‘চরিত্রহীনা২’ পর্ব-৫
.
লেখক : Mahian Khan
.
রনির চোখ থেকে পানির প্রবাহ আরো শতগুণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিন্নির দু গাল ধরে রনির কি অদ্ভুত আকুতি! হয়ত তিন্নির মন গলে গিয়েছে তবে অনেকটা নাটক করেই রনির হাত দুটোকে গাল থেকে নামিয়ে দেয়। অনেকটা অভিনয় করেই তিন্নিকে বলতে হয়,
.
– তুমি এখান থেকে যাও। সোজা চলে যাও আর আসবে না।
.
রনি কাঁদতে কাঁদতে দু হাটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। তিন্নির হাতটা ধরে মাথা নিচু করে, তিন্নির কাছে দয়ার জন্য ভিক্ষা করতে থাকে। এই দৃশ্য তিন্নির সহ্যের বাইরে। এটা আর কোনোভাবে তিন্নির পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না।
.
– উঠে দাড়াও।
.
– প্লিজ শুধু একবার দয়া কর।
.
– আচ্ছা, আগে উঠে দাড়াও।
.
উঠে দাড়িয়েও কান্না স্বরে রনির শুধু একটা দাবী আর সেটা হল, “একটু দয়া কর। ”
.
– ইরা, ঘুমিয়ে আছে। দূর থেকে ওকে দেখতে পারবা। এর চেয়ে বেশী কিছু না।
.
– সেটাই যথেষ্ট আমার জন্য।
.
– ঠিক আছে, তাহলে আমার সাথে আসো।
.
তিন্নির পিছনে পিছনে রনি হাটা শুরু করে। তিন্নি, রনিকে তার বেডরুমে নিয়ে যায়। বিছানার কাছে যেতে অথবা ইরাকে স্পর্শ করতে তিন্নি স্পষ্টভাবে রনিকে নিষেধ করে দেয়। রনি, তিন্নির নিষেধাজ্ঞার প্রতি মোটেও অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে না। এক দৃষ্টিতে, চোখের সর্বোচ্চ গভীরতা দিয়ে ইরাকে দেখতে থাকে। হয়ত, রনি প্রচন্ড অবাক, হয়ত প্রচন্ড শোকাহত। মোবাইল বের করে রনি ইরার ৫-৬ টা ছবি তুলে ফেলে। ছবিগুলোকে মনযোগ দিয়ে বারবার দেখতে থাকে। এখনো দুচোখে বিশ্বাস হয় না যে, ইরা তার সন্তান আর সে ইরার পিতা। ছবিগুলোকে দেখতে দেখতে রনির চোখ থেকে পানি বের হয়ে যায়। হয়ত নিজের সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার যে তীব্র ব্যাথা! সেই ব্যাথার সাক্ষী হল রনির চোখের পানিগুলো।
.
একজন পিতাকে তার সন্তান থেকে দূরে রাখাটা হয়ত বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্নভাবে ব্যাখা করবে। কেউ বলবে অপরাধ আবার কেউ বলবে সেটা পিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নীর্ভরশীল। তিন্নির কাছে রনি একজন অপরাধী। হয়ত, তিন্নিরও ইচ্ছে নেই রনিকে এভাবে শাস্তি দেওয়ার তবে ইরাকে সে কখনো রনির সংস্পর্শে দেখতে চায় না। তাই বাধ্য হয়েই রনির হাতে হালকা টান দিয়ে বলতে হয়,
.
– এখন, চলে যাও, আর আসবে না কখনো।
.
– আচ্ছা আর একটু সময় দেখি, ইরাকে।
.
– অনেক দেখেছো এখন যাও, আমার কাজ আছে।
.
– প্লিজ তিন্নি!
.
– শোনো না কানে? তাড়াতাড়ি বের হও। অনেক সু্যোগ দিয়েছি, সেটাই যথেষ্ট।
.
– আরেকটু?
.
– এক সেকেন্ডও না। সোজা বের হও।
.
মুখ কালো করে, চুপচাপ রনি বেরিয়ে আসে। রনির নীরবতা অনেক কথা বলে দেয়। রনির এই নীরব মুখ বলে দেয়, সে কতটা শোকাহত, কতটা আঘাত পেয়েছে। এত বছর পর নিজের সন্তানকে দেখেও আবার নিজের সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে তীব্র ব্যাথা সেটা তার নীরব মুখ চিৎকার দিয়ে আর্তনাদ করে জানাচ্ছে। রনি দরজার কাছে গিয়ে একটু স্থির হয়ে যায়। তিন্নি কৌতূহলী হয়ে রনিকে জিজ্ঞেস করে,
.
