ছায়া সঙ্গিনী পর্ব -২১ ও শেষ

#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-২১
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

কেটে যাচ্ছে দিন,মাস,বছর। রাহাতের ভালোবাসার কোন কমতি নেই
“আলহামদুলিল্লাহ”। তবে আমার সুখের একটাই অভাব”বেবি”। বিয়ের দুই বছর হতে চললো!সময় গুলো আনন্দেই কাটছে রাহাতের সাথে। ছুটি পেলেই দেশের ঐতিহাসিক স্থান গুলোতে ঘুরতে নিয়ে যায় সে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার দেশ কে ঘুরে দেখার, সেই ইচ্ছেটা আল্লাহ তা’আলা ধীরে ধীরে পুরন করছেন। আমি বিশ্বাস করি, এরকম ভাবে আমার সুখের অভাব টাও একদিন পুরুন হবে “ইনশা আল্লাহ”।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হসপিটাল গুলোতে অনেক পরিক্ষা নিরিক্ষা করা হয়েছে আমাদের উভয়ের। কিন্তু কোন খারাপ কিছু ধরা পরেনি “আলহামদুলিল্লাহ”।
হয়তো এই মুহূর্তে আমার জন্য সন্তান কল্যাণকর হবে না তাই আল্লাহ তা’আলা আমার দো’আ কবুল করছেন না। কেননা আল্লাহ তা’আলা উত্তম পরিকল্পনাকারী।তাই আমি বিশ্বাস করি আমার জন্য যখন কল্যাণকর হবে তখন নেক সন্তান দান করবেন আল্লাহ তা’আলা। আমি রাহাত দু’জনেই চেয়েছিলাম অনাথ আশ্রম থেকে বেবি দত্তক নিতে কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি মা এতে মত দেন নাই। এতো দিন আমি আর রাহাত মিলে মায়ের পিছনে পড়ে ছিলাম রাজি করানোর জন্য। শেষমেষ সফল হতে পেরেছি।আর তাই আজকেই আমি আর রাহাত এসেছি একটা অনাথ আশ্রমে। রাহাত আশ্রমের লোকজনের সাথে কথা বলছে আর আমি পাশে বসে আছি।
কথাবার্তা পাকা হলে একজন ভদ্র মহিলার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে হেঁটে এলো ছোট্ট মেয়েটি বয়স চার। নাম ঝুমুর। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ওর হাত দুটো আমার হাতের বাজে নিয়ে বললাম,
– মামনি কেমন আছো?

ঝুমুর পাশে থাকা ভদ্রমহিলা কে পিছন থেকে জরিয়ে ধরলো। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল এতে। পরক্ষনেই মনে হলো ও তো ছোট্ট একটা মেয়ে তার উপর আমাকে চিনে না।তাই ওর এরকম আচরণ স্বাভাবিক। ঝুমুর কে নিয়ে আসার সময় ও খুব কান্নাকাটি করে, আমি রাহাত ওর মন ভালো করতে প্রথমে শপিং মলে তারপর রেস্তোরাঁয় খাওয়া দাওয়া করে বাসায় ফিরে আসি।মা ঝুমুর কে দেখলেন কিন্তু কোন কথা বললেন না। হয়তো মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না তাই।
বসায় আসার পর আপু,ভাই, আব্বু, আরিয়ান,ভাবী সবাই মিলে গ্রুপ কলে ঝুমুর কে দেখে। আমি সবাই কে বলি ঝুমুরের জন্য একটা সুন্দর নাম সিলেক্ট করার জন্য। একেক জন একেক নাম বলছে, আমি আর রাহাত কোনটা রেখে কোনটা রাখবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। শেষে ভাবী বললেন রাহাতের সাথে মিলিয়ে “রাফা” । নামটা রাহাতের খুব পছন্দ হলো তাই আমাকে বললো,
– তুমি কি বলো?রাফা রাখবো?

