চড়ুই সংসার, পর্ব:৩

#চড়ুই_সংসার

____________
কোচিং-এ ভর্তি হবার বেশ কিছুদিন পর একজন নতুন মানুষের আগমন ঘটলো আমার জীবনে। যার নাম ইনতিসার ইলহাম। সেজ্যোতির সেই জ্যাঠাতো ভাই। স্পেশালি আমার জীবনে কেন বলছি তা বুঝতে পারবেন একটু পর।
মূলত সে আমাদের কোচিং-এ ইংলিশ টিচার হিসেবে জয়েন করেছিল। সেজ্যোতির মুখে শুনেছি সম্প্রতি তার চাকরি চলে যাওয়ায় একটা লং টাইমের ছুটি নিয়ে এসেছেন গ্রামে। ফেরার সম্ভাবনা বেশি একটা বোধহয় নেই। আবার গ্রামে নাকি পোল্ট্রি ফার্ম দেবার চিন্তাভাবনাও করছে।
কিন্তু বাড়ি থেকে তেমন সায় নেই। সবাই চায় সে ঢাকায় ফিরে আবারও কোনো চাকরি শুরু করুক। শিক্ষিত একটা ছেলে, নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসে কি-না পোল্ট্রি ফার্ম করবে? কিন্তু সে পরিবারকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজের পরিকল্পনাগুলো। কতটুকু সফল হবে জানেনা।
ততদিন বাড়িতে বেকার বসে থাকার চাইতে কোনো কাজের মধ্যে ব্যস্ত থাকাটাকে ভালো মনে করলো। ওদিকে আমাদের কোচিং-এও আর্জেন্ট একজন ইংলিশ টিচারের প্রয়োজন ছিল। সেজ্যোতি যখন তাকে এ ব্যাপারে অবগত করলো তখন সে দ্বিতীয়বার না ভেবে এখানেই জয়েন হয়ে গেল । এটাতে কোনো সমস্যা ছিলনা আমার। সমস্যা তৈরি হলো এরপর। ততদিনে ক্লাসে অন্যসব প্রথম সারির স্টুডেন্টদের মধ্যে আমার নামটাও ভাগ্যক্রমে জায়গা পেয়ে গেছে। সব টিচারদের নজরে এসে গেছি আমি। আমায় নিয়ে তাদের এক্সপেকটেশন তৈরি হয়েছে।
টিচারদের মুখে মুখে আমার নাম শুনতে শুনতে তারও হয়তোবা আমায় নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তাই সে আমায় পরীক্ষা করার চিন্তাভাবনা করলো। দেখা গেল ক্লাসে আসলে শুধু আমায় পড়া ধরছে,কোনো টপিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে বলছে। আমি ইংলিশের ওপর ভালোই জোর দিয়েছিলাম। তাই আটকাতাম না। পরপর কয়েকটা ক্লাসে তার মনপুত হবার পর সে আমার নাম দিয়ে দিলো “স্টুডেন্ট নম্বর ওয়ান”
এবং নিজের দেয়া নামখানা সগৌরবে প্রচার করে দিলো অন্য টিচারদের মাঝে।
তারপর থেকে যে টিচারই ক্লাসে আসে সে-ই আমায় ডাকে “এই স্টুডেন্ট নম্বর ওয়ান দাঁড়াও তো। তুমি পড়া বলো”
এভাবে টিচারদের মুখে প্রচার হতে হতে ক্লাসমেটরা এই নাম পেয়ে গেল। আমার নাম তখন প্রজ্ঞা থেকে ডিরেক্ট হয়ে গেল “স্টুডেন্ট নম্বর ওয়ান”
যে-ই যেখানে দেখে ওখানেই ডেকে ওঠে “আরে স্টুডেন্ট নম্বর ওয়ান তুমি এখানে? আচ্ছা আমাকে একটু এইটা বোঝায় দাও তো..”