– কী ব্যাপার? দাড়িয়ে গেলে কেনো? তোমাকে এখন যেতে হবে।
.
– জানি, যেতে তো হবেই। কিন্তু একটা জিনিস ভেবেছো?
.
– কি?
.
– একজন পিতা হয়েও নিজের সন্তান থেকে আমি কতদূরে! এতটা কাছে এসেও, এতটা বছর পর আবার বিচ্ছিন্ন হতে হচ্ছে। আমি হয়ত পৃথিবীতে একমাত্র পিতা। যে, নিজের সমগ্র জীবনে নিজের সন্তানকে শুধুমাত্র ২ বার দেখার সু্যোগ পেয়েছে। কতটা অভাগা আমি, ভেবেছো একবার?
.
– হুহ! আমি কি তোমাকে তোমার সন্তানের কাছ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছি? যদি সামান্য ইচ্ছে থাকত, তাহলে কি ৪ বছর বসে থাকতাম তোমার জন্য? জানো তোমাকে আল্লাহ্ এভাবে শাস্তি দিচ্ছে। কেন, জানো? তোমার নিম্ন মানসিকতা, স্বভাবের কারণে। ৪ বছর আগে তো হনহন করে ইরাকে রেখে চলে গিয়েছিলে, মনে আছে?
.
– সব মনেআছে। তবে, এটাও তো সত্য যে, ইরা তো আমারও। আমি ভুল করেছি তাই বলে এত শাস্তি?
.
– একটা কথা কানে স্পষ্টভাবে ঢুকিয়ে রাখো, ইরা শুধু আমার। শুধু আর শুধু আমার, অন্যকারো না! তোমার মত বিকৃত মানসিকতার কোনো লোক কখনো ইরাকে নিজের হিশেবে দাবি করার অধিকার রাখে না। তুমি যে ভুল করেছো সেটার শাস্তি অসীম!
.
– হতে পারে। কিন্তু তাই বলে তোমার কাছে আমি এতটা ঘৃনিত? সত্যি! বিশ্বাস হয় না। কিভাবে সব পরিবর্তন হয়ে যায়, তাই না? তুমি আমাকে এতটা ঘৃনা করতে পারবে কখনো, এটাতো আমার কল্পনার বাহিরে ছিল। কিন্তু তবুও তোমার ঘৃনার মাঝেই আমি ভালোবাসা খুজি, ঠিক যেমন : সাগরের মাঝে হারিয়ে যাওয়া কানের দুল। তোমার সাথে কাটিয়েছিলাম জীবনের ১ বছর ৫ মাস আর এই ১ বছর ৫ মাসকেই আমি আমার জীবনের সর্বমোট আয়তন মনেকরি। আর সব মিথ্যা, সব কিছুই মিথ্যা। শুধু ঐ ১ বছর ৫ মাস বাদে। আমি একটা লাশ যেই লাশ নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন আজকে প্রায় ৭ বছর। তুমি যদি আমায় শত ঘৃনা কর তবুও ঐ ঘৃনাগুলোকে গোলাপ বুঝেই গ্রহণ করব। গোলাপের কাটায় হয়ত হাত কেটে লাল রক্ত বের হবে তবুও সেই রক্তের কথা ভুলে গিয়ে তোমার গোলাপের সৌন্দর্যকেই আমি উপভোগ করব। কারণ এখনো সেই হাসতে থাকা, নিজের বিশাল চুলগুলোকে ছেড়ে দিয়ে, কলেজে থার্ড বেঞ্চে বসে থাকা সেই মেয়েটার ছবি আমার মাথা থেকে নামাতে পারিনি আর কখনো পারব না। কারণ, সেই মেয়েটা আমার কৃত্রিম দেহে জীবন এনে দিয়েছিল। সেই মেয়েটাই আমার জীবন আর আমি চিরদিন আমার জীবনকে ভালোবেসে যাব। জানো,আমি আবার সেই থার্ড বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটার হাত ধরে হাটতে চাই।
.