আমি বললাম তোমার পছন্দ‌ই আমার পছন্দ। তারপর রাহাত সবাই কে জানিয়ে দিল আগামীকাল নারায়ণগঞ্জ আসছি আমরা। ওখানেই আকিকা করে রাফা নাম রাখা হবে।

ঝুমুর এতোক্ষণ আমাদের কথা গুলো বসে বসে শুনছিলো।কল কাটতেই বললো,
– মামনি! কোথায় যাব আমরা?

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সেই দুপুর বেলা থেকে বলেছি আমাকে মামুনি বলে ডাকার জন্য কিন্তু ঝুমুর একবার ও ডাকেনি। মাথা নিচু করে বসে ছিল। রাহাত ও কতোবার বলেছে ওকে বাবাই বলে ডাকার জন্য কিন্তু তা-ও ডাকে নাই। হঠাৎ ওর মুখে মামনি শুনে হুরহুর করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
– কি বললে? আবার বলো না প্লিজ?

ও আমার কান্না দেখে বিচলিত হয়ে যায়। সাথে খানিক ভয় পায়।তাই আর মামনি বলে ডাকতে পারে না। রাহাত আমাকে ঝুমুরের থেকে ছাড়িয়ে বললো,আয়রা মেয়েটা ভয় পাচ্ছে তো। এভাবে কাঁদছো কেন?দেখ ও কিভাবে ভয়ে চুপসে আছে। আমি ঝুমুরের ছোট ছোট গাল দুটো ধরে বললাম,ভয় পেয়েছো মামনি?
ওর উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। তারপর আমি আবার বললাম, মামনি খুব পঁচা তাই না?ও বামে ডানে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। আমি খুশি হয়ে ওরে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলাম। তখন রাহাত বললো, শুধু মামনি ডাকবে?বাবাই ডাকবে না?
ঝুমুর তখন মাথা নিচু করে র‌ইলো। রাহাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে বললো,বাবাই!
রাহাত থমকে দাঁড়ায়, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ঝুমুরের কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। একদম বাবা মেয়ের থেকে কম মনে হচ্ছে না দু’জনকে। আমার চোখ থেকে আনন্দের পানি গড়িয়ে পড়ছে।

খাবার টেবিলে আমি রাহাত দু’জনেই ঝুমুর কে খাইয়ে দিচ্ছি। ঝুমুর তৃপ্তি ভরে খাচ্ছে, মনে হচ্ছে কতো বছর তাকে এভাবে আদর করে কেউ খাইয়ে দেয় নি। শুনেছি শিশুরা পবিত্র হয়, এবং তাদের সাথে ফেরেস্তা থাকে। তাইতো এতো কোমল মনের অধিকারী হয়। তাদের একটু আদর করলেই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে দেয়। তাদের ধমক দিয়ে যেখানে একটা কাজ করানো যায় সেখানে আদর করে বললে, দশটা কারতে ও মানা করে না।এই হচ্ছে শিশু সুলভ মন।
ঝুমুর কে নিয়ে আসার সময়, ঝুমুরের খেয়াল রাখা ভদ্রমহিলা চোখের পানি ফেলে বলেছিলেন,
– আপা এই ছোট্ট মেয়েটি কে আপনার হাতে তুলে দিলাম খেয়াল রাখবেন ওর।আড়াই বছর বয়সে মাকে হারিয়েছি মেয়েটা। তারপর বাপ বিয়ে করে আনছে,সৎ মা অনেক অত্যাচার করে বলে বাপ অনাথ আশ্রমে দিয়ে যায়।

