ছন্দহীন পদ্য পর্ব -১২+১৩

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১২
.
রাতে স্মৃতি রোমন্থন করে পদ্য কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি। ঘুম থেকে উঠেছে দেরিতে। অসুখী, দুঃখী, অসুস্থ, অস্থির মানুষেরা বোধহয় অনিদ্রার সমস্যায় ভুগে, অথবা ঘুম অনেক বেশি বেড়ে যায়। পদ্যেরও তাই হয়েছে। ঘুম বেড়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে গোসল করে নিল সে। মনিরা বেগম টেবিলে খাবার দিলেন। দেরিতে ঘুম থেকে উঠলে তিনি চা-নাশতা না দিয়ে ভাত দেন। পদ্যের খেয়ে যেতে ইচ্ছা না করলেও মায়ের জন্য খেতেই হয়। খেয়ে-দেয়ে বোরখা-নেকাব পরে উঠানে বের হতেই দেখে পুকুর পাড় দিয়ে আতাই ঘটক আসছে। থুতনিতে দাঁড়ি, সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরনে৷ ঠোঁটের এককোণে সুপারির লাল রস দেখা যাচ্ছে। পদ্যের বুকটা কেঁপে উঠে। কেন এসেছে কে জানে। মতিন মাস্টার বারান্দার চেয়ারে বসা ছিলেন। ঘটককে দেখে এগিয়ে গেলেন। পদ্য দাঁড়িয়ে আছে দেখে মনিসা তাড়া দিয়ে বললো, ‘আপু আসো।’

সে পিছু ফিরে তাকিয়ে হাঁটে। স্কুলে গিয়ে পুরো দিন গেল তার একধরনের অস্থিরতায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে মা-বাবাকে খুবই হাসি-খুশি দেখা গেল। আছরের নামাজ পড়ে মতিন মাস্টার চটের ব্যাগ নিয়ে বাজারের জন্য বের হলেন। অন্যদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কাউকে বাজারে যাওয়ার মতো পেলে টাকা আর ব্যাগ দিয়ে দেন। ওরা বাজার করে বাড়ি এসে দিয়ে যায়। দেবেই না কেন, গাঁয়ের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই উনার প্রাক্তন ছাত্র। আজ ফিরছেন না দেখে মনিরা বেগম পদ্যকে বললেন, ‘কিরে পদ্য, তোর আব্বা এই শরীর নিয়ে বাজারে চলে গেল না-কি।’

পদ্য বিছানা ঝাড়ু দিতে দিতে বললো, ‘কাউকে মনে হয় রাস্তায় পায়নি আম্মা।’

– ‘কি যে বলিস। বিকালে কত লোক বাজারে যায় এদিকে।’

– ‘তাহলে রাস্তা থেকে দেখে আসো গিয়ে।’

– ‘হ্যাঁ দেইখা আসি।’

মনিরা বেগম গিয়ে দেখে এসে বললেন, ‘নাই কোথাও, হাই প্রেশার নিয়া বাজারে না গেলে হত না তার?’

– ‘চিন্তা করো না তো আম্মা। রাস্তা-ঘাটে মানুষ আছে। বাজারে যাক, সবার সাথে দেখা হবে। হাঁটাচলা হবে। তাতে শরীর ভালো থাকবে। তুমি আব্বাকে বাড়িতে আঁটকে রেখে আরও অসুখ বাড়াচ্ছ।’

– ‘হ্যাঁ পন্ডিত হইছিস। উনি বাজার টেনে আইনা খাইয়ে বিছানায় পড়ে মরু*ক। তোর ভাই আছে তো দু’একটা৷ বাপ ম*রলে বুঝবি দুনিয়ায় ব্যাটা মানুষ না থাকলে কি হয়।’

– ‘কোন কথা থেকে কোথায় চলে গেলে আম্মা। আর বাজারে কি আমি পাঠালাম না-কি। আর তোমার ছেলে নাই কে বললো। আমি আছি না। আমিই তো তোমার ছেলে-মেয়ে সবকিছু।’

– ‘ঢং করবি না আমার সাথে। তোর ঢং এর কথা শুনলে আমার গা জ্বলে। তোর চিন্তায় আরও মানুষটার অসুখ ছাড়ে না।’

মনিসা বাড়ির পাশের মাঠে খেলতে যাচ্ছিল। কয়েকদিন থেকে তারা গোল্লাছুট খেলে। মনিরা বেগম হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে পিঠে ধড়াম করে কি*ল দিয়ে বললেন, ‘বিকাল হইতেই চলে যাচ্ছিস তিড়িংতিড়িং করতে। ওইদিকে অসুখ নিয়া বুড়া বাপ বাজারে গেল না-কি কোথাও পড়ে ম*রলো সেই খেয়াল তো তোদের নাই৷ ম*রলে বুঝবি। এর আগে না।’

মনিসা কি*ল খেয়ে বক্র হয়ে পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ পদ্য হেঁসে বললো, ‘আম্মা অকারণ কি শুরু করলে তুমি। চটের ব্যাগ কি এত ভারী যে আব্বা নিয়ে আসতে পারবে না?’

– ‘তোলা বহন করতে করতে লোহার ভার হয়, বুঝলি? এইগুলার তোরা কি বুঝবি। লোকটার শরীরের বাতও আছে। পা ফুইলা থাকে সারাক্ষণ৷’

– ‘আচ্ছা, আব্বার আসতে দেরি আছে। মনিসা আর তুমি সন্ধ্যার আগে খেয়াঘাটে চলে যেও। আব্বা যেভাবেই হোক সন্ধ্যার আগেই ফেরার চেষ্টা করবে।’

মনিরা বেগম কিছু না বলে রান্নাঘরে চলে গেলেন। মনিসা ধীরে ধীরে বারান্দায় গিয়ে হঠাৎ দৌড়ে চলে গেল মাঠের দিকে৷ মাগরিবের ঠিক আগে৷ মনিরা বেগম পুকুরে অজু করছেন। দেখলেন হাসি হাসি মুখে মতিন মাস্টার আসছেন। তিনি কিছুই বললেন না৷ ঘরে যেতেই পদ্য ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো, ‘বাবা সিগারেটের গন্ধ কোত্থেকে এলো?’

মতিন মাস্টার ফতোয়া খুলে রাখতে রাখতে বললেন, ‘খাই না তো রে মা। বাজারে লোকজনের সাথে বসলাম। হাতে ধরিয়ে দিল। তাই আরকি এক, দুই টান।’

– ‘তোমার শরীরের অবস্থা নাই৷ আবার সিগারেটে না টানলে হয় না আব্বা? তোমার বাজারেই বা যাওয়ার কি দরকার।’

মনিরা বেগম ঘরে ঢুকলেন। মতিন সাহেব বিছানায় বসে বললেন, ‘কৈ মাছ এনেছি পদ্যের মা। মেয়েটা কৈ মাছ ভুনা অনেক পছন্দ করে।’

মনিরা বেগম জবাব না দিয়ে চলে গেলেন। পদ্য বাবাকে এনে এক গ্লাস পানি দিল। মতিন মাস্টার গ্লাস হাতে নিয়ে বললেন, ‘বস মা, পাশে বস।’

– ‘চা বসাবো আব্বা।’

– ‘তোর মা পারবে। তুই এখানে বস।’

পদ্য বসলো বাবার পাশে। তিনি তিন চুমুকে পানি খেয়ে বললেন, ‘পানি খেতে হয় তিন চুমুকে, এবং বসে বসে।’

– ‘তোমাকে আজ এত খুশি খুশি লাগছে কেন আব্বা।’

