ছন্দহীন পদ্য পর্ব -২০+২১

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২০
.
রাতের খাবার শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আফরার ঘুম আসছে না। অনিকের যুক্তিগুলো ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অনেকক্ষণ ওর সঙ্গে যুক্তি-তর্ক হয়েছে। তার দিক থেকে সে সঠিক। কিন্তু ব্যাপারগুলো অন্যদের কীভাবে বোঝাবে? সবচেয়ে বড়ো কথা মেয়েটাই তো তাকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। একদিন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতেই হবে। কিন্তু বিয়ে যদি এর ভেতরে হয়ে যায়? এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সে হঠাৎ ঘুমিয়ে গেল।
ঘুম থেকে উঠলো খানিক দেরিতে। উঠে দেখে নাঈম অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে গেছে। অবাক হয়ে বললো, ‘আরে কয়টা বাজে? তুমি এত তাড়াতাড়ি রেডি হলে যে? খেয়েছো কিছু?’

নাঈম মুচকি হেঁসে বিছানায় বসে বললো, ‘ম্যাডাম, ঘুমাচ্ছ তাই বিরক্ত করিনি। বুঝেছি কাল তোমার অনেক ধকল গেছে।’

– ‘আরে কি বলো। ডাকতে, আমি নাশতা বানিয়ে দিতাম।’

– ‘ইভাকে নিয়ে বানিয়ে নিয়েছি।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘আমি যাচ্ছি তাহলে, আর শোনো, তুমি অনিকের বিষয় নিয়ে ভেবো না। আমি আব্বার সাথে কথা বলেছি। উনি সব জানে। বলছে এখন আমরা শুধু অনিককে দেখে রাখতে। আর ইভাকে এসব না জানাতে।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘গেলাম তাহলে। আর পারলে ইভাকে ওর কাছে যেতে বলতে পারো৷ এখন একা লাগবে তো, আরেকজন থাকলে ভালো।’

আফরা কিছু না বলে শাড়ি টেনে-টুনে ঠিক করতে করতে বিছানা থেকে নামে। নাঈম চলে যায় অফিসে। মুখ-হাত ধুয়ে আফরা গিয়ে ইভার রুমে উঁকি দেয়। ওর কানে মোবাইল। তাকে দেখে ‘এখন রাখছি, পরে কথা হবে’ বলে বললো, ‘আপু তোমার দেবরকে ডাকিনি। ঘুমোচ্ছে মনে হয়। দু’জনে নাশতা করে নাও।’

– ‘কার সঙ্গে এত কথা বলিস? রাতেও দেখলাম।’

– ‘বান্ধবী একটা।’

– ‘আচ্ছা যা, অনিককে আগে গিয়ে ডেকে তুলে আয়। ফ্রেশ হোক। আমি নাশতা দিচ্ছি।’

ইভা এসে ওর দরজায় কয়েকটা নক দিয়ে সাড়া পেল না৷ দরজা খুলে ভেতরে এসে দেখে কেউ নেই। বাথরুমে নক দিল। বারান্দায় উঁকি দিল। অনিক নেই। ফিরে এসে বললো, ‘আপু অনিক ভাই তো রুমে নাই।’

– ‘বলিস কি? কোথায় গেল তাহলে।’

– ‘বাইরে হয়তো।’

আফরা রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে কল দিল। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করলো সে।

– ‘অনিক কোথায় তুমি?’

– ‘বাইরে ভাবি।’

– ‘বাইরে মানে, বাইরে কোথায়?’

অনিক হাসলো। হেঁসে বললো, ‘আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না, হাত কা*টবো না, আত্মহ*ত্যা করবো না।’

– ‘তোমাকে যা বলেছি তার উত্তর দাও, কোথায় আছো?’

– ‘পার্কে একটা বেঞ্চে শুয়ে আছি। রোদ লাগছে গায়ে। ভালোই লাগছে।’

– ‘অফিসে গেলে না?’

– ‘অফিসে গিয়ে কি হবে। ভালো লাগে না এসব।’

– ‘তুমি বাসায় আসো তো। নাশতা করবে, আসো।’

অনিক ফিরে এলো মিনিট তিরিশেক পর। আফরা ততক্ষণে তার রুম ঝাড়ু-টারু দিয়ে পরিষ্কার করে দরজা-জানালা খুলে দিয়েছে। সিগারেটের টুকরোতে ভরে আছে মেঝে। ভ্যাপসা গন্ধ। অনিক এসে বিছানায় বসে বললো, ‘রুমটা তো একেবারে মানুষের করে ফেলেছো ভাবি।’

আফরা ওর দিকে তাকায়। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। শুকনো মুখ। লালচে চোখ। এলোমেলো চুল। একটা হাত লম্বা শার্টের বোতাম খোলা। নিচে সাদা গেঞ্জি। এই সবই অনিকের স্বাভাবিক হওয়ার একটা চেষ্টা। আফরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘নাশতা করতে আসো।’

– ‘হ্যাঁ চলো।’

আফরা টেবিলে বসে বললো, ‘ভালোই তো আছো। বাইরে হাঁটতে গিয়েছিলে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘সবই তো ঠিকঠাক মতো চলছে। তাহলে অফিসে যেতে।’

– ‘অফিসে যেতে ভালো লাগছে না৷ অফিস-টফিস করে কি হবে?’