ওদের সম্বোধনে আমার কেন যেন বিরক্ত লাগে। মনে হয় তাচ্ছিল্য করে বলছে। এমন মনে হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আমি জানিনা। শুধু জানি বিরক্ত লাগে। কিছু বলতেও পারিনা আর না পারি সইতে।
তার মাঝে হলো কি, অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং খাওয়াদাওয়ার অনিয়মের ফলে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লাম কোচিং-এ। সেদিন ছিল ইংলিশ পরীক্ষা। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পনেরো কি বিশ মিনিট পর হঠাৎ মাথা ঘুরতে শুরু করলো আমার, তারপর অজ্ঞান। সবাই তো আমায় দেখে হতভম্ব।ইনতিসার ভাইয়ের ডিউটি ছিল পাশের রুমেই। বন্ধুদের চিল্লাচিল্লি শুনে অন্য টিচারদের সাথে সেও ছুটে এলো। পরে তাড়াহুড়ো করে চার পাঁচজন ধরাধরি করে নিয়ে গেল হাসপাতাল। স্যালাইন লাগানো হলো। ডাক্তার বললেন, প্রেশার ফল করেছে আর শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে কোনো অনিয়ম নয়। গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলতে চাইছিলেন; টিচাররাও ফোন করবে বাড়িতে, আমি খুব রিকোয়েস্ট করে তাদের আটকালাম। এমনিতেই কম প্রেশারে থাকতে হয়না আব্বাকে। তার ওপর যদি আমার অসুস্থতার কথা শোনেন তাহলে ভেঙে পড়বেন। এই বয়সে এসে ওনাকে এত টেনশন দেয়া কি শোভা পায়!
কিন্তু ডাক্তার সাহেব গার্ডিয়ান ছাড়া কথা বলবেন না। এমন সময় আমাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলো ইনতিসার ভাই। সে গার্ডিয়ান হয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলল। ডাক্তার আমার খাওয়াদাওয়ার একটা রাফ রুটিন এবং প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র লিখে দিলেন। প্রেসক্রিপশনে অত বড় বড় ঔষধের নাম দেখে আমার মুখটা ছোটো হয়ে গেল। ঔষধ কেনবার মত টাকা তো আমার কাছে নেই। বেখেয়ালে প্রেসক্রিপশনে চোখ বুলচ্ছিলাম, ইনতিসার ভাই হঠাৎ আমার হাত থেকে প্রেসক্রিপশনটা টেনে নিলেন। ওতে নজর বোলাতে বোলাতে বললেন,
— ঔষধপত্র নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবেনা। আমার এক পরিচিত বড় ভাইয়ের ঔষধের দোকান আছে হাসপাতালের সামনে। সেখানে থেকেই এগুলো চলে আসবে।
— কিন্তু আমার কাছে তো..
— আমি কিনে দেবোনে সমস্যা নাই।
হালকা হেসে বললেন উনি। আমি সংকোচ করে বললাম,
— আপনি কীভাবে! মানে..
— বললাম তো আমি কিনে দিবো । এত সংকোচ কেন? সেজ্যোতির বন্ধু তুমি। মানে আমার কাছের মানুষই তো হলে। কাছের মানুষদের সাহায্য করবো না তো কাকে করবো! তাছাড়াও স্কুলজীবনে তোমার বাবা আমার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন। তার মেয়ে তুমি। তোমার বিপদে সাহায্য করবো না তো কার করবো!
ইনতিসার ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমি অশ্রুসজল হয়ে উঠলাম। ওনার জন্য সম্মানটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল মনে। তবে তখনও কিন্তু আমি আন্দাজ করতে পারিনি ওনার “কাছের মানুষ” শব্দটার দ্বিতীয় এবং গভীর কোনো অর্থ থাকতে পারে!
_________
আমার অসুস্থতার ছুতোয় নাকি অন্যকোনো কারণে ওনার বিশেষ দৃষ্টি পড়লো আমার ওপর। ভালোই খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। রাস্তা-ঘাটে কিংবা ক্লাসে। ওনার এই বিশেষ দৃষ্টি আমি ছাড়াও ক্লাসের সবাই উপলব্ধি করতে পারলো। কি চিন্তা খেলা করলো তাদের মাথায় জানা নেই। কিন্তু এরপর থেকে ওদের আচরণ খানিক পাল্টে গেল। দেখা গেল ইনতিসার ভাইয়ের ক্লাসের ডেট পড়লে সবাই রসিকতার ছলে আমায় জিজ্ঞেস করছে, “কি ইংলিশ স্যারের স্পেশাল স্টুডেন্ট পড়া হয়েছে আজ? তোমার তো মনে হয় প্রিপারেশন খুব ভালো। এডমিশনে টপ করবা তাইনা? দেখো আবার বোর্ডই ফুটো করে দিও না” এসব বলে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে লুটিয়ে পড়ে। তারপর ইনতিসার ভাইয়ের ক্লাস চলাকালীন মুখ চেপে হাসে আর একবার আমার দিকে একবার ওনার দিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে। একদিন তো কে যেন হোয়াইট বোর্ডে লিখেও ফেলল ” E+P” P এর পাশে ব্র্যাকেটে ছোট্টো করে লেখা (স্টুডেন্ট নম্বর ওয়ান) এর মানে একটাই দাঁড়ায় ইনতিসার+প্রজ্ঞা। ওদের এসব বালখিল্যতা দেখে আমি ভীষণ কষ্ট পেলাম। এবারে আর সহ্য হলোনা । লজ্জায় কেঁদে ফেললাম। একটা নরমাল ছাত্রী-শিক্ষকের সম্পর্ককে এরা কি বানিয়ে দিচ্ছে!
