অমানিশার চাঁদ পর্ব -০৯

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

[ ৯ ]

চারদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। এত এত কোলাহলে সবাই আতংকে আছে। কি করে হলো এসব। নীলা বাক বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে তুরের নিথর দেহটার দিকে। কি জঘন্য ভাবেই না আ*ঘাত গুলো করেছে।‌ মনে হচ্ছে বহু জন্মের ক্ষোভ মিটিয়েছে। কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কি করে একজন কে এভাবে কো পা তে পারে? জানা নেই নীলার। চারদিকে মানুষ কানাকানি করছে সিকদার বাড়িতে দাসীর লা*শ পাওয়া গিয়েছে। ফাবিহান ভীড় ঠেলে ভেতরে আসে। সে মানুষ সরিয়ে ইব্রাহিম সিকদারের কাছে যায়। সে স্বাভাবিক ভাবেই শ্বশুর কে সালাম দেয়-

-” আসসালামুয়ালাইকুম বাবা।

ইব্রাহিম সিকদার সালামের জবাব দেয়-

-” ওয়ালাইকুমুস সালাম।

ইব্রাহিম সিকদার থমথমে মুখে বসে আছেন। তার মাথায় এসব কিছুই ঢুকছেনা। এমনিতেই তাঁর বড় মেয়ে পালিয়েছে এসব খবর গ্রামে ছড়িয়ে আছে। এখন তো তুরের মৃ*ত্যুর খবরও গ্রামবাসীর মুখে মুখে। কেউ কেউ বলছে ফাবিহার বিশ্বস্ত দাসী ছিলো‌ তুর। ফাবিহার সম্পর্কে কিছু না বলায় হয়তো সিকদার রা তুর কে মে*রে ফেলেছে। এখন নিজেরাই খু*নের নাটক সাজাচ্ছে। ইব্রাহিম সিকদার মাথা দু হাতে চেপে ধরে। ফাবিহান হালকা হাসে। তা কারো চোখে পড়ে না। ফাবিহান গলা খাঁকারি দিয়ে ইব্রাহিম সিকদার কে প্রশ্ন করে-

-” বাবা শুনলাম মেয়েটা আপনাদের দাসী। কিভাবে কি হলো?

ইব্রাহিম সিকদার চোখ তুলে তাকান। তার চোখে অসহায়ত্ব ভয় স্পষ্ট। ফাবিহানের যেন খুশি লাগলো সেই আনন্দ দেখে। তবুও সে ভাব মুখে প্রকাশ করলো না। ইব্রাহিম সিকদার মিনমিন করে বললেন-

-” সকালে ফজরের নামাজ পড়ে হাঁটতে বাগানে গিয়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে ঝোপের পাশে পায়ে হোঁচট খাই। একটুর জন্য মাটিতে পড়িনি। তারপর লক্ষ করতেই দেখি কারো পা বেড়িয়ে আছে। তখন দুজন ছেলে কে ডাক দেই। তারা এসে বের করতেই দেখি তুরের ক্ষ*তবিক্ষ*ত লা*শ। সারা গ্রামে সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ তো বলছে আমরাই মে*রেছি। বাবা বিশ্বাস করো এসবের কিছুই আমি জানিনা।

ফাবিহান মনে মনে কটাক্ষ করে ভাবে, আপনারাই এইসবের শুরু করেছিলেন সিকদার। এখন কিছুই জানিনা বললে তো হবেনা। অপেক্ষা করুন সবে তো আপনাদের ধ্বং*সের শুরু। তবুও মুখে দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বলে-

-” বাবা চিন্তা করবেন না। মানুষ এর কথা তো উল্টাপাল্টা বলাই। আপনি ভেঙে পড়বেন না।

ইব্রাহিম সিকদার কিছুক্ষন চুপ করে রইলো। মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলল-

-” বাবা ফাবিহান শুনেছি বিয়ের পরেরদিন তোমাদের বাড়িতে কারো লা*শ পাওয়া গিয়েছে। লোকটার বাড়ি নাকি শিবপুর।

ফাবিহান নিজেও জানেনা এই লোকটার খু*নের রহস্য। সে কপাল কুঁচকে বলল-

-” হ্যা বাবা ঠিক শুনেছেন। লোকটাকে আমরা কেউই চিনি না। জানিও না কিভাবে আমাদের আঙিনায় এলো। তবে শিবপুরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ওনার দুই ছেলে আর বউ আছে। তাদের সংসার চালানোর মতো কেউ নেই। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, লোকটার বউকে নীলার দাসী নিযুক্ত করবো। আর ছেলে দুটোর জন্য ও ভালো কাজের ব্যবস্থা করেছি। এখন তারা চলতে পারবে।

ইব্রাহিম সিকদার অভিভূত হয়ে গেলেন। আহ কতো ভালো জামাই তার। নাহলে কোথাকার কে ম*রেছে তার জন্য এত কিছু করার দরকার কি? ইব্রাহিম সিকদার প্রসন্ন হয়ে বললেন-

-” বাহ খুব ভালো পদক্ষেপ বাবা। তোমার মতো জামাই পেয়ে গর্বে বুকটা ফুলে যাচ্ছে। দোয়া করি বেঁচে থাকো।

ফাবিহান ভুবন ভোলানো হাসি দেয়। সে হাসিতে কোন খাদ নেই যেন। কি সরল নিষ্পাপ মুখখানা। ফর্সা গায়ের অবয়ব। ফাবিহান মনে মনে বলে- হ্যা গর্বে বুকটা যত পারেন ফুলিয়ে নেন। তবে জামাই হিসেবে ঠিক আছি আপনার মেয়ের জন্যেই। ফাবিহান মিষ্টি হাসি মুখে ঝু*লিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ইব্রাহিম সিকদার দুজন দাসী ডেকে বলেন-

