গোধূলি লগ্নের সেই তুমি পর্ব -৪২ ও শেষ

#গোধূলি_লগ্নের_সেই_তুমি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#অন্তিম_পর্ব [দ্বিতীয়াংশ]

হসপিটালের ও’টি রুমের বাইরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করছে ফাইজা। ফাইজা’র কোলে একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা। জেহের বেঞ্চে বসে আছে টলমলে চোখে। ও’র পাশেই ফারদিন বসে ও’কে স্বান্তনা দিচ্ছে। ফাইজা বার বার ও’টি রুমের লাল লাইটের দিকে তাঁকাচ্ছে। বাচ্চা’টা কান্না করে উঠতে’ই ফাইজা ব্যস্ত ভঙ্গী’তে ও’কে দোলাতে লাগলো। ফারদিন উঠে গিয়ে ফাইজা’র কোল থেকে বাচ্চা’টাকে নিয়ে ওর হাত ধরে বললো..…..

–আমার সাথে এসে বসো। কি করছো তুমি? আইয়াজ কান্না করছে শুনতে পারছো না……

ফাইজা টলমলে চোখে ফারদিনের দিকে একবার তাঁকিয়ে আইয়াজের দিকে তাঁকালো। বাবা’র কোলে গিয়ে একদম শান্ত হয়ে গেছে ছেলে’টা। ফারদিনের বুকের সাথে লেপ্টে আছে মুখে আঙ্গুল দিয়ে। ফাইজা’র চোখে ভেসে উঠলো তিন মাস আগের সেই ঘটনা….
____________________________________________
সময় সময়ের গতীতে বয়ে চলে। খারাপ ভালো মিলিয়ে সেদিনের পর কেটে গেছে। দুটো বছর। মাত্র তিন মাস হলো আইয়াজ’কে ওরা দত্তক নিয়েছে। কিছুদিন আগে ফাইজা’ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। তখন ডাক্তার দেখানোর জন্য একদিন ওরা দুজন এই হসপিটালে’ই এসেছিলো। ডাক্তার দেখিয়ে বেরিয়ে আসার সময় এক’টা কেবিনের পাশে এসে ওরা দুজনে’ই থেমে যায়। একটা সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চা’র কান্নার আওয়াজে চারদিক ভরে উঠেছে। দুই তিনজন ডাক্তার আর নার্স মিলে বাচ্চা’টাকে কোলে নিয়ে কিছু বলছিলো। বাচ্চা’টার কান্না’র আওয়াজ কিছুতে’ই থামছেনা। বাচ্চা’টাকে কাঁদতে দেখে ফাইজা এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে’ ফারদিন ওর হাত ধরে বলে উঠে…..

–ওইদিকে কোথায় যাচ্ছো? তোমার শরীর অনেক উইক ওইদিকে যাওয়ার দরকার নেই। বাসায় চলো….

ফারদিনের কথা শুনে ফাইজা টু-শব্দ না করে নিজেই ফারদিনের থেকে হাত’টা ছাড়িয়ে ওইদিকে হেটে গেলো। নার্সের সামনে গিয়ে দেখলো একটা ফুটফুটে বাচ্চা বেগতিক কান্না করেই যাচ্ছে। বাচ্চা’টাকে দেখেই ফাইজা’র বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো। ফাইজা নিজেকে সামলে থমথমে স্বরে নার্স’কে বলে উঠলো….

–ওর মা কোথায়? ও এভাবে কাঁদছে কেন?

নার্স ফাইজা’কে বিরক্ত নিয়ে জবাব দিলো…..

—ওর মা ও’কে জন্ম দিয়ে’ই মা/রা গেছে আজ সকালে। সেই থেকে বাচ্চা’টা কান্না করেই যাচ্ছে। কিছুতে’ই থামছে না। এ’কে নিয়ে কি করব আমরা বলুন তো? কিছুই বুঝতে পারছিনা…..

কথাগুলো শুনে ফাইজা’র চোখ পানিতে ভরে উঠলো। ফাইজা টলমলে চোখে বললো…..

–ওর মা মা’রা গেছে৷ তাহলে ওর ফ্যামিলির মানুষ কোথায়? ওর বাবা বা অন্য কেউ?

এইবার নার্স পূর্বের তুলনায় দ্বিগুন বিরক্ত নিয়ে কপাল কুচকে বললো….