– ‘মা রে এতদিন কত ছেলে দেখলাম। ঘর জামাই বানানোর মতো কোনো ভালো ছেলেই পাওয়া যায়নি। একটা গাঁ*জাখো*র মিলে তো আরেকটা ভ*ণ্ডা। এখন এমন একটা যুগ। কে ভালো কে মন্দ বুঝা মুশকিল। সকল পোলাপানকে একই রকম লাগে। আমাদের সময় ভণ্ড, গুন্ডা-ফান্ডাদের দেখলেই চেনা যেত। এদের হাতে আর গলায় মোটা মোটা চেইন। চুল লম্বা। বসতো গাছের গোড়ায় না হয়ে দেয়ালে। এগুলোই আড্ডার জায়গা। তাদের প্রধান খেলা ছিল তাস। এখন এরকম না…।’

পদ্য থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘তুমি এত কথা কেন বলছো আব্বা? কথা বলতে বলতে তো হাঁপিয়ে যাচ্ছ৷ কি বলতে চাও সেটা বলো।’

– ‘কথা হলো মা, একটা ভালো ছেলে পাইছি। আতাই ঘটকই আলাপ এনেছে। ছেলের ত্রিভুবনে কেউ নাই। থাকে মামার বাড়ি। কৃষিকাজ করে মামার সাথে। আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে মসজিদে গিয়ে। মাঝে মাঝে মুয়াজ্জিন না থাকলে না-কি আজানও দেয়। বাজারে দেখা করিয়ে দিল আতাই ঘটক। দূর থেকে দেখা আরকি। চায়ের দোকানে বসে আছি। পোলা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ঘটক বললো ওই দেখো যায়।’

পদ্যের মুখ মলিন হয়ে এলো। এরকম কিছুই সে আঁচ করেছিল। মনিরা বেগম এসে বললেন, ‘তুমি ছেলে দেইখাও আসছো তাহলে।’

– ‘হ্যাঁ, ঘটক বলেছিল বাজারে গেলে দেখাইতে পারবো।’

মনিরা বেগম বিছানায় বসে বললেন, ‘পদ্য যা তো চা দেখ গিয়া, বসিয়ে আসছি।’

তারপর মতিন সাহেবকে বললেন, ‘ছেলে কেমন দেখতে?’

– ‘কেমন দিয়ে কি হবে মনিরা। মানুষ হলো আল্লাহর দান। তার ভেতরই আসল। বাইর খোলস। ছেলেটা কিছু খাটো।’

– ‘থাকুক খাটো, ঘর-জামাই করে বিয়ে দিতে হলে এত ছেলে খুঁজাখুঁজি করে কই পাবে?’

– ‘হ্যাঁ, তাছাড়া ছেলে যত নরমাল হবে। ততই ভালো। পদ্যের কথায় উঠবে-বসবে। ঘর-জামাই এরকমই হওয়া ভালো।’

মনিসা খানিক পর এসে পড়ার টেবিলে বসলো। পদ্য এসে চা দিল তাদের। মনিরা বেগম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘সবকিছু ঠিক কইরা এত লোক জানাজানি না করে বিয়া দিয়া দাও। লোক আগে জানাইলে কত জনের কত কথা৷ জামাই খাটো, ঘর-জামাই কইরা বিয়া দিছে কত কি বলবে। এর চাইতে একদিন ওরা এসে দেখে বিয়ার তারিখ ঠিক করে নিক।’

মতিন মাস্টার বিছানায় পা তুলে বসে বললেন, ‘সে কথাও আমি বলেছি। ছেলের মামাকে নিয়ে একদিন আসুক। পছন্দ হইলে একদিন কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়িয়ে দেবো। শেষ।’

পদ্য রান্নাঘরে চলে গেল। রান্নাঘরের পালায় হেলান দিয়ে জলচৌকিতে বসলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মুখ থেকে একটা শব্দ, একটা কথা বের করারও আর যেন পথ খোলা নেই। কি করবে সে কথা বলে? অকারণ নিজের মা-বাবাকে হয়রানি করা ছাড়া কাজের কাজ কি কিছু হবে? এই যে ঘর-জামাইয়ের কথা বলেছিল। ওরা পাগলের মতো ছোটাছুটি করে বের করেছে এমন ছেলে। এখন যদি বলে এই ছেলে পছন্দ হয়নি। তারা আরেকটা ছেলে খুঁজবে। এর শেষ আসলে কোথায়? কিছুই ভালো লাগছে না৷ কিছুই ভাবতে পারছে না। চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমে চোখবুজে আসতে লাগলো। কি অদ্ভুত। চিন্তার সময় মানুষের ঘুম আসে না। অথচ সে চোখ টেনে খুলে রাখতে পারছে না। রাতে ভাত খেতে ডাকলেন মনিরা বেগম। সে ঘুম ঘুম গলায় বললো ‘ক্ষিধে নেই। আজ খাবে না।’ অনেক্ষণ ডেকেও তিনি নিতে পারলেন না। কিন্তু সেই যে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে গেলেন, পদ্যের আর ঘুম এলো না। উলটো মাথা ব্যথা শুরু হলো। মনিসাও বাতি নিভিয়ে পাশে এসে শুয়ে পড়ে। পদ্য মাথা ব্যথা নিয়ে মধ্যরাত অবধি ছটফট করে কাটিয়ে দিল। তার বমি পেল রাত তিনটার দিকে৷ তাড়াতাড়ি উঠে বারান্দায় গেল বমি করতে। মনিরা বেগম বমির শব্দে শুনে বাতি জ্বালিয়ে বাইরে গিয়ে দেখলেন পদ্যকে।

– ‘কিরে পদ্য, শরীর খারাপ করছে না-কি?’

– ‘আম্মা পানি দাও।’

মনিরা বেগম গ্লাসে করে পানি এনে দিলেন। সে কুলি করে, মুখ ধুয়ে পুনরায় বিছানায় চলে এলো। মনিরা বেগম পাশে বসে বললেন, ‘কি হয়েছে হঠাৎ?’

– ‘মাথা ধরছে আম্মা, কিছু না, তুমি যাও।’

– ‘বমি করেছিস মাথা ধরা কমবে এখন। ভাত এনে দেই অল্প খা।’

– ‘না তুমি বাতি নিভিয়ে যাও তো। আলো সহ্য হচ্ছে না।’

মনিরা বেগম বাতি নিভিয়ে চলে গেলেন। পদ্যের মাথা ধরা কিছুটা কমেছে। কিন্তু আবারও চিন্তা শুরু হয়ে গেছে৷ কি করবে আসলে সে? অনিককে রেখে আরেকজনের সঙ্গেই বা সে সংসার করবে কিভাবে? আরেক ছেলেকেই বা সে কি দেবে? শরীর ছাড়া কি কিছু দিতে পারবে? অনিকের মতো ছেলেকে ভালোবাসার পর আর কোনো ছেলেকে কি ভালোবাসা সম্ভব? বমি করতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল। সেবার পদ্যের ভীষণ জ্বর। অনিক অনেকটাই বড়ো হয়ে গেছে। ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। কথাবার্তায় আরও বেশি বড়ো। কথা বলার সময় কোনটা রসিকতা আর কোনটা সিরিয়াস বুঝা ছিল মুশকিল। মানুষকে পলকে বোকা বানিয়ে ফেলতো। একটা সময় পদ্যের মনে হতো অনিকের কাছে অসাধ্য বলতে কোনোকিছুই নেই। অথচ সে ছাড়া কেউ সেটা জানে না। লম্বাও বেশ হয়ে গিয়েছিল তখন। পদ্যের নিজেকে ওর থেকে ছোটই মনে হতো। গরমের দিন তখন। পদ্যের প্রচণ্ড জ্বর। রাত এগারোটার দিকে অনিক তার ফোনে কল দিল। তখন তাদের দুজনেরই মোবাইল আছে। ঘরের মোবাইল থাকতো পদ্যের কাছে। অনিককে তার চাচা দিয়েছিলেন ইংল্যান্ড থেকে। অনিক কল দিয়ে বললো, ‘আপু দরজা খুলো। তোমাকে দেখে যাই।’

পদ্যের অবস্থা জ্বর-সর্দিতে নাজেহাল। রূঢ় গলায় বললো, ‘এখন কেন আসছো অনিক? আমরা ঘুমিয়ে গেছি।’

– ‘অসুস্থ মানুষকে যখন-তখন দেখতে আসা যায় আপু। ঘুমানোর আগে দেখে যাওয়াটা কর্তব্য। রাত মানে কত ঘণ্টা জানো? এই সময়ে একজন অসুস্থ মানুষের কত কিছু হয়ে যেতে পারে। তাই রাতে দেখা যাওয়া নিয়ম।’

– ‘ফা*জিল, এখন আমার জ্বর নিয়ে উঠে খুলে দিতে হবে।’

– ‘তুমি কি দিচ্ছ?’

