ছন্দহীন পদ্য পর্ব -২৬+২৭

ছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৬
.
যার সঙ্গে বিচ্ছেদ নিশ্চিত, তার স্মৃতিবিজড়িত তল্লাটে থাকাটা মোটেও সুখকর নয়। তখন ভোলার চেষ্টা করাতেই মঙ্গল। অথচ স্মৃতির সাগরে সাতার কেটেই দিন যাচ্ছে অনিকের। গ্রামে বেশ কয়েকদিন কেটে গেল তার।
রোজই আফরা ভাবির সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, খবর নেয় ওদের। গ্রামের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা খুবই কম হয়। দু’দিন আগে একটা পুরাতন বাইকও কিনে নিল সে। কেউ একজন বিক্রি করবে শুনেই হুট করে ইচ্ছা হলো, তারপর কিনে নেয়া। এখন বাইক নিয়ে কখনও খেয়া পাড় হয়ে রসুল পুর বাজারে যায়। আবার কখনও সন্ধ্যায় রইসু চাচার শিমুল গাছের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা নদীর পাড়ে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। রাতে লিখতে বসে মাঝে মাঝে। লেখা আসে না। লিখতে বসলেই লেখা থেকে স্মৃতি রোমন্থনই বেশি হয়ে যায়৷ সে জানে, শুধু সময়েরই অপেক্ষা, তারপর হঠাৎ একদিন তার চোখের সামনে পদ্যের বিয়ে হয়ে যাবে। এটাই হওয়ার কথা। পদ্য যেখানে তাকে চায় না, তার আসলে সেখানে কিছুই করার নেই। দিনকাল এভাবেই যাচ্ছিল৷ অনেকটা ঘোরের ভেতর দিয়ে। কিন্তু সামান্য পরিবর্তন হলো আজ, পৃথিবী ভেসে যাওয়া এই চাঁদনি রাতে। রসুল পুর বাজার থেকে সোজা নদীর পাড়ে এসে বসেছিল। পেছনে সবুজ ধান ক্ষেত। সামনে যৌবন ফুরিয়ে যাওয়া নদী। আর মাথায় কিছু মিষ্টি স্মৃতি৷ এই জায়গাটাকে পদ্য একদিন ‘বেশ সুন্দর’ বলে তার পাশে বসেছিল। পদ্য সুন্দর বলেছে মানে সুন্দর। গোধূলিলগ্নে এসে বসে পুরো রাত কাটিয়ে দেওয়ার মতো সুন্দর। পদ্যের থেকে রুচিশীল মানুষ তো আর কেউ হতে পারে না। অনিকও সেই সন্ধ্যার আগে এসে রাত ন’টা এখানে। চাঁদের মুখোমুখি হাত তুলে পেছনে ছায়া ফেলছে, দেখছে। নিজের হাতকে বারবার পদ্যের সেই হাত বলে ভ্রম হচ্ছে। এরকমই সময় যাচ্ছিল। হঠাৎ আফরা ভাবির থেকে কল এলো। আর পালটে গেল যেন তার পৃথিবী। এক অবিশ্বাস্য তথ্য দিল আফরা ভাবি। সেটা হলো পদ্যও তাকে ভালোবাসে৷ এবং শুধু ভালোবাসে না। ওর বাবার অসুস্থতার পেছনে তারা দু’জনই দায়ী। পদ্য পরিবারকে তার কথা বলে দিয়েছিল। এসব কথা অনেকদিন কষ্ট করে গোপন রেখেছে। বারবার বলতে গিয়েও বলেনি। আজ নাঈমের সঙ্গে পরামর্শ করে বলে দিয়েছে। তাদেরও কিছু করার নেই আর। কারণ মতিন মাস্টারের যে অসুখ। তাতে উনার মনে প্রভাব পড়ে এমন আলাপই করা যাবে না। অনিক ফোন রাখার পর থেকে এখানে থ মেরে বসে আছে। পদ্য তাকে ভালোবাসে! তার কথা পরিবারকেও বলেছিল? এরচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা যেন আর নেই। কোনোভাবেই তার বিশ্বাস হচ্ছে না। এখন সে কী করবে? চাইলেই তার বাবাকে বলতে পারে। এতটুকু সাহসী কিংবা বেয়াদব সে জন্ম থেকেই আছে। কিন্তু পদ্যের বাবা? ওর বাবাকে তো উত্তেজিত করা যাবে না। আর পদ্যকে কী সে দেখবে না? এখন যে দেখতে আরও বেশি ইচ্ছা করছে। আরও বেশি আপন মনে হচ্ছে মেয়েটাকে। তাকেও যে ভালোবাসে তার পদ্য। সাহস করে পরিবারকেও বলে দিয়েছিল তার কথা। সে কালই সিলেট যাবে। অবশ্যই যাবে। দু’চোখ ভরে দেখে আবার চলে আসবে। আজ থেকে তো পদ্য তার স্ত্রী। অলিখিত, অসাংবিধানিক, অস্বীকৃত স্ত্রী৷ দু’জনের মন যখন একে অন্যকে গ্রহণ করে নেয় তখন আর বাকি থাকে কী? বাকি শুধু খাতা-কলম, লোক-দেখানো অনুষ্ঠান। সেই সুযোগ যদি কোনোদিন তার নাও হয়৷ সে অবিবাহিত থাকবে। মনে করবে পদ্যই তার স্ত্রী। নিষ্ঠুর এই সমাজ মনগড়া নিয়ম-কানুন বানিয়ে তার স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়েছে, নিক। পদ্য তাকে ভালোবাসে, এর থেকে বড়ো পাওয়া আর কোনোকিছুই হতে পারে না। অনিক আফরাকে কল দিল। কয়েকবার রিং হতেই রিসিভ করলো সে। কিছু একটা নিয়ে খিলখিল করে হাসছে ওরা।

– ‘হ্যালো ভাবি।’

– ‘হ্যাঁ বলো।’

– ‘এত হাসাহাসি কি নিয়ে?’

