ছন্দহীন পদ্য পর্ব -০৮+৯

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৮
.
ক’দিনের ভেতরে পদ্যের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। পুরো এলাকায় ঘটনাটা কিভাবে যেন ছড়িয়ে পড়েছে। পদ্যের প্রাক্তন অনেক ছাত্রদের তোপের মুখেও পড়তে হচ্ছে লিটনকে। এলাকায় তার নাম পড়ে গেছে ‘গাল কাটা লিটন।’
কিন্তু পদ্যের কাছে মনে হয়, সমস্যাটা বেশি তারই হয়েছে। নিজের স্বাভাবিক জীবন-যাপনে প্রভাব পড়েছে ব্যাপক।
স্কুলে যেতে-আসতে রাস্তাঘাটে সবাই তাকে দাঁড় করিয়ে এটা-ওটা জিজ্ঞেস করে। অতি উৎসাহী কিছু মানুষ তাদের বাড়িতেও চলে আসে। জানা ঘটনা বারবার জানতে চায়। সবার মুখেই প্রশ্নের ঝুড়ি। পদ্যের মা মনিরা বেগমের কাছে তারা ঝুড়ি খুলে বসে, ‘পদ্য না-কি চেয়ারম্যানের ছেলের গাল কেটে দিছে! কিভাবে কাটলো? কেন কাটলো…!’
রোজই এরকম নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় তাদের। লিটনকে অবশ্য রাস্তাঘাটে আর পায় না পদ্য। এলাকায় তার নাম ‘গাল কাটা লিটন’ পড়ায় হয়তো বের হতেই পারে না। সেসব রাগ-ক্ষোভ মেটানোর সুবিধাজনক কোনো পন্থা তারজন্য আর খোলাও নেই। পদ্যের কিছু হলে দোষটা তার ঘাড়েই পড়বে। অবশ্য কয়েকদিন রাতে পদ্যদের বাড়ির টিনে কেউ ঢিল মেরেছে।
কে মেরেছে তারা জানে না। তবে পদ্যের ধারণা লিটনেরই কাজ এটা৷ এর বাইরে লিটনের দিক থেকে আর কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি তাকে৷ তবে পদ্যের অজান্তেই মতিন মাস্টার অনিকের বাবা মিরাজুল সাহেবকে ধরলেন একটা ভালো ছেলের খোঁজ করতে। তিনি অসুস্থতার জন্য বাজার-ঘাটে খুব একটা যান না৷ সেই দায়িত্ব যে খুব ভালোমতোই মিরাজুল সাহেব পালন করেছেন। তার প্রমাণ ক’দিন পরই পাওয়া গেল।
পাশের গ্রামের আতাই ঘটক শুক্রবারে ছাতা হাতে এসে হাজির। পাত্রের ছবি দিয়ে, পাত্রীর ছবি নিয়ে যাওয়া হলো। পদ্য মায়ের শাড়ি পরে বছর কয়েক আগে এক বান্ধবীর বিয়েতে গিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে ছবি তুলেছিল। সেই ছবির এক কপি তাকেও দেয়া হয়েছিল। সে ছবিই দেওয়া হয়েছে ঘটককে। কথা চালাচালি শুরু হয়ে যায়। পরের শুক্রবার ভোরে মনিরা বেগম পদ্যকে ডাকলেন, ‘পদ্য উঠ মা।’

পদ্যের পাতলা ঘুম। এক ডাকেই সে উঠে যায়। বাইরে হাস-মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছে। সে উঠে বসে ‘হাই’ তুলে বললো, ‘কি আম্মা? ডাকলে কেন?’

– ‘গোসল করে শাড়ি পর। তোকে দেখতে আসবে।’

পদ্য যে একেবারেই কিছু জানে না তা নয়। ঝড় একটা আসবে সেটা টের পাচ্ছিল। তবুও অবাক হয়ে বললো,

– ‘এসব কি বলো আম্মা! হঠাৎ শুরু করছো কি এগুলো?’

– ‘কি শুরু করছি মানে? তোর কি বয়স আসছে না যাচ্ছে? আর কত? আমাদেরও একটু শান্তিতে বাঁচতে দে, যুবতী মেয়ে ঘরে নিয়ে থাকাও যে কত দুশ্চিন্তার তুই সেটার কি বুঝবি। মা হলে তখন না বুঝতি।’

পদ্য থমথমে মুখে বিছানায় বসে রইল। কি বলবে, কি করবে বুঝতে পারে না সে। মনিসা আলনায় হেলান দিয়ে মুচকি হাসছে। সে কোনোভাবেই হাসি আঁটকে রাখতে পারছে না। বাড়িতে একটা বিয়ে লাগলে ভালোই তো হয়। মন্দ কি? ধমক দিলেন মনিরা বেগম, ‘এই তুই আলনা ঠেলতেছিস কেন? মোচড়ামুচড়ি করার আর জায়গা নাই তোর জন্য?’

