গোপন বিয়ে পর্ব ৪+৫

পর্ব ৪+৫
#গোপন_বিয়ে
#৪র্থ_পর্ব
#অনন্য_শফিক



এলিজার সে প্রেমিক ছিল আমার স্ত্রী বিন্দুর বড় ভাইয়ের বন্ধু।তার প্রেমিকের নাম ছিল পুণম।পুণম যে বিন্দুর পরিচিত তাও জানতো না এলিজা। এলিজা শুধু জানতো পুণম তার বয়ফ্রেন্ড এছাড়া আর কিচ্ছু না।’
‘তারপর? তারপর কী হলো বলুন!’
ইমতিয়াজ তার কপালের ঘাম মুছলেন। অগ্রহায়ণের বাতাস বইছে গাছের পাতায় পাতায়। তবুও যে তিনি কেন ঘামছেন কী জানি!
ইমতিয়াজ এবার বললেন,’পুণমকে পাগলের মতো ভালোবাসতো এলিজা।মা তার রিলেশনের ব‍্যাপারে জানতে পেরে এলিজাকে অনেক বকেন। মারধোর পর্যন্ত করেন। চেম্বার থেকে বাসায় ফিরে এসব শুনে আমি মাকে বোঝায়।বলি,’মা,যোগ পাল্টেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দেই প্রেম বিয়ে করছে এবং তারা হ‍্যাপিও হচ্ছে।আর এলিজা এখন যথেষ্ট ম‍্যাচিউ‍্যর।সো, তাকে বাঁধা না দেয়ায় উত্তম হবে আমাদের জন্য।ও যদি কাউকে ভালোবেসে হ‍্যাপি হতে পারে তাতে আমাদের সমস্যা কোথায়?’
মা আমার কথা শুনলেন। তারপর এলিজাকে মা বললেন,’ছেলেকে বল তার বাবাকে বলতে আমাদের বাসায় এসে কথা বলার জন্য।’
এলিজা পুণমকে জানালো।তার দুদিন পরেই পুণমের বাবা এলেন আমাদের বাড়িতে। এবং তিনি এসে কথাবার্তা বলে এলিজার হাতে আংটি পরিয়ে দিয়ে গেলেন।এর কদিন পরই বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হলো ওদের। এরপর থেকে পুণম নিয়মিত আসা যাওয়া করতে লাগলো আমাদের বাড়িতে।আর এলিজা ছিল তখন অনেক হ‍্যাপি।’
আমি ইমতিয়াজ সাহেবের কথাগুলো শুনছিলাম খুব মনোযোগ সহকারে।শুনতে আমার ভালো লাগছিলো। আমি এবার পরবর্তী অংশ শোনার জন্য আগ্রহ ভরা গলায় বললাম,’তারপর কী হলো? এলিজা মারা গেল কীভাবে?আর পুণমই বা কোথায়? আপনার ওয়াইফ এর কথা বলছিলেন তিনি এখন কোথায়?আর আপনার মা! তিনি এখন কোথায় আছেন?’
ইমতিয়াজ বললেন,’আমার মাথা ব্যথা করছে। প্রতিদিন রাতে আমার এমন হয়। এখন উঠতেও পারবো না। তুমি আমার জন্য এক গ্লাস পানি আনতে পারবে বোন?তেষ্ঠা পেয়েছে খুব!’
আমি বললাম,’এক্ষুনি এনে দিচ্ছি।’
বলে আমি সিঁড়ি ভেঙে দৌড়ে নীচে গেলাম এবং জগ ভর্তি করে পানি নিয়ে এলাম। কিন্তু ছাদে এসে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ইমতিয়াজ সাহেব শুয়ে আছেন ছাদের ধুলো বালির উপর। আমি দ্রুত জগটা মাটিতে রেখে তার কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি তার জ্ঞান নেই। মুখ দিয়ে কেমন ফেনা ফেনা বের হচ্ছে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। আমার কপালেই কেন শুধু বিপদ আর বিপদ?
ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু কেঁদে আর কী লাভ হবে। তারচেয়ে কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু কী করবো আমি?