কথা গুলো শুনে তখনি কষ্টে বুকটা কেঁপে উঠে আমার। নিজের সাথে নিজে ওয়াদা করি, মেয়েটা কে সারাজীবন নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখবো আমি।
_______
দু’দিন পর,
রাহাত আর আরিয়ান মিলে ছাগলের গোসত গুলো কেটে ঠিক করছে।আর আব্বু বসে বসে দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে কতটুকু সাইজ করে কাটবে।
কিছুক্ষণ আগে আকিকার জন্য, কসাই দিয়ে একটা ছাগল জবাই করা হয়েছে। সেটাই শালা দুলাভাই মিলে ঠিক করছে। এদিকে আমি আর ভাবী মিলে অন্যান্য রান্না বান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিছু মানুষ নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। রাহাতের বোন’রা ও আসতেছে। আমার কলেজ ফ্রন্ডদের ও বলেছি।
অতঃপর,
মেহমান আসতে শুরু করে দিয়েছে। রান্না বান্না শেষ করে মাত্র‌ই শাওয়ার নিয়ে বেড়িয়েছি আমি। রুমে এসে শাড়ি পড়েছিলাম তখন পিছন থেকে দরজা লক করার শব্দে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি রাহাত।তাই আবার শাড়ি পরাতে মনোযোগ দিলাম।
রাহাত এগিয়ে এসে বললো কি করছো?
আমি মাথা তুলে তাকাতেই কোমর জড়িয়ে ধরলো! হঠাৎ তার এরকম কান্ড দেখে ভ্রু কুঁচকে বললাম, হচ্ছে টা কি? মেহমান চলে এসেছে কিন্তু।ছাড়ো তৈরি হতে হবে আমাকে।সে আমার কথা পাত্তা না দিয়ে উল্টো শাড়ির আঁচল ফেলে দিল! আমি বললাম,
– এই যে আর্মি সাহেব বুড়ো বয়সে কি বিমরতি ধরলো নাকি?

রাহাত অবাক হ‌ওয়ার ভান ধরে বললো,
– আমি বুড়ো! তুমি জানো এখনো অবধি মেয়েরা লাইন ধরে আমার পিছনে?

– হয়েছে হয়েছে।মেয়ের বাপ হয়েছো সেই খেয়াল আছে তোমার? কিছুদিন পর তো শ্বশুর হয়ে যাবে। হা হা হা,,,

– তাই না??

ব্যাস আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে,সে তার কাজে মনোনিবেশ করে। ধীরে ধীরে তার ছোঁয়া গুলো গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমি দুই হাতে খামচে ধরি তার পাঞ্জাবি। মিনিট খানেক পর তার পাগলামো শেষ হয়, তখন পরম আবেশে তার মাঝে আগলে রাখে আমায়।
তারপর শাড়ি পড়তে সাহায্য করে আমায়। কালো রঙের মাঝে রানী গোলাপী রঙের নকশা করা জামদানি শাড়ি পড়েছি আমি। সাথে মেচিং করে হিজাব। ঠোঁটে হালকা রঙের লিপস্টিক ব্যাস এতেই পারফেক্ট। তৈরি হ‌ওয়া শেষে রাহাত কয়েকটা ছবি ক্যামেরা বন্দি করে রাখে। তারপর নিজের সাথে সেলফি তুললো।
আমি তাড়া দিয়ে বললাম, হয়েছে এবার আমি যাই সবাই কি মনে করবে এভাবে রুমে বসে থাকলে।
রাহাত বললো,
– আর দশ মিনিট, তুমি এখানে বসো আমি যাবো আর আসবো।

তারপর দরজা খুলে কোথায় যেন চলে গেল। আমি বসে বসে ফোন স্ক্রল করছি। হঠাৎ মিষ্টি কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে এসে আমার মেয়ে মামনি বলে জড়িয়ে ধরে।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে যাই আমি। রাহাত তৃপ্তি ভরে দেখে আমাদের আর হাসে।

আমি রান্নার কাজ শেষ করে প্রথমে ঝুমুর কে তৈরি করে দেই। রাহাত ওর জন্য খুব সুন্দর পার্টি ড্রেস নিয়ে এসেছে। আমার শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করা রানী গোলাপী রঙের ড্রেসটা, আমার সুন্দর মেয়েকে আরো সুন্দরী করে তুলেছে। রাহাত বলে, ঝুমুর কে আমার মেয়ে হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা’আলা।তাই তো আমাদের ফেইসের নাকি অনেক মিল।

