চুক্তিহীন বাঁধনে আবদ্ধ পর্ব -০৫

#চুক্তিহীন_বাঁধনে_আবদ্ধ(০৫)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টিসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

তোমার বোনের পোয়াতি হ‌ওনের খবরে নিশ্চয়ই হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হ‌ইয়া যাইতাছো?

শিমু ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–” বিপদাপদ আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কেননা, আল্লাহর ইচ্ছায় যা হ‌ওয়ার তা হবেই। আপনি যত‌ই রাগ করুন, বা দুঃখে হা-হুতাশ করুন, আল্লাহকে গালি দেন বা আল্লাহর বিচারের দোষারোপ করেন বা অসুন্তুষ্ট হোন, আপনি তা বন্ধ করতে পারবেন না। বরং আপনাকে তা ভোগ করতে হবে এবং অসুন্তুষ্টির জন্য আপনি আখেরাতের স‌ওয়াব লাভে তো বঞ্চিত হবেনই, অধিকন্তু কঠিন শাস্তি ও ভোগ করবেন। তবে আপনি যদি এরূপ অবস্থায় দুঃখিত বা অসুন্তুষ্ট না হয়ে সন্তুষ্ট মনে সহ্য করতে পারেন, তবে ইহকাল ও পরকাল উভয় লোকেই আপনার জন্য অশেষ মঙ্গল ও পুরস্কার ধার্য থাকবে। পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা, হে মুমিনরা! তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য চাও। নিশ্চয় আল্লাহ সফরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।
(সূরা বাকারা, আয়াত:১৫৩)

তাই আপনারা যত‌ই স্বরযন্ত্র করেন না কেন আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা সব দেখছেন, তিনি ঠিক এর বিচার করবেন। একটা কথা মনে রাখবেন আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।

শিমুর কথায় মুখ বাঁকিয়ে চলে যায় নাহার বেগম। শিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঠোন ঝাড়ু দিয়ে গোসলে যায়।

কাউসার কাজে গিয়ে মাথায় ইটের ভোঝা নিতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ধরলে সাথের একজন ধরে তাকে সামলে নেয়। তারপর শরীর দূর্বলতার কারণে কাজ করার শক্তি পায় না। তাই বাড়ি ফিরে আসে। এরকম প্রায়ই হতে থাকে তার। বাসায় ও কাউকে বলে না।

একদিন কাজে গেল না কাউসার। শিমুর ঘরে এসে বসে রইল। শিমু কাপড় গুছাতে গুছাতে বলল,
–” কি ব্যাপার আপনি আমার ঘরে কি করছেন? কাজ নাই নাকি?
কাউসার মাথা নিচু করে বসে থেকে বলল,
–” কাজে যেতে ইচ্ছা করে না। ইদানিং কিচ্ছু করতে ইচ্ছা করে না। মাথা কেমন জানি লাগে ক‌ইতে পারি না।

কাউসারের কথায় বুক ধক করে উঠল শিমুর। কাছে এসে দুই হাতে ধরে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে আপনার?
হাতে ধরার পর শিমু, শক্ত কিছু খেয়াল করে
বলল,
–” আপনার হাতে এটা কি!
কাউসার কে কিছু বলতে না দিয়ে শিমু নিজেই কাউসারের সার্টের হাতা সরিয়ে দেখলো তাবিজ বাঁধা! শিমু বিস্ফোরিত হয়ে বলল,
–” আপনি হাতে তাবিজ লাগিয়েছেন কেন?
কাউসার আস্বস্ত করে বলল,
–” আমি আমার সমস্যার কথা আম্মা বলাতে, আম্মা লাগিয়ে দিয়েছেন।

অনেকেই আছে তাবিজ-কবচ ব্যবহার করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস এসব ব্যবহারে বিপদ-আপদ, রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। কিন্তু এগুলো ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ কিনা এ বিষয় বিবেচনা করেন না।
শিমু বলল,
–” যেকোনো ধরনের তাবিজ তো মোটেই নয়, বরং কোরআনের আয়াত লেখা তাবিজও ব্যবহার করা যাবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝোলাল, সে ব্যক্তি কুফরি করল এবং শিরক করল। ’

