চড়ুই সংসার, পর্ব:৪

চড়ুই সাংসার
৪/অন্তিম পর্ব
_______
যাওয়ার সময় আব্বা নিজের বাটন ফোনটা রেখে গেছিলেন। আমি,মা আর আমার বাকি দু’ ভাই-বোন সেই রাত থেকে ছোট্টো ঐ বাটন ফোন হাতে চাতকের ন্যায় অপেক্ষা করতে থাকলাম কোনো কল আসুক, কোনো খবর পাই আব্বা কেন গেল? কোথায় গেল?
ওসব ঝামেলায় লেখাপড়া মাথায় উঠে গেল। কোচিংও বাদ, এডমিশনের প্রিপারেশনও বাদ। সেজ্যোতি এসেছিল আমাকে মানাতে, আমি শুনিনি। আমার ওপর পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আব্বা,তিনি না ফেরা পর্যন্ত এক পা বাড়ির বাইরে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। দেখতে দেখতে কেটে গেল দু’দিন। মা কেঁদেটেদে অস্থির। আমার পক্ষেও আর সম্ভব হচ্ছেনা এভাবে, মনে সব উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘোরাফেরা করছে। কীভাবে পাবো আব্বার সন্ধান? কে এনে দেবে আমার আব্বার খোঁজ! অসহায় আমি কি করবো না করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। যে নম্বর থেকে কল এসেছিল, বেরুনোর সময় ঐ নম্বরটা আব্বা ডিলেট করে চলে গেছিলেন। কেমন জট পাকানো মনে হচ্ছিল সব।
আমাদের পরিবার বলতে আমরা ছয়জনই। নানার তরফ থেকে যদিওবা এক মামা আছে, কিন্তু দাদার তরফ থেকে কেউ নেই। আব্বা তাদের একমাত্র সন্তান। দাদা-দাদির মৃত্যু হয় আমাদের জন্মের আগেই। এখন এক মামা ছাড়া আর কেউ নেই সাহায্য করবার। মা বললেন তোর মামাকে ফোন দে। ও ই একমাত্র পারবে আমাদেরকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে।
মায়ের কথা শুনে দিলাম মামাকে ফোন। ফোন পেয়ে তো মামার অস্থিরতার শেষ নেই। ব্যবসার কাজে গেছেন টেকনাফ। তবে চিন্তা নেই আজ রাতের গাড়িতে রওয়ানা হবেন আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যে। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো অপশন নেই। তাই অপেক্ষা করলাম আমরা। পরদিন সকালবেলা মামা আসার খানিক পর আবার উপস্থিত হলো ইনতিসার ভাই। সেজ্যোতির মুখে সব জানতে পেরে সে এসেছে। আমার কাছে আরেক তরফা শুনলো সেদিনের ঘটনা৷ তারপর ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করলো কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি-না! কন্ট্রাক্ট লিস্ট থেকে ভাইয়ার নম্বরটা বের করে নিজের ফোন থেকে ফোন দিয়ে দেখলো ভাইয়ার থেকে কোনো ইনফরমেশন পাওয়া যায় কি না!
ভাইয়ার ফোনে রিং হলো ঠিক। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না৷ পরে ইনতিসার ভাই করলো কি তার এক বন্ধুকে ভাইয়ার ফোন নম্বর দিয়ে লোকেশন ট্রেস করতে বলল। সে জানালো দুপুরের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে।
ইনতিসার ভাই আমাদের দুশ্চিন্তা করতে মানা করলো। সে খুঁজে এনে দেবে আব্বাকে।
দুপুর পর্যন্ত সে আমাদের বাড়িতে বসে রইলো। সেই ফাঁকে মামার সাথে কথাবার্তাও হলো বেশ। দুপুর ১ টা দেড়টার সময় ঢাকা থেকে একটা কল এলো। না ইনতিসার ভাইয়ের কাছে নয় আব্বার ফোনে। অপরিচিত নম্বর দেখে ইনতিসার ভাই রিসিভ করলো কলটা। রিসিভ করামাত্র ওপাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বলল,
— আমি ঢাকা সিটি হাসপাতাল থেকে বলছি। এটা কি প্রতীক হাসানের বাড়ির নম্বর?
“হাসপাতাল” শব্দটা শুনেই আমার শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। ইনতিসার ভাই উত্তর দিলেন,
— জ্বী আমি তার ভাই।
— একটা খারাপ সংবাদ আছে।আজ শেষরাতের দিকে গুলশান-২ এ দূর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে প্রতীক হাসান এবং তার বাবা খারাপভাবে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই প্রতীক হাসানের বাবা মৃত্যুবরণ করেন আর আজ সকালে প্রতীক হাসানও…
মর্গে তাদের লাশ রাখা আছে। আপনারা এসে নিয়ে যাবেন ভাই।

লোকটার কথা শুনে ইনতিসার ভাই হতবুদ্ধি হয়ে গেল, সাথে মামাও। আর আমার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গেল যেন! অকস্মাৎ এমন সংবাদ শোনার পর ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিছু। বিড়বিড় করে বললাম, ওরা মিথ্যে বলছে না ইনতিসার ভাই? আব্বা ফিরে আসবে, ভাইয়া ফিরে আসবে।
আমার অপ্রকৃতস্থ গলা শুনে ইনতিসার ভাই বসা থেকে উঠে আসলো আমার কাছে।
— প্রজ্ঞা..
