‘চরিত্রহীনা’ পর্ব-১
.
লেখক : Mahian Khan
.
(১)
.
রাত ১২.৩০,এখনো রনি বাসায় আসেনি। চিন্তায় তিন্নি প্রায় অর্ধপাগল, সচারচর রনি বাসায় ফিরতে কখনো এত দেরি করে না। প্রচুর উদ্ভট চিন্তাভাবনা তিন্নিকে ক্রমশ গ্রাস করতে থাকে। বেশ কয়েকবার ফোন পর্যন্ত দেয় তিন্নি কিন্তু রনির ফোন বন্ধ। ফোনে এমনিতে চার্জ ছিল না তাই হয়ত ফোন বন্ধ হয়ে আছে, কিন্তু এই ব্যাখা কেন জানি তিন্নির পছন্দ হয় না।তিন্নির মন শুধু তাকে ভয় দেখাতে থাকে। রনিকে হারানোর তীব্র আতঙ্ক তিন্নির সমগ্র দেহে যেন বিদ্যুৎ প্রবাহ করতে থাকে। এই পৃথিবীতে তিন্নির একমাত্র আশ্রয়স্থল হল রনি, তিন্নির কাছে রনি শুধুমাত্র তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষ না বরং রনি তার কাছে পৃথিবীর সমর্থক শব্দ যাকে কেন্দ্র করে আজকে প্রায় এক-দেড় বছর তিন্নি বেচে আছে।
.
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ যেন তিন্নির সব ভয়, আতঙ্ক, চিন্তাকে আনন্দের উত্তপ্ত আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। দৌড়ে দরজাটা খুলে রনিকে জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত অভিমানের সাথে কাঁদতে থাকে।
.
-কোথায় গিয়েছিলা? আমি কত টেনশনে ছিলাম জানো? কতবার ফোন দিয়েছি জানো? মোবাইলটা বন্ধ করে রেখেছ কেন?
.
-আরে বাবা! সায়েমের বাসায় গিয়েছিলাম। ও অনেক অসুস্থ পায়ে সিরিয়াস ব্যাথা পেয়েছে ফুটবল খেলতে গিয়ে, ওর সাথে আড্ডা মারতে ছিলাম। আর মোবাইলে তো চার্জ ছিল না। ২ না ৩ পার্সেন্ট চার্জ ছিল। তুমি বুঝি দেখনি? ৩ পার্সেন্ট চার্জ আর কতক্ষণ থাকবে?
.
– আমি অত কিছু জানিনা, কিন্তু তোমাকে যদি হারিয়ে ফেলতাম, তাহলে?
.
– বাবা! আমি কী কখনো আমার তিন্নিকে রেখে যেতে পারি।
.
তিন্নির গাল দুটো ধরে রনি যখন কথাটা বলে, তিন্নির মন যেন তখন গলে যেতে বাধ্য, এত মিষ্টি সান্তনার বাণী যেন কেউ তাকে কখনো শোনায়নি!
.
-ভাত খেয়েছ?
.
– খেয়েছি।
.
-তাহলে ঘুমাতে যাও।
.
-আসলে অনেক ঘুম এসেছে,কিন্তু…
.
-কিন্তু কী?
.
-ঘুম পাড়াবে কে?
.
– ফাজলামি করা বন্ধ কর ঘুমাতে যাও।
.
-নাহ! আজকে আমার তিন্নির কাছেই ঘুমাবো।
.
-প্লিজ, রনি এরকম কর না।
.
-কী করলাম? আমার তিন্নির কাছে আমার ঘুমানোর অধিকার নেই?
.
– প্লিজ,এরকম দাবি কর না। এটা উচিত না।
.
– কি উচিত না? আরে বাবা! তুমি এত ভয় পাও কেন? আমাকে বুঝিয়ে বলবা?আমার উপর কী তোমার বিশ্বাস নেই? আমার জীবনে শুধু একটা তিন্নি আছে, এই তিন্নি শুধু কোনো মেয়ে না। এই তিন্নি আমার শ্বাস। যদি কখনো তিন্নি আমাকে ছেড়ে চলে যায় অথবা কখনো এই রনি তিন্নিকে ছেড়ে চলে যায়, বুঝতে হবে রনির শ্বাস-প্রশ্বাস ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
.
