চন্দ্রাণী(০৪)

#চন্দ্রাণী(০৪)
সারারাত শর্মীর ঘুম হলো না। কেমন আধো ঘুম আধো জাগরণে রাত কেটে যাচ্ছিলো।বুকের ভেতর কষ্টের নীল ঢেউ।
আকাশের ওই চাঁদের দিকে তাকিয়ে শর্মীর যন্ত্রণা আরো বেড়ে গেলো। নিয়াজ ভালোবেসে বলতো,”আমার আকাশের চাঁদ তুমি। ”

মিথ্যে সব,সব ধোঁকা। ঘড়িতে সময় ২.৪৬ বাজে।শর্মী দাদীর ফোন থেকে নিয়াজ কে কল দিলো।শেষ বারের মতো নিয়াজের সাথে কথা বলতে চায় সে।

মা ভ্যারাইটিজ স্টোর নামে মোড়ের মুখে যেই দোকানটা নিয়াজ চালায়,তার পেছনের অংশে মদ,জুয়ার পসরা বসেছে।
মদের আড্ডার মধ্যমণি হচ্ছে টগর। সবাই অবাক হয়ে টগরের বোতল শেষ করা দেখছে।টগরের একটা নিয়ম আছে, তার বোতল কারো সাথে শেয়ার করা করে না সে।
এক টানে এক বোতল শেষ করে ফেলে।

মা নেই,বাবা নেই,ভাই নেই,বোন নেই।সব বন্ধন মুক্ত সে।তাকে কেউ শাসন করবার নেই।কেউ নিষেধ করার ও নেই।
যা ইচ্ছে তাই করে। প্রতিদিন ৩-৪টা বোতল নিয়ে আসে। বসে বসে বোতল শেষ করে আর বিরহের গান গায়।
জুয়াড়িরা গাঁজা দেওয়া সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে জুয়া খেলছে আর টগরের গান শুনছে।

এই যে তিন নাম্বার বোতল খালি করে টগর এখন গান গাইছে,
“মনাই সওদাগর, তোমার কোথায় বাড়ি ঘর?
আইছো হাটে কত চালান লইয়া রে,যাইবা তুমি কি সদাই লইয়া?
রূপগঞ্জের হাটে এসে,সদাই নিছো কি?
যে সদাই কিনতে আইছো মনে আছে কি?
তোমার ছেলে আর মেয়ে,আছে পন্থের দিক চেয়ে
আসবা বাবায় কত কিছু লইয়া রে,আসবে বাবায় কত কিছু লইয়া।”

দুই একজনের চোখে জল চলে এলো গানের ভাবার্থ বুঝতে পেরে।
নিয়াজ অপেক্ষা করছে একটা নতুন চালানের জন্য। ইন্ডিয়া থেকে একটা মালের স্যাম্পল আসবে আজকে।নেশার নতুন একটা আইটেম।
নিয়াজের উপর অর্ডার আছে নতুন স্যাম্পল কালেক্ট করে অফিসে জমা করে দেওয়া।

নিয়াজ অপেক্ষা করছে কল আসার জন্য।

টগর গান থামিয়ে আরেকটা বোতল নিয়ে বসলো। তার চোখের সামনে সব কেমন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে।
জুয়ার টাকা নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেছে এদিকে।

নিয়াজ সিগারেট টানতে টানতে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। হঠাৎ করে ফোন বেজে উঠতেই চমকে উঠে কল রিসিভ করলো।
কিন্তু রিসিভ করে শর্মীর কণ্ঠ শুনে তার মেজাজ বিগড়ে গেলো।

ওপাশ থেকে শর্মী বললো, “নিয়াজ তুমি কি চাও আমাকে খোলাখুলি বল আজ,এরপর আমি আর কখনোই তোমাকে ডিস্টার্ব করবো না।”

রাগে,ক্রোধে নিয়াজ বললো, “আমি চাই তোরে দিয়া **গিরি করাইতে,বুঝছস তুই?কল দিলি ক্যান তুই আমারে?খবরদার আর কোনো দিন আমারে কল দিবি না।তা না হইলে আমি সারা গ্রামের মানুষরে জানামু চেয়ারম্যানের মাইয়ার পেটে বাচ্চা আসছে বিয়ার আগেই।আর শুন,তোর আর আমার বিয়ার যেই কাগজপত্র দেখছিলি তুই সব ভুয়া কাগজ, কাজী ও ভুয়া।তোর লগে আমার বিয়াই হয় নাই আইনত।”

শর্মী বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো, নিয়াজের মুখ থেকে এতো নোংরা শব্দ বের হতে পারে শর্মীর মাথায় ও ছিলো না। শর্মীর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। হাত থেকে আপনা আপনি ফোনটা পড়ে গেলো।

কখন নিজের অজান্তেই দুই চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল ভিজে গেলো শর্মী জানে না।
এতটা ধোঁকাবাজি?
কিসের জন্য এরকম করলো নিয়াজ?
ঝামেলা যদি থাজে তবে ওদের দুজনের বাবার মধ্যে, সেই ঝামেলার শোধ নিতে,ক্ষমতা পাওয়ার জন্য কি-না নিয়াজ এভাবে তাকে ব্যবহার করলো?

