অমানিশার চাঁদ পর্ব -১০ ও শেষ

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ (লেখিকা)

[ ১০+১১]

শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ হালকা হাওয়ায় চুলগুলো উড়ছে নীলার। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুজন দুজনার চোখে। একটু আগে তীরন্দাজ যেনো ভালো কাজই করলো। কিন্তু এরই মধ্যে তীরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। নীলা আর ফাবিহান কে একজন আরেকজনের উপর পড়ে থাকতে দেখে অন্যদিকে ঘোরে সে। চোখ চেপে ধরে বলে-

-” ম্যাডাম আমি কিছু দেখি নাই। আপনারা উঠেন তাড়াতাড়ি। বড় গিন্নি আপনাগো ডাকতাছে।

ফাবিহানের মেজাজটাই বিগড়ে যায়। একের পর এক আছেই। প্রথমে ঐ তীর তারপর এই তীরা। নীলা ফাবিহান কে ঠেলে নিজের উপর থেকে সরিয়ে দেয়। শাড়ি ঝেড়ে ঠিকঠাক করে। ফাবিহানের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে-

-” এখনো মাটিতে চিৎ হয়ে আছেন কেন?‌ উঠুন। শোনেন নি মা ডাকছে। এই তীরা তুই যা এখান থেকে।

তীরা এই আদেশের অপেক্ষাতেই ছিলো যেন। সে চোখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা দৌড়ে চলে যায়। নীলা ফাবিহানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়।‌ ফাবিহান অসহায় মুখ করে বলে-

-” নীলা আমাকে উঠাও না। তুমি ধা’ক্কা দেয়ায় আমি ব্যাথা পেয়েছি!

নীলার কেন জানি ফাবিহানের কন্ঠস্বর শুনে মায়া হলো। সে ফাবিহানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ফাবিহান হাতের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হাত ধরে নীলা কে টে’নে ফে/লে দেয়। আর নিজে উঠে দাঁড়ায়। নীলা হতভম্ব হয়ে ফাবিহানের দিকে তাকায়। ফাবিহান উঠে হাত ঝেড়ে বলে-

-” ভেবোনা সৈয়দ রা তোমাদের কাছে সাহায্য চাইবে। সিকদার রা সবসময় সৈয়দ দের নিচেই থাকে। এখন সব ঠিক আছে।

ফাবিহান আস্তে আস্তে ভবনের ভেতর চলে যায়। নীলা সেদিকে মূর্তির মতো তাকিয়ে থাকে। ফাবিহান কি এখনো শ*ত্রুতা ভোলেনি? নিজেই তো বলল সব শ*ত্রুতা শেষ। নীলার বুক ভারি হয়ে আসে। তাদের ধোঁ*কা দিলো না তো? আর রোজ ফাবিহান কই যায়। দুদিন দুটো খু*ন হলো‌। প্রতিদিন ফাবিহান বাহিরেই ছিলো। নীলা আর কিছু ভাবতে পারে না। সে উঠে দাঁড়ায়। আম গাছের তীরটার কাছে এগিয়ে যায়। তীরের মাথায় একটা ছোট চিরকুট। তাঁতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা-

-” আজ রাতে সিকদার বাড়ির পেছনের দরজার পাশে!

