গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -৩৭+৩৮

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_সাঁইত্রিশ[প্রথমাংশ]
[Holud Special]

হলুদ লেহেঙ্গার সাথে লাল আর হলুদ কম্বিনেশনে গহনা পড়েছে ফাইজা। খোলা চুলে সৌন্দর্য দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ফারদিনের আবদারে চুল খোলা রাখতে হয়েছে। আরজা আজো ফাইজার মতো সেম কালার লেহেঙ্গা আর গহনা পড়েছে। কিন্তু ওর চুল গুলো স্টাইল করে বেনুনী করে বাধা আর বিভিন্ন রঙিন ক্লিপ লাগানো চুলে। আরজা’কেও দেখতে খুব মিষ্টি লাগছে। কাল অনুষ্ঠান শেষে ফাইজা জোর করে আরজা’র হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছিলো। হাতের মাঝে [AJ] খুব সুন্দর করে লিখে দিয়েছে। এতে অবশ্য আরজা’র খটকা লাগে’নি কারন আরজা যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার নাম ও J দিয়ে। আরজা’র মুখে আজ চওড়া হাসি। মনে হচ্ছে সব কিছু ঠিক ঠাক আছে আজ। খুব সহজে’ই মেনে নিয়েছে সব আরজা। কেনো যেনো এই ব্যাপার’টায় জেহেরের খটকা লাগছে। জেহের, ফারদিন আজ বাসন্তী আর লাল কম্বিনেশনে পাঞ্জাবী পড়েছে। হাতে আজ সিলভার কালার ঘড়ি। ফারদিন সব কিছুর তদারকি করছে আর জেহের মন ম’রা হয়ে এক কোনে চেয়ারে বসে বসে ভাবছে…..

–একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার ড্রামাকুইন’টা খুব কষ্ট পাচ্ছে। মুখের হাসি বিলিন হয়ে গেছে। চঞ্চল মেয়ে’টা শান্ত হয়ে গেছে। বিশ্বাস করো, আমার ও তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। কিন্তু, জানো তো, কষ্টের পর স্বস্তি আছে। আর এটা তোমার শাস্তি। কি শাস্তি জানো, আমাকে ভালোবেসেও অন্য একজনের সাথে টাইম পাস করার শাস্তি…….

কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে জেহের হকচকিয়ে উঠে ঘুরে তাঁকিয়ে দেখে আরজা’র মা দাড়িয়ে আছে। আরজা’র মা’কে দেখে’ই জেহের দাড়িয়ে পড়ে সালাম দিয়ে অন্য একটা চেয়ার তার দিকে এগিয়ে দিলো বসার জন্য। আরজার মা বসতে বসতে জেহের’কেও বসার জন্য ইশারা করলো। জেহের মাথা নিঁচু করে শান্ত কন্ঠে বললো….

–আমাকে ক্ষমা করবেন আন্টি। আমি জানি আমি আপনাদের মেয়ে’কে খুব বেশি কষ্ট দিচ্ছি। আর মাত্র একটা দিন তারপর আর কোনোদিন আপনার মেয়ে’কে কষ্ট দিব না আন্টি প্রমিস…

জেহেরে’র নিঁচু স্বর শুনে আরজা’র একটু হেসে জেহের’কে বলে উঠলো……

–আমি জানি বাবা তুমি আমার মেয়ে’কে খুব বেশি ভালোবাসো। আর, এই সারপ্রাইজ’টা পেয়ে আমার মেয়ে তোমার উপর রেগে থাকতে’ই পারবে না। আমি তো শুধু তোমার সাথে কথা বলার জন্য আসলাম।

আরজা’র মায়ের কথায় জেহের এইবার স্বস্তির হাসি হাসলো। ভেবেছিলো মেয়ের কষ্টে হয়তো উনারা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাই আগেই অনুতপ্ত হয়ে কথা গুলো বলেছে।
___________________________________________
তনুজা আর সায়মা খানম মিলে ওদের দুজন’কে নিয়ে নিচে নামলো। হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। আজো কালকের মতো আরজা আর ফাইজা এক সোফায় আর ফারদিন জেহের এক সোফায়। জেহের’কে আজ খুব সুন্দর লাগছে। না চাইতেও আরজা’র চোখ বার বার ওই দিকে যাচ্ছে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ফারদিন মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্য হাসি মুখে বলে উঠলো…..