রনির মুখ থেকে এত অসাধারণ কথা শুনে তিন্নি যেন সম্পুর্ন গলে যায়। সম্পুর্ন নিশ্চুপভাবে হেটে যায়, তবে তার হাটার ভঙ্গিমা যেন কোনো ইশারা দিতে থাকে রনিকে আর এই ইশারা খুব ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারে রনি, দৌড়ে গিয়ে তিন্নির নরম দেহ নিজের ডান হাতের মধ্যে চেপে ধরে,তিন্নির দেহ যেন এতটা নরম যেন রনির হাতের মধ্যে তিন্নির দেহ গলে গিয়েছে। এত অসাধারণ নরম দেহকে রনি নিজের মনথেকে উপভোগ করে তা বোঝা খুব একটা কঠিন কাজ না। তিন্নি শুধু রনির; এই তিন্নিকে সে কারো সাথে ভাগ করতে পারবে না। তিন্নি শুধু রনির,আর তিন্নির সব কিছুর উপর এই ভাগ্যবান তরুণের অধিকার।
.
(২)
.
বেশ সকালে তিন্নির ঘুম ভেঙে যায়। এত সকালে তার ঘুম থেকে ওঠার রেকর্ড খুব কম। হয়ত কোনো দু:স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু তা দু:স্বপ্ন কিনা সে বিষয় তিন্নি শতভাগ নিশ্চিত না। কেননা কি স্বপ্ন দেখছিল তা তিন্নির মনে নেই। স্বপ্নটা দু:স্বপ্ন হোক অথবা সাধারণ কোনো স্বপ্ন তবে তিন্নির ঘুমের বারটা বেজে গিয়েছে তা নি:সন্দেহে বলা যায়। পুনরায় ঘুমিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা নেই তিন্নির তাই বরং ঘুম থেকে উঠে যায়।
.
বিছানার পাশে মাটিতে পড়ে থাকা পোষাক হাতে নিয়ে নিজের অর্ধনগ্ন দেহকে ঢেকে দেয় তিন্নি। কালকে এক অসাধারণ রাত কাটিয়েছে রনির হাতের মধ্যে, সারারাত রনি তাকে আদর করেছে, তিন্নির দেহে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে রনির আদরের ছাপ নেই।বহুদিন পর রনির সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে রাত কাটিয়েছে তিন্নি। তাই মন বেশ ভালো।
.
প্রতিদিনের রুটিন মাফিক আজও ঘুম থেকে উঠে আয়নায় ভালো করে একবার নিজেকে দেখে। আজ কেন জানি আয়নায় শুধু নিজেকে দেখতে পায় না বরং নিজের অতীতকেও দেখতে পায়, বেশ ভয় পেয়ে যায় তিন্নি। সরে আসে আয়নার কাছ থেকে। আয়না তিন্নিকে প্রচুর আঘাত করেছে, বিছানার পাশে পড়ার টেবিল থেকে রনির সিগারেটের প্যাকেট থেকে ১টা সিগারেট হাতে নিয়ে বেশ অদ্ভুত ভাবে টানতে থাকে তিন্নি, ধোয়ার সাথে নিজের অতীতের স্মৃতিগুলো উড়িয়ে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকে। বাংলাদেশে মেয়েদের সিগারেট টানতে খুব একটা দেখা যায় না, হাতে গোনা অল্পকিছু মেয়েদের হয়ত খুজে পাওয়া যেতে পারে। পরিসংখ্যান করলে এবং তা শতকরা হিশেবে প্রকাশ করলে হয়ত দেশে নারী ধুমপায়ীর সংখ্যা দশমিক আকারে বের হবে। আর এই নারী ধূমপায়ীদের যে অসভ্য হিশেবে সমাজ চিহ্নিত করে তাতে নতুনত্ব কিছু নেই। যদিও শুধু ধূমপান না, অসভ্য হিশেবে সমাজে খেতাব দেওয়ার জন্য তিন্নির প্রচুর দোষ-ত্রুটি সমাজ হয়ত তুলে ধরতে পারে। যেমন : বিয়ে না করে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে বসবাস, বিয়ের পুর্বে একাধিকবার নিজের ভার্জিনিটি হারানো, বাবা-মায়ের অবাধ্য মেয়ে, পিতা দ্বারা সন্তান হিশেবে স্বিকৃতি হারানো।লিস্ট হয়ত শেষ করা যাবে না। যদিও অসভ্য মেয়ে হিশেবে অনেকেই তাকে স্বিকৃতি দিয়েছে। তাই নতুন করে স্পেশাল ভাবে আর স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। যদিও ‘চরিত্রহীনা’ হিশেবে এখনো স্বিকৃতি পাওয়া বাকি কিন্তু হয়ত উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো তাকে অসভ্য প্রমাণ করতে পারলেও হয়ত চরিত্রহীনা প্রমাণে যথেষ্ট না।
.
