গোধূলি বেলায় তুমি এসেছিলে পর্ব -০৭+৮

#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৭

রাত তখন আটটা। আটের কাঁটা ঘড়ি পেরিয়েছে। রাশেদ সাহেব কিছুক্ষণ হলেন বাড়িতে এসেছেন চেম্বার থেকে। চেম্বারে ভীড় ছিল বলে আজ আসতে দেরিই হয়েছে। অন্যদিন আরো দ্রুত চলে আসেন। এসেই রাগিনীকে এখনো বাড়িতে না দেখেই চিন্তিত হয়ে পড়েন তিনি। তবুও মনকে শান্ত রেখে অপেক্ষা করতে থাকেন রাগিনী ফেরার। এরপর ফোনটা হাতে নেন। তখনি খোলা সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির ভেতর কিছুটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রবেশ করে রাগিনী। হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে তার। হাত থেকে ঝরছে র’ক্ত। সেটা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা তার। হলরুমে পা রেখেই বাবাকে দেখে শান্ত হয়ে দাঁড়ায় সে। টিস্যুটা আর র’ক্ত মাখা হাত পেছনে রেখে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় সে। রাশেদ সাহেব শান্ত চাহনি নিয়ে রাগিনীর হাতের দিকেই চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে তিনি ইশারায় ডেকে উঠলেন রাগিনীকে কাছে যাওয়ার জন্য। রাগিনী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তার বাবার নিকটে গিয়ে বলে,
“সরি বাবা। আজকেও লেট হয়ে গেছে। আসলে আমি…”

রাশেদ সাহেব তার মেয়ের হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দেন আর গলা ছেড়ে সৈয়দকে ডেকে বলেন,
“সৈয়দ, আমার ঘর থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এসো যাও।”

সৈয়দ হ্যাঁ বোধক দ্রুত ছুটে যায় রাশেদ সাহেবের ঘরের দিকে। কিছুক্ষণ পর ফার্স্ট এইড বক্সটা নিয়ে এলে রাশেদ সাহেব তা নিয়ে তুলো বের করে রাগিনীর হাতটা সযত্নে ধরে পরিষ্কার করতে থাকেন তাজা র’ক্ত। নির্বিঘ্নে জিজ্ঞেস করেন,
“কি করে হলো? ওই কোহিনূর কিছু করেছে?”

“না বাবা। উনি আমাকে আ’ঘাত করার কথা ভাবতেও পারেন না। আমাকে ভরসা করেন অনেক। উনি কিছু করেন নি।”

রাগিনীর কথায় জোর না পেয়ে সন্দেহ হলো রাশেদ সাহেবের। তিনি জানেন রাগিনী যা বলে খুব জোর দিয়ে বলে। আজ তিনি তেমন জোর পেলেন না কথায়। তাই আবারও ব্যস্ত সুরে বললেন,
“তবে কি করে হলো? পায়েও ব্যথা পেয়েছো মনে হচ্ছে। কিছু লুকিয়ে যাচ্ছো আমার থেকে?”

“না বাবা। আসলে জুতো ছিঁড়ে স্লিপ কেটে পড়ে গেছি। গিয়ে কিছু কাঁচের টুকরো হাতে লেগে হাত কে’টে যায়।”

এবার আর রাশেদ সাহেব কিছু বলেন না। চুপচাপ মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন হাতে। রাগিনী চোখ খিঁচে অন্যদিকে মুখ করে রয়েছে। সে সাধারণত কা’টাছেঁড়া দেখতে পারে না। রাশেদ সাহেব কাজ শেষে বলেন,
“হয়ে গেছে। এখন আর অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। আর রাতে ঘুমানোর আগে পায়ে স্প্রে লাগিয়ে নেবে।”

রাগিনী চোখ খুলে একদৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকায়। আপনাআপনি মনে এক প্রশান্তি আসে। তার বাবা মানুষটি ভীষণ গম্ভীর! তবে মানুষটার কেয়ারিং দিকটা সবাইকে মুগ্ধ করবে। তার মা বোধহয় তার বাবার এই দিকটা দেখেই ভালোবেসেছিলেন? কেয়ারিং মানুষগুলো বোধহয় সত্যিই চমৎকার হয়?