তার বাকি কথা শুনতে পারলাম না। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। আস্তে আস্তে চোখের সামনে সব ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো আর তারপরেই চেতনা হারালাম।
চেতনা যখন ফিরলো তখন আঙিনা থেকে মায়ের আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। আমার ভাইবোন দু’টো বিছানার শেষ মাথায় বসে গুণগুণ করে কাঁদছে। আর বিছানার পাশে চেয়ার পেতে মাথা নিচু করে বসে আছে ইনতিসার ভাই।
সবার এমন কান্নাকাটি, আর্তচিৎকার আমার শরীরে অদ্ভুত জ্বালার সৃষ্টি করছে। উঠে বসতে বসতে বললাম,
— তোমরা সবাই চলে যাও এ ঘর থেকে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
আমায় উঠে বসতে দেখে ইনতিসার ভাই এগিয়ে আসতে নিলে তাকে থামিয়ে দিলাম।
— বললাম না একটু একা থাকতে চাই?
পরে আর কেউ কিছু বলার সাহস পেলনা। মাথা নিচু করে সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি দরজা আটকে মেঝেতে বসলাম। আমার আব্বা আর নেই! তরতাজা মানুষটা নেই হয়ে গেল। বিশ্বাস করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। এখন কে আমাকে “মা” বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? কে আমার জীবনযুদ্ধে অনুপ্রেরণা দেবে? আমি তো অনাথ হয়ে গেলাম।
চোখ ফেটে কান্না আসতে শুরু করলো আমার। করতলে মুখ লুকিয়ে কান্নার শব্দগুলোকে আটকাতে চেষ্টা করলাম। ভেঙে পড়া যাবেনা তো আমার। আব্বা আমায় পরিবারের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। এ দায়িত্ব যথা যজ্ঞ পালন করতে হবে।

আব্বা আর ভাইয়ার লাশ নেয়ার জন্য আমিও যেতে চেয়েছিলাম মামার সাথে। কিন্তু মামা আমায় নিলেন না, বললেন বাড়িতে থেকে মা’কে সামলা।
একটা গাড়ি ভাড়া করে মামা আর ইনতিসার ভাই গেল ঢাকায়। ঠিক ঠিক একুশ ঘণ্টা পর ফিরলো আমার আব্বা-ভাইয়ের লাশ নিয়ে।
জানতে পারলাম,সেদিন রাতে পুলিশ স্টেশন থেকে ফোন এসেছিল আব্বার কাছে। কার যেন মেয়েকে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে নেয়া অপরাধে ভাইকে এ্যারেস্ট করা হয়। মা শুনে কষ্ট পাবেন বলে ফোন নম্বরটা ডিলেট করে গেছিলেন আব্বা। হয়তোবা পরিকল্পনা এমন ছিল যে ওদিকের সব সমস্যা আমাদের থেকে লুকিয়ে একা একাই সলভ করে ফেলবেন।
করেছিলেনও তাই। ভাইয়ার বন্ধুদের সহায়তায় মেয়েটার বাবা-র সাথে দেখা করেন। অতঃপর হাতেপায়ে ধরে কেস উঠিয়ে নেন।
দু’দিন লেগে যায় এসব করতেই। অবশেষে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ওকে নিয়ে বাড়িতে ফিরছিলেন আব্বা। কিন্তু পথে দূর্বৃত্তরা…
আব্বা-ভাইয়ের জানাজায় এসে গ্রামের লোকরাও এসব শুনতে পেলো। তারপর কিছু সময়ের মধ্যে মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে গেল পুরো গ্রাম। কেউ নিন্দা করলো আমাদের, কেউবা সহানুভূতি দেখালো।
পরিবারের কর্তা হারিয়ে অসহায় আমাদের ওপর ইনতিসার ভাইয়েরও বিশেষ দৃষ্টি পড়লো। প্রায় প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা সে বাড়ি এসে খোঁজখবর নিতে শুরু করলো।
তার এত আন্তরিকতা আবার গ্রামের কিছু মানুষের পছন্দ হলোনা। তারা সহজ ব্যাপারটাকে পেঁচিয়ে নোংরা করে চেয়ারম্যান সাহেবের কানে তুলল।
“আমরা নাকি অসহায়ত্ব দেখিয়ে ইনতিসারের থেকে সুযোগ সুবিধা নিতে চাইছি আরও কত কি!”