–আজ অনুষ্ঠান শুরু হবে আমার একমাত্র শা’লিকার একটা মন মাতানো গান দিয়ে সাথে সুর মেলাবে তার ওয়ান এন্ড অনলি জিজু ফারদিন। সবাই রাজি তো……..

ফারদিনের কথা শুনে সবাই এক সাথে কড়ো তালি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠে সম্মতি জানালো। আর আরজা অস্বস্তি’তে পড়েছে। গান’টা ও বরাবর খুব ভালো গায়। ছোট বেলা থেকে’ই গানের প্রতি জোঁক বেশি ওর। গান ও শিখেছে কয়েক বছর। কিন্তু অনেক দিন গানের সাথে ওর দেখা সাক্ষাত নেই। এই মুহূর্তে কি গান গাইবে তা নিয়ে খুব বেশি ভাবনায় পড়ে গেলো। ফারদিন স্টাইল করে গিয়ে আরজার দিক্ব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো……

–কাম ইন মাই হাফ-ঘাড়ওয়ালি…..

সবাই আরেকবার করোতালি দিয়ে উঠলো। আরজা’র অস্বস্তি নিয়ে ফারদিনে’র হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে এলো। মাইক্রোফোন’টা হাতে নিয়ে জেহেরের দিকে একবার নজর দিলো। জেহের এক দৃষ্টি’তে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে তা দেখে তাড়াতাড়ি আরজা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। ফারদিনের কাছে গানের’ নাম’টা বলতে’ই ফারদিন অসহায় ফেস করে ফিসফিসিয়ে আরজা’র কানে বললো…..

–আজ এত সুন্দর একটা দিনে তুমি এই ছ্যাকা খাওয়া মার্কা গান গেয়ে সবাই’কে ইমোশনাল করে দিবে তো শা’লিকা…….

ফারদিনের কথা আরজা স্বশব্দে হেসে উঠলো। দুষ্টুমি ভঙ্গিমাতে বলে উঠলো….

–আমি তো আর আমার জিজুর মতো রোমান্টিক নই যে রোমান্টিক গান গেয়ে সবাই’কে রোমান্টিক বানিয়ে দিব। এই দায়িত্ব’টা বরং আমার জিজুর থাকুক আর আমি না হয় দুঃখ বিলাশ করার জন্য এই গান’টাই গাইলাম……..

আরজার এহেতুক কথা শুনে ফারদিনের মুখ’টা চুপসে গেলো। উওর দেওয়ার শব্দ খুঁজে পেলো না। হাফ ছেড়ে বললো…..

–যথা আজ্ঞা। আপনি যাহা বলিবেন তাহা’ই হইবে…..

বলে দুজনে’ই একসাথে হেসে উঠলো। আরজা’র কথা মতো ফারদিন গিটারে সুর তুলতে লাগলো। আর আরজা মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে গান’টা শুরু করতে যেয়েও কয়েকবার থেমে গেলো। ওর বুকের ভেতরে সুনামি শুরু হয়েছে। এলোমেলোহীন ঢৈউ এসে বার বার তীরে আছড়ে পড়ছে। চোখের পাতা দুটো নোনা জল দ্বারা ভারী হতে লাগলো। তাও মুখে হাসি ফুটিয়ে জেহেরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাইতে শুরু করলো……

“তুমি যাকে ভালোবাসো”
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো
তার জীবনে ঝড়…

তোমার কথায় শব্দ দূষন
তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি
আমার দারুন জ্বর

তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর….
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘুর….