একের পর এক কল করে যাচ্ছে নির্জন শাহিদকে। ফোন সুইচড অফ বলছে। যোগাযোগ করতে পারছে না। ফলে অস্থির হয়ে উঠেছে সে। বড় বড় পায়ের ধাপ ফেলে নিজের কেবিনটা পুরো পায়চারী করছে। শাহিদ সেই ব্যক্তি যাকে নির্জন রাগিনীকে চোখে রাখার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু তার বর্তমানে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অস্থিরতার মাঝে কেবিনে প্রবেশ করে মেহরাজ। আর বলে ওঠে,
“স্যার, শাহিদের লাস্ট লোকেশন একটা ফ্যাক্টরির কাছে।”

কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে চুপ থাকে নির্জন। অতঃপর দ্রুত জবাব দেয়,
“টিমকে রেডি হতে বলো, মেহরাজ। আর দেরি করা ঠিক হবে না। বের হবো আমরা।”

“ইয়েস, স্যার।”
মেহরাজ বেরিয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। নির্জন আয়নায় নিজের দিকে একবার তাকায়। মনে মনে প্রার্থনা করে, আজ যেন কোনো বড় অঘটন না ঘটে। তবে হয়ত নিজের জায়গাটা রক্ষা করতে পারবে না সে। আর ইন্সপেক্টর রায়ান তো আছেই তাকে এই জায়গা থেকে সরানোর জন্য। নির্জন সরবে না। সে হারার পাত্র নয়। চেয়ারের উপর থেকে নিজের কালো লং কোট টা হাতে নিয়ে অন্যহাতে রি’ভলবার নিয়ে সেও তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে পড়ে।

রাত বেড়েছে। নিস্তব্ধতা বেড়েছে। ঝিঁঝি পোকাদের গান শোনা যাচ্ছে। অর্ধচাঁদ তার আলো ছড়াচ্ছে মিটমিট করে। তাঁরাগুলো যেন বেশিই সুন্দর লাগছে। বাড়ির পেছনের বড় বড় গাছের পাতা গুলো হালকা করে নড়ছে বাতাসে। পরিবেশটা বেশ রোমাঞ্চকর। জানালার কাছে ঠেস দিয়ে বেডে বসে আছে রাগিনী। তার মনেও রোমাঞ্চ জেগেছে। সে বসেছে হাতে পেন্সিল আর স্কেচ নিয়ে। মনের মাঝে ঘোরাঘুরি করছে কিছু একটা অদ্ভুত মানবের দৃশ্য। তবে তা সম্পূর্ণভাবে নয়। কখনো চোখ, কখনো মুখ বা কখনো নাক! রাগিনী আজ অসহ্য হয়েই বসেছে স্কেচ করতে। পরিপূর্ণ রূপ দেওয়া দরকার এই মনে ঘোরাঘুরি করা মানবটিকে। দেখা দরকার কে এই বিরক্তিকর মানুষ! এতো অন্য কুমারী নারীর মনে উঁকি দেওয়ার অসভ্যের মতো কাজ। এই অসভ্য মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভাবতে ভাবতে পেন্সিল কামড়াতে থাকে রাগিনী। ফের মুখের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো কানে গুঁজে মনোযোগ দিয়ে আঁকতে শুরু করে চোখ। কয়েকবার নষ্ট করে কাগজ। চোখটা মনমতো হচ্ছে না। পাঁচ ছয়বার পর সফল হয় সে। খাঁড়া নাক এঁকে কিছুটা চেনা চেনা লাগে এই মুখশ্রী। চোখ দুটো সরু করে গভীর দৃষ্টি দেয়। চিকন ঠোঁট আকার পর কিছুটা চমকায় এবার। হাতের স্কেচটা দূরে ধরে আরো খানিকটা চমকায়। আরেহ এটা কার ছবি আঁকছে? কোহিনূর কোহিনূর লাগছে যে! চিত্রটা দেখার পর স্কেচটা আপনাআপনি যেন রাগিনীর হাত থেকে খসে পড়ে। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকার পর। পুরো শরীর ঝাড়া দিয়ে নিজের দুটো গালে হাত দিয়ে বলে ওঠে,
“ওহ হো! রাগিনী রাগিনী! এটাকে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছিস কেন? ইউ আর অ্যা ফিউচার সাইকোলজিস্ট। তাই তোকে স্বাভাবিক ব্যাপারটা বুঝতে হবে। এই দুই দিন তুই লাগাতার বেশির ভাগ সময় মি. কোহিনূরকে দিয়েছিস। যার কারণে তোর মস্তিষ্কে তারই চিত্র বিচরণ করছে। তাই তুই এটা এঁকে ফেলেছিস। তাই বলে বিষয়টা তো অন্যরকম হতে পারে না!”