– ‘হ্যাঁ, দাঁড়াও দিচ্ছি।’

হাসতে হাসতে বললো,

– ‘ওয়েট, ওয়েট, উঠা লাগবে না এখন শুয়ে থাকো।’

– ‘কেন? আসছো যখন ফিরে যাবে কেন?’

– ‘আমি আসিনি এখনও, দেখলাম খুলে দেবে কি-না। আসছি একটু পর।’
বলেই কল কেটে দিল সে। মিনিট তিরিশেক পড়েই এসে দরজায় নক দিল। মা এসে দরজা খুলে দিলেন। পদ্য বিছানা থেকে তাকিয়ে আছে। স্মিথ হাসছে সে। অনিক হয়তো মা’কে দেখে বিব্রত হবে। কারণ সে ভেবেছিল পদ্য দরজা খুলে দিবে। কিন্তু অনিক বিব্রত হলো না। কেমন করে যেন পুরো পরিবেশ তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল। মা দরজা খুলে তাকে বললেন, ‘কে, অনিক না-কি? এত রাতে।’

সে ভেতরে এলো। একটা চায়ের ফ্ল্যাক্স, বিস্কুট আর একটা বক্স। টেবিলে রাখলো। মা হেঁসে বললেন, ‘এসব কি বাবা?’

অনিক বিছানায় বসে বললো, ‘অসুস্থ মানুষকে দেখতে এলে না-কি কিছু নিয়ে আসতে হয়।’

– ‘কে বললো?’

– ‘সন্ধ্যার সময় যে এসেছিলাম তখন পদ্য আপু খোঁচাটা দিল। তাই এখন সাইকেল নিয়ে দোকানে গিয়ে নুডলস, বিস্কুট নিয়ে এলাম। এসে নিজে বানিয়ে রোগী দেখতে এসেছি। এখন রোগীর সেবাও করবো। তুমি ঘুমিয়ে যাও চাচি। পানি আর কোনো কাপড় দিয়ে যাও শুধু। জলপট্টি দেবো। আমি যাওয়ার পর আপু দরজা লাগিয়ে নিবে। তুমি ঘুমাও। আর একটা চামচ, দু’টা কাপ দিয়ো।’

পদ্য “হা” করে তাকিয়ে রইল। মনিরা বেগমও হাসতে হাসতে চলে গেলেন। পদ্য তখন ফিসফিস করে বললো, ‘আমি কখন খোঁচা দিয়ে বললাম রোগী দেখতে হলে কিচ্ছু নিয়ে আসতে হয়? এরকম মিথ্যে বলে এগুলো করার কারণ কি অনিক?’

পদ্যের স্পষ্ট মনে আছে, অনিক তাকেও বোকা বানিয়েছিল। তখন বুঝতে পারেনি, এখন বুঝে৷ তার চিন্তা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল। যাতে পদ্য তার আলাদা গুরুত্ব দেওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে। অনিক ঠোঁটে আঙুল রেখে ‘চুপ’ থাকতে ইশারা করে বিছানায় বসে ফিসফিস করে বললো, ‘আমরা এক সঙ্গে বড়ো হয়েছি কি-না বলো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আমরা কি বন্ধুর মতো না?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তো তুমি কি ছেলে বন্ধুর মতো আমার সঙ্গে থাকতে পারো? আমার ইচ্ছা করছিল দেখতে। অসুস্থ হয়ে পড়ে আছো ভাবলাম দেখে আসি৷ নুডলস, চা আমি লেখালেখির জন্য প্রায় রাতেই বানাই। তাছাড়া আমার ইউটিউবে তুমি কত কষ্ট করে ভয়েজ দাও। কৃতজ্ঞতাবোধও তো থাকে মানুষের। আমি কি এতই অকৃতজ্ঞ? তাই ভাবলাম এগুলো বানিয়ে নিয়ে যাই। বসে গল্প করবো, চা খাব। কিন্তু আসতে হলে দশবার ভাবতে হচ্ছে কারণ তুমি মেয়ে। চাচিও ভালোভাবে নিবে না। তাই এরকম মিথ্যে বললাম, বলতে হয়। তুমি এখন উলটো অবিভাবকদের মতো প্রশ্ন শুরু করেছো। কখনও এরকম করবে না। বরং তুমি এখন আন্টি এলে কি বলবে জানো?’

– ‘কি?’

– ‘বলবে আম্মা অনিককে চেনো না? সে ওই দেখো খাতা এনেছে। তার স্বার্থ আছে বলেই এগুলো নিয়ে এসেছে। এখন তার ওই লেখা পড়াবে আমাকে। লেখা ভালো হলো কি-না পড়িয়ে জানবে। আর জলপট্টি দিবে। চাও এনেছে। এর কারণ হলো তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যেন ভয়েজ দিতে পারি। তারই লাভ।’

– ‘কেন, এগুলো কেন?’

সে কপাল থেকে হাত সরিয়ে গাল টিপে ধরে বললো,

– ‘আবার বলো কেন? একটু ছল-চাতুরী ছাড়া কি আসতে পারতাম না-কি?’

– ‘সেটা না, তুমি এখন স্বার্থের জন্য এসেছো এটা কেন মা’কে বলবো?’

– ‘বুঝা লাগবে না। তুমি বলবে শুধু।’

– ‘বসে আছি নাটক করতে।’

– ‘তুমি বলার পর দেইখো আমি কি নাটক করি। সেই নাটক দেখার জন্য, এই নাটক করবে।’

মা তখনই আসলেন। অনিক সঙ্গে সঙ্গে বললো, ‘বাবা আপুর প্রচুর জ্বর তো চাচি। আর সারাদিন শুয়ে থেকেছে তো, তাই আরও বেশি শরীর ব্যথা। আপু তুমি উঠে বসো তো।’

পদ্য উঠে বসে বললো, ‘অনিককে চেনো না তো আম্মা। ওর স্বার্থ আছে বলেই খাতির দেখাচ্ছে। ওইযে খাতা দেখছো। গল্প লিখে এনেছে। এখন আমার পড়তে হবে, পড়ে কেমন হয়েছে বলতে হবে। আর চা নুডলস এনেছে যাতে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ভয়েজ দেই।’

অনিক সঙ্গে সঙ্গে মুখ কালো করে চুপচাপ বসে রইল। মনিরা বেগম মেয়েকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘ধু*রো, বোকার মতো কি থেকে কি বলে। বাতাসে বড়ো হয়েছিস। এখনও কথা বলতে শিখিসনি।’

অনিক বসা থেকে উঠে বললো, ‘আচ্ছা চাচি আমি তাহলে এখন যাই। ফ্লাক্স থাকুক।’

– ‘আরে না বসো তুমি। ওর কথায় রাগ করলে হয়। বোকার মতো কথা বলে।’