– ‘লুডু খেলছি তিনজন মিলে।’

– ‘ভাবি আমি তো কাল একটা কাজে সিলেট আসব। ওদের কি কোনো দরকার আছে বাড়িতে?’

আফরা ওদের মাঝখান থেকে উঠে বারান্দায় এসে বললো,

– ‘কীসের দরকার থাকবে?’

– ‘আমার ধারণা ওদের কাপড় বেশি নেয়নি। আমি যখন যাচ্ছি ওদের কাপড় নিয়ে যেতে পারবো। আম্মার কাছে ওদের ঘরের চাবি আছে।’

– ‘অনিক পাগলামি করো না। এখানে এসে কোনো পাগলামি করলে তোমার ভাই আমাকে দোষারোপ করবে।’

– ‘তুমি না বললে ভাইয়ার সাথে কথা বলে আমাকে জানিয়েছো।’

– ‘সেটা তো আমি জিজ্ঞেস করার পর বলেছে আচ্ছা জানাও, জেনে-বুঝে ভাবুক কী করবে। এভাবে থাকবে না-কি এসে জবে জয়েন করবে। পদ্যের চিন্তা বাদ, নিজের বিয়ের কথা ভাবুক। সে তো তার দিক থেকে বলেছে।’

– ‘আচ্ছা বুঝেছি, আমি পাগলামি কিছু করবো না। যাচ্ছি একটা কাজেই।’

– ‘মিথ্যে বলবে না অনিক। তোমাকে জানানো ভুল হয়েছে তাহলে।’

– ‘আহা যাও তো ভাবি। জিজ্ঞেস করো ওদের।’

আফরা গিয়ে বললো, ‘পদ্য তোমাদের বাড়ি থেকে কিছু কী আনাবে? অনিক সিলেট আসবে তো তাই জিজ্ঞেস করছে।’

মনিসা আগেই বললো, ‘আমার ড্রেস আনতে হবে।’

পদ্য ইতস্তত করে বললো, ‘আমার লাগবে না, তোমার এগুলোতেই চলে যাবে।’

অনিক ওপাশ থেকে বললো, ‘ভাবি তাহলে কাল আমি ভিডিয়ো কল দেবো৷ মনিসা কাপড় দেখিয়ে দিতে হবে কী আনবো।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

পরেরদিন অনিক রেডি হয়ে বের হলো এগারোটায়৷ মিরাজুল সাহেব বারান্দায়। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের কাপড়-চোপড় নিয়ে যাচ্ছ না-কি?’

– ‘হ্যাঁ আব্বা।’

– ‘আজই চলে আসবে তো?’

সে ঘাড়ের চুলগুলো ঠিক করে বললো, ‘আমি বাসায় থাকলে কী সমস্যা?’

– ‘না তা হবে কেন? বাসায় তো যথেষ্ট রুম খালি আছে।’

– ‘সমস্যা থাকলে বলো আব্বা, থাকবো না। কিন্তু মুখে যদি সমস্যা না বলে আবার ওদের বাসা থেকে বের করে দেওয়ার চিন্তা করো তাহলে কাজটা ঠিক হবে না।’

– ‘অনিক বেয়াদবের মতো কথা বলো না। কেউ কারও বাসায় এতদিন জায়গা দেবে না। আমি দিয়েছি। আর তুমি এসব কী বলছো?’

– ‘না তো বুঝেছি৷ তাহলে আমি দু-একদিন থাকবো বাসায়। আমার কাজ আছে।’

– ‘কী কাজ?’

– ‘একটা অনুষ্ঠান আছে। ইন্টারভিউ আছে। লেখালেখি নিয়ে কাজ আছে। তাই থাকা লাগবে। যদি সমস্যা থাকে আমি হোটেলে থাকবো।’

– ‘তুমি সমস্যা, সমস্যা করছো কেন অনিক। কীসের সমস্যা থাকবে?’

‘আচ্ছা তাহলে গেলাম।’ বলে সে বেরিয়ে পড়লো। বাবার এমন কোনোকিছু না জানার ভান ধরে থাকা নিয়ে তার বেশ সন্দেহ হয়। উনি জানেন, অথচ তাকে কোনো বকাঝকা করছেন না। এদিকে পদ্যের বাবা হসপিটাল সেটা তাকে জানাতে নিষেধ করেছেন। স্যারের সঙ্গে এত খাতির। তারই কারণে বাসায় থাকতে দিতে চাচ্ছিলেন না৷ এগুলো তাকে বেশ ভাবাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে এত সজাগ থাকলেও তাকে কিছু বলছেন না কেন? এই ভাবনা থেকেই এভাবে কথা বলেছে আজ৷ সন্দেহ আরও গাঢ় হয়েছে।

দু’টার দিকে বাসায় এসে পৌঁছে গেল সে৷ কলিংবেল কয়েকবার চাপতেই এসে দরজা খুলে দিল পদ্য। পরনে আফরার শাড়ি। সদ্য স্নান করা স্নিগ্ধ, লাবণ্যময় চেহারা। চকিত দু’জোড়া চোখের মিলনকাল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর পদ্য চোখ সরিয়ে চলে গেল। অনিক সিটিং রুমে বসার পর মনিসা এলো রুম থেকে বের হয়ে। অনিক তাকে ডেকে এনে বললো, ‘এই ব্যাগে আছে তোমাদের কাপড়।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘ব্যাগ নিয়েই চলে যাবে না-কি? বসো, গল্প করি।’