মনিসা মুখ ভেঙচি করে চলে গেল।

পদ্য নির্লিপ্ত চেহারায় তখনই বললো, ‘আম্মা শোনো, আমি কখনও বিয়ে করবো না। তোমরা বেশি চাপাচাপি করলে আমি বিষ খে*য়ে ম*রবো।’ কথাটি বলেই সে দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো।

মনিরা বেগম অবাক হয়ে বললেন, ‘আশ্চর্য, কান্নার কি আছে? বিয়ে কি এই দুনিয়ায় আর কারো হয়নি? বিয়ের আলাপ শুনলেই তোর ঢং দেখলে তো মনে হয় বাপ-মা গোসল-টোসল করাইয়া কবরে রেখে আসার পরিকল্পনা করছে।’ কথাটি বলে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন।
মতিন সাহেব বারান্দায় বসে গোঁফ কাটছিলেন। মেয়ের কান্না শুনে ঘরে এলেন। পাশে বসে বললেন, ‘এমন করিস কেন মা? ছেলেটা ভালো আছে। সৌদি থাকে। বাড়িঘর নিজে কামাই করে বানিয়েছে। পরিবারে ননদ-টনদ নাই। তোর জামাই, তোর সংসার। যে সংসারে ননদ-শাশুড়ি নাই সেটা তো সংসার না, সাক্ষাৎ বেহেশত। মেয়ে মানুষ স্বামীর জ্বালাকে কোনো জ্বালাই মনে করে না, এক ব্যাটা আর কত জ্বালাইবে? আসল জ্বালা হইল ননদ-শাশুড়িদের।’

সায় দিলেন এসে মনিরা বেগম, ‘ঠিকই কইছো, সংসার যত ছোট, তত সুখ। আজকাল সবাই এরকম পরিবারই চায়। কোনো জ্বালা-যন্ত্রণা নাই৷ এই বিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা মাথায়ই আনবা না।’

পদ্য চোখের পানি মুছে বললো, ‘বাবা, আমার প্রথম এবং শেষ কথা। আমি বিয়ে করবো না।’

মনিরা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। এসব দেখলে রাগে মাথায় আ*গুন ধরে যায়। এত বড়ো মেয়ের গায়ে না কখন হাত তুলে বসেন কে জানে। মতিন সাহেব নিজেকে শান্ত রেখে বললেন,

– ‘এটা কেমন কথা মা। বিয়ে করবি না এটা কোনো সিদ্ধান্ত হলো? তোর একটা ভবিষ্যৎ আছে না?’

– ‘আর তোমাদের ভবিষ্যৎ? আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমাদের কি হবে? তোমার কি ছেলে আছে যে তোমাদের দেখবে?’

– ‘আমাদের চিন্তা তোর করা লাগবে না, আমাদের যা হয়, হবে। যার কেউ নাই তার আল্লাহ আছেন।’

– ‘আমার চিন্তাও তোমাদের করা লাগবে না।’

– ‘জেদ করবি না মা।’

মিরাজুল সাহেব তখন এসে ঢুকলেন। কথাবার্তা শুনে বললেন, ‘বাপ মেয়ের কি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে?’

– ‘আর কি নিয়ে ভাই, সে বিয়ে করবেই না।’

– ‘কেন করবে না।’

– ‘এখন বলে আমাদের কথা। তার বিয়ে হয়ে গেলে আমরা কিভাবে চলবো।’

– ‘তাহলে ঘর-জামাই দেখে বিয়ে দাও।’

মতিন সাহেব হাসলেন। হেঁসে বললেন, ‘কিরে মা, ঘর-জামাই দেখবো তোর জন্য?’

মতিন সাহেব গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টা না নিলেও পদ্য পরিস্থিতির উপস্থিত সামাল দেয়ার জন্য এটাকেই হাতিয়ার হিসাবে নিল। আপাতত এই বিয়েটা তো ভেঙে দিতে হবে। সে চোখ মুছে বললো, ‘হ্যাঁ বাবা, তোমাদের যদি বিয়ে দিতেই হয় তাহলে ঘর জামাইই দেখো। আপাতত এই সম্মন্ধ ভেঙে দাও।’

‘একি কথা’ তিনি উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। মনিরা বেগমকে গিয়ে জানালেন কথাটা৷ তিনি খানিক ভেবে বললেন, ‘তাইলে এটাই করো। ঘর-জামাই দেখো। এই বিষয়টা মাথায় আসেনি আগে। তারপরও যদি মেয়ে বিয়ে বসতে রাজি হয়।’

হঠাৎ করেই তাদের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। ঘটককে কল দিয়ে না করে দিলেন। শুরু হলো ঘর-জামাইয়ের সন্ধান করা।