রনির কথাগুলো শুনে তিন্নি অদ্ভুত দৃষ্টিতে রনির দিকে তাকিয়ে থাকে। কথাগুলো তিন্নির মস্তিষ্কে যে প্রভাব ফেলেছে তা তিন্নির চোখ দেখেই বোঝা সম্ভব তবে তিন্নি সেই সকল ব্যাথাকে লুকিয়ে রেখে রনিকে বেরিয়ে যেতে বলে। একেবারে নীরবে তিন্নির সকল ঘৃনাকে নিজের মধ্যে শুষে নিয়ে রনি চুপচাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। রনির দিকে তিন্নির চেয়ে থাকা আর সম্ভব হয় না। দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দেয়। মুখে হাত দিয়ে দরজায় হেলান দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ে। এতক্ষণ অভিনয় করে যে ব্যাথাগুলোকে লুকিয়ে রেখেছিল নিজের মাঝে, এখন কান্নাকরে সেগুলো সব বের করে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে থাকে। আসলেই প্রতিটি মানুষ অভিনয় পারে। তবে কেউ হয়ত হাজার হাজার মানুষের সামনে সেটা ট্যালেন্ট হিশেবে ব্যবহার করে, কেউ আবার লুকিয়ে নিজের আপনজনদের সাথে করে। কেউ হয়ত অভিনয় থেকে টাকা আয় করে, কেউ আবার অভিনয় থেকে ফোটাফোটা নোনাজল আয় করে।
কে জানে, হয়ত দু:খের স্বাদ লবনাক্ত!
.
(৭)
.
আজকে ৯৮৮ তম দিন। আজকে প্রথম দিন যেদিন জাভেদ, তিন্নিকে কোনো মেসেজ করেনি। এর পিছনে জাভেদের অভিমান অথবা বিরক্তি নেই। বরং একটি নাটকের দৃশ্যপট ব্যতীত এগুলো কিছুই নয়। এই নাটক করার ন্যূনতম ইচ্ছা জাভেদের মধ্যে ছিল না। বরং ধৈর্যের বাধ ভেঙে যাওয়ায় জাভেদকে নাটক সাজাতে হয়। এতে করে তিন্নির সাথে একবার দেখা করতে পারবে নাকি সেটা এখনো জাভেদের অজানা তবুও এত বছর সেই একই মেসেজ পাঠাতে পাঠাতে অধৈর্য হয়ে সম্পুর্ন এবার ভিন্ন কিছু করার সিদ্ধান্ত নিল। বন্ধু শোভনকে বহুকষ্টে এই নাটকে অভিনয় করানোর জন্য বাধ্য করাতে পেরেছে। হঠাৎ জাভেদের ফোনটা বেজে উঠল। ফোন উঠিয়ে দেখে শোভন ফোন দিয়েছে। এই কলের জন্যই অপেক্ষায় ছিল। সামান্য অপেক্ষা না করেই মুহূর্তেই জাভেদ কলটা রিসিভ করল।
.
– হ্যালো, শোভন।
.
– হ্যা তো এখন ম্যাসেজ পাঠাবো?
.
– হুম এখন পাঠা। রাত ৯-১০ টার দিকে প্রায় সবাই এক্টিভ থাকে। ছবিগুলো পাইছো?
.
– হুম, পাইসি। ভাই তুই শিউর এতে করে কোনো ফলাফল হবে। আর একটা মেয়ে নিয়ে এত তামাশার কি আছে?
.
– ফলাফল হবে নাকি জানি না। তবে, তিন্নি আমার কাছে শুধু কোনো মেয়ে না, আমি ওকে পাওয়ার জন্য এগুলো করছি না। শুধু একবার দেখার জন্য করছি।
.
– আচ্ছা যেরকমটা ভালো মনেকর।
.
– ঠিকআছে ভাই, দায়িত্ব সম্পুর্ন তোর উপরে।
.
– আচ্ছা ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ।
.
– আল্লাহ হাফেজ।
.