মনিসা লাজুক হেঁসে পাশে বসলো। তারপর পলিথিনের ব্যাগ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘এই নাও, এখানে স্যারের জন্য আলাদা আছে। তোমার জন্যও চকলেট আইসক্রিম আছে।’

মনিসা মাথা নেড়ে বললো, ‘আচ্ছা।’

আফরা বের হয়ে এলো খানিক পর।

– ‘তুমি এসে মেহমানের মতো বসে আছো যে, ডাকলে না।’

– ‘আহত মন নিয়ে বসে আছি৷ মেহমানকে দরজা খুলে দিয়ে বাড়ির মানুষ কোনো কথাই বলেনি।’

আফরা মুচকি হেঁসে সোফায় বসে বললো,

– ‘কে খুলে দিল।’

– ‘রসুল পুর প্রাইমারি স্কুলের বোবা ম্যাডাম।’

মনিসা ঠোঁট টিপে হাসছে৷ আফরা ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমার আপুকে গিয়ে বইলো বোবা ডাকছে।’

মনিসা ব্যাগ নিয়ে উঠে চলে গেল। অনিক আফরাকে ফিসফিস করে বললো, ‘ও এত লজ্জা পায় কেন? সব জেনে গেছে তাই না?’

– ‘হ্যাঁ, জানে হয়তো।’

– ‘আচ্ছা আমি কী তাহলে চলে যাব?’

– ‘দুইতলায় থাকলে, থাকতে পারো। তোমার রুম তো পদ্য আর মনিসা দখল করেছে।’

– ‘স্যার আর চাচি কোথায়?’

– ‘ইভার রুমে।’

– ‘আচ্ছা তুমি এখন মনিসাকে কোনো দরকার দেখিয়ে ডেকে নিতে পারবে?’

আফরা চোখ ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কেন?’

– ‘আমার রুমে কিছু দরকারি জিনিস আছে নেব।’

– ‘পদ্য যে রুমে তাহলে..।

– ‘সে থাকুক, চিন্তা করো না। তুমি জাস্ট মনিসাকে নিয়ে আসো।’

– ‘প্লিজ কোনো সিন ক্রিয়েট করো না অনিক। ওর মা-বাবা দেখবে।’

– ‘দেখলে বলবে ওর দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে উপরে যাবে তাই গেছে।
প্লিজ ভাবি, মনিসাকে জাস্ট বের করে নিয়ে যাও।’

আফরা ইতি-উতি করে উঠে গিয়ে মনিসাকে নিয়ে ওর রুমে চলে গেল। অনিক ধীরে ধীরে তার রুমে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে রাখলো। পদ্য বিছানায় বসা ছিল। আঁতকে উঠলো সে। অনিক মুহূর্তে পরনের ব্লেজার বিছানায় ছুড়ে ফেলে পদ্যের দিকে ধেয়ে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ‘তুমি বেশি বাড়াবাড়ি করছো পদ্য..।’

পদ্য পলকে তার হাত ধরে থামিয়ে বললো, ‘প্লিজ অনিক আস্তে-আস্তে। কী করছো তুমি? আব্বা-আম্মা শুনবে তো। তুমি কী পাগল হয়ে গেছো? এখানে কেন এসেছো?’

– ‘শুনলে শুনবে, তোমার কারণেই শুন..

পদ্য আবার থামিয়ে বললো, ‘তুমি জানো না আব্বার এসব শুনলে ক্ষতি হবে?’

– ‘আমি তা জানতে চাই না। আমি নিজেই তো ম*রে যাচ্ছি৷ তুমি তো শুধু নিজের বাবারটা দেখছো..।’

– ‘তুমি কী পা*গল হয়েছো অনিক? প্লিজ এখান থেকে যাও।’

– ‘পাগল হওয়া কী অস্বাভাবিক? তুমি যা আচরণ করছো আত্মহ*ত্যা করাও তো অস্বাভাবিক না।’

– ‘প্লিজ এখান থেকে যাও, তুমি বুঝতে পারছো না ব্যাপারটা।’

– ‘শোনো পদ্য, আমার মাথা কিন্তু ঠিক নাই। আমি গিয়ে তোমার আব্বার কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেবো।’

– ‘কি বলো এসব! দেখো এরকম করলে তোমাদের বাসা থেকে চলে যাব।’

– ‘কোথায় যাবে? বাড়িতে গেলেও আমি যাব। গ্রাম, বাড়ি, পাড়া-মহল্লায় পাগলামি করবো। তোমার আব্বা সেগুলো শুনলে কী হবে?’

– ‘আস্তে কথা বলো, তুমি এগুলো করবে কেন অনিক? শান্ত হয়ে বসো এখানে।’

– ‘আমি বসবো না। আমার কথা আছে। আপাতত তুমি সবকিছুতে আনব্লক করো। তাহলে সকল পাগলামি তোমার কাছে থাকবে। না হলে পাগলামি ছড়িয়ে পড়বে।
গিয়ে নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেবো তোমার আব্বার কাছে। আর সহ্য করতে পারবো না আমি। মাথা কিন্তু ঠিক নাই। পাগল হয়ে গেলে কিন্তু কার বাবা স্ট্রোক করবে সেটা ভেবে কেউ কাজ করে না।’

পদ্য দরজার দিকে উঁকি দিয়ে বিছানা থেকে ব্লেজার তুলে তার হাতে দিয়ে বললো, ‘প্লিজ যাও তুমি এখন, আমি আনব্লক করছি। প্লিজ যাও, মেসেজে বলো যা বলার।’