এইটুকু গেয়ে থেমে গেলো ওর গলার স্বর আটকে আসচ্ছে। বুকের ভেতর চে’পে আসচ্ছে। জেহেরের দিকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অন্য দিকে দিয়ে আবার গাইতে শুরু করলো…….

তোমার নৌকোর মুখোমুখি আমার সৈন্য দল
বাঁচার লড়াই…..

আমার মন্ত্রী খোয়া গেছে
একটা চালের ভুল
কোথায় দাড়াই……?

কথার উপর কেবল কথা
সিলিং ছুঁতে চায়..
নিজের মুখে আয়না আদল
লাগছে অসহায়….

তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান….
তুমি অন্য কারোর ছন্দে বেঁধো গান……

এইটুকি গেয়ে আর গাইতে পারলো না আরজা। চোখ থেকে নেমে এলো অথৈজল। চোখের নোনা জল সবার থেকে আড়াল করার জন্য গান’টা এইটুকু গেয়েই দৌড়ে অন্য দিকে চলে গেলো। আরজা’কে ওমন ভাবে দৌড়ে যেতে দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে আছে। আর জেহের নিস্তব্দ হয়ে মাথা নিঁচু করে আছে। ওর চোখ থেকেও টুপটাপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে। ফারদিন অসহায় চোখে ফাইজা’র দিকে তাঁকাতে’ই দেখলো ফাইজা’র চোখেও জল। ফারদিন তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি সামলানোর জন্য চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–আমার শা’লিকার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স এর জন্য একটা হাত তালি অবশ্যই প্রয়োজন………

ফারদিনের কথায় সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠলো। কেউ কেউ শিষ বাজালো। নিরবতা কেটে গেলো সাউন্ড বক্সের গানে। ফাইজা স্টেজ থেকে নেমে আরজা পেছন পেছন গেলো। আরজা এক কোনে দাড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফাইজা গিয়ে আরজার কাঁধে হাত রাখতে’ই আরজা আচমকা ফাইজা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। ফাইজা কি বলে স্বান্তনা দিবে খুঁজে পাচ্ছেনা। নিজেকে অপরাধী লাগছে। কাল আরজা’র কষ্ট দেখতে না পেরে অর্ধেক সত্যি’টা আরজা’কে বলে দিয়েছিলো। আরজা’কে বলে ছিলো জেহের কাউকে ভালোবাসেনা। আর বিয়েও অন্য কাউকে করবেনা। আর এটা বলেছে একটু অপেক্ষা কর তোর জন্য বিরাট একটা সারপ্রাইজ আছে। আরজা ফাইজা’র কথা ভাবার্থ পুরো বুঝতে পারেনাই। তাই আরজা কষ্ট পাচ্ছে কারন জেহের আরজা’র থেকে দূরে দূরে থাকছে তাই। আরজা কাঁদতে কাঁদতে বললো……

–জেহের ভাইয়া কেনো আমাকে কষ্ট দিচ্ছে ফাইজু। আমার সত্যি অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। এর থেকে ম’রে যাওয়া ও বোধহয় ভালো। আমার ম’রে যেতেই ইচ্ছে করছে……

ফাইজা এইবার রেগে আরজা’কে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলো….

–ম’রে যাবি তাইনা। কেনো ম’রে যাবি। কেনো এত কষ্ট পাচ্ছিস?

এইবার আরজা চুপ করে গেলো। আরজা কখনো ফাইজা’কে বলে’নি ও জেহের’কে ভালোবাসে। তাও কাল ফাইজা নিজেই বলেছিলো আরজা’কে অর্ধেক সত্যি। আজো আরজা’র নিশ্চুপ থাকা’টা ফাইজা মেনে নিতে পারছেনা। আরজা কথা এড়িয়ে যেতে চোখের জল মুছে নিয়ে বললো……

–গান গাইতে গাইতে আমি বেশি ইমোশনাল হয়ে গেছি ফাইজু। কি বলতে কি বললাম এইসব নিয়ে ভাবিস না। চল চল ওইদিকে সবাই কি ভাবছে কে জানে? তাড়াতাড়ি আয়……

বলে আরজা সামনে পা বাড়ালো। আর ফাইজা ওর দিকে তাঁকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো…..