কিন্তু দিনকে দিন পদ্য কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে, বয়স, লিটনের সঙ্গে ঝামেলা, এরকম অসংখ্য প্রশ্নের উৎস বের হচ্ছে। স্কুলে যাবার জন্য বের হলেই পদ্যের বুকটা কাঁপতে থাকে। মানুষের প্রশ্ন যে কি ভয়াবহ ব্যাপার তা ক্রমশই পদ্য বুঝতে শুরু করল। প্রশ্নের জন্যই যে মানুষ, মানুষ থেকে পালিয়ে বেড়াতে পারে তা হুট করেই সে বুঝতে শুরু করলো। সেসব যন্ত্রণা থেকে খানিকটা হলেও রক্ষা পেতে সে বোরখা-নেকাবের আশ্রয় নেয়। ছাতা হাতে, বোরখা-নেকাব পরে স্কুলে যায়। ক্লাসে গিয়ে কেবল মুখ খুলে। বাড়িতেও কেমন অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। মা আজকাল তার সঙ্গে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছেন। বাড়ির পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে হবে। না হলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। সন্ধ্যায় মনিসাকে পড়তে বসিয়েছে। খুবই বিক্ষিপ্ত বিরক্ত মন নিয়ে সে পড়তে বসে। পড়ার টেবিলে বসতেই ইচ্ছে করে না। মোবাইল, টিভি থেকে নিজেকে সরিয়ে কত কষ্টে যুদ্ধ করে জেতার পর আজকাল বাচ্চাদের পড়তে বসতে হয়। তা মনিসাকে দেখলেই বুঝা যায়। পদ্য চা নিয়ে এলো। বাবা-মা’কে দিল। মনিসা পিছু ফিরে বললো, ‘আমাকে দেবে না?’

পদ্য ওকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘তার কি উপায় আছে?’

মনিরা বেগম চুপচাপ বিছানায় বসে আছেন। পদ্য বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আম্মাকে আলাদা একটা রুমে মশারির ভেতরে রাখলে কেমন হয় আব্বা?’

তিনি কিছুই বুঝলেন না। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘কেন, কি হয়েছে?’

– ‘এভাবে সবার সঙ্গে বসে, শুয়ে এতেকাফ হয় না-কি?’

– ‘কি বলিস এসব?’

– ‘আমার আম্মা যে এতেকাফে ঢুকছে দেখো না? কারও সঙ্গে কথা বলে না সে।’

মতিন সাহেব হাসলেন। হেঁসে বললেন, ‘কই আমাদের সাথে তো কথা বলে, তুই কি কষ্ট দিয়েছিস দেখ। তোর সঙ্গেই বন্ধ করেছে।’

পদ্য মা’কে দুইহাতে প্যাঁচিয়ে ধরে মাথায় গাল ঠেকিয়ে বললো, ‘তাই না-কি আম্মা? এটা কেমন এতেকাফ হলো। সবার সঙ্গে কথা বলো শুধু আমি ছাড়া। না-কি ঘরের মানুষের সঙ্গে কথা বলা যায়। আমি ঘরের না, বাইরের মেয়ে?’

মনিরা বেগমের রাগটা উধাও হয়ে গেল। হুটহাট রাগ চলে যাওয়ারও একটা যন্ত্রণা আছে। তখন রেগে থাকার অভিনয় চালিয়ে যেতে হয়। মনিরা বেগম বললেন, ‘আমার কাছ থাইকা সর, লা*ত্থি দিব বললাম। সর আমার কাছ থাইকা, আহ্লাদ দেখাইবি না আমাকে।’

– ‘হ্যাঁ লা*ত্থিই তো দিবা, কোনোভাবেই আমাকে ঘর থেকে তাড়াতে পারোনি তো৷ এখন লা*ত্থি দিয়ে বের করা বাকি আছে।’

মনিরা বেগমের গলা ধরে এলো। তিনি মতিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বললেন, ‘শুনছো তোমার মেয়ের কথাবার্তা?’
মতিন সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হাসলেন।

রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে৷ পদ্য চোখবুজে আছে। চোখে ঘুম নেই। মানুষের অনেক রকম নেশা আছে। সেরকম নেশার মাঝে হয়তো স্মৃতি রোমন্থনও একটা। পদ্যের আজকাল স্মৃতি রোমন্থন করতে প্রচণ্ড ভালো লাগে। অতীতের একেকটা ঘটনা নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকে। অতীতের অতি তুচ্ছ ঘটনাগুলোও তার কাছে খুবই মজার মনে হয়। এই যে সন্ধ্যার চা খাওয়ার ব্যাপারটা। তখন এইটে পড়ে পদ্য। অনিক সিক্সে। ভীতু, লাজুক ছেলেটা তখন খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ক্লাস সিক্সে হঠাৎ দেখা গেল মানুষকে চেতনে-অবচেতনে অনিক মিমিক্রি করছে। কখনও একা। কখনও সবার সামনে বসে আনমনে। সেদিন সন্ধ্যায় ওর সঙ্গে অনিক পড়তে এসেছে। গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি তখনও। হারিকেনের হলদে নরম আলোয় তারা বারান্দায় শীতলপাটিতে বসে উচ্চস্বরে পড়তো। একদিন শীতলপাটি বিছিয়ে হারিকেন রেখে পদ্য বই আনতে ভেতরে চলে গেল। আসার সময় দরজার কাছ থেকে দেখে অনিক আসন পেতে বসে চোখবুজে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। পদ্য আরও খানিকটা আড়ালে চলে যায়। খানিক পর দেখে অনিক, চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে কর্কশ গলায় বললো, ‘নাঈমের মা তোমার কি হয়েছে? দেখি চা-টা কিছু দেওয়ার হইলে দাও।’

তার কথা বলার অদ্ভুত ভঙ্গি দেখে পদ্য হাসতে হাসতে মেঝেতে বসে যায়। অনিক ঘটনাটা টের পেয়ে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। পদ্য নিজেকে সামলে নিয়ে এসে পাটিতে বই রেখে বললো, ‘একা একা তুমি কি করছিলে অনিক?’

