অমানিশার চাঁদ পর্ব -০৮

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ (লেখিকা)

‌ [ ৮ ]

ফজরের আযান পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নীলার। সে নড়েচড়ে জানালার দিকে ঘুরে যায়। চোখ খুলে অন্ধকারের মধ্যেই তাকিয়ে থাকে। কিন্তু গায়ে কাঁথা দেখে যার পর নাই অবাক হচ্ছে। কে দিয়েছে কাঁথা? ফাবিহান? মূহুর্তেই তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে ঠোঁটে। অ*ত্যাচার করে দরদ দেখানো। কেন জানি ফাবিহান কে মাঝে মাঝে চিনতে পারে না সে। এই তার মায়ের থেকে বাঁচিয়ে ঘরে নিয়ে আসলো। আবার নিজেও এসে মা*রলো। আচ্ছা আমার বোনটা কেমন আছে? আপুর চিঠিটা এখনো আমার কাছেই আছে। বাবা মা হয়তো একটাবার ও খোঁজ নেয়নি। বা নেয়ার চেষ্টাই করেনি। চিঠিটার লেখাগুলো কেমন জানি ছিলো। মনে হচ্ছে খুব তাড়াহুড়ো করে লিখেছে ফাবিহা আপু। আচ্ছা সে পালিয়ে না গিয়ে বাবা কে একবার বললেও তো পারতো। চিঠিটা মুখস্থ হয়ে গেছে নীলার। কতবার যে পড়েছে তার ইয়াত্তা নেই। চোখ বুজে বোনের লেখা চিঠিটা মনে মনে আওড়ায় নীলা-

[ প্রিয় নীলু;

খোঁজাখুঁজি করছিস আমায় তাই না? অনেক চিন্তা হচ্ছে তোর এই অভাগা বোনটা কই গেলো। চিন্তা করিস না আমি ভালোই আছি, আমি আমার ভাগ্য খুঁজে নিয়েছি। আমি এখন আর অভাগা নই। আমার তোকে অনেক মনে পড়বে। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না রে। তুই ছাড়া আজো আমাকে কেউ বুঝতে পারেনি। জানিস ওনারা খুব ভালো। যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো সে অনেক সুদর্শন। আমি জানি আমি পালিয়ে গেলে বাবা তোকে বিয়ে দিয়ে দেবে। কিন্তু কিছু করার নেই আমার। তোকে সাগরে ফেলে দিলাম তাই না। আমি একজন কে খুব ভালোবাসি। সারাটা জীবন তার সাথেই কাটাতে চাই। তাই তোদের এত ভালোবাসা রেখেও আমি চলে গেলাম তার কাছে। তুই অনেক বুদ্ধিমতী। তুই চাইলেই সব সামলাতে পারবি। বাবা মা কে বলিস তাদের এই মেয়েটাকে ক্ষমা করে দিতে। তোকে আর ফাতিহা কে তোর এই বোন খুব ভালোবাসে। একদিন দেখা হবে। ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ। ভালো থাকবি আমার পাখিটা।

ইতি;
তোর অপ্রিয় বোনটা!]

নীলা হাসে। বোনটা কে সে কত ভালোবাসে। সে কিনা বলছে যে অপ্রিয়? বোনের উদ্দেশ্যে বলে-

-” আপু তুই যদি আমার ভালোবাসা টা বুঝতি। তাহলে আর অপ্রিয় বলতে পারতি না। তুই আমার সবচেয়ে প্রিয়। কখনোই অপ্রিয় হবি না রে। দোয়া করি খুব সুখে আছিস!

নীলার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সে কাঁথা টা সরিয়ে উঠে বসে। চারদিক হালকা হালকা আলোকিত হচ্ছে। নামায পড়তে হবে। কালকের ঘটনার পর আজকে কেমন যেন লাগছে নিচে নামতে। তবুও নীলা শাড়ি টা ঠিক করে নেয়। পা টিপে টিপে নিচে নামে। সে পেছনের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। ওখান থেকেই ঘাট পাড়ে গিয়ে ওযু করবে। কিন্তু পেছনে দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেয়ে দাড়িয়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে দেখে ফাবিহান ভবনের দরজা খুলে, ভেতরে ঢুকছে। নীলা অবাক হয়ে যায়। ফাবিহানের সাথে চোখাচোখি হওয়ার আগেই সে ঘুরে যায়। ফাবিহান নীলা কে দেখে প্রশ্ন করে-

-” এত সকালে কোথায় যাচ্ছো?