এসব কথা নিজেকে বিরবির করে বলে শান্ত করে দিল রাগিনী। পুনরায় হাতে স্কেচ তুলে নিল সে। তারপর কোহিনূরের মুখটা খুব ভালো করে দেখে নিয়ে বলল,
“সো মি. কোহিনূর, আপনি তো মাঝে মাঝে লাট সাহেবদের মতো আচরণ করেন। তাই ভাবছি আপনাকে আজ আমি আমার কল্পনায় লাটসাহেব সাজিয়ে দেব।”

বলেই মুখের সামনের হাত রেখে হেঁসে ওঠে রাগিনী। তারপর একটা সরু আগার পেন্সিল কাছে নিয়ে বসে অন্য পেন্সিল কানের পিঠে দিয়ে কাজে লেগে পড়ে। প্রতিদিনের দেখা কোহিনূরের অগোছালো চুলগুলো গুছিয়ে আঁকিয়ে দেয় রাগিনী। চুলের একপাশে হালকা সিঁতি দেখা যাচ্ছে তাও বেশ সাইডে। অন্য সাইডের চুলগুলো উপরে তুলে দেওয়া। এরপর সুন্দর করে ডিজাইন করে একটা কোট আঁকে রাগিনী। স্কেচ ফুলফিল করে নিজেই হতবাক হয় সে। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে স্কেচটা স্ট্যান্ডে রেখে দিয়ে দূরে দাঁড়ায় রাগিনী। দূর থেকে লক্ষ্য করে ছবিতে থাকা সাহেব কোহিনূরকে। মুগ্ধ না হয়ে পারে না সে। আপনমনে বলে ওঠে,
“আচ্ছা কোহিনূর রত্ম? একটা কথা বলুন তো? আমার স্কেচ আঁকানো সুন্দর বলে আপনাকে এতোটা সুন্দর লাগছে নাকি আপনি মানুষটাই সুন্দর বলে এতোটা সুন্দর লাগছে? কোনটা?”

কথাটা বলে চুপ থাকে রাগিনী। বিছানায় ধপ করে বসে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে তার স্কেচের দিকে। সে হয়ত নিখুঁতভাবে আঁকেনি। তবে স্কেচে আঁকা মানুষটা যে মন মাতানো চেহারা। কিন্তু তার পরিণতি মানতে অসুবিধে হয় রাগিনীর। সে মনে মনে চায়, এমন একদিন আসুক! যেদিন রাগিনী আসলেই কোহিনূরকে সাহেব রূপে দেখতে পাবে।

ভাবতে ভাবতে একটা কাজ করে বসে রাগিনী। নিজের আলমারির কাছে গিয়ে একটা সাদা শার্ট আর কালো কোট বের করে সে। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে দেখে কোট হাতে নিয়ে তাকে মানাবে কিনা!

