চুক্তিহীন বাঁধনে আবদ্ধ পর্ব -০১

স্বামীর সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে গলা টি’পে ধরে সিমু! মেয়েটা সম্পর্কে সিমুর খালাতো বোন হয়! বোন হয়ে বোনের এতো বড় সর্বনাশ করতে দ্বিতীয় বার ভাবলো না মেয়েটা? অনাথ বলে যাকে নিজের বাসায় আশ্রয় দিল সেই সিমুর পিছন থেকে ছু’ড়ি বসিয়ে দিল! ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে সিমুর। ইচ্ছে করছে সব কিছু ভেঙে চুরমার করে দিতে।
গলা টি’পে ধরায় মেয়েটার চোখ দুটো উল্টে যাচ্ছে, প্রাণ পাখিটা বুঝি গেল বলে! এমন সময় সিমুর স্বামী কাউসার এসে হেঁচকা টানে সরিয়ে নিয়ে এলো সিমু কে। সাথে গালে একটা চ’ড় বসিয়ে দিল! গালে হাত দিয়ে মাথা তুলে তাকায় সিমু। সামনে স্বামী নামক মানুষটাকে দেখতে পেয়ে দুনিয়া যেন অন্ধকার হয়ে এলো তার। এই মানুষটাই কি তার প্রাণ প্রিয় স্বামী? না না এ হতে পারে না। তার স্বামী তো আজ পর্যন্ত তার গায়ে হাত তুলে নাই। তবে আজ কি করে তুলবে? সে নিশ্চয়ই একটা ঘোরের মধ্যে আছে তাই সব ভুলভাল দেখছে।
কিন্তু সিমুকে ভুল প্রমাণিত করে কাউসার বলে উঠল,
–” আম্মা ঠিক কথাই বলেছিল, তুমি আসলেই একটা অমানুষ! তা না হলে কারো গলা টি’পে ধরতে পারে? ছিঃ তোমার চেহারা দেখলে ঘৃণা লাগছে আমার।

কাউসারের আম্মা নাহার বেগম সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,
–” আমার কতা যদি আগে শুনতিরে বাপ আইজ তোর কপাল পুড়তো না। এতদিন দু-চার জনের বাপ হ‌ইয়া যাইতি!

এদিকে রেশমা মানে সিমুর খালাতো বোন। সিমুর কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে কাঁশতে কাঁশতে দম বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আর একটু হলেই হয়তো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতো। চোখ দুটো লাল রঙা হয়ে গেছে, পানি পড়ছে অঝোরে। মৃত্যু ভয় কাবু করে ফেলছে যেন। নিস্তেজ শরীরটা মাটিতে বসে পড়ল।
কাউসার গ্লাসে করে পানি এনে নিজ হাতে খাইয়ে দেয় রেশমা কে। তারপর ধরে ঘরে নিয়ে যায়।

আশেপাশের বাড়ীর লোকজন মিলে দাঁড়িয়ে থেকে সবটা উপভোগ করছে। আর একজন আরেকজনের সাথে কানাঘুষা করছে। কাউসার চলে যাওয়ার পর নাহার বেগম সকলকে ইচ্ছা মতো গালমন্দ করে বাড়ি থেকে বিদায় করলেন। সিমু যখন মাটিতে পড়ে কাঁদছে তখন মুখ বাঁকিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলেন তিনি।

হয়তো এরমধ্যে পুরো গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে, পাশের গ্রামেও পৌঁছে গেছে এই খবর। একেই বলে গ্রাম। শহরে কেউ কারো ব্যাপারে নাক গলাতে আসে না। কিন্তু গ্রামে কিছু একটা হলে পুরো গ্রাম ছড়িয়ে যেতে দশ মিনিট ও দেরি হয় না।
_________

রাতটা অনাহারে কাটলো সিমুর। সে খেয়েছে কিনা একবার খবর ও নিল না কেউ। বেলা এগারোটার দিকে রান্না ঘরে গিয়ে খাওয়ার কিছু পেল না তাই গ্লাস ভরে পানি খেল।
কিছুক্ষণ পর রেশমা থালা দিয়ে রুটি আর আলু ভাজি নিয়ে এসে বলল,
–” আপা তাড়াতাড়ি খাবার গুলো খেয়ে নেও।

রেশমা কে দেখেই সিমুর মেজাজ গরম হয়ে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
–” তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা! একদম আমার চোখের সামনে আসবি না বলে দিচ্ছি।
রেশমা আবারো অনুনয় করে বলল,
–” প্লিজ আপা খাবারটা খেয়ে নাও। আমার সাথে রাগ করে না খেয়ে থেকো না। তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে খাওয়ার পর বলবখন। এখন খেয়ে নাও প্লিজ?

সিমু আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না। রেশমার হাত থেকে থালা টা নিয়ে ছুড়ে মারল! যার ফলে কপালে হাত রেখে আর্তনাদ করে উঠল রেশমা। রেশমার আর্তনাদ শুনে নাহার বেগম আর তার মেজ মেয়ে দৌড়ে আসে। এসে এই কান্ড দেখতে পেয়ে ফুঁসে ওঠে দু’জনে। সিমুর চুলের মুঠি ধরে রান্না ঘর থেকে বের করে আনে। সিমু আর্তনাদ করে বলে, আম্মা ছাড়ুন লাগছে আমার।

নাহার বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
–” তোকে আমি মেরেই ফেলবো অলক্ষুনে মেয়ে মানুষ কোথাকার। তোর সাহস কি করে হলো আমার বৌয়ের গায়ে হাত তোলার? কাইল রবি ছেড়ে দিল বলে ভেবেছিস আমি তোকে ছেড়ে দিব? কক্ষোনা!