– ‘না চাচি, আপু সব সময় এরকম নেগেটিভ চিন্তা করে।’

মনিরা বেগম তাকে হাত ধরে বসিয়ে বললেন, ‘পদ্য তুই না বড়ো হবি না। খাতায় গল্প লিখে আনছে একটু পড়ে দিলে মুখ পড়ে যাবে না৷ মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? ছেলেটা এত কষ্ট করে চা নুডলস বানিয়ে এনেছে। একটু পড়ে দিলে কি হবে।’

– ‘না আন্টি পড়া লাগবে না। আপু বলছে তো আমি এই কাজে এসেছি। আমি তাকে মাথায় জলপট্টি দেবো। চা খাইয়ে, নুডলস খাইয়ে খাতা না পড়িয়ে চলে যাব৷ আর এরপর থেকে ভয়েজও নেব না। একা একা ভয়েজ দেবো। সে ভাবছে এই কাজগুলোর জন্যই আমি খাতির জমাই।’

মনিরা বেগম খাতা পদ্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আরে না, ও তোমাকে রাগায় এরকম। রাগ করো না বাবা৷’ বলে তিনি চলে গেলেন।

পদ্য বিছানায় চোখ বড়ো বড়ো করে বললো, ‘এটা কি ছিল অনিক? এই নাটকের কারণ কি?’

– ‘এত প্রশ্ন করবে না তো আপু। বুঝবে না তুমি। নাটক কেমন হলো সেটা বলো?’

– ‘তুমি তো আমাকে উলটো বকা খাইয়ে নিয়েছো।’

অনিক চেয়ার নিয়ে এসে বিছানার পাশে বসে বললো, ‘বকা খাওয়ানো লক্ষ্য না। বুঝবে না তুমি। এবার আগে পানি দিচ্ছি, পানি খাও’ বলে টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এনে হাতে দিল। পদ্য দুই চুমুক পানি খেয়ে ফিরিয়ে দিল। অনিক বক্সটা খুলে আসন পেতে বিছানায় বসে বললো, ‘তোমার হাত কাঁথার ভেতর থেকে বের করলে ঠাণ্ডা লাগবে। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

পদ্য না করতে যাবে তার আগেই এক চামচ এগিয়ে এনে বললো, ‘নাও।’

পদ্য মুখে নিল। কয়েক চামচ খাওয়ার পর এক টুকরো নুডলস পদ্যের থুতনি বেয়ে বিছানায় পড়লো। অনিক বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে থুতনি মুছে দিল। সেই স্পর্শ এখনও মনে আছে। ওর চাহনিও। কত আবেগ নিয়ে ছেলেটা ছুঁয়ে দিয়েছিল কে জানে। নুডলস পুরোটা খেতে পারলো না পদ্য। অনিক তখন বললো, ‘খাবার নষ্ট করা ঠিক না। আমিই শেষ করি খেয়ে।’

একই চামচ দিয়ে খেতে শুরু করে অনিক। পদ্য অবাক হয়ে বললো, ‘আরে চামচ তো ধুয়ে আনো। আর না হয় অন্য চামচ গিয়ে নিয়ে আসো।’

সে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেবল। পদ্য আবার বললো, ‘জ্বরও ছুঁয়াচে রোগ৷’

– ‘খেয়েই তো ফেলেছি সমস্যা নেই।’

তারপর দু’টা কাপে চা ঢেলে পদ্যকে দিয়ে সে চেয়ারে বসলো একটা কাপ নিয়ে। তেমন কোনো কথাও বললো না। চা শেষে বললো, ‘তুমি শুয়ে যাও। আমি জলপট্টি দেই। তারপর চলে যাব।’

পদ্য বাঁধা দিয়ে বললো, ‘তুমি চলে যাও লাগবে না।’

সে মাথায় হাত রেখে বললো, ‘তোমার কি বিরক্ত লাগছে? লাগলে চলে যাব। আর ভালো লাগলে ঠেলে দিয়ো না।’

পদ্য তখন শুয়ে যায়৷ অনিক কাপড় ভিজিয়ে ভালো করে চিপে বললো, ‘তোমার মুখ আর গলা মুছে দেই আগে? দেখবে ফ্রেশ লাগবে।’ পদ্য জবাব দেয়ার আগেই সে মুখ, গলা, ঘাড় মুছে নিল। তারপর কপালে জলপট্টি দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। এরপর পদ্য আর কিছুই জানে না। ঘুমিয়ে পড়ে সে। সেবার যখন অনিকের নীল ডায়েরিটা তার হাতে আসে। সেটায় পুরো ডায়েরি ভর্তি পদ্যকে নিয়ে লেখা। এই অসুস্থতার রাত্রির অংশও ছিল। সেই অংশটা আজ ভীষণ মনে পড়ছে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,

“পদ্য নামটাও সুন্দর। কিন্তু ওর নাম পদ্ম হলেই ভালো হতো। পুষ্পের মতো রমণীটির নাম ফুলের নামে হতো। আমার চোখে যাকে ফুল লাগে৷ তাকে ছুঁয়ে দেখার অধিকার কি আমার নেই? ফুল স্পর্শ করার অধিকার সবার আছে। আজ রাতে আমার পদ্যের পদচুম্বন আমি করেছি। আপাতদৃষ্টিতে এটা অন্যায়। ভারী অন্যায়। একজন অসুস্থ, ঘুমন্ত নারীর পায়ে চুমু খাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। কিন্তু আমি কি নিষ্পাপ, ফেরেশতা? আমি অবশ্যই অনেক অন্যায় করি। সেরকম একটা অন্যায় এটা। তাছাড়া মানুষ অপরাধ করার পর সেটার পক্ষে নানান যুক্তি দাঁড় করায়। আমিও করেছি। সেটা হলো পদ্য নামের এই মেয়েটি পুষ্প। পুষ্পের মতো সুন্দর, পবিত্র। তাকে ছুঁয়ে দেখেছি। ছিঁড়ে ফেলিনি তো। ফুল ছেঁড়া অন্যায়। ঘ্রাণ নেয়া, ছুঁয়ে দেয়া নয়। যুক্তিগুলো নিজের কাছেই খোঁড়া যুক্তি মনে হচ্ছে। কিন্তু কি করবো? পদ্য ঘুমিয়ে আছে। কি মায়াময় মুখ। চোখের লালচে পাতা। আমার বারবার ঘোর লেগে যাচ্ছিল। একবার দেখি কাঁথার ভেতর থেকে ওর পা বের হয়ে গেছে৷ কি সুন্দর মায়াবী পা। পায়ের নখগুলো ঈষৎ লম্বা। মোমের মতো মসৃণ ফরসা পাতা। আমার তখন মনে হলো পায়ে হয়তো চুমু খেলে সমস্যা নেই। তাতে কোনো অন্যায় নেই৷ নিজেকে প্রশ্রয় দিয়ে আমি হাঁটু গেড়ে বসে ওর পায়ে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। পদ্য নামের পদ্মফুলটা ঘুমের ভেতরেই খানিকটা কাঁপলো। আমার যেন তৃষ্ণা মিটলো না। আমি গাল চেপে রাখলাম পায়ে। অনেক্ষণ চেপে রাখলাম। তারপর দেখি আমার চোখ ভিজে গেছে। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। আমি ওর পা-টা ঢেকে দিয়ে চেয়ারে চলে আসলাম। জীবনের প্রথম চুম্বন আমার। প্রিয় পদ্মফুলের পায়ে সেই চুম্বন। ভাবলেই আমার গা বারংবার কাটা দিয়ে উঠছে। একটা অপরাধ করলাম। অথচ গর্বে বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই জন্মের সেরা প্রাপ্তি ছিল এই চুমুটা।’

পদ্য ফ্যাসফ্যাস করে কেঁদে উঠলো। মনিসা পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘কি হয়েছে আপু, কাঁদো কেন?’