সে লজ্জায় মাথা নুইয়ে পাটিতে নখ দিয়ে খুঁটতে খুঁটতে বললো, ‘কিছু না।’

– ‘তুমি কিছু একটা বলছিলে তো। আমি শুনলাম। তুমি নাঈম ভাইয়ের নাম ধরে কি যেন বলেছিলে।’

সে কোনো জবাব দেয় না। পদ্য কাছে এসে থুতনি ধরে মুখ তুলে বললো,

– ‘বলবে না আপুকে?’

অনিক আরও বেশি লজ্জা পেল। পদ্য হাসতে হাসতে বললো, ‘লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আমার অনেক ভালো লেগেছে তো। আবার করো। প্লিজ করো।’

অনিক সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে অবিকল আগের মতো করে একা একাই হাসলো। পদ্য হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো, ‘নাঈমের মা তোমার কি হয়েছে? দেখি চা-টা কিছু দেবার হইলে দাও।’ এ কথার মানে কি?

অনিক বললো, ‘আব্বা প্রতিদিন মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে বিছানার আসন পেতে বসে দুলতে দুলতে গুনগুন করে তসবিহ পড়েন, দোয়াদরুদ পড়েন, তারপর হঠাৎ কর্কশ গলায় বলেন, চা-টা কিছু কি হইল..। দেখে তখন মনে হয় আব্বা আর আম্মার ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছে। আসলে তেমন কিছুই না।’

কথাগুলো শুনে তখন পদ্য আবারও হেঁসেছিল। সেই হাসিটা স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু স্মৃতি রোমন্থন করে মাঝরাতে একা একা খিলখিল করে হাসা স্বাভাবিক নয় বটে। তাই মনিসা কনুই দিয়ে তাকে পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘ভূ*তে ধরছে না-কি আপু? একা একা হাসছো কেন?’

– ‘হ্যাঁ, আমাকে ভূ*তে ধরছে তুই ঘুমা।’

– ‘মাঝরাতে কেউ খিলখিল করলে ঘুমাবো কিভাবে। ভয় লাগে।’

– ‘তাহলে এখান থেকে চলে যা। না হলে হঠাৎ দেখবি আমার জিভ হাতের মতো লম্বা হয়ে মুখ থেকে বাইরে ঝুলে আছে। চোখ দু’টা থেকে র*ক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। আমি তোর ঘাড় ধরে আছি ম*টকে দেয়ার জন্য…।’

মনিসা বালিশ নিয়ে সত্যি সত্যি উঠে চলে গেল মায়ের কাছে। পদ্য মুচকি হেঁসে পাশ ফিরে মোবাইল হাতে নেয়। অনিককে ব্লক মারার আগে অসংখ্য মেসেজ দিতো ছেলেটা। রিপ্লাই না দিলেও দিতো। মাঝে মাঝে রেকর্ড পাঠাতো। সেসবের স্ক্রিনশট নিয়ে নিয়ে সে একটা ফাইলে রেখেছিল। আজও আছে। অনেক কবিতা আবৃত্তিও আছে ওর। এখন সেসব দেখলে বা রেকর্ড শুনলে গা কাটা দিয়ে উঠে। একটা ছেলের এত আবেগ থাকে? এত সুন্দর পুষ্পের মতো মনও হয়? অনিককে না দেখলে সে জানতো না।
পদ্য ওর একটা অডিও বের করলো। মানুষটার ভয়েজ শুনতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। চ*ড় খেয়ে যাওয়ার পর একদিন মধ্যরাতে হেলাল হাফিজের “প্রস্থান” কবিতাটা ভয়েজ রেকর্ড করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিল। পদ্য ইয়ারফোন কানে গুঁজে প্লে করলো। অনিক তাকে ফিসফিস করে বলতে শুরু করে,

“এখন তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ? পত্র দিও।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালীর তালপাতাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে পত্র দিও।
ক্যালেন্ডারের কোন পাতাটা আমার মত খুব ব্যথিত
ডাগর চোখে চেয়ে থাকে তোমার দিকে, পত্র দিও।
কোন কথাটা অষ্টপ্রহর কেবল বাজে মনের কানে,
কোন স্মৃতিটা উস্কানি দেয় ভাসতে বলে প্রেমের বাণে
পত্র দিও , পত্র দিও।
আর না হলে যত্ন করে ভুলে যেয়ো, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কি তাতে?
আমি নাহয় ভালবেসে ভুল করেছি, ভুল করেছি
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায়?
এক জীবন কতটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতটা আর কষ্ট দিবে?”

