চড়ুইপাখির অভিমান পর্ব -৩৫ ও শেষ

#চড়ুইপাখির_অভিমান🕊️
#অন্তিম_পর্ব
#লেখনীতে_নন্দিনী_নীলা

ঘুরাঘুরির আনন্দেতে আমাদের জ্বর পালিয়ে কোথায় চলে গেছে। আমরা চারজন সেন্টমার্টিন এর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ যা মূলভূখন্ডের সর্ব দক্ষিণে এবং কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে ১৭ বর্গ কিলোমিটারের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ। স্থানীয় ভাষায় সেন্টমার্টিনকে নারিকেল জিঞ্জিরা বলেও ডাকা হয়। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যমন্ডিত এ দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে। নীল আকাশের সাথে সমুদ্রের নীল জলের মিতালী, সারি সারি নারিকেল গাছ এ দ্বীপকে করেছে অনন্য। সেন্টমার্টিনে এসে আর পানিতে নামার সাহস করলাম না শুধু ঘোরাঘুরি করলাম আর ছবি তুললাম।
গায়ে জ্বর না থাকলেও এখন আর পানিতে নেমে ঝামেলা বাড়াতে চাই‌ না তাই আমি আর মিষ্টি নামলাম না। কিন্তু দিগন্ত ভাই আর স্পর্শ ঠিকই পানিতে নামল। পানিতে নামার আগেই স্পর্শ দুজন হাতে ডাব ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। ‌আমরা দুজন ডাব হাতে গাল ফুলিয়ে রইলাম।
রিয়েল রেস্তোরাঁ লাঞ্চ করে নিলাম। সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসলাম। এভাবে চার দিন কেটে গেল পঞ্চম দিন আমরা কক্সবাজার কে বিদায় দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। এবার আমাদের যাত্রা গাড়িতে নয় ট্রেনে। আমার আর মিষ্টির জন্য এইটা এইটা করতে হয়েছে। আমরা কখনো ট্রেনে উঠি নি। তাই সুযোগটা মিস করতে চাইনা।

‘মিষ্টি খুব মজা হবে রে। নিঝুম, ধারা কে কল কর। ওরা তো সবকিছু মিস করলো। ভিডিও কল দে!

স্পর্শ আর দিগন্ত ভাই আমাদের কেবিনে বসিয়ে রেখে কোথায় যেন গেল। আমরা দুজনে একসাথে বসে ভিডিও কল করলাম গ্রুপে। ওরা দুজনেই অ্যাক্টিভ ছিল সাথে সাথেই রিসিভ করল।

নিঝুম কল রিসিভ করেই বললো, ওই তোরা কোথায় রে? এটা কোন জায়গা? তোরা কি কক্সবাজার থেকে চলে আসতেছিস নাকি। এটা কোন গাড়ি কিসে চড়ছিস দেখি?’

আমি টান মেরে মিষ্টি হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলাম আর বললাম, ‘দাঁড়া দেখাচ্ছি! কক্সবাজার এসেছি বলে তো খুব হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছি। এবার আরও মরবি। তোদের কে বিয়ে করতে বলেছিলাম। নিঝুম তোকে বলেছিলাম বয়ফ্রেন্ড টাকে বিয়ে করে চলে আয়। আসলি না। আর ধারা তুই বলদি জীবন একটা বয়ফ্রেন্ড জুটাতে পারলি না। আর বাপ মার পছন্দে তুই বিয়া করবি না। ব‌ইন তুই আজীবন সিঙ্গেল থাক।’

নিঝুম চিৎকার করে বলল, ‘শালা ছাতার বয়ফ্রেন্ড বানাইছিলাম। ও জীবন চাকরি নিতে পারবো না। আর জীবন আমার বাড়িতে প্রস্তাব নিয়েও আসতে পারবো না রে। কপালটাই খারাপ। তোদের দোষ। তোরা তিনজন যদি আমাকে না ম্যানেজ করতি। আমি জীবনে ওই হাঁদারাম এর সাথে রিলেশন করতে যাইতাম না।’

এবার ধারা চিৎকার করে বলল, ‘একদম আমাকে বলদি বলবি না। মার বাপের পছন্দ যে বিয়া করতে বলিস ওই ভুড়ি ওয়ালা কাকুর সাথে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছিল। আর প্রেম করতে বলিস ওই খাটাস শাহ আলম আমাকে প্রপোজ করেছিল।ও কি আমার নখের যোগ্য বল‌। ওর সাথে আমি প্রেম করবো? ইম্পসিবল! ওর মত ছেলের সাথে প্রেম করার থেকে আজীবন আমি আইবুড়ি থাকবো।’

‘ওকে তোরা তোদের মতো থাক। এই দেখ আমরা কি সে উঠেছি।’

বলে ক্যামেরাটা পেছন দিয়ে দেখালাম ট্রেনে উঠেছি। ট্রেনে উঠেছি দেখি ওরা দুজন চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দিলো। আর ওদের জ্বলতে দেখে হাসতে হাসতে আমি মিষ্টিকে ফোন দিয়ে দিলাম। ফোন হাতে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মিষ্টি আমাকে কিল মেরে বলল,

‘শাকচুন্নি নিজের ফোন দিয়ে কথা বলতে পারিস না। আমার ফোন নিয়ে রাজত্ব করছিস।’

‘বেশ করেছি একশ বার করব!’