ড্রেস চেঞ্জ করে তৎক্ষনাৎ সাদা শার্ট আর সেই কোট পড়ে আয়নার সামনে হাজির হয় রাগিনী। চুলটা খোঁপা করে বেঁধে মুখে গম্ভীর ভাব নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“তোমার হাতের খাবার ছাড়া আমি খেতে পারি না মিস. রাগিনী! তুমি কি তা জানো না? জেনেও এমন উদ্ভট কাজকর্ম কেন?”

বলেই শব্দ করে হেঁসে দেয় রাগিনী। সে পারছে না কোহিনূরের মতো গাম্ভীর্য ধারণ করতে। তবুও আবারও গলা খাঁকারি দিয়ে আয়নার আরেকটু সামনে যায় সে। হাতটা ব্যথায় ঝিমঝিম করছে। তবে বাম হাতে লেগেছে বলে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। আর পা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে। এই হলো সমস্যা! রাগিনী আবারও বলতে শুরু করে,
“বুঝতে পারছিলাম না তোমার এই সুগভীর নয়নের দৃষ্টি দ্বারা কোহিনূর রত্মকে খাচ্ছিলে নাকি খাবার খাচ্ছিলে। আমাকে তো আর সত্যিই খেতে পারবে না তাই খাবার এগিয়ে দিলাম।”

বলে নিজেই লজ্জায় পড়ে গেল রাগিনী। চোখেমুখে হাত দিয়ে ঢেকে লজ্জা নিবারণ করার চেষ্টা করল! প্রচন্ড নির্লজ্জ হচ্ছে সে আজকাল! যে কথায় লজ্জা পায় সে কথায় বলে ফেলে। অদ্ভুত লোকের সাথে থাকার ফল বোধহয় এটাই। সে কোথায় লোকটার মানসিক সমস্যা দূর করবে বরং লোকটাই তাকে মানসিক সমস্যাই ফেলে দিচ্ছে!

দরজার খটখট শব্দে চোখমুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রাগিনী। সৈয়দ থতমত খেয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তা দেখে রাগিনীর মুখটাও ফ্যাকাশে হয়ে আসে। সৈয়দ কি সব রঙঢঙ দেখছিল তার? ভাবতেই মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে তার। দরজাটা কেন খোলা রেখেছিল সে? সৈয়দ কফির ট্রে টা সুন্দর মতো দরজার কাছে শোপিস সাজানো টেবিলে রেখে দিয়ে তোতলানো সুরে বলে,
“আপনি কফি বা…বানাতে বলেছিলেন। তাই আরকি… ”

কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই ধড়ফড় করে চলে গেল সৈয়দ। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল রাগিনী। সেও দ্রুত বিছানায় উপুড় হয়ে বালিশ দিয়ে মুখটা ঢেকে বিরবির করে বলে,
“আপনি না থেকেও শান্তি নেই কোহিনূর রত্ম! বড্ড অশান্তি দেন আমাকে।”

রাত তখন প্রায় এগারোটা। বিকট শব্দে পুরো শহরটা যেন কেঁপে উঠল। কেঁপে উঠল মাটি। কিছুক্ষণ পরেই হুড়মুড়িয়ে উপস্থিত হলো জনগন। সেই সাথে পুলিশ ও ইনভেস্টিগেশন টিম! সবার বলাবলি চলতে থাকল। লোকজনের ভীড় সরানো হলো ধ্বংসপ্রাপ্ত ফ্যাক্টরি থেকে। সেখানে প্রবেশ করল নির্জনের গাড়ি। বেরিয়ে এলো নির্জন। আগে থেকেই উপস্থিত ছিল ইন্সপেক্টর রায়ান। নির্জনকে দেখেও চুপ রইল সে। কারণ সে জানে তাকে কিছুই বলতে হবে না। সে যদি সত্যিই এবার অক্ষম হয় তবে উপরমহল থেকে শাস্তি পাবে।

নির্জন আসামাত্র গাড়ির সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো হেলদোল নেই তার। এসপি সাহেবের প্রবেশ ঘটে। তিনি আসার পরই তাকে স্যালুট করা হয়। নির্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
“এতো ক্ষতি কি করে মেনে নেব এবার অফিসার নির্জন? ভেবেছিলাম তুমি অন্যরকম। তুমি কোনো গতি করতে পারবে এই কেসের। কিন্তু সমানে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি আমরা।”

এবার রায়ান এগিয়ে আসে। নির্জনের শান্তশিষ্ট মুখ দেখে বলে,
“অফিসার নির্জন! আপনি কি আদেও কেসের জন্য কোনোরকম ক্লু পেয়েছেন?”