মোবাইলটা কেটে দিয়ে শোভন শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরেই এই উদ্ভট কাজটা করল। পেনড্রাইভটা ঢুকিয়ে, ল্যাপটপটা খুলে একগাদা ফটোশপ করা ছবি যা দেখে বোঝা যাচ্ছে জাভেদ মৃত, , আরেকটা ছবি জাভেদের গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যার ছবি। আর একটা সুইসাইড নোটের কয়েক পৃষ্ঠার ছবি। খুউব নিখুঁতভাবে ছবি দুটো এডিট করা, দেখে কোনোভাবে বোঝার উপায় নেই যে, এগুলো এডিট করা। কাজটা অনেক উদ্ভট দেখালেও জাভেদের এতটা অনুরোধকে কোনোভাবে শোভন না করতে পারে না। তাই বাধ্য হয়েই এমন উদ্ভট এক্টিং করতে হচ্ছে। ফেইক আইডি খুলে এই কাজ করলে শোভন অবশ্যই ধরা খাবে তাই রিয়েল আইডি ব্যবহার করা বাদে কোনো উপায় নেই। এই উদ্ভট কাজ করতে হচ্ছে তা নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজের ফেইসবুক আইডিতে লগ ইন করে তিন্নির ফেইসবুক একাউন্টে মেসেজ লেখা শুরু করে,
.
” আপু আপনার সাথে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে ইচ্ছুক। আমার বন্ধু, জাভদকে আপনি চিনেন? ওর পুরো নাম ইমরান হাসান জাভেদ। সংক্ষেপে জাভেদ। গতকাল রাতে ও সুইসাইড করেছে। আজকে সকালে ওর লাশ ওর এপার্টমেন্টে সকালবেলা আমি খুঁজে পেয়েছি। ওর বাসায় মূলত আমার একটা ফাইল ছিল, সেই ফাইল নিতে গিয়েছিলাম একবার ৭-৮ বার দরজা টাকিয়ে ফেরত গিয়েছিলাম কিন্তু ফাইলটা আমার অনেক জরুরী ছিলাম তাই পরে টানা ১০-১২ বার কল দিয়েও দেখি ও রিসিভ করে না। তারপর আবার ওর বাসায় গিয়ে দরজা টাকানো শুরু করলাম। কিন্তু ও কোনোভাবে দরজা খুলল না। অবশেষে আমার সন্দেহ হচ্ছিল আর ফাইলটাও আমার প্রচুর জরুরী ছিল তাই লোকজন ডেকে এনে শেষমেশ দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে জাভেদের লাশ খুজে পেলাম আর একটা ৮ পৃষ্ঠার সুইসাইড নোট পেলাম। সেখানে আপনাকে নিয়ে লেখা ছিল, আপনার মেয়ে ইরাকে(যদি ভুল না বলি) নিয়ে অনেক কিছু লেখা। আরো আপনার জীবন নিয়ে, ৭ বছর আগে জাভেদের আপনার সাথে কিভাবে দেখা হয়েছিল সেগুলো নিয়ে লেখা। আমি ভেবেছিলাম প্রথমে অন্যকোনো তিন্নি হতে পারে তবে লেখিকা, আর্টিস্ট উল্লেখ থাকায় ভাবলাম আপনি তাছাড়া ওর বাসায় আপনার অনেকগুলা বই পেয়েছি। যেগুলোর নাম ওর সুইসাইড নোটেও লেখা ছিল। ঐ সুইসাইড নোটে শেষের দিকে ও ইচ্ছে পোষন করেছিল যে, ওর একটা ডায়েরি আছে। সেটা যেন আপনার কাছে পাঠিয়ে দেই। আজ ওর লাশ ওর গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি সাথে যাইনি কারণ সুইসাইডের জানাযা পড়লে নাকি পাপ হয় তাই, নিজের অনেক ভালো বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও যাইনি। কিন্তু ওর কথাগুলো, ওর স্মৃতিগুলো শুধু মাথায় ভাসছে। তাই মেসেজটা দিলাম। ”
.
মেসেজটা লিখে শোভন ভালোভাবে চেক করে দেখে কোনো ভুল হয়েছে নাকি! অতপর মেসেজটা তিন্নিকে সেন্ড করে। অতপর ছবিগুলো ভালোভাবে চোখ দিয়ে বুলিয়ে ছবিগুলোকে তিন্নির কাছে সেন্ড করে।
.
“এই যে আপু, প্রমাণ দিলাম। আপনি বিশ্বাস নাও করতে পারেন তাই। প্লিজ আপু আমি ডায়েরিটা পাঠাতে ইচ্ছুক, কিন্তু কিভাবে পাঠাবো দয়া করে যোগাযোগ করুন। ”
.
শোভন বেশ ভালোভাবে মেসেজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
.
– কোনো ভুল হয়নি, কিন্তু আদৌ এটা কাজ করবে!
.
(চলবে….)
.