তিন্নির মাথায় শুধু অতীতের সেই ভয়াবহ স্মৃতিগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। কি ভয়াবহ রক্ষণশীল পরিবারে তিন্নির শৈশব কাটাতে হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, তাদেরকে সাংঘাতিক রক্ষণশীল বলতে অনেকে দ্বিধাবোধ করতে পারে। আর ১০ টা বাঙালি পরিবারের মত বলা যেতে পারে তাদের। হয়ত তিন্নি বেশি আধুনিক ছিল। তিন্নির পোষাক, চলাফেরা, আচরণ নিয়ে তার পরিবার সব সময় আপত্তি জানাত। বাঙালি পরিবারগুলোতে এটা খুব একটা নতুন কিছু না। কিন্তু তিন্নির কাছে তার পরিবারের এই আচরণ অসহনীয় হয়ে ওঠে, সারাদিন বাসায় ঝগড়া, মারামারি,বাবার অত্যাচার । শেষমেশ ঘড় ছেড়ে নিজের জীবনকে রনির হাতে জমা দিয়েছে, আজকে দেড় বছর পরিবারের সাথে ন্যূনতম সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই তিন্নির। তার জীবন এখন দুজনের উপর নির্ভরশীল। এই দুজন হল আল্লাহ আর রনি। সিগারেট প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে, নাহ! সিগারেটের এই উত্তপ্ত অবশিষ্ট অংশ তিন্নির নরম ঠোট আর স্পর্শ করতে পারে না, সিগারেট বাইরে ফেলে দেয়। সিগারেট তার মনকে খুব একটা শান্ত করে পারেনি । চুপচাপ রান্নাঘরে গিয়ে রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে তিন্নি। মনথেকে অতীতের স্মৃতিগুলোকে কোনোভাবে যেন বের করতে পারছে না।
.
হঠাৎ রনি পিছন থেকে এসে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে। রনির স্পর্শ যেন তিন্নির মন থেকে অতীতের সব ব্যাথাকে মুহূর্তে পুড়িয়ে দেয়। রনির স্পর্শে তিন্নি অদ্ভুত এক সুখ অনুভব করে। তিন্নির গাল রনি চুমু দিয়ে ভরে দেয়।
.
– কী কর?
.
-দেখনা? নাস্তা বানাই
।
.
-আজকে বাসায় বানানো লাগবে না, বাইরে খাব।
.
-তাহলে এই নাস্তাগুলোর কী হবে?
.
-অত ভাবা লাগবে না, রেডি হও।
.
-ধুর
.
-প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
.
রনির এরকম করুন আবদার তিন্নি আর সহ্য করতে পারে না।
.
-ঠিক আছে চল। কিন্তু নাস্তা….
.
-ধুর বাদ দেও তো।
.
রনি দ্রুত বেগে নিজের রুমে চলে যায় রেডি হওয়ার জন্য। রনির চাঞ্চল্যতা আর শিশুসুলভ আচরণ তিন্নির মুখে এক অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে তোলে। এই হাসির ব্যাখা দেওয়া অত সোজা না, প্রচুর রহস্যময় হাসি! কিন্তু এই রহস্যময় হাসির মধ্যে রনির প্রতি তিন্নির অকৃত্রিম ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটা বোঝা খুব একটা কঠিন না।
.
(৩)
.
এই সকালে ১টা টিউশনি করে হেটে হেটে ঘরে ফিরতে ফিরতে জাভেদের শরীর ঘেমে ভিজে গিয়েছে। এখনো বহু কাজ বাকি, যদিও সাব্বির ভাই তাকে আশ্বাস দিয়েছিল, নতুন বাসায় জিনিস পত্র উঠানোর দায়িত্ব সব তার। কিন্তু নতুন বাসায় জিনিস উঠানোর দায়িত্ব অন্য একজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজে বাইরে থাকা এই তত্বটা জাভেদের বেশ অপছন্দ হয় তারাহুড়া করে নতুন বাসায় যায়। বাসাটায় এর পুর্বে জাভেদ ২-৩ বার এসেছে। ৫ তলা বিল্ডিং, দোতালায় সে জায়গা পেয়েছে। দোতালায় যাওয়া মাত্র সাব্বির ভাইকে দেখে।
.