ইনতিসার ভাইও এসব লক্ষ্য করে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। তাকে আর বিব্রত না করতে পরবর্তী দু’দিন আমি কোচিং-এ গেলাম না। মা আমায় কোচিং-এ না যেতে দেখে নানারকম প্রশ্ন করলেন। তার কোনো সঠিক উত্তর আমি দিতে পারলাম না।
পরপর দু’দিন লাম-ছাম বাহানায় কোচিং মিস করলেও তৃতীয় দিন সেজ্যোতিকে ফেরানো সম্ভব হলো না। ও আমায় নিয়ে যাবেই যাবে। হয় আজ যেতে হবে নয়তো কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দর্শাতে হবে কেন যাচ্ছিনা।
শেষে ওর জিদের কাছে হার মেনে বাধ্য হয়ে সবটা বললাম। ও মন খারাপ করে বলল, “এগুলো কোনো কথা! এই তুচ্ছ কারণে তুই কোচিং বাদ দিবি? ইংলিশ ক্লাসে সমস্যা নাহয় করলিনা ইংলিশ। বাকি সাবজেক্টগুলো কর”
আমি বললাম,
— ইংলিশ বাদ দেয়া সম্ভব তুই বল? এটাই তো সবচাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য।
— একেবারে তো বাদ দিতে বলতেছি না। কোচিং-এ বাদ দে। কিন্তু বাসায় পড় প্রাইভেট আকারে।
— প্রাইভেটই যদি পড়বো তাহলে কোচিং-এ ভর্তি হলাম কেন! আর এখন কি সম্ভব প্রাইভেট পড়া?
— সম্ভব না কেন? যার কাছে কোচিং-এ পড়তাম তার কাছেই প্রাইভেট পড়বো। পড়া একই থাকতেছে। বরং আরও ভালো করে শিখতে পারতেছি আমরা।
— মানে ইনতিসার ভাইয়ের কাছে?
— হুম।
— বাজে আইডিয়া। ওনাকে নিয়েই তো সমস্যা আবার ওনার কাছেই পড়বো! এগুলা কেমন কথা?
— তাহলে তোর জন্য কি স্পেশাল টিচারের ব্যবস্থা করবে কোচিং?
— না না ওনার কাছে পড়তে পারবো না৷ তারচেয়ে কোচিংটাই বাদ দেই।
— যেজন্য এত কষ্ট করতেছিস সেটাই বাদ দিবি? সেটা খুব ভালো হবে তোর জন্য?
ও খানিক রেগে গেল। আমি অসহায় গলায় বললাম,
— কিন্তু সমস্যা তো ওনাকে ঘিরেই।
— সমস্যার সৃষ্টি করতেছে তোর ক্লাসের ছেলেমেয়েরা। হয় ক্লাসে কান বন্ধ করে নিজের কাজ করে যা, নয়তো আমার প্রস্তাবটা মেনে নে।
— আচ্ছা আজকে কোচিং-এ গিয়ে দেখি কি হয়।
— হ্যাঁ চল। দেখ সবার কথা অগ্রাহ্য করে ক্লাস করতে পারিস কি-না। নাহলে আমার কথা মানতে হবে।
— আচ্ছা মানবো।

সেদিন তৈরি হয়ে কোচিং-এ গেলাম। দু’দিন বাদে আমাকে ক্লাসে দেখে সবাই যেন আরও সুযোগ পেয়ে গেল কথা বলার। যদিওবা ইনতিসার ভাইয়ের ক্লাস ছিলনা কিন্তু ওদের কথাবার্তা ঠিক হজম করতে পারলাম না।
ফেরার সময় ভাবছিলাম সেজ্যোতির কথাই মেনে নিতে হবে। কিন্তু টাইম মেইনটেইন কি হবে?
