ছায়া সঙ্গিনী পর্ব -১৩

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-১৩
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

তারপর,,,
সেই দিনের মতো করে এক‌ই স্থানে,এক‌ই ভাবে তার অধর দুটি ছুঁয়ে দিল। আমি দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বললাম,
– আবার কবে আসবা তুমি? আমি অপেক্ষায় থাকবো।

আমার দুটো বাক্য শুনে, তার কার্যকলাপ থেকে স্থব্দ হয়ে গেল সে। সামনে ফিরে দুই হাত দিয়ে আমার গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,
– তুমি বলছো আমাকে ফিরে আসার জন্য? আদৌও কি সত্যি? আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।

তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
– আমাকে এত্তো পাষান মনে হয় কেন তোমার? আমি কি তোমায় ভালোবাসি না?

– ভাসো বুঝি?

– আবার জিজ্ঞাসা করে, তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। আমি জানি তো,সব সময় আমার সাথে রাগ দেখাও। এতো গুলো দিন একসাথে ছিলে, তুমি চাইলেই আমাকে নিজের করে নিতে পারতে তুমি সেটা করো নাই। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে একদম ভালোবাসো না।

রাহাত জোর করে আমার মাথা উঁচু করে,ভ্রু কিঞ্চিৎ উঁচু করে বললো,
– এই কথা গুলো এতো দিন বললে কি হতো? এখন চলে যাচ্ছি বলে বলছো? আমি যে চাইলেও এখন তোমার কাছে থাকতে পারবো না। কেন বললে না এতো দিন? কত্ত অপেক্ষা করে ছিলাম মুখে না বললেও ঘড়িটা আমাকে পরিয়ে দিয়ে তোমার মনের কথা বুঝাবে আমায়। কিন্তু তুমি তাও করলে না।

আমি আবার ঝাপটে ধরে কান্নার বেগ বাড়িয়ে বললাম,
– ঘড়ির কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তাছাড়া ওটা,,,,

– তাছাড়া ওটা?

– কিছু না, তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, আমি যেতে দিব না তোমাকে। তুমি ওখানে গেলে আবার অসুস্থ হয়ে পরবে। তোমার কপালের ক্ষত স্থান এখনো ভালো করে শুকায় নাই। তুমি যাবে না, আমি যেতে দিব না তোমাকে।

এসব বলে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম, আমি জানি ছারলেই ও চলে যাবে। রাহাত কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো,
– আয়রা আমাকে যে যেতেই হবে,এখান থেকে
ক্যান্টনমেন্ট ফিরে, সেনাবাহিনীর টিম কে নিয়ে র‌ওনা হতে হবে। আমি খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো তোমার কাছে ইনশা আল্লাহ। এবার আমাকে বিদায় দাও প্লিজ?

– না দেব না।

– তুমি না আমার কিউট ব‌উ।

– না, আমি কিছু শুনতে চাই না।

– আমার পিচ্চি ব‌উ, তুমি তো জানো আমার কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে। না গিয়ে উপায় নেই, দেশের কল্যাণের জন্য নিজেকে যে সঁপে দিয়েছি আমি।সেখান থেকে পিছিয়ে আসা যে কাপুরুষ বলে গণ্য হবো। তুমি কি চাও তোমার স্বামী একজন কাপুরুষ হয়ে বেঁচে থাকুক?

মাথা নাড়িয়ে বললাম,
– না কখনোই না।

– তাহলে তো এবার আমাকে বিদায় দিতে হবে। আল্লাহ তা’আলা চায় তো আমি আবার তোমার কাছে ফিরে আসবো। তুমি মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো।জ্ঞান অর্জনের একমাত্র পথ পড়াশোনা।আর পড়াশোনা কখনো বিফলে যায় না,তাই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা শুরু করো। আমি ফিরে আসলে তো পড়তে পারবে না!

আমি মাথা উঁচু করে বললাম,
– কেন পড়তে পারবো না?

সে দুষ্টু হাসি দিয়ে বললো,
– আমি তোমাকে সারাক্ষণ আমার সাথে মিশিয়ে রাখবো, একটুও ছাড়বো না।তাই এখন পড়াশোনা করে রাখ। বুঝাতে পারলাম?

আমি আবার তাকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম,
– দুষ্টু লোক কোথাকার।

আমার একটা আবদার রাখবে ব‌উ? শেষ বারের মতো!