—কাল তোর সব দুঃখ,যন্ত্রনা ঘুঁচে যাবে। আমার ভাই’টা ও কষ্ট পাচ্ছে। তাও কেনো এমন করছে কে জানে? হয়তো কিছু সারপ্রাইজ এমন বিষাদময় হয়…….

বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও পা বাড়ালো সেদিকে।
আরজা স্টেজের সামনে এসে জেহের চুপসানো মুখের দিকে তাঁকিয়ে নিজে নিজে’ই হালকা হেসে বললো……

–ভালোবাসারা থাকুক হৃদয়ে লুকায়িত…
প্রকাশ হোক অশ্রুধারার বিষাদিনী যন্ত্রনা…….
#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_আটত্রিশ[শেষাংশ]
[Holud special]

ফাইজার মুখের উপর ফারদিনের গরম নিশ্বাস পড়ছে। অনুভূতি’তে বুকের ধুকপুকানি বেড়ে চলেছে। ফারদিনের থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মুচড়া-মুচড়ি করে যাচ্ছে ফাইজা। আর ফারদিন সে এক ধ্যানে তাঁকিয়ে আছে তার প্রেয়সীর দিকে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথে ফারদিন’ ও’কে টেনে নিয়ে আসে। সেই থেকে এক নজরে তাঁকিয়ে আছে ওর দিকে। এতে ফাইজা’র অস্বস্তি যেনো বেড়ে চলেছে। ফাইজা এইবার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে প্রশ্ন করে বসলো…….

–কি সমস্যা আপনার? যখন তখন টানাটানি শুরু করেন। এখন কিছু বলেন না। খালি হা করে তাঁকিয়ে আছেন…..

ফারদিন উওর না দিয়ে ফাইজা’র নাকে নাক ঘষলো। অনুভূতি’তে এইবার ফাইজা ফারদিনের পাঞ্জাবি খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। ফাইজা’র চোখের পাতা কাঁপছে। ঠোঁট গুলো তিরতির করছে। এতে ফারদিনের নেশা যেনো দ্বিগুন বেড়ে গেলো। কপালে হলুদ লাগানো দেখে মুখ’টা হলদে হয়ে আছে দেখতে বেশ মায়াবী লাগছে। ফারদিন ঘোর লাগা কন্ঠে বললো……

–আমার বউ’টাকে যদি আমি হলুদ না লাগাতে পারি তাহলে পুরো হলুদ অনুষ্ঠান অসম্পন্ন রয়ে যাবে তো…….

ফাইজা এখনো চোখ বন্ধ করে রয়েছে। ফারদিন পাশের টেবিল থেকে হলুদের বাটি নিয়ে ফাইজা’র দুই গালে, নাকের মাথায় লাগালো। তারপর নিজেই ফাইজা’র গালে গাল ঘষলো। ফারদিনের হালকা দাড়ির খোচা ফাইজার গালে লাগতে’ই আরো বেশি খামচে ধরলো ফারদিনের বাহু। ফাইজা’র অবস্থা দেখে ফারদিন মুখ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। ফাইজা হালকা কাঁপছে। তা দেখে ফারদিন ফাইজা’র দিকে ঘনিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলো…..

–আজকে এত বেশি কাঁপা-কাঁপি করো না জান। কিছু’টা না হয় আমাদের ফুলশ….

বলতে পারলো না তার আগে’ই ফাইজা ফারদিনের মুখ চে’পে ধরলো। ফারদিন না থেমে ফাইজা’র হাতে চু’মু খেলো। ফাইজা রাগী চাহনী দিয়ে বললো…….

