছে। তাই সন্দেহ সেও উড়িয়ে দিতে পারছে না। সে কৌতূহল নিয়ে বলল,
“ধারণা পাল্টানোর কারণ?”

নির্জন বাঁকা হাসে। বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীনের হেমোফোবিয়া আছে। যার মানে র’ক্তে ফোবিয়া। সেই সঙ্গে অ্যাকোস্টিকোফোবিয়াও রয়েছে। এরমানে অতিরিক্ত শব্দে ফোবিয়া। তাহলে এটা তো ধরে নেওয়ায় যায় যেই মেয়ে এতোটা ভীতু সে কী করে পরপর এতো কান্ড ঘটাবে?”

নির্জন থামে এবার। হাঁচি আসছে আবার। নিজেকে সংযত করে আবারও বলে,
“ইন্সপেক্টর রায়ানকে যেদিন টার্গেট করা হয় সেদিন ছিল অভিরূপ চৌধুরী আসার ঠিক আগের দিন। হয়ত টেরো’রিস্ট টিম কোনো না কোনোভাবে জেনেছিল যে ইন্সপেক্টর রায়ান অভিরূপ চৌধুরীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তারা সফল হয়নি। ইন্সপেক্টর রায়ানের ভাষ্যমতে সেদিন উনি নিজের গাড়ির কাছে একটা মেয়েকে দেখেছিলেন। যে মাস্ক পরিহিত থাকলেও তার অনেকাংশ রাগিনী তাজরীনের সাথে মিলে যায়। কিন্তু ওইদিনই ওই সময় রাগিনীর লোকেশন ছিলোই না সেই এরিয়ায়। আর রাগিনীর সঙ্গে সেই মেয়েটির পোশাকের ধরনে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ।”

সকলের মুখে ছেয়ে যায় কৌতূহলে। কানাকানি চলতে থাকে। ফিসফিস কথা শুরু হয়। আইজিপি সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন,
“তাহলে রাগিনীর মতো আরো কেউ আছে বলতে চাইছো?”

“প্রশ্নটা আমারও সেখানে। আমার সন্দেহ আরো তীব্র হয় এয়ারপোর্টে সেই হা’মলার সময়। তবে ভাগ্যটা ভালো ছিল। ইন্সপেক্টর রায়ানের বুদ্ধিমত্তায় অভিরূপ চৌধুরীর কোনো ক্ষতি হয়নি। উনি কৌশলে গাড়ির নম্বর চেঞ্জ করে দেন। ফলে বিভ্রান্ত হয় আত’ঙ্কবাদী। নিঃসন্দেহে ইন্সপেক্টর রায়ান ভালো কাজ করেছেন।”

এবার সকলের দৃষ্টি গেলো রায়ানের উপর। উসখুস করে নির্জনের দিকে তাকালো রায়ান। সে ভালোমতো বুঝেছে নির্জন ইচ্ছে করে এমন বলছে। নির্জন এবার রিমোটের অন্যজায়গায় চাপতেই সিন পাল্টে যায়। দৃশ্যমান হয় এয়ারপোর্টের বাহিরে অভিরূপের গাড়ির সামনে থাকা সেই মেয়েটির মুখশ্রী। অস্পষ্ট হলেও সকলে বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটিকে। পাশাপাশি দৃশ্যমান হয় রাগিনী তাজরীনের স্পষ্ট ছবিও। নির্জন দুটো ছবিই দেখিয়ে বলে,
“ছবিটা মিলিয়ে দেখুন কাইন্ডলি।”

“আরে এরা তো একই দেখতে।”

ডিআইজি সাহেব তড়িঘড়ি করে নিজেকে সামলাতে না পেরে বললেন। নির্জন সম্মতি জানিয়ে বললেন,
“একই দেখতে তবে দুটোই আলাদা দেহ। এয়ারপোর্টের যেই রাগিনী তাজরীনকে দেখছেন সে এইসময় এয়ারপোর্টে উপস্থিত থাকলেও একই সময়ে অন্য রাগিনী তাজরীন সিটি হসপিটালে উপস্থিত ছিল। একটা বাচ্চা ছেলেকে রেসকিউ করে তার সেফটি দিয়ে ব্যস্ত ছিল।”

বলেই আবারও রিমোট দিয়ে সিন পাল্টালো নির্জন। দেখা গেল হসপিটালের সিন। সেখানেও রাগিনীকেই দেখা যাচ্ছে। তার চিন্তায় ভরা মুখটা স্পষ্ট। নির্জন শক্ত গলায় বলে,
“এটা ঠিক ওইসময়েরই ফুটেজ যখন এয়ারপোর্টে এই রাগিনী তাজরীনকে দেখা গিয়েছিল।”

সকলে এবার স্তব্ধ। মাথাটা যেন ভনভন করে ঘুরছে সকলেরই। এসপি সাহেব হাফ ছেড়ে বললেন,
“তাহলে রাগিনী তাজরীনের মতো আরেকজনও এক্সিস্ট করে? তাহলে তার পরিচয় কী? সে কি রাগিনীর জমজ?”

“রাশেদ সাহেবের ডিটেইলস ঘেঁটে দেখা হয়েছে। উনার স্ত্রীর প্রেগ্ন্যাসির সময়কার ডিটেইলসও যোগাড় করা হচ্ছে। তবে জমজ বলতে এখনো কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি।”

সকলে পড়েছে এবার গোলকধাঁধায়। কোনটার সঙ্গে কোনটা জুড়ে আছে সেটা কারোরই মাথায় আসছে না। সবাই চোখাচোখি করছে। উত্তর খোঁজার চেষ্টায় মগ্ন। কবে পাবে সেসব উত্তর?

রাত প্রায় এগারোটার কাছাকাছি। ফাঁকা রাস্তা। ঢাকা শহরের রাস্তা যতই রাত হক ফাঁকা হতে চায় না। তবে এটা ওফসাইডের রাস্তা। চারিপাশে কিছুটা জঙ্গলের উপস্থিতিও রয়েছে। আবার মনে হচ্ছে কোথাও পরিত্যক্ত কবরস্থান! মাঝ দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা দিয়ে দুটো গাড়ি চলছে। একটার রঙ সাদা আরেকটা গাড়ির রঙ কালো। একটা গাড়ি আরেকটা গাড়িকে টক্কর দিচ্ছে বলা চলে। দুটোই চলছে হাই স্পিডে। কালো গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বয়ং অভিরূপ। আর সাদা গাড়ির মধ্যে নোমান। অভিরূপের শখ হয়েছে এদেশে একটু রেসিং করার। নোমানকে জোরজবরদস্তি করেই নিজের সাথে এই রেসে নামিয়েছে সে। অভিরূপের কানে ব্লুটুথ। সে নোমানের ব্লুটুথে কানেক্ট করে বলল,
“গেট রেডি মাই ডিয়ার। তুই হারবি।”

“রিয়েলি? লেটস সি!”

বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে উঠল নোমান। অভিরূপ তার এতো আত্মবিশ্বাসের কারণ খুঁজে পেলো না। কারণ তার গাড়িটাই আগে চলছে। তাই সে ব্যঙ্গ করে প্রতিত্তোর করল,
“ফাঁকা কলসি বাজে বেশি। নোমানও বাজছে ঠকঠক!”

নোমান উচ্চস্বরে হেঁসে উঠতেই অভিরূপ নিজের গাড়িতে একটা অদ্ভুত সমস্যা লক্ষ্য করল। গাড়িটার স্পিড কমাতেই নোমানের গাড়ি তার পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়িটা আস্তে করে ব্রেক কষলো অভিরূপ। গাড়ি থামলো। জানালা খুলে একটু উঁচু হয়ে মাথা বের করে গাড়ির নিচে উঁকি দিতেই দেখলো গাড়ির টায়ারে হাওয়া নেই। এবার বুঝতে বাকি রইলো না তার। দাঁত চেপে চিল্লিয়ে নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
“চিটিংবাজ!”