মনিরা বেগম পাশের রুম থেকে বললেন, ‘কি হয়েছে?’

– ‘আম্মা, আপু কাঁদছে এসে দেখো।’

মনিরা বেগম উঠে এসে বললেন, ‘কিরে বমি করেও মাথা ধরা যায়নি?’

পদ্যের মাথা ধরা নেই। অনিকের জন্য ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাই এই কান্না। তবুও মনিরা বেগমের প্রশ্নের জবাবে সে বললো, ‘হ্যাঁ আম্মা, মাথা ব্যথা করছে।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_১৩
.
মনিরা বেগম পদ্যের মাথায় হাত রেখে বললেন,

– ‘ঘুমানোর চেষ্টা কর মা। তাহলে কমে যাবে।’

– ‘হ্যাঁ আম্মা, তুমিও যাও, ঘুমাও গিয়ে।’

মনিরা বেগম আবার বাতি বন্ধ করে চলে গেলেন। খানিক পর পদ্যও ঘুমিয়ে যায়। ভোরে ঘুম ভাঙলো বারান্দায় কথা-বার্তা শুনে। উঠে বসলো সে। অনিকের বাবা মিরাজুল ইসলাম এসেছেন। মতিন মাস্টারের সঙ্গে বারান্দায় বসা।
মনিরা বেগমও চা নিয়ে গিয়ে যুক্ত হয়েছেন। পদ্য তাদের কথোপকথনে মনযোগ দিল। মিরাজুল ইসলাম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘তাহলে ছেলে দেইখা আসছেন গতকাল?’

– ‘হ্যাঁ, ঘটক বললো, বিকালে বাজারে আসেন, ছেলের সাথে দেখা করিয়ে দিব।’

– ‘ভালো করছেন। আমিও কয়েকদিন আগে ঘটককে বাজারে পেয়ে তাড়া দিয়ে এসেছিলাম।’

– ‘গতকাল দেখলাম না যে, কোথায় ছিলে?’

– ‘বাড়িতে ছিলাম না তো। ভোরে উঠে চলে গেলাম। আমার বড়ো বোনের জামাই মারা গেছেন।’

– ‘কি বলো, জানি না তো।’

মনিরা বেগম বললেন, ‘কেন, দেখোনি তাদের ঘর তালা।’

– ‘খেয়াল করিনি।’

মিরাজুল ইসলাম চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এবার বলুন, বিয়ের কথা কি ভাবলেন? ছেলে কি পছন্দ হইল?’

মতিন মাস্টার বললেন,

– ‘তা হয়েছে। ঘটককে বলবো ওরা এসে মেয়েকে দেখে যাক। তুমিও থাকবে, আলাপ-আলোচনা করে নিব।’

– ‘হ্যাঁ তাই করো। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় মাস্টার ভাই। কয়েক মাস আগে নাঈমের মা’কে নিয়ে বাসায় গিয়েছিলাম মনে আছে?

মনিরা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ।’

– ‘গিয়েছিলাম অনিককে বিয়েতে রাজি করাতে। নাঈমের এক শালী আছে। ওদের সাথেই থাকে। দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ ভালো। ভাবলাম অনিক পছন্দ করবে। কাজ হলো না। কোনো কথাই শোনেনি। উলটো বললো, জব করি না, ঠিক আছে এখন জব করবো। কিন্তু বিয়ে করবো না। কি আজব দুনিয়া আসলো মাস্টার ভাই ভাবুন তো। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা বিয়ে-শাদি করতেই চায় না।’

– ‘হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। তাছাড়া অনিক তো বাড়িতেও আসে না।’

পদ্য বিছানা থেকে সবকিছুই শুনছে। অনিক আজও কি তার জন্য অপেক্ষা করে? বিয়ে করছে না কেন পাগলটা? তার বিয়ে হয়ে গেলে কি করবে তখন? আবার পদ্যের বুকটা বেদনায় ‘হু হু’ করে উঠে। ছেলেটা শেষদিকে একদিন মেসেজে দিয়ে বলেছিল, ‘পদ্য আপু, তুমি ডায়েরিটা তো পড়েছো। সবকিছু এখন তো জানোই। লুকোচুরির আর কিছুই নেই। তোমাকে আর এভাবে মেসেজ বা কল দেয়াও হয়তো ঠিক হচ্ছে না। সব জেনেও যে দূরে ঠেলে দেয়, তাকে আর বলার কি থাকে? তখন বারবার তার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করা মানে উলটো বিরক্ত করা। আমি বিরক্তির কারণ হচ্ছি। শুধু এটুকু বলি, আমি তোমার পায়ে প্রথম চুমু খেয়েছিলাম। এটাই আমার জীবনের প্রথম চুম্বন। কখনও ভুলতে পারবো না। এখনও মনে পড়লে গা কাটা দেয়। এ ছাড়াও আমি বহুদিন, বহুভাবে তোমাকে স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছি, জানো তুমি? মনে আছে তোমার? প্রতি বছরই প্রবল বৃষ্টির কারণে শুরুতে বিলে অল্প পানি বাড়তো। সেই পানিতে ডুবে যেত চর। কিন্তু চরে পানি কম থাকায় সেদিকে খেয়া যেতে পারতো না। ফলে স্কুলে যাবার সময় আমরা সবাই প্যান্ট ভাঁজ করে অনেকটা জায়গা হেঁটে রাস্তায় গিয়ে উঠতাম। নতুন পানিতে তখন প্রচুর জোঁক। তুমি জোঁক ভয় পেতে। আমি সেই সুযোগটা নিতাম। কখনও কাঁধে করে, আবার কখনও পাঁজাকোলা করে শেওড়া গাছের পাশ দিয়ে উঠতাম গিয়ে রাস্তায়। অন্য সবাই শুরুর দিকে হাসতো, মনে আছে তোমার? তুমি জোঁকের ভয়ে ঠিকই কোলে চড়ে যেতে মানা করতে না। কয়েকদিন যাবার পর কেউ হাসেনি আর। এটাই নিয়ম। কোনোকিছু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চালিয়ে গেলে মানুষ হাসি বন্ধ করে দেয়। এটাই নিয়ম পদ্য আপু। যাইহোক, আমি নিজেকে সামলে নিচ্ছি। তবুও পারি না। অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করে। অজান্তেই মেসেজ, কল দিয়ে বসি। একদিন দেবো না হয়তো। তবে বিশ্বাস করো। আর কখনও কোনো নারী আমার জীবনে আসবে না। বিয়েও করবো না। জীবনের এই ক্ষুদ্র সময়ে তোমাকে যে ক’বার ছোঁয়া হলো আমার। এই জন্মে নারীকে ছোঁয়া, পাওয়া বলতে না হয় সেটুকুই থাকলো আমার। এযাবৎকালে অনিচ্ছায় তুমি যা দিয়েছো আমায়, তা দিয়েই কাটিয়ে দেবো গোটা একটা জীবন। বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? বিশ্বাস করো, ওইযে পায়ে চুমু খেয়েছিলাম। যতবার মনে করি সেই অনুভূতিটা নতুন করে হয়। কি মিষ্টি অনুভূতি। তোমাকে কোলে নিতাম না? এই যে এখনও চোখে ভাসছে। আমি তোমার সেই বিশেষ ঘ্রাণটা পাচ্ছি। তোমার নরম, কোমল শরীর আমার সঙ্গে মিশে আছে। সেই উষ্ণতা এখনও গায়ে লেগে আছে যেন। সেই বিশেষ ঘ্রাণ, ‘ওম ওম’ উষ্ণতা, সবকিছু মৃত্যুর আগ অবধি পাব আমি। আচ্ছা তুমি এত মিষ্টি কেন? কেমন কোমল, নরম, পবিত্র। যখন ঠোঁট নেড়ে কথা বলো আমি বুঁদ হয়ে তাকিয়ে থাকি জানো? তোমার দাঁত যেন শিউলি ফুল। কথা বলার সময় মনে হয় কোনো একটা ফুল বারবার আমার চোখের সামনে ফুটছে। কতবার, কতদিন যে তোমার মুখটা একবার ছুঁতে ইচ্ছা করেছে। একবার আঁজলা করে ধরতে ইচ্ছা হয়েছে। তার কোনো হিসাব নেই পদ্য আপু। এই অল্প বয়সের সবটুকু আমার এসব লোভের সঙ্গে সংগ্রাম করেই কেটে গেল।
যাইহোক, আবার বেশি কথা বলে বিরক্ত করছি। তুমি বললে না, সবকিছুতে ব্লক দেবে আমাকে, দিয়ে দিয়ো। আমিও চাই কাউকে আর বিরক্ত না করতে। ভালো থেকো।’