হযরত ইমরান বিন হুসাইন (রা.) বর্ণিত, একদা নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে তামার চুড়ি দেখে বললেন, এটা কি? তিনি বললেন, এটা অহেনার অংশ। (অহেনার অর্থ এক প্রকার হাড়, যা থেকে কেটে ছোট ছোট তাবিজ আকারে দেয়া হয়) নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটা খুলে ফেল, কারণ এটা তোমার দূর্বলতা বাড়ানো ভিন্ন কিছুই করবে না। যদি এটা বাঁধা অবস্থায় তোমার মৃত্যু হয়, তবে কখনো তুমি সফল হবে না। ’ (মুসনাদে আহমদ, হাকেম ও ইবনে মাজাহ)

হযরত উকবা বিন আমের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসুলকে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, আল্লাহ তাকে পূর্ণতা দেবেন না, আর যে কড়ি ব্যবহার করবে, আল্লাহ তাকে মঙ্গল দান করবেন না। (মুসনাদে আহমদ, হাকেম)

তাই আমার অনুরোধ আপনি এই তাবিজ খুলে ফেলুন। ভালো ডাক্তার দেখিয়ে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত পালন করুন নিয়মিত। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা সব কিছু ঠিক করে দিবেন ইনশা আল্লাহ।

শিমুর কথায় রে’গে গেল কাউসার। শিমুর হাত ঝাড়া দিয়ে উঠে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। শিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাউসারের হয়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে মাফ চাইলো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।
________

দেখতে দেখতে কয়েক মাস চলে গেল। রেশমার শারীরিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। পেট বড় হয়েছে। মাঝে মাঝে আড়াল থেকে চেয়ে থাকে শিমু। তখন চোখের কোণে পানি জমা হয়। মনে হয় আজ তো এই স্থানে আমিও থাকতে পারতাম। তারপর আবার নিজেকে শান্তনা দিয়ে বুঝায়,
–” আমার জন্য হয়তো সন্তান কল্যাণকর নয়। সে জন্যই আল্লাহ তা’আলা আমাকে সন্তান দেয়নি।

তারপর ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
আজকাল শিমুর বন্ধুবান্ধব হয়েছে! খালের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর যখন বসে থেকে সময় কাটায় তখন পাশের জমিতে দুটো ছাগল ঘাস খেতে দিয়ে যায় মালিকরা। একটা ছাগলের দুটো ছোট ছোট পিচ্চি বাচ্চা আছে। তাদের মধ্যে একটি কে কোলে নিয়ে বসে আদর করে শিমু। তার সাথে নিজের দুঃখ গুলো শেয়ার করে। ছাগল ছানা টা চুপটি করে শুনে থাকে শিমুর কথা গুলো। যেন সে সব বুঝতে পারছে। তার মায়াবী কাজল কালো চোখে চেয়ে থাকে অপলক।
মানুষের থেকে এই অবুঝ প্রাণী গুলো অনেক ভালো হয়। এরা কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করে না। কিন্তু মানুষ কখন যে নিজের রূপ বদলে ফেলে বলা যায় না। স্বার্থে আঘাত লাগলে আপন মানুষটি ও পর হতে সময় লাগে না আফসোস।