আমি আবার ডুকরে কেঁদে দিলাম,কিল ঘুষি মেরে, কেঁদে কেটে হেঁচকি দিতে দিতে বললাম,
– আমাকে আঘাত দিতে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না? কেন বার বার বলছো শেষ বারের মতো, এমন অলক্ষুনে কথা দ্বিতীয়টি শুনতে চাই না আমি।

– আচ্ছা বাবা ঠিক আছে।তাহলে নতুন করে বলি শুনো, আমার একটা আবদার রাখবে সব সময়ের জন্য?

– আচ্ছা বলো?

– আমাকে সব সময়ের জন্য আদর করে দাও! না মানে যতদিন তোমার থেকে দূরে থাকি ততোদিন যেন তোমার আদর গুলো আমাকে সাহসের সাথে কাজ করতে সাহায্য করে।নাও এবার শুরু করো?

তারপর আর কি, প্রথমে কপাল তারপর দুটো গাল,নাক, থুতনি, শেষে কিনা….
শেষ মেষ দিলাম কামড় বসিয়ে!সে আউচ শব্দ করে হাসতে হাসতে বের হয়ে যায় রুম থেকে। তারপর সবাই কে বিদায় জানিয়ে র‌ওনা হয়। আমি সাথে সাথে নিচে গেইট অবধি এসে দাড়িয়ে রইলাম।যতক্ষন পর্যন্ত তাকে দেখা যায়, ততোক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম।
_______
কলেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, আজকে দুদিন হলো রাহাত গিয়েছে। একবার ও কল করে নাই।কাজে গিয়ে ব‌উকে একদম ভুলে গেছে।
হঠাৎ পিছন থেকে বিকট শব্দ শুনে ইয়া আল্লাহ বলে কানে হাত দিলাম। এদিকে ফারহা হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। মেয়েটা সব সময় আমার সাথে এরকম করে। এরকম আচমকা কোন শব্দ শুনলে ভয়ে লাফিয়ে উঠি আমি।আর এটার সুযোগ নেয় ফারহা।
হাসি থামিয়ে ফারহা বললো,
– দোস্ত সেদিন তুলি আমাকে বলেছিল, ইমরান ভাইয়া কে তোর বিয়ের খবর যদি না দেই তাহলে আমাকে চিকেন ফ্রাই আর নান রুটি খাওয়াবে। কিন্তু বজ্জাত তুলি এখনো অবধি খাওয়ালো না।

ফারহা’র কথা শুনে বুঝতে পারলাম সে জন্যই ফারহা এতো দিন চুপ করে আছে।ফারহা কে বললাম,
– ঘুষ দেওয়া আর নেওয়া সমান অপরাধ তুই কি জানিস? তোকে খাওয়াবো অবশ্যই তবে ঘুষ হিসেবে নয়।ট্রিট হিসেবে।তুলি আসলে একসাথে যাবো রেস্তোরাঁয়।

ফারহা আনন্দে জরিয়ে ধরে বললো,
– থ্যাংক ইয়ু দোস্ত। দাঁড়া আমি তুলি কে কল করছি এক্ষুনি আসার জন্য।

তুলি কে কল করলে জানতে পারলাম ও কলেজ গেইটের কাছাকাছি।তাই ফারহা বললো, গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। আমি আর আয়রা এক্ষুনি আসতেছি।

তারপর আমরা নিচে চলে গেলাম গেইটের কাছে। তিন মিনিটের মধ্যে তুলি এলো,এসেই আমাকে বললো,
– কুত্তা তুই আমার ফোন ধরিস না কেন?

আমি কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে বললাম,
– তোকে না বলেছি, মানুষকে প্রানীর নাম নিয়ে ডাকলে আল্লাহ তা’আলা নারাজ হন।
আমরা হাসির ছলে মানুষকে মন্দ নামে বা বিকৃত নামে ডেকে ফেলি। কারো নাম পদবি বা কার্যকলাপ নিয়ে উপহাস না করলে অনেক সময় সামাজিক আড্ডাই জমে উঠে না। কিন্তু যা আমাদের দৃষ্টিতে হাস্যরসিকতা তা আল্লাহর দৃষ্টিতে জুলুম অর্থাৎ মানুষের মান সম্মান ভূলুণ্ঠিত করার মতো মারাত্মক অপরাধ।

আল্লাহ মানুষকে মন্দ নামে ডাকা বা উপহাস করতে নিষেধ করেছেন।

এ উপলক্ষে কোরআনে আল্লাহ বলেন : ‘হে ঈমানদারগণ। তোমাদের কোন পুরুষ যেন অপর কোন পুরুষকে উপহাস না করে কেননা সে উপহাসকারীদের অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী যেন অন্য কোন নারীকে উপহাস না করে কেননা তারা উপহাসকারিণীদের অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। আর তোমরা একে অন্যকে দোষারোপ করো না এবং একে অন্যকে মন্দ নামে ডেকো না, ঈমান আনার পর মন্দ নামে ডাকা গর্হিত অপরাধ। আর যারা এহেন অপরাধ থেকে তওবা না করে তারাই প্রকৃত জালেম। (সূরা হুজরাত ৪৯:১১)