অর্ধেক বেলা টিউশন করিয়ে বাকি বেলা কোচিং তারপর দীর্ঘ সময়ের একটা জার্নি শেষে এমনিতেই শরীরের অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। এত এত ব্যস্ততা শেষে আবার আলাদা করে প্রাইভেট! নিজে পড়ার সময় থাকবেনা।
কিন্তু সেজ্যোতি নাছোড়বান্দা। আবার আমারও তো লাগবে। দোটানায় পড়ে গেলাম।
সেজ্যোতি আমার সংশয় দূর করতে বোঝালো, “ইনতিসার ভাই শিক্ষক হিসেবে বেশ ভালো। বাড়ির মানুষ জন্য উনি আমাদের আরেকটু যত্ন নিয়ে পড়াবেন। আর তার কাছে পড়া বাবদ অতিরিক্ত কোনো টাকাও দিতে হবেনা।”
ওর কথা শুনে বললাম,
— বাসায় জানিয়ে দেখি।
সেদিন সিদ্ধান্ত পেন্ডিং রইলো। একা একা চিন্তাভাবনা করে কোনো কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। পরে আব্বাকে জানালাম ব্যাপারটা। আব্বা বললেন যদি উপকার হয় তাহলে পড়বেনা কেন? অবশ্যই পড়ো।
আব্বার সায় দেখে আমিও আর না করতে পারলাম না। পরদিন সন্ধ্যা থেকে আমাদের প্রাইভেট পড়া শুরু হলো।
পড়তে গিয়ে ইনতিসার ভাইকে দেখে আমি অবাক। কোচিং-এর ক্লাসমেটদের জন্য যে একটা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তা যেন ভুলেই গেছেন উনি। একদম স্বাভাবিক আচরণ করলেন আমার সামনে। আমি ভাবলাম নাহ্ ভালোই হয়েছে, ওসব মনে রাখলে অযথা ওনার সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে যেত। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে পূর্বের মত হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নিয়তি যে আমার জন্য অন্যকিছু ভেবে রেখেছিল তা কি আমি জানতাম?
আমাদের এডমিশনের আছে আর কম করে মনে হয় তিন সপ্তাহ। রুদ্ধশ্বাসে পড়াশোনা করছি আমি। কোনোদিকে তাকানোর সময় নেই। সেই সময় হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা সেজ্যোতি ছুটতে ছুটতে আমাদের বাড়ি এলো। বিকেলে নাকি ওকে দেখতে ছেলেপক্ষ আসবে। অসময়ে এসব কথা শুনে ভীষণ বিরক্তবোধ করলাম আমি। ক’দিন বাদে ওর পরীক্ষা , এটা কোনো সময় হলো দেখতে আসার? কিন্তু এখন বিরক্ত হয়ে লাভ কি!
ও আমায় ওর পাশে থাকতে বলল। আমি যেন গ্যারাকলে ফেঁসে গেলাম। কিছু বলতে পারলাম না কারণ সময়ে অসময়ে অনেক হেল্প করেছে ও আমাকে। তীব্র অনিচ্ছায় উঠে গেলাম ওর সাথে। ওর মা’কে দু একটা কাজে সাহায্য করে ওকে তৈরি করে দিলাম। ইনতিসার ভাইও দেখি ছুটতে ছুটতে অনেক কাজ করছে। তার ওপরও একটা বিরক্তিভাব চলে এলো আমার। শিক্ষিত মানুষ সে বোঝেনা কোনটা ভালো কোনটা মন্দ? নিষেধ করতে পারলো না চাচাকে?
কিছু বললাম না। মুখ তেঁতো করে থেকে গেলাম ওখানে। কাঙ্ক্ষিত সময়ে ছেলেপক্ষ চলে এলো। সেজ্যোতিকে সামনে পাঠিয়ে আমি ঘরে বসে রইলাম। আধঘন্টা-একঘন্টা কথা বলল ওনারা। তারপর খাওয়াদাওয়ার পালা। চাচি আবেগি হয়ে দুপুরের ভারী খাবারের আয়োজনও করে ফেলেছেন। অসময়ে ভাত খাবেনা বলে যদিওবা না-না করছিলো ছেলেপক্ষের লোকেরা তবুও চাচি তাদের ছাড়বে কেন?
বসিয়ে দেয়া হলো টেবিলে। সেই সময় আমার ডাক পড়লো। চাচিকে হাতে হাতে একটু সাহায্য করতে। দাঁতে দাঁত চেপে আমি বেরুলাম ঘর ছেড়ে। না পারছি কিছু বলতে আর না পারছি সইতে।
কিন্তু আমার বেরুনোটাই যেন কাল হয়ে গেল। আমায় দেখে ছেলেপক্ষের একজন বয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করলেন আমার সম্পর্কে। চাচি আমার পরিচয় দিলো খুশি মনে। ভদ্রমহিলা শুনতে শুনতে চট করে বলে বসলেন কি, আমায় দেখে ওনার পছন্দ হয়েছে। ওনার বোনের ছেলের জন্য আমাকে চান পাত্রী হিসেবে।
একথা শুনে আমার মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙে পড়লো। চোখ দু’খানা আলুর সাইজ করে আমি সেজ্যোতির দিকে তাকালাম। সেজ্যোতিও হতভম্ব। এ কি কথা!