শর্মী আলমারি খুলে নিজের কয়েকটা জামা কাপড় বের করলো। দেয়ালে লাগানো তিন ভাই বোনের ছবিটা ও ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।

ইচ্ছে করছে শেষ বারের মতো বাবা মা আপা শুভ্রকে একবার দেখে আসতে।কিন্তু সবার রুমে তো দরজা বন্ধ শুধু শুভ্রর রুমের দরজা খোলা।

শর্মী উঠে গেলো। ভাইটাকে শেষ দেখা দেখে যাবে সে না হয়।
পা টিপে টিপে বের হলো শর্মী।শুভ্র ঘুমাচ্ছে কোল বালিশ জড়িয়ে ধরে।
অন্ধকার চোখ সওয়া হয়ে এলো।উঠানে জ্বলতে থাকা লাইটের আবছা আলোয় শুভ্রকে দেখা যাচ্ছে।
শর্মী গিয়ে শুভ্রর পাশে বসলো। তারপর ভাইয়ের হাত টেনে নিয়ে কতগুলো চুমু খেলো।
শুভ্র ঘুম থেকে জেগে গেলো।উঠে বসে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। শর্মীর মায়া হলো। অবুঝ ভাইটা বললেও বুঝবে না তার আপা কি বলছে।

মনের কষ্ট চেপে রেখে ভাইকে বললো, “আপাকে তুই ক্ষমা করে দিস ভাই।সারাজীবন তোকে আগলে রাখার যেই সংকল্প করেছিলাম আজ সেই সংকল্প ভেঙে পালিয়ে যেতে হচ্ছে তোদের মান সম্মান নষ্ট যাতে না হয় সেই ভয়ে।
এই জীবনের জন্য ভাই বোনের সম্পর্ক এখানেই শেষ। হয়তো কখনো আর খুঁজে পাবি না,অথবা কখনো খুঁজে পাবি তোর আপার প্রাণহীন দেহ।বড় আপাকে বলিস আমাকে ক্ষমা করে দিতে।”

শুভ্র হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। শুভ্রকে শুইয়ে দিয়ে শর্মী নিজের রুমে চলে গেলো।

বাকী রাত আর শর্মী ঘুমাতে পারলো না।
ফজরের আজান হতেই শর্মী বের হলো দেখতে কেউ বের হয়েছে কি-না।
পা টিপে টিপে বের হয়ে দেখে দরজা খোলা।অবাক হয়ে শর্মী বের হলো। বের হয়ে দেখে সিড়িতে বসে আছে বড় আপা আর মা।

এতো সকালে আপা আর মা উঠে পড়েছে!
এখনো তো আলো ফুটে নি,চারদিক অন্ধকার।

রেহানা ছোট মেয়েকে দেখে বললো, “আয়,মা’র কাছে এসে বস।”

শর্মী যন্ত্রের মতো এগিয়ে গিয়ে মায়ের অন্য পাশে বসলো। রেহানা আরেক হাতে ছোট মেয়েকে ও জড়িয়ে ধরলেন।চন্দ্র মা’য়ের কাঁধে মাথা রেখে বললো, “আমাদের জীবনটা এরকমই। একবার আলোয় আলোয় ভরে যায়,আবার অন্ধকারে ডুবে যায়।
জীবনে অন্ধকার খুবই ক্ষণস্থায়ী। এই যে রাতের যে নিগুঢ় অন্ধকার ছিলো, আকাশের দিকে তাকালে দেখা যাবে আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তারপর চারদিকে তাকালে দেখা যাবে একটু একটু করে অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। আমাদের সমস্যা হলো অন্ধকার থেকে আলোতে আসার জন্য যেটুকু সময় দরকার হয় আমরা সেই সময়টা অপেক্ষা করতে পারি না।আমাদের ভীষণ তাড়াহুড়ো সবকিছুতে।আর এই তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই জীবনের সবকিছু আমরা হারিয়ে ফেলি।অথচ একটু যদি ধৈর্য ধরি,আল্লাহকে ভরসা করি,সবর করা শিখে যাই,বিশ্বাস করি যে কষ্টের পর স্বস্তি আছে তাহলে সব হতাশা মুছে যাবে,সব আঘাত গা সওয়া হয়ে যাবে।শুধু অপেক্ষা করতে হবে আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্যের জন্য।
প্রকৃত মুমিন সবসময় আল্লাহর সাহায্য কামনা করে। ”

শর্মী ভীষণ চমকে উঠলো আপার কথা শুনে। আপা এসব কেনো বলছে?আপা কি কিছু জেনেছে?
কিভাবে জানবে আপা?

হঠাৎ করে এসব কথা-ই বা কেনো বলছে আপা?
কেনো জানি মনে হচ্ছে আপা এসব তাকে উদ্দেশ্য করে বলছে।
আপার কথায় কেমন ম্যাজিক আছে,শর্মীর মনের উল্টো পাল্টা সব ভাবনা চলে গেলো।

শর্মী ধীর পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।অযু করে ফজরের নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে খাস দিলে দোয়া করলো আজ।
কতদিন পর আল্লাহর সাথে মন খুলে কথা বলেছে শর্মী জানে না।অনেকদিন ধরে নামাজ পড়ে শুধু,টুকটাক সিজদাহ্ দিয়ে উঠে যায়।যেনো পড়া দরকার তাই পড়ছে।

আজ বহুদিন পর মন থেকে আগ্রহ নিয়ে নামাজ পড়লো।

চলবে

রাজিয়া রহমান

গল্প সম্পর্কে মতামত জানাতে জয়েম করুন আমার গ্রুপ রাজিয়ার গল্প কুটির এ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here