—মুখ সামলা’তে শিখুন। আর কেউ যদি এখন এসে আমাদের দেখে কি হবে ভাবুন তো?

ফারদিন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো……

–এখন থেকে মুখ সামলানো শিখব কেনো? বরং বেশি বলব কারন এখন থেকে তুমি আমার বউ। আর কেউ দেখলে দেখবে তাতে আই ডোন্ট কেয়ার। আমার বউ, আমার মুড, আমি রোমান্স করব তাতে কার বাবার কি বলো তো? আমি পারলে তো এক্ষুনি…….

বলে থেমে গেলো। সশব্দে হেসে ফাইজা’র নাকে নাক ঘষলো পূর্নরায়। ফাইজা’র গাল দুটো দুই হাতে আকড়ে ধরে ফাইজা’র কপালে কপাল ঠেকালো। নেশাময় কন্ঠে বললো……

–আর মাত্র কয়েক ঘন্টা তারপর তুমি সারাজীবনের জন্য আমার। শুধু আর শুধুমাত্র আমার জান। উপর ওয়ালা ছাড়া কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবেনা জান।

ফাইজা এইবার আদুরে হয়ে উঠলো। ভালো লাগা এক আবেশে ছেয়ে গেলো অঙ্গ-প্রতঙ্গ। “ভালোবাসি” বলে আকড়ে ধরলো ফারদিন’কে। ফারদিন ও মিষ্টি হেসে জড়িয়ে নিলো নিজের প্রিয়তমা’কে।
____________________________________________
আরজা চারদিকে ফাইজা’কে খুঁজতে ছিলো। খুঁজতে খুঁজতে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠতে’ই কারোর হেচকা টানে বিশাল দেহী কারোর বুকে ধাক্কা খেলো। আরজা চোখ মুখ কুচকে রেখেছে ভয়ে। ভেবেছিলো সিড়ি দিয়ে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু নাকের মধ্যে চেনা পারফিউমের ঘ্রান যেতে’ই আরজা’র বুক’টা কেঁপে উঠলো। শরীরে কম্পন সৃষ্টি হলো। ভয়ে ভয়ে মাথা উঠাতে’ই সামনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি’কে দেখে আরজা কয়েকপা পিছিয়ে যেতে নিয়েও পারলো না। জেহের ও’কে শক্ত করে ধরে সামনের দেয়ালের সাথে চে’পে ধরলো। আরজা ভয়ে বার বার ঢোঁক গিলছে। কাঁপা-কাঁপি স্বরে বললো……

-দূরে সরে দাড়ান জেহের ভাইয়া। আমার অস্বস্তি হচ্ছে…..

