চুপকথা পর্ব -০৩

#চুপকথা
#৩য়_পর্ব

নামাজের পাটি বের করতেই জামা কাপড়ের ডিবি নিচে পরে গেল। ইস্ত্রি করা জামা কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে ভেবেই বিরক্ত হলো আরশিয়া। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার গুছাতে হল সবকিছু। তখন ই পৃথুলের শার্টের ভাঁজ থেকে একটি ছবি হাতে পড়ল। কৌতুহল মানুষের সবথেকে বড় শত্রু। সেই কৌতুহলই আবারও ক্ষত বিক্ষত করল আরশিয়াকে। কারণ ছবিটি একটি হাস্যজ্জ্বল দম্পতির যেখানের পুরুষটি এখন তার স্বামী। মুহুর্তেই বক্ষস্থলের অবশিষ্ট শান্তি গুলোকে কেউ যেন গ’লা চে’পে হ’ত্যা করলো। সেই সাথে ছড়িয়ে দিল দমবন্ধ করা তিক্ততা। যে সম্পর্কের ইতি বছর চারেক পূর্বেই টানা হয়েছে সেই সম্পর্কের স্মৃতি বয়ে বেড়ানোর অর্থটা বোধগম্য হল না৷ অভিমানের পাহাড় ভারী হল। পৃথুলের প্রতি যে বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে তা মোটেই ঘৃণা নয়। পৃথুল নামক মানুষটিকে সে মোটেই ঘৃণা করে না। যাকে স্বযত্নে আলতো হাতে মনমন্দিরে স্থান দেওয়া হয় তাকে হুট করেই ঘৃণা করা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে তার প্রতি যা সৃষ্টি হয় তা হল অভিমান। আরশিয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, সে অভিমান জমিয়ে রেখেছে পৃথুলের প্রতি। এবং তার জানা আত্মদাম্ভিক আরশিয়ার অভিমান কতটা জোড়ালো। তাই তো একশত দিনের এই শর্ত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে সে। এই অভিমানের দূর্গ ভাঙার নয়, বরং দিনকে দিন তার প্রাচীর শক্ত হবে। আর ভেতরে সঞ্চিত প্রণয়ফুলটি অচিরেই মূর্ছা যাবে।

আরশিয়া এখন সেই ছবিখানা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশ ঘটল পৃথুলের। ঘর্মাক্ত শরীরে কালো টিশার্টটি লেপ্টে আছে। ঘামে সিক্ত চুলগুলো অবহেলিত ভাবে পরে আছে কপালের উপর। চোখে ক্লান্তি। উদাসীন চোখজোড়া সারা ঘর একবার দৃষ্টিপাত করে আটকে গেল আলমারীর সম্মুখে। মেঝেতে অগোছালো কাপড়, এবং স্থির আরশিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হল সে। মৃদু স্বরে বলল,
“জায়গা কি কম হয়ে গেছে”

আরশিয়ার চিন্তায় ব্যাঘাত হানল পৃথুলের গাঢ় কন্ঠ। কাতর নয়নে চাইল সে। সে পেছনে ঘুরতেই পৃথুলের নজর গেল তার হাতে থাকা ছবিটির দিকে। মুহূর্তেই মুখের রঙ পালটে গেল। ভ্রূজোড়া কুঞ্চিত হল নিমিষেই। মুখে বিরক্তির রেখা অঙ্কিত হল। ছো মেরে হাত থেকে ছবিখানা নিয়ে নিল সে। রুক্ষ স্বরে বলল,
“আমি তো আপনাকে আলাদা থাক দিয়েছি, তবুও কেন আমার জিনিসে হাত দিতে হবে? যদি জায়গা কম পরে তবে বলবেন আমি ব্যবস্থা করব”

আরশিয়ার হৃদয়খানা আরোও একবার চূর্ণ বিচূর্ণ হল। খানিকটা জেদ ও চাপলো মস্তিষ্কে। বরফ শীতল স্বরে বলল,
“যে জীবনে নেই তার স্মৃতি এত আগলে রাখার মানে বুঝলাম না। যদি এতটাই আবেগ এখনও অবশিষ্ট থেকে থাকে তবে আমার জীবনে প্রবেশের কি মানে?”