কান ভাঙানোর পর একদিন সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান সাহেব আসলো আমাদের বাড়িতে। খুব ঠান্ডা মাথায় অপমান করলো আমাকে, মা’কে। মৃত আব্বার নাম করেও চারটে খারাপ কথা বলতে ছাড়লো না। তারপর শাসালো গ্রাম ছাড়তে হবে নইলে শান্তিমত বাঁচতে দেবে না।
আব্বা-ভাইকে হারিয়ে শোকে মুহ্যমান মা এই অপমান নিতে পারলেন না। অসুস্থ হয়ে পড়লেন তখুনি। মামা সেদিন মাত্র বিকেলে তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছেন। মা’কে এমন অসুস্থ দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করবো! কি করবো না। বাধ্য হয়ে পুনরায় কল করলাম মামাকে। মামা অর্ধেক পথ তখন চলে গিয়েছেন। আমার কল পেয়ে পুনরায় পরের স্টপ থেকে ফিরে এলেন। তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এখানে আর নয়। আজ, এক্ষুণি চিরকালের মত আমরা এই গ্রাম ছেড়ে মামার সাথে চলে যাব। নিজ পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হওয়ার কষ্ট অন্যরকম। কিন্তু আমাদের কিচ্ছু করার নেই। চেয়ারম্যান লোকটা ভালো নয়। অনেক অপরাধের সাথে জড়িত সে। শোনা গেছে একসময় উত্তরপাড়ার এক মুদি দোকানির মেয়েকে তুলে এনে রেপ করেছিল।
তবুও যে মানুষ কেন ওকে ক্ষমতায় বসতে দিয়েছে কে জানে!
আমরা যদি সেরকম কোনো বিপদে পড়ি তাহলে কেউ তো আমাদের পাশে থাকবেই না! উল্টো মান সম্মান খুঁইয়ে ঘর ছাড়তে হবে। তার চাইতে কোনো ক্ষতি না হওয়ার পূর্বেই চলে যাওয়া ভালো। আমি অবশ্য এসবের পক্ষে ছিলাম না। দেশে আইন আছে। কাউকে শাসানো যত সহজ ক্ষতি করা ততটা সহজ নয়। আমার কথা শুনলেন না মা। মামাও বললেন তিনি অতদূর থেকে কীভাবে আমাদের ভালোমন্দ দেখাশোনা করবেন? তারচাইতে বরং তার সাথেই চলে যাই। নানা-নানির মৃত্যুর পর দু’টো ঘর বন্ধই পড়ে আছে। মামার যেহেতু ছেলেপুলে নেই, একটাই মেয়ে তারও আবার বিয়ে হয়ে গেছে। অতগুলো ঘর লাগেনা ওদের। আমরা গেলে বরং ভালোই হয় সবাই মিলেমিশে থাকা যাবে।
আমাদের জীবনের সিদ্ধান্ত এখন মা নেবেন। উনি যেখানে রাজি সেখানে আর কিছু বলার আছে। বুকের কষ্ট বুকেই চেপে রেখে শেষ পর্যন্ত বাক্সপেটরা গুছিয়ে বাড়ি ছেড়ে চিরকালের মত রওয়ানা হলাম চাপাইনবয়াবগঞ্জের উদ্দেশ্যে। চলে যাওয়ার সময় সবাই যেন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছিলাম কর্তাবিহীন একটা পরিবার কতখানি অসহায়!
_________
লোকে বলে সৃষ্টিকর্তা মানুষের এক পথ বন্ধ করে দিলে অন্য পথটা ঠিক খোলা রাখেন। কিন্তু আমাদের জন্য একথা সত্যি নয়।
তিন সন্তান নিয়ে মায়ের ভাইয়ের বাড়িতে ওঠার ব্যাপারটা মামি মোটেই ভালো চোখে দেখলেন না। প্রথমদিনই তার ঘৃণার দৃষ্টি আমাদের ব্যথিত করলো। ভেবেছিলাম থেমে যাওয়া পড়াশোনাটা এখানে থেকে শুরু করবো। কিন্তু মামির ভৎসনা আমায় স্মরণ করে দিচ্ছিল এ পরিকল্পনা সফল হওয়ার নয়। কেবলই মনে হচ্ছিল আমরা একটা বৈঠা বিহীন নৌকায় করে মাঝ সমুদ্রে গিয়ে আটকে গেছি। বেঁচে ফেরার কোনো উপায় নেই।
মা’ও যখন উপলব্ধি করলেন নিজেদের অসহায় অবস্থা তখন বাধ্য হয়ে এক অন্যরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হলো তাকে। এই অন্যরকম সিদ্ধান্তের নাম “মেয়ের বিয়ে”। হ্যাঁ এক ঝটকায় আমাদের দু বোনের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন মা। তার কেবলই মনে হচ্ছিল একমাত্র মেয়েদের বিয়ে দিলেই জীবনের মোড় ঘুরে যাবে, হয়তোবা তা ভালোদিকে।
আমার ধারণা বিয়ের পরামর্শটা মামাই দিয়েছিলেন মা’কে।
মেয়েদের মধ্যে আমি যেহেতু বড় অতএব আমার সিরিয়াল সবার আগে। মাত্র এইচএসসি দেয়া আমার দুচোখ ভরা স্বপ্নগুলোকে একটু একটু করে ডুবে যেতে দেখছিলাম এই একটা দূর্ঘটনার পর। কিছু বলার ছিল না। সদ্য স্বামী-সন্তান হারানো মা’কে কি বলা উচিৎ, কীভাবে সাহস দেয়া উচিৎ আমার জানা ছিল না,সত্যিকার অর্থেই জানা ছিল না। আমি জানি মায়ের মনে এখন একটাই চিন্তা গার্ডিয়ান ছাড়া কীভাবে সার্ভাইব করবো আমরা!