অনিক কি সেই কথাগুলো এখনও মনে রেখেছে? পদ্য ভেবে পায় না। সেই অল্প বয়সের প্রেম কি একইরকম রয়ে গেল অনিকের বুকের ভেতর? হয়তো রয়েছে। না হলে বিয়ে করতে চায় না কেন ছেলেটা? কষ্ট লাগে পদ্যের। বুকটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে উঠে। আগে ভাবতো বয়স কম তাই এত আবেগ অনিকের। এক সময় চলে যাবে। এখন বুঝতে পারছে ছেলেটা কত কষ্টে কথাগুলো বলতো। ব্লক দেয়ার পর একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে রাতে কল এলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নাক টানার শব্দ পাচ্ছিল সে। যেন ঠাণ্ডায় কারও নাক বন্ধ। মুখ দিয়ে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে হাঁপিয়ে গেছে। পদ্য চিনতে পেরেছিল মানুষটাকে। রূঢ় গলায় বললো, ‘তুমি কি এখন এভাবে রং নাম্বার দিয়ে বিরক্ত করা শুরু করেছো অনিক?’

ওপাশ থেকে হাঁপানো গলায় বললো, ‘দিতে চাইনি। তুমি প্লিজ সবকিছুতে আনব্লক করো আপু। ব্লক থাকলে আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগে। তুমি আনব্লক করে রাখো।’

– ‘পাগলের মতো কথা বলবে না অনিক। এখন রং নাম্বার দিয়ে কল দিচ্ছ। আনব্লক করলে তো তখন আরও বেশি দেবে।’

– ‘না আপু দেবো না। প্লিজ আনব্লক করে রাখো। যখন খুব ইচ্ছা করবে, তখন শুধু মেসেজ দেবো। তুমি সিন করে রেখে দিয়ো। রিপ্লাই দিতে হবে না৷ তুমি আমার মেসেজ দেখতে পাচ্ছ এটা ভেবেই শান্তি পাব।’

– ‘তো এসবের শেষ কোথায়?’

– ‘আমি ধীরে ধীরে একেবারে মেসেজ দেয়া বন্ধ করে দেবো।’

– ‘তোমার যা ইচ্ছা তা করলে তো হবে না, ফোন রাখো। আর বিরক্ত করো না। আপু ডাকো আবার এসব বলতে লজ্জা করে না?’

বলেই পদ্য কল কেটে দিয়েছিল। দম-বন্ধ ব্যাপারটার পুরো অনুভূতি এখনও পদ্যের হয়তো হয়নি৷ কারণ সে চাইলেই অনিককে কল দিতে পারবে। দিচ্ছে না। সামলে নিচ্ছে নিজেকে। কিন্তু অনিক চাইলেই পারতো না৷ ব্লক ছিল সবকিছুতে। দু’একবার বাড়িতে এসেও পারেনি। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হওয়ার পর সুযোগ না পাওয়ার কষ্ট আসলে কেমন?
ভীষণ কথা বলার ইচ্ছা। কিন্তু বলার কোনো পথ খোলা নেই? তখন আসলে কেমন লাগে? পদ্য বুঝতে পারে এখন, আগে পারতো না। অনিকের কষ্ট বুঝতে পারে। বুঝতে পারে বলেই হয়তো কান্না পায়। শক্ত মেয়ে পদ্য, কখনও এমন ছিল না সে। কিন্ত সেই যে ঈদের আগের দিন ওকে কয়েক পলক দেখা, এরপর থেকে অনিকটার জন্য মন বড়ো পুড়তে শুরু করলো। এখনও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দিনে-দুপুরে তো কাঁদা যায় না। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে ছলছল চোখকে সামলে নিতে চেষ্টা করছে। অনিকের চিন্তা মাথা থেকে সরাতে হবে। আজ স্কুলে কি যাবে না সে? টাইম কয়টা হয়েছে কে জানে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো এগারোটা। মনিসা নেই, চলে গেছে হয়তো। মনিরা বেগম তাকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘উঠেছিস মা, মাথা ধরা কি কমেছে?’

পদ্য মাথা নেড়ে বললো, ‘হ্যাঁ মা, কমেছে।’

– ‘যা মুখ-হাত ধুয়ে আয়।’

পদ্য উঠে চুলের খোঁপা বেঁধে ওড়না মাথায় দিয়ে ব্রাশে পেস্ট নিয়ে বাইরে এলো। মিরাজুল সাহেব দেখে বললেন, ‘পদ্য মায়ের শরীর খারাপ না-কি?’

মনিরা বেগম বললেন, ‘হ্যাঁ, রাত থেকে ওর মাথা ধরেছে।’

সে উঠান পেরিয়ে পুকুরে চলে এলো। ক’টা হাস পুরো পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে। পদ্য কামিজ এঁটো করে বসে হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলো ঘরে। মনিরা বেগম ভাত দিলেন তাকে। পদ্যের খেতে ইচ্ছা করছিল না। বেলা এগারোটা হয়ে যাচ্ছে। রাতেও খায়নি। মনিরা বেগম তাই বকাবকি করে খাওয়ালেন। খাবার পর সে সিন্দুক খুলে ডায়েরি নিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো পুনরায়। মতিন মাস্টার আর মিরাজুল সাহেব কোথাও গিয়েছেন। মনিসা নেই। মনিরা বেগম রান্নাঘরে। সে আবছা আলো ছায়ার রুমে ডায়েরি জড়িয়ে ধরে চোখবুজে রইল। ডায়েরি খুলে কি পড়বে? সবকিছুই তো মাথায় গেঁথে আছে। চোখে ভাসছে। অনিকের ডায়েরির লেখাগুলোও মনে আছে। সেসবের অনেক কিছু নিজের ডায়েরিতেও লিখেছে পদ্য। অনিকের মতো হয়তো হয়নি। প্রতিটা বিষয় নিয়ে ছেলেটা কি অসীম ভালোবাসা নিয়ে লিখে রেখেছিল। তাদের সাতার শেখার বিষয়টা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেখা। সেবার বাইসাইকেল কিনেছিল। এইটে পাস করে নাইনে উঠার পর তার চাচার উপহার। সাইকেল চালানো শিখলো পশ্চিমের মাঠে। সেই সাইকেল নিয়েও লেখা ছিল। লেখাটার কথা মনে পড়লে হাসি পাবার কথা। অনিকের এখন পাবে কি-না কে জানে। আসলে প্রতিটি বয়সের আলাদা একটা আবহ থাকে। তার কাছে তার অনুভূতি সেই বয়সে গাঢ় হয়। বড় হবার পর সেটা নিয়ে হাসে মানুষ। তুচ্ছ করে দেখে। মনে হতে পারে বাইক হলে একটা ব্যাপার ছিল, তাই বলে বাইসাইকেল নিয়ে? অনিকের ডায়েরির লেখাটায় সেই চিহ্ন ছিল না। কেবলই আবেগ, ভালোবাসা ছিল। লেখাটা এখনও স্পষ্ট মনে আছে পদ্যের,

