অমানিশার চাঁদ পর্ব -০৭

#অমানিশার_চাঁদ
#মেঘলা_আহমেদ(লেখিকা)

‌ [ ৭ ]

মাথা নত করে তার বাবা আর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফাবিহান। তার বাবা রুষ্ট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মায়ের মুখের অবস্থা স্বাভাবিক। সৈয়দ তুরাগ রেগেমেগে ছেলের দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে-

-” এসব কি শুনছি ফাবিহান? তুমি নাকি ঐ সিকদারের মেয়ের জন্য তোমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো? এসব কোন ধরনের শিক্ষা?

ফাবিহান মায়ের দিকে তাকায়। তার মা অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তার মনে হচ্ছে ছেলে তার এই মেয়ের রূপে ডুবে গেছে। শ*ত্রু বংশের মেয়েকে সে কিছুতেই মানবেনা। তার ছেলের ঐ মেয়েকে নিয়ে এত আদিখ্যেতা তার সহ্য হচ্ছে না। ছেলেকে বাঁচাতে হলে ঐ মেয়েকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করতেই হবে। ফাবিহান দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়-

-” আব্বাজান, আমি শুধু নীলাকে ওনার হাত থেকে রক্ষা করেছি। ওনার সাথে খারাপ ব্যবহার করিনি। আর করলেও বা কি? তার কৈফিয়ত আমি কাউকে দিতে বাধ্য নই!

তুরাগ ছেলের কথায় রুষ্ট হয়ে বলে-

-” তুমি কেন ঐ মেয়েকে রক্ষা করবে? আর উনি উনি করছো কেন? ভুলে যাবেনা উনি তোমার আম্মা।

ফাবিহান তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে করিমন এর দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আব্বাজান, মা হওয়ার যোগ্যতা সবার থাকেনা‌। ওনাকে সবার সামনে বাধ্য হয়ে আম্মিজান ডাকি। তাই বলে ভাববেন না মাথায় উঠিয়ে রাখবো। মা শব্দটার মানে উনি কি আদৌ জানেন আব্বাজান?

তুরাগ বুঝলেন তার ছেলে রেগে যাচ্ছে। এভাবে হলে সব হাতছাড়া হয়ে যাবে। সে কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-

-” যাই হোক তোমার মা ডাকতে হবেনা। তবে তুমি কেন করিমনের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছো? তাকে নুন্যতম সম্মানটুকু কেন দিচ্ছোনা?

-” আব্বাজান আমি একবার বলেছি তো আমি খারাপ ব্যবহার করিনি। আমি নীলাকে ওনার হাত থেকে রক্ষা করেছি। উনি মা*রছিলো মেয়েটাকে। আমি এসব সহ্য করবো না। নিয়ম মোতাবেক নীলা আমার স্ত্রী। তাই তাকে উনি মা*রতে পারবেনা।

তুরাগ সন্দেহের দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকায়। তার ছেলের মন ঘুরে গেলো না তো? যার জন্য সে এত কষ্ট করে বেশি সুন্দর মেয়েটাকে না এনে এই মেয়েটাকে আনলো। তাহলে লাভটা হলো কি। বড় মেয়েটাকেই আনা উচিত ছিল। শুধু শুধু নিজের বাড়ির মানসম্মান ও খেলো। সৈয়দ তুরাগের ছেলের বউ পালিয়েছে। শুনতেই কত সুন্দর শোনায় কথাটা। রঙচঙে গ্রামবাসী কথাটাকে আরো সুন্দর করেছে। তুরাগ এখন বুঝতে পারছে। ফাবিহাই ঠিক ছিল। কিন্তু তাঁর ছেলে ও তো নাছোড়বান্দা। এখন রাগ লাগছে, নিজের উপর। সাদিক ঠিকই বলেছিল। এখন সাদিকের কথা না শোনার জন্য কি তাকে পস্তাতে হবে? না সৈয়দ তুরাগ পস্তাবে না। দরকার পড়লে একেও সরিয়ে দেবে। তুরাগ নড়েচড়ে বসে বলল-

-” মা*রলে মা*রবে। ওকে এ বাড়িতে বউরানী করে রাখার জন্য আনা হয়নি। ওকে শুধু আমাদের কাজের জন্য এই বাড়িতে রাখা হয়েছে। তুমি ওর উপর এত সদয় কেন হচ্ছো? তুমি কি ভুলে গেলে সব কিছু? তুমি নাকি তোমার আম্মিজান কে বলেছো, তোমার বউয়ের গায়ে কেউ যেন ফুলের টোকাও না লাগায়? তুমি কি করছো এসব কায়েস? তোমার বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে? ঐ বংশের মায়ায় জড়িয়ে নিয়ো না নিজেকে‌। ওরা বি*ষধর সাপের মত। ওদের বি*ষ নিজের ইচ্ছায় গ্রহণ করো না। নিজের লক্ষ্যে ফিরে এসো।

ফাবিহান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তাদের এই লক্ষ্যের জন্যই সে আজ দোটানায় পড়েছে। এসব জানলে সে কখনোই এই সৈয়দ বাড়িতে পা রাখতো না। সে চোখ তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে-