এবারও নির্জন চুপ। এসপি সাহেব অধৈর্য হয়ে বলেন,
“তোমার ভাবসাব এবার আমার ভালো লাগছে না অফিসার নির্জন। মনে হচ্ছে কেসটা তোমার দিকে হস্তান্তর করে ভুল করেছি আমি।”

এবার খানিকটা হাসে নির্জন। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সেই ধ্বংস প্রায় ফ্যাক্টরি দেখিয়ে বলে,
“ধ্বংস হয়েছে শুধুমাত্র সেই ফ্যাক্টরি। না প্রাণহানি হয়েছে কোনো মানুষের। আর না কোনো দামি দ্রব্য বা মেটেরিয়ালস্ এর!”

বলে থামে নির্জন। আবারও বলতে শুরু করে,
“এসপি স্যার, নির্জন আহমেদের উপর ভরসা করেছেন যখন তখন ভরসাটুকু রাখুন। নির্জন কোনো কেস হাতে নেয় সেটাকে সম্পূর্ণ এক্সপোজ করার জন্য। কোনো ক্ষতির জন্য নয়।”
#গোধূলি_বেলায়_তুমি_এসেছিলে
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৮

উপস্থিত সকলের চোখে তাক লেগে যায় এবং নিস্তব্ধতা বিরাজ করে নির্জনের বলা কথা শুনে। নির্জন থামে না। বরং দম নিয়ে বলতে শুরু করে,
“ইয়েস আমি ঠিকই বলেছি। হাতে সময় কম ছিল আমার। আমি ধরতে পেরেছিলাম এখানে মা*ইন ফিট করা ছিল। জানতে দেরি হয়েছে। তবুও যতটুকু করা সম্ভব হয়েছে ততটুকু করেছি। আই এম সরি স্যার! হয়ত আমার অসাবধানতার জন্যই আজকে আমাদের টিমের আরেকজন মেম্বার কমে গেল। শাহিদকে আমি পাঠিয়েছিলাম আমার সন্দেহ করা রাগিনী তাজরীনকে ফলো করতে। পরে ওর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে বুঝতে সময় লাগেনি যে হয়ত কিছু একটা ঘটে গেছে। তাই আমি শাহিদের লাস্ট লোকেশন ট্র্যাক করে এই পর্যন্ত আসি। আশপাশ খুঁজে ফ্যাক্টরির পেছনে খুঁজে পাই শাহিদের মৃ’তদেহ। বুঝতে পারি এখানেই কোনো গোলমাল আছে। আমি এই জায়গা সিল করে দিয়েছি আর এখানকার সবাইকে বলে দিই কাজ বন্ধের জন্য। দ্রুত লোকজন দিয়ে এখানকার মেটেরিয়ালস্ সরিয়ে ফেলি। অনেক খুঁজেও পাইনি কিছু। তাই হাল ছেড়ে দিই। আমার অনুমান অনুযায়ী এখানে ব্লা*স্টও হয়ে যায়। আর যতটুকু ক্ষতি হয়েছে তার জন্য আই এম সরি!”