নোমান জোরে হেঁসে বলল,
“বাই বাই! তুই পরে আয়। আমি রাস্তা ঘুরে তোকে পিকআপ করব। ওকে মাই ডিয়ার?”

বলেই কল কাটলো নোমান। যেচে রেসিং করতে গিয়ে হেরে যাবার রাগটা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। মুখটা বেলুনের ন্যায় ফুলিয়ে চাবি ঘুরিয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করল অভিরূপ। গাড়ির এসির পাওয়ারটা বাড়িয়ে দিয়ে বেশ আয়েশে বসে সামনে তাকাতেই একটা অবয়বকে গাড়ির কিছুটা সামনে দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যেতে দেখলো। চোখ কচলে ভালো করে সোজা হয়ে বসলো তৎক্ষনাৎ অভিরূপ। সে কি ভুল দেখলো? যখন আরো একদল ছেলেকে ছুটে জঙ্গলের ভেতরেই ঢুকতে দেখলো তখন অভিরূপের মনে হলো এটা ভুল নয়। মেয়েটির বিপদের আশঙ্কা!
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩১

জঙ্গলের ভেতরটা পুরোটা অন্ধকার। উপরের সেই চাঁদের আলো গাছের বড় বড় ডালপালা ভেদ করে মাটি স্পর্শ করতে পারছে না। একপ্রকার অন্ধের মতো নিজের সব শক্তি লাগিয়ে ইচ্ছেমতো একদিকে দৌড়ে চলেছে এক মানবী। চোখেমুখে আতঙ্ক স্পষ্ট। হৃদয়ের কম্পন বেড়ে চলেছে ভীতিতে। মাথায় যত্ন করে করা ছোট চুলের খোঁপার অবস্থাও করুন। প্রায় খুলে এসেছে। চুলগুলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ে ব্যথাও পেয়েছে বেশ। তবুও যে থামা যাবে না। ছুটতে হবে যদি সম্মান বাঁচাতে হয়। তবে বিধি বাম। এই অন্ধকারে মাথা গিয়ে খুব জোরে ঠুকে গেল মেয়েটির। কপালে অসহ্যরকম যন্ত্রণা করে উঠলো। খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। মাটিতে বৃষ্টির কারণে জমেছে কাঁদা। সেই সাথে বড় বড় গাছের পাতা। মেয়েটি আশেপাশে পাগলের মতো হাতাতে থাকে। নিজেকে রক্ষা করার মতো কোনো কিছুই পায় না। হঠাৎ সুক্ষ্ম আলোর দেখা মেলে। তড়িঘড়ি করে হামাগুড়ি দিয়ে একটা গাছের পেছনে লুকায় মেয়েটি। আড়াল থেকে দেখতে থাকে তাকে সেই চারজন বখাটে ছেলে গুলো খুঁজে চলেছে। মুখে রয়েছে অশ্রাব্য গালাগাল। এই প্রথম এমন কোনো পরিস্থিতির শিকার হয়েছে সে। জানা ছিল না নিজের সম্মান হারানোর ভয়টা এতো তীব্র। মাথাটা ভনভন করে ওঠে তার। গাছটা শক্ত করে ধরে থাকে। চোখটা বুঁজে গাছের সাথে মাথা লাগিয়ে দেয় সে। মিনিট দুয়েক সেভাবে থেকে সরাসরি যখন চোখে আলো লাগে চোখটা খিঁচে ফেলে সে। নেত্রপল্লব মেলতেও খানিকটা কষ্ট হয়। বুকটা ধক করে ওঠে। তার সামনেই সেই চার জন ছেলে লাইট ধরে হাসাহাসি করছে। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই তার। বসে থেকে কিছুদূর পিছিয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল সে। সকলের নিকৃষ্ট হাসি দেখে মনে হচ্ছে এখানেই সব শেষ। না চাইতেও যে চোখ দিয়ে সহজে পানি পড়ে না সেই চোখ দিয়ে পানির ধারা ছুটতে লাগলো। ছেলেদের মধ্যে একজন এগিয়ে বলল,
“আরে মামনি! এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় ছুটছিলে? লাভ আছে কোনো? সেই তো আমাদের কবলেই পড়তে হলো।”

চোখ থেকে অশ্রু বেরিয়ে আসা সেই অপরূপ নারীর দিকে নিচু হয়ে বসে পড়লো ছেলেটি। তার গালে ছেলেটি তার বিশ্রী স্পর্শ ঠেকাতেই তার শরীর জন্য ঘৃণায় রি রি করে উঠলো। শরীরের বাকি শক্তিটুকু দিয়ে নিজের পা উঠিয়ে ছেলেটির বুক বরাবর সজোরে লা’থি মে’রে বসলো। টাল সামলাতে না পেরে ছিটকে গিয়ে খানিকটা দূরে পড়লো ছেলেটি। বেশ কষ্ট সহ্য করে উঠে দাঁড়ালো সেই মানবী। কোনো কিছুর পরোয়া না করে ছুট লাগালো সে আঘাত লাগা পায়েই। তবে তার মনে হলো সে বেশিক্ষণ নিজেকে বাঁচাতে পারবেনা। কিন্তু শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? বেশিদূর এগোতে পারলো না। পা দুটো অসার হয়ে এলো। যেখানে এসে থামবে সেখানেও প্রশস্ত কিছুর সাথে জোরেশোরে ধা’ক্কা খেলো আবারও। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে ‘উহ’ শব্দটা বের করলো সে। তৎক্ষনাৎ লাইট তার দিকে ধরা হলো। মেয়েটির মনে ধরা দিল আশঙ্কা। ছেলেদের মধ্যে একজন আবারও তাকে ধরে ফেললো? না চাইতেও তার মুখ দিয়ে মিনতির সুরে বেরিয়ে এলো,
“প্লিজ, আমাকে ছেড়ে দিন! যেতে দিন আমাকে।”

“আরে! আমি আপনাকে ধরলাম কখন?”

এই চিকন কন্ঠস্বরে যেন কোনোরকম জটিলতা নেই। সেখানে মেয়েটি পেলো না কোনো নিকৃষ্টতা। বরং কোথাও একটা ভরসার আশা জমা হলো। পিটপিট করে চোখ খুলল সে। অচেনা হয়েও চেনা লাগলো সেই মুখ। সেই দৃষ্টির মাঝে রয়েছে বিস্ময়। অর্থাৎ লোকটাও তাকে দেখে অবাক। এবার লোকটির মুখ ফুরে বেরিয়ে এলো একটা নাম।
“রাগিনী!”