ইমতিয়াজ সাহেবের কাছে এসে তাকে ডাকতে চাইলাম। কিন্তু কী বলে ডাকবো ঠিক করতে পারছিলাম না। ডাক্তার কিংবা স‍্যার বলে ডাকা ঠিক হবে না।নাম ধরে ডাকাও ঠিক হবে না। কারণ তিনি আমায় বোন ডেকেছেন। ফস করে তখন আমার মুখ থেকে ভাই শব্দটিই বেরিয়ে এলো। আমি তার হাত ধরে নাড়া দিয়ে জোরে ডাকতে লাগলাম,’ভাইয়া,এই ভাইয়া?’
ইমতিয়াজ সাহেব সাড়া দিচ্ছেন না। আমি দ্রুত তার মাথায় জগের পানিটা ঢাললাম। চোখে মুখেও পানি ছিটিয়ে দিলাম।এতেও কাজ হলো না। ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে। মনে মনে আল্লাহকে ডেকে ডেকে আবার নীচে নামলাম আর নীচ থেকে বড় দুটো বোতল ভরে নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ইমতিয়াজ সাহেবের মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম। দের বোতল পানি ঢালার পর ইমতিয়াজ সাহেবের হাতের একটা আঙ্গুল নড়লো। তারপর চোখের পাতা। আমি এবার তার হাত ধরে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতে তখন আমি শুধু বলছিলাম,’ভাইয়ারে,এই ভাইয়া,কথা বলো ভাইয়া!’
ইমতিয়াজ সাহেব ঝাঁপসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,’এলিজা! এই এলিজা।’
তিনি আমার নাকে মুখে তার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,’তুই কোথায় চলে গিয়েছিলে এলিজা!’
আমি তখনও কাঁদছি।কী সব বিপদে পড়ছি বারবার আমি। আমি আর আধ বোতল পানি দিয়ে ভালো করে ইমতিয়াজ সাহেবের চোখ মুখ ধুয়ে দিলাম। ইমতিয়াজ সাহেবের মাথাটা মনে হয় এখন ঠিক হয়েছে। তিনি এখন আমায় চিনতে পারছেন। ইমতিয়াজ সাহেব আস্তে আস্তে উঠে বসে বললেন,’তোমাকে ধন্যবাদ বোন। আমার হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। তারপর কী হলো আর জানি না। ‘
আমি বললাম,’আপনার কী এমন আরো হয়েছে কখনো?’
মাথায় ব‍্যাথা হয় প্রতিদিন কিন্তু আজই প্রথম ঢলে পড়েছি।’
‘আপনি টেস্ট করান ভাইয়া!’
‘আমায় ভাইয়া ডেকেছো তুমি!’
খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলেন ইমতিয়াজ।আর তিনি আমার একটা হাত টেনে নিয়ে বললেন,’ভেবেছিলাম পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই তাই আমি ধুঁকে ধুঁকে শেষ হয়ে যাবো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বেঁচে থাকাটাও মন্দ না।যার কেউ না থাকে তারও কেউ জুটে যায়! আমারও জুটে গেছে। আমার বোন জুটে গেছে!’
ইমতিয়াজ ভাইয়া পরবর্তী ঘটনাটা তখনই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তাকে শাসনের গলায় বললাম,’আগে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম হোক। সকাল বেলা যখন আপনার শরীর ভালো লাগবে তখন বলবেন।’
ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,’আচ্ছা।’