“কয়েক মাস হলো আমি সাইকেল চালানো শিখেছি। ক’দিন আগে অর্নবকে পেছনের সিটে বসিয়ে বাজারে নিয়ে গেলাম। লক্ষ্য করলাম, ডাবল টানতে কোনো অসুবিধা হয়নি আমার। তখনই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাইকেলের মতো এত জটিল একটা যন্ত্র আমি চালানো শিখলাম। এটার পেছনে সিটও আছে। অথচ পদ্য আপুকে নিয়ে ঘুরতে পারবো না। এটা কেমন কথা? পদ্য আপু লজ্জা পায় সাইকেলে উঠতে। তা আমি জানি। রাস্তায় আমার সঙ্গে সাইকেলের পেছনে বসে সে যাবে তা কল্পনাও করতে পারবে না। ওর সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি রকমের লজ্জা। লোকে কি বলবে তা নিয়ে অতি ভাবনা। আমি পরশু ওদের উঠানে নানানভাবে সাইকেল চালিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করলাম আমি কত দক্ষ চালক। স্যার বারান্দায় বসে মুখ কামাচ্ছিলেন। চাচি পাটিতে বসে কাঁথা সেলাই করছেন। পদ্য পাশে বসা। সে ভালোভাবে দেখছেই না চালানো। আমি বারবার সাইকেলের টুংটাং শব্দ তুলছিলাম। স্যার বললেন ‘কিরে অনিক? এত হর্ন কেন দিচ্ছিস?’

চাচি বললেন, ‘তা দিক, নতুন কিছু শিখলে প্রথম প্রথম এমন করেই সবাই। তুমি বাড়িতে মাস্টারি ফলাতে শুরু করো না।’

স্যার হাসলেন। আমি সাইকেল বারান্দার কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘নতুন শিখলেও চাচি। আমি ভালো চালাতে পারি। গতকাল অর্ণবকে নিয়ে বাজারে গেলাম।’

স্যার বললেন, ‘বাজার থেকে কি চাল আনতে পারবি পেছনের সিটে বেঁধে?’

আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ পারবো। চাল কেন? পদ্য আপুকেও পেছনে নিয়ে চালাতে পারবো। আপু উঠে দেখবে? আসো।’

পদ্য আপু লজ্জা পেয়ে বললো, ‘বাবা আমি এসবে নাই। ভয় লাগে।’

আমিও স্যারের সামনে আর কিছু বললাম না। কিন্তু এরপর থেকে স্যার চাল আনতে আমাকে পাঠান।
আজ চাঁদনি রাত ছিল। আমি পদ্য আপুদের ঘরে রাত নয়টার দিকে গিয়ে বললাম, ‘আপু বাইরে এসে দেখো কি সুন্দর চাঁদনি রাত।’

সে বাইরে এলো। এসে বললো, ‘তাই তো। দিনের মতো লাগছে সবকিছু। উঠানে কি সুন্দর ছায়া পড়েছে দেখো।’

আমি সুযোগ পেয়ে বললাম, ‘রইসু চাচাদের বাড়ির পরে কদম গাছের পাশ দিয়ে বিলের পাড়ে যাওয়ার একটা সরু রাস্তা আছে না?’

পদ্য আপু উঠানে হাঁটতে হাঁটতে বললো, ‘হ্যাঁ।’

আমি মিথ্যে করে বললাম, ‘ওদিকে ধান খেতের উপর আজ এত জোনাক পোকা কোত্থেকে যেন এসেছে। আমি গিয়ে দেখে তো অবাক। এত জোনাক পোকা! চারদিকে শুধু জ্বলজ্বল করছে৷ বিলের উপরেও।’

সে অবাক হয়ে বললো, ‘তাই?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, দেখতে যাবে না-কি?’

– ‘কিভাবে যাব। আম্মা জানলে বকা দেবে।’

– ‘আরে জানবে না। তুমি আমাকে ধরে সাইকেলে বসবে। আমি চোখের পলকে গিয়েই আবার চলে আসবো। এসে বলবে আমাদের ঘরে গিয়েছিলে। আর রাতে তো কেউ দেখবেও না।’

সে ইতি-উতি করছিল। আমি হাত ধরে বললাম, ‘চলো তো, আসো।’

সে এলো। আমি সাইকেলে উঠে বললাম, ‘আমাকে ধরে বসো।’

ভয়ে ভয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে বসলো সে। আমি দ্রত চালিয়ে কদম গাছের নিচ দিয়ে চলে গেলাম বিলের পাড়ে। পদ্য আপু বারবার বলছিল, ‘কিরে জোনাক পোকা কই?’

আমি বিলের পাড়ে গিয়ে বললাম, ‘বুঝলাম না, ছিল তো। চলে গেল মনে হয়।’

ওর মন খারাপ হলো। আমি ঘাসে বসে বললাম, ‘এসেছো যখন বসো এখানে। এখন কেউ এদিকে আসবে না। একটু পর জোনাক পোকা আবার আসতেও পারে।’

সে চারদিকে তাকিয়ে পাশে বসে বললো,

– ‘আহ পরিবেশটা কি সুন্দর লাগছে অনিক। বিলের টলোমলো জল চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে৷ পেছনে সবুজ ধানক্ষেত। ছেলেদের অনেক মজা তাই না? যখন তখন বাড়ি থেকে বের হতে পারে।’

আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললাম, ‘তোমার ইচ্ছা হলে বের হও, কে বাঁধা দেয়?’

– ‘হ্যাঁ বের হই আর আম্মার বকা খাই।’

– ‘কে দেখবে, এই যে নিয়ে আসলাম। আমাকে বলবে দেইখো। কিভাবে নিয়ে আসি। তোমার যা ইচ্ছা হয় সব আমাকে বলো না কেন?’

সে ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা বলবো।’

তারপর বিলের দিকে তাকিয়ে রইল। আমাদের ছায়া পড়েছিল পেছনে। আমার ইচ্ছা করছিল ওর পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বসি। সে মাথা রাখুক আমার কাঁধে৷ তা পারিনি। সম্ভবও নয়। তবে হাত ধরার বুদ্ধি বের করলাম। সুন্দর হাত, নখগুলো অল্প লম্বা। কোনো রঙ নেই। পরিষ্কার ফরসা ঈষৎ লম্বা নখ। এমন নখে ওর হাত-পায়ের আঙুল যে কি ভীষণ মায়াবী লাগে। আমি ওর হাতটা আলগোছে মুঠোয় নিলাম। সে কেঁপে উঠে বললো, ‘কিরে?’