চোখ গোল গোল করে তাকালো মেয়েটি পোশাক ভর্তি কাঁদা লেগে আছে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। মনে একটাই প্রশ্ন! সে রাগিনী নামটা জানলো কী করে? হঠাৎ কানে এলো ছেলেগুলোর বাজে কথাবার্তা। মেয়েটির মনে জানান দিলো বাঁচতে হলে হয়তবা এই লোকটাই একমাত্র ভরসা! হাত-পা অনবরত কাঁপতে থাকলো তার। কি করে সাহায্য চাইবে সেটাও বুঝে উঠতে পারলো না সে। উপরন্ত মাথা ঘুরছে। টলমল করতে করতে হঠাৎ যখন সেই পুরুষালী হাতটা তাকে স্পর্শ করলো পুরো শরীরে বয়ে গেল এক আলাদাই কম্পন। অভিরূপ তাকে টেনে নিয়ে গভীর আবেশে এক হাতে ধরে বলল,
“আর ইউ ওকে? আমি ভেবেছিলাম আপনি স্ট্রং গার্ল! আমার ধারণা পাল্টে দিচ্ছেন আপনি।”

ঘোলা চোখে তাকালো সে একপলক। এবার মনে হচ্ছে সে মানুষটাকে চেনে। কোথাও দেখেছে! নিউজে? নাকি পেপারে? হ্যাঁ! এইতো সেই অভিরূপ চৌধুরী অভি। যাকে শে’ষ করার তাড়নায় সে প্রতিদিন তড়পে যাচ্ছে। যার প্রা’ণটা ছিনিয়ে নেওয়ার তার এতো আকাঙ্ক্ষা আজ সে-ই কিনা তার সম্মান বাঁচাতে ব্যাকুল? এসব আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে মেয়েটি ঢলে পড়ল এবার। সেই সঙ্গে অভিরূপের শার্ট প্যান্টেও লেগে গেল কাঁদা। শরীরে এই মেয়েলি স্পর্শ লাগায় হৃদকম্পনকে যেন ঘোড়া মনে হলো অভিরূপের। এতো জোরে জোরে ছোটে নাকি? অন্যদিকে তার বুঝতে কমতি নেই ছেলেগুলো পেলে তাকে সহ রাগিনীকেও পিস পিস করে কে’টে ফ্রাই করে খাবে। বিরবির করে অসহায় সুরে অভিরূপ বলে উঠল,
“ওহ গড! আমাকে এমন সিচুয়েশনের মধ্যে ফেলো কেন তুমি? একদিকে এতো সুন্দর ফিলিং নিতেও পারছি না। অন্যদিকে এই ছেলেগুলো পেলে না জানি কি করে! বুঝিনা এই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হলেই কি বিপদও ফ্রীতে মিলে যায় নাকি বিপদের সঙ্গে মেয়েটাও ফ্রী?”

অতি যত্নে তার দেখা রাগিনীকে পাজ কোলে তুলে ছুটতে থাকলো অভিরূপ। তবে ভাগ্য বোধহয় সাথ দেয়নি। অতিরিক্ত কাঁদায় সেও ধ’পাস করেই পড়লো মেয়েটি সমেত। হুঁশ ফিরে রাগিনীর। নড়েচড়ে তড়িঘড়ি করে পিছলে যায় অন্যদিকে। ছেলেগুলো তাদের সামনেই এসে পড়েছে। এবার অভিরূপ উঠে দাঁড়ায়। রাগিনীর দিকে ছেলেগুলো তেড়ে যেতেই অভিরূপ তাদের বাঁধা দিয়ে বলে,
“আরে ভাই! এতো তাড়া কীসের? আমাকে চেনো না তোমরা? অভিরূপ চৌধুরী আমি। একটু কথা তো বলো! এদেশে দেখি আমার মতো মানুষদের দামই দাও না তোমরা। সবাই লাইনে দাঁড়াও দেখি। একটু অটোগ্রাফ দিই। গান শুনতে চাইলে ফ্রীতে শোনাবো। তাও এতো তাড়াহুড়ো করবেন না। রিল্যাক্স!”

ছেলেগুলো এবার হতভম্ব হয়ে দাঁড়ালো। একজন অন্যজনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরে এতো সত্যিই অভিরূপ চৌধুরী! দ্যা ফেমাস সিঙ্গার ওফ ইন্ডিয়া। সে এখানে কী করে?”

“আরে ভাই, আপনাদের জন্যই তো এসেছি। আপনাদের গান শোনাবো।”

বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিল অভিরূপ। কী ভোলাভালা সেই হাসি! কিন্তু কে জানে সেই হাসির পেছনে কূটবুদ্ধি লুকিয়ে? হাতে ধরে রাখা একগাদা কাঁদা পালা করে ছেলেগুলোর চোখেমুখে ছুঁড়ে মারলো অভিরূপ। আর দেরি নয়। দ্রুত রাগিনীর হাতটা ধরে তাড়াহুড়ো করে বলল,
“আর সময় নেই। বাঁচতে চাইলে পালাই চলুন।”

রাগিনী থেমেই থামে। সরু চোখে তাকিয়ে থাকে অভিরূপের দিকে। তার এই চাহনি লক্ষ্য করে অভিরূপ আবারও তার হাত টেনে বলে,
“আরে আপনাকে নিয়ে বিয়ে করতে পালাচ্ছি না। আপনাকে বাঁচাচ্ছি।”

এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাগিনী। অভিরূপ খেয়াল করে তার বাম হাতে একটা শক্ত গাছের বড় ডাল ধরে আছে। এবার সেটা ধরেই ছেলেগুলোর নিকটে যায় সে। অভিরূপের চোখ তখন কপালে! এই মেয়েই না একটু আগে জ্ঞান হারালো? ভয়ে কুঁকড়ে ছিল? এখনি তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তার চোখ দিয়ে আগুনের লাভা বেরিয়ে আসছে। বেশ ইন্টারেস্টিং তো! ছেলেগুলোকে এবার কৌশলে একের পর এক পিটিয়ে যাচ্ছে রাগিনী। আর জোরে জোরে বলছে,
“সুযোগ পেলে তোদের একটার ঘাড়েও মাথা থাকতো না। আজকে আমি নিরুপায় ছিলাম বলেই বেঁচে গেলি। জানো’য়ার! হাতের কাছে কিছু ছিল না বলে আমার উপর ভালোই জোর দেখিয়েছিস। এখন কোথায় যাবি?”

ছেলেদের মা’র খাবার পর একেকটা আর্তনাদ শুনেই অভিরূপের শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠলো। মেয়েটাকে সে যতটা ভীতু ভেবেছিলো সে ততটাও না। বেশ ডেঞ্জারাস লেভেলের! একসময় মে’রে ক্লান্ত হয়ে সেই রক্তিম আঁখি দ্বারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে অভিরূপের দিকে। অভিরূপ ঢক গিলে একটা ক্যাবলা হাসি দেয়। আর বলে,
“যাওয়া যাক? এভাবে তাকাবেন না। আর হাত ধরে টানাটানি করব না। সো ম্যাডাম, ক্যান উই গো নাউ?”

রাত প্রায় বারোটা পেরিয়েছে। প্রকৃতিতে নেমে এসেছে পিনপতন নীরবতা। ঝিঁঝি পোকার শব্দ সেই নিস্তব্ধতাকে কমিয়ে দিলেও খুব একটা বেশি পারছে না। ‘শাহ্ মানসিক হাসপাতাল কেন্দ্র’ অর্থাৎ মেন্টাল হসপিটালের পেছনদিকের বড় দরজায় তালা খোলার শব্দ তীব্র হচ্ছে ধীরে ধীরে। পেছনদিকে মানুষ চলাচল করার জন্য নয়। এদিক দিয়ে বড় বড় গাড়ি আর সেইসব এম্বুলেন্স ঢুকানো হয়। আজিম বড় তালা খুলে দিয়ে গেট ফাঁক করে দিয়ে একটা স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে কোহিনূরের উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
“আসেন স্যার! অনেক ক্লান্ত হইছেন না? কিছু খাইতে দিব?”

কোহিনূর প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে ঘাড় এদিক ওদিক কাঁত করে বলল,
“নো নিড। খেয়ে এসেছি বাহিরে থেকে।”

“আচ্ছা তাইলে ভেতরে আসেন। কেউ দেইখা নিলে আবার বিপদ!”

“রিল্যাক্স। এতো রাতে কে আর আসবে! তুমি যে এসেছো এটাই আমার ভাগ্য। সিরিয়াসলি আজিম! এতো রাতে তোমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে জ্বালিয়ে দরজা খুলে নিচ্ছি। বিরক্ত হয়ে যাও খুব তাই না?”