একেকটা লাইন পদ্যের বুকের ভেতর ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। চিনচিনে এক ব্যথা করছে বুকে। গলার কাছটায় কান্না যেন দলা পাকিয়ে এসেছে। এত বিষাদমাখা কণ্ঠে অনিক কথাগুলো পড়ছে৷ মানুষটা তাকেই বলছে। পদ্য বারবার শেষের কথাগুলো শুনতে লাগলো,

“আর না হলে যত্ন করে ভুলে যেয়ো, আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে, কার কি তাতে?
আমি নাহয় ভালবেসে ভুল করেছি, ভুল করেছি
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরে নির্জনতা খুন করেছি, কি আসে যায়?
এক জীবন কতটা আর নষ্ট হবে,
এক মানবী কতটা আর কষ্ট দিবে?”

পদ্য শেষ অবধি কেঁদেই ফেললো। দুইহাতে মুখ ঢেকে এই অন্ধকার রাত্রে একা একা ফুঁপা কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো সে৷ এছাড়া আর কি করার আছে তার? মানুষটাকে সে কোনোভাবেই পাবে না জানে। একটু মন খুলে কথাও বলতে পারবে না৷ সেও ভীষণ ভালোবাসে, এটাও বুঝতে দেয়া যাবে না। ওর জন্য না হয় একজীবন খুব নীরবে কেবল কেঁদেই যাবে। অনিক হোয়াটসঅ্যাপে প্রফাইল চেঞ্জ করলে, সে সেভ করে রাখে। মাঝে মাঝে আনব্লক করেও আবার ব্লক দেয়। এখন অনিকের হোয়াটসঅ্যাপ প্রফাইলে কোনো একটা অনুষ্ঠানের ছবি। অনিক মাইক হাতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছে৷ সেখানে মুখটা ওর পুরোপুরি স্পষ্ট নয়। তাই পদ্য নিজের মোবাইলের ফাইল থেকে একটা ছবি বের করে। সে ছবিটা বড়ো করে দেখতে দেখতে আনমনে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় মোবাইলের স্ক্রিনে।
__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_৯
.
সন্ধ্যায় দু’জন একই সঙ্গে টিউশনি থেকে ফিরেছে। এ বাসায় ইভার বেশ কয়েক মাস কেটে গেল৷ এখন নিজেরই বাড়ি মনে হয় তার। মানুষগুলোও কেমন যেন। খুব সহজে আপন করে নিয়েছে তাকে৷
ইভা এখন নিজ থেকে কিছু কাজ-কর্ম করে। ওরা স্বামী-স্ত্রী অফিসে থাকে, সে এসে ঘর-দোর গুছায়। অনিক ভাইকে টেবিলে খাবার দেয়। যখন যা দরকার আগ্রহ নিয়ে সাহায্য করে। উনিও তাকে টিউশনি থেকে রাতে বাসায় নিয়ে আসেন। মাঝে মাঝে ঘুরতে নিয়ে যান। মানুষটাকে সে প্রথমে অনেক ভুল বুঝেছিল৷ আসলে ভেতরটা ভালো। বাইরে শুধু লাগামছাড়া আর উদ্ভট কথাবার্তা। ভেতরে ভেতরে অনেক কেয়ারিং। তা না হলে কি তাকে জুঁইদের বাসার সামনে থেকে রোজ গিয়ে নিয়ে আসতেন? মোটেও না। আরেকটা টিউশনিও দিয়েছেন জোগাড় করে৷ ভোরেও পড়াতে যায় ইভা। তবে মানুষটাকে পুরোপুরি বুঝা যায় না। মাঝে মাঝে মনে হয় উনি খুবই দুঃখী৷ তা কেন মনে হয় ইভা নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে অনিক ভাই থেকে সুখী মানুষ এই সংসারে খুবই কম আছে। হাসি-খুশি মুখ, সারাক্ষণ রসিকতা, যা ইচ্ছা বলে ফেলা, চাকরি না করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো। এগুলো দেখে তো যেকেউ বলবে ভালোই আছেন৷ তবুও সবকিছুতে একটা কিছু যেন আছে, বিষাদের সুর। টের পায় ইভা। উনার সঙ্গে যতক্ষণ থাকে সে, কেন যেন প্রচণ্ড ভালো লাগে। অদ্ভুত মানুষ, যার মুখে সারাক্ষণ উদ্ভট কথাবার্তা, তার সঙ্গ ভালো লাগার কারণ কি আসলে? ইভা বুঝতে পারে না। সে খুব একটা চিন্তাশীল মানুষও নয়। তবুও অনিক ভাইয়ের কিছু বিষয় সে খেয়াল করেছে। উনি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে তুচ্ছ করে দেখেন, আর তুচ্ছ বিষয়গুলোকে বড়ো করে৷ টাকা-পয়সা থেকে পৃথিবীতে বড়ো কিছু কি আছে? আসলেই নেই৷ কিন্তু এগুলো উনার কাছে, তুচ্ছ। খুবই তুচ্ছ। ইভা এরকম মানুষ জীবনে দেখেনি।

এই ব্যাপারগুলো মাঝে মাঝে তার মাঝেও চলে আসে, তখন সবকিছু ভীষণ ভালো লাগে। সকল দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়। খুবই ডিপ্রেশনে কেউ আছে, ইভার ধারণা অনিক ভাইয়ের সঙ্গে মিশলে উধাও হয়ে যাবে৷ কারণ যে কারণে সে ডিপ্রেশনে, সেটাই অনিক ভাই তুচ্ছ করে দেবেন। কিছু কিছু বিষয়ে এখনও ইভার প্রচণ্ড রকমের রাগ উঠে।
এইতো, সেদিন রিকশায় আসার সময় ইভা বলেছিল, ‘আচ্ছা অনিক ভাই, আপনার কি প্রেমিকা নেই?’