আমাদের হতভম্বতা বেশিক্ষণ রইলো না। ভদ্রমহিলা আমার হাত ধরে টেনে তার পাশে দাঁড় করালেন। তারপর হাসিমুখে আমার পুরো বায়োডাটা শুনে নিলেন। আমার ওনার সাথে কথা বলার মুহুর্তে আগমন ঘটলো ইনতিসার ভাইয়ের। ভদ্রমহিলার সাথে আমাকে কথা বলতে দেখে তার ভ্রু জোড়ায় খানিক কুঞ্চন পড়লো। কৌতূহলী হয়ে সে সেজ্যোতিকে বোধহয় প্রশ্ন করেছিল। সেজ্যোতির মুখে কথার সারমর্ম শুনে তার চোখ জোড়াও বড় বড় হয়ে গেল। অকস্মাৎ সে মৃদু চিৎকার দিয়ে বলল,
— প্রজ্ঞার বিয়ে হতে পারেনা। ওর তো অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক।
তার এমন অদ্ভুত কথা শুনে আমি সহ উপস্থিত সকলের মুখ থেকে সমস্বরে বেরিয়ে এলো, “কিহ্”
ইনতিসার ভাই তড়িঘড়ি করে আমার হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলল,
— হ..হ্যাঁ হ্যাঁ। চাচি প্রজ্ঞার তো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে এক জায়গায়। ও আপনার বোনের ছেলের পাত্রী হবে কীভাবে? তাইনা প্রজ্ঞা?
দাঁত বের করে হেসে আমার দিকে তাকালো। আমি বোকার মত মাথা নাড়লাম।
আমার সম্মতি দেখে ভদ্রমহিলার মন খারাপ হয়ে গেল। চাচিও আবার সম্মতিসূচক দু একটা কথা বলে আমাদের ঘরে পাঠিয়ে দিলেন৷ আমি বুঝলাম পরিস্থিতি সামলাতে ওনার এই বুদ্ধি। আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ইনতিসার ভাইয়ের থেকে হাত ছাড়িয়ে একপ্রকার ছুটে বেরিয়ে এলাম বাইরে। সেজ্যোতিও এলো আমার পিছু পিছু।
ওকে দেখে বললাম,
— আমার বিয়ে ঠিক আর আমিই জানিনা?
সেজ্যোতি মৃদু হাসলো। তারপর খানিক চুপ থেকে বলল,
— প্রজ্ঞা বল তো ভাইয়া আজ এমন কেন করলো?
— সেটা তো আমিও ভাবছি। ভাই হঠাৎ এমন করলো কেন?
— তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস না?
— কি বুঝবো?
আমাদের কথার মাঝেই ইনতিসার ভাই চলে আসলো। সেজ্যোতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
— তোকে ভেতরে ডাকে।
সেজ্যোতির আর আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়া হলো না৷ ও একবার আমার দিকে, একবার ইনতিসার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
— ও মনে হয় এখন বাড়িতে যাবে। তুমি একটু পৌঁছায় দেও ওকে। আমি খাবার প্যাকেট করে দিতেছি।
আমি না করতে যাবো কিন্তু সেজ্যোতি শুনলো না। দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
আমি বিচলিত হয়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলাম ইনতিসার ভাইয়ের সামনে। খানিক পূর্বে সে আমার যে হাতটা ধরেছিল সে হাতে তার স্পর্শ এখনও অনুভব করতে পারছি মনে হলো। কিন্তু এমনটা মনে হওয়ার কারণ জানিনা।

খানিক পরেই দু পট খাবার নিয়ে উপস্থিত হলো সেজ্যোতি। আমাকে বিদায় দিতে দিতে বলল,
— কাল কথা হবে।
আমি মাথা নেড়ে ইনতিসার ভাইয়ের সাথে হাঁটা ধরলাম। যদিও তার সাথে যাওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু সেজ্যোতির কথা ফেলতে পারলাম না।
অনেকটা নিঃশব্দেই হেঁটে চলে এলাম বাড়ি পর্যন্ত। বাড়ির কাছাকাছি আসার পর নিজে থেকে বললাম,
— আপনি এখানে থেকেই ফিরে যান ইনতিসার ভাই। পাড়া প্রতিবেশী দেখলে আবার খারাপ মনে করবে।
— করবে না। তুমি চিন্তা করোনা প্রজ্ঞা।
— তবুও..