“কী যে বলেন স্যার! আপনে তো এর বদলে আমাকেও কিছু হাত খরচ দেন নাকি?”

কোহিনূর মুচকি হাসে। নিজের ঘাড়ে একটা হাত রেখে শক্ত করে মোচড় দেয়। ঘাড় ব্যথা করছে। যতক্ষণ ধরে মিটিং হয়েছে আর তাকে কথা বলতে হয়েছে যে এখন কথাও বলতে ইচ্ছে করছে না। ভাগ্যিস এর মাঝে রাগিনী আর আসেনি! নাহলে তাকে না পেয়ে নিশ্চিত মেয়েটা সন্দেহ করতো? অতঃপর সে শান্ত গলায় বলে,
“এইতো আর কিছুদিন। তারপর এই জ্বালাতন সহ্য করতে হবে না তোমায়।”

“তা আপনাগো তদন্ত শেষ হইতেছে?”

“শেষ আর কোথায় হলো আজিম? কিছুই তো খুঁজে পাচ্ছিনা। তবে এটা নিশ্চিত রাগিনী মেয়েটাকে অযথা সন্দেহের খাতায় ফেলেছি। এখন নিজেই নিজের দিকে তাকাতে পারছি না।”

আজিম কোহিনূরকে আশ্বাস দিয়ে বলে ওঠে,
“আপনাদের কাজই তো সন্দেহ করা। কারণ আছিল বলেই সন্দেহ করছিলেন। এখন তো বুঝছেন। সমস্যা নাই।”

কোহিনূর কিছুক্ষণ নীরব থেকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে চাইলো। তবে কিছুটা দূরে একটা মেয়েলি অবয়ব আঁটকে দিলো তাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো মেয়েটা এতো রাতে এই জনমানবহীন রাস্তায় হাঁটছে কেন? কোনো বিপদ হয়নি তো? আস্তে আস্তে যখন মেয়েটা এগিয়ে এলো তখন যেন কোহিনূরের পায়ের নিচের মাটির ভিত নড়ে উঠল। পা দুটো অবশ হয়ে এলো। মেয়েটির চোখমুখ তো তারই মনের অভ্যন্তরে তাকা। হ্যাঁ, সে তো রাগিনী। এতো রাতে রাগিনী? তাও এই বিধ্বস্ত অবস্থায়? সারা গায়ে কাঁদা আর কপাল ফোলা। কোহিনূরকে দেখে তার থেকে কিছুটা দূরত্বেই থেমে গেছে রাগিনী। থমকে গেছে তার চোখ। কোহিনূর এবার নিজের দিকে তাকালো। নিজের পা থেকে মাথা অবধি তাকালো। তার পরনে সিক্রেট অফিসারের ইউনিফর্ম। কালো লং কোট। পায়ে দামি বোট জুতো। মেয়েটা কি তবে সব ধরে ফেলল? কোহিনূর কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে রাগিনীর দিকে একধাপ এগিয়ে গিয়ে ধীর সুরে কম্পন ধরানো কন্ঠে বলল,
“রাগিনী!”

কোহিনূরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি উপলব্ধি করল অন্যকিছু। মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা বুঝে ফেলল সে। দৃষ্টি শক্ত হলো তার। হাত নামিয়ে নিল। মাথাটা এপাশ ওপাশ নাড়ালো। আর বিরবির করে বলল,
“না। রাগিনী না!”

হয়ত এই মেয়েটিও বুঝে নিয়েছে অনেক কিছুই। তাই সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে। কোহিনূরের মাথায় যেন র’ক্ত চড়ে বসলো। দাঁত কটমট করে তেড়ে যেতেই মেয়েটা দৌড় লাগালো। কোহিনূরও দমে গেলো না। এবার পেয়েছে সে মেয়েটাকে। ছাড়া যাবে না এতো সহজে। সেও পিছু ছুটলো মেয়েটার। পেছন থেকে আজিম হতভম্ব হয়ে গেলো! কী হলো টা কী? কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।

মেয়েটার পায়ের বেগ আছে মানতে হবে। অনেকটা দূরে ছুটেছে কোহিনূর। রি’ভলবার বের করে বেশ কয়েকবার ওয়ার্নিং করেছে। তবে ফলাফল হয়নি। সে লক্ষ্য করেছিল মেয়েটা খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। অথচ তার দৌড়ানোর বেগ অসামান্য! অবশ্য অপরাধীরা এসব বিষয়ে পারদর্শীই হয়। তার খোঁজ না পেয়ে কংক্রিটের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পাশের গাছে জোরে লা’থি মার’লো কোহিনূর। মাথা যেন আগুনের দাবানলে পরিণত হয়েছে। নিজেকে কোনোরকম সংযত করে শান্তভাবে দ্রুত ফোনটা বের করে কোহিনূর। মেহরাজের নম্বর ডায়াল করে কল দিয়ে ফোনটা কানে ধরে। দৌড়ে গরম লাগছে ভীষণ। হাঁপিয়ে উঠেছে একেবারে। কোটের বোতাম একহাতে খুলতে খুলতে বিরক্তির সুরে বলে,
“দরকারের সময় ইডিয়টের ফোনে কল দিলে পাওয়ায় যায় না।”

পুনরায় কল করতে হলো কোহিনূরকে। এবার কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পরেই ওপাশ থেকে মেহরাজের ঘুম জড়ানো গলা শোনা গেল।
“আরে ভাই! এতো ভোর ভোর ফোন দেওয়ার কী আছে? কী সমস্যা? রাখ তো।”

মেজাজটা আরো চড়ে যায় কোহিনূরের। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“আমি তোমার ভাই নয়, মেহরাজ!”

এবার যেন ওপাশের মেহরাজের টনক নড়ে। তড়িঘড়ি করে বলে,
“সরি স্যার, সরি। এতো রাতে ঘুমাচ্ছিলাম স্যার তাই…”

“তোমার বাড়তি কথা রাখো। দ্রুত অফিস যাও। রাগিনীর লোকেশন চেক করো। আর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে জানাও শাহ্ মানসিক হাসপাতাল কেন্দ্রের আশেপাশে সবখানে চেক পোস্ট দিতে। রাগিনী তাজরীনের মতো কাউকে দেখতে পেলেই তাকে যেন আটক করা হয়। গট ইট?”

“ওকে স্যার। বাট…”
কোহিনূর ফোনটা কেটে দিলো। মেহরাজের সব কথা বলেও বলা হলো না।

সকাল সকাল আজ রাগিনীর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে উর্মিলা। এর আগে বেশ কয়েকবার রাগিনীর বাড়ি এলেও ব্যস্ততা এবং তেমন যোগাযোগ না থাকার কারণে মাঝখানে আর আসাই হয়নি। আসার সাথে সাথেই সৈয়দ তাকে হলরুমের সোফায় বসতে দিয়েছে। বসে বসে হলরুমের চারিদিকটা দেখতে দেখতে বেশ মুগ্ধ হয় উর্মিলা। সবটাই পরিপাটি করে সাজানো। দামি দামি শোপিচে ময়লাও জমেনি। নিশ্চয় প্রতিদিন পরিষ্কার করা হয়! পরক্ষণেই নিজের পরনের চশমাটা খুলে নিলো উর্মিলা। ওড়না দিয়ে হালকা করে মুছে রেখে দিল তারই পাশে। তখনই সৈয়দ উপর থেকে নেমে এলো। উর্মিলার উদ্দেশ্যে বেশ নম্র সুরে বলল,
“আপনেরে রাগিনী মামনি উপরে যাইতে বললো। সে নিজের ঘরেই আছে। উপরে গিয়া ডান দিকের প্রথম ঘরটাই তার।”
উর্মিলা হালকা হেঁসে উঠে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে ধাবিত হয়। সোফায় ফেলে যায় তার চশমা।

দরজায় টোকা পড়তেই রাগিনীর বুঝতে দেরি হয় না দরজার ওপাশে কে। তাই রিও কে ব্যস্তরত রাগিনী কিছুটা জোরেই বলে ওঠে,
“ভেতরে আয়।”

উর্মিলা ধীর পায়ে রাগিনীর ঘরে প্রবেশ করে। বেডে বসে থেকে একটা বিড়াল ছানাকে খাইয়ে দিচ্ছে রাগিনী। উর্মিলা বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে দ্রুত বিছানার কাছে গিয়ে বলে,
“ওয়াও! সো কিউট কিটি! নাম কী রে ওর?”