– ‘বেঁচে থাকতে হলে অফিস থেকে গুরুত্বপূর্ণ আর কি আছে? টাকাপয়সা ছাড়া চলা যায়?’

– ‘এগুলো ভাবতে ভালো লাগছে না ভাবি।’

– ‘ইভাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাও অনিক। মন ভালো হতে পারে।’

– ‘না এসব ঘুরাঘুরিও ইচ্ছা করছে না। এভাবেই ভালো আছি।’

– ‘আমার মনে হয় কি। তুমি বিয়ের চিন্তা করো। অথবা অন্য কোনো মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করো। আর অফিস ঠিকমতো করতে শুরু করো।’

– ‘বিয়ে সংসার আর অফিস ভাবতেই বিরক্ত লাগছে। সবার যে গোছানো জীবন থাকতে হবে এমন তো না ভাবি। একজন মানুষের আসলে কি আর লাগে। দু’বেলা দুমুঠো ভাত আর হঠাৎ একদিন মরে যাওয়া৷ এইতো জীবন৷ পার্কে বসে একটা কু*কুরকে দেখে আজ মনে হলো৷ প*শু হয়ে জন্মালে আসলে ক্ষতি কি ছিল? মানুষ আসলে কেন প*শুরু জীবন কামনা করে না? প*শু বা মানুষের আসলে পার্থক্য কোথায়। একই তো, মানুষের মতো ক্ষুধা আছে। অসুখ আছে। রুচি আছে। মানুষের যা প্রয়োজন তাদেরও সেসবের প্রয়োজন আছে। অথচ তারা কত নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ায়। কোনো কষ্ট নেই। আমাদের মতো খাওয়া নিয়ে চিন্তা নেই। যখন খিদে লাগে, যতটুকু খাওয়া দরকার, ততটুকু খায়, এরপর কি খাবে তা নিয়ে চিন্তা নেই৷ তাদেরও অসুখ হয়, অথচ তা নিয়ে ভীত নয়, আমরা…।’

আফরা তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে বললো, ‘হয়েছে আর কথা বলা লাগবে না। তুমি নাশতা করো। কষ্টের সময় মানুষ দার্শনিক হয় যায়৷ তোমার সেই দশা হয়েছে।’

– ‘কি যে বলো ভাবি, আমার আবার কীসের কষ্ট, মোটেও তা না।’

– ‘তোমার লেখালেখির কি অবস্থা।’

– ‘লিখবো।’

– ‘যাও, নাশতা করে গোসল করে না হয় লেখো।’

– ‘লিখে-টিখে কি হবে।’

– ‘এই কি হবে, কি হবে মাথা থেকে সরাও অনিক।’

সে মাথা নাড়িয়ে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো,

– ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো। সব কিছুতে এত ‘কি হবে, কি হবে’ বললে তো দুনিয়ায় চলা মুশকিল।’

আফরা উঠে গিয়ে ওর কাপে চা ঢেলে দিয়ে বললো, ‘চা খাও, আর রাতে ঘুম হয়েছিল? চোখ এত লাল কেন?’

অনিক জবাব না দিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘ভাবি, তোমাকে আমি প্রথম যেদিন দেখেছিলাম না, সেদিনই বুঝেছি তুমি কিরকম হবে।’

– ‘হ্যাঁ, তুমি তো এসবে পণ্ডিত৷ মানুষ ভালো চিনতে পারো।’

– ‘ভুল, পণ্ডিতরাও ভুল করে। মানুষ মানেই ভুল করে। আমিও মানুষ চিনতে ভুল করেছি।’

– ‘কাকে, পদ্যকে?’

অনিক আর জবাব দিল না। আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘বেশি কথা বলো কেন? নাশতা খেয়ে গোসল করে রেস্ট নাও। তুমি মাতালদের মতো কথা বলছো। অথচ আমি চা ঢালার সময় নাক টেনেও মা*দ-ট*দ জাতীয় কিছুর গন্ধ পাইনি।’

অনিক হেঁসে ফেললো। তারপর চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘কই আমি তো স্বাভাবিক, উলটো মাথায় অনেক নতুন নতুন ভাবনা আসছে। লিখতে বসলে ভালো হবে মনে হয়।’

– ‘চা শেষ করে গিয়ে বসো।’

– ‘ঠিকই বলেছো, প্রচুর লিখতে হবে।’

আফরা যোগ করে বললে, ‘আর সিগারেট টানতে হবে, দেখলাম নতুন আরও কয়েক প্যাকেট এনেছো।’

– ‘সিগারেটকে এত তুচ্ছ করে দেখো না। একটা জিনিস পু*ড়িয়ে খাচ্ছি। ভাবতেই তো ভালো লাগে।’

– ‘নিজেরও ক্ষ*তি।’

– ‘নিজের ক্ষ*য়েও এক ধরনের আনন্দ আছে।’