আমি বললাম চাঁদের সামনে পাঁচটা আঙুল ফাঁক করে দেখো পেছনের ঘাসে কি সুন্দর ছায়া পড়ে। সে ঠোঁট টিপে হেঁসে তাই করলো। ছায়ায় নিজের লম্বা লম্বা আঙুল দেখে হাসছে। আমি তাকে দেখছি মুগ্ধ নয়নে। সে আঙুল বন্ধ করছে আর খুলছে। নানাভাবে দেখছে। হঠাৎ বললো,

– ‘চলো অনিক, যাই এবার, আম্মা জানলে আগুন লেগে যাবে।’

আমি আবার তাকে পেছনে বসিয়ে নিয়ে আসলাম। আমাকে আঁকড়ে ধরে বসেছিল। একেকটা দিন হুট করে এত সুন্দর হয়। ইচ্ছা করে দিনটা ছবির মতো কোনভাবে দেয়ালে যদি টাঙিয়ে রাখা যেত৷ কি সুন্দর হাতটা ধরেছি ওর। কি সুন্দর আমাকে ধরে বসেছিল। আহা, মনে থাকবে আজীবন। মনে রাখতে চাইও। তাই যত্ন করে লিখে রাখলাম।”

পদ্য চোখ মুছে নিল। ডায়েরিটা ফিরিয়ে দিয়েছিল সে৷ অথচ সবকিছুই মনে আছে৷ ডায়েরিটা না পেলে আসলে কি হতো? অনিক কি তার অনুভূতিগুলো জানাতো এক সময়? তখন পদ্য স্কুলে টিচার হয়ে গেছে। ডিগ্রিও শেষ৷ বাড়ি থেকেই পড়েছে। অনিক অনার্সের জন্য শহরে চলে গেল তখন। কিন্তু প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন লেখা নিয়ে আসতো। রাতে ছাদে গিয়ে দু’জন ডুয়েল ভয়েজে রেকর্ড করে৷ শেষবার শহর থেকে ফিরে তাদের উঠানে এসেই ডেকে বললো, ‘পদ্য আপু আমাদের ঘরে আসো, সুখবর আছে।’

পদ্য শুনে একটু পরই ছুটে গেল। গিয়ে দেখে অনিক টেবিলে ব্যাগ রেখে বাথরুমে হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছে। সে বিছানায় গিয়ে বসে বললো, ‘তোমার সুসংবাদটা কি আগে বলো অনিক।’

– ‘ইউটিউবে মনিটাইজ পেয়ে গেছি আপু। এখন থেকে যা ইনকাম হবে অর্ধেক তোমার।’

– ‘ওরে বাবা তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ, আরেকটা সুসংবাদও আছে। পাণ্ডুলিপি রেডি করতে হবে। আগামী বইমেলায়ই বই বের হবে আমার। একটা প্রকাশনী নিজ থেকে চাইছে।’

– ‘বাহ দারুণ তো। তা লেখা কতদূর?’

– ‘তোমাকে অল্প লিখে লিখে দেবো, পড়ার সময় আছে তো? হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাবো।’

– ‘হোয়াটসঅ্যাপে যে পাঠাবে সেই লেখা যদি পরে বলি আমার? আমি যদি তোমার আগেই প্রকাশ করে ফেলি?’

– ‘কি যে বলো। আর শোনো তোমার জন্য একটা গিফট আছে।’

– ‘কি গিফট তাড়াতাড়ি দাও।’

‘হাত-মুখ ধুয়ে আসি দিব’ বলেই অনিক বাথরুমে ঢুকে গেল।

গিফট কি এনেছে দেখার জন্য পদ্য ব্যাগ খুলে দেখে একটা শাড়ি।

– ‘ও আচ্ছা শাড়ি এনেছো। আমি ভাবলাম অন্যকিছু।’

অনিক বাথরুম থেকে বললো,

– ‘অন্যকিছুটা কি? শাড়ি এনেছি তুমি তো এখন আবার স্কুলের ম্যাডাম। কাজে লাগবে।’

– ‘ঠিক আছে, সুন্দর হয়েছে।’

– ‘কিনতে গিয়ে কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। কালার-টালারও ভালো বুঝি না।’

– ‘কেন বুঝো না, না বুঝলে লিখো কিভাবে? লিখতে গেলে তো সবই লাগে।’

– ‘শোনো আপু, শিল্পী মানেই সাংসারিক সবকিছুতে আনাড়ি। সে লেখক, কবি, গায়ক, চিত্রকার যেই হোক। এরা জন্মগত অকর্ম হয়। তারা ফুল-ফল, লতা-পাতা এগুলো ছাড়া সাংসারিক জটিলতার কিছুই বুঝে না। দূর থেকে মনে হয় সবকিছু জানে।’

‘ও আচ্ছা’ বলে নীল ডায়েরিটা নিল পদ্য। শাড়ির সঙ্গে বের হয়ে এসেছে ব্যাগ থেকে। ভেবেছিল ডায়েরিতে হয়তো নতুন গল্প। সে ডায়েরি মেলে বললো, ‘ইউটিউবের জন্য নতুন কি গল্প লিখলে অনিক?’

– ‘লিখেছি, তোমাকে দেবো এসে। পড়ে প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে আজ সন্ধ্যায়ই রেকর্ড করে নিব।’

এরকমই কাজ করে তারা। আগে গল্প পদ্যকে দেয় পড়ে রাখার জন্য। পদ্য সেই ভাবনা থেকে ডায়েরিটা খুলেছে। কিন্তু প্রথম পাতায় বিস্মিত হয়ে দেখে তাকে নিয়ে কি যেন লেখা। না পড়ে একের পর এক পেইজ উলটে চোখ বুলাতে থাকে। স্পষ্ট পুরো ব্যাপারটা তখনও বোঝেনি। তবে মনে হচ্ছিল তাকে নিয়ে অনেক কিছুই লেখা আছে এই ডায়েরিতে। পদ্য কৌতূহলী হয়ে শাড়ির ভাঁজে নিয়ে নেয় ডায়েরি। অনিক হয়তো কিছু সময়ের জন্য ডায়েরির কথা ভুলে গিয়েছিল। বের হয়ে এসে ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে দিয়ে বললো, ‘এই নাও গল্প। সন্ধ্যার আগে পড়ে নিয়ো।’

পদ্য খাতা হাতে নিয়ে বললো,

‘তাহলে এখন যাই’ বলে সে পুরো ডায়েরি পড়ে ফেলে সন্ধ্যার আগেই। রাগে শরীর জ্বলতে শুরু করে। এসব কি দেখছে সে? অনিক তাকে অন্যচোখে দেখে। এসব ভাবে তাকে নিয়ে? লজ্জায়-ঘৃণায় সে অনিকের সামনে যায়নি আর। দরজা বন্ধ করে পড়ে রয় রুমে। খানিক পর রেকর্ড করার জন্য অনিক এসে ডাকে তাকে। পদ্য ডায়েরি, গল্পের খাতা, শাড়ি নিয়ে উঠানে এসে বললো, ‘আজ থেকে তুমি আমার আশেপাশেই আসবে না। তুমি একটা বেয়াদব, অসভ্য। এই নাও এগুলো।’ অনিক ডায়েরি দেখে বুঝে ফেলে সব। তবুও না ঘাবড়ে বললো, ‘ডায়েরি পড়ে রাগ করেছো তাই না? কিন্তু সব কিছুই সত্য। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

– ‘আর কখনও এমন কথা মুখ থেকে বের করলে, থা*প্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেবো নির্লজ্জ কোথাকার। তোমার বয়সে আমি বড়ো। আপু বলে ডাকো তুমি আমাকে।’

সে চারদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আস্তে কথা বলো আপু, কেউ শুনে ফেলবে। তুমি ব্যাপারটা..।’

পদ্য থামিয়ে দেয়, রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘এসব নিয়ে এখান থেকে যাও অনিক৷ অকারণ আমাকে রাগাবে না। এতদিন তোমার সাথে মিশেছি ভেবে নিজের ঘেন্না লাগছে এখন।’

অনিক সবকিছু হাতে নিয়ে আমতা-আমতা করে বললো, ‘আচ্ছা তোমার মাথা ঠাণ্ডা হলে আমি আসব। এখন গেলাম।’

অনিক চলে গিয়েছিল৷ সেদিন পদ্য বা অনিক কেউ বুঝতে পারেনি। মিরাজুল ইসলাম নামাজ পড়ে একটু দেরিতে মসজিদ থেকে ফিরছিলেন। বাতি ছিল না, তাই অন্ধকারে খানিকটা ধীরে ধীরেই হাঁটছিলেন। হঠাৎ তাদের কথোপকথন শুনে একটা গাছের আঁড়ালে দাঁড়িয়ে থাকেন।
__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here