“রিও।”

“নামটাও মিলিয়ে রেখেছিস! দারুণ তো। তোর মতোই কিউট গোলুমোলু দেখতে।”

রাগিনী এক ঝলক হাসে। তারপর রিও কে কোলে নিয়ে শান্ত গলায় বলে,
“দাঁড়িয়ে আছিস যে! বস।”

উর্মিলা রাগিনীর পাশ ঘেঁষে বসে পড়ে ধপ করে। তারপর জিজ্ঞেস করে,
“তারপর বল! সব ফাইলস্, ডিটেইলস ঘেঁটে দেখলি? কী মনে হচ্ছে এখন তোর?”

“সবই ঘেঁটে দেখেছি উর্মিলা। আর যত পড়েছি তত সন্দেহ আর তীব্র হয়েছে। কোহিনূরের মাঝে কোনোরকম লক্ষণ দেখতে পাইনি আমি। সবটা গুলিয়ে গিয়েছে আমার।”

তপ্ত শ্বাস ফেলল রাগিনী। উর্মিলা কিছু ভেবে বলল,
“উমম…সেদিন আমাকে যা যা বলেছিলি আমারও ঠিক এটাই মনে হয়েছিল। ওই কোহিনূর একদম সুস্থ। অসুস্থ হবার ভান ধরেছে।”

রাগিনীর জবাব এলো না এবার। সে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত। যেন অন্য জগতে হারিয়েছে। উর্মিলার মাথায় ফট করেই একটা বিষয় ঘুরপাক খেতেই তড়িঘড়ি করে সে রাগিনীর হাতটা চেপে ধরে বলল,
“আচ্ছা! সে যদি সুস্থ হয় আর এমন ভান করে থাকে তাহলে নিশ্চয় তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য আছে? এখন তো কয়েকদিন ধরে টে’রোরিস্ট হাম’লার বিষয়টা চলছেই। এমন নয় তো? যে ওই কোহিনূর কোনোভাবে টে’রোরিস্ট টিমের সাথে যুক্ত?”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩২

মূহুর্তের জন্য যেন নিঃশ্বাস কোথাও একটা আঁটকে গেল। এই কথা আগে কখনো মাথা আসেনি রাগিনীর। হুট করেই বলা উর্মিলার এই কথায় যেন তার নেত্রপল্লব চড়কগাছ হলো। দুটো হাত শক্ত করে মুঠো করে কোহিনূরের সাথে দেখা হওয়ার পর প্রতিটা ঘটনা পরপর সাজিয়ে নিলো সে মনে মনে। কোথাও একটা সত্যিই সূক্ষ্ম সন্দেহের রেখা পেতেই পা থেকে মাথা অবধি অদ্ভুত ঝাঁকুনির সৃষ্টি হলো। নিজেকে সামলে সে বলে উঠল,
“কীসব বলছিস! আমার সন্দেহ হচ্ছে ঠিকই তবে এতো বড় ক্রাই’মের সাথে সন্দেহের বশে উনাকে যুক্ত করা ঠিক হবে না। এটা টেরো’রিস্ট কেস উর্মিলা। সাধারণ ক্রা’ইম নয়। যা বলবি ভেবেচিন্তে বল।”

“আরে বাবা এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? আচ্ছা আমাকে একটা কথা বল মেন্টাল হসপিটাল কি শখ করে থাকার কোনো জায়গা? যে তোর ইচ্ছে হলো আর তুই চলে গেলি থাকতে? তাও আবার ছদ্মবেশে। এমনটা কারা করে? যারা অপরাধ করে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে বা যাদের মধ্যে অপরাধ করার প্রবণতা থাকে। কোহিনূর কি এমনি এমনি সেখানে আছে তোর মনে হয়? তোর অতিরিক্ত বিশ্বাসকে একটু মাটিচাপা দিয়ে যতটা পড়াশোনা করেছিস সেই জ্ঞান থেকে। সাইকোলজির স্টুডেন্ট তুই। বুদ্ধি তো তোর বেশি থাকার কথা।”

রাগিনী বিষয়টা যতই এড়িয়ে যেতে চাইছে ততই যেন উর্মিলা কথাগুলো একেবারে তার মস্তিষ্কে গেঁড়ে দিচ্ছে। তার গায়ের লোম শিউরে ওঠে। মনেপ্রাণে চায় এমনটা না হক। তাহলে নিজের মনের মাঝে বুনে রাখা সেই সুন্দর অনুভূতির বীজগুলো আপনাআপনি অবিশ্বাস নামক কীটনাশক ব্যবহারে ধ্বংস হয়ে যাবে। ঢক গিলে নিজের কথাগুলো একের পর এক সাজাতে থাকে রাগিনী। বিরবির করে বলে ওঠে,
“পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার মানে বিচ্ছিন্নকারক বা বহুব্যক্তিত্ব রোগ। এই যে এমন একটি মানসিক রোগ যে দুটি স্বতন্ত্র বা ব্যক্তিত্ব বজায় রাখে। বিভিন্ন কারণে এই রোগের সৃষ্টি হতে পারে। তার মধ্যে প্রধান কিছু কারণ হলো মাদ’কদ্রব্যের সেবন, বিষণ্নতা, খাওয়ার ব্যাধি, এমনকি এমন কিছু অতীত যা মানুষকে ট্রমার মধ্যে ফে’লে দেয়। কোহিনূরের ডিটেলস থেকে আমি যা পেয়েছি সেটা হলো উনার পুরো পরিবার একসাথে কোথাও ট্রাভেল করতে গিয়ে এক্সি’ডেন্ট করে। সেই ট্রমা থেকে উনার এই রোগ। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রথম প্রথম উনার দুটি ব্যক্তিত্ব লক্ষ্য করলেও আস্তে আস্তে উনার একটি ব্যক্তিত্ব স্থায়ী হয়। উনার কথাবার্তায় ম্যাচিউরিটি দেখা যায়। অদ্ভুতভাবে, উনার গাড়ি বা যানবাহন দেখে ভয় পাওয়ার কথা তবে উনি খুব দক্ষতার সাথে একবার গাড়ি কন্ট্রোলও করেছিলেন। সন্দেহের শুরু হয় সেখান থেকেই।”

কথার মাঝে ফাঁকতালে উর্মিলা বেশ ধীর সুরে বলে ওঠে,
“তাহলে তুই নিজেই ভাব তোর সন্দেহ করাটা কি অযৌক্তিক? নাকি আমি যা বলছি তা অযৌক্তিক? মানুষ ছদ্মবেশে থাকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে।”

“তবে আজ পর্যন্ত ঊনার দ্বারা তো কোনো ক্ষতি হয়নি।”

“হতেও তো পারে সে প্ল্যানিং সাজাচ্ছে।”

এবার মাথাটা ধরে যায় রাগিনির। চোখটা বন্ধ করে দেয়ালের সাথে ঠেস মেরে বসে। উর্মিলা জিজ্ঞেস করে,
“দেখি দে ফাইল গুলো কোথায়? আমিও একটু দেখি।”

বলার পরে তার খেয়ালে এল তার চোখে কোনো চশমা নেই। আশেপাশে হাতাতে থাকল সে। না পেয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে সে বলল,
“আরে আমার চশমাটা কোথায়? দেখেছিস তুই?”