তিনি আনমনা ছিলেন। প্রশ্ন শুনে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘আমার?’

– ‘হ্যাঁ আপনার।’

– ‘আমি তো বিয়ে-শাদি করবো না। তাই প্রেমও করি না৷ কেউ আমার প্রেমে পড়ুক, তাও চাই না।’

– ‘বিয়ে-শাদি করবেন না কেন?’

তিনি এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে সিরিয়াস মুখে ইভার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই ইভা শোনো, তুমি দেইখো আবার ভাইয়ার প্রেমে-টেমে পড়বে না। এসব আমার দ্বারা হবে না, অকারণ কষ্ট পাবে।’

ইভা ভীষণ অপমানবোধ করলো৷ কোনো মেয়েকে কেউ এভাবে বলবে? তোমার ভাই এত পণ্ডিত হয়ে কি লাভ, একটা মেয়ের সঙ্গে যদি সুন্দর করে কথা বলতে না জানো? এই যে বললেন, ‘এই ইভা শোনো, তুমি দেইখো আবার আমার প্রেমে-টেমে পড়বে না’ এই কথা কাউকে বললে সে অপমানবোধ করবে না? এটা কি বুঝার মতো জ্ঞান নেই উনার? এগুলোই ইভার বিরক্ত লাগে, প্রচণ্ড রাগ হয়।
সেও তাচ্ছিল্য করে জবাব দিয়েছিল,
– ‘আমি কোনো সিগারেটখোরের প্রেমে পড়বো ভাবলেন কি করে? নিজেকে কি ভাবেন আপনি। সালমান খান?’

অনিক ভাই তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হেঁসে বললেন, ‘গুড গার্ল, এইতো ঠিক আছে।’
এই কথা শুনে ইভার আরও বেশি রাগ উঠেছিল৷ শরীর যেন জ্বলে যাচ্ছিল রাগে। এমনভাবে বলেছিলেন, ‘গুড গার্ল’। যেন সে গায়েপড়া মেয়ে। উনার সাথে প্রেম করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন প্রেম করবে না বলায় খুশি হয়ে বলেছেন, ‘এইতো গুড গার্ল।’

এখন দু’জনই টিউশনি থেকে ফিরেছে। অনিক ভাইয়ের একটা লেখার অংশ সামনে বসে পড়তে হবে। হাত-মুখ ধুয়ে চা বসিয়ে দিল সে। মানুষটা চা ভীষণ পছন্দ করে। এটা খেয়াল করেছে ইভা। কিন্তু নিজে জ্বাল দেবে সেই খেয়ালটুকুও যেন উনার থাকে না। কেউ চা নিয়ে গেলে বেশ খুশি হন। সেটা দেখেই বুঝা যায়। ট্রে-তে করে দু-কাপ চা নিয়ে অনিকের রুমের দিকে গেল সে। বাতি জ্বলছে। অনিকের হাতে একটা বই। ইভা তাকিয়ে দেখে ‘সত্যের সন্ধানে’ নিচে লেখা আরজ আলী মাতব্বর। সে ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘আরজ আলী মাতব্বুর’ আবার কে?’

অনিক বই থেকে মুখ সরিয়ে উঠে বসে বললো, ‘বাহ চা নিয়ে এসেছো, ধন্যবাদ।’

ইভা বসলো। অনিক চা হাতে নিয়ে চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘এই রাইটারের কথা বলছিলে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘উনি কবি বা ঔপন্যাসিক না। একজন বাংলাদেশি দার্শনিক। এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হলো উনার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই ছিল না। কৃষক ছিলেন। শুধু লাইব্রেরিতে বই পড়তেন। লোকে তাকে স্বশিক্ষিত বলতো। তার লেখা বই পড়ে অবাকই হতে হয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে এত জানলো কিভাবে? তার লেখায় অনেক জিজ্ঞাসা, এই পৃথিবী, মানুষ, জগৎ নিয়ে অনেক ভয়ংকর প্রশ্ন। চমকে দেয়ার মতো যুক্তি। যদিও সেসবের উত্তর এখন অনেকেই দিয়েছেন, দিচ্ছেন।’

‘বাবা এগুলোতে আমি নাই’ তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘ভুলেই গিয়েছিলাম, বাসায় এত মশা৷ যাই অ্যারোসল দিয়ে এসে বসি।’

ইভা গিয়ে আফরা এবং ওর রুমে স্প্রে মে’রে এসে বললো, ‘অনিক ভাই সিটিং রুমে চলে আসুন। স্প্রে দেই। ওখানে বসে আপনার লেখা পড়ে নিব।’

অনিক চায়ের কাপ রেখে বললো,

– ‘আসো, ভেতরে আসো।’

– ‘রুমে থাকলে ক্ষতি হবে তো বের হোন।’

অনিক একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো,

– ‘এই বস্তু আমার রুমে লাগবে না।’

– ‘কেন, মশা কি আপনার রুমে নাই?’