লেগে গেলে দুইজনেই ঝগড়া ফোন রেখে আমি আর মিষ্টি ঝগড়া করে যাচ্ছি। ধারা আর নিঝুম কথা বলে যাচ্ছে। আসতে পারল না সে জন্য আফসোস করছে। আমাদের ঝগড়া দেখে আমাদের থেমে ওদের সাথে কথা বলতে বলছে। আমরা থামছিনা। স্পর্শ আর দিগন্ত এস আমাদের দুজনকে থামালো‌ আমি রাগ করে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের সিটে বসে পড়লাম। মিষ্টি ও তাই করল দিগন্ত আর স্পর্শ অবাক হয় আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে কি হয়েছে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে।

স্পর্শ আমার পাশে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,

‘কি হয়েছে তোমাদের? এই তো কিছুক্ষণ আগে গল ধরে হাঁটছিলে। খুশিতে লাফাচ্ছিলে। এখন আবার কি নিয়ে ঝগড়া বাঁধলো?’

‘ আপনার তো সাহস কম না আমাদের দুই বান্ধবীর ঝগড়ার কারণ জানতে এসেছেন। আমরা ঝগড়া করেছি আমরা একটু পরে মিল হয়ে যাব। আপনার এখানে কিসের কথা?’

‘ ওরে বাবা কতো ভালোবাসা। বান্ধবীর উপর এত ভালোবাসা এর একটুখানিও যদি আমার জন্য হতো তাহলে তো আমি ধন্য হয়ে যেতাম। ‘স্পর্শ গাল ফুলিয়ে বলল।

আমি স্পর্শ দিকে ঘুরে বললাম,’আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আপনার উপর আমার কোন টান নাই?’

স্পর্শ মুখ নিচু করে বলল, ‘আছে কি? আমার তো মনে হয় না। কখনো তো ভালোবাসা দেখাতে দেখলাম না।’

‘তোর কি এখন এই ট্রেনে ভালোবাসা দেখাবো?’

স্পর্শ বলল, ‘দেখালে দেখাতে পারো আমার কিন্তু সমস্যা নাই।’

আমি সত্যি সাহসিকতার একটা প্রমাণ দিলাম স্পর্শকে টেনে সিট থেকে উঠলাম স্পর্শ এসব করা দেখে বলল,

‘আরে কি হচ্ছে? আমাকে টেনে বাইরে নিচ্ছ কেন? আমি তো ভালোবাসা দেখাতে বলেছি! তুমি কি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে আমাকে এখন কেবিনের বাইরে বের করে দিবে নাকি? আচ্ছা সরি আমাকে ভালোবাসা দেখাতে হবে না। তুমি তোমার মতো থাকো। আমাকে আমার মত থাকতে দাও তোমার পাশে আমাকে বের করে দিও না।’

আমি ফার্স্ট টাইম স্পর্শকে একটা ধমক দিলাম, ‘স্টপ আপনার মুখটা দেখা করে বন্ধ রাখুন।’

আমি সরাসরি স্পর্শ কে টেনে বাইরে বের করালাম। আমাদের এসব দেখে মিষ্টি আর দিগন্ত ভাই এসেছে কি হচ্ছে দেখার জন্য। মিষ্টি আমাকে কিছু বলতে যাবে তখনই আমি স্পর্শকের দাঁড় করিয়ে রেখে ফট করে স্পর্শের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরলাম,

‘ স্পর্শ সহ আশেপাশে যতগুলো মানুষ আছে সবাই আমাদের দেখেছে অবাক চোখে। স্পর্শের সারা মুখে চরম বিষ্ময়। আর সবাই উৎসুক জনতা হয়ে তাকিয়ে আছে কি হচ্ছে দেখার জন্য।’

স্পর্শ বলল, ‘কি হচ্ছে তুমি নীচে বসলো কেন? উঠো সবাই তাকিয়ে আছে দেখতে পাচ্ছ না!’

‘থাকুক‌ আমি তো আজ এই টেনের সবার সামনে ওই কথাটা বলেই ছাড়বো।’

স্পর্শ অবাক গলায় বলল,’কোন কথাটা?’

‘এই যে আপনি সবসময় বলেন আমি নাকি আপনাকে ভালোবাসি না! ভালোবাসি না! কখনো মুখে বলি না। ওকে হ্যাঁ আজকেই এই ট্রেনের সবাইকে সাক্ষী রেখে এ কথাটা আমি প্রমাণ করব‌ই। আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি।’

স্পর্শ বলল, ‘সবার সামনে সিনক্রেট করো না প্লিজ চলো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। তোমাকে আমাকে কিছুই প্রমাণ করতে হবে না। তুমি না বললেও আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো!’