অনিক ব্লেজার হাতে নিয়ে। আলনা থেকে কিছু কাপড় হাতে নিয়ে আবার পিছু ফিরে তাকিয়ে বুকটা কেমন চিনচিনে এক ব্যথায় ভরে উঠলো। পদ্যের সঙ্গে এরকম আচরণ করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার। শুধু আনব্লক করানোর জন্য এই অভিনয়টুকু দরকার ছিল। বিছানার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কোন বালিশে ঘুমাও তুমি।’

পদ্য কাঁপা কাঁপা আঙুলে দেখালো বালিশটি। অনিক হাতে নিয়ে বালিশে চুমু খেয়ে বুকে চেপে রেখে কাতর চোখে তাকিয়ে বললো, ‘এই বালিশটা আমি নিয়ে যাই পদ্য? ভাবিকে বললে অন্য একটা দেবে তোমাকে।’

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলামছন্দহীন পদ্য
.
পর্ব_২৭
.
পদ্য ওর কাতর চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করে সম্মতি দেয়। অনিক রুম থেকে বের হয়ে চলে যায়। ওর প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে মুখটা দুইহাতে ঢেকে বসে যায় পদ্য৷ কেন এমন করছে মানুষটা? সেও যে রক্ত-মাংসের এক রমণী, আর কত নিজেকে সামলে রাখবে? বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে অনিক যখন বললো, ‘নিয়ে যাই?’

ওর সম্মোহনী চোখের দিকে তাকিয়ে পদ্যের শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। দু’টা লাল বিরহবিধুর চোখ। কত কষ্ট পাচ্ছে মানুষটা। দু’টা কথা বলে সান্ত্বনা দেওয়ারও পদ্যের সুযোগ নেই। যে হাত দিয়ে অনিককে শান্ত হতে বলেছিল। পদ্য সেই হাতের তালুতে চুমু খেল। নিজের গালে চেপে ধরলো। তারপর চোখমুছে মোবাইল হাতে নিয়ে আনব্লক করে রাখলো অনিককে। মিনিট কয়েক পর আফরা আসায়, অন্যদিকে তাকিয়ে ভেজা চোখ মুছে নিল সে। আফরা পাশে বসে বললো, ‘অনিক কিছু করেছে?’

– ‘কী করবে?’

– ‘কিছুই না?’

– ‘না তো।’

– ‘তাহলে পাগলটা আমাকে বললো কেন মনিসাকে বের করে নিয়ে যেতে।’

– ‘কী জানি কেন।’

– ‘আমি আরও ভাবলাম জোর করে যদি চুমু-টুমু দেয়, দিক, তুমি মুখে না না করলেও খুশি হতে তা তো আমি জানি।’

পদ্যের মুখে লজ্জা ছড়িয়ে পড়লো। সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো, ‘কি যে বলো ভাবি।’

– ‘আচ্ছা কিছু তো বলেছে, কী বলেছে বলা যাবে না আমাকে?’

– ‘হোয়াটসঅ্যাপে আনব্লক করতে।’

– ‘হুম আমি বুঝেছি এরকম কিছু, আমার দেবর যে জো*র করে কাউকে কিছু করবে না তা জেনেই মনিসাকে ডেকে নিতে রাজি হয়েছি।’

পদ্যের ঠোঁটে চলে এসেছিল সেই জ্বরের রাতে পায়ে চুমু খাওয়ার কথা, তবুও নিজেকে সামলে নিল সে। আফরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বললো,

– ‘তুমি কিন্তু অনেক ধৈর্যশীল। অনিককে এড়িয়ে চলতে পারছো। অথচ আমার বোন আছে না ইভা? সে সিগারেটের গন্ধই নিতে পারে না। বলতো জামাই সিগারেট খেলে ঘর থেকে বের করে দেবে৷ শেষপর্যন্ত বেচারি প্রেমে পড়লো অনিকের। আমাদেরও দোষ আছে। সবাই মিলে ওর পেছনে ইভাকে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।’

– ‘কেন?’

– ‘আমি আর নাঈম তখন জানতাম না অনিক তোমাকে ভালোবাসে। আমাদের মনে হতো ওর ইচ্ছা নেই বিয়ে করার। ইভা যথেষ্ট সুন্দর ছিল। ভেবেছিলাম ওর প্রেমে পড়লে বিয়েতে রাজি হবে অনিক, কিন্তু তুমি কী যে জাদু করে রেখেছো, পাত্তাই পায়নি বেচারি। উলটো কষ্ট পেল মাঝখান থেকে।’

পদ্য কিছু বললো না। আফরা পুনরায় বললো, ‘অনিককে দেখলে মনেই হয় না এত ভালোবাসতে পারে কাউকে। কোন একটা নাটকে বা বইয়ে পড়েছিলাম কিছু মানুষ ডাবের মতো। ডাবে টোকা দিলে নখে ব্যথা পাওয়ার মতো শক্ত। অথচ তার ভেতরে টলটলে পানি। কিছু কিছু পুরুষ মানুষ বোধহয় এরকম, তাই না?’

পদ্য দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘আপনি নিজেও এরকম ভাবি। যদিও আপনাকে দেখলেও বুঝা যায়।’

– ‘আনব্লক করেছো ওকে?

– ‘ও আজ হঠাৎ এরকম চড়াও হল কেন আগে বলুন তো ভাবি?’

– ‘বলবো? রাগ করবে না তো?’