– আসসালামু আলাইকুম ভাই, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
.
– ওয়ালাইকুম আসসালাম, ধন্যবাদ লাগবে না তুমি কি আমার আপন ভাইর চেয়ে কম?
.
-এত কষ্ট করলেন আর আমি বাইরে ছিলাম, আমি খুব দু:খিত।
.
-ধুর মিয়া বাদ দাও তো। আগে দেখ বাসা সাজানো কেমন হইসে।
.
বাসার ভিতর ঢুকে জাভেদ যেন অন্য এক জগতে প্রবেশ করেছে। সাব্বির ভাইর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার যেন কোনো শেষ নেই। মাত্র ২ রুমের বাসাটাকে এত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে যে যেকোন মানুষ অবাক হতে বাধ্য হবে।
.
– অনেক ধন্যবাদ ভাই, কিছু বলার ভাষা খুজে পাই না। আপনি সত্যি অসাধারণ।
.
নিজের ব্যাগ থেকে গুনে গুনে প্রায় ৬ হাজার টাকা বের করে জাভেদ।
.
-ভাই টাকাটা রাখেন। ছোট ভাই হিসাবে যতখানি সম্ভব, দিলাম।
.
– ধুর মিয়া পাগল নাকি?
.
– না ভাই নিতেই হবে।
.
অবশেষে বহু যুদ্ধের পর সাব্বির ভাইকে টাকাটা দিতে সক্ষম হয়।
.
– একটা কথা জিজ্ঞেস করব রাগ করবা না।
.
– বলেন ভাই।
.
– তোমার বাসা তো শহরে, তুমি বাপ মায়ের কাছে না থাইক্যা কষ্ট কইর্যা বাসা ভাড়া দিয়া থাক ক্যান?
.
– এমনি, বাসায় একটু ঝামেলা আছে তাই!
.
সাব্বির ভাই জাভেদেকে আর কোনো প্রশ্ন করে না, প্রশ্নটা যে জাভেদের ভাললাগে না তা সে ভালোভাবে বোঝে।
.
– আচ্ছা গেলাম, আল্লাহ হাফেজ
.
– আল্লাহ হাফেজ, আবার আসবেন ভাই।
.
সাব্বির ভাইর প্রশ্নগুলো জাভেদের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
.
– বাসা ছেড়ে আসার কোনো ইচ্ছাতো আমার ছিল না। আমার বোনটাকে একটা বুড়া লম্পটের কাছে বিয়ে দিয়েছে আমার বাপ। আমার বাবা একটা আস্তা কুলাঙ্গার। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য, শুধু মাত্র লাখ খানিক টাকা ঋণ পরিশোধের জন্য আমার বোনকে বেচে দিয়েছে অসভ্যটা, ঐ অসভ্যর কাছে থাকার চেয়ে কবরে থাকা ভালো।
.
রাগে জাভেদের ঘেমে যাওয়া শরীর যেন উত্তপ্ত হতে থাকে। দরজাটা খোলা,সাব্বির ভাই যাবার পড়ে দরজাটা আটকাতে মনে ছিল না। তাই তারাহুড়া করে আটকাতে যায়, দরজা আটকাতে গিয়ে বেশ অদ্ভুত দৃশ্য জাভেদের নজর কাটে,
.
একটা অদ্ভুত সুন্দরি মেয়ে সাথে বেশ হ্যান্ডসাম একটা ছেলে। বেশ অন্তরঙ্গভাবে একজন আরেকজনের হাত জোরে চেপে ধরে নিচে নামতে থাকে । দৃশ্যটা জাভেদের নজর কাটে। জাভেদ ভালোভাব বোঝে এদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক। কিন্তু এদের বয়স কত হবে? হয়ত ১৮-১৯, বেশ অনুশোচনা বোধ হয় জাভেদের।
.
– ধুর পোলাপানরাও প্রেম করে আর আমরা এখনো টিউশনি করি।
.