অসহায় ছিলাম তো। পেটের দায়ের কাছে সকল স্বপ্ন বিসর্জন দেয়া অসহায়দের মূল ধর্ম। অমত করলাম না আমি। কেবল প্রার্থনা করলাম মায়ের একটা মনোকামনা যাতে পূর্ণ হয়, স্বামী নামক মানুষটা যেন ভালো হয়! আমাদের দায়িত্ব নিতে বিরক্তবোধ না করে।
তারপর আর কি! আমি রাজি হয়ে যাওয়ার পর পাত্র দেখার তোড়জোড় শুরু হলো। পর পর তিনটে ভালো ঘর থেকে সম্বন্ধ আসলো, তারা আমাকে পছন্দও করলো কিন্তু যখনই পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে এই ব্যাপারটা তোলা হলো তখনই পিছিয়ে পড়লো সব। আমি জানতাম এমনটাই হবে। অন্যের বোঝা কে টানতে চায়?
তিন নম্বর পাত্রপক্ষের থেকে না সূচক জবাব আসার পর মা ভেঙে পড়লেন। অবস্থা এমন নিজেকে অপরাধী ভেবে সুইসাইড করে ফেলেন। মামা তাকে আটকালেন অনেক কষ্ট করে। বললেন ধৈর্য্য ধর, সব ঠিক হয়ে যাবে৷
এর বেশ কয়েক মাস পরের ঘটনা। এক সকালে পুনরায় ঘটকের আগমন। ঐ পাড়ার এক চেয়ারম্যানের ছেলের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। ছেলে ঢাকার একটা সরকারি কলেজের প্রফেসর। দুজন সন্তান চেয়ারম্যান সাহেবের। তার মধ্যে এই ছেলে বড়। কয়েকমাস হলো চাকরি হয়েছে। এখন সংসার সাজিয়ে দিতে পারলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে পারেন চেয়ারম্যান সাহেব। আমার ছবি দেখে ওনার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের সম্মতি থাকলে পরের সপ্তাহে দেখতে আসতে চান।
ঘটকের মুখে সব শুনে মামা তাকে আমাদের শর্তের কথা মনে করিয়ে দিলেন। ঘটক বলল, চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে এ ব্যাপারে কথা হয়েছে। উনি আবার ওনার ছেলেকে একথা বলেছেন। ছেলের কোনো আপত্তি নেই। এতদিন বাদে একটা পজিটিভ উত্তর পেয়ে সকলের মন খুশিতে ভরে উঠলো।
পরের সপ্তাহ পর্যন্ত দেরি করতে হলো না। পরদিন শুক্রবার পুরো পরিবারসহ আমায় দেখতে এলো পাত্রপক্ষ । সামনাসামনি দেখে এতই পছন্দ করে ফেলল যে কোনোরূপ প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়ে আংটি বদল হয়ে গেল। তারপর আমাকে আর ছেলেকে আলাদা কথা বলার সুযোগ করে দেয়া হলো। জানিনা কেন আলাদা কথা বলতে পাঠানোর পর থেকে আমার ভেতরটা ভেঙে আসতে শুরু করলো। আমি কোনোমতেই নিজের কান্না আটকাতে পারছিলাম না। ঘরে ঢোকার পরপর ওনার সামনেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। অকস্মাৎ আমার কান্না দেখে উনি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। অস্থির হয়ে শুধলেন,
— কোনো সমস্যা? আমি কি কাউকে ডাকবো?অস্থিরভাবেই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেন। আমি ওনাকে আটকে বললাম,
— না না। একটু সময় দিন আমাকে। এক্ষুণি কান্না থেমে যাবে।
— আচ্ছা আপনি কি বিয়েতে রাজি নন?
খুব ধীরগলায় দ্বিতীয় প্রশ্নটা করলেন উনি। ওনার প্রশ্ন শুনে আমার কান্না থামার বদলে আরও বেড়ে গেল। আমি জড়ানো গলায় বললাম,
— চাই।
— উঁহু আপনি মিথ্যে বলছেন। বিয়েটা অবশ্যই আপনার অমতে ঠিক করা হচ্ছে। নইলে এভাবে ব্যাকুল হয়ে কাঁদবেন কেন? সময় আছে, এখনই বলে দিন। আমি তাহলে বাইরে গিয়ে না করে দিই।
— না না প্লিজ। আমি বিয়েটা করতে চাই কিন্তু…
— কিন্তু?
— তার সাথে এটাও চাই আমার পড়ালেখাটা বন্ধ না হোক। এবার এডমিশন দিতাম আমি। কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে এতসব হয়ে গেল যে, আমার পড়ালেখাটাই বন্ধ হয়ে গেল।
— বন্ধ হয়ে যাবে কেন? এবার হলোনা সেকেন্ড টাইমের প্রিপারেশন নেবেন। আগামীবছর পরীক্ষা দেবেন। বিয়ের পর কি মানুষ লেখাপড়া করেনা?