#৫ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক



সকাল বেলা ইমতিয়াজ ভাইয়ার আগেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল।আর আমি সেই নীল শাড়িটা পরেই গিয়ে দাঁড়ালাম ছাদে গোলাপ বনের কাছে।সকালের শীতল বাতাসে শরীর কেমন কাঁপছে।আর শাড়ির আঁচল উড়ছে পালতোলা নৌকোর বাদামীর মতন। আমার খুব ভালো লাগছে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকালাম।কী সুন্দর নীল ঝকঝকে তকতকে আকাশ।আকাশের সাথে যেন মিশে যাচ্ছিল আমার শাড়ির আঁচল।না চাইতেও আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো দুটো লাইন,

‘আকাশ তোমার নীলের সাথে মিললে আমার শাড়ির আঁচল,
বলবে তখন দুঃখ ছেড়ে আমার সাথেই মিশবে যা চল?’

আমি তখন একটা গোলাপের পেটে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম।একটা লাল টকটকে গোলাপ।আর তখনই ছাদে উঠে এলেন ইমতিয়াজ ভাইয়া। তিনি এসে বললেন,’গুড মর্নিং গোলাপজান বিবি।’
পেছনে তাকিয়ে দেখি ইমতিয়াজ ভাইয়া হাসছেন।তার মুখ থেকে গোলাপজান নাম শুনে আমারও ভীষণ হাসি পেয়ে গেল। ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,’তোমাকে বেশ লাগছে। একেবারে আকাশের নীলের সাথে মিশে গেছো তুমি!’
‘আমি না মিশলেও আমার দুঃখগুলো মিশে গেছে ভাইয়া।’
‘বেশ তো!যে আকাশ হতে জানে সে মহৎ হতেও জানে।’
তারপর আবার আমরা বসলাম গোলাপ বনের কাছে।একটা প্রজাপতি তখন ভূ ছোট দিয়ে চলে গেল আমাদের পাশ কাটিয়ে। তারপর আরেকটা। খুব ভালো লাগছিলো তখন!
আমি বললাম,’ভাইয়া, আপনার শরীরটা এখন কেমন?’
ইমতিয়াজ ভাইয়া মৃদু হাসলেন। তারপর ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,’ভালো আছি।’
এবার আমি কিছু একটা তাকে বলতে চাইছিলাম কিন্তু এর আগেই তিনি বলে উঠলেন,’ঠিক এভাবেই আরো তিন বছর আগে আমি আর এলিজা বসেছিলাম মুখোমুখি। এলিজার চোখ ভরা জল তখন।সে আমায় ভেজা গলায় বললো,’ভাইয়া, ভাবীর সাথে না আগে থেকেই পুণমের পরিচয় ছিল।’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’তাই নাকি?তাহলে তো ভালোই!’
‘ভাবীর বড় ভাইয়ের বন্ধু পুণম।’
‘আচ্ছা। খুব ভালো।’
ভালো না ভাইয়া। ভালো না একটুও!’
বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো এলিজা। আমি অস্থির হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,’কী হয়েছে এলিজ,তোর কী হয়েছে? এমন করছিস কেন তুই হঠাৎ?’
এলিজা মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে দিয়ে বললো,’ভাইয়া,ভাবীর সাথে পুণমের আগে থেকেই রিলেশন ছিল। এখনও আছে!’
শুনে কেমন অবিশ্বাস্য লাগলো কথাটা। আমার মনে হলো এলিজা হয়তো কোন কারণে বিন্দুকে ভুল বুঝছে।হয়তো ওরা আগে থেকে পরিচিত বলে একসাথে ওদের গল্প করতে দেখে এলিজা ভেবে নিয়েছে অন‍্য কিছু। আসলে কাউকে বেশি ভালো বাসলেই এমন হয়। ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সব সময় ভয় কাজ করে।অন‍্য কারোর সাথে মিশতে দেখলেই ভয় করে। মনে হয় অন‍্য কেউ যদি তার ভালোবাসার মানুষটিকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়!