এর মানে কি? আজ রাতে এই বাড়ির পেছনে কি হবে? নীলার গলা শুকিয়ে আসে। ফাবিহান কি তাদের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? সে তীর টাকে আবার আগের মতো ঢুকিয়ে দেয়। যাতে কেউ এটা নিতে আসলেও না বোঝে। পা টিপে টিপে ওখান থেকে সরে যায়। আগন্তুক তা দেখে ক্রুর হাসে। নীলা ভবনে গিয়ে দেখে তার বাবা, চাচা, ফাবিহান আর তার ভাই বোনদের খাবার দেয়া হয়েছে। নীলা কে খাবারের জন্য ডাকলে সে না করে দেয়। ধীর পায়ে মায়ের কক্ষের দিকে যেতে থাকে। ফাবিহান সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। নীলা মায়ের কক্ষে গিয়ে দেখে সে সুয়ে আছে। একদিনেই মানুষ টা কেমন শুকিয়ে গেছে। পাশে ফাতিহা বসে আছে। নীলা ধীর পায়ে গিয়ে মায়ের মাথার কাছে বসে। মায়ের শুকনো মুখ দেখে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বড় বোনের জন্যেও চিন্তা হচ্ছে। মা যে দুই মেয়ের জন্যই এই চিন্তা করছে তা সে ঢের বুঝে গেল। কি অদ্ভুত না ছোটবেলায় আমাদের সকল প্রয়োজন বাবা মা না বললেই বুঝে যেত। আর এখন আমরা সন্তান রা বাবা মায়ের চিন্তা বুঝেও কিছু করতে পারিনা। নীলা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ফাতিহা কে ইশারায় চুপ করিয়ে দেয়। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তাহেরা কিছুটা চমকে উঠে বলে-

-” মা ফাবিহা তুই এসেছিস।

নীলা ঠোঁট চেপে কান্না আটকায়। গলার কাছে কান্না গুলো দলা পাকিয়ে আছে। নীলা কান্না চেপে চুপে বলে-

-” মা আমিই!

তাহেরা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। নীলা কে দেখেই শুকনো হাসে সে। নীলার খুবই কষ্ট হয় মায়ের মুখটা দেখে। সে মায়ের কপালে তার ওষ্ঠাধর ছুয়িয়ে দেয়। নীলা হালকা গলায় বলে-

-” চিন্তা করো না মা আপু ভালোই আছে।

তাহেরার মন মানছে না। ফাবিহা কখনো তার কাছ থেকে কথা লুকায় না। কিন্তু এতবড় সিদ্ধান্ত নিতে সেই মেয়ের বুক কাঁ*পলো না? তাহেরা ধরা গলায় বলে-

-” কেমন আছিস মা? রেগে আছিস? তোর শ্বশুরবাড়ির লোক তো খুব ভালো!

নীলার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফোঁটে। বলতে ইচ্ছে করলো এতই ভালো যে তারা আমার গায়ে হা*ত ও তুলেছে! সে কথা বলা হলোনা। নীলা মুচকি হেসে বলে-

-” হ্যা মা সবাই অনেক ভালো। তুমি খাওনা কেন? এভাবে নিজের অযত্ন করো কেন বলো তো?

-” মা আমার মেয়ে টাকে এনে দিবি? ওকে ছাড়া আমার ভালো লাগছে না। আমার ফাবিহা ভালো নেই। ওর অনেক বড় বিপদ হয়েছে নিশ্চয়। মা আমার মেয়েটা কে এনে দে। ওকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরবো একটু। এনে দে না মা। আমি এবার ওকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবোই। ওর বাপ বললেও শুনবো না। এভাবে অভিমান করে আমার মেয়েটা কেন চলে যাবে। ও মা আমার মেয়েটা কে এনে দে না।

তাহেরা হাউমাউ করে বাচ্চাদের মত কেঁদে ওঠে। নীলার শব্দভাণ্ডারে স্বান্তনা দেয়ার ভাষা মজুদ নেই। সে অশ্রুসজল চোখে দু হাতে মা কে আঁকড়ে ধরে বলে-

-” শান্ত হও মা, শান্ত হও। আপুর কিছু হয়নি। তোমাকে ওয়াদা করছি আমি আপুকে খুঁজে এনে দেবো। এখন কিছু খেয়ে নাও। নাহলে আপুই যদি দেখে তুমি এমন অসুখ বানিয়েছো। সে খুব রাগ করবে। খাবে তো?