‘তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছা নাই অনিক, যাও, গোসল করে লিখতে বসো। আজ আমি পড়বো তোমার লেখা।’

‘হ্যাঁ, যাচ্ছি’ বলে অনিক চলে গেল। আফরা টেবিল গুছিয়ে। নিজের রুমের বিছানা বালিশ ঠিক করে। ঘণ্টা খানেক পর এসে উঁকি দিল অনিকের রুমে। দরজা ভেজানোই ছিল। টেবিলে ল্যাপটপ। সেখানে একটা লাইন লেখা,

‘সবই তো আছে আমার, কেবল হারিয়েছো তুমি
তবু এই কোলাহলের শহর লাগে বিরান ভূমি।’

অনিক টেবিলে বাঁ হাতের উপর কপাল ঠেকিয়ে বসে আছে। ডান হাত এক পাশ দিয়ে ঝুলে আছে নিচের দিকে। আঙুলের ফাঁকে সিগারেট। আফরা ওর কাঁধে হাত রাখতেই অনিক মাথা তুলে তাকায়৷ কেঁপে উঠে আফরার বুক। অনিকের মুখ প্রায় ফুলে আছে। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে অবাক হয়ে বললো, ‘অনিক কাঁদছো কেন পাগল?’

অনিক চোখ মুছে বললো, ‘ভাবি ভালো লাগছে না, যাও তো রুম থেকে, যাও বলছি।’

আফরা বের হয়ে চলে এলো। বিছানায় বসে আছে, কখনও পায়চারি করছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু৷ ছেলেটা এত ভালোবাসে। এভাবে সারাজীবন কষ্ট পাবে। কিছুই কি করার নেই? মেয়েটিই বা কেন তাকে ফিরিয়ে দিল? বয়সে ছোট বলে? অনিক তাকে যা বললো, সেগুলো কি পদ্যকে বলেনি? না-কি সুযোগই পায়নি? না, একবার কথা বলবেই সে। কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ মাথায় এলো নাম্বার কল ব্লক দিলেও হোয়াটসঅ্যাপে নিশ্চয় দেয়নি৷ মেয়েটা হোয়াটসঅ্যাপে আছে কি-না কে জানে। আফরা মোবাইল হাতে নিয়ে পদ্যের নাম্বার সেভ করে হোয়াটসঅ্যাপে গেল। গিয়ে দেখে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সে মেসেজ দিল, ‘পদ্য, আমি তোমার নাঈম ভাইয়ের বউ। তোমার সাথে কিছু কথা বলবো। ফ্রী থাকলে একবার কল দেবে প্লিজ।’
__চলবে…ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২১
.
বিয়ে পেছানো হয়েছে শুনে মিরাজুল ইসলাম খানিকটা আ* হত হলেন। পদ্য তখনই স্কুল থেকে ফিরে এসেছে। তাই মতিন মাস্টারকে কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘তাহলে যাই মাস্টার ভাই।’

মনিরা বেগম পানদানি নিয়ে এসে বললেন, ‘পান খেয়ে যাও।’

মিরাজুল ইসলাম পান খেয়ে আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে বের হয়ে গেলেন। পদ্য কারও সঙ্গে কোনো কথা না বলে বোরখা-নেকাব খুলে নিল। মনিসা টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে পদ্যের চুলের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আচ্ছা আম্মা, আপুর চুল এত সুন্দর, আমার চুল তাহলে লালের মতো কেন?’

মনিরা বেগম পদ্যের বোরখা বারান্দার দড়িতে মেলে রেখে এসে বললেন, ‘তুই আরও বড় হলে তোরও কালো হবে।’

– ‘কী যে বলো আম্মা, আমি এখন এতদূর খেয়া পার হয়ে স্কুলে যাই। তোমরা এখনও আমাকে ছোটো বলো।’

মতিন সাহেব হেঁসে ফেললেন। মনিরা বেগম ধমক দিয়ে বললেন, ‘এই তোর জানে শান্তি নাই? পিঠ দিয়ে কোনোকিছু না ঠেললে তোর হয় না? টেবিল ঠেলতেছিস কেন?’

মতিন মাস্টার পা তুলে বিছানায় বসে বললেন, ‘আহা তুমি মেয়েটার সাথে সারাক্ষণ ধমকা-ধমকি করো কেন বলো তো।’