আমাদের দুজনের একসাথে অনেক ছবি তুললো রাহাত। তারপর তিনজনে মিলে সেলফি তুললাম।
আজকের এই দিনটি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তা’আলার কাছে শুকরিয়া আদায় করেও শেষ করতে পারবো না আমরা।
_____
সব আত্মীয় স্বজন প্রায় চলে এসেছে। আমার কলেজ ফ্রেন্ড ফারহা,আদিবা,স্বর্ণা,সাথী,মোনা সহ সবাই এসেছে কিন্তু আমার বেস্টুর এখনো অবধি দেখা নেই। সেই যে সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার সময় একবার দেখা হয়েছিল তুলির সাথে আর দেখা হয়নি। জানিনা কেন সেদিন বেশি কথা বলেনি আমার সাথে তুলি!তারপর থেকে যোগাযোগ ও হয়নি!এই যে আজকে আসছে সেটা আরিয়ানের দৌলতে, আরিয়ান কে ওদের বাসায় পাঠিয়ে ফোন নাম্বার কালেক্ট করেছি।তুলি ফোন নাম্বার চেঞ্জ করেছে,তাই অনেক বার কল করেও পাইনি আমি।

কিছুক্ষণ আগে আবার কল করে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় আছে?ও বললো বাসার কাছাকাছি তাই বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছি, কখন ও আসবে।যে মেয়েটা আমায় ছাড়া কিছুই বুঝতো না, সেই মেয়েটা হঠাৎ করে কিভাবে এতো পরিবর্তন হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না।যাই হোক ও আজকে আসছে এতেই খুশি আমি।

তুলির কথা ভাবতে ভাবতে আব্বু কে খাবার বেড়ে দিচ্ছি তখন ঝুমুর একটা বেলুন এনে বললো,
– মামনি এটা ফুলিয়ে দাও।

তারপর বেলুন কিছুটা ফুলাতেই দরজায় কলিং বেল বেজে উঠল। আমি দ্রুত পায়ে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খুলে যাকে দেখবো তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না আমি!হাতে থাকা বেলুন টা ছেড়ে দিলাম,যার ফলে বেলুন টা উড়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ হাওয়া বেড়িয়ে নিচে পরে গেল। সামনে থাকা ব্যক্তি নিষ্পলক তাকিয়ে রইল আমার দিকে! ঝুমুর এসে বললো,মামুনি আমায় বেলুন দাও। তখন সামনে থাকা ব্যক্তিটার দৃষ্টি ঝুমুরের দিকে নিবদ্ধ হলো,,,,#ছায়া_সঙ্গিনী
#পর্ব-(অন্তিম পর্ব)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)

সামনে থাকা ব্যক্তিটা আগের তুলনায় অনেক রোগা হয়ে গেছে। ফর্সা মুখশ্রী শ্যাম বর্ণ ধারণ করেছে। চুল গুলোতে আর আগের মতো গ্লেস নেই। আমি কিছু বলবো তখন তুলি পাশে এসে দাঁড়ালো! আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তুলি বললো,
– কি হলো ভেতরে যেতে দিবি না? ও হ্যাঁ পরিচয় করিয়ে দেই, আমার হাসবেন্ড ইমরান তালুকদার!

– হোয়াট?
মজা করছিস আমার সাথে?

তুলি ইমরান ভাইয়ার হাত ধরে বললো, এখানে তোর সাথে রসিকতা করতে আসিনি আমরা। আমাদের গ্রহণ না করলে বলে দে চলে যাই।
আমি দ্রুত তুলির হাত ধরে বললাম,
– প্লিজ ভিতরে আয়। তোরা বিয়ে করেছিস একবার বলতে পারতি আমাকে? না বললে বুঝবো কিভাবে?