“না আমি তোর চশমা দেখিনি। তুই তো আমার ঘরে এসেছিলি চশমা ছাড়াই।”

“কী বলিস‌! তাহলে নিশ্চয়ই নিচে ফেলে এসেছি। যাই গিয়ে নিয়ে আসি।”

উর্মিলার চোখে একটু সমস্যা রয়েছে। চশমা ছাড়া ছোট লেখাগুলো অস্পষ্ট দেখে। যার কারণে চশমা ব্যবহার করতে হয়। তাই বিলম্ব না করে চশমা নেওয়ার উদ্দেশ্যে সে রাগিনীর রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

বরাবরের মতো সকলের ঘুমটা একটু দেরিতে ভেঙেছে। মুখে ব্রাশ নিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে হলরুমে পায়চারি করছে অভিরূপ। নোমান সৈয়দের হাতের কফি নিয়ে অভিরূপের কাছে এসে দেখল সে পায়চারি করছে। গতকাল রাতেই তারা রাশেদ সাহেবের বাড়িতে এসে পৌঁছেছিল। তবে অভিরূপের মুখটা গত রাত থেকেই বিষণ্ণ। তা দেখে নোমান কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে এমন বেতালের মতো পায়চারি করছিস কেন?”

অভিরূপ ব্রাশ করতে করতে নোমানের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাচ্চাদের মতো বলল,
“ওই মেয়েটা!”

“কোন মেয়েটা? গত রাতে যার জন্য কাঁদায় গড়াগড়ি খেয়েছিলি সেই মেয়েটা?”

“হু! সে এভাবে পালিয়ে গেল কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? নাকি ওকে বিয়ে করতে নিয়ে যেতাম? আরে বাবা আমি তো শুধু ওকে ওর বাড়ি পর্যন্ত ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আসলে সব তোর দোষ।”

থতমত খেয়ে যায় নোমান। আশ্চর্য হয়ে অভিরূপের দিকে তাকায়। বিস্ফোরিত সুরে বলে ওঠে,
“আমি আবার কী করলাম?”

“তোর সাথে কথা বলতে বলতেই তো মেয়েটা কোথাও যেন হাওয়া হয়ে গেল।”

“তেরে কিসমত মে নেহি হে ও লারকি।”

“আমি তো শুনেছিলাম আঙ্কেলের মেয়ের নামও রাগিনী। সকাল থেকে তো সেই মেয়েটার দেখাই পাচ্ছি না।”

নোমান এবার আর অভিরূপের কথায় পাত্তা দেয় না। ছেলেটা রাগিনী রাগিনী করে সারা রাত জ্বালিয়েছে। আর নামটা শুনতে চাইছে না। কফির কাপ সোফার সামনের টেবিলে রেখে ফট করেই সোফায় বসে পড়ে। একটা উদ্ভট আওয়াজ পায় কানে। কোনো কিছু মটমট করে ভাঙার শব্দ হয়। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রয় নোমান। সে যেখানে বসেছে সেখানেই কিছু ভেঙেছে বুঝতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে সোফার দিকে চাইতেই দেখতে পায় একটা ভেঙে যাওয়া চশমা। চশমার গ্লাস ভেঙে সোফায় মুষড়ে পড়েছে।
“আরে এটা কার চশমা?”

হুট করে এক ধা’ক্কা খেয়ে নিজের নির্ধারিত স্থান থেকে সরে যেতে বাধ্য হলো নোমান। এমন রূঢ় ধা’ক্কায় মেজাজ বিগড়ে গেল তার। রাগটা ঝাড়া দরকার। নিশ্চয় ধা’ক্কা দেওয়া ব্যক্তিটি অন্যায় করেছে! এবার মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে তার কর্ণকুহরে।
“আমার চশমা! আমার এতো সুন্দর চশমাটা ভেঙে দিলেন আপনি? কানা নাকি দেখতে পান না?”

এবার নোমানের চোখে আটকালো ছিপছিপে গড়নের একটা মেয়ে। গায়ে জড়ানো সবুজ রঙের কামিজ। সেই সাথে ওড়নাও সবুজ। সরু চোখ দুটোতে রাগি রাগি ভাব। মুখ চোখাচোখা করে রয়েছে। তবে মেয়েটির কথা শুনে নোমান যেন আরো চোটে গেল। মায়াবী সুন্দরী বলে তো ছেড়ে দেওয়া যায় না! সে কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“আপনার মাথায় কি বুদ্ধি নেই? বুদ্ধিভ্রষ্ট? চশমা কেউ বসার জায়গায় রাখে? এমন করলে জায়গায় রাখলে ভাঙবেই। তাতে আমায় কানার উপাধি দেবেন?”

“আশ্চর্য লোক তো আপনি! একে তো নিজে ভুল করেছেন। কোথায় আপনার সরি বলা উচিত। তা না করে আমার সাথে গলাবাজি করছেন? লজ্জা করে না?”

“আমার লজ্জা করবে কেন? আমি চুরি করেছি নাকি ডাকাতি? আর সরি বলব কেন? ভুলটা কি শুধু আমার? চশমা টেবিলে রাখতে পারতেন। সোফায় কেন রেখেছেন? এটা চশমা রাখার জায়গা?”

অভিরূপ এবার দুজনের ঝগড়ায় কিছুটা তটস্থ হয়ে একবার নোমানের দিকে চাইছে তো একবার মেয়েটির দিকে। ব্রাশ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার। নোমান ছেলেটা বেশ শান্তশিষ্ট হলেও রাগ করলে ব্যাপারটা সুবিধাজনক আর থাকে না। দুজনের এমন ঝগড়ার মাঝেই অভিরূপের মাথায় প্রশ্ন খেলে যায় একটা। এই মেয়েটা আবার রাশেদ আঙ্কেলের মেয়ে রাগিনী নয় তো? ঢক গিলে আস্তে করে এগিয়ে এসে নোমানের পাশে দাঁড়ায় সে। মুখ ভর্তি পেস্টের ফেনা। তবুও নোমানের কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলার চেষ্টা করল,
“এই এখানেই থেমে যা। মনে হচ্ছে এই মেয়েটা রাগিনী!”

নোমান এবার একটু নিজেকে সামলায়। গলা খাঁকারি দিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকায়। উর্মিলা রাগে ফুঁসছে। নিজের হাতে যত্ন করে ভাঙা চশমা তুলে আফসোসের সাথে বলল,
“আমার পছন্দের চশমাটা। কত কষ্ট করে এতো সুন্দর ফ্রেম পেয়েছিলাম। সেটাও ভেঙে গেল।”

ঝগড়ার কথোপকথন রাগিনীর ঘর অবধি এসেছিল। বিশেষ করে উর্মিলার এমন রাগি কন্ঠ শুনে তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ির কাছে চলে এসেছে রাগিনী। দ্রুত বেগে সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই দেখতে পেয়ে যায় উর্মিলার সাথে আরো দুটো পুরুষকে। একজনকে দূর থেকে চিনতেও ভুল হয় না এক মূহুর্তও। মুখে ব্রাশ নিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে সে। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে কোনোরকম চিরুনি পড়েনি এখনো। গোল গোল চোখ দুটো রাগিনীর দিকে স্থির হয়েছে। রাগিনী নিজেকে সামলে নিল। পায়ের বেগ কমতে লাগলো। ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামল। নিজের গলায় দলা পাকানো কথাগুলো কোনোরকমে উগড়ে বলল,
“কী হয়েছে, উর্মিলা? উপর থেকে তোর গলা পেলাম!”