পৃথুল উত্তর হাতড়াল। তার কাছে সত্যি ই উত্তর নেই। আরশিয়া তো ভুল প্রশ্ন করে নি। এত বছর পর এই একটি ছেড়া স্মৃতি কেন স্বযত্নে রেখেছে সে! তার মৌনতা কাঁটার মত চুবল আরশিয়ার ব্যথিত হৃদয়ে। ফলে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাল সে। বেশ জোড়ালো স্বরে বলল,
“আপনার মত নিখুঁত অভিনেতা, জন্মে দেখিনি”

কথাটা বলেই তীব্র বেগে পা চালিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো আরশিয়া। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, চোখজোড়া জ্বলছে। আকাশ পাতাল উজার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই লোকটির সম্মুখে সে কাঁদবে না। তাহলে নিজের কাছেই হেরে যাবে সে। পৃথুল এখন দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে ছবিখানা। নিলীন চোখে একবার দেখল ছবিটা। ছবিটায় সে হাসছে। প্রাণচ্ছ্বল, মনখোলা হাসি। শেষ কবে এমন হেসেছে নিজের ও জানা নেই_________

*********

পৃথুলদের বাসাটা বড্ড পুরোনো। আশির দশকে তার দাদা এই বাড়ি নির্মাণ করেন। বাসাটা তিনতালা। সর্বোচ্চ তালায় থাকে পৃথুলরা, দোতালায় বড়চাচারা এবং নিচতালায় থাকতো ছোট চাচা। এখন ছোট চাচা এবং তার পরিবার দেশের বাহিরে। পুরোনো ধাচের বাসা হওয়ায় রুম গুলো বিশাল বড় বড়। বিশাল ঝুলানো বারান্দাও রয়েছে। পৃথুল যেহেতু সুমী বেগমের একমাত্র পুত্র তাই এই বিশাল বাসায় মাত্র চারটে প্রাণের বাস। আরশিয়া, পৃথুল, সুমীবেগম এবং কাজের মেয়ে কোহিনূর। আরশিয়ার প্রথম দিনেই বোঝা হয়ে গেছে কোহিনূর মেয়েটি বড্ড বেশি বাঁচাল। এক মুহূর্ত তার মুখখানা বন্ধ থাকে না। এতে অবশ্য সুমী বেগমের তেমন ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি হয়ত অভ্যস্ত। রান্নাঘরের দিকে যেতেই কোহিনূরের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ কানে এল আরশিয়ার। সুমী বেগম ভাজি বানাচ্ছেন এবং সে পরোটা। পরোটা বেলতে বেলতে সে বলছে,
“নতুন ভাবি হেব্বি সুন্দর কাকি, আমার সেই লাগছে। কি সুন্দর হাসে! আগেরটা ঘোমড়া ছেল, কত্ত দেমাগ। বড ঘরের বেটি আনলে এমন ই হয়। এই জন্যই তো বারো ভা/তা/ড়ির মত চোদ্দ জায়াগায় মুখ দেয়”
“ভাষা ঠিক কর কোহিনূর”
“কে গো কাকি, হে করতে পারে। আর আমি কইতে পারি না”

এরমধ্যেই রান্নাঘরে প্রবেশ করলো আরশিয়া। তাকে দেখতেই কোহিনূর থেমে গেল। আরশিয়া খানিকটা বিব্রত ও হল। হয়ত অসময়ে তার আগমণ ঘটেছে। সুমী বেগম ভাজিটায় ঢাকা নিয়ে বলল,
“তুমি উঠে গেছো আরশিয়া?”
“জি আন্টি”
“সেকি আন্টি বলছো কেন? আমি কিন্তু এখন তোমার আন্টি নই”

