#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১৭
সূর্য ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে আহত কন্ঠে বলল,
-” ছোট মা, আমি কি লাইন টা কেটে দিব? তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাইছো না?”
মিসেস প্রীতি চোখে অশ্রু বর্ষন নিয়ে মাথা নেড়ে না বোঝালেন। সূর্য মন খারাপ করে বলল,
-” তাহলে এতক্ষণ হলো আমার সাথে একটাও কথা বলছো না কেন? আমি যে এতো প্রশ্ন করলাম তুমি একটারও উত্তর না দিয়ে এভাবে কাঁদছো কেন?”
মিসেস প্রীতি চোখ বন্ধ করে সবটুকু অশ্রু গড়িয়ে দিয়ে ডান হাত দিয়ে গালটা মুছে মৃদু হাসার চেষ্টা করে।তারপর সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” বাবু, তুমি কি জানো তুমি দেখতে একদম তোমার ছোট বাবার মতো হয়েছো?”
ছোট মায়ের কথায় সূর্য মৃদু হেসে উঠে। মিসেস প্রীতি সূর্যের দিকে তাকিয়েই আবারও বললেন,
-” তোমার হাসি টাও তোমার ছোট বাবার মতো।”
বলে মৃদু হাসলেন মিসেস প্রীতি।হঠাৎই সূর্য ছলছলে চোখে তাকিয়ে বলল,
-” ছোট মা, আই মিস ইউ আ লট।ছোট মা, তুমি যাওয়ার পর থেকে কেউ আর আমাকে বাবু বলে ডাকেনি।ছোট মা প্লিজ ফিরে আসো,প্লিজ।ছোট মা…”
-” পুতুল কোথায় অবাক বাবু?” হেসে বললেন মিসেস প্রীতি।ছোট মা কথা ঘুরানোর চেষ্টা করাই সূর্য চুপ হয়ে যায়।তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে হেসে বলল,
-” কোথায় আবার, তোমার মেয়ে ছোট বেলায় যেমন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যেত এখনও তাই করছে। প্রিন্সেস ঘুম কাঁদুনি তার বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন।আর আমি তার পাহারাদার হয়ে বসে আছি তিনি কখন জাগবেন আর আমি তার কান্নার উপশম করবো।
সূর্যের কথা শুনে হেসে উঠেন মিসেস প্রীতি।ছোট মায়ের সাথে সূর্যও হাসতে শুরু করে।
কারো হাসির শব্দ পেয়ে জেগে উঠে পুতুল।চোখ পিটপিট করে খুলতেই দেখতে পায় সূর্য ভীষণ হেসে হেসে কারো সাথে কথা বলছে।হঠাৎই মাম্মার কন্ঠ শুনে পুতুল ধড়ফড় করে উঠে বসে।ফটাফট পা ফেলে ডিভানের কাছে এসে দ্রুত সূর্যের হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে নেয়।
-” মাম্মা,আমি তোমার কাছে যাবো মাম্মা।তুমি বড় আব্বুকে বলো আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে।আমি কালই চলে যাব।মাম্মা তুমি এখুনি বড় আব্বুকে ফোন করে বলো।”
একনিশ্বাসে কথা গুলো বলেই কেঁদে ফেলে পুতুল।আর পুতুলের কাজে সূর্য অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
-” পুতুল, তোমাকে কতবার বলেছি তুমি আর এখানে আসবে না।আর আমার এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে আসতে হবে।আর কথায় কথায় কান্নাকাটি করা বন্ধ করো।”
-” মাম্মা আমি তোমার কাছে যাব, আমার কষ্ট হচ্ছে মাম্মা।প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও নইলে তুমি এখানে চলে আসো।” বলেই কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল পুতুল।
-” আমি ঠিক আছি পুতুল।আর তুমি যদি এরকম পাগলামি করতে থাকো আমি আর তোমার সাথে কোন যোগাযোগ করবো না।এখন তুমি ভাবো কি করবে?”
মায়ের কথায় পুতুল মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। মিসেস প্রীতি একটু চুপ থেকে আবারও বললেন,
-” আমি খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। তুমি তোমার পড়াশোনা ঠিক ভাবে করো।আমি যত দ্রুত সম্ভব তোমাকে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো।”
প্রচন্ড বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়ার কারণে মা আর টুকটুকি আটকে গেছে।তাই সূর্যকে ফোন করে জানিয়েছেন বৃষ্টি থামলে চলে আসবে নইলে থেকে যাবে।সূর্য কথা শেষে পুতুলের রুমে এসে দেখে পুতুল ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে চুপচাপ বসে আছে।এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলো পুতুল শূন্য স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে।
-” কথা শেষ? চলো খেয়ে নেবে ( ঘড়ির দিকে তাকিয়ে) অনেক রাত হয়ে গেছে।” বলে ল্যাপটপ টা বন্ধ করে পাশে রাখে।পুতুল মন খারাপ করে বলল,
-” আমি খাবো না কেপ্টেন, আমি ঘুমবো।” বলেই বিছানায় উঠে বসে।সূর্য পুতুলের দিকে এগিয়ে এসে বলল,
-” তুমি কি আমার কোলে উঠতে চাইছো?”