– ‘বলুন আগে।’

– ‘তুমিও তাকে ভালোবাসো বলে দিয়েছি৷ আসলে আমার অসহ্য লাগছিল। গোপন রাখতে পারছিলাম না। আমার অবস্থা কেমন হয়েছে জানো? বই বা সিনেমার দর্শকদের মতো। যারা ভালোবাসার জয় দেখতে চায়, নায়ক-নায়িকার মিল দেখতে চায়। আমি তোমাদের বাস্তব প্রেম দেখে হয়েছি তাদের মতো। তোমাদের জন্য খুব কষ্ট হয়।’

– ‘আপনি আমার জায়গায় থাকলেও তাই করতেন ভাবি৷ ওকে বলে ঠিক করেননি। যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে। ওর পাগলামি বেড়ে গেছে।’

– ‘আসলে আমিও বলতে চাইনি। অনেকদিন বলতে গিয়েও বলিনি। তারপর গতকাল কি যে হলো, বলে দিয়েছি। আর হ্যাঁ, তোমার জায়গায় আমি হলে কী করতাম বলছো তো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তোমার আব্বুর এই অবস্থা হতো আমি বিয়ে করার পর। আমি এর আগেই বিয়ে করে নিতাম হয়তো। আর আরেকটা কথা শোনো৷ এরকম হয়েছি আমি তাও অনিকের সঙ্গে মিশে। ওর সঙ্গে তুমি কথা বলো না। বললে তুমিও করে নিতে।’

– ‘তাই না-কি?’

– ‘হ্যাঁ অবশ্যই। আমি যতদূর বুঝেছি তুমি সুযোগই দাওনি তাকে। ওর সঙ্গে কথা বললে কী হয় জানো? দুনিয়ার সবকিছু তুচ্ছ লাগে। মনকে এই জীবন নদীর মাঝি বানিয়ে নিতে ইচ্ছা করে। তারপর মনের উপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়া। ইভাও কিন্তু বলেছিল একথা।’

পদ্য ঠোঁট টিপে হেঁসে বললো, ‘তাই? আপনাকেও ও ভক্ত বানিয়ে নিয়েছে দেখছি।’

– ‘হেঁসো না, তুমি ওকে কোনো সুযোগই দাওনি। দিলে ঠিকই প্রেমে পড়তে।’

– ‘আমি কী প্রেমে পড়িনি?’

– ‘ও হ্যাঁ পড়েছো৷ কিন্তু ওর পাগলামি আর উদ্ভট কথাবার্তা শোনা হয়নি তোমার। শুনলে এরকম রক্ষণশীল হতে না৷ হুট করে মা-বাবাকে বলে কিংবা না বলে বিয়ে করে নিতে।’

– ‘এখন তো আর কিছু করার নেই। ওর সঙ্গে কথা বললেও বিশেষ লাভ হবে না নিশ্চয়।’

আফরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছো। কারণ সে নিজেই গতকাল বলেছে৷ পদ্য যা বলে তাই। সে আসলে তুমি চাইলে পালিয়ে নিতেও রাজি। মা-বাবা না মানলেও বিয়ে করতে রাজি। তার সবকিছু তোমার মাঝেই আঁটকে গেছে।’

– ‘ভাবি প্লিজ এসব বাদ দিন তো। আপনিও আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছেন। আমি আর এসব ভাবতে চাই না। এমনিতেই আমার কারণে আব্বার আজ এই অবস্থা।’

আফরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ‘যাই, অনিকের রুমটা গুছিয়ে দিয়ে আসি, যাবে তুমি?’

– ‘কি যে বলো ভাবি।’

আফরা মুচকি হেঁসে বললো, ‘যেতে কীসের এত ভয়? নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দূর্ঘটনার?’

– ‘যান তো ভাবি, সরেন।’

আফরা রুম থেকে বের হয়ে উপরে এলো। রুমগুলো খুঁজে খুঁজে একেবারে পশ্চিম দিকে গেল। ইভার রুমের সোজা উপরে যে কামরা সেখানে দরজা খোলা। আফরা ভেতরে গেল। অনিক খালি গায়ে শর্ট প্যান্ট পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।

– ‘এখানে দাঁড়িয়ে কাকে বডি দেখাচ্ছ, পদ্য তো নিচে।’

অনিক সিগারেট ফেলে বললো, ‘নিয়ে আসলেই পারতে।’

– ‘বলেছিলাম আসেনি। এখানে কী লাগবে বেড, বালিশ আছে তো দেখছি।’

– ‘বিছানা চাদর দিলেই হবে। আর ঝাড়ু আনবে।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘আর শোনো, আজ সন্ধ্যার পর পদ্যকে যখন দেখবে ও রুমে নাই। তুমি নিজের রুম লাগিয়ে বসে থাকবে। যাতে অন্যরা ভাবে সে তোমার সঙ্গে তোমার রুমে আছে।’

– ‘তা কেন?’

– ‘ওরা কেউ এমনিতেই উপরে আসবে না। বড়জোর রুমে হঠাৎ না দেখে ভাববে কোথায় গেছে। তখন তোমার দরজায় নক করলে বলবে তোমার রুমে আছে।’

– ‘আরে বাবা সেটা বুঝেছি, কিন্তু কেন?’

– ‘ও সন্ধ্যার পর উপরে আসবে।’

– ‘কেন? বলেছে তোমাকে?’

– ‘না, আমি বলবো।’

– ‘আর তাতেই চলে আসবে?’