— আচ্ছা তুমি না চাইলে আর এগোবো না। যাও বাড়িতে ঢোকো তারপর আমি চলে যাচ্ছি।
— আচ্ছা ।
বলে আমি দু কদম এগুলাম। কি মনে করে থেমে পিছু ঘুরে বললাম,
— আমাকে তখন ঐ পরিস্থিতি থেকে বের করার জন্য থ্যাঙ্কিউ।
— থ্যাঙ্কিউ দিতে হবেনা প্রজ্ঞা। আমি তোমায় হেল্প করেছি নিজের জন্যই।
— মানে?
— মানেটা আশা করি দ্রুতই বুঝে যাবে তুমি।
হালকা হেসে বলল সে। আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকলাম। আর কোনো উত্তর পাওয়া যাবেনা বোঝাই যাচ্ছে। তাছাড়া আমিই বা আর কি প্রশ্ন করবো! খুঁজে পেলাম না। শেষে অমন হতভম্বতা নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলাম।
ইনতিসার ভাইয়ের এসব আচরণ অন্যকিছুর দিকে ইশারা করছে। তার মানে কি আমার ক্লাসমেটদের ভুল ধারণা সত্যি হয়ে যাবে? তার মনে আমাকে নিয়ে আসলেই কোনো অনুভূতি আছে! বিষয়টা ভাবনাতেই বেশ অপ্রস্তুত করে তুললো আমাকে।
সেদিন রাতে আর পড়া হলোনা। আবোলতাবোল চিন্তায় রাত কাবার। পরদিন সকাল সকাল সেজ্যোতির আগমন। কোচিং ছিলনা বিধায় আমায় নিয়ে বাইরে যাবে ও। ভাগ্য ভালো টিউশনটাও ছিলনা সেদিন। তাই বেরুলাম ওর সাথে। ও কথায় কথায় ইনতিসার ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুললো। যদিওবা বেশি আগ্রহ প্রকাশ করলাম না ওর কথায় তবুও ও অক্লান্ত বকে গেল ভাইয়ের হয়ে। সারাদিন আমরা একসাথে ছিলাম। অন্যকোনো গল্প করিনি, শুধু ইনতিসার ভাই সম্পর্কেই বলে গেল। শুনতে শুনতে একসময় বিরক্ত হয়েই বললাম, “ওনার সম্পর্কে এত কথা বলছিস কেন? ওনার বায়োডাটা জেনে আমি কি করবো?”
প্রতুত্তরে সেজ্যোতি দুষ্টু হেসে বলল,
— জেনে রাখ। দু’দিন পর তো কাজেও লাগতে পারে৷
ওর সরাসরি ইঙ্গিতটা বুঝতে সমস্যা হলো না এবার। কিছু বলতে পারলাম না, শুধু মনে মনে ভেবে রাখলাম এসবে তাল দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়৷ তাই যথাসম্ভব দূরে থাকতে হবে তার থেকে। এবং এরপর থেকে তাই করলাম৷ইগনোর করার চেষ্টা করলাম তাকে। যখন ইগনোর করার চেষ্টা করলাম তখন দেখা গেল সে খোলা খাতার মত হয়ে গেল। আর কোনো রাখঢাক নেই। আমায় নিয়ে তার অনুভূতি জাহির করতে শুরু করলো। সবার সামনে তো বটেই আমার সামনে আরও বেশি বেশি। যেন আমাকেই বোঝাতে চাইছে সব। প্রতিদিন কোচিং-এ যাওয়া আসার সময় আমাদের সাথে থাকছে। টিউশন গুলোতে যাওয়ার সময় দু পাড়ার সীমানায় যে চায়ের দোকান ওখানে তাকে দেখছি। এলাকার বড় ভাইয়েরা আমাকে দেখলেই ছোট্টো করে ভাবি ডাকছে। প্রায়ই আমাদের বাসায় এ-ও সবজি কিংবা মাছ দিয়ে যাচ্ছে। নিতে না চাইলে বলছে, “ক্ষেতের কিংবা পুকুরের। ভালো ফলন হলো তাই এলাকার সবাইকে খাওয়াচ্ছি।” আবার বাজার করে ফেরার সময় আব্বার বাজারের ব্যাগ বহন করে বাড়ি নিয়ে আসছে।
আমি তো সবই বুঝতে পারছি কিন্তু পণ করেছি তাল দিবোনা৷ ওদিকে প্রতিবেশি কিংবা এলাকার ছেলেপেলেদের এত পরিবর্তন আমার সহজ সরল আব্বা এর কিছু টের না পেলেও ভেতরে ভেতরে মা ঠিকই পেলেন। এক সপ্তাহ এমন হওয়ার পর আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গম্ভীর গলায় শুধলেন,
— হঠাৎ করে আমাদের ওপর সকলের এত দরদ এর কারণ কি তুই প্রজ্ঞা? লুকবিনা আমার থেকে। চেয়ারম্যানের ছোটো ছেলের সাথে কিছু চলছে তোর?