‘আমি শুধু ধমকা-ধমকি করি। তুমি তাইলে বেশি আহ্লাদ কইরা মাথায় তুলে রাখো’ বলে মনিরা বেগম রান্নাঘরে চলে গেলেন। পদ্য পুকুরে এলো হাত-মুখ ধুতে। অথচ পানিতে কবজি অবধি হাত ডুবিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে কেবল নাড়ছে সে। অনিক এখন কি করছে? খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয় ওর। এই পুকুরে তারা কত সাঁতার কেটেছে। অনিককে তার বাবাই সাঁতার শেখান। তখন মতিন মাস্টার এমন নরম-কোমল ছিলেন না। সবাই ভয় পেত। শেষদিকে পদ্য আর তার মা বাড়িতে সবসময় বুঝাতো ‘বাচ্চাদেরকে আদর করতে হয়, তোমাকে ভয় পায় সবাই।’ ধীরে ধীরে তিনি সেটা বুঝেও ফেলেছিলেন। অনিকেরা যখন এখানে আসে। পদ্য আর অনিক অনেক ছোটো। অনিক প্লাস্টিকের একটা ছোট্ট পাইপ কোত্থেকে এনেছে। তারপর কোদাল দিয়ে তাদের উঠানের মাথায় গর্ত করে। মনিরা বেগম কোনোভাবেই আঁটকে রাখতে পারছেন না। তার কথা হলো শেষে আবার মাটি ফেলে গর্ত ভরা রেখে যাবে। সেই গর্তের মাঝখানে পাইপ রেখে মাটি দিয়ে দুইভাগ করে নিল। পদ্য স্কুল থেকে আসার পর টেনে নিয়ে এসে বললো, ‘পদ্য আপু দেখবে এখন একপাশের গর্তে পানি দিলে আরেক পাশে কীভাবে যায়?’

পদ্যের দারুণ লাগলো খেলাটা। সে আগ্রহ নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা পানি আনো তো।’

অনিক লোটা নিয়ে পুকুর থেকে পানি আনতে গিয়ে পড়ে গেল। নারিকেল পড়ার মতো শব্দ শুনে পদ্য দৌড়ে গিয়ে দেখে অনিক নেই। তখনও অনিক সাঁতার শেখেনি। কোত্থেকে মতিন মাস্টার তখন পুকুর পাড়ের রাস্তা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছেন। পদ্যকে দেখে বললেন, ‘কী হয়েছে?’

সে বললো, ‘আব্বা অনিক পুকুরে পড়ে গেছে।’

তিনি দৌড়ে এসে লোটা সহ তাকে টেনে তুলে আনলেন। তারপর পিঠে দিলেন কয়েকটা কি*ল-ঘু*সি। তাতেও শাস্তি শেষ হলো না৷ পরেরদিন ছিল শুক্রবার। অনিককে বাড়িতে গিয়ে ধরে নিয়ে এলেন। সাঁতার শিখতে হবে। সে চিৎকার করে কাঁদছে৷ নিয়ে এসেই ঠেলে ফেললেন পুকুরে।

‘কিরে পদ্য, এতক্ষণ থেকে বইসা আছিস কেন?’ মনিরা বেগমের কথা শুনে যেন পদ্য চৈতন্য ফিরে পায়।
তাড়াতাড়ি আঁজলা ভরে মুখে পানি দিয়ে বললো, ‘আব্বা অনেক পালটে গেছে তাই না আম্মা? আগে কি রাগী ছিল।’

– ‘হ্যাঁ, এখন কি আহ্লাদ বেড়েছে।’

পদ্য মুচকি হেঁসে উঠে ঘরে চলে এলো। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে হঠাৎ মনে হলো মেগাবাইট (MB) নেই।
মনিসাকে বললো, ‘আব্বা কইরে?’

– ‘চেয়ার নিয়ে পিছে বসছে গিয়ে।’

পদ্য রান্নাঘর দিয়ে বাড়ির পেছনে এসে বললো, ‘আব্বা মোবাইলে তো টাকা নাই। একটু কি দেখবে কেউ বাজারে যায় কি-না।’

– ‘নাম্বার একটা কাগজে লিখে দে মা। খেয়াঘাটে গেলে পাব।’

– ‘আচ্ছা আব্বা।’

পদ্য গিয়ে একটা কাগজে নিজের নাম্বার এবং টাকা লিখে দিল।
.
অনিক ইয়ারফোন কানে গুঁজে অন্ধকার রুমে বসে আছে। মোবাইলে পদ্যের একটা ছবি। শাড়ি পরনে। লাল লিপস্টিক ঠোঁটে। মুখে লাজুক হাসি ছড়ানো। ছবিটি, ছবি থেকে তোলা। পদ্যদের ঘরেই ছিল। একদিন মোবাইলে তুলে নিয়েছিল সে। এখন দেখছে। কানে বাজছে পুরাতন বাংলা গান। পুরাতন হিন্দি বা বাংলা গানে কি মেশানো আছে কে জানে। শুনলেই নস্টালজিক হয়ে যায় সে। পদ্যের কাছে গিয়ে পড়তে বসতো অনিক। ছোট্ট থেকে একেবারে এসএসসি পর্যন্ত ইচ্ছা করেই যেত। পড়তে বসলে প্রায়ই পদ্য একেকটা গান গুনগুন করতো। রেডিওতে ছায়াছবির গান শোনা হতো তখন। পদ্যের ঠোঁটের সেই গানগুলো এখন খুঁজে খুঁজে শুনে অনিক। চোখের সামনে ভেসে উঠে একটা মায়াময় মুখ। কি সুন্দর ছিল দিনগুলো। হারিকেনের হলদে আলো। পদ্য বাঁ হাতে ভর দিয়ে মাদুরে বসে আছে। চুলগুলো একপাশের গাল বেয়ে এসে পড়েছে। মৃদু দুলতে দুলতে গুনগুন করে চিকন মিষ্টি কণ্ঠে একেকটা গানের একেক লাইন হঠাৎ গেয়ে উঠছে পদ্য। শেষদিকে বেশি শুনেছে,

“রাতের আকাশে তারার মিতালি
আমারে দিয়েছে সুরের গীতালি
কত যে আশায় তোমারই নামে
জ্বালিয়ে আমি রেখেছি দীপালি…।”

অনিক তখন মন্ত্র-মুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতো পদ্যের দিকে। একদিন তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পদ্য বললো, ‘এভাবে কী দেখো তুমি অনিক?’