– ‘সেটা থাক, তুমি নিজেও উপরে এসো না সন্ধ্যা পর।’

আফরা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘কি শুরু করেছো অনিক। বাড়াবাড়ি একদম ভালো না। তোমাকে জানিয়ে ভুল করেছি দেখছি।’

– ‘আমি মোটেও কারও সঙ্গে বাড়াবাড়ি করিনি ভাবি। তবে হ্যাঁ, তোমার কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি, তুমি এতকিছু করছো..।’

– ‘আমাকে পাম্প দিবে না একদম।’

– ‘ভাবি মানুষের কিছু কথাকে পাম্প, গ্যাস, তেল বলে আমরা তাচ্ছিল্য করি। এগুলো কিন্তু যাকে দেয়া হয়, তার খুশি হওয়া উচিত।’

– ‘কেন? এগুলো টাকা দিয়ে কিনতে হয় বলে?

– ‘এত সস্তা রসিকতা আমি করি না। সিরিয়াস কথা বলছি। বেশিরভাগ সময়ই মানুষ কাউকে প্রশংসা করার হলেও করে না। সেটা হিংসায় হতে পারে, ইগো থেকেও হতে পারে। কিন্তু যারা পাম্প দেয়, তারা কিন্তু খুশি করতে দেয়। তারমানে তোমার খুশি হওয়া কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’

– ‘পাম্প দিবে কেন অকারণ।’

– ‘পাম্প অকারণ কেউ দেয় না। তার কোনোকিছু আদায় করার মতলব থাকে। অথবা স্রেফ খুশি করতে বলে। পাম্প অনেক ধরণের হয়। একটা মিথ্যে প্রশংসা, আরেকটা সত্য, কিন্তু বাড়িয়ে বলা। যেমনই হোক যাকে দেয় তার খুশি হওয়া উচিত।’

– ‘যাইহোক তুমি কোন মতলবে দিয়েছো শুনি।’

– ‘কোনো মতলব না। আসলে আমি সত্যিই বলেছি। কৃতজ্ঞতা থেকে বলেছি। আমার এই ব্যাপারটা নিয়ে তোমার আন্তরিকতা মুগ্ধ করছে।’

আফরা বুকে হাত বেঁধে রেলিঙে হেলান দিয়ে বললো, ‘তাই?’

– ‘হ্যাঁ তাই, এবার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করে চলে যাও। একবার বিছানা চাদর দিয়ে যেও এসে। আমি বাইরে যাব।’

আফরা ইমোশনাল হয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিচে এসে মনে হলো, অনিককে জিজ্ঞেস করা হয়নি পদ্যকে কেন উপরে নিবে। ভুলে গিয়েছিল সে। চাদর নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে হবে।
কিন্তু খানিক পর বিছানা চাদর নিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে দেখে অনিক কাপড় পরে বাইরে যাচ্ছে। তাকে দেখে বললো, ‘গেলাম ভাবি।’

– ‘তা যাও, কিন্তু আগে যে বললে পদ্য সন্ধ্যায় উপরে আসবে মানে বুঝিনি কিছু।’

– ‘কিছুই না, ওর সাথে কিছু কথা বলবো। যদি আসে তাহলে আমি মেসেজ দিয়ে বলবো তুমি নিজের দরজা বন্ধ করে রাখবে এই আরকি।’

– ‘আমাকে কোন বিপদে ফেলবে তুমি।’

– ‘কিছুই হবে না ভাবি। আমি জাস্ট কথা বলবো।’

– ‘তাহলে আমি থাকলে সমস্যা কী?’

– ‘না একান্তে লাগবে। তাছাড়া আসবে কি-না জানি না। শুধু বলবো।’

– ‘আসবে না।’

‘তাইই মনে হচ্ছে, সুতরাং প্যারা নিয়ো না।’ বলে অনিক বাইরে চলে গেল।

পদ্য রুমেই বসে আছে। ভেতরে অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা৷ অনিকের মেসেজেরও অপেক্ষা করছে। কী বলতে চায় জানতে ইচ্ছা করছে। মেসেজ এলো ঠিক তখনই। মোবাইল হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে গেল। অনিক মেসেজ দিয়েছে,

‘প্রিয় পদ্মফুল,
আনব্লক করে দয়া করার জন্য ধন্যবাদ।’

পদ্য রিপ্লাই দিল, ‘আমি দয়া করিনি।’

– ‘তাহলে ভালোবেসে আনব্লক করেছো?

– ‘আজাইরা কথা না বলে কাজের কথা বলো অনিক। তুমি জোর করে আনব্লক করিয়েছো।’

– ‘রেগে রেগে কথা বলো না তো আর প্লিজ। আমি তো বলেছি শুধু তোমার সঙ্গেই পাগলামি করবো। এই যে কথা বলছি তাতেই হবে আমার।’

– ‘আর না বললে?’

– ‘তখন তো মাথা ঠিক থাকবে না। পাগলামি করবো, বিয়ের প্রস্তাব দেবো। আর ভুলেও ব্লক করবে না বললাম। আমার কথা শোনো আগে।’

– ‘কী?’

– ‘তুমি আজ দোতলায় আসবে সন্ধ্যা সাতটায়। যে শাড়ি পরনে ছিল সেটা থাকলেই হবে। চুলগুলো অবশ্যই খোলা থাকবে। যেরকম আগে থাকতো। একপাশের চুল কানে গুঁজে, অন্যপাশের চুল ছাড়া৷ গালে, কাঁধে, পিঠে ছড়িয়ে থাকবে চুলগুলো। সেরকম আসবে তো?’

পদ্যের কেমন যেন লাগে। ইচ্ছা করে ‘আসবো’ বলে দিতে। তবুও বললো, ‘কেন যাব? পাগল না-কি?’