-” আব্বাজান আমি কিছুই ভুলে যাইনি। সব কাজ আমি ঠিকমতই করবো। চাচাজান কে বলে দেবেন আমার সাথে দেখা করতে। মেয়েটাকে কোথায় রেখেছে জানতে হবে। আর রুহুল ভাইয়া কে বলেছি। সে দুটো ছেলে জোগাড় করেছে। আর একজন মহিলা দাসী নিযুক্ত করেছি। সে কাল থেকে নীলার সাথে থাকবে। আর ঘাটপাড়ে কে এসেছিল এই বিষয়টা আপনি দেখবেন। আজ ঘাটপাড়ে এসেছে, কাল ভবনে প্রবেশ করে বাড়িতে আ ক্রমণ ও করতে পারে! আর নীলা কে কেউ কিছু বলবেন না। ওকে যা করার আমি করবো। অনুরোধ ও যেনো কিছু না জানে। ও সিকদার বাড়ির মেয়ে। ভুলে যাবেন না। পরিবারের সবার মতোই ও নিজেও ধূর্ত। নিজেদের স্বার্থের জন্য হলেও ওর সাথে ভালোমানুষীর অভিনয় করুন। আশা করি আপনি আর আপনার উনি বুঝতে পেরেছেন। ওনাকে সাবধান করে দিন।

করিমন ছেলের কথায় ক্ষেপে গিয়ে বলে-

-” কায়েস! তুমি বারবার উনি উনি করতাছো কেন? আমি তোমরার মা।

ফাবিহান তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলে-

-” হয়েছে হয়েছে। আর নিজেকে আমার মা দাবী করা লাগবেনা। আমি ভালো করেই জানি আপনি আমার কি হন। আমার উপর অধিকার খাটাতে আসবেন না। আব্বাজান আমি আসি।

তুরাগ ভ্রু কুঁচকে বলে-

-” তুমি এত রাতে কোথায় যাবে?

-” আপনি জানেন আমি রাতে কোথায় যাই। তবুও কেন শুধু বাক্য ব্যয় করেন। আমি আসলেই বুঝিনা। আব্বাজান আপনি কি জানেন আপনি দিন দিন বড্ড বাঁচাল হয়ে যাচ্ছেন। কম কথা বলুন। আমাকে যেতে দিন। আর কথা বলতে ইচ্ছে করলে আপনার ওনার সাথে বলুন।

-” শোন কাল সিকদার বাড়িতে যাবে তুমি আর ঐ মেয়ে। এটা নিয়ম। সবকিছু ঠিকঠাক মিটে গেলেই নিজের মত কাজ করতে পারবে।

ফাবিহান বিরক্ত হয়ে বলে –

-” আমি জানি আব্বাজান। চুপ করুন। আমি আসছি।

তুরাগ চুপ করে রইলেন। তার ছেলেটা সবসময় কম কথা বলে। কিন্তু কাজটা ঠিকই করে। আর এবারের কাজটা ঠিকঠাক হলেই হলো। সব কিছুর বদলা নেবে। কিন্তু আসলেই কি সে দিন দিন বাঁচাল হয়ে যাচ্ছে?

ফাবিহান হাঁটতে হাঁটতে বাগানে এসে বসে। আকাশে চাঁদের দিকে তাকায়। আচ্ছা মেয়েটা কি বেশি কষ্ট পেয়েছে তার ব্যবহারে? মা এমনটা না করলেও পারতো। আগামীকাল সিকদার বাড়িতে যাবে তারা। ফাবিহান হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে বের হয়। একবার চোখ ফেলে দেখে নেয় ভবন তিনটা। নিজেদের বারান্দায় চোখ পড়তেই কারো ছায়া দেখতে পায়। আঁতকে উঠলো সে। ভবনের দোতলায় কে? দেখে কোন পুরুষ মনে হচ্ছে। ফাবিহান দ্রুত পায়ে আবারো বাড়ির ভেতর ঢোকে। লোকটা তাঁকে দেখতে পায়। দ্রুত সে বারান্দা থেকে সরে যেতে থাকে। ফাবিহান পারে না দৌড়ে ভবনে ঢোকে। কিন্তু বারান্দায় গিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। তন্ন তন্ন করে সারা ভবন খোঁজে। বাড়ির দরজাও তো খোলা নেই। সে তো সামনে থেকেই এসেছে, পেছনের দরজাও বন্ধ। লোকটা গেলো কোথায়? এতটুকু সময়ে তো সে সামনে থেকে বের হতে পারবেনা। তাহলে নিশ্চয়ই ফাবিহানের সামনে পড়তো। ফাবিহান কপাল কুঁচকে চিন্তিত মনে নিজের কক্ষে প্রবেশ করে। নীলা এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পরিধানের নীল শাড়ি সরে গিয়ে ফর্সা পেটের খানিকটা উন্মুক্ত হয়ে আছে। ফাবিহানের চোখ আটকে যায় সেদিকে। জানালাটা খোলা থাকায় খানিকটা চাঁদের আলো এসে পড়েছে কক্ষে। হারিকেনের টিমটিমে আলো আর চাঁদের আলো মিলেমিশে নীলার মুখের উপর পড়েছে। ফাবিহান নীলার দিকে তাকায়। চোখ মুখ ফুলে আছে মেয়েটার। ফর্সা গালে চ*ড়ের দাগ দুটো স্পস্ট। তবুও মায়াবী লাগছে। নীলার ছোট ছোট চুলগুলো কপালের উপর এসে পড়েছে। ফাবিহান ঝুঁকে নীলার কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলো। গায়ে পাতলা নকশিকাঁথা টা টেনে দিলো। ফাবিহান আস্তে আস্তে নীলার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে। তার ঘোর লেগে যাচ্ছে। নীলা নড়েচড়ে উঠতেই চমকে সরে যায়। নিজের উপর নিজেরই রাগ লাগছে। কেন বারবার নীলার কাছে যাচ্ছে সে। নিজেকে কেন সংযত করতে পারছেনা। সে যে ক্ষ*তিকর তার জন্য। হারিকেন টা নিভিয়ে দিয়ে বের হয়ে যায় নিজের গন্তব্যে।

#চলবে

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here