–ওর ফ্যামিলি’র কেউ নেই। ওর বাবা গত দুই মাস আগে মা’রা গেছে। ওর বাবা’র সাথে ওর মা পালিয়ে এসেছিলো বলে দুইপরিবারের কেউ মেনে নেয় নি। ওর বাবা এই হসপিটালে দারোয়ানের চাকরি করতো। এক্সিডেন্টে ওর বাবা মা’রা যাওয়ার পর ওর মা একদম একা হয়ে গিয়েছিলো। আমি ওর মা’কে আমার বাসায় আশ্রয় দিয়েছিলাম। এই দুই মাস ওর মা আমার বাসায় এই ছিলো। কাল হঠাৎ তীব্র ব্যাথা উঠায় ও’কে আমি হসপিটালে নিয়ে আসি। আর ভোরের দিকে ছেলে’টাকে জন্ম দিয়ে ও মা’রা যায়। এখন বলেন ও’কে নিয়ে আমি কি করব? তাই সবার মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও’কে আমরা একটা ভালো এতিম খানায় রেখে আসব। তাতে…

নার্স সম্পূর্ণ কথা শেষ না করতে’ই ফাইজা জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো….

—“নাহ ও’কে এতিম খানায় দিবেন না প্লিজ”

ফাইজা’র এমন রিয়েক্টে উপস্থিত সবাই ওর দিকে অবাক দৃষ্টি’তে তাঁকিয়ে আছে। ফাইজা এইটুকু বলে আর কথা বলতে পারছেনা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। কষ্টে ওর বুকের ভেতর’টা ফেটে যাচ্ছে। তীব্র যন্ত্রনায় সব’টা এলোমেলো লাগছে। ফারদিন এগিয়ে এসে ফাইজা’র পাশে দাঁড়িয়ে সবা’র উদ্দেশ্যে শান্ত কন্ঠে বললো…..

–আমি আপনাদের সব’টা বুঝিয়ে বলছি। আপনাদের ভাষ্যমতে তো ওর কেউ নেই তাইনা…

ফারদিনের জবাবের নার্স মাথা ঝুলালো। যার অর্থ”, হ্যাঁ কেউ নেই” ফারদিন তা দেখে আবারো বললো…..

–আপনারা ও’কে এতিম খানায় দিবেন না। আমি মানে আমরা ও’কে এডোপ্ট করব। দেখুন আমাদের ও কোনো সন্তান নেই আর না হবে। তাই আমি ও’কে এডোপ্ট করতে চাচ্ছি। প্লিজ না করবেন না। আপনাদের যদি টাকা লাগে আমি দিব। যা যা প্রয়োজন সব আমি করব। তাও ও’কে এতিম খানায় না দিয়ে আমাদের দিবেন। হাত জোড় করছি প্লিজ…….

বলে হাত জোড় করে দাড়ালো ফারদিন। আর ফাইজা অশ্রুসিক্ত চোখে ফারদিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। কি সুন্দর করে ফাইজা’র মনে’র কথাগুলো ফারদিন এক নিমিশেই বুঝে গেলো? ফারদিনের কথা শুনে একজন ডাক্তার বললো…..

–আমাদের কোনো সমস্যা নেই। তবে আমরা তো এভাবে একটা বাচ্চা’কে দিয়ে দিতে পারিনা বলুন? কিছু ফর্মালিটি’স পূর্ন করতে হবে। তারপরেই ও’কে নিয়ে যেতে পারবেন…..

ডাক্তারের কথায় ফারদিন এক সেকেন্ডেই রাজি হয়ে গেলো। ডাক্তারের সাথে গেলো ফর্মালিটি পূর্ন করতে। ফাইজা নার্সের থেকে এক থাবা দিয়ে বাচ্চা’টাকে নিয়ে নিজের বুকের সাথে আকড়ে ধরে কান্না করে উঠলো। নার্স দুজন অবাক হয়ে তাঁকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোনো মা তার হারানো সন্তান ফিরে পেয়েছে? ফাইজা কেঁদে’ই যাচ্ছে৷ এই কান্না কষ্টের না সুখের। একটা মা তার সন্তান’কে পেয়ে কাঁদছে। ফাইজা’র কোলে যেতে’ই বাচ্চা’টার কান্না থেমে গেলো অদ্ভুত ভাবে। ফাইজা কান্নারত স্বরে বলতে লাগলো….