– ‘আমি বলছি তাই আসবে, প্লিজ আসো না। কেউ জানবে না। ভাবিকে বলেছি। কেউ খুঁজলে সে বলবে ওর রুমে।’

– ‘অনিক সেটা না। আমার কথা হলো যাব কেন? আমার তো কোনো দরকার নেই।’

– ‘তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে তাই, আসবে না তো? ঠিক আছে৷ আমি কথাগুলো আঙ্কেলকেই তাহলে বলবো।’

– ‘অনিক বাড়াবাড়ি বেশি করছো তুমি।’

– ‘আরও বেশি করবো, পাগল তো হয়েই গেছি। জবও ছেড়ে দিয়েছি। লেখালেখিও বাদ। আর তো বাকি কিছু নাই। যা হয় হবে, তুমি যখন কথা বলতে আসবে না। সোজা আঙ্কেলের কাছেই বলবো।’

– ‘অনিক আমি কালই তোমাদের বাসা ছাড়বো কিন্তু।’

– ‘ছাড়লে কি আমি পাব না? আমার প্রস্তাব আমি যেভাবে হোক দেবো।’

– ‘তুমি কী বলতে চাও বলো, মেসেজে।’

– ‘সন্ধ্যায় আসো বলবো। আমি তো বলেছি কোনো সমস্যা হবে না। কেউ জানবেও না। একটু সময় পর চলে যাবে তুমি।’

– ‘তুমি কেন এমন করছো অনিক। প্লিজ এগুলো বাদ দাও।’

– ‘এই মেয়ে তুমি আমাকে আবার ব্লক দাও। ব্লক দাও বলছি। আমার যা বলার তোমার আব্বার কাছে বলবো। বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার অধিকার সবার আছে। আমি তাই করবো, বাই।’

– ‘পাগলামি করো না অনিক। প্রস্তাব দিয়ে কোনো লাভ হবে না। যাইহোক আমি আসবো।’

– ‘ওকে ধন্যবাদ।’

পদ্যের এরপর পুরো দিন গেল দুশ্চিন্তায়। কেন যেতে বলছে তা নিয়ে ভয়। আফরা নিচে আসার পর পদ্য তাকে গিয়ে বললো পুরো ঘটনা। আফরা খানিক ভেবে কল দিল অনিককে। সে রিসিভ করলো,

– ‘হ্যালো ভাবি।’

– ‘অনিক তুমি কি শুরু করেছো। উপরে নিয়ে কী করবে? ওরা যদি জানে তোমার কাছে গেছে, তখন কী হবে?’

– ‘জানবে না ভাবি। ওরা যদি খুঁজেও সকল রুম খুঁজে তোমার দরজায় নক করলে বলবে তোমার রুমে আছে। দরজা ভেতর থেকে লাগানো তাই ভাববে কাপড় টাপড় কিছু চেঞ্জ করছো হয়তো।’

– ‘কিন্তু ওরা কেউ ডাকবে পদ্যকে, জবাব আমি দেবো কেন? পদ্য দেয়ার কথা।’

– ‘এত খেয়াল করবে না ভাবি। তুমি বলবে হ্যাঁ পদ্য এখানে। বাথরুমে গেছে। ব্যস।’

– ‘কোন বিপদে ফেলবে তুমি অনিক।’

– ‘কিছুই হবে না অকারণ ভয় পাচ্ছ।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, যা ইচ্ছা করো।’

সন্ধ্যা সাতটার সময় পদ্য ধীরে ধীরে বের হয়ে উপরে এলো। চারদিকে অন্ধকার। অনিককে মেসেজ দিল, ‘আমি এসেছি, কোথায় তুমি?’

– ‘প্যাসেজ দিয়ে সোজা মাথার রুমে আসো।’

পদ্য ভয়ে ভয়ে এসে মেসেজ দিল, ‘কই? অন্ধকার তো।’

দেশলাইয়ের শব্দ হলো৷ তারপর নিভু নিভু আলো জ্বলে উঠলো একটা রুমে। পদ্য এগিয়ে গেল সেদিকে। রুমের চারদিকে রঙিন মোমবাতি। লাল, বেগুনি, সাদা, গোলাপি। দু’টা দরজার সামনে। দু’টা টেবিলে। কিছু মেঝেতে। পালঙ্কের দুইপাশে। মিষ্টি একটা ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে চারপাশ। অনিক এগিয়ে এলো। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। আস্তে করে বললো, ‘এদিক আসো।’

পদ্য পিছু পিছু গেল বারান্দায়। রুমের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দা। সেখানে একপাশে মাদুর বিছানো আর
একপাশে ফুলের পাপড়ি দিয়ে লাভ চিহ্ন। বৃত্তের মাঝখানে পদ্য+ লেখা। পদ্যের নামের সঙ্গে আর কোনো নাম যুক্ত করা হয়নি। চারটা মোমবাতি আছে চার কোণায়। অনিক পকেট থেকে একটা পলিথিনের ব্যাগ থেকে ফুলের পাপড়ি পদ্যের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘পদ্য, তোমার নামের পর একটা নাম দরকার। সেটা খালি আছে। তুমি একটা নাম লিখবে প্লিজ?’