জেহের ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে আরজার গালে স্লাইড করতে’ই আরজা চোখ বন্ধ করে নিলো। জেহের কিছু’টা আরজা’র দিকে ঝুঁকতে’ই আরজা’র হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো। চোখ খুলতে’ই জেহের’কে নিজের এত কাছে দেখে কিছু’টা অবাক হলো। এক নজরে জেহের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। জেহের আরজা’র দিকে তাঁকিয়ে মুচকি হেসে আরজার গালের সাথে গাল ঘষে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে নিমিশেই আরজা’র থেকে দূরে চলে গেলো। সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে আরজা’র দিকে পেছন ফিরে তাঁকিয়ে দুষ্টুমি হাসি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। আর আরজা ঠান্ডা বরফ হয়ে দাড়িয়ে আছে। ওর শরীর নিমিশেই বরফে পরিনত হলো। হঠাৎ এহেতুক ঘটনায় আরজা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। নিজের লেহেঙ্গা’ জোরে খামচে ধরলো। কল্পনাও করতে পারছেনা জেহের এমন কাজ করতে পারতে। মনের মধ্যে প্রশান্তি বয়ে চললো। খুশিতে মুখে হাসি ফুটলো আরজা’র। চোখ দিয়ে টুপটাপ করে পানি পড়তে লাগলো। আজকের এই নোনাজল খুশির। কষ্টের না। চোখ বন্ধ করে গাল হাত দিয়ে জেহের ছোয়া অনুভব করতে লাগলো।
____________________________________________
রাতে অনুষ্ঠান শেষে সবাই সব কিছু গুঁছিয়ে সুয়ে পড়লো। কিন্তু সবার চোখের আড়ালে ফারদিন জেগে আছে। তার প্রিয়তমা’কে এক নজর দেখার জন্য। আজকের রাত’টা প্রিয়তমা’র সাথে কাটাবে বলে। কিন্তু ফাইজা কোথায় ঘুমিয়েছে ফারদিন নিজেও জানেনা। তাই সবাই সুয়ে পড়তে অন্ধকারে ফারদিন পা টিপে টিপে সবার আগে গেস্ট রুমে ঢুকলো। কারন, ওর জানা মতে ফাইজা আর আরজা দুজনের এই রুমে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রুমের দরজায় হাত রাখতে’ই দেখলো দরজা খোলা। মনে মনে একটু খুশি হলো। মোবাইলের আপসা আলোয় রুমের মধ্যে ঢুকলো। খাটের সামনে যেতে তিন জোড়া পা দেখে ফারদিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। জানা মতে দুই জোড়া পা থাকা’র কথা। সবাই পাতলা কম্বল দিয়ে মুড়ি দিয়ে সুয়ে আছে। গরমের মধ্যে কেউ কম্বল গায়ে সুয়ে থাকতে পারে। ভাবতে পারছেনা ফারদিন। এখন কি করে ফাইজা’কে খুঁজে বের করবে? খুব চিন্তায় পড়ে গেলো এইবার। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে লাগলো একটা উপায় খুঁজে পাওয়ার জন্য। মাথা’র মধ্যে তৎক্ষনাৎ একটা দুষ্টু বুদ্ধি আসলো। ওদের পায়ের সামনে বসে আস্তে আস্তে তিনজনের পায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো। পাশের দুইজনের মধ্যে তেমন একটা ভাবান্তর হলো না। মাঝের’টার পায়ে সুড়সুড়ি দিতে’ই আচমকা ফারদিনের মুখে এসে এক লা/থি উড়ে এসে পড়তে’ই ফারদিন হঠাৎ ব্যাথায় “আহ” করে মৃদ শব্দ করে পড়ে গেলো। নাক বরাবর লা’থি’টা এসে পড়েছে। ফারদিন নাক ডলতে ডলতে মিনমিনিয়ে বলে উঠলো……

—ও খোদা এ কার পা’টা উড়ে এসে আমার কপালে ঠেকলো কে জানে? তারে যদি একবার পাই ওর নাক’ আমি ঘু’ষি মে’রে থেতলে দিব। ঠিক করে ঘুমাতে পারেনা নাকি। ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছড়ানোর অভ্যাস যদি আমার বউ’টার থাকে আমার কি হবে?

ফারদিনের মুখ’টা এই মুহূর্তে খুব অসহায় লাগছে। এমন সময় পাশের একজন নড়ে উঠতে’ই তার হাত কম্বলের নিচ থেকে বেড়িয়ে এলো। কিন্তু হাত’টা সম্পূর্ণ ঢাকা ওড়না দিয়ে। ওড়না’টা চিনতে পেরে ফারদিনের মুখে হাসি ফুটলো। খুশি মনে উঠে গিয়ে মানুষ’টার মুখ না দেখে’ই জড়িয়ে ধরলো। ফারদিন কম্বলের উপর দিয়ে মুখ অনুমান করে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো…..

–জান একটু উঠো না প্লিজ। আজকের রাত’টা তুমি আর আমি নির্ঘুম কাটাব। কালকে তো আর সুযোগ পাবোনা। তাই উঠোনা প্লিজ……

ফারদিন বলতে’ই জবাবে কেউ চিকন স্বরে মিনমিনিয়ে বললো….