আমি সরাসরি অস্বীকার করলাম। এবং বললাম আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা। মা আমার কথা বিশ্বাস করলেন না। কড়া শব্দে আমায় বুঝিয়ে দিলেন এসব করলে পড়ালেখা এখানেই শেষ। বুঝেশুনে যেন এগোই।
মায়ের বকা শুনে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মনের ভেতর রাগ জড়ো করতে করতে ঠিক করলাম ঐ চেয়ারম্যানের ছেলেকে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় লাগিয়ে বলবো, “ব্যাটা আর মানুষ পেলিনা? আমারই পিছনে পড়তে হলো! তোর জন্য আজ আমার মা আমায় অবিশ্বাস করলো, তোর জন্য সংগ্রাম করে শুরু করা আমার পড়াশোনাটা থেমে যাওয়ার যোগাড়। সাবধান করে দিচ্ছি। পিছু যদি না ছাড়িস তাহলে কিন্তু খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম”
মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে তার সাথে দেখা করবো ঠিক করলাম। সেজ্যোতির মাধ্যমে তাকে চিঠি লিখে পাঠালাম,ঠিক বিকেল চারটায় আমাদের এলাকার শেষ মাথায় যে পুকুরপাড় আছে সেখানে যেন চলে আসে।
চিঠি পেয়ে সে বেজায় খুশি হলো। ফিরতি চিঠিতে তা জানালো।
আমি তো পাহাড়সমান রাগ পুষে দেখা করার উদ্দেশ্যে বেরুলাম। গিয়ে দেখি সে আগে থেকেই উপস্থিত। আমায় দেখে কেমন নার্ভাস হতে শুরু করলো৷ আমি ঠিক করেছিলাম সামনে পাওয়া মাত্র রাগের উদগিকরণ করে দেবো কিন্তু তা সম্ভব হলোনা। তার পূর্বেই সে আমায় হাত চেপে ধরলো। অস্থিরচিত্তে অনেকটা তোতলাতে তোতলাতে বলল,
— আগেই কি..কিছু বলোনা প..প..প্রজ্ঞা। আ…আমাকে আগে বলতে দাও। আ..আমি না অনেক আ..গে থেকেই ত..তোমাকে পছন্দ করি। তু…মি যখন ক্লাস এইটে তখন থেকে। ক..কখনো বলার সাহস হয়নি কারণ ত..তখন তো আমার কোনো জব ছিলনা। তাছাড়াও ত..তোমার আব্বাকে ভয় লাগতো আমার। প্র..প্রপোজ করলে যদি আমার আব্বার কাছে বিচার দিয়ে ঠ্যাঙানি খাইয়ে নেয় এই ভয় পেতাম।
তাই কখনো চেষ্টা করিনি মনের কথাটা জানাতে৷ তাছাড়া তুমিও ছোটো ছিলে। যদি হঠাৎ প্রপোজালে ভয় পেয়ে যাও!
অপেক্ষা করছিলাম তোমার বড় হওয়ার, ভালোবাসা জিনিসটা বোঝার। কিন্তু এখানে থেকে অপেক্ষা সম্ভব হচ্ছিল না। তোমাকে সামনে দেখলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারতাম না। সব জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো। নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব যখন সম্ভব হচ্ছিল না তখন বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে গেলাম। সবাই জানলো আমি পড়াশোনার উদ্দেশ্যে গেছি কিন্তু শুধু আমি জানি আমার এ যাওয়া ভালোবাসার মানুষটার ভালোর খাতিরে যাওয়া। বিশ্বাস করো প্রজ্ঞা ওখানে একটা দিন এমন যায়নি তোমার কথা ভাবিনি আমি। নিজের অনুভূতিটা না জানিয়ে, তোমায় এক পলক না দেখেও নিজের সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসে গেছি। আমার এই ভালোবাসা চার বছরে অনেক গাঢ় হয়েছে। তুমি আমার অন্তরের সাথে মিশে আছো প্রজ্ঞা।
আজ এতদিন বাদে যখন সোশ্যাল সাইটে সেজ্যোতির সাথে তোমার ছবি দেখলাম তখন মনে হলো আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ। সময় হয়েছে তোমায় নিজ অনুভূতি জানানোর, নিজের করে পাওয়ার৷ নইলে অন্যকেউ যদি এসে যায় তখন আমার কি হবে?