সকলে স্তব্ধ হয়ে রইল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। নির্জনও এবার ক্ষ্যান্ত হলো। নির্জন জানে এবার কারোর মুখ থেকে কথা বের হবার নয়। সে সবাইকে পাশ কাটিয়ে মেহরাজের নিকটে গিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ইন্সপেক্টর রায়ানের নজর তবুও তার থেকে সরছে না। অফিসার নির্জন নামক ব্যক্তিটি ভীষণই অদ্ভুত। ঠিক সময়ে ঠিকভাবে কি করে পরিস্থিতি খুব ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে। রায়ান কিছুটা মুগ্ধ হলেও তা প্রকাশ করে না। চুপ থাকে। এসপি অফিসারের কন্ঠে নির্জনের থেকে মনোযোগ সরায় রায়ান।
“আমার এখন মনে হচ্ছে কেসটা আমি সঠিক জনের হাতে তুলে দিয়েছি। এই কেসটা একমাত্র অফিসার নির্জন সমাধান করতে পারবে। হি ইজ সাচ অ্যা ব্রিলিয়ান্ট পারসন! তার তীক্ষ্ণ বুদ্ধিই একমাত্র এতোদিনের এই পুরোনো কেসকে সলভ করতে পারবে।”

বলে থামলেন এসপি অফিসার। আবারও বলে উঠলেন,
“ওয়েট! অফিসার নির্জন কার যেন নাম বলল। রা…রাগিনী নাম! এই রাগিনীটা কে?”

রায়ানের নিরবতা ভাঙ্গে এবার। বলে ওঠে,
“রাগিনী তাজরীন! সাইকোলজিস্ট শাহ্ রাশেদের একমাত্র মেয়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে সাইকোলজি নিয়ে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায় রাগিনী যখন পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় ব্যাক করে সেই টেরো*রিস্ট টিমও সেই সময় চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসে। তাও আবার চট্টগ্রামে বিগ এনাউন্সমেন্ট করে এসেছে সেই টিম। বলেছে তারা ধ্বংস করে তবেই বিদায় হবে। আরেকটা কথা, ট্রেনে যেদিন চেক আউট করা হচ্ছিল তখন ব্যাগে যেই বো*ম বানানোর যন্ত্রপাতি সব পাওয়া গিয়েছিল সেটা রেখে সেই ব্যাগের মালিক পালিয়েছিল। আর একজনের বর্ণনা অনুযায়ী সে রাগিনী তাজরীন ছিল। তার থেকে স্কেচ এঁকে নেওয়া হয়েছে। স্কেচটা রাগিনীর সাথে মিলে যায়। এর বেশি আমার জানা নেই স্যার।”

এসপি অফিসার সবটা মনোযোগ দিয়ে শুনে বেশ কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন,
“জানা নেই এর সত্যতা কতটুকু। যদি সত্যিই তা হয় তাহলে নির্জনকে সঠিক প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ এতো বড় অপরাধের দায়ে আমরা সঠিক এবং উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া কাউকে অভি’যুক্ত করতে পারব না।”

রায়ান মাথা নুইয়ে বলে,
“ইয়েস স্যার!”

আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে রাগিনীর। প্রায় দশটা বেজে গিয়েছে। ঘুমাবে কি করে? সারারাত তো আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরঘুর করছিল। কল্পনার মি. সাহেব কোহিনূর তাকে ঘুমোতে দেয় নি একদম। চোখ বুঁজলেই দেখা দিয়ে আর তার মারাত্মক হাসি দিয়ে বিরক্ত করেছে। চোখ খোলা রাখলেও বিরক্ত করেছে। সব মিলিয়ে রাত পার হয়ে গিয়েছিল ঘুমানোর চেষ্টা করতে করতে। তাই তো আজ এতো দেরি। অবশ্য ফ্রেশ হয়েই নিজেকে তৈরি করতে শুরু করে দিয়েছে সে। একটা হলুদ রঙের লং জামা এবং তার উপরে সাদা ওড়না পেঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো সাইড করে বেনী করে ছেড়ে দিল সে। তারপর খেয়াল করল ড্রেসিং টেবিলের পাশে সদ্য ফোঁটা কাঠগোলাপগুলো পড়ে আছে। তাদের বাড়ির পেছনে বড় কাঠগোলাপের গাছ থেকে মাটিতে পড়ে ছিল ফুলগুলো। রাগিনী ফুল পছন্দ করে বলে সৈয়দ মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে এনে রেখে দেয় রাগিনীর ঘরে। তা দেখে রাগিনী একটা একটা করে ফুল হাতে গিয়ে চুলের বেনীর প্রতিটা ভাঁজে লাগিয়ে নেয়। চুল ঠিকঠাক করে নিজেকে দৃঢ় নয়নে পর্যবেক্ষণ করে দেখে খুব একটা খারাপ লাগছে না তাকে। ভালোই লাগছে। কিন্তু কান ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!