তাহেরা উঠে বসতে চায়। নীলা ধরে বসিয়ে দেয়। তার মা এই দুদিনে এত দুর্বল হয়ে গেছে। ভাবতেই অবাক লাগে। নীলা আচমকা মা কে ধরে বাঁধভাঙা নদের মতো হু হু করে কেঁদে ওঠে। তাহেরা মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে যাস না ও বাড়িতে আর। ওটা একটা দোযখ রে মা তোকে আমি যেতে দেবোনা। কিন্তু ছোট মেয়ের দিকে তাকিয়ে আর বলতে পারলেন না। স্বামীর কথা সে অমান্য করেনা। তাহেরা মেয়ের কাছে আবদার করে বলল-

-” আমাকে খায়িয়ে দিবি মা?

নীলা অবাক হলেও কিছু বললো না। সে দাসী কে ডেকে খাবার দিতে বলল। ফাতিহা ঘুমিয়ে গেছে। কি নিষ্পাপ মুখ। তার বোনের উপর এই শ*ত্রুতার প্রভাব পড়বে না তো? দাসী খাবার নিয়ে আসলেই নীলা উঠে বিছানায় বসে। হাত ধুয়ে মা কে খায়িয়ে দেয়। তার মা প্রতিটা লোকমা যেনো যত্ন করে মুখে তুলছে। মা কে খায়িয়ে দিয়ে শুয়িয়ে দেয় সে। মায়ের পাশে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে একেবারে এশারের আযানের সময়। তাহেরা এখনো ঘুমাচ্ছে। ফাতিহা ফাবিহানের ভাই বোনদের সাথে বসে আছে। ফাবিহান নীলার কক্ষে ঘুমাচ্ছে। বাড়ির সবাই কাজে ব্যস্ত। নীলা সাবধানে নিজেদের বাড়ির একেবারে পেছনের দিকটায় যায়। তার হাতের হারিকেনের টিমটিমে আলোয় সামনে অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে। এখানে একটা দরজা আছে যেটা নীলা কখনো খুলতে দেখেনি। এদিকটায় কেউ আসেনা। দরজার নিচ তো মাটি পড়ে ঢাকা ছিলো। কিন্তু এখন মাটি সরানো। নীলা চমকে ওঠে। দরজায় তালাও তো নেই। সে চারদিকে আরেকবার তাকিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বিসমিল্লাহ বলে দরজাটা ধাক্কা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায়। এটা একটা কক্ষ। নীলা অবাক হয়ে কক্ষে প্রবেশ করে। হারিকেন ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতেই হঠাৎ কক্ষের এক কোনায় চোখ আটকে যায়। তার হাত কাঁপছে। এটা কি সত্যি দেখছে? সে হারিকেন একপাশে রেখে দৌড়ে ফাবিহার কাছে যায়। হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বাঁধা। নীলা হাত মুখ খুলে দেয় ফাবিহার। অচেতন ফাবিহা কে অনেকক্ষন ধরে চেষ্টা করে উঠাতে সক্ষম হয়। উত্তেজনায় নীলার হাত পা কাঁপছে। ফাবিহা চোখ মেলে তাকায়। নীলা কে দেখেই কেঁপে ওঠে সে। অনেক কষ্টে বলে-

-” ফুরাত এটা তুই? আমার পাখিটা?

নীলা কেঁদে দেয় বোনের কথা শুনে। তাঁর চোখ যেন বাঁধ মানছে না। সে জানতো তার বোন কখনো পালাবে না। কিন্তু এই অবস্থা কি করে ফাবিহার। নীলা কান্না থামিয়ে বলে-

-” আপুই তুই এখানে কি করে?

ফাবিহা নাক টেনে বলে-

-” আমার এখানে ওরা আঁ*টকে রেখেছে। ভাবিনি আর কক্ষনো তোকে দেখতে পাবো।

নীলা ফাবিহার চোখ মুছে দিয়ে বলে-

-” আপুই ঐ চিঠি কি তুই লিখেছিস?