— আপনি আমাকে পড়াবেন?
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম। উনি মৃদু হাসলেন।
— অবশ্যই। এমনটাই তো কথা হয়েছে। কেন আপনার মামা আপনাকে বলেনি ?
আমার অবাকের মাত্রা বেড়ে গেল। মামা বলেছে আমার পড়াশোনার কথা? অথচ উনিই না কত আগ্রহ ভরে বিয়ের কথা পাড়লেন!
— আপনার কিছু জিজ্ঞাসার আছে প্রজ্ঞা? এর বাইরে অন্য কোনো সমস্যা? এখনও বিয়েতে অমত?
ওনার মিষ্টি কন্ঠস্বরে আমার চিন্তাভঙ্গ হলো। মাথা নেড়ে বোঝালাম “না”
ঠোঁটের কোণের হাসিটা বজায় রেখেই উনি বললেন,
— তাহলে চলুন? বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে।
আমি মাথা নেড়ে ওনার পিছু পিছু চললাম। দরজার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে অবচেতন মনেই বললাম,
— আপনার নামটা জানা হয়নি আমার।
— সে-কি! যার সাথে বিয়ে হবে তার নামটাই জানেন না?
হাসতে হাসতে বললেন উনি। ওনার হাসিতে আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম।
— আমার নাম অভিক। অভিক আনোয়ার। আপনাকে কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে প্রজ্ঞা। চিন্তা করবেন না পছন্দের মানুষদের সকল সুখ-দুঃখের ভার আমি স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিতে পছন্দ করি। ফ্যামিলি প্রবলেম কিংবা পড়াশোনা কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে হবেনা। আমি এসেছি তো, আপনার সঙ্গী।
হাসিমুখে কথাগুলো বলে উনি চলে গেলেন। আমি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার পথে। আজ দ্বিতীয় বারের মত ফের একজন ফেরেশতাসম মানুষের আগমন ঘটলো আমার জীবনে। এ যে সৃষ্টিকর্তারই আশীর্বাদ। তাহলে আমি ভুল ছিলাম। এক পথ বন্ধ হলেও দু নম্বর পথটা আমাদের জন্য ভীষণ আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিল তাহলে!
__________
সৃষ্টিকর্তার ওপর মামার অগাধ বিশ্বাস। স্ত্রী’র কর্মকাণ্ডের পর মামা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার বোন সন্তানদের নিয়ে এখানে সুখে থাকতে পারবে না। তাচ্ছিল্যের যন্ত্রণা সইতে সইতে তাদের জীবন বিষিয়ে উঠবে। এজন্যই আমার আর বোনের বিয়ের ব্যাপারটা ওনার মাথায় আসে। আমাদের সকলের সামনে “চলনসই পাত্র হলেই হলো” বলা মামা আসলে ভেতরে ভেতরে বংশীয় পরিবার খুঁজছিলেন। যাদের মন মানসিকতা ভালো হবে, আমাদের সকল দুঃখ, দুর্দশা যারা চোখ বন্ধ করে মেনে নেবে। অভিকের বাবা-র খোঁজ অনেক আগেই পেয়েছিলেন মামা এক বন্ধুর মাধ্যমে। তাদের পরিবারে বিবাহযোগ্য ছেলে আছে শুনে খোঁজখবরও নিয়েছেন বেশ। ভাগ্যের যোগ ছিল তাই মামার চিন্তাভাবনাগুলো মিলে গেল ওদের সাথে। আর একমুহূর্ত দেরি না করে পাঠালো ঘটককে ও-বাড়িতে। তারা এক দেখায় আমায় পছন্দ করলো। এরপর মামা আলাদাভাবে কথা বললেন চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে। ওনাকে সব খুলে বললেন আমাদের সম্পর্কে। শুনে চেয়ারম্যান সাহেব খুশি খুশি মেনে নিলেন সবটা। তারপর তো এই বিয়ের কথাবার্তা হলো।
খুব কম সময়ের ছুটি নিয়ে এসেছিল অভিক। তাই এমাসের মধ্যেই বিয়ের ডেটটাও ফাইনাল হয়ে গেল।
বিয়ের ডেট ফাইনাল হওয়ার পর থেকে মামির আচরণে একটু পরিবর্তন দেখা দিলো। মুসিবত কাঁধ থেকে নেমে যাচ্ছে এই ভেবে উনি ভালো ব্যবহার করছিলেন আমাদের সাথে। খুশিমনে বিয়ের কাজে হাত লাগাচ্ছিলেন। মা’ও ওনার পরিবর্তনে খুশি হলো বেশ।
ওদিকে অভিকের সাথে যেন যোগাযোগ করতে পারি এজন্য মামা একটা ফোন কিনে দিলেন আমাকে। এরপর থেকে দিনের অর্ধেকটা কেটে যেতে লাগলো অভিকের সাথে কথা বলে। মাঝে দু একদিন বাড়িতে এসে সকলের সম্মতিতে আমায় ঘুরতেও নিয়ে গেল অভিক।