ওদের দুজনকে নিয়ে বসলাম। ভাবী শরবত এনে দিল শুধু। দুপুরের খাবার খাবে বলে নাস্তা দেয়নি।
কথায় কথায় তুলি বললো,
– তোর মেয়ে হয়েছে জানালি না তো?

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
– যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিস জানাবো কিভাবে?
তারপর ঝুমুর কে ডেকে ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। ইমরান ভাইয়া ঝুমুর কে কাছে নিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলো, তখন ঝুমুর আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার মেয়ের চাহনি বুঝতে পেরে বললাম, “রাফা”।
ইমরান ভাইয়া তখন বললেন, খুব সুন্দর নাম তোমার।
তুলি বললো, আচ্ছা তোমরা কথা বলো আমরা একটু আসতেছি। তারপর আমাকে আমার রুমে নিয়ে আসে তুলি। এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে সাথে সাথে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– দোস্ত আমাকে মাফ করে দিস, তোর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণে।জানিস সেদিনের পর থেকে ইমরান নিজেকে সব কিছু থেকে গুটিয়ে নেয়। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। কলেজে আসা বন্ধ করে দেয়, এবং নে*শাগ্রস হয়ে পড়ে।স্যারের ছেলে বলে কলেজে পুরো ছড়িয়ে পড়ে এ খবর কিন্তু জানিস এই পর্যন্ত কলেজে কেউ জানে না যে সেই মেয়েটি তুই যার কারণে ইমরান নিজেকে এভাবে শাস্তি শুরু করে। এমনকি স্যার ও জানে না। আমার শ্বাশুড়ি মাকে ইমরান কড়া ভাষায় বলে দেয় তোর কথা যেন কাউকে না বলে। একদিন আমি দেখা করি ইমরানের সাথে,জানিস সেদিন খুব কান্না শুরু করে আর বলে তোমার বান্ধবী এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হলো বলতে পারো? আমি কি খুব খারাপ ছেলে যার কারণে ওর মনে একটু স্থান হলো না আমার?

আমি অনেক বুঝাই কিন্তু কোন কাজ হয় না। তারপর একদিন আমার শ্বাশুড়ি মা মানে ইমরান এর আম্মু আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো! মায়ের মনে হয়েছে আমি তার ছেলেকে সামলে নিতে পারবো তাই।
আর আমার মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা তো জানিস তুই, এতো ভালো ঘর থেকে বিয়ের ঘর আসায় তারা অকপটে রাজি হয়ে যায়। অবশ্য ইমরান যে নে*শা করে সেসব জানতো না। তারপর বিয়ে হয়ে গেল আমাদের। প্রথম প্রথম খুব ইগনোর করে সে, অবশ্য প্রথম কি বলছি জবে থেকে জানতে পেরেছে আমি প্রেগন্যান্ট তবে থেকে ভালো ব্যাবহার শুরু হয়েছে তার!

আমি চমকে উঠে বললাম,
– দোস্ত তুই প্রেগন্যান্ট? আলহামদুলিল্লাহ। আজকে একটা খুশির দিনে আল্লাহ তা’আলা আরেকটা খুশির খবর দিলেন।
কিন্তু তোকে দেখে বোঝার উপায় নেই। এখন কতো মাস চলছে?