-” হ্যা বোন। কিন্তু ওটা আমাকে দিয়ে জোড় করিয়ে লেখানো হয়েছে। বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছে করে লিখিনি‌। বোন তুই আর ঐ সৈয়দ বাড়িতে যাবিনা।

ফাবিহা উত্তেজিত হয়ে পড়ে কথা বলতে বলতে। নীলা তাকে ধরে বলে-

-” আপুই শান্ত হও। কেন যাবো না। আর কে তোমায় বন্দি করেছে?

-” সা…..

ফাবিহা কথা বলা বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে সামনে তাকিয়ে আছে। নীলা তাকে বারবার জিজ্ঞেস করছে – আপুই কে তোমায় বন্দি করেছে। ফাবিহার উত্তর না পেয়ে নীলা পেছনে তাকায়। মুহূর্তেই শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। কালো পোশাক পড়া কিছু লোক। একজনের চোখ তার খুব চেনা। এই চোখ সে আগেও দেখেছে। এই কালো পোশাকের লোকটাকেই চেনা লাগছে। দুইজন লোক এসে নীলা কে ধরে। ফাবিহা সব জেনে গেছে এখন তাঁকে বাঁ*চিয়ে রাখা মানেই বোকামি। নীলা ছোটার জন্য ছটফট করছে। ঘৃণা করছে এই স্পর্শে তার। নীলা চিৎকার করে বলে-

-” ছাড়ুন আমায় ছিহ। আপনারা আমায় ধরে রেখেছেন কেন?

নীলার চোখের সামনেই ফাবিহার গলায় ছু রি চা*লিয়ে দেয় এক লোক। নীলা চিৎকার করে বলে-

-” ইয়া আল্লাহ। আমার আপুকে বাঁ*চাও। ছেড়ে দিন ও ম রে যাবে। আমার আপু। ফাবিহা।

তার চিৎকারে কারো কানে যাচ্ছে না। সবাই পৈশাচিক হাঁসি দিচ্ছ। ফাবিহা কিছুক্ষন ছ*টফট করতে করতে শান্ত হয়ে যায়। চোখের সামনে তাঁর নিথর দেহটা দেখে চিৎকার করছে নীলা। কালো পোশাক পরিহিত একটি ব্যক্তি বলে-

-” এই মাইয়াডারেও শে*ষ কইরা দেই?

অন্য একজন বাঁধা দিয়ে বলে-

-” নাহ খবরদার। ও কায়েসের বউ। কায়েস বলেছেন তার বউকে যেন কেউ কিছু না বলে। ওকে কিছু করিস না। ফেলে দে এখানেই। আর সেই চিঠিটাও ফেলে যা।

নীলা বুঝলো এরা তার ক্ষতি করবেনা। ফাবিহান কি এর সাথে জড়িত? একমাত্র ফাবিহানের জন্যই লোকগুলো ওকে মা*রলো না। লোকগুলো নীলাকে মেঝেতে ফেলে চলে যায়। নীলা মেঝে থেকে চিঠি টা উঠিয়ে নেয়। তারপর ধীর পায়ে ফাবিহার কাছে যায়। নীলা একদম শান্ত হয়ে গেছে। ঝড় আসার আগের পূর্বাভাস। নীলা গিয়ে ফাবিহাকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে। হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দেয়। সেই আলোতে বোনের মায়াবী মুখটা দেখে নেয়। ফাবিহাকে নিজের পায়ের উপর নিয়ে মেঝেতে বসে। শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে ফাবিহার গলার র’ক্ত মুছে দিতে দিতে বলে-