রাগিনীকে দেখেই উর্মিলা প্রায় কেঁদেই ফেলে। কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে দুর্বল সুরে বলে,
“এই অভদ্র ছেলেটা আমার চশমা ভেঙে ফেলেছে।”

বলেই নোমানের দিকে ইশারা করিয়ে দেখিয়ে দেয় উর্মিলা। নোমান হতভম্ব। সামান্য চশমার জন্য এভাবে কেউ কেঁদে ফেলে নাকি? কিন্তু তাতে তার কী? নোমান ক্ষিপ্ত সুরে বলে,
“আবারও আমার দোষ দিচ্ছেন? মস্তিষ্ক তো পুরোটাই ফাঁকা।”

“দেখেছিস দেখেছিস? আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি গাধা বলে ইনসাল্ট করছে। আপনি গাধা।”

নোমান বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বলে,
“কে গাধা সে নিজে স্বীকার করে নিয়েছে।”

উর্মিলা লাল চোখে তাকায়। কাঁদবে নাকি রাগবে বুঝে উঠতে পারে না। এই মূহুর্তে সবথেকে অসহ্যকর লাগছে সামনে থাকা এই লোকটাকে। দশ তালার ছাঁদ থেকে টুক করে যদি ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দিতে পারত তাহলে বোধহয় খুব শান্তি আসতো মনে। রাগিনী ততক্ষণে যা বোঝার বুঝে গেছে। সে উর্মিলার কাঁধে হাত রেখে চুপি চুপি বলে,
“উনারা আমাদের গেস্ট। প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড, উর্মি! তাও যেমন তেমন গেস্ট নয়। সিলেব্রিটি গেস্ট। তোর সামনে কিন্তু অভিরূপ চৌধুরী দাঁড়িয়ে।”

অভিরূপের নামটা শুনেই যেন উর্মিলা আপনা-আপনি শান্ত হলো। উত্তেজনা নামক অনুভূতিটা তড়তড় করে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। তার গান কে না শোনে? কী সুন্দর সুকন্ঠের অধিকারী! ইন্সটাগ্রামের কতশত ফলোয়ার। একটা ছবি আপলোড করলেই মিনিটেই কতগুলো করে রিয়েক্ট পড়ে। তার মারাত্মক হাসিতে তো মেয়েগুলো হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর এখন রাগিনীর কথা শুনে উর্মিলা থরথর করে কাঁপছে। সে খেয়াল করেনি সেখানে আরো একজন উপস্থিত ছিল। এবার না চাইতেও নজর চলে যায় ব্রাশ মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অভিরূপের দিকে। কীভাবে সে দেখছে। নিশ্চয় মনে মনে ভেবে নিয়েছে মেয়েটা পাগল! এবার পা থেকে মাথা অবধি পর্যবেক্ষণ করল উর্মিলা। হ্যাঁ, এ তো সত্যিই অভিরূপ! স্বপ্ন নয়। মাথাটা ভনভনিয়ে ঘুরল। ভালো করে নোমানের দিকে চেয়েও বুঝল একেও সে দেখেছে। অভিরূপের অনেক ইন্টারভিউ আর তার ইন্সটাতেও। দুই বেস্টফ্রেন্ডের একসাথে ফটোশুটও অনেকবার চোখে পড়েছে উর্মিলার! কত বড়সড় ব্যক্তি। তার সঙ্গে গলা উঁচিয়ে ঝগড়া করে ফেলল?

এতক্ষণ যেন নিজের ভুল ভেবেই উড়িয়ে দিচ্ছিল অভিরূপ। মনে হয়েছিল সকালের ঘুমটা এখনো কাটেনি। এমনি সেই সাহসী নেত্রপল্লব দিনে-রাতে, ঘুমিয়ে না ঘুমিয়েও দেখতে পায়। তাই সামনে থাকা স্বয়ং রাগিনীকেও নিজের ভ্রম ভাবছিল সে। কিন্তু এখন বুঝেছে এইতো সে! নিজের উত্তেজনা সামলে রাখতে না পেরে নোমানের কাঁধ ধরে বড়সড় লাফ দিয়ে উঠে আনন্দের সহিত চিৎকার দিয়ে উঠল সে। সকলে চমকে গেলেও উর্মিলা টলে পড়ল। তার আগে বিরবির করে বলল,
“এখন আমার কী হবে!”

রাগিনী কোনোরকমে উর্মিলাকে ধরতে গিয়ে হিমশিম খেতে হলো। না পেরে সাহায্য করতে এলো নোমান। একটু অস্বস্তি হলেও সাহায্যের উদ্দেশ্যে মেয়েটির ঠান্ডা হাত স্পর্শ করল। সেও বিরবির করে বলে উঠল,
“নির্ঘাত মেয়েটার মাথায় সমস্যা! নয়ত অযথা কেউ সেন্স হারায়? অভিরূপ কি কম ছিল যে এই মেন্টাল মেয়েটাও এসে জুটলো?”

বদ্ধ ঘরে সৃষ্টি হয়েছিল এক গুমোট পরিস্থিতি। অসহ্যকর এক গন্ধ আর ধোঁয়াশা ভরা ঘরটাকে একটু নিস্তার দেওয়া প্রয়োজন। তাই বড় জানালার পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাসটা খুলে দিল এক পুরুষ। চোখেমুখে আলো পড়তেই চোখমুখ কুঁচকে এলো তার। সহ্য হয় না তার এতো আলো। অন্ধকার বেশ ভালোবাসে সে। নিস্তব্ধ পরিবেশে সে শান্তি খুঁজে পায়। সেকারণেই তো পুরো শহরটাকে নিস্তব্ধ বানাতে উঠেপড়ে লেগেছে। কলিংবেল বাজলো বাহিরের দরজায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সে তাকাল। এলোমেলো পায়ে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাহিরের ছোট ড্রয়িং রুমটার শেষ মাথায় থাকা দরজার লকটা খুলতেই বাড়িতে হুড়মুড়িয়ে প্রবেশ করল এক নারীজন। চোখেমুখে আতঙ্ক। কপাল ভর্তি ঘাম! রীতিমতো হাঁপিয়ে চলেছে। ঘরে ঢুকেই মূহুর্ত অপেক্ষা না করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে দরজায় ঠেস মেরে মাস্ক খুলে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকল সে। তাতে মানবটির কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না। সে নিজের প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক রেখে লম্বা ডিভানের কাছে গিয়ে তার পাশে শোপিসের মতোই সাজিয়ে রাখা বড় কাঁচের বোতলটা নিলো। পাশেই ছিল ছোট কাঁচের দুটো গ্লাস। বোতলের মুখ খুলে গ্লাসে ঢেলে নিলো তরল পদার্থ। ছেয়ে গেল ঘরটা এক বাজে গন্ধে। একটা গ্লাস সে নিজে নিয়ে চুমুক দিয়ে আরেকটা সেই নারীর দিকে বাড়িয়ে বলল,
“হাঁপিয়ে গেছো বুঝি? টেক ইট। ঠান্ডা করো নিজেকে।”

মেয়েটি লম্বা শ্বাস নিতেই ব্যস্ত। তবে এতোকিছুর মাঝেও যে তার সামনে থাকা লোকটা কী করে শান্ত থাকে খুঁজে পায় না সে। এখন সে রিল্যাক্স ফিল করছে? মেয়েটি শুধু গ্লাসটা হাত দিয়ে নিলো। তবে মুখ দিল না। ঢক গিলে কিছু বলতেই তার আগেই ডার্ক ম্যাক্স বলে ফেলল,
“তোকে বার বার এখানে যখন তখন আসবি না। সন্দেহ করবে আশেপাশের লোক। লেডি বস! তোর থেকে এতো বোকামি আশা করা যায় না।”

“আমি ইচ্ছে করে এখানে আসিনি। উপায় ছিল না। অনেক কথা ছিল। ইম্পরট্যান্ট কথা। যেটা না বললে হবে না। গতরাতে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে।”

“কী এমন ঘটল আবার?”