মহিলা অত্যন্ত আদুরে কণ্ঠে কথাখানা বলল। আরশিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়াল। সুমী বেগম আলতো হাতে আরশিয়ার হাতজোড়া নিজ হাতে নিল। তারপর উচ্ছ্বাসিত স্বরে বলল,
“তুমি জানো না মা, আমি কতটা নিশ্চিন্ত এখন। তোমার বাবা যখন বলছিলেন বিয়েটা ভেঙে দিবেন আমি খুব চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনে একটা বিশ্বাস ছিল তুমি আমাকে হতাশ করবে না। ঠিক তাই হল। আসলে আমার ছেলেটা চাপা স্বভাবের। হাজারো দুঃখ বুকে চেপে রাখলেও টু শব্দটি করে না। সর্বনাশী গেল তো গেল, আমার ছেলেটিকে শেষ করে গেল। এখন শুধু ভাঙাচুরা পৃথুলটা রয়ে গেছে। সে বেঁচে তো আছে কিন্তু তার মাঝে জীবিত সত্তাটি নেই। আমার তোমার আছে একটি ই আবদার, আমার ছেলেটিকে এই নির্জীব দশা থেকে মুক্তি দাও। আমি জানি তুমি পারবে“

সুমী বেগমের প্রত্যাশিত মুখখানা দেখে অজান্তেই বেশ অপরাধবোধ হল আরশিয়ার। মহিলাটির আশাভঙ করতে ইচ্ছে হল না। তার তো জানা নেই, আরশিয়া এখানে চিরদিন থাকবে না। আর মাত্র নিরানববই দিন বাকি______

*******

মাথার উপর চৈত্রের খরা রোদ্দুর, আকাশে ছেয়ে আছে সাদা মেঘরাজি। বাতাসে বসন্তের শেষ গান। দমকা হাওয়ায় উড়ছে আত্মিকার কোকড়া চুল। অবিন্যস্ত হয়ে মুখের উপর আছড়ে পরছে বারংবার। ঘাম গড়িয়ে পড়েছে শ্বেত ঘাড় বেয়ে। ফলে প্রচন্ড বিরক্ত সে। মধ্যাহ্নের সময় রিক্সা পাওয়া যেন প্রতিযোগিতা। ক্লান্ত পা জোড়া চলতে চাইছে। কিন্তু নিরুপায় সে। বাসায় যেতে হবে, বাবা কাল থেলে হরতালে আছেন। আরশিয়ার সাথে তিনি সম্পর্ক ছিন্ন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আর সেই অভিমান আত্নিকা এবং আনহার উপর ই জাহির করছেন। কিন্তু মুল দোষী যে তাকে কিছুই বলা হচ্ছে না। এতেই বিরক্ত লাগছে আত্নিকার। বাবা সর্বদা এমন ই করেন, দূর্বলের উপর জোর দেখান। অথচ সবলের সামনে মূর্ছা যান। ভাবতেই বক্ষস্থলের দীর্ঘশ্বাসটা মুক্তি দিল সে। পিচের রাস্তায় পা এগুতে চাইছে না একটা রিক্সা পেলে মন্দ হত না। তখন ই আলাদিনের চেরাগের জ্বিনের মত রিক্সা নিয়ে হাজির হল এক শৌম্য যুবক। গাঢ় স্বরে বলল,
“বেয়ান, রিক্সায় উঠুন”

কথাটা শুনতেই চোখ কুচকে গেল আত্নিকার। কপালে পড়লো প্রগাঢ় ভাঁজ। ছেলেটিকে চিনে সে। পৃথুলের বড় চাচার ছোট ছেলে। ছেলেটির নাম রাইয়ান। আশ্চর্যজনক ভাবে ছেলেটি তার সমবয়সী। সেই বিয়ে থেকে দেখছে তার যেন আত্নিকার প্রতি অতি দরদ। বেয়ান, বেয়ান করে মাথা খাচ্ছে, অনেকটা গায়ে পরা স্বভাবের। যা আত্নিকাকে একটু হলেও বিব্রত করছে। আত্নিকাকে মৌন থাকতে দেখে রাইয়ান আবারো বলল,
“কি হল, উঠুন। বাড়ি পৌছে দিচ্ছি। আমি ওদিকেই যাব”