-” দেখছো এই র: ক্তগুলো লেগে আছে। আপুই একটুও এসব নোংরা থাকা পছন্দ করে না‌। আপুই শুনছো? এই ফাবু উঠ না। বনু উঠ না। দেখ না আমার কষ্ট হচ্ছে। তোকে আমি আমার সব চুড়ি দিয়ে দেবো। রাগ করে এভাবে হারিয়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি ঘুমাতে পারি না তো। বোন শোন না জানিস আমায় যখন শ্বাশুড়ি খুব মে*রেছিল, তখন কেউ বলেনি, কাঁদিস না আমার পাখিটা আমি তোকে ঘুরতে নিয়ে যাব। বোনু তুই যদি এভাবে আমায় ছেড়ে যাস আমার আর কলেজে পড়া হবেনা। তুই না আমায় ওয়াদা করেছিলি আমায় কলেজে পড়ার ব্যবস্থা করে দিবি। তুই বলেছিলি আমি একদিন তোর জন্য কাঁদবো। বোন বিশ্বাস কর তোর জন্য আমি প্রতিদিন কাঁদি। আমায় আর কাঁদাস না। বোনু রে। আমি কার‌ কাছে আমার দুঃখের কথাগুলো বলবো? বনু তুই কি শুনতে পাচ্ছিস? দেখ না আমার কষ্ট হচ্ছে তো। ইয়া আল্লাহ তুমি এটা কি করলে? আমার বোনটাকে এভাবে কেন কেড়ে নিলে? আপা ও আপা। ফাবু দেখ আমি তোকে আপা বলে ডাকছি। রাগ করে আমায় বকে দে একটু। বোন আমাকে কে নীলা পাখি বলে ডাকবে? আমায় যে তুই ছাড়া কেউ বোঝেনা। মা কে আমি কথা দিয়েছি তোকে খুঁজে দেবো। আমি মা কে গিয়ে কি বলবো বোন। তোকে কে আটকে রেখেছে তাও বললি না। এত মানুষ কে আমি কি জবাব দেবো। বোন তুই কেন আমাকে এত প্রশ্ন আর রহস্যের মুখে ফেলে গেলি। আল্লাহ তোমার কি দয়া হলো না একটুও? আমি মায়ের কাছে কি জবাব দেবো। তার মরা মেয়ের লা”শ খুঁজে এনেছি? আল্লাহ আমার বোন কে ফিরিয়ে দাও। ওকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। আল্লাহ এমন করলে কেন?

নীলা কাঁদতে কাঁদতে ফাবিহাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। বোন কে যে এভাবে খুঁজে পাবে তা সে কখনোই বোঝেনি। নীলা কিছুক্ষন বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হারিকেন টা হাতে নিয়ে বলে-

-” বোন তোর কি অন্ধকার এ ভয় করবে? আমি মা কে ডেকে নিয়ে আসি কেমন? একটু একা থাক না। আমি যাবো আর আসবো।

নীলা ধীর পায়ে বেরিয়ে যায় দরজা লাগিয়ে। এদিকে সারা ভবনে নীলা কে খোঁজাখুঁজি করছে। হারিকেন নিয়ে সবাই। নীলা হারিকেন নিয়ে তাদের বাগানে আসে। তাকে দেখে ছুটে আসে তীরা‌। বিধ্বস্ত নীলা কে দেখে সে যেন আঁতকে ওঠে। সারা গায়ে মাটি আর র*ক্তের মাখামাখি দেখে তীরা আঁতকে ওঠে। নীলা ওকে পরোয়া না করে ভবনে ঢোকে। নীলা দৌড়ে মায়ের কক্ষে যায়। তাহেরা মেয়েকে দেখে আঁতকে ওঠে। নীলা মায়ের কাছে গিয়ে বলে-

-” মা মা আপুকে খুঁজে পেয়েছি।

তাহেরা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে-

-” মা তোর গায়ে কিসের র*ক্ত।

নীলা কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে-

-” ও কিছুনা। চলো তুমি।

নীলা তার মা কে ধরে নিয়ে ভবনের পেছন দিকটায় আসে। তার পেছনে তার বাবা চাচারা ও এসেছে। ফাবিহান ও আছে তাদের সাথে। সে এতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলো। নীলা ঐ দরজার কাছে আসতেই তার বাবা বলে-

-” মা এখানে আছে ফাবিহা?