পদ্য শুকনো ঢোক গিলে নিজের ঘেমে যাওয়া মুখটা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে বললো, ‘অনিক আমার ভয় লাগছে৷ তাড়াতাড়ি বলো কী বলতে ডেকেছো।’

– ‘আচ্ছা নাম না হয় পড়ে লিখবে। বসো মাদুরে৷ বারান্দা বলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মানুষ দেখবে না৷ ওপাশে পাহাড়, চা বাগান। আসো বসো।’

পদ্য ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসলো। আনিক আসন পেতে বসলো ওর মুখোমুখি। তারপর পলিথিনের ব্যাগটা পাশে রেখে বললো, ‘আজ পুরো দিনের সকল আচরণের জন্য দুঃখিত। আসলে যখন তুমি দরজা খুলে দিয়ে কিছু না বলেই চলে গিয়েছিলে। তখন আমার কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল। বারবার মনে হয়েছিল ভাবির কথা হয়তো মিথ্যে। আমাকে ভালোবাসে না এই মেয়ে। তখনই হুট করে মাথায় এলো তোমার রুমে গিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে আনব্লক করাবো। মানে এই ভয়-ভীতি আসলে মিথ্যে দেখিয়েছি।’

– ‘অনিক কেন এসব করছো তুমি? আমাদের মিলন সম্ভব না। তাছাড়া আব্বা সুস্থ হলেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে।’

– ‘পদ্য সেটা আমি জানি। তবুও যখন শুনেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো আমার কী যে আনন্দ লেগেছে। মনে হয়েছিল বিয়ে না হলেও অন্তত এটুকু শান্তি আজ থেকে আমার আছে। পদ্য আমাকে ভালোবাসে। এটাই অনেক বড়ো আমার কাছে। একটা প্রচলিত কথা আছে পদ্য, ‘পাগলের সুখ মনে মনে।’ আমি সেই পাগলই ভাবতে পারো। তুমি একবার আমাকে সামনা-সামনি ভালোবাসার কথা বলে দিলে আর কিছুই লাগবে না আমার। আমি পুরো জীবন একা কাটিয়ে দেবো। আমি মনে করবো আমার স্ত্রী আছে। এই সমাজ, সমাজের নিয়ম আমার থেকে দূরে রেখেছে তাকে। পাগলের মনে এইটুকু সুখ তুমি দাও। প্লিজ সত্যি করে বলো ভালোবাসো কি-না?’

– ‘অনিক আমি ভালোবাসলেই তো হবে না।’

– ‘আমি সেটা চাই না পদ্য। তুমি জাস্ট সত্যি করে বলো ভালোবাসো কি-না৷ তোমাকে পাওয়া না পাওয়া ভিন্ন বিষয়৷ আমি শুধু জানতে চাই আমার পদ্য আমাকে ভালোবাসে কি-না। এরপর তোমাকে না পেলে না পেলাম।’

– ‘তুমি এই কারণে আমাকে ডেকেছো?’

– ‘হ্যাঁ, এই নাও পাপড়ি, ভালোবেসে থাকলে আমার নামটা লিখো।’

– ‘কিন্তু তাতে লাভ কী?’

– ‘কোনো লাভ নেই। পাগলের সুখ মনে মনে। এখানে নাম লেখার পর আমি ভাববো তুমি আমার স্ত্রী। আমাকে তোমার বিয়ে করা লাগবে না।’

– ‘অনিক দেরি হচ্ছে আমাকে যেতে দাও প্লিজ।’

– ‘তাহলে তাড়াতাড়ি লিখে নাও।’

পদ্য কাঁপা কাঁপা হাতে পাপড়িগুলো নিয়ে পদ্যের পাশে অনিক লিখলো। লিখে জল ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি যাই?’

অনিক সামনে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমার ইচ্ছার সেই নেই পদ্য। জানি যা বলবো তাতেই তুমি বিরক্ত হবে। সমাজ স্বীকৃত সেই বিয়ে ছাড়া হয়তো তার সব পাওয়ার অধিকারও নেই হয়তো আমার। শুধু আরও একটা আবদার রাখবে বলো?’

– ‘কী?’

– ‘আমি তোমার গালে হাত রেখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে চাই।’

– ‘কেউ এসে পড়বে অনিক।’

– ‘আচ্ছা তাহলে যেতে পারো।’

পদ্য ভেজা গলায় বললো, ‘আচ্ছা একবার শুধু। তারপর চলে যাব।’

অনিক তার ডান হাত বাড়িয়ে পদ্যের গালে রেখে চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘প্রচণ্ড ভালোবাসি পদ্য।’

পদ্যের গাল বেয়ে একফোঁটা জল এলো। তাড়াতাড়ি মুছে বললো, ‘অনিক এবার যাই।’

– ‘আমাকে ভালোবাসো সেটা বলবে না?’

– ‘অনেক হয়েছে অনিক এবার যাই।’

– ‘গাল থেকে হাত সরাতে ইচ্ছা করছে না..।’

পদ্য নিজেই ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ‘যাচ্ছি।’

– ‘দাঁড়াও, মাদুরে বসে একসঙ্গে ফুসকা, বাদাম খাব বলে এনেছিলাম। হয়নি খাওয়া। আগে থেকে আমরা যা ভাবী সেরকম আসলে কিছুই হয় না। আচ্ছে ফুসকা খেয়ে যাবে একটা? আনি?’

– ‘অনেক হয়েছে অনিক, প্লিজ আমি যাই। ওরা খুঁজবে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে যাও।’

পদ্য চলে যাচ্ছিল৷ অনিক আবার পিছু থেকে ডাকলো। পদ্য দরজার কাছ থেকে ফিরে বললো, ‘কী?’

– ‘তুমি অনিচ্ছায়, অনাগ্রহে হলেও আজ আমাকে অনেক কিছু দিয়ে গেলে। তোমার কাছে হয়তো তা অতি সামান্য। কিন্তু দেখো, আমার এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার এই জন্মটাই স্বার্থক। যাইহোক, ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি চলে যাব পদ্য। তুমি চাইলে আবার ব্লক করে দিতে পারো আমায়। ছলনা করে হলেও তোমাকে যা হুমকি-ধামকি, ভয়-ভীতি দেখিয়েছি আজ। তারজন্য দুঃখিত।’

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here