– সামনের সপ্তাহে পাঁচ মাস হবে।

– যাক আলহামদুলিল্লাহ।
আচ্ছা চল এবার খাবার খাবি অনেক টাইম ওয়েস্ট হয়ে গেছে।

অতঃপর, সবাই কে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছি, আমি আর রাহাত। আর বাকি সবাই কে খাবার দিয়েছি। তুলি রাফা কে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে সাথে নিজেও খাচ্ছে। আমি কিচেন থেকে এটা ওটা এনে দিচ্ছি আর রাহাত কার কি লাগবে তা তদারকি করছে।
কিচেনে পানি নিতে এসেছি হঠাৎ মাথাটা কেমন করে উঠলো। সাথে সাথে নিচে বসে পড়লাম আমি। আসলে সেই ফজর নামায আদায় করে কাজ শুরু করেছি সেই জন্যই হয়তো এরকম হচ্ছে। আম্মুর কথা খুব মনে পড়ছে, বাসায় কোন আয়োজন করা হলে আম্মু খাবার দাবার না খেয়ে কাজ শুরু করে দিত। তারপর ঠিক অসুস্থ হয়ে যেত। আমি অবশ্য খাবার খেয়েছি, রাহাত নিজ হাতে আমাকে রাফা কে খাইয়ে দিয়েছে।
এখন একটু সুস্থ বোধ করছি তাই পানি নিয়ে ডাইনিং এ গেলাম। তুলি বললো,রাফা আর খেতে চাইছে না।ঘুমে ঢুলে পড়েছে। তাই আমি বললাম, আচ্ছা থাক তুলি তুই এবার ঠিক মতো খাবার খেয়ে নে।রাফা ঘুম থেকে উঠলে আমি আবার খাইয়ে দেব। সেই সকাল থেকে ফুফাতো ভাই বোনদের পেয়ে খুব আনন্দ দুষ্টুমি করেছে।তাই এখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরবে।
রাফা কে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম তারপর পাশে আমিও শুয়ে পড়লাম। আমার ও খুব ক্লান্ত লাগছে। কিছুতেই শরীর চলছে না আর।
______
চোখের পাতা গুলো টিপ টিপ করে খুললাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখি রাহাত নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে আমায়। এবং আমার উপর দিয়ে ডান হাতটা নিয়ে রাফা কেও ধরে রেখেছে। এরকম মুহূর্তটা উপভোগ করছি আমি। এখন আমাদের ছোট্ট পরিবার টা পূর্নতা পেয়েছে। “আলহামদুলিল্লাহ”।
পাশে থাকা ফোনটা অন করে দেখি পাঁচটা বেজে আট মিনিট। মানে অনেক সময় যাবত ঘুমিয়েছি। এতোক্ষণে সবাই হয়তো চলে গিয়েছে। রাহাত আমাকে একটু ডেকে দিতে পারতো।ওরা কি মনে করবে?আল্লাহ তা’আলা জানেন।

আযান হয়ে গেছে তাই উঠে নামায পড়ে নিলাম। তারপর রাহাত কে ডাক দিতেই রাফা ও ওঠে বসে রইল। রাহাত রাফা কে আদর করে ফ্রেশ হতে গেল নামায পড়বে বলে। এদিকে আমি রাফা কে ফ্রেশ করে খাবার খাইয়ে দিচ্ছি। মাঝে মাঝে খাবে না বলে বায়না ধরে বসে, তখন আমি এটা ওটা বলে খাইয়ে দেই।
এরপর রাহাত নামায পড়ে এসে বললো,
– খুব খিদে পেয়েছে খাবার দাও তাড়াতাড়ি।

আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম তুমি দুপুরে খাবার খাওনি?সে মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো। আমি রেগে বললাম খাওনি কেন? শুধু শুধু এতো সময় যাবত না খেয়ে থাকে মানুষ?
তখন তার উত্তর,
– আমার একমাত্র ব‌উ না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি কি করে খাই বলো?