–আজ থেকে তুই আমার ছেলে। আমাকে মা বলে ডাকবি। গুঁটি গুঁটি পায়ে আমার চোখের সামনে হেঁটে বেড়াবি। এর চেয়ে বেশি সুখ আমার চাইনা। তুই আমার ফাতিন আবসার আইয়াজ……

বলে খনিক হাসলো। আধা ঘন্টা পর ফারদিন এসে একটা সাদা কাগজ এগিয়ে দিয়ে ফাইজা’কে বললো সিগন্যাচার করে দিতে। ফাইজা খুশি মনে সিগন্যাচার করে দিলো। যা যা করার দরকার সব করে ওরা দুজন আইয়াজ’কে নিয়ে চলে আসলো।
বাড়ি মাথায় করে ফেলেছিলো সেদিন ফাইজা খুশি’তে চেঁচামেচি করে। সারা বাড়ি বাচ্চাদের খেলনা, জামা কাপড় দিয়ে ভরপুর করে রেখেছিলো। সেদিনের ফাইজার খুশি দেখে ফারদিন সব দুঃখ নিমিশেই ভুলে গিয়েছিলো।
____________________________________________
ও’টি রুমের লাল লাইট’টা বন্ধ হতে’ই ফাইজা’র ধ্যান ফিরে আসলো। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো দরজা’র সামনে। কিছু সময়ের ব্যবধানে দরজা খুলে একজন ডাক্তার বেরিয়ে আসতে জেহের ও ছুটে গেলো সেদিকে। সেই মুহূর্তে ভেতর থেকে বাচ্চা’র কান্না আওয়াজ ভেসে আসলো। জেহের শান্ত কন্ঠে’ই প্রশ্ন করলো…..

–ডাঃ আমার ওয়াইফ কেমন আছে? আর….

জেহের কে থামিয়ে ডাক্তার এক গাল হেসে বললো…..

–মিষ্টি নিয়ে আসুন আগে। কংগ্রাচুলেশনস আপনার মেয়ে হয়েছে। আর আপনার ওয়াইফ ও সুস্থ আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে’ই আমরা ওদের দুজন’কে কেবিনে দিব…

বলে জেহের’কে জড়িয়ে ধরলো।।আর জেহের খুশি,’তে বাকরুদ্ধ হয়ে নিশ্চুপ হয়ে আছে। প্রথম বার বাবা হওয়ার আনন্দ’টা আকাশ ছোঁয়া। কত বেশি আনন্দ হচ্ছে তা জেহের নিজেও বুঝতে পারছেনা। ডাক্তার চলে যেতে’ই জেহের ফাইজা’কে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–আমি বাবা হয়ে গেছি বোন। আমি মেয়ে’র বাবা হয়ে গেছি।

ফাইজা’ ও ভাইয়ের খুশিতে তাল মিলিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো…..

–আর আমি ফুপ্পি হয়ে গেছি ভাই। আমি দ্বিতীয় বার মা হয়ে গেছি ভাইয়া…….

দুই ভাই বোন খুশি’তে হসপিটালের করিডোরে’ই নাঁচতে শুরু করলো। আর ফারদিন আইয়াজ’কে বুকে জড়িয়ে ধরে ওদের খুশিতে তাল মিলিয়ে হাসচ্ছে আর ভাবছে। সেদিন যদি জেহের সব’টা না বলতো তাহলে হয়তো আজ জেহেরের এই খুশি’টা থাকতো না। যতই হোক নিজের সন্তান’কে অন্যের হাতে তুলে দেওয়ার মতো জঘন্যতা আর হয়না ফারদিনের ভাষায়। সেদিনেই আরজা’র কথা শুনে জেহের ফাইজা’কে সব’টা বলে দিয়েছিলো। সব’টা শুনে ফাইজা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো। তাও আরজা’কে কিছু জানতে দেয়নাই। ওরা তিনজন মিলেই সব’টা সামলে নিয়েছে। তাই আরজা প্রেগন্যান্ট হতে’ই ফাইজা নিজে ও’কে সামলে রেখেছে৷ সব দায়িত্ব পালন করেছে। আরজা’কে একটা কাজ ও করতে দেয়নাই। তাই আগে আগে’ই ফাইজা একটা বাচ্চা দত্তক নেওয়ার জন্য হন্নে হয়ে খুঁজছিলো। আর পেয়ে গেছে। আজ সবার খুশির দিন। খুশিতে ভেসে চলেছে সবাই। সবার সব কষ্ট৷ বিষাদ ভুলে মেতে উঠেছে খুশির আমেজে। আইয়াজের গালে একটা চু’মু ফারদিন ও’কে বুকের সাথে আগলে নিয়ে বললো…..

–তোর জন্য আজ আমি তোর মা’কে এতটা খুশি দেখতে পারছি৷ তুই হয়তো আমার রক্ত না কিন্তু তুই আমার পুরো পৃথিবী। যাকে ছাড়া এখন আমার বেঁচে থাকা অসম্ভব……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here