#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#পর্ব_৩
#লেখনীতে-নন্দিনী নীলা
আমি তরিৎ গতিতে স্পর্শের বুক থেকে সরে এলাম। মাথা নিচু করে ফেললাম আমি লজ্জায়। কতো কি ভেবেছি। স্পর্শের সামনে গেলে এই করব ওই করব। কথা বলবো। কিন্তু স্পর্শের সামনে এসে সব হাওয়া হয়ে গেছে। আমি নিজেকে যতই সাহসী ভাবিনা কেন আমি এই উনার সামনে ভীতুর ডিম।
স্পর্শ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি লজ্জা লাল নীল হচ্ছি।
তখন স্পর্শের গম্ভীর কন্ঠে একটা শব্দ কানে এলো,
‘ আর ইউ ওকে?’
আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। সীফা মানে স্পর্শের এক মাত্র বোন আর আমার একমাত্র ননদ। সীফা আমার বাহু ধরে বলল,
‘ ভাবি কেমন আছো?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ। চলো ভেতরে যাই।’
সীফাকে নিয়ে ভেতরে চলে এলাম। আমি শশুর শাশুড়ি কে দেখে তারাতাড়ি মাথায় কাপড় টেনে তাদের সালাম দিলাম। সবাই সোফায় বসে পরেছে সীফা আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আম্মু এসে আমাকে বলল সীফাকে আমার সাথে নিয়ে যেতে।আমি সীফাকে নিয়ে আমার রুমে এলাম। আপু তখন আমার কাছে একটা পিন চাইতে এলো।
‘ মারু আমার একটা পিন পাচ্ছি না তোর একটা পিন দে তো।’
আমি পিন এনে দিলাম। সীফা আপুর কাছে গিয়ে বলল,
‘ ওয়াও মাশাআল্লাহ আপু তোমাকে তো খুব সুন্দর লাগছে।’
‘ তাই। ধন্যবাদ সীফা। কেমন আছো?’
‘ এইতো আলহামদুলিল্লাহ। আমার ভাবি কেও তোমার মতো শাড়ি পরাতে।’
‘ তোমার ভাবি তুমি বলো। আমি বললে কি আর তিনি শুনবে?’
আপু চলে গেল। সীফা আমার পেছনে পরলো শাড়ি পরতে বলছে আমি পরতে পারি না বলছি।
সীফা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিরবির বলল, ‘ কয়দিন পর না তোমার খালি শাড়ি পরেই ঘুরতে হবে। তোমার জামাই তো এটাই করবে আছি জানি। তাই আগে থেকে শিখে রাখো।’
আমি না শুনে বললাম, ‘ কিছু বললে।’
সীফা বলল, ‘ নাহ।’
আম্মুর ডাকে সীফা নিয়ে বাইরে এলাম। সবাই সোফায় বসে আছে। মাহিন ভাইয়ারাও চলে এসেছে। আমার করা শরবত দুই ট্রেতে করে একটা আমার ও একটা আপুর হাতে দিল। আমি কাচুমাচু মুখ করে এগিয়ে গেলাম। সবার আগে শশুর তারপর শাশুড়ি তার স্পর্শের সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্পর্শ নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল আমি সামনে দাড়াতেই চোখ তুলে তাকিয়েছিল। তারপর হাত বাড়িয়ে শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল। আমি সীফাকে দিয়ে পাশে দাঁড়ালাম। মাহিন ভাইয়ার মা শরবত খেয়ে জিজ্ঞেস করলো, শরবত কে বানিয়েছে। আম্মু বললো আমি করেছি। তখন আমার শশুর মশাই বললেন হাসতে হাসতে,