আমি তোমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা হতে চাই প্রজ্ঞা। বলো তুমি কি আমায় একসেপ্ট করবে? বিশ্বাস করো আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি, ভীষণ।”
শক্ত করে হাতটা চেপে ধরে কাতর স্বরে বলল সে। আমি অবাক নয়নে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই আঠারো-ঊনিশ বছরের জীবনে প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি খুব কম। যা পেয়েছি তা হাইস্কুলে ওঠামাত্র। ঝোঁকের মাথায় প্রেম প্রস্তাব আরকি! আমার গম্ভীরমুখ এবং কারো সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়ানোর প্রতি তীব্র অনাগ্রহ দেখে কেউ এগোতে চাইতো না৷ তাই জানিনা কেউ প্রপোজ করলে বিনিময়ে কি বলতে হয়!
আজ এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতেও বাক্যহারা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উপলব্ধি করলাম মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গেছে আমার। সমস্ত চিন্তন শক্তি হারিয়ে পাথুরে মূর্তি হয়ে গেছি আমি।
সে আমার বিস্ময় আরও দ্বিগুণ করতে এবার হাঁটু মুড়ে বসে ছলছল নয়নে বলল,
— আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি প্রজ্ঞা। প্লিজ আমাকে একসেপ্ট করো। তুমি যদি বলো তাহলে সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে যাবো তোমার বাড়িতে। চিরকালের জন্য আপন করে নেবো তোমায়।
ওনার দ্বিতীয় কথায় আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। চট করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এক পা এক পা করে পেছাতে পেছাতে বললাম, “এ সম্ভব নয়। কিছুতেই সম্ভব নয়। কিছুতেই না”
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
— কেন সম্ভব নয় প্রজ্ঞা?
— জানিনা। শুধু সম্ভব নয়।
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালাম না। পিছু ঘুরে এক ছুটে চলে এলাম বাড়িতে। এসেই দরজায় খিল দিয়ে ভাবতে লাগলাম, আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি এটা বাস্তব?
সেদিন সারা সন্ধ্যা আর দরজা খোলা হলোনা। ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে আমি ইনতিসারের ভাবনায় বুঁদ হয়ে রইলাম। আব্বা কয়েকবার ডাকতে এসেছিলেন। সাঁড়া না পেয়ে চলে গেছেন। মা’ও কেন যেন ঘাটায়নি আমাকে।
পরে ওভাবেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি মনে নেই। সে ঘুম ভাঙলো মাঝরাতে, দরজায় দুমদাম শব্দ শুনে। ভয় পেয়ে দরজা খুলে দেখি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে মা কাঁদছেন। এক মুহুর্তের জন্য দেহ থেকে আত্মা উড়ে গেল আমার। তাকে ধরে অস্থিরচিত্তে জানতে চাইলাম কি হয়েছে?
মা কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
— এক্ষুণি একটা ফোন আসছিল। ফোন পেয়ে তোর আব্বা তড়িঘড়ি করে উঠে রেডি হইতেছে। কই জানি যাবে। আমারে তো কিছু বলতেছে না। মনে হয় প্রতীকের কিছু হইছে রে।
মায়ের কথা শুনে আমি আরও ভয় পেয়ে গেলাম। আব্বার ঘরে ছুটে গিয়ে দেখলাম, শার্ট প্যান্ট পরা আব্বা দ্রুতহাতে কিছু টাকা আর কাপড়চোপড় গুছিয়ে নিচ্ছেন ব্যাগে। ঘরের ভেতর ঢুকে সরাসরি আব্বাকেই প্রশ্ন করলাম,
— কই যাও আব্বা?
আমার প্রশ্ন শুনে একটু থামলেন আব্বা। তারপর ব্যাগের চেন আটকে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
— আমি খুব দ্রুত চলে আসব রে মা। তোর মা আর ভাই-বোনরে দেখে রাখিস। ওদের দায়িত্ব এখন তোর। আমি জানি তুই আমারে নিরাশ করবি না।
— কিন্তু আব্বা..
আমাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে আব্বা ব্যাগ হাতে বেরিয়ে গেলেন অজানার উদ্দেশ্যে। আমরা কি তখনও জানতাম এই একটা কল আমাদের জীবনটাকে আমূল পরিবর্তন করে দিবে?
চলবে,
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here