সূর্যের প্রশ্নে পুতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তার দিকে তাকায়।তারপর রেগে বলল,
-” কেপ্টেন আমি একদম মজা করার মুডে নেই। আপনি কিছু করলে আমি কিন্তু বড় আম্মুকে ডাকবো।”
-” উপস,,,,আমি ভীষণ ভয় পেয়েছি।” বলেই ভীতু ভীতু চাহনি দিয়ে পুতুলের দিকে তাকায়।তারপর রেগে বলল,
-” বড় আম্মুকে ডাকবে!! বলদ কোথাকার।বলছি রানী এলিজাবেথ আপনার বড় আম্মু কেন বাসায় আমি আর আপনি ছাড়া কেউ নেই।তো দয়া করে আপনার ভোজন শেষ করে আমাকে উদ্ধার করুন।”
পুতুল ভ্রু কুঁচকে বলল,
-” কেউ নেই মানে? সবাই কোথায় গেছে?”
-” বাবা দুদিনের জন্য রংপুর গেছে।মা আর টুকটুকি বৃষ্টিতে আটকে গেছে।বৃষ্টি থামলে চলে আসবে।বাড়িতে শুধু আমি আছি,সো কোনো হাংকি পাংকি না করে খেতে আসো নইলে কপালে শনি আছে বলে দিলাম।”
সূর্যের কথায় পুতুল অসহায় লুক নিয়ে তাকায়।সূর্য তার অসহায় দৃষ্টি সম্পূর্ণ ইগনোর করে পুতুলের হাত ধরে বলল,
-” চলো” বলেই পুতুলকে নিয়ে ডাইনিং এ চলে যায়।
——————————————-
অনেকক্ষণ যাবত সূর্য পুতুলের কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে আছে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুটো বিশ বেজে গেছে।অনেকেই বেড়িয়ে গেছে কিন্তু পুতুল বা ওর কোনো ফ্রেন্ডদের কাউকে বের হতে দেখছে না।ফোন টা বের কর কল দেয় পুতুলকে কিন্তু ফোন টা তুলছে না দেখে ভেতরের দিকে পা বাড়ায় সূর্য।মাঠে কাউকে না পেয়ে পুতুলের ক্লাস রুম চেক করে।কোথাও না পেয়ে একটু চিন্তায় পড়ে যায় সূর্য।কিছু একটা ভেবে প্রিন্সিপালের রুমের দিকে হাটতে শুরু করে।কিন্তু ক্যান্টিনের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় পুতুলের বন্ধু প্রতীক আর বেশ কয়েকটা ছেলে হাতাহাতি করছে।সেদিকে এগিয়ে দাড়াতেই কেউ ঝোপ করে জাপটে ধরায় বিস্মিত হলেও পরক্ষনেই বুঝতে পারে সেটা পুতুল।কিন্তু টিশার্টে উষ্ণ পানির উপস্থিতি টের পেতেই দ্রুত পুতুলের মাথায় হাত রাখে পুতুলের মুখ দেখার জন্য।কিন্তু তার আগেই হাতে চিটচিটে কিছু লাগায় হাতটা সামনে নিয়ে বুঝতে পারে সস টাইপ কিছু হাতে লেগেছে।পরক্ষণেই পুতুলের মাথার দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি পুতুলের মাথায় বেশ খানিক সস লেগে আছে।বিস্মিত হয়ে আশেপাশে তাকাতেই কিছুদূরে তিতিয়াকে টিসু বক্স হাতে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় কাছে ডাকলো।
তিতিয়া কাছে এসে দাড়াতেই সূর্য রেগে বলল,
-” কী হয়েছে তিতিয়া?”
তিতিয়া কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,
-” ভাইয়া আসলে, (প্রতীকের পাশের ছেলে গুলোকে দেখিয়ে) ওই ছেলে গুলো সবসময় পুতুল আর আমাকে বাজে কথা বলে।আজ লাস্ট ক্লাস না থাকায় আমি, পুতুল আর প্রতীক ক্যান্টিনে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম, তখন সিয়াম তার গ্রুপ নিয়ে আমাদের টেবিলে বসে বাজে কথা বলতে শুরু করে।প্রতীক বাধা দিতেই ওকে বাজেভাব গালাগালি করতে শুরু করে।এসব দেখে পুতুল দ্রুত আমার হাত ধরে উঠে দাড়ায় বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু শয়তান সিয়াম টা পুতুলের হাত ধরে আটকে ওর মাথায় সস ঢেলে দেয়।আর এখন প্