নীলা মাথা উপর নিচ করে হ্যা বোঝায়। ইব্রাহিম সিকদার দরজা খুলে প্রবেশ করে। সঙ্গে নীলা আর তাহেরাও ঢোকে। হারিকেনের আলো তে ফাবিহার নিথর দেহটা কে দেখে গগনবিদারী চিৎকার করে তাহেরা। ছুটে মেয়ের কাছে যায় সে। ইব্রাহিম সিকদার যেনো পাথরের মুর্তি হয়ে আছে। চোখের সামনে সন্তানের মৃ*ত দেহ দেখে কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত তা সে বুঝতে পারছেনা। তাহেরা মেয়েকে ধরে বিলাপ করতে করতে জ্ঞান হারায়। ফাবিহান এসে নীলা কে ধরে। নীলা ফাবিহানের দিকে তাকিয়ে বলে-

-” এই যে শুনুন। আপনি আমার আপু কে এনে দেবেন? আমি আপু কে নিয়ে ঘুরতে যাবো। আপু আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেবে বলেছিল। আপুকে আপনি এনে দিতে পারবেন?

নীলা ফাবিহান কে একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। ফাবিহান কি করবে বুঝতে পারছেনা। পরিস্থিতি তার হাতের বাইরে। ফাবিহান নীলা কে বুকের ভেতর আগলে রাখে। নীলা বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার প্রিয় বোনটি নেই এ কথা যেন মানতেই পারছেনা।

___________

সকালবেলা, সারা বাড়িতে চিৎকার আর আহজারির শব্দ। অকালে মেয়েটার চলে যাওয়া কেউ মানতে পারছেনা। নীলা কে সবাই অনেক প্রশ্ন করেছে। ফাবিহাকে কই পেলো? কিভাবে পেলো? সে উত্তর দেয়নি। সবাই ধারনা করছে ফাবিহা যার সাথে পালিয়েছে সে ওকে ব্যবহার করে মে*রে রেখে গেছে। তা হয়তো নীলা কোনভাবে দেখেছে। নীলা শেষবারের মতো বোনের মুখটা দেখে নেয়। গোসল করানোর পর এত সুন্দর লাগছে কেন। সবাই কে শেষবারের মতো দেখিয়ে, খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয় নীলার বাপ চাচারা। ইব্রাহিম সিকদারের মনে হচ্ছে কাঁধে কোন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। মেয়ের খু*নিকে সে উচিত শিক্ষা দিবে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো। ফাহিতা বার বার আপু আপু বলে চিৎকার করছে। এতসব কোলাহল ভালো লাগছে না নীলার। সে সবার থেকে সরে যায়। ফাবিহার কক্ষে গিয়ে দুয়ার লাগায়। ফাবিহার ব্যবহৃত প্রত্যেকটা জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। তার ভেতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। নীলা কক্ষের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। খুবই সাবধানে কাপড়ের ভাঁজ থেকে গতকালের চিঠি টা বের করে। চিঠিটায় খুব সুন্দর করে লেখা-

-” আমি যা বলি মেনে নাও। ক্ষমতা তুমি কখনোই পাবেনা। আমাদের কথা মেনে নাও নাহলে পরেরবার আরো পস্তাবে।

নীলা চিঠিটা রেখে দেয়। এই চিঠিটা কাকে লেখা হয়েছে। যে লিখেছে সে নিশ্চিত খুব চালাক‌। নাহলে কোন সম্বোধন নেই। এ যেন জন্ম জন্মান্তরের শ*ত্রুতা। নীলা ফাবিহার কাঠের বাক্সটার কাছে গিয়ে নীলা থেমে যায়। এটাকে ফাবিহা কখনোই ছুঁতে দেয়নি কাউকে। নীলা সারা ঘর খুঁজে চাবি বের করে। বাক্সটার তালা খুলে অনেক কিছুই দেখতে পায়। একেকটা শাড়ি তার সাথে মিলিয়ে চুরি আরো অলংকার। আর একেকটা চিরকুট। একটা চিরকুট খুললো নীলা। তাতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা –

-” নীলা তোকে আমি কখনোই জন্মদিনে উপহার দেইনি। কিন্তু তুই কি জানিস তোর জন্য আমি সবসময় উপহার কিনি। প্রতি জন্মদিনে একটা করে শাড়ি কিনি। এগুলো তোর বিয়ের দিন তোকে একসঙ্গে উপহার দেবো। তুই কি খুশি হবি?