লেডি বস এবার বড় শ্বাস নিয়ে বলা শুরু করল,
“গতরাত কিছু কাজে আমি বের হই। নিজের কাছে কোনোরকম অ’স্ত্র রাখিনি। কারণ পুলিশের চেকপোস্ট দিন দিন বাড়ছে। কয়েকজন ছেলে আমাকে তাড়া করে। আমি নিজেকে বাঁচাতে জঙ্গলে যাই আর ভাগ্যক্রমে অভিরূপ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় আমার।”

ডার্কের এবার টনক নড়ে। সরু চোখে তাকায়। এবার বেশ মনোযোগের সহিত বলে,
“তারপর?”

“সে আমাকে বাঁচায়।”

ডার্ক কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ ফিচেল হেসে মুখে গ্লাস ঠেকিয়ে সবটা পান করে। তারপর শব্দ করে হেঁসে বলে,
“ওহ ওয়াও! ইট ইজ লাইক সিনেমা ওর ড্রামা! হিরো হিরোইনকে বাঁচিয়ে নিল? কিন্তু তুই তো হিরোইন না। ভিলেন!”

“কথা সেটা নয় ডার্ক ম্যাক্স। সে আমাকে রাগিনী বলে সম্মোধন করেছে। আর আজ কবীর খবর দেয়, রাগিনীর বাবার সাথে নাকি অভিরূপের বাবার ভালো সম্পর্ক হওয়ায় অভিরূপ হোটেল ছেড়ে রাগিনী তাজরীনের বাড়িতে উঠেছে।”

কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই যেন ডার্কের স্বচ্ছ সাদা পর্দার মাঝে মার্বেলের মতো চোখের মণি দুটো চকচক করে উঠল। ঘাড় কাঁত করে বলল,
“রিয়েলি! এটা তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তোকে সে রাগিনী বলে বিশ্বাস করেছে। আর রাগিনীর বাড়িতে সে উঠেছে। আমাদের পক্ষে তো রাস্তা আরো সোজা হয়ে গেল।”

মুখটা কাঁচুমাচু করে থাকে লেডি বস। চোখটা নামিয়ে নেয়। জড়তা কাটিয়ে আবারও বলে,
“কিন্তু খারাপ খবরও আছে একটা।”

ডার্কের নয়নে নেমে এলো আবারও তীব্র ক্ষিপ্রতা। ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল বিষয়টা জানাতে। গলা শুঁকিয়ে এলো মেয়েটার। ঠোঁট ভিজিয়ে কোনোরকমে বলল,
“আমরা রাগিনীর ব্যাপারে সব নিয়ে যা জেনেছি গত বেশ কয়েকদিনে রাগিনী কোহিনূর নামক একটা মেন্টাল পেশেন্টের সঙ্গে বেশি সময় কাটাচ্ছে। গতকাল রাতে অভিরূপের কোনোরকম সন্দেহ হওয়ার আগে একরকম পালিয়ে আসতে সেই মেন্টাল হসপিটাল অতিক্রম করতে হয় আমায়। পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে আমি ওই কোহিনূরকে দেখতে পাই।”

কথার মাঝে থামে লেডি বস। চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আসে তার। ঘাম যেন বেশিই ঝরতে থাকে। সেই সময় ডার্কের গম্ভীর গলা পেয়ে ভয়ে যেন কাঁপুনিও ধরে যায়।
“তো? কী এমন হলো? সে তো একটা পাগলই। পাগল তোকে পেলেও ভুলেও যাবে। আর…”

ডার্কের কথার মাঝে সে বাগড়া দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলে,
“না। সে মেন্টাল পেশেন্ট হতেই পারে না। সে পুলিশের লোক। আমার যতদূর মনে হলো সে কোনো সিক্রেট টিমের মেম্বার। সে রাগিনীকে সন্দেহ করে পাগলের বেশে সেখানে রয়েছে।”

ডার্কের চোখেমুখে এবার উচ্ছ্বাস ফুটে ওঠে। ঝলমলে হাসি দিয়ে ডিভানে একটা থাবা দিয়ে বলে,
“এ তো গুড নিউজ। তার মানে আমাদের প্ল্যানিংটা সাকসেসফুল হয়েছে। পুলিশের লোক রাগিনীকে সন্দেহ করে এগোচ্ছে। আর এদিকে ওদের এমন ভুল ধারণাকে কেন্দ্র করে এই গোটা শহরে ধ্বংসলীলা চালানো সহজ হবে! ও মাই গড! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!”

ডার্ক ম্যাক্সের আনন্দ বেশিক্ষণ টিকলো না। আনন্দে পানি ঢেলে দিয়ে লেডি বস বলল,
“না ডার্ক ম্যাক্স। এতোটা বোকা পুলিশের লোক হয়নি এখনো। তারা ধরতে পেরেছে রাগিনীর মতো অন্যকেউ আছে। কাল প্রথমে ওই কোহিনূর আমায় রাগিনী ভেবে ভুল করলেও এক মূহুর্তেই চিনে ফেলে আমি সে নই। সে আমাকে ধাওয়া করেছে অনেক পথ। আমি ভাগ্যক্রমে বাঁচি। তারা বুঝে গেছে রাগিনী তাজরীন ফাঁসানো হচ্ছে।”

ডার্কের চোখে নেমে এলো অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা গ্লাসটা চেপে প্রচন্ড ক্রোধের সহিত ফ্লোরে ছুঁড়ে মা’রল সেই গ্লাস। বিকট শব্দে চমকে উঠল লেডি বস। ডার্কের দপদপ করতে থাকা কপালের রগটা যেন বেরিয়ে আসবে যেকোনো মূহুর্তে। কিছুক্ষণ চলল নীরবতা। ডার্ক গভীর ভাবনায় ডুব দিয়েছিল যেন। কিছুটা সময় নিয়ে হঠাৎ লেডি বসের দিকে তাকাতেই চোখমুখ আপনাআপনি শুঁকিয়ে এলো তার। ধীর পায়ে যেন ডার্ক এগিয়ে এলো কম্পন বেড়ে গেল তার। কিছু বলতে চাইতেও পিছিয়ে এলো। ডার্ক তার এক হাত ধরে কাঁধের জামা টেনে ধরে বলে,
“এসব স্টাইলিশ পোশাক বাদ দে। রাগিনী তাজরীন কীসব যেন পড়ে? কামিজ, লং ড্রেসগুলো। যেগুলোর অভ্যেস যত দ্রুত করবি ততই ভালো।”

বলার পরপরই ডার্ক ম্যাক্স বেশ রূঢ় ভাবে মেয়েটির চুলের মুঠি টেনে ধরে। চোখ খিঁচে সে কুঁকড়ে উঠতেই ডার্ক থেমে থেমে বলে,
“একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, তোকে এখানে রূপাঞ্জনা হিসেবে আনি নি। এনেছি রাগিনী তাজরীন হিসেবে। তাই রাগিনীর সম্পূর্ণ রূপ তোকে ধারণ করতে হবে। তোর নাম যে কখনো রূপাঞ্জনা ছিল সেটা ভুলে যা। আর রাগিনীর ওই অপরূপ রূপটাই ওই কোহিনূরকেও শে’ষ করবে সেই সাথে দ্যা ফেমাস অভিরূপ চৌধুরীকেও। রাগিনী তাজরীন নিজেও জানে না সে ডার্ক ম্যাক্সের তুরুপের তাস!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here