বেশ শোকাহত হয়ে দরজাটা আটকিয়ে ভিতরে ঢোকে, কিন্তু শোকাহত হওয়ার সময় নেই,অনেক কাজ আছে। রান্না করা, আরো ৩-৪ জায়গা টিউশনি আছে। অযথা শোকাহত হয়ে সময় নষ্ট করলে হবে না। তারাহুড়া করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জাভেদ
.
(৪)
.
সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে তিন্নি আর রনি বাসায় ফেরে। দুজন বেশ কাহিল, তিন্নি শুধু কাহিল না বেশ অসুস্থ। গায়ে জ্বর জ্বর ভাব, তাছাড়া বেশ বমি আসছে,হালকা মাথাব্যাথা আছে। বাসায় এসে চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়ে তিন্নি, রনিও বেশ কাহিল, ফ্যান ছেড়ে সোফায় বসে আছে। বারবার খালি রনির ফোনটা বেজে ওঠে। প্রায় ১৫-২০ বার বেজেছে প্রত্যেকবার মোবাইল কেটে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে বেশ বিরক্ত হয়ে এবার ফোনটা ধরে,পাশের রুমে গিয়ে কথা বলতে থাকে। রনি বেশ মেজাজের সাথে যে কথাগুলো বলতে থাকে তা বেশ স্পষ্টভাবে শুনতে পায় তিন্নি, কিন্তু এই ভয়াবহ অসুস্থ অবস্থায় সেদিকে তার মন যায় না।
.
কিছুক্ষণ পর রনি রুমে ঢোকে, তিন্নির শরীরের অবস্থা রনি বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারে।
.
– আমার একটু চট্টগ্রাম যেতে হবে।
.
-কি? ফাজলামি কর?
.
-না অনেক জরুরি যেতে হবে
.
– আমার শরীরের অবস্থা দেখেছ?
.
-দেখেছি কিন্তু আমার নানা মারা গিয়েছে সেখানে না গিয়ে উপায় নেই।
.
– আর ইউ সিরিয়াস?
.
-হ্যা সিরিয়াস এখন না গেলে কেমন দেখাবে বল?
.
– কালকে গেলে হবে না?
.
– না আম্মু বারবার বলতেছে।
.
-ঠিক আছে তাহলে।
.
রনির সাথে হয়ত সম্মতি জানানোর ইচ্ছা তিন্নির ছিল না। কিন্তু কাউকে নিজের মৃত নানার কাছে যেতে বাধা দেওয়া অমানবিক এবং অপরাধ। মনকে বেশ শক্ত করে নিজের শরীর থেকে সব ব্যাথা,অসুখ ধ্বংস করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে থাকে তিন্নি।
.
তিন্নির সম্মতিতে রনির আনন্দের কোনো সীমা থাকে না। তিন্নির কপালে চুমু খেয়ে তারাহুড়া করে ব্যাগ গুছাতে থাকে। পোষাক পর্যন্ত চেঞ্জ করে না। তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে বারবার চুমু দিতে থাকে। কিন্তু রনির এই আনন্দের মাঝে কোথাও যেন শোকের ছাপ স্পষ্ট। হয়ত তিন্নিকে এভাবে রেখে দূরে বিগত এক-দেড় বছরে কখনো যায় নি হয়ত সে কারণে অথবা নানার মৃত্যুর শোক।
.
– বাসায় ভালভাবে থেক, গায়ে দেখি জ্বর চুপচাপ শুয়ে থেক, কৌটায় ঔষধ রাখা আছে,খেয়ে নিয়।
আর টাকা কিন্তু আলমারির মধ্যে।
.
রনির হাতটা বেশ শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খেতে থাকে তিন্নি
.
– আমাকে নিয়ে টেনশন কর না, তুমি ধীরে ধীরে সুন্দর ভাবে যাও। গিয়ে আমাকে ফোন দিতে যেন মনে থাকে। আর বাইরের ঐসব হাবিজাবি ভুলেও টাচ করবা না বরং হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যাও। আর অন্য কোনো মেয়ের দিকে ভুলেও তাকাবা না।
.
– কী ব্যাপার তুমি কাঁদো?
.
– না তো।
.
– আরে বাবা আমি তো আসব, প্লিজ এভাবে কাঁদলে আমি যাব কিভাবে?
.
– কৈ আমি তো কাদতেছি না।? তাড়াতাড়ি যাও, আর তাড়াতাড়ি আসতে যেন মনে থাকে।
.