‘ এই না হলে আমার বউমা। আমার যে ডাইভেটিক্স আছে সেই জন্য টক শরবত করেছে আমার বউমা। কতো চিন্তা আমার জন্য। আমার ঘরে যাওয়ার আগেই আমার কতো খেয়াল রাখছে। দেখো মিনারা।’ আমার শাশুড়ি মাকে ইশারা করলেন। তার নাম মিনারা।
আমি বোকা চোখে সবার দিকে তাকিয়ে আছি।সাথে ঢোক গিলছি কেউ শরবত খাচ্ছে না শুধু স্পর্শর গ্লাস ফাঁকা তিনি খেয়েছে। এখন মিটিমিটি হাসছে। আমি কি সমস্যা বুঝতে পারছি না। সীফা আমার কানে এসে বলল,
‘ ভাবি তুমি তো শরবতে চিনিই দাও নাই। এতো টক হয়ছে কি বলবো।’
কথাটা শুনে ভয়ে ভয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম আম্মু অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমার কপালে শনি আছে আজ। আমি আম্মুকে বকতে বকতে শরবত করেছি তাই এমন আকাম টা করেছি। রান্নাঘরে এসে একটু খেয়ে দেখলাম খুব টক হয়েছে। স্পর্শ এমন টক শরবত ই খেল। তাই ভাবছি। আমি দূর থেকে যতই সাহসী আর হেমব্র তেমব্র করি না কেন কাছে গেল কিছুই করতে পারিনা দেখছি।
সেইদিন ও আর কথা হলো না শরবতের কাহিনী নিয়ে আমি আর তাদের সামনেই গেলাম না। যাওয়ার আগে শাশুড়ি মা আসে বিদায় নিয়েছে।আপু বিয়ে দুই মাস পর ঠিক হলো ততদিনে আপুর ফাইনাল পরীক্ষা ও শেষ হয়ে যাবে। দশটার দিকে সবাই চলে গেল।
.
কয়েকদিন পর কলেজে বসে আছি।আমি মিষ্টি নিঝুম । আজ সিনথি আর ধারা আসে নি।
ওরা দুজন আফসোস সুরে বলছে,
মিষ্টি বলল,
‘ কতো আশা করেছিলাম। আমাদের বেস্টুর জন্য একটা টিচার দুলাভাই পাইছি এখন আর টেনশন করা লাগবে না। পড়া লাগবে না। কিন্তু এখন তো দেখছি এই দুলাভাই পাইয়া আমাগো কপাল পুড়েছে। এই কয়দিনে যা প্যারা দিছে তাতে আমি নিশ্চিত এখন থিকা ম্যাথ নিয়ে সিরিয়ার পড়া লেখা না করলে ক্লাসে আর ঢুকা যাইবো না। কতো আশা করছিলাম সব এমনে ভেস্তে গেল।’
এবার নিঝুম বলল, ‘ মারু তুই আমার পাঁচশত টাকা ফিরত দে। কতো কিছু ভেবে সেইদিন টাকা গুলা ভাঙলাম। এখন তো সুবিধার জায়গায় অসুবিধা এসে ভর করেছে। আমার কি মন চায় জানস। আমার কলেজেই আস্তে মন চায় না। কিন্তু ওই যে আমার মা একটা কলেজে না আইলেই বিয়া দিব। কইয়া ভয় দেখায়! নইলে সত্যি আমি আর এই খাটাশ দুলাভাই এর অত্যাচার সহ্য করতে আসতাম না!’