-” জামাই কে নীলার কক্ষে নিয়ে যাও। তাকে ঘাট পাড়টাও দেখিয়ে দাও। একেবারে হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিবে। আর নীলা কে পাঠিয়ে দাও নিজের কক্ষে।

ফাবিহান কে একজন দাসী ঘাট পাড়ে নিয়ে যায়। ফাবিহান দাসি কে বলে –

-” এই মেয়ে তুমি যাও। নীলা কে এখনে পাঠিয়ে দাও। সঙ্গে হাত মুখ মোছার জন্য কিছু দিয়ো।

মেয়েটা মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। উল্টো ঘুরে বড় বড় পা ফেলে ভবনের ভেতরে ঢুকে যায়। ফাবিহান ঘাট পাড়ে বসে। বসার জন্য সুন্দর উঁচু জায়গা বানানো আছে। সে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে সব পরিকল্পনার কথা। কিন্তু তাদের বাড়িতে শিবপুরের লোকটাকে কে খু*ন করলো, এটাই বুঝতে পারছেনা। মাথা ব্যাথা করছে। কদিন ধরে ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না। ফাবিহান ঘাট পাড়ে নেমে হাত পা ধোয়। চোখেমুখে পানি দিয়ে আবার উঠে বসে। বসতেই নিজের ভাবনায় তলিয়ে যায়। এরমধ্যে নীলা হেলেদুলে ঘাট পাড়ে আসে। ফাবিহান অবশ্য সেটা খেয়াল করেনি। সে তার ভাবনায় ব্যস্ত। নীলা মাটির দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আপনি ডেকেছেন আমায়?

নীলার রিনরিনে কন্ঠস্বরে ফাবিহানের ধ্যান ভাঙে‌। সে মুখ ঘুরিয়ে নীলার দিকে তাকায়। কালো শাড়ি পড়া মেয়েটির দিকে তার চোখ আটকে যায়। তেমন একটা সাজগোজ নেই। গয়না গুলো এখনো পড়ে আছে। তবে শাড়িটাই পাল্টেছে। এই শাড়িটা ফাবিহানের কেনা। যাক তার কেনা স্বার্থ করেছে নীলা। ফাবিহান বিরবির করে বলে-

-” মাশাআল্লাহ।

নীলা নিচের দিকে তাকিয়েই বলে-

-” কি বললেন?

ফাবিহান কপাল কুঁচকে তাকায়। নীলা কে ধমক দিয়ে বলে-

-” কি ব্যাপার নীলা তুমি নিচের দিকে তাকিয়ে আছো কেন? উপরে তাকাও!

নীলা কেঁপে ওঠে ধমক খেয়ে। সে আস্তে আস্তে চোখ তুলে ফাবিহানের দিকে তাকায়। চোখ আটকে যায় তার। ফর্সা মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ফর্সা লোমশ দুটি হাত। তার উপর পানির ফোঁটা গুলো মুক্তার মতো জ্বলজ্বল করছে। বুকের ভেতর অশনি সংকেত দিচ্ছে। ঝড় শুরু হচ্ছে যেন‌। নীলার হৃদযন্ত্রটা লাফাচ্ছে। নীলা কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হালকা হাসে ফাবিহান। ভ্রু নাচিয়ে বলে-

-” আমি জানি আমি খুব সুদর্শন তাই বলে এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাবে? এটা উচিত নয়। আমি তোমাকে বউ বলেই তো মানিনা। এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খেলে যখন অন্য কাউকে বিয়ে করবো তখন সে কি খাবে?

নীলা ভীষণ অবাক হয়ে তাকায়। কি বলল আবার বিয়ে করবে? কথা টা তার হজম হলো না। সে যেন এটা মানতেই পারলো না। নীলা অভিমানী কন্ঠে বলল-

-” দুঃখিত আপনি সুদর্শন তাই তাকাই নি। আপনার চোখে মুখে পানি গুলো দেখতে বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালার মতো লাগছিলো। তাই দেখছি। আপনি মোটেও সুদর্শন না। কিছু বলার থাকলে বলুন।

ফাবিহান বুঝলো নীলা অভিমান করেছে। সে জিজ্ঞেস করলো-

-” আচ্ছা আমার হাত মুখ মোছার জন্য কাপড় এনেছো?

নীলা ভ্রু কুঁচকে বলে-

-” আমি কেন আনতে যাবো। কক্ষে গিয়ে মুছে নিন।

নীলা গটগট করে চলে যেতে থাকে। ফাবিহান পেছন থেকে সামনে এসে বাঁধা দিয়ে দাঁড়ায়। নীলা বিরক্ত হয়ে বলে-

-” কি হয়ে‌ছে? পথ ছাড়ুন!

ফাবিহান কিছু না বলে নীলার শাড়ির আঁচল নিয়ে হাত মুখ মোছে। এহেন কান্ডে নীলা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার চোখজোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে যাবে হয়তো। ফাবিহান নিজের কাজ শেষ করে সরে দাঁড়ায়। নীলার মুখের সামনে তুড়ি মেরে বলে-

-” এভাবে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলে, মুখে পোকামাকড় চলে যাবে। আমার কাপড় আনো নি তাই আঁচল কাজে লাগালাম। যে জিনিস কাজে লাগেনা সেটা রাখা উচিত নয়।

নীলা কটমট করে ফাবিহানের দিকে তাকায়। আচমকা নীলা ফাবিহান কে ধাক্কা দেয়। ফাবিহান নীলার হাত ধরে ফেলায় দুজনেই পড়ে যায়। একটা তীড় এসে আমগাছে ঢুকে পড়ে। ফাবিহান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here