সে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বলতো, ‘তোমাকে দেখি আপু।’

পদ্য মুচকি হেঁসে বলতো, ‘কেন?’

– ‘তোমার চেহারা কেমন মায়া মায়া।’

পদ্য খিলখিল করে হেঁসে উঠেছিল। কথাটা গিয়ে মা’কেও বলে আসে। তারপর সবাই অনিককে নিয়ে একদফা হাসাহাসি।

অনিক একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বাতি জ্বালিয়ে টেবিলে বসলো। কতদিন হলো ডায়েরি পড়ে না। চাবি হাতে নিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে নীল ডায়েরি বের করে আনলো। চেয়ারে বসে পাতা উলটে যেতে যেতে দেখে শেষদিকে কিছু পেইজ খালি। কলম বের করলো সে। সিগারেট টানতে টানতে লিখলো,

“প্রিয় পদ্মফুল, তুমি কি জানো? সেই ছোট্ট বালকটি থেকে এই পরিণত যুবক হওয়া পর্যন্ত জগতের সুন্দর কিছু বলতে তোমাকেই বুঝি আমি। জীবনের এই ক’টা বছর তোমার থেকে আমি দূরে থেকেছি। তোমাকে না দেখার, না পাওয়ার, দু’টা কথা বলতে না পারার যে যন্ত্রণা নিয়ে আমি পথ চলি, ঘুমাই, দৈনন্দিন সবকিছু করি। যখন করি তখন কষ্ট হয়। সেটা যখন অতীত হয়। তখন ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে৷ ওই কষ্টের দিনগুলোও যেন কি ভীষণ মিষ্টি৷ দিনগুলোতে তুমিই তো ছিলে মিশে।

পদ্মফুল, তুমি কি জানো? এদিকে একটা হসপিটাল আছে। প্রায়ই রাত্রে এম্বুল্যান্সের সাইরেন শুনতে পাই। আমার তখন কেন যেন প্রচণ্ড ভয় হয়। বুকটায় কি এক চাপা যন্ত্রণা। কেন হয় জানি না৷ সেই ভয়ের সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ অদ্ভুতভাবে বাকি রাতটা আমার শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। আমি বুঝি না। কীসের সঙ্গে কী? সুযোগ পেলেই সবকিছুতে তোমার কথা এমন মনে পড়তে হবে কেন?

পদ্মফুল, ভোরের চড়ুই পাখির কিচির-মিচির শব্দের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক কী? বিষণ্ণ দুপুরে আকাশে কাক ‘কা-কা’ উড়ে গেলে আমার তখন এত তোমার কথা মনে পড়ে কেন? কোনো মিষ্টি ঘ্রাণ কিংবা দূরে কোথাও থেকে কোনো করুণ সুরের গান আমার কানে আসলেই, চোখে তুমি চলে আসো কেন? কীভাবে? আমি বুঝি না পদ্মফুল। এসবের যুক্তি কী? বিজ্ঞান এসব নিয়ে কিছু বলেছে কি-না কে জানে। এতকিছু তো জানা হয়ে উঠে না আমার।

পদ্মফুল, তুমি কি জানো? আমি কোনো উপন্যাস লিখতে লিখতে আচমকা মনে হয় পুরো বইজুড়ে তোমাকে লিখে ভরে ফেলেছি। সবকিছুতে তুমি যেন ওতোপ্রোতোভাবেই জড়িয়ে থাকো, মিশে থাকো, এগুলো কীভাবে হয়? কোনো যুক্তিই তো খুঁজে পাই না। সবকিছুতে তুমি কীভাবে? দরবেশ, পীরবাবা কিংবা কোনো ধর্মযাজক কী এসব নিয়ে কিছু বলে না? বলেছে হয়তো, আমার তো সবকিছুর খবর রাখা হয়ে উঠে না।

পদ্মফুল, আরেকটা অদ্ভুত বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি। কিছু কিছু মেয়েদের আমার ভীষণ আপন লাগে। ইচ্ছা করে ওদের সঙ্গে দু’একটা কথা বলি। আমার অফিসে এক কলিক আছে। মেয়েটাকে দেখলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। অনেকদিন ভেবেছি মেয়েটাকে এত মায়া লাগে কেন? কিছুদিন পর বুঝতে পারলাম ওকে পিছু থেকে দেখলে খানিকটা তোমার মতো লাগে। শুধু এই কারণে আমি মেয়েটির সঙ্গে কাজে-অকাজে গিয়ে কথা বলি। কেমন যেন শান্তি পাই। এমন কেন হয়? হওয়াটা কী ঠিক হলো? এই বিষয়টা জানলে কি তোমার খুব রাগ হবে? রাগ হওয়াটা কী ঠিক?