এরকম আরো কয়েকটা শাড়ি আর চিরকুট। নীলা শাড়িগুলো বুকে জড়িয়ে ধরে। চিরকুট গুলো হাতে নিয়ে পড়তে থাকে। নীলার চোখ থেকে পানি পড়ে চিরকুট গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সে চিরকুট গুলো তে অগনীত চুমু খায়। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে-

-” আমাকে এতো কেন ভালোবাসলি? তোর ভালোবাসার এই বোঝা বইতে যে আমার কষ্ট হবে!

সবশেষে বাক্সের নিচে একটা বড় কাগজ পায়। চিঠি মনে হচ্ছে। নীলা ভাঁজ খুলে পড়তে থাকে-

-” আমার বিয়েটা বাবা হুট করেই ঠিক করেছে শ*ত্রু বংশের সাথে। আমি জানি বাবা এখনে আত্মীয়তার জন্য বিয়ে ঠিক করেনি। তার যে অনেক লোভ। মেয়ে হয়ে এই কথাগুলো বলতে আমার ভীষন লজ্জা করছে। আমাদের দুই বংশের শ*ত্রুতা যে অনেক বছরের। বিয়ে, ক্ষমতার লোভ নিয়ে যে শ*ত্রুতা শুরু হয়েছিল তা আবার বাবা নতুন করে তাজা করতে চাইছে কেন আমি জানি না। আসলেই কি আমাকে ওরা নিজেদের বউ করে নেবে। নাকি নির্যা*তিত দাসী তে রূপান্তর করবে? আমাকে নানীমা সব বলেছে। সে এই বিয়েতে কখনোই আসবে না। আমি জানি‌। এটা তো বিয়ে না যু*দ্ধ শুরুর প্রথম ধাপ‌। আমি সব জেনেও পালাবো না। আমি কখনোই বাবার সম্মান নষ্ট করবো না। আমি চাই না এই শ*ত্রুতার কালো ছায়া আমার বোনদের উপর পড়ুক। আল্লাহ আমি যে অবস্থাতেই থাকি না কেন আমার মা বোনদের সুরক্ষিত রেখো।

নীলা বোনের চিঠিটা আরো কয়েকবার পড়তে থাকে। কিসের ইঙ্গিত দেয়া এখানে। সে কি পারবে সব কিছু ঠিক করতে?

_____

নিয়াজ সিকদার থেমে যায়। খুক কুক করে কেশে ওঠে। তার মেয়ে অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করে-

-” বাবা তারপর কি হলো?

নিয়াজ সিকদার উঠে দাঁড়াল। জানালার পর্দাটা টেনে দেয়। তারপর মেয়ে রুসি কে বলে-

-” মা এখন ঘুমাতে যাও অনেক রাত হয়েছে। পরের টুকু অন্য একদিন বলব।

রুসির মনটা খারাপ হয়ে যায়। কত ইন্টারেস্টিং গল্পটা। মাঝপথে থামিয়ে দেয়ায় সে খুব বিরক্ত। তার সারারাত হয়তো ঘুম আসবেনা। অথবা যতদিন পুরো গল্পটা শুনছে ততদিন হয়তো সে ঘুমাইতেই পারবেনা।

#সমাপ্ত

(প্রথম খন্ডের সমাপ্তি। যারা রহস্যের কোন কুল কিনারা করতে পারছেন না তারা ধৈর্য ধরুন একটু। পরবর্তী খন্ডে আস্তে আস্তে রহস্যের জট খুলবে। ২য় খন্ড কিছুদিন পর শুরু করবো। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের কেমন লেগেছে জানাবেন কিন্তু)

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here