ড্রয়ার থেকে বের করে ছোট্ট দুটো ঝুমকো দুই কানে পড়ে রাগিনী। হাতে একটা একটা করে সযত্নে পড়ে নিল হলুদ ও সাদা রেশমি চুড়ি! তারপর হাত ঝাঁকাতেই ঝনঝন করে উঠল তার হাত। শব্দটা কানে আসতেই হালকা শব্দ করে হাসে রাগিনী। তারপর উঠে যায় আয়নার সামনে থেকে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে একটু কষ্ট হচ্ছে রাগিনীর। পায়ের ব্যথা রয়ে গেছে এখনো একটু। হাতটা এখনো আগের মতোই ব্যান্ডেজ করা। সেদিকে খেয়াল নেই ততটা। দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলেছে সে। তার নামার ধরণ দেখে সৈয়দ খেয়াল করে বলে উঠল,
“রাগিনী মা, এতো তাড়াহুড়ো করে নামছো কেন? তোমার পায়ে তো লাগা আছে। হাতের অবস্থাও তো ভালো নয়। এই অবস্থায় তাড়াহুড়ো করে কোথায় যাচ্ছো?”

কথা শোনার নয় রাগিনী। ছুটে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে রাগিনী। আর বলে,
“সৈয়দ কাকা! তোমাকে যে বলেছিলাম টিফিনবক্সে খাবার রেডি করতে সেটা করেছো?”

“হুমম করছি। কিন্তু এতো সকালে কই যাচ্ছো? স্যার জানে তুমি যাচ্ছো বাহিরে?”

“আমি কথা বলে নেব। এখন তাড়াতাড়ি আমাকে একটু খাবার দাও তো। হাতে একদম সময় নেই জানো তো! জলদি করো।”

সৈয়দ এগিয়ে এসে রাগিনীকে খাবার বেড়ে দেয়। খাবার মুখে দিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
“ইশশ… কোহিনূর সাহেব বোধহয় না খেয়ে বসে আছেন এখনো!”

সৈয়দের বুঝতে বাকি থাকে না রাগিনী কোথায় যাচ্ছে! তিনি গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে কিছুটা শান্ত ভঙ্গিতে বললেন,
“রাগিনী মা! তোমার কি মনে হয় না তুমি ওই পাগলটাকে নিয়ে একটু বেশিই চিন্তাভাবনা করছো?”

রাগিনীর খাওয়া বন্ধ হলো। সৈয়দের কথা বোঝার চেষ্টা করে বলে উঠল,
“আমি শুধু উনাকে তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। এখানে অতিরিক্ত তো কিছুই করিনি। আর কাকা! উনার একটা নাম আছে। সেই নাম ধরে সম্মোধন করলে ভালো লাগে।”

বলেই ভার মুখে খাবার খাওয়া আরম্ভ করে রাগিনী। সৈয়দ আর কিছু বলেন না। কিই বা বলবে? যদি রাগিনী রেগে যায়?
অল্প খেয়ে উঠে গেল রাগিনী। নিজ গন্তব্যের জন্য বেরিয়ে গেল দ্রুত!