পদ্মফুল, তোমাকে আমি পেয়ে গেলে প্রথমে কি করতাম জানো? আঁজলা করে তোমার মুখটা ধরে তাকিয়ে থাকতাম। টানা কয়েক জন্ম তাকিয়ে থাকতাম। আমার ছোটো বেলার সেই ‘মায়া মায়া’ মুখটার দিকে শান্তি মতো তাকিয়ে থাকার, ছুঁয়ে দেখার ভীষণ লোভ..।’
আঁটকে যেতে হলো। কেউ অনেকক্ষণ থেকে দরজায় নক দিচ্ছে। ডায়েরি বন্ধ করে ওয়ার্ডরোবে রেখে দরজা খুলে দিল সে। ইভা চা হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

– ‘বাতি জ্বালাও তো অনিক ভাই। দরজা বন্ধ করে এই সন্ধ্যাবেলা কেউ বসে থাকে না-কি? আর রুমে কি ভ্যাপসা গন্ধ।’

অনিক বাতি জ্বেলে দিয়ে চেয়ারে বসে বললো, ‘ইভা একটা ব্যাপার তুমি খেয়াল করেছো?’

– ‘কী?’

– ‘আচ্ছা চা দাও, চা খেতে খেতে বলি।’

ইভা এসে চা বাড়িয়ে দিয়ে বিছানায় বসে বললো, ‘খুব জরুরি কথা মনে হচ্ছে?’

– ‘জরুরি ব্যাপারটাও আসলে আপেক্ষিক। কে কোন জিনিসটা জরুরি মনে করবে সেটা তার বিষয়। যেমন কেউ জীবন বাঁচাতে ম*রণব্যাধির সাথে সংগ্রাম করে, হসপিটাল দৌড়ায়, কোটি কোটি টাকা ঢালে। আর কেউ কেউ কী করে? আ*ত্মহ*ত্যা।’

ইভা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘অদ্ভুতভাবে কথা বলবেন না তো। প্রথমে কি বলতে চাইছিলেন সেটা বলুন।’

সে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,

– ‘চা জিনিসটা একটা দারুণ খাদ্য।’

– ‘কী বলতে চাইছিলেন সেটা তো আগে বলুন।’

– ‘কথা হলো আমার রুমের দরজা বন্ধ থাকলে, বাতি বন্ধ থাকলে, তোমরা যে রিয়াকশনটা দেখাও সেটা কী ঠিক?’

– ‘ঠিক নয় কেন?’

– ‘ধরো যারা নির্মাণ কাজ করে। ওরা বালি, সিমেন্টে পানি-টানি দিয়ে একেবারে নিজেদের কাপড় সহ নোংরা করে কাজ করে, করে কি-না?’

– ‘হ্যাঁ করে।’

অনিক চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, ‘আবার অনেকে জমিতে কাজ করে। সেটা পুরোপুরি কাদা-পানিতে। উপরে সূর্যও থাকে নি*র্যাতন করার জন্য।’

– ‘অনিক ভাই জ্বালাবেন না তো। কী বলবেন বলুন। দুনিয়া ঘুরিয়ে এনে একটা কথা বলবেন।’

– ‘কথাটা হলো ওদের গিয়ে কি তোমরা কখনও বলেছো, ছি, কাদায় মাখামাখি করছো কেন? সিমেন্ট, বালিতে কাপড় নষ্ট করছো কেন? রোদে চামড়া পোড়াচ্ছ কেন?’

– ‘আচ্ছা বাবা বলি না। তো হয়েছে কী?’

– ‘তাহলে আমার রুমে ঢুকেই নাক টেনে বলো ভ্যাপসা গন্ধ, অন্ধকার রুম, সবকিছু এলোমেলো। এসবের কারণ কী?’

– ‘ওদের সাথে আপনার রুমের সম্পর্ক কী?’

– ‘সম্পর্ক হলো আমিও রুমে একটা কাজ করি। সেটা হলো লেখালেখি। সেই কাজের স্বার্থে দরজা বন্ধ থাকে, কখনও বাতি অফ রাখি।’

– ‘হায় আল্লাহ, এই কথা বলতে এত লম্বা কাহিনি!’

– ‘শুধু এই কারণে না, আরেকটা কারণ হলো চা খাওয়া। একা চা খাওয়ায় আনন্দ নাই। তোমাকে তাই আঁটকে রাখা হয়েছিল। এখন যেতে পারো।’

– ‘আচ্ছা, একটা কথা অনিক ভাই৷ কি হয়েছে বলুন তো আপনার? দেবদাস হয়ে যাচ্ছেন কেন?’

– ‘কিছু না, তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’

– ‘ভালোই, আপনার ওই উপন্যাস শুরু করবেন কবে?’