– ‘তা প্রচুর আছে।’

– ‘তাহলে কি কামড়ায় না?’

– ‘সুযোগ পায় না। তাদের অভিযোগটা হলো আমি ফ্যান ছেড়ে মুখ ঢেকে ঘুমাই। ফলে মশারি ছাড়া ঘুমানো ব্যক্তিকেও তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারে না।’

প্রথমে ইভা খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। তারপর ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘মানে, আমি প্রথমে খেয়াল করিনি৷ আপনি এই গরমেও মুখ ঢেকে ঘুমান? এখনও শীত আসেনি এতটা!’

অনিক আঙুল দিয়ে বিছানার দিকে দেখায়। ইভা অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো, ‘তাইতো, আপনি একটা অদ্ভুত, উদ্ভট লোক।’

অনিক হাসতে হাসতে বললো, ‘বিছানায় বসো, হোয়াটসঅ্যাপে দিয়েছি দেখো, পড়ো বসে।’

এই কাজটা ইভার জন্য ভীষণ কঠিন লাগে। উনি মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন৷ তার শব্দ করে পড়তে হয়৷ অবশ্য অংশগুলো ছোট্ট থাকে। এমনিতে পুরো উপন্যাস একা একা পড়ে শেষে বানান বা অনুভূতি ভালোমন্দ বললে হয়। কিন্তু উনার ‘বিশেষ অংশ’ নামে যে লেখা সামনে বসে পড়তে হয় তা অস্বস্তিকর। কেউ ‘হা’ করে তাকিয়ে আছে৷ তার সামনে বসে শব্দ করে পড়া বড়োই মুশকিল। সবচেয়ে মুশকিল হয় অংশটা যদি রোমান্টিক থাকে। ইভা লেখা বের করে পড়তে শুরু করলো। এই অংশটাও রোমান্টিক।
.
ভোরে ঘুম থেকে উঠে ‘আজ শুক্রবার’ মনে হতেই নাঈমের মনটা ভালো হয়ে গেল৷ অফিসে যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। ফুরফুরে মেজাজে পাশ ফিরে সে। আফরা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। চুলগুলো সরিয়ে ঠোঁট আলতো করে কপালে ছুঁয়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেল আফরার৷ ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে পাশ ফিরিয়ে নিল সে। নাঈমও নাছোড়বান্দার মতো অপর পাশে এসে জড়িয়ে ধরে ওর গলায় নাক ডোবায়। নাঈমের ছোঁয়া আর উষ্ণ শ্বাসে পুরোপুরি ঘুম ভেঙে গেল আফরার৷ সে চুল ধরে টেনে সরিয়ে বললো, ‘ভোরেই কি শুরু করলে তুমি?’

নাঈম ওর গালে হাত রেখে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘কেন, তুমি কি জানো না ভোরে পুরুষ মানুষদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইচ্ছা বেড়ে যায়?’

আফরা স্মিথ হেঁসে বললো,

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, ভোরে পুরুষ মানুষদের সে*ক্স হরমোন টেস্টোসটেরনের ক্ষরণ অন্য সময়ের তুলনায় বেড়ে যায়।’

– ‘আর মহিলাদের?’

– ‘রাতে।’

আফরা ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো,

– ‘তাহলে আমি কেন ঘুম নষ্ট করে ভোরে তোমাকে সঙ্গ দেবো? আমার কাছ থেকে সরো বলছি, সরো।’

নাঈম ওর হাত টেনে এনে চুমু খেয়ে বললো,

– ‘ভোরে যে এর আলাদা উপকারও আছে ম্যাডাম। ব্যায়াম হয়। পুরো রাত ঘুমিয়ে শরীর বসে যায়৷ ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে শরীরের রক্ত সঞ্চালনও বেড়ে যায়। সুতরাং রাতের থেকে ভোরে কি ভালো নয়?’

আফরা ফিক করে হেঁসে বললো,

– তাই বুঝি? আর ঘুম থেকে উঠে যে সবার মুখে দূর্গন্ধ থাকে, তার কি হবে?’

নাঈম আচমকা তাকে পাঁজাকোলা করে কোলে নেয়। আফরা খিলখিল করে হেঁসে উঠে বললো, ‘কি করছো?’