‘চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন তো একদম আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাবেন না।’

স্পর্স আমার ধমক খেয়ে চুপ করে থাকল। মিষ্টি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ওর মুখে হাসি। আমি তখনই চোখ বন্ধ করে একটা ঢোক গিললাম। ভালোবাসি কথাটা যত‌ই ভাবি বলল কিন্তু স্পর্শ সামনে আসলে কথাটা বলতে গিয়ে আমি কেমন ভীতুর ডিম হয়ে যায়। হঠাৎ একটা ছোট্ট বাচ্চা আমার হাতে একটা ফুল ধরিয়ে দিয়ে গেল।
আমি কিছু বলতে যাবো মেয়েটা যেভাবে এসেছিল আবার সেই ভাবে তার কেবিনে ছুটে গেল তাকিয়ে দেখলাম মেয়েটার মা বলছে বেস্ট অফ লাক। আমি হেসে দিলাম। এবার খুব লজ্জা লাগলো। এতক্ষণ আমি খেয়াল করলাম আশেপাশের সবাই আমার দিকে কিভাবে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা আমার হাতে লাল সূর্যমুখী ফুল দিয়ে গেছে। আমি লজ্জায় কিছুক্ষণ নিচের দিকে চোখ বন্ধ করে র‌ইলাম। তারপর স্পর্শের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আমি যৌবনে পা দেওয়ার আগেই জানতে পেরেছিলাম একটা ছেলে নাকি আমাকে পাগলের মত ভালবাসে। তখন আপনাকে আমার একটু সহ্য হতো না। অনেক পাগলামি করেছিলাম আপনার ছবি, আর বিয়ের কথা শুনে। আপনাকে আমার শত্রু মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন আমি একটু বড় হলাম আপু আমাকে অনেক কিছু বললো। তখন আপনার এই ভালোবাসা আপনাকে ভালো লাগতে শুরু করলো। কিন্তু তখন আমি আপনার নাগাল পাই না। আপনি আমাকে পাত্তা দেন না। কিন্তু সবাই বলে আপনি নাকি আমাকে খুব ভালোবাসেন‌। সেই ভালোবাসা শুধু আমাকে দেখান না। সবাইকে দেখান এটা কেমন অবিচার। এই নিয়ে কত কেঁদেছি আপুর কাছে আর আমার বেস্টি মিষ্টির কাছে বিশ্বাস না হলে ওকে জিজ্ঞেস করে দেখেন। আপনার আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার প্রথমে আমাকে দেখানোর জন্য একটা ছবি নিয়েছিল আমার আপু। আপনার সেই ছবিটা আমি 2 বছর আগে দেখে কতো পাগলামি করেছি। আপনার ছবিটা ছিড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। সেই ছবিটাই দুই বছর পর আমার ভালো থাকার অস্ত্র হয়ে গিয়েছিল। খুব যত্নে এই বুকে জায়গা দিয়েছিলাম। আপনার ছবিটার দিকে তাকিয়ে কতো অভিযোগ করেছি আপনি আমার সাথে ঠিকমত কথা বলতেন না বলে। বুকে জড়িয়ে না নিলে রাতে আমার ঘুমই আসতো না। এখনো বলবেন আমি আপনাকে ভালোবাসি না। আমি আপনার মত ভালোবাসি বলতে পারিনা। আমার তো লজ্জা লাগে। আমি কেন ভালোবাসি বলবো? সব সময় আপনি আমাকে ভালোবাসি বলবেন! আর আমি শুধু রাগ করবো। আপনি ভালোবাসা দিয়ে সেই রাগ অভিমান ভাঙ্গাবেন। পারবেন না?’

স্পর্শ আমার দু কাঁধে হাত রেখে দাঁড় করালো। আমি উত্তরের আসায় তাকিয়ে আছি ওর চোখের দিকে। স্পর্শে আমার হাত থেকে লাল সূর্যমুখীটা নিয়ে আমার খোপায় গুজে দিলো তারপর বলল,

‘এটা তো আমাকে পারতেই হবে। চড়ুইপাখির অভিমান তো আমাকে ভাঙাতেই হবে। এইযে আমার মিষ্টি বউ তার রাগ না ভাঙ্গিয়ে কি আমি থাকতে পারি?’

‘ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি স্পর্শ।’

স্পর্শ বুকে হাত দিয়ে বলল,

‘এবার তো আমি হার্ট অ্যাটাক করেই মরে যাবো। একদিন এত শক দিওনা আমি তো এত নিতে পারিনা।’

চারপাশ থেকে সবাই চিল্লাচিল্লি করতে লাগল আমি লজ্জা পেয়ে স্পর্শ ওর বুকে মুখ লুকালাম।
স্পর্শ হাসতে হাসতে আমার কানে বলল,

‘ওরে লজ্জাবতী রে। এত সাহসিকতার দেখিয়ে শেষে আমার বুকেই মুখ লুকালো?’

‘ এটা আমার হাজবেন্ডের বুক এখানে আমি মুখ লুকাবে নাতো লুকাবে কে!’

‘ তাইতো আমি ভুলে গেছিলাম।’

আমি স্পর্শের বুকে কিল মেরে কেবিনে চলে এলাম। বাইরে সবার হাসির আর কড়তালির আওয়াজ পেলাম।

(সমাপ্ত)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here