তার ভদ্রতা, ভালোমানুষি, কেয়ারনেস এসবে ক্রমশ মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার জীবনের প্রথম ভালোলাগার মানুষ বনে গিয়েছিল সে। অভিকের মাঝে মুগ্ধ হতে হতে ইনতিসারের কথা স্মৃতি থেকেও হারিয়ে গেল আমার। কিন্তু ইনতিসারের আমার কথা ঠিক মনে ছিল। সে এসেছিল আমার বিয়ের রাতে, আমায় নিয়ে পালিয়ে যেতে। আমি তার পাগলামিকে প্রশ্রয় দেইনি। ফিরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু সে ফিরে যায়নি সারাটা রাত দাঁড়িয়ে ছিল আমার অপেক্ষায়।
দ্বিতীয়বার আর তার সামনে যাইনি আমি, যেতে পারিনি৷
একপ্রকার পালিয়ে এসেছি তার থেকে। অপরাধবোধে জর্জরিত হয়েছিল ভেতরটা। কিন্তু এ-ও সত্য আমার ভাগ্যে তার নামটা লেখা ছিল না। লেখা ছিল অভিকের নাম।
আমি তাকে ভালোবাসা তো দিতে পারিনি তবে মন ভরে দুআ করেছি তার ভাগের ভালোবাসাটাও সে পাক। এক পৃথিবী ভালোবাসা নিয়ে কেউ আসুক তার জীবনে। মুছে দিক সকল কষ্ট-যাতনা।
________
বিয়ের পরপর আমার ভাইবোন দুটোকে শহরের স্কুলে ভর্তি করে দিলো অভিক। স্কুলের পাশেই একটা বাসা ভাড়া করে মা সহ ওদের তুলে দিলো।
আর আমায় নিয়ে এলো ঢাকায়। বই-খাতা সব কিনে দিলো। বাসায় বসেই সেকেন্ড টাইমের প্রিপারেশন শুরু করলাম। ও প্রতিদিন সকাল ন’টায় বেরিয়ে যেত ফিরতো দুপুরের পর। কখনো ক্লাস না থাকলে অবশ্য দুপুরের আগেই চলে আসতো। সেটা দু সপ্তাহে হয়তোবা একবার!
আমি একা একা বাসায় বোর হয়ে যাচ্ছিলাম, ভয়ও লাগতো। মাঝেমধ্যে ছাদে যেতাম সময় কাটাতে। সেখানে অন্য এক ভাড়াটিয়া ভাবির সাথে কথা হলো। আমাদের নতুন বিয়ে, সংসার সব নিয়ে গল্প হতো তার সাথে। সে বলল তার যখন নতুন বিয়ে হয় তখন সেও এমন ফাঁকা বাসায় থাকতো। প্রথম প্রথম ভীষণ ভয় করতো। কোনোভাবেই এই ভয় কাটাতে পারছিল না। তখন করলো কি তাদের একটা রুম সাবলেটে দিয়ে দিলো। নতুন সংসারে দু’টো মাত্র মানুষ, কিন্তু ঘর তিনটে। একটা যেহেতু পড়েই থাকতো তাই সাবলেটে দিলে কিছু টাকাও আসতো আবার সময়ও কেটে যেত।
ভাবির কথা শোনার পর আমার মাথায়ও হঠাৎ সাবলেটের ভূত ঢুকে গেল। অভি’র সাথে শেয়ার করার পর ও প্রথমে রাজি হলো না।আমি নানারকম যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝালাম তবুও না থেকে হ্যাঁ হলো না। পরে আবার ভাবির থেকে বুদ্ধি ধার করতে গেলাম, কি করা যায় কি করা যায়! ভাবি বলল একটু মান-অভিমানের নাটক করো। একবেলা না খেয়ে থাকো দেখবে ঠিকই মেনে গেছে। আমি তা-ই করলাম। এবং সত্যিই এবার কাজ হলো।একটু রাগলো ও তবে সম্মতিও দিলো। শুরু হলো আমাদের সাবলেটের জন্য মানুষ খোঁজা। আমি ততদিনে নেট চালানো শিখে গেছি। আমি খুঁজছি নেটে আর ও কলিগদের মাঝে। এই করে করে একমাস কাটলো। একমাস পর একটা ফ্যামিলি পেলাম নিম্ন আয়ের। ফ্যামিলিতে তিনজন। হাসবেন্ড-ওয়াইফ আর তিন বছর বয়সী একটা মেয়ে বাচ্চা। বাচ্চা পেয়ে আমার খুশি দ্বিগুণ হয়ে গেল। এখন সময় কাটবে বেশ ভালোভাবেই। ওকে কথা বলিয়ে দিলাম ওদের সাথে। কথাবার্তা বলে ওর মনপুত হলে উঠে যেতে বলল ওদের।
মাসের প্রথম সপ্তাহেই উঠে গেল ওরা৷ আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পরিচিত হলাম। ভাবিটাও খুব ফ্রী ছিল। প্রতিদিন আসতো ঘরে গল্প করতে। যখন কাজ করতো তখন বাচ্চাটাকে দিয়ে যেত আমার কাছে। বাচ্চার সাথে খেলাধুলো করতাম আমি। ভালোই চলছিল সব৷ কিন্তু সমস্যা যে আমাদের সাদরে গ্রহণ করার জন্য বসে ছিল তা কি আর আন্দাজ করতে পেরেছি!