মিষ্টি কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘ প্রত্যেক দিন আমাগো পড়া ধরবোই আর না পারলেই কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবো। লজ্জায় আমি শেষ রে।’
আমি আর কি বলবো। যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। এখন এরা ও বুঝে গেছে এই দুলাভাইয়ের হাতে থেকে কোন উপকার পাওয়া যাবে না। এই কয়দিনে তা অন্তত বুঝিয়েছে স্পর্শ।
‘ ওই টাকা দে আমার তোরে খাইয়ে শুধু শুধু টাকা নষ্ট করছি।’ বলেই নিঝুম আমার দিকে তেরে এলো।
আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘ একদম আমাকে টাকা নিয়ে কথা শুনাবি না। আমি কি বলেছিলাম যে খাওয়া। তোরা নিজেরা ইচ্ছে করে সব করেছিস আমি শুধু গ্রহন করেছি। এখন আমাকে দোষারোপ করতে পারিস না।’
‘ তোর ওই জামাই আমাগো কি নির্যাতন করে এর সব শোধ তোর উপর তুলবো। দাঁড়া তুই।’
আমাকে আর পায় কে। আমি দৌড়াচ্ছি ক্লাস জুড়ে। নিজেরাই খাইয়ে এখন আমার উপর অত্যাচার করছে শয়তানি গুলা।
স্যার এসেছে দেখে থেমে যায় সব ঝগড়া ঝাটি।
নিজেদের সিটে বসে পরি। স্পর্শ ক্লাসে ঢুকে। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। আজ স্পর্শকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। আজ উনি এ্যাশ কালারের শার্ট পরেছে সব সময়ের মতো হাতা গুটিয়ে রেখেছে। আমি ক্রাশ খেয়েছি কিন্তু ওনার মুখের গম্ভীর ভাব টা মানায় নি।
সবাই বসতেই স্পর্শ ফট করেই আমার দিকে তাকালো। আমি তারাতাড়ি চোখ সরিয়ে নিলাম। কিন্তু ধরা আমি খেয়েছি মনে হলো। উনি সামনে থেকেই আমার দিকে আঙুল তাক করল। আমি চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছি আমাকে ইশারা করছে নাকি অন্য কাউকে? আল্লাহ আমার দিকে যেন না হয় আবার কান ধরতে হবে ভাবতেই লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। যাকে নিয়ে আমি রোমান্টিক কথা ভাবি প্রেম করি তার সামনে প্রতিদিন মান সম্মান ক্ষুয়াতে হয় ভাবতে মুখে কালো আঁধার নেমে আসে।
নিঝুম ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ ওই তোকে স্যার ইশারা করেছে দেখিস নি। দাড়া না হলে কপালে শনি আছে কিন্তু।’
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্পর্শ একটু এগিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলল, ‘ হে ইউ তোমাকে ওইদিন বললাম না। সামনে বসতে আজ ও পেছনে ফ্রেন্ডদের সাথে বসে আড্ডা দিছো কেন?’
আমি চমকে উঠলাম,ওইদিন স্পর্শ আমাদের বলেছি আলাদা বসতে আর সামনে বসতে কিন্তু আজ ও পেছনে বসেছি।
আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘ স্যার আসলে…
‘ আনসার মি! তোমার পেছনে বসেছো কেন? খালি পড়া চুরি করে গল্প করা তাই না। আর একদিন পেছনে এক জুট হয়ে বসতে দেখলে সবকটাকে বেঞ্চের উপর দাড় করিয়ে রাখবো।
আমি আতকে উঠলাম।হায় আল্লাহ বলে কি।
‘ সরি স্যার আমি সামনেই বসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি সিট পাই নি। বিশ্বাস করুন তাই পেছনে বসেছি।’
‘ আগে আসতে পারো না। ভালো করে লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকলে আগেই আসতে ইচ্ছে করে লেট করে আসলে তো সিট পাবেই না। তুমি উঠে আসো।’
আমি বিহ্বল হয়ে তাকালাম স্পর্শের দিকে। উঠতে বলছে কেন আমাকে কি ক্লাস থেকে বের করে দিবে নাকি।
‘ সরি স্যার আর পেছনে বসবো না প্রমিজ। আজকের মতো মাফ করে দিন। বের করে দিবেন না প্লিজ।’ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম।
‘ নো এক্সকিউজ সামনে আসো।’
আমি ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে সামনে এলাম। লজ্জা আজ ক্লাস থেকেই বের করে দিবে এতো বড় অপমান। উনি এইভাবে অপমান করতে পারলো। খুব রাগ হলো আমার। উনার উপর কোন দিন সুযোগ পেলে এর শোধ আমি তুলবই।
সামনে এসে ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাব তখন স্পর্শের গম্ভীর কন্ঠ আবার কানে এলো।
‘ কোথায় যাচ্ছ এইখানে বসো। এখন থেকে এই জায়গায় বসবে তুমি।’
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি মাঝখানের সামনের সিটে জায়গা করে দিয়েছে। এই সিটে পাঁচজন আছে আমাকে দিয়ে ছয়জন করেই বসিয়েছে। চিকন চিকন তিনটা মেয়ে বসেছে তাই আমার জায়গাও হয়েছে। আমি এতোক্ষণ কি ভেবেছিলাম আর এখন কি হলো। নিজের মাথায় নিজেই বাড়ি মারতে ইচ্ছা করছে।
#চলবে….