– ‘করবো।’

– ‘আচ্ছা চা শেষ, বাইরে চলুন। আপনার না-কি মন খারাপ। এখন বাইরে নিয়ে যেতে হবে আমার।’

– ‘তাই না-কি, কে পাঠিয়েছে?’

– ‘থাক, জানা লাগবে না চলুন। অন্ধকারে বসে না থেকে বাইরে গেলে ভালো লাগবে।’

অনিক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘তা অবশ্য ঠিক বলেছো।’

খানিক পর দু’জন রেডি হয়ে বাইরে চলে গেল।

রাত আটটার দিকে আফরার কাছে একটা কল এলো। নাঈম তখন বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে। আফরা ইভার রুমের বারান্দায় এলো। পদ্য হোয়াটসঅ্যাপে কল দিয়েছে। সে ব্যাক করলো। ওপাশ থেকে সালাম দিল পদ্য। আফরা জবাব দিয়ে বললো, ‘কেমন আছো?’

– ‘ভালো আছি ভাবি, আপনারা সবাই ভালো আছেন তো?’

– ‘না, আমরা মোটেও ভালো নেই।’

পদ্য নীরব হয়ে গেল। তারপর আফরা পুনরায় বললো, ‘অনিকের অবস্থা খুবই খারাপ বোন। ওর জন্য কিছুই কি করার নেই? দেখে কি যে কষ্ট লাগছে।’

পদ্য আমতা-আমতা করে বললো, ‘আমার কী করার আছে ভাবি?’

– ‘তোমাকে এত ভালোবাসে ছেলেটা। কীভাবে পারলে ফিরিয়ে দিতে? জানো, তোমার বিয়ের খবর শুনে পাগল হয়ে গেছে প্রায়। রাগে-দুঃখে সিগারেট চিবিয়ে খেয়ে রাস্তায় গিয়ে বমি করেছে। এতটা বছর ফ্যামিলির সবাই বুঝিয়েও বিয়ে করাতে পারিনি। তোমার বিয়ে হয়ে গেলে ছেলেটা পাগল হয়ে যাবে বোন।’

পদ্যের গলা পালটে গেল। সে ধরা গলায় বললো, ‘ভাবি আমি এসব নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। আসলে ওকে ফিরিয়ে না দিয়ে উপায়টাই বা কি আছে বলুন?’

– ‘উপায় অবশ্যই আছে। তুমি অনিকের কথা শুনে দেখতে পারো। কথা বলো ওর সাথে। বয়সে ছোটো এই বিষয় নিয়ে সে মাথাই তো ঘামায় না।’

– ‘আমি ওর সঙ্গে কথা বলে প্রশ্রয় দিতে চাই না ভাবি। যা সম্ভব নয়, তা ভুলে যাওয়াই ভালো৷ কথা বললে ওর ভুলতে কষ্ট হবে।’

– ‘ওর তো এমনিতেই কষ্ট হচ্ছে। আমার মনে হয় একটু চিন্তা করে দেখা দরকার তোমার। এখন যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে নিশ্চয় অনিক থেকে কোনোভাবে এগিয়ে না..।’

পদ্য তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘এগিয়ে থাকা না থাকা নিয়ে আমি চিন্তিত না ভাবি।’

– ‘না থাকলেও চিন্তা করো। তোমার জন্য যে ছেলেটা ম*রে যাচ্ছে৷ তাকে ফেলে আরেকজনকে বিয়ে করবে, সে নিশ্চয় এগিয়ে আছে? না থাকলে কেন করছো?’

– ‘আমি অনিককে ভালোবাসি না বলেছি তো ওকে।’

– ‘যাকে বিয়ে করবে তাকে কি বাসো?’

– ‘না।’

– ‘তাহলে বিয়ে করছো কেন? এক সময় ভালোবাসা হবে তাই। অনিককেও সেভাবে বিয়ে করতে পারতে। ছেলেটা তো ভালোবাসে তোমাকে।’

– ‘অনিক আমার ছোটো, সমাজ এটা ভালোভাবে নেবে না।’

– ‘তুমি সমাজের কথা কেন ভাবছো? নিজের ভালোটা বুঝবে না বোন? অনিক ভালো ছেলে, শিক্ষিত, লেখক, জব করে, তোমাকে পছন্দ করে। সমাজের জন্য কেন তুমি ভালো পাত্র হাতছাড়া করবে? অনিককে ভালো না বাসলেও তো তাকে বিয়ে করা উচিত তোমার।’

– ‘আপনার কাছে কি বয়স ব্যাপারটা এতটাই ছোটো?’

– ‘ছিল না, তবে অনিকের কাছে ছোটো। অনিক আমাকে বুঝাতে পেরেছে সেটা। তারমানে বাকি জীবন অন্যদেরও বুঝাতে পারবে। বোকামি করো না পদ্য। ওর সাথে কথা বলো। আর সত্যি করে বলো তো, অনিককে কি তুমি পছন্দ করো না? আমি বিশ্বাস করি না। আমি একটা মেয়ে। আমি জানি অনিককে ভালো না বেসে থাকতে পারার কথা না৷ আর তুমি এখন কথা বলতে গিয়ে বলতেই পারছো না। তা কেন? গলায় কান্না-কান্না ভাব কেন?’