কতদিন আর হবে? জোর দুমাস ভালো ছিলাম ওদের সাথে। দুমাস পর থেকে নানারকম ঝামেলার সৃষ্টি হতে থাকলো। ওরা হাজবেন্ড ওয়াইফ প্রচন্ড ঝগড়া করতো। লোকটা বোধহয় হাতও তুলতো তার ওয়াইফের ওপর। ভাবিও চুপ নেই, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো হাজবেন্ডকে। ওদের ওইসব গালিগালাজ শুনলে আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যেতাম অভিকের সামনে। অভিক তো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। হাজবেন্ড ওয়াইফের ঝগড়া যে কখনো গালিগালাজ আর মারপিট পর্যন্ত যেতে পারে এটা আমরা কেউই যেন আগে দেখিনি এমন মনে হতো। ওদের ওই ঝগড়ার কারণে বাসার অন্য ভাড়াটিয়ারা খুব ডিসটার্ব ফিল করতো। বাসাওয়ালার কাছে নালিশও করতো এ নিয়ে। বাসাওয়ালা আবার আমাদেরকে কথা শোনাতো তা নিয়ে।
আমরা নির্বিবাদী মানুষ। শান্ত ভাবে বোঝালাম ওদের, এসব করা যাবেনা লোকে খারাপ বলবে। ওরা বুঝলোও, কয়েকদিন আর ঝগড়া টগড়া করলো না৷
কিন্তু যারা নিজেরাই সমস্যা তৈরির মেশিন তার এত সহজে আমাদের ক্ষ্যান্ত দেবে কেন?

বাসায় থাকলে অভিকের প্রিয় কাজ ছিল আমার কাজে হেল্প করা৷ দেখা যেত কখনও ঘর গোছাচ্ছে, কখনওবা আমায় রান্নায় হেল্প করছে।
ভাবিটা যে আমাদের কর্মকাণ্ডে নজর রাখছিল তা কি আমরা জানতাম!
একদিন হলো কি ও অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর ভাবি এলো আমাদের ঘরে বাচ্চা নিয়ে। গল্প করতে করতে ওর কাজের বিষয়টা তুলল এবং এ নিয়ে মজা করার নাম করে অনেক লেইম কথাবার্তা বলে হাসাহাসি করলো যা আমার মোটেই ভালো লাগলো না।
আমি সেদিনটা চুপচাপ সহ্য করে গেলাম। কিন্তু আমার চুপ থাকাটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো। তারপর থেকে তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল ও বেরিয়ে যাওয়ার পর এসব ব্যাপার নিয়ে আমাকে নানা কথা শোনানো। বাইরের মানুষের কথা শুনতে অভ্যস্ত নই আমি। তাই কষ্ট পেতাম খুব। মানসিক চাপ লাগতো। ও যখন হেল্প করতে আসতো সরিয়ে দিতাম। দেখা যেত ও একটু আদর সোহাগ করতে এলেও রাগছি। আমার এমন অবহেলা ওরও মাথা গরম করে দিত। এভাবে একটা অদ্ভুত দেয়াল তৈরি হতে শুরু করেছিল আমাদের মাঝে। খুব কষ্ট পেতাম আমি। কষ্ট পেতো সেও৷ বুঝতে দিতো না। আমি পরিবর্তন হলেও ও কিন্তু এক ফোঁটাও পরিবর্তন হলো না৷ পূর্বের মতই আমার রাগ হজম করে কাজে হেল্প করে গেল, আমার যত্ন নেয়া কিংবা পড়ার খোঁজ নেয়া সবই তার তরফ থেকে ঠিক ছিল। ওদিকে ভাবি যখন দেখলো কোনোকিছু করেই আমাদের মাঝে ঝামেলার সৃষ্টি করা যাচ্ছে না তখন সে আমার মাথায় বাচ্চার ভূত ঢুকিয়ে দিলো। আমি ভালোমন্দ বিচার না করে, নিজের জীবনের লক্ষ্য ভুলে সংসার ধর্মে ব্রতী হওয়ার পণ করলাম। এখন আমার বাচ্চা চাই। আমাদের নতুন ঝগড়ার টপিক হয়ে গেল বাচ্চা। আমি বাচ্চা চাই কিন্তু ও চায়না। ও চায়না কেন! এ নিয়ে আমার নিত্যদিন কান্নাকাটি। অস্থির হয়ে উঠছিল ও আমার এসব কর্মকাণ্ডে। তারসাথে এটাও বুঝে গেছিল আমাদের সংসারে হঠাৎ করে এত অশান্তির কারণ একটাই, ওই ফ্যামিলি।
এখন সাবলেটের গান শেষ। আর রাখা যাবেনা ওদের এই বাসায়। পরদিন সকালেই ওদের জানিয়ে দিলো, গ্রাম থেকে তার বাবা-মা আসবে এখন থেকে এখানেই থাকবে। তাই এই মাস থেকে আর সাবলেট রাখবে না।
ওনারা শুনে একটু সমস্যায়ই বোধহয় পড়লো। ওদের সমস্যা দেখে অভিক নিজে উদ্যোগ নিয়ে কম ভাড়ার একটা বাসা খুঁজে দিলো ওদের।
পরের মাসেই ওরা উঠে গেল ঐ বাসায়। শেষ পর্যন্ত সমস্যা দূর হলো আমাদের ঘাড় থেকে।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও আমার একতরফা অভিমান চলছে। তা বুঝতে পেরে ও সেদিন কলেজ থেকে ছুটি নিলো। আমায় জোর করে রেডি করিয়ে বাইরে নিয়ে গেল ঘুরতে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটিসহ আরও দু তিনটে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখালো আমায়। পুরনো আমিকে ফেরানোর অদম্য চেষ্টা করলো এর মাধ্যমে।
ব্যর্থ হলোনা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া ওর সত্যিটাকে সহজেই উপলব্ধি করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম কীভাবে জীবনের লক্ষ্য থেকে লাইনচ্যুত হয়ে গেছি। মূল্যবান সময়গুলো নিজ হাতে নষ্ট করেছি। ভাগ্যিস সঠিক সময়ে ও আমায় সঠিক পথটা দেখিয়ে দিলো!