–নাহ জান আমি উঠতে পারব না….

গলার স্বর’টা অচেনা লাগলো ফারদিনের। পরক্ষনেই মনে করলো হয়তো ঘুমের কন্ঠ তাই অন্যরকম লাগছে। তাই আরো একবার চুমু খেয়ে বললো……

–উঠোনা জান প্লিজ। সবাই জেগে গেলে খুব সমস্যা হয়ে যাবে………

কথা’টা শেষ হতে না হতে’ই রুমে আলো জ্বলে উঠলো। আলো দেখে ফারদিন ধড়ফড়িয়ে উঠে দাড়াতে’ই বিস্ফোরিত কন্ঠে ভেসে আসলো……

–বাহঃ বাহ আপনি আমাকে শেষ অব্দি ঠকালেন। এই রাতের আধারে আপনি মেয়েদের সাথে এইসব করেন। ছিঃ…….

চেনা কন্ঠস্বর শুনে ফারদিন চোখ বড় বড় করে পেছনে তাঁকাতে’ই ফাইজা’কে দেখে ওর হার্ট অ্যাটাক করার অবস্থা। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেলো। একবার খাটের দিকে তো আরেকবার ফাইজা’র দিকে তাঁকিয়ে তোতলানো স্বরে বলে উঠলো……

–তুতুমি এখানে?

ফাইজা এইবার রাগী ফেস করে ফারদিনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো…..

–হ্যা আমি এখানে। আর আমি এখানে বলেই দেখতে পারলাম আপনার আসল রুপ। কাল আমাদের বিয়ে আর আজ আপনি এইসব করছেন।

বলেই ন্যাকা কান্না শুরু করলো। মুখে ওড়না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো…..

–এখন আমি সবাইকে মুখ দেখাব কি করে?

বলে কান্নার বেগ বাড়িয়ে নিচে বসে হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করতে করতে কপাল চাপড়ে বলতে লাগলো……

— এ আমার কি সর্বনাশ হলো গো? এখন আমার কি হবে গো? ও খোদা তুমি আমার কপালে এমন একটা স্বামী লিখেছিলে? আমার কি হবে গো?? এখন আমাকে কে বিয়ে করবে গো?

ফারদিন বেচারার কান্না করে দেওয়ার উপক্রম। মুখ দিয়ে শব্দ’ই বের হচ্ছেনা। ফাইজার চিৎকার শুনে জেহের আর দৌড়ে এলো পাশের রুম থেকে। আরজা আর তনুজা দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। কিন্তু কম্বলের নিচে কে আছে এখনো ফারদিন জানেনা। তনুজা খাটে বসে বসে মিটমিটিয়ে হাসচ্ছে। ফারদিন তাঁকাতেই এমন একটা ভান ধরলো যেনো এখানে কি হচ্ছে সে কিছুনা। তনুজাও ফারদিন’কে দেখাতে বিস্ময় ভরা চোখে তাঁকিয়ে রইলো। আরজা তাড়াতাড়ি ফাইজা’র কাছে এসে বসে প্রশ্ন করে বসলো……

–কি হয়েছে ফাইজু? এত রাতে এভাবে কান্না করছিস কেনো?

জেহের ও এগিয়েও সেম প্রশ্ন করলো। ফাইজা আরজা’কে জড়িয়ে ধরে বিলাপের স্বরে পূর্নরায় বলতে লাগলো…..

–আমার সব শেষ হয়ে গেছে রে আরজু। আমি এখন এই মুখ কি করে দেখাব। আমার স্বামী কিনা……

এইটুকু বলেই কান্নার বেগ আরো বাড়িয়ে দিলো। ফারদিন অসহায় হয়ে দাড়িয়ে ফাইজা’র দিকে চেয়ে আছে। ওর সাথে কি হচ্ছে ও এখনো বুঝতে পারছেনা। মাথার দশ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। ফারদিন সব কিছু মাথায় রেখেও অবাক স্বরে বলে উঠলো…..