আমি আর কোন জবাব দিলাম না,রাফা কে খাইয়ে দিয়ে ওভেন থেকে খাবার গরম করে দুজনে মিলে খেয়ে নিলাম।

সন্ধ্যা বেলা,
রাফা আর আব্বু মিলে দৌড়া দৌড়ি করে অনেক দুষ্টুমি করে। আমি শুধু বসে বসে নানা নাতনির কার্যকলাপ দেখে চলেছি। তখন আপু কল করেছে বিদেশ থেকে। কল রিসিভ করতেই সাফা আর মার‌ওয়া চিৎকার করে বলে, আম্মু মণি তুমি কেমন আছো? আমি হাসতে হাসতে বললাম আলহামদুলিল্লাহ ভালো তোমরা সবাই কেমন আছো আম্মু?
তারা বললো ভালো, আমাদের বোনু কে দেখাও তাড়াতাড়ি।
রাফা কে ডেকে নিয়ে এলাম। সাফা আর মার‌ওয়া খুব সুন্দর করে কথা বলতে শুরু করল রাফা’র সাথে। আমি আর রাহাত বসে বসে দেখছি।এর মাঝখানে রাহাত আমার গালে তার অধর ছুঁয়ে দিল। আমি চোখ রাঙিয়ে বললাম,
– কি করছোটা কি? রাফা আছে এখানে।

সে আরো কয়েকটা দিয়ে বললো,
– আমার মেয়ে অনেক লক্ষী মা শা আল্লাহ। বাবাই কে ডিস্টার্ব করবে না বুঝলে? তাছাড়া এখন কথা বলতে ব্যাস্ত।

এসব আবল তাবল বকে আবার আমাকে জড়িয়ে ধরতে নিবে তখন ভাবী নাস্তা নিয়ে আসে। এতে করে রাহাত লজ্জা পেয়ে একটু সরে বসে। আমার যে কি পরিমান খুশি লাগছে কি বলবো? এদিকে ভাবী মুচকি হেসে বললো,
– ভাই নেন গরম গরম চিকেন নাগেট খেয়ে নিন। খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে।এই প্রথম বার রেসিপি দেখে তৈরি করলাম।

রাহাত একটু খেয়েই বললো সুপার হয়েছি ভাবী। আপনার ননদিনী একটু শিখিয়ে দিয়েন তো, জানেন ও বাসায় কিছুই তৈরি করতে চায় না।এক নাম্বারের অলস হা হা হা,,,

আমি ভেংচি কেটে চলে গেলাম আমার শ্বাশুড়ি মাকে ডেকে আনতে। এরপর মাকে ডেকে আব্বুর জন্য রুমে দিয়ে আসলাম।আর আরিয়ান কে ড্রয়িং রুমে আমাদের সাথে খেতে বললাম। অতঃপর সবাই গল্প করতে করতে ভাবীর হাতের স্পেশাশ চিকেন নাগেট খাচ্ছি।মাঝ খানে রাহাত এক পিস নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরল, তো আমিও খুশি মনে হাঁ করতেই ও নিয়ে খেয়ে ফেললো। আমি রাগে ফুঁসছি,আর রাফা তার বাবার কোলে বসে থেকে হাসতে হাসতে কুটি কুটি হয়ে যাচ্ছে।যেমন বাপ তেমনি তার বেটি।
______
কোয়ার্টারে ফিরে এসেছি আমরা, গতকাল বিকালে। আজকে রাফা কে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য এসেছি আমি রাহাত।তো রাহাত প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলছে আর আমি রাফা কে নিয়ে বাহিরে। রাফা দৌড়ে এখান থেকে এখানে এরকম করে বেড়াচ্ছে।ওর সাথে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ আমার মাথা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। আমি কোন রকম একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। রাফা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো,
– মামনি কি হয়েছে তোমার? তোমার কি কষ্ট হচচে? কথা বলো মামনি?