সকাল সকাল ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে আছে কোহিনূর। মুখে নেই কোনো হাসি শুধু রয়েছে তিক্ততা। গোমড়া মুখ করে চেয়ে আছে দরজার দিকে। দরজা অনবরত বাহির থেকে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে আজিম। আজ সে এসেছে সকালের খাবার নিয়ে। কিন্তু খাবার নিয়ে আসা দেখেই কোহিনূরের দরজা লক করে দেওয়া শেষ। সে এখন ঘরে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। এতো দরজা ধাক্কানোর শব্দে ক্ষুদ্ধ সে। হঠাৎই তার ক্ষুব্ধ মনে সুভাসের সঞ্চার হয়ে এলো রাগিনীর কন্ঠস্বর। দরজায় হালকা থাবা দিয়ে নমনীয় কন্ঠে ডাকছে রাগিনী। কোহিনূরের ঠোঁটের প্রান্তে মূহুর্তেই চলে আসে এক রাজ্য জয়ের অদ্ভুত হাসিটা। দেরি না করে তড়িঘড়ি করে গিয়েই খুলে দেয় দরজা।

আচমকা দরজা খোলাতে চমকে উঠে তাকায় রাগিনী। তার বাম হাতে টান পড়ে। চাপ পড়ে ঠিক কাটা জায়গায়। চিৎকার করবার আগেই তাকে ঘরের ভেতরে টেনে আনা হয়। আর বসিয়ে দেওয়া হয় অগোছালো বিছানায়। ততক্ষণে রাগিনী চোখ খিঁচে ফেলেছে ব্যথায়। হাত যেন ছিঁড়ে গেছে। বড়বড় শ্বাস ফেলতে থাকে সে। বাম হাতটা কাঁপতে থাকে অনবরত। আকস্মিকভাবে রাগিনীর এমন রূপে হতবিহ্বল নয়নে দৃষ্টিপাত করছে কোহিনূর। মুখে কোনো শব্দ আসছে না। শরীরে নেই কোনো গতি। তার সামনে এক অপরূপ নারী। বেনী করে বেঁধে রাখা চুলগুলোতে আঁটকে রাখা কাঠগোলাপেই চোখ আটকায় তার। খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয় কোহিনূরের। রাগিনীর ঠোঁটে হালকা করে লিপ গ্লোস লাগানো। সেই ঠোঁটে গিয়ে আঁটকে গেছে কিছু ছোট চুল। না চাইতেও কোহিনূরের হাত চলে যায় সেখানে। আলতো করে ছুঁইয়ে সরিয়ে দেয় সেই ছোট চুল। কানে সুন্দর করে গুঁজে দিতেই তার খেয়াল হয় সে কি করছে? তড়তড় করে হাত সরিয়ে নেয়। পুরো শরীর কেঁপে ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে তার। খেয়াল করে তার কন্ঠস্বর শুঁকিয়ে এসেছে। নারীর রূপের ঝলক বুঝি এতোই তীব্র হয় যে একজন পুরুষের গলা শুঁকিয়ে আসে? হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়? কোহিনূর না চাইতেও অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“এতোগুলো কাঠগোলাপের ভেতরে থাকা এক বড় কাঠগোলাপ এই মানবী। যেই কাঠগোলাপের সৌন্দর্য সব থেকে বেশি চোখে পড়ছে আমার! চোখটা যেন ঝলসে যাচ্ছে।”

এতোক্ষণ অবধি চোখটা বন্ধ রেখেছিল রাগিনী। হাতটা ব্যথা যে নাড়ানো যাচ্ছে না একেবারেই। কিন্তু কোহিনূরের স্নিগ্ধ সেই কন্ঠে অদ্ভুত সব বাক্য শুনে যেন চোখটা আপনাআপনি খুলে গেল। একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো কোহিনূরের দিকে। লোকটা তাকে বুঝি মনোযোগ দিয়ে দেখেছে? এই সাজ বুঝি তার পছন্দ হয়েছে? রাগিনীর মনটা না চাইতেও খুশিতে নেচে ওঠে। এ কেমন মনের এক অনাকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি? না চাইতেও এই অনুভূতির প্রবেশ কেন?

চলবে…

[বি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here