এইসব কিছুই ভাবছিলাম আমি।আর এলিজাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। কিন্তু এলিজা এবার যে কথাটি বললো তা আরো ভয়াবহ।সে বললো‌ বিন্দুর সাথে পুণমকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছে।সে তখন ওয়াশরুমে ছিল। এবং চট করে ওখান থেকে ফিরে আসতেই চোখে পড়ে তার এমন দৃশ্য।
এলিজার কথাগুলো শুনে আমার কান কেমন গরম হয়ে উঠলো।আর পায়ের মাটি কেমন যেন দূরে সরে যেতে লাগলো। আমি তখন চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েও পারিনি। কেমন যেন বোকাসোকা হয়ে গিয়েছিলাম একেবারে।’
ইমতিয়াজ ভাইয়ার চোখে জলের রেখা দেখা গেল আবার।আর আমার চোখও কেমন ঝাঁপসা হয়ে আসছিলো। আর কেবল বার বার মনে হচ্ছিল , এই যে আমি নিজেকে ভেবেছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃখী মানুষ আমি এখন তো মনে হচ্ছে আমার চেয়ে শত শত গুণ বেশি দুঃখী একজন মানুষ এই ইমতিয়াজ ভাইয়া। আসলে আমরা উপর থেকে যাকে দেখি হাসিখুশি আর প্রাণোচ্ছল তার ভেতরে লুকিয়ে থাকে ঠিক ততটাই কিংবা আরো গভীর ক্ষত।
আমি এবার পরবর্তী অংশ টুকু জানতে চাইলাম। কিন্তু ইমতিয়াজ ভাইয়াকে বলতে পারছিলাম না কারণ তিনি তখন চোখ মুছছিলেন।
শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিয়ে ইমতিয়াজ ভাইয়া বাকী টুকু বলতে শুরু করলেন। তিনি এবার বললেন,’এলিজার কাছ থেকে এই কথাগুলো শুনেও পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি। কারণ দুই দুইটা বছর এক ছাদের নিচে কাটিয়েছি আমি আর বিন্দু। এই এতো গুলো দিনেও বিন্দুকে সন্দেহ করার মতো কোনো কিছু আমার চোখে পড়েনি।তার আচরণ,ব‍্যাবহার আর কথায় আমার সব সময় মনে হতো বিন্দু আমায় অনেক বেশি ভালোবাসে। সম্মান করে।’
ইমতিয়াজ ভাইয়া একটু থামলেন। থেমে একটা দীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস টানলেন। তারপর বললেন,’নাতাশা, তোমার সামনে বসে যদি আমি সিগারেট ধরাই তবে কী তোমার অসুবিধা হবে?’
আমি হেসে বললাম,’অসুবিধা হবে না ভাইয়া।’
ইমতিয়াজ ভাইয়া তার প‍্যান্টের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে নিয়ে ধরালেন। তারপর সেই সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বললেন,’আগে সিগারেট খেতাম না। এখন খাই।নাতাশা, আমার না খুব দুঃখ। আমি এই দুঃখের কথাগুলো কাউকে কোনদিন বলিনি। দুঃখ থেকে জন্ম নেয়া বুকের ভেতরে জমা কান্না গুলো ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি।’
আমি বললাম,’ভাইয়া, আল্লাহ আপনাকে একদিন সুখি করবেন।’
ইমতিয়াজ ভাইয়া বললেন,’মৃত‍্যুর আগে নয়। মৃত্যুর পরে হলে হতে পারে।’
তারপর আবার বলতে শুরু করলেন।
‘আমি এলিজাকে বলেছিলাম,এলিজ, তুই পুণমের সাথে কিংবা তোর ভাবীর সাথে এমন বিহেভ করবি যেন ওরা বুঝে তুই কিছু জানিস না।বাকী টা আমি দেখছি।’
এলিজা বললো,’আচ্ছা।’
এরপর দিন সকাল বেলা পুণম চলে গেল ওদের বাড়িতে।পুণম চলে যাওয়ার পর থেকেই বিন্দুর কেমন মন ভার।রাতে আমার সাথে সেদিন একটি কথাও বললো না বিন্দু।কী অদ্ভুত কান্ড!
এর দুদিন পর হঠাৎ করেই—

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here