-ঠিক আছে।
.
রনি বাসা থেকে চলে যায়। তিন্নি বেশ জোরে কাদা শুরু করে। দরজাটা আটকিয়ে, স্বজোরে চিৎকার যেকোন নিষ্ঠুর মানুষকে কষ্ট পেতে বাধ্য করবে। হয়ত অন্য কোনো নারী নিজের প্রেমিক হারালেও এরকম করবে না।
.
মাথাব্যাথা আরো তীব্র হচ্ছে, বেশ কয়েকবার বমি পর্যন্ত হয়েছে। ঔষধ খেয়েছে তবে তার কোনো প্রভাব হচ্ছে না। সম্পুর্ন পাগলের মত আচরণ করছে তিন্নি। রনিকে ফোন দেওয়ার বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে কিন্তু রনি ফোন ধরে না। হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। শরীরের ব্যাথায় সম্পুর্ন উম্মাদ তিন্নি,চোখের পানি আর আটকাতে পারে না। স্বজোরে বালিশ চেপে ধরে কাদতে থাকে তিন্নি। হয়ত, এখন আল্লাহ শুধু তার বন্ধু, চোখ বন্ধ করে নিজের এই বন্ধুকে ডাকতে থাকে। এখন তার স্রষ্টা তার একমাত্র সাহায্যকারী।
.
(৫)
.
সারারাত নরকে বসবাসের পর তিন্নি যেন পৃথিবীতে ফেরত আসে। আজকে ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে যায়। মাথা এখনো হালকা ঝিম দেওয়া। আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারে না,এক রাতে অদ্ভুত পরিবর্তন। টয়লেটে গিয়ে নিজের হাত মুখ পরিষ্কার করে। আবার একবার বমি করে দেয় তিন্নি। শরীর ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, মাথায় কেন জানি নেগেটিভ ভাবনা চলে আসে। নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে মুছে দিতে চায়। কিন্তু পরক্ষণে আবার ভাবে নেগেটিভ চিন্তাগুলো বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভয়ে তিন্নি অস্থির হয়ে যায়। এই নেগেটিভ চিন্তাগুলো যদি সত্যি হয় তাহলে? কী হবে তার? শরীর খারাপ হওয়ার সাথে সাথে নেগেটিভ চিন্তাগুলো আরো শক্তিশালী হতে থাকে। নাহ! কাজটা ভয়াবহ কিন্তু উপায় নেই তিন্নির এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হবে তাকে তাতে যা হোক। এই নেগেটিভ চিন্তাগুলোকে পরাজিত করতেই হবে। বাধ্য হয়ে বহু সাহস সঞ্চয় করে নিচে দোকান থেকে একটা ‘প্রেগনেন্সি টেস্ট কিট’ কিনে আনে। যদিও এটা ব্যাবহারের সাহস জুটাতে পারে না।
.
বহু সাহস সঞ্চয় করে ভয়ের সাথে লড়াই করে জয়ী হয়ে, শেষমেশ এটা ব্যাবহারে সাহস জুটাতে পারে। যেন একটা ভয়ানক অস্ত্র তিন্নির হাতে। কিন্তু এই ভয়ানক অস্ত্র ব্যবহার ব্যতীত কোনো উপায় নেই তার। শেষমেশ প্রেগনেন্সি টেস্ট তাকে করত হল। টেস্টে পজিটিভ ফলাফল দেখে তিন্নি সোফায় বসে পড়ে ভয়ে তার দেহ কাঁপছে, ঘামে শরীর ভিজে গিয়েছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না তিন্নি।রনিকে তারাহুড়া করে ফোন দেয় কিন্তু এখন ফোন সুইচ অফ আসে। নেগেটিভ চিন্তাগুলো শেষ পর্যন্ত পজিটিভে পরিনত হয়।, ৩০-৪০ বার ফোন দেয় রনিকে কিন্তু বারবার ফলাফল একই। প্রায় উম্মাদে পরিনত হয়েছে তিন্নি, চিন্তাশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ সংগঠিত হয়েছে তার দ্বারা। রনির বন্ধ হয়ে থাকা মোবাইল তিন্নিকে আরো উম্মাদ করতে থাকে। মনে শুধু একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।
.
-আমি কী তাহলে একজন চরিত্রহীনা?
.
(চলবে….)