আমি ধীর কন্ঠে বললাম না মামনি আমি ঠিক আছি, আমার কিছু হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।
তারপর ভর্তি করানো শেষ করে বাসায় এসে শুয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। এরপর উঠে রান্না বান্না শেষ করি। আমার শ্বাশুড়ি মা এখন অনেকটাই ফ্রি হয়েছেন রাফার সাথে।রাফা ও তার দাদু কে ছাড়া কিছু বোঝে না। রাতের বেলা চলে যায় দাদুর কাছে ঘুমাবে বলে।

রাহাত আবার তার কাজে জয়েন হলে,ব্যাস্ত থাকে সারাদিন।আর আমি রাফা কে স্কুলে দিয়ে এসে ঘরের কাজ গুলো শেষ করি। তারপর আবার সময় মতো রাফা কে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। রাতের বেলা বাবা আর মেয়ের দুষ্টুমি গুলো খুব শান্তি দেয় আমাকে। তারপর রাফা ঘুমিয়ে পড়লে রাহাতের দুষ্টুমি শুরু হয় আমার সাথে।এরকম ভাবেই আনন্দে কেটে যাচ্ছে দিন গুলো।

আজকে শরীর টা খুব খারাপ লাগছে, তবুও রাফা কে নিতে এসেছি স্কুলে। হাঁটতে ভিশন দুর্বল লাগছে তাই রাফা কে নিয়ে স্কুলের একটা বেঞ্চে বসে আছি। শরীর টা একটু ভালো লাগলে তবে বাসায় যাবো।
এরপর করে প্রায় পঁচিশ মিনিট বসে রইলাম কিন্তু শরীরের দূর্বলতা কাটছেই না। তাই ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করলাম, পাশেই একটা হসপিটালে যাবো বলে।
অতঃপর,
ডাক্তার চেক‌আব করে টেষ্ট দিলেন। এরপর টেষ্ট গুলো করে রিপোর্ট এর জন্য বসে আছি। কিছু সময় লাগবে তাও বসে আছি, রিপোর্ট দেখে তবেই বাসায় যাব।
তারপর সেই কাঙ্খিত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যা বললো নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হয়ে গেল। ছোট্ট রাফা কে বুকের সাথে চেপে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম! মেয়েটা আমার ভয়ে কান্না করে দিল।
রাহাত কে কল করে বললাম তাড়াতাড়ি এই ঠিকানায় চলে আসো‌। রাহাত বার বার জিজ্ঞাসা করছে কেন কান্না করছি আমি! কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারলাম না। জানি ওর অফিস থেকে বের হতে অনেক ঝামেলা হবে তবুও এই মুহূর্তে একা বাসায় যাওয়ার শক্তি নেই আমার। একজন নার্স আমাকে শান্তনা দিয়ে চলেছেন কিন্তু আমার রাহাত কে চাই যাকে পেলে আমি নিমিষেই শান্ত হয়ে যাবো।

ঘন্টা খানেক পর রাহাত এলো।দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা দুশ্চিন্তা নিয়ে দৌড়ে এসেছে। গায়ের ইউনিফর্ম টা ঘামে ভিজে একাকার। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম।ও বার জানতে চাইছে কি হয়েছে আমি এখানে কেন এসেছি? এদিকে রাফা ও কান্না করছে। তখন নার্স বললো,
– স্যার আপনি বাবা হতে চলেছেন! সেই খুশিতে আপনার স্ত্রী এভাবে কান্না করছে।আর হ্যা উনি খুবই দুর্বল এই সময়ে বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার খাওয়াবেন।আর বেশি পরিশ্রম করতে দিবেন না।

রাহাত হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাত গুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমুতে ভরিয়ে তোলে। আমি তার চোখে স্পষ্ট আনন্দের বন্যা দেখতে পাচ্ছি।এক হাতে রাফা জরিয়ে ধরে কান্না থামায়।অন্য দিকে আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
– পাগলি এভাবে কান্না করতে হয়? আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভাঙ্গা কন্ঠে বললাম,
– আমার রাফা’র যেন কোন অবহেলা না হয় রাহাত। না হয় আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা।

রাহাত আমাদের দুজনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
– আমি বেঁচে থাকতে কখনোই এমনটা হবে না ইনশা আল্লাহ। তারপর আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুজে রাখে।

🍀 সমাপ্ত 🍀

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here