কাউসারের বোন রুমি একটা লাঠি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–” আম্মা এটা নাও।
তারপর লাঠি দিয়ে আঘাত করে সিমুকে। সিমু আল্লাহ বলে চিৎকার করে উঠলে আশেপাশের মানুষ দৌড়ে আসলেও কেউ সাহস পায়নি এগিয়ে যাওয়ার। নাহার বেগম কে সবাই চিনে, এখন যদি কেউ এগিয়ে আসে তবে তাকে ছেড়ে কথা বলতে দ্বিধা করবে না নাহার বেগম। তাই নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে কিউ এগিয়ে গেল না। রেশমা কয়েক বার চেঁচিয়ে বলেছে, আম্মা আপাকে মারবেন না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এতো দিনের সব শোধ তুলছেন নাহার বেগম। তাই কারো কথা শুনবেন না তিনি।
যেদিন থেকে শুনেছেন সিমু কোন দিন মা হতে পারবে না সেদিন থেকে সিমু তার দু চোক্ষের বি’ষ হয়ে উঠেছে। এতো দিন শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। কবে ছেলেকে দ্বিতীয় বিয়ে করাবেন আর সিমুকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করবেন। আজ সেই দিন এসেছে নাহার বেগমের।

কাউসার মোড়ের দোকানে বসে ছিল কেউ গিয়ে তাকে খবর দিতে দৌড়ে আসে। মায়ের এমন নির্মম অত্যা’চার দেখে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায় তার। দৌড়ে গিয়ে মায়ের হাত থেকে লাঠি ফেলে দিয়ে ক্ষিপ্ত, রগচটা নয়নে তাকিয়ে বলল,
–” আম্মা তুমি আমাকে কি কথা দিয়েছিলে সব ভুলে গেছো? আমি কিন্তু বলেছিলাম তুমি সিমুর গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের চোখ রাঙিয়েও তাকাবে না কখনো। আর তুমি কি করলে! অমানুষের মত সিমুর গায়ে হাত তুললে? যদি এই ছিল তোমার মনে তাহলে আমি কখনোই তোমার পাতা ফাঁদে পা দিতাম না। আমার বুঝা উচিৎ ছিল তুমি ভাঙ্গবে তবু মচকাবে না।

নাহার বেগমের মুখের উপর কথা গুলো বলে কাউসার সিমুকে ঘরে নিয়ে যায়। একটা বক্স বের করে তার থেকে মলম নিয়ে লাগিয়ে দিতে যায়। তখন কাঁদতে কাঁদতে সিমু মলমটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। আর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–” আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে এসেছেন তাই না? চলে যান আমার চোখের সামনে থেকে। আপনার এই পা’পি মুখটা আমি সহ্য করতে পারছি না। বের হয়ে যান বলছি।

কাউসার অনেক বলেও মলমটা লাগাতে পারলো না সিমুর গায়ে। তাকে বের করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সিমু। স্তব্ধ ঘরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ ক্রমে অসহ্য হয়ে উঠে চারিদিক। ঘরে কেউ থাকলে সিমুর এই কান্না সহ্য করতে পারতো না। কষ্টে তার‌ও বুক ভার হয়ে যেত। মেয়েটার ফর্সা শরীরে মারের দাগ গুলো কেমন ফুলে উঠেছে। কান্না করতে করতে চোখের কোল ভারী হয়ে গেছে। কিন্তু এই শরীরের ব্যথা তোয়াক্কা না করে। ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে কলপাড়ে গিয়ে উত্তম রুপে অযু করে নিল। অযু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। এই পৃথিবীর কাউকেই আর বিশ্বাস, ভরসা করে না সিমু। একমাত্র আল্লাহ তা’আলা ই তার ভরসা। মনে যত কষ্ট সবকিছু ঐ উপর ওয়ালাকেই বলতে চায় সে। তাই আর দেরি না করে নামাযের সেজদায় লুটিয়ে পড়ে।
_________

সারাদিন গেল। এখন রাতটাও চলে যাচ্ছে, না রবিউল বাসায় ফিরেছে আর না সিমু নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। সুখের সংসার টা যেন ডুবতে বসেছে।

নাহার বেগম আর সুমি মিলে রেশমার কান ভারী করছে। তাকে বুঝাচ্ছে রবিউল যেন সিমুর আসেপাশে না ঘেঁসতে পারে রেশমা যেন সে দিকে খেয়াল রাখে। না হয় সিমুর কথায় রেশমা কে ছেড়ে দিতে দ্বিতীয় বার ও ভাববে না রবিউল!

সকালে বেলা সাড়ে দশটা বাজে তখনও সিমুর ঘরের দরজা বন্ধ দেখতে পায় রেশমা। কয়েক বার করাঘাত করেও যখন খুলছে না তখন চিৎকার করে বাড়ির সবাই কে ডাকে।
কিছুক্ষণ আগেই রবিউল বাড়ি ফিরেছে। রেশমার আর্তনাদ শুনে দৌড়ে এসে সেও দরজায় সমানে কড়াঘাত শুরু করে। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সারা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না….

#চলবে?

#চুক্তিহীন_বাঁধনে_আবদ্ধ
#সূচনা_পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here