ছেলেটি কি অতি ভালো মানুষ নাকি এ সব ই তার ছ্যাচড়ামি; ধরতে পারছে না আত্মিকা। ফলে এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। তাই বিনয়ের সহিত বলল,
“না না, সমস্য নেই। আপনি যান”
“সমস্যা নেই কি করে, আপনি হচ্ছেন ভাবির ছোট বোন। আমার একমাত্র বেয়ান। আপনার ভালো মন্দ দেখা তো আমার দায়িত্ব। আর আমি ওদিকেই যাচ্ছি। একসাথে গেলে খুব একটা মন্দ হবে না, যদি আপনার আপত্তি না থাকে। এই সময় রিক্সা পাবেন না যদিও।“

আত্নিকা কিঞ্চিত চিন্তায় পড়ে গেল। অনেক সাতপাঁচ ভেবে অবশেষে রিক্সায় উঠল সে। রাইয়ান সরে গিয়ে যথেষ্ট জায়গা দিল তাকে। অবশেষে রিক্সা যাত্রা শুরু করল তার গন্তব্যে।

আত্নিকাকে ঠিক তার বাসার গেটে নামিয়ে দিল রাইয়ান। আত্নিকা কৃতজ্ঞতার সাথে তাকে বলল,
“ধন্যবাদ”
“মুখে ধন্যবাদ আমি নিচ্ছি না”

দুষ্টুমি মিশ্রিত কণ্ঠে কথাটা বলল রাইয়ান। ফলে আত্নিকার ভ্রুকঞ্চিত হল। অবাক স্বরে বলল,
“মানে?”
“মানে শুধু মুখে চিড়া ভিজে না। ধন্যবাদটা যদি কফিতে মিশিয়ে দেন তবে নিতে পারি”

রাইয়ানের ইঙ্গিত বুঝতে বাকি রইল না আত্নিকার। সে খিলখিল করে হেসে উঠল। তারপর বলল,
“ভেবে দেখব”

বলেই ভেতরের দিকে পা বাড়াল আত্নিকা। রাইয়ানের ঠোঁটে হাসির প্রলেপ। দূর্বোধ্য সেই হাসি। রিক্সাচালককে বলল,
“যেখান থেকে এনেছ, সেখানেই চল মামা”

********

বিকালের আকাশে বিক্ষিপ্ত কমলা রঙ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সাথে মিশে আছে অব্যক্ত কিছু গল্প। বাতাসে মনখারাপের বিষন্নতা। বাগানবিলাসী ফুলে ঘেরা বারান্দায় হাটু গেড়ে বসে আছে আরশিয়া। তার মুক্তকেশ গড়াগড়ি খাচ্ছে মেঝেতে। হঠাৎ একটি ধোঁয়া তোলা চায়ের কাপ রাখা হল তার ঠিক সামনে। আরশিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইতেই দেখল পৃথুল পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ভারি অভিমান তার আবেগগুলো শক্ত হস্তে দমন করল। নয়ত, স্বামী তার জন্য চা বানিয়ে আনবে এটা এক সময়ের ইচ্ছের ঝুলির সবচেয়ে প্রথম ইচ্ছে ছিল। আরশিয়া নিজের অভিমান গুনতে ব্যস্ত তখন কানে এলো গাঢ় কণ্ঠ,
“আমি ছবিটি তার স্মৃতি আগলে রাখতে স্বযত্নে রাখি নি। রেখেছি সেই স্মৃতিগুলোয় আমার দোষটি কোথায় ছিল সেটা খোঁজার জন্য………

চলবে?

[পেজের রিচ ডাউন। সকলের রেসপন্স কামনা করছি। আপনাদের রেসপন্স আমার জন্য শক্তি রূপে কাজ করবে। তাই অনুরোধ রইলো। গল্পটি ফিডে গেলে রেসপন্স করবেন]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here