–ফাইজা যদি এখানে থাকে তাহলে কম্বলের নিচে কে?

এইটুকু প্রশ্ন করে কম্বল’টা টান দিয়ে সরাতে’ই কম্বলের নিচের ব্যাক্তি’টাকে দেখে ফারদিন জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো……

–লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনায-যোয়ালিমিন…..

এইটুকু বলে বুকে হাত দিয়ে ধড়াম করে খাটের উপর পড়ে গেলো। ফারদিন’কে এমন করে পড়তে দেখে উপস্থিত সবাই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। সায়মা খানম ভয় পেয়ে গেলো। ফাইজা আর আরজা দুজনে’ই দৌড়ে গেলো ফারদিনের দিকে। ফাইজা ফারদিনের সামনে গিয়ে ফারদিনের গালে সপাটে একটা থা’প্প’ড় মা/রতে’ই ফারদিন লাফিয়ে উঠে ফাইজা’র হাত ধরে বলতে লাগলো…..

–বিশ্বাস করো জান৷ আমি ভেবেছিলাম ওইটা তুমি। আমি অন্য মেয়ের জন্য এখানে আসি’নি…..

ফাইজা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ন্যাকা স্বরে বললো…….

—আপনাকে আর মিথ্যা বলতে হবেনা। আমি আপনার পাপি মুখ দেখতে চাইনা। চললাম আমি বাপের বাড়ি…..

বলে মুখে ওড়না গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে এলো। আরজা ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে বলে উঠলো……

–জিজু আপনার যে এই মুদ্রাদোষ ছিলো আগে জানতাম না। ছিঃ জিজু ছিঃ আপনি আমার প্রানের টুকরো বান্ধবী’কে ঠকালেন। এমন আশা করি’নি আপনার কাছে থেকে ছিঃ…..

বলে আরজা ও বেড়িয়ে গেলো। তনুজা ফারদিন’কে এসব বলে বেড়িয়ে গেলো। আর সায়মা খানম মিটমিটিয়ে হাসচ্ছে। তা দেখে ফারদিন এইবার কাঁদো কাঁদো স্বর করে বলে উঠলো…..

–এই বুড়ো কালে তোমার আমার চুমু খেতে ইচ্ছে করল দীদা। কি দরকার ছিলো আমার বউ এর ওড়না’টা হাতে প্যাচানোর। এখন আমার কি হবে গো দীদা। এখন আমার কি হবে….

এইবার ফারদিন ও হাত পা ছড়িয়ে বিলাপ করতে লাগলো। আর সায়মা খানম মিছে মিছে স্বান্তনা দিতে লাগলো। জেহের হাবুলের মতো চেয়েই আছে ফারদিনের দিকে। বেচারার মুখ দেখে জেহের পেট ফেটে হাসি হাসচ্ছে। কিন্তু হাসতে পারছেনা।
____________________________________________
ফাইজা আর আরজা রুমের বাড়িয়ে সিড়ির সামনে দুজনে থেমে গেলো। ফাইজা মুখ ঘুরিয়ে আরজা’র দিকে মুখের ভঙ্গিমা চেঞ্জ করে লাজুক স্বরে বললো……

—আমিও তোমার থেকে কম অভিনয় জানিনা বান্ধবী। কেমন হলো আমার অভিনয় বলো তো…..

ফাইজার কথা শুনে ওরা আর নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারলো না। দুজনে এক সাথে হা হা করে হেসে দিলো। পেট ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে ফাইজা’র তাও হাসি থামছে। ফারদিন’কে ঘোল খাওয়ালো প্লান করে। বেচারার মুখ’টা মনে পড়তে’ই ফাইজা হাসি থামাতে পারছেনা। দুজনে একসাথে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর ওইদিকে ফারদিন কেঁদে কেটে একাকার অবস্থা…….

#চলবে

[
[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here