নাঈম কোনো জবাব না দিয়ে বাথরুমে চলে গেল। আয়নার সামনে আফরাকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নাও, ব্রাশ করো ম্যাডাম। আমিও করি।’

– ‘আজব! ছুটির দিন ঘুম থেকে তুলে কি পাগলামি শুরু করলে।’

নাঈম কোনো কথা না বলে পেস্ট লাগিয়ে দিল ওর ব্রাশে। তারপর পেছনের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজেও ব্রাশ করতে শুরু করে। দু’জনের ফ্রেশ হওয়া শেষ হতেই নাঈম পুনরায় তাকে কোলে করে নিয়ে এলো বিছানায়।

আফরা গোসল থেকে বের হলো সাতটার দিকে। নাঈম পুনরায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো আফরা। আজ সে শাড়ি পরবে। চুল মুছে তোয়ালে শুকিয়ে দিয়ে এসে একা একা শাড়ি পরে নিল। নিজেকে কেমন যেন অসহ্য রকমের সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। ইভার রুমে গিয়ে দেখে ও বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সে পশ্চিমের দরজা খুলে বারান্দায় গেল। সূর্যের কোমল নরম আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। সবুজ মাঠ আর পাহাড়ের ওপরে চা-গাছ দেখা যাচ্ছে। ইস নাঈম কখনও এই দৃশ্যটা দেখতে পায় না। মানুষটা অফিসে চলে যায়। আবার ছুটির দিনে বেলা করে ঘুমায়। এখন গিয়ে কি একটু ঝাড়ি দেবে? ঝাড়ি দিলেই বাচ্চা ছেলেদের মতো ঘুম থেকে উঠে যাবে। আফরা আবার রুমে চলে এলো। নাঈমকে ধাক্কা দিতে গিয়েও বুকটা হু হু করে উঠলো। মানুষটা ঘুমাচ্ছে, একটু শান্তিতে ঘুমাক না৷ সে আবার চলে এলো রান্নাঘরে। দীর্ঘ সময় রান্নাঘরে কাটিয়ে নাশতা বানিয়ে প্রথমে অনিকের রুমে এলো। ওর বিছানায় বসে মনে হলো, থাক ঘুমাক৷ আজ মন ভীষণ ভালো, মন ভালো থাকলে আফরার সকলের প্রতি কেমন ভীষণ মায়া লাগে৷ তখন কাউকে কষ্ট দেয়া সে কল্পনাই করতে পারে না। অনিককে ঘুমে দেখে উঠে চলে যাচ্ছিল। তখনই হাত ধরে ফেললো অনিক। ভালো ভাবে তাকিয়ে বললো, ‘বাহ শাড়ি পরেছো, সুন্দর লাগছে তোমাকে ভাবি। কেমন শান্ত-স্নিগ্ধ চেহারা। চোখে-মুখে তৃপ্তি, প্রশান্তির ছাপ।’

– ‘ও তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘কিন্তু তুমি না ঘুমে ছিলে?’

– ‘ঘুমে না, চোখবন্ধ করে শুয়ে আছি। কবিতার মতো কয়েকটা লাইন মাথায় এলো।’

– ‘বলো শুনি।’

আফরার হাত ধরে সে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“জীবন থেকে যেতে যেতে
কম যায়নি কাল,
অথচ আজও আমার কেউ নেই-
যে মুঠোফোনে কিংবা
কপালে হাত রেখে বলবে, ‘শুভ সকাল’।

আফরা ফিক করে হেঁসে বললো, ‘সুন্দর হয়েছে ডিয়ার দেবর। কিন্তু চাকরি-বাকরি করে বিয়ে করো। তাহলে তো একজন পেয়ে যাবে, যে ভোরে কপালে হাত রেখে ‘শুভ সকাল’ বলবে। তুমি বিয়েটাকে যত অশান্তির মনে করো, ততটাও কিন্তু না।’

অনিক হাত ছেড়ে দিয়ে বললো, ‘যাও তো, ফিলিংসটাই মাটি করে দিয়েছো। আরে বাবা বিরহ যে একটা ভালো লাগার বিষয়, কেউ সেটা বুঝতে চায় না৷ একটা বউ রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে সবাই আমার জীবনটাকে তছনছ করে দিতে চায়।’

‘হইছে, উঠে এসো, চা খাবে’ আফরা কথাটি বলে চলে যাচ্ছিল। আবার ফিরে এসে বললো, ‘আচ্ছা একটা কথা সত্যি করে বলবে ভাবিকে?’

– ‘জানি সেটা।’

– ‘কিভাবে জানো? বলো তো কি?’

– ‘যদি বলি তাহলে তুমি বলবে ‘চো*রের মনে পুলিশ পুলিশ’ তখন আর না করলেও বিশ্বাস করাতে পারবো না। তাই জিজ্ঞেস করে ফেল।’

– ‘না আগে বলো তুমি কি বুঝেছো? না হলে বলবো না।’

‘তাহলে যাই, আমি গিয়ে দাঁত ব্রাশ করি। আমার শোনার ইচ্ছা নেই’ অনিক কথাটা বলে বাথরুমে চলে গেল।

আফরা দরজায় নক করতে করতে বারবার বলছে, ‘অনিক তুমি কি শুনছো? আমি বলি কি বলতে চাচ্ছিলাম, অনিক শুনছো….?’

অনিক কোনো জবাবই দিচ্ছে না। ভোরটা সুন্দরভাবেই শুরু হয়েছিল। এখন কথাটা না বলতে পেরে কেমন অশান্তি লাগছে আফরার।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here