পদ্য আবারও নীরব রইল। কোনো জবাব এলো না। আফরা পুনরায় বললো, ‘একটু আগে বলেছি অনিককে যদি ভালো নাও বাসো, তাহলেও কেন বিয়ে করা উত্তম। এখন বলবো যদি ভালোবাসো, পছন্দ করো, তাহলে কি করবে৷ প্রথমত যদি অনিককে ভালোবাসো। তাহলে আর কাউকে বিয়ে করলে তিনটা জীবন নষ্ট হবে। তোমার আর অনিকের, সঙ্গে নিরপরাধ একজন ব্যক্তি, যে তোমাকে বিয়ে করবে। এই ভুলটা করো না বোন। তোমার জীবনে সবচেয়ে বড়ো একটা ভুল হবে।’

ওপাশ থেকে নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আফরা অবাক হয়ে বললো, ‘কী হলো? তুমি কাঁদছো না-কি? কথা বলো।’

পদ্য তবুও কথা বললো না। আফরা পুনরায় বললো, ‘তুমি জানো? আমি অনিককে বলেছিলাম পদ্য তো তোমাকে ভালোবাসে না। তাহলে তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? তখন সে আমাকে একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। তাকে ভালো না বাসলেও কেন পদ্যের তাকেই বিয়ে করা উচিত। এটা নিয়ে লম্বা লেকচার দিল। সেই লেকচারের অল্প একটু উপরে তোমাকে বলেছি। অথচ সেই লেকচারের কোনো দরকারই নেই। তুমি অনিককে ভালোবাসো। শোনো পদ্য, অনিকের সঙ্গে কথা বলো। মনখুলে কথা বলো। এরকম ছেলে কখনও পাবে না। সমাজের কথা ভেবে হাতছাড়া করো না।’

পদ্য নাক টেনে বললো, ‘ভাবি ফোন রাখছি আমি’ বলেই কল কেটে দিল।

আফরা বারান্দার রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের মিটিমিটি তারার দিকে তাকায়। খানিকক্ষণ কিছু একটা ভেবে আবার হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দেয়, ‘তুমি বুদ্ধিমান মেয়ে হলে আশাকরি অনিককে কল দেবে। সমাজের জন্য নিজের ক্ষতি করো না। তুমি যেসব ভয় পাচ্ছ। অনিক পায় না, কারণ তার কাছে এসবের ব্যখ্যা আছে। আত্মবিশ্বাস আছে। তোমাকে পাওয়ার জন্য, ভালোবাসার মানুষকে জয় করে নেয়ার জন্য বুকে সাহস আছে। এগুলোও সংক্রামিত হয়, অনিকের সঙ্গে কথা বললে তোমার মাঝেও হবে। আমার যখন বিয়ে ঠিক হয়েছিল। নাঈমের দিশেহারা অবস্থা। আমিও ভাবতে পারছিলাম না কিছু। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে একজন বিজনেস ম্যানের সঙ্গে। বাড়ি গাড়ির অভাব নেই৷ অনিক আমার সঙ্গে দেখা করলো। আমি বললাম বিয়ে ঠিক হয়েছে। পরিবার বিয়ে দিতে চায়। এতো ভালো পাত্র রেখে তোমার ভাইয়ের কাছে ওরা বিয়ে দেবে কীভাবে? সে তখন এমনভাবে হাসলো, আমি ঘাবড়ে গেলাম। হাসি দেখে মনে হয়েছিল খুবই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ বিরাট কোনো ভুলের মধ্যে আছি। তারপর অনেকক্ষণ কথা হলো। এই দিনই আমি বাড়িতে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিলাম। ওর কাছ থেকে কি এমন সাহস পেয়েছিলাম আমি জানি না। অথচ আমি মোটামুটি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অনিক অল্প সময়ে আমাকে কথা বলে বলে পালটে দিয়েছিল। এরপর আমি নাঈমের সঙ্গে দেখা করলাম। অনিকই বিয়ে দিয়েছিল আমাদের৷ মা-বাবা, চাচা কারও কিছু করার নেই। নাঈম কারও ফোনই রিসিভ করতে হয়নি। সবকিছু সামলে নিয়েছিল অনিক। এগুলো তার কাছে খুবই তুচ্ছ, সিম্পল। একজন ম্যাজিক ম্যান।
সেই মানুষটা আজ নিজেরই সমস্যা সমাধান করতে পারছে না। কত অসহায় হলে রাগে-দুঃখে সিগারেট চিবিয়ে খায়? আর তুমিও কীসে এমন অন্ধ হয়ে আছো বোন? কেন দেখতে পারছো না এগুলো? অনিকের মতো ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকা অন্যায়। একটা পুরুষকে তো তোমার বিয়ে করতেই হবে পদ্য, তাহলে সুযোগ থাকার পরও অনিককে কেন নয়? এই ভুলটা করো না।’
__চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here