নীলা একবার ভাবলো উত্তর দেবেনা। পরক্ষনেই আস্তে করে বলল-

-” ওযু করতে‌।

ফাবিহান আর কিছুই বলল না। সে ধুপধাপ শব্দ করে পা ফেলে উপরে উঠে গেলো। নীলা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দরজা খুলে ঘাট পাড়ে চলে এলো সে। মাথায় হাজার টা প্রশ্ন কিলবিল করছে। ফাবিহান বিয়ের প্রথম রাতেও কক্ষে ছিলো না। আর গতকাল ও ছিলো না হয়তো। তাহলে কোথায় ছিলো? এই ভোরবেলা কোথা থেকে এলো। সারারাত বাহিরেই ছিলো? আর বাকি মানুষ গুলো কোথায়। মরিময়, জিনাত, জহুরা বা অন্য কাউকে দেখতে পেল না। নীলার মাথা ঘুরছে এত এত প্রশ্নে। সে দ্রুত অযু করে নিজের কক্ষে চলে যায়। তার শ্বাশুড়ি এখনো ঘরের দরজা খোলেনি। তারা কি নামায আদায় করে না? নীলা কক্ষের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ফাবিহান বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে না কি বোঝা যাচ্ছে না। এতটুকু সময়ে কি কেউ ঘুমাতে পারে। আর কেমন মানুষ, নামায টাও পড়লোনা। নীলা সাত পাঁচ ভাবনা বাদ দিয়ে নামায আদায় করে নেয়। তারপর কোরআন শরীফ নিয়ে বসে। কোরআন তেলাওয়াত করলে মনটা ভালো লাগবে। কোরআন শরীফ টা তাঁকে মরিয়ম উপহার দিয়েছে। নীলা মৃদু কন্ঠে কোরআন তেলাওয়াত করছে। ফাবিহানের তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে যায়। অনেকক্ষন সে একমনে নীলার তেলাওয়াত শোনে। নীলা কোরআন শরীফ রেখে দেয়। ফাবিহান উঠে বসে বলে-

-” শোন আজকে আমরা তোমাদের বাড়ি যাব।

নীলা স্বাভাবিক ভাবেই ভাবে জিজ্ঞেস করলো-

-” আর কে কে যাবে?

ফাবিহান অবাক হয় নীলার ব্যবহারে। রাতে মা হয়েছে তার পর এই ব্যবহার টা হজম হচ্ছে না। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলে-

-” তুমি, আমি, রাহেলা, শাহেদ, রোজা।

নীলা আর কিছু না বলে নিজের কাপড় গোছাতে শুরু করে। ফাবিহান আরচোখে সেদিকে তাকিয়ে বলে-

-” আমার জামাকাপড় ও নিয়ো কিছু।

তবুও নীলা জবাব দেয় না। ফাবিহান অপমানিত বোধ করে। তাকে অবহেলা করছে। সে কাঁথা মুড়ি দিয়ে অন্যপাশে ফিরে শোয়। নীলার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাঁসি ফুটে ওঠে। সে জামাকাপড় গুছিয়ে নিচে নামে। দুজন দাসী মিলে রান্না করছে। নীলা গিয়ে বলে-

-” কি রান্না করছেন? আমায় দিন আমি রান্না করি।

একজন দাসী তাড়াতাড়ি করে বলে-

-” আরে কি বলতাছেন? আপনি নতুন বউ মানুষ। আপনে কেন রানবেন? এই বাড়িতে কোন বউ রা রানধে না। সব কাজ করার লাইগাই মানুষ আছে। আপনি ঘরে যান। ছোটসাহেব রে সময় দেন। নতুন নতুন বিয়া হইছে। এহন জামায়ের লগেই থাকবেন।

বলেই মেয়েটি লজ্জা পেলো যেন। নীলার বিরক্ত লাগলো এসব কথায়। যেখনে কোন সম্পর্ক নেই‌। সেখানে সময় দেবে, হাহ। নীলা কিছুক্ষন ভবনে ঘুরঘুর করে নিজের কক্ষে চলে যায়। ফাবিহান এখনো ঘুমাচ্ছে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে আকাশে। নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরিবেশ টা উপভোগ করে।
______

শান্ত নিরিবিলি পরিবেশে সা সা করে বাতাস বইছে। গরুর গাড়ি গ্রামের মেঠো পথে হেলেদুলে এগিয়ে যাচ্ছে। নীলা অদুরে তাকিয়ে আছে। তার পাশে বসেছে রোজা, তারপর রাহেলা, তারপর শাহেদ আর‌ তার পাশে ফাবিহান। রোজা ফাবিহানের মেজো চাচার মেয়ে। তার মেজো চাচা মারা গিয়েছে বছর দুয়েক আগে। তার লাশ পাওয়া গিয়েছিলো নদীর তীরে। সে মৃত্যু আজো এক রহস্য। তবে ও বাড়ির কাউকে এ নিয়ে ব্যথিত হতে দেখা যায় না। শাহেদ আর রাহেলা ফাবিহানের বড় চাচার ছেলে মেয়ে। বড় চাচার আরো এক ছেলে আছে তার নাম শুভ। সে ঢাকায় গিয়েছে জরুরি একটা কাজে। শুভর এক ছোট মেয়ে আছে। নাম পাখি। ফাবিহানের পরিবার অনেক বড়। তিন বাড়ি তিন জনের। ফাবিহানের বাবার সম্পদ বেশি থাকায় সে তিনতলা ভবন করেছে। নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গাড়ি এসে থামে সিকদার বাড়ির সামনে। নীলার নিজের বাড়ি টাকে দেখে মনে হচ্ছে কত বছর দূরে ছিল। সে তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে শাড়িতে পা পেঁচিয়ে পড়ে। নীলা পড়তে নিলেই ফাবিহান দূই হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। নীলার দিকে রাগী দৃষ্টি তে তাকিয়ে বলে-

-” আস্তে নামবে তো।

নীলা পেছনে তাকিয়ে দেখে শাহেদ, রাহেলা, রোজা মুখ টিপে হাসছে। সে ফাবিহানের থেকে সরে যায়। বাড়ির সামনে মানুষ দেখে অবাক হয়। ফাবিহান ও বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। এত মানুষ কেন? তার মা ঠিক আছে তো? নীলা তাড়াতাড়ি করে ভবনে প্রবেশ করে। পেছন পেছন ফাবিহানরাও আসে। নীলা প্রবেশ করে যা দেখলো তাতে তার লোমকূপ পর্যন্ত হিম হয়ে যায়। নীলা আর্তচিৎকার করে বসে পড়ে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here