ফেরার পর আমায় ওভাবে কাঁদতে দেখে ও মাথায় হাত রাখলো। নরম গলায় বলল,
— সময় থাকতেই নিজেকে শুধরে নাও।জীবন তোমাকে বারবার সুযোগ দেবেনা। একবার সুযোগ হারানোর পর ভাগ্য করে আরেকবার তাকে পেয়েছো। এবার হেলায় হারালে ক্ষতিটা তোমারই।
ভয়কে জয় করতে শেখো। বিষাক্ত মানুষের মাঝে থাকার চাইতে একা থাকা ঢের ভালো। সময় কাটেনা? সংসারটাকে পুনরায় নিজের মত করে সাজাতে শুরু করো। ব্যালকনি বাগান করো, আরও দুটো বুক শেলফ এনে দিচ্ছি সব পছন্দের বইয়ে সাজাও। নেট ঘেটে নতুন নতুন বই আনো। বইয়ে ডুবে থাকো। জ্ঞানও বৃদ্ধি পাবে আবার সময়ও কেটে যাবে। তুমি যদি বলো দু’টো পাখি এনে দিই? তাদের সাথে কথা বলে বলে দিন পার করো। আর বিকেলে তো আমি ফিরছিই। কি এতটুকু সময় এই বন্ধুগুলোর সাথে থাকতে পারবে না?
আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম, পারবো। সে মৃদু হেসে বলল,
— বাচ্চার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো প্রজ্ঞা। তোমার জীবন এখনও অনেকটা বাকি। আকাশছোঁয়া স্বপ্নগুলোর দিকে মাত্র হাত বাড়িয়েছ, ছুঁতে পারোনি তো এখনও। আগে স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখাও। খোদা চাইলে সংসারও হবে।

এরপর সব উল্টোপাল্টা চিন্তা ছেড়ে তার কথামত কাজ শুরু করলাম আমি। বই আর গাছে ঘর ভরিয়ে ফেললাম। সে দুটো পাখি এনে দিলো। নাম রাখলাম মিঠাই আর পান্তুয়া।
তাদের যত্ন করতে করতে আমার একাকিত্ব ঘুচলো। পড়াশোনায় মন লাগালাম পূর্বের মত। একটা টিউটরও রাখলো বাসায়৷ সে সন্ধ্যায় এসে একগাদা পড়া দিয়ে যেত। সেই পড়া কমপ্লিট করতে হতো অভিকের বেতের সামনে বসে। সে আস্তে আস্তে আমায় শেখালো কীভাবে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। ওর ভালোবাসা, আদর মাখনো শাসন আমাকে জীবন্ত করে তুলল। আমি নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পেলাম, সংসারের নবরূপ আবিষ্কার করলাম।
স্বীকার করতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ নেই একমাত্র ওর প্রচেষ্টায় সমস্ত দুঃখ-কষ্টের সমাপ্তি ঘটিয়ে একঝাঁক সুখ নেমে এসেছিল আমাদের চড়ুই সংসারে।
স্বামী-স্ত্রীকে তো এভাবেই একে অপরের পরিপূরক হতে হয়। সব ভুলত্রুটি শুধরে দিয়ে, জীবন চলার সঠিক পথটা দেখিয়ে দিয়ে হাতে হাত রেখে এগিয়ে যেতে হয়।
তবে সব প্রজ্ঞাদের জীবনে কিন্তু অভিকরা আসেনা। তাই খারাপ সময়ে মুখ বুঁজে সব মেনে নিতে হয়না, লড়াই করে নিজেরটা নিজে আদায় করে নিতে হয়। তবেই তো মিলবে সফলতা।
সমাপ্ত
sinin tasnim sara

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here