শিমু উদাস মনে বসে আছে খালের পাড়ে। আজকে জমিতে ছাগল গুলোকে ঘাস খেতে দিয়ে যায়নি তাদের মালিক। তাই মন খারাপ করে বসে আছে শিমু। এমন সময় কাঁধে কারো স্পর্ষ পেয়ে চমকে তাকায়।
শিমুর ননাস মানে কাউসার এর বড় বোন এসেছেন। শিমুর পাশে বসে কুশল বিনিময় করে বললেন,
–” এতো কিছুর পরেও পড়ে আসছি কেন এখানে?
–” নিজেকে হিং’সুটে প্রমাণ করতে চাই না আমি আপা। আমি যদি চলে যাই তবে সবাই বলবে আমি ওদের হিং’সা করি বলে চলে গিয়েছি। কিন্তু এই তকমা লাগিয়ে আমি যেতে চাইনা। কোন মুমিন বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রে থাকতে পারে না। (হাদীস সম্ভার:২১৮৯)
তাছাড়া একাধিক বিয়ে করার নিয়ম আছে একাধিক বিয়ে করা সুন্নাত নয় বরং তা প্রয়োজনের স্বার্থে শর্ত স্বাপেক্ষে অনুমতি দেয়া হয়েছে। কারণ দুনিয়ার সকল মানুষের প্রয়োজন ও সমস্যা এক রকম নয়। তবে ইসলামে এর সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তা হল, ২ অথবা ৩ অথবা ৪। ইসলামের আগে এর কোন সীমা-সংখ্যা ছিল না।

তবে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলাম কঠিন শর্ত দিয়েছে। তা হল, সকল স্ত্রীর মাঝে সমতা রক্ষা করা। সমতা রক্ষা করতে না পারলে একটির অধিক বিয়ে করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ পুরুষদের জন্য আখিরাতে কঠিন খারাপ পরিণতির কথা বলা হয়েছে।

মরিয়ম শিমুর দিকে চেয়ে থেকে বলল,
–” তুই এত্ত ভালো কেন রে? একটু স্বার্থপর হলে ক্ষ’তি কি? তোর অধিকার তুই আদায় করে নিতে পারিস না কেন? এমন নির্জিব হলে এই যুগে টিকে থাকা সম্ভব না। তুই যত চুপ থাকবি মানুষ ততোই পেয়ে বসবে তোকে। আর কেন যে দরদ দেখিয়ে ঐ কাল নাগিনীকে জায়গা দিতে গেলি! শোন কথায় আছে না,
পুরুষ মানুষ চিতায় উঠেও যদি একবার চোখ মেলার সুযোগ পায় তবুও সেটা মেলবে মেয়েদের দিকে।
(লেখা: সমরেশ মজুমদার)
তাই ঘরে এরকম উপযুক্ত মেয়ে যায়গা দিতে নাই।

শিমু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–” নিজের জীবন দিয়ে সেটা উপলব্ধি করতে পারছি আপা।

কাউসার এর বড় বোনটা তার বাবার মতো হয়েছে নম্র, ভদ্র। কাউসার এর বাবা বেঁচে থাকতে খুব শাসন করে রাখতেন নাহার বেগম কে। কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানতেন নাহার বেগম এর সভাব সম্পর্কে। তিনি মারা যাওয়ার পর নাহার বেগম নিজের মন মতো চলতে শুরু করেন।

যাই হোক সেদিন এর পর মরিয়ম শিমুকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার সাথে তার বাসায় নিয়ে যায়।

এদিকে রেশমার নয় মাস শেষের দিকে চলে এসেছে। শরীর টা বয়ে চলতে ভীষণ কষ্ট হয়। সাথে সংসারের টুকটাক কাজে হাত দিতে হয়। বসে বসে তো আর খাওয়া যায় না।
দুপুর বেলা যখন গোসল করে ঘরে যাচ্ছিল তখন ঘরের সামনে উঁচু মাটির ডেলনা থেকে পড়ে গিয়ে ভীষণ চুট পায়! আর্তনাদ করে উঠলে কাউসার নাহার বেগম সবাই দৌড়ে আসে। এসে দেখে র’ক্তের বর্ণা বয়ে যাচ্ছে!
অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায় রেশমাকে।

ডাক্তার সিজারিয়ান করে বাচ্চা কে বাঁচাতে পারলেও মাকে বাঁচাতে পারলো না!….

#চলবে…ইনশা আল্লাহ।

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here