তাই প্রতিটি মানুষের উচিত কারো চালচলন বা আচরণ নিয়ে কোন ধরনের বিব্রতকর মন্তব্য না করা। কোন অবস্থাতেই কাউকে গালিগালাজ না করা।

তুলি সবটা শুনে বললো,
– আচ্ছা ব‌ইন মাফ কর এবার বল এখানে থাকতে বললি কেন?

ফারহা বললো,
– গেলেই দেখতে পাবি চল এবার।

তারপর ভালো একটা রেস্তোরাঁয় গেলাম। তারপর তিন জনের জন্য খাবার অর্ডার করে বসে গল্প করতে শুরু করলাম।এক পর্যায়ে ফারহা বললো,
– দোস্ত বাসর রাতে কি হলো?

সাথে তুলি ও যোগ হয়ে বললো,
– হুম দোস্ত বল না? আমার অনেক জানার আগ্রহ।

– অন্য টপিক নিয়ে কথা বল, এগুলো বাদ দিয়ে।

তুলি বললো,
– প্লিজ দোস্ত?বল না?

– স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার কথোপকথন অন্য কারো সাথে শেয়ার করা উচিৎ নয়।
পবিত্র ধর্ম ইসলামে মানুষকে এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে নিষেধ করা হয়েছে। স্বামী-স্ত্রীর একান্ত বিষয় অন্যের কাছে প্রকাশ করা গর্হিত অপরাধ। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম মানুষ হবে ওই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ৩৪৩৪)

অন্য বর্ণনায় হাদিসটি এভাবে এসেছে, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ওই ব্যক্তি কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বড় আমানত খিয়ানতকারী বিবেচিত হবে, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়। অতঃপর সে তার স্ত্রীর গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়। (মুসলিম, হাদিস : ৩৪৩৫)

অনুরূপভাবে স্ত্রীর ও গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

ওয়েটার খাবার নিয়ে আসলে সবাই খাবার খাওয়াতে মনোযোগ দিল। খাওয়া শেষ করে কলেজে ফিরে যাবো তখন কোথায় থেকে যেন ইমরান ভাইয়া এসে বললো,
– আয়রা তোমাকে কলেজে খুঁজে পেলাম না। তোমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে বললো, তুমি কলেজে এসেছ। কিন্তু সারা কলেজ খুঁজেও পেলাম না।তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ এখানে নজর পড়তেই তোমাদের দেখলাম।

আমি উত্তরে কেবল বললাম,
– ভাইয়া আমাদের পাঁচ মিনিট পর ক্লাস শুরু হবে।তাই কলেজে যাই।

– না আজকে ক্লাস করতে হবে না, তুমি আমার সাথে যাবে!

– কিসব বলছেন ভাইয়া? আমি কোথাও যাবো না আপনার সাথে। আমাদের কলেজে যেতে দিন?

– প্লিজ আয়রা আজকে ক্লাস না করলে কিছু হবে না। আমার আম্মু কে তোমার কথা বলেছি আমি! আম্মু তোমাকে দেখতে চেয়েছে।তাই তুমি আমার সাথে যাবে।

– আমি যাবো না।
তুলি ফারহা চল।

আমি চলে যেতে নিলে, ইমরান ভাইয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে! তারপর টানতে টানতে নিয়ে যায়। তুলি সাথে আসতে চাইলে, তুলিকে নিষেধ করে দেয়! এদিকে আমি রাস্তায় সিনক্রেট করছি না যত‌ই হোক স্যারের ছেলে বলে কথা। লোকজন জড়ো হলে স্যারের সম্মানহানি হবে।
_______
ইমরান ভাইয়ার আম্মুর সামনে বসে আছি আমি,তখন আমার ফোনে কল আসলো। আননোন নাম্বার থেকে, তবুও রিসিভ করে সালাম দিলাম।
ওপাশ থেকে সালামের জবাব দিয়ে বললো,
– আমার মিষ্টি বউ কেমন আছো?

ভয়ে চুপসে গেলাম আমি, এখন যদি রাহাত জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায় আছি! তখন কি জবাব দেব আমি? এদিকে ইমরান ভাইয়ার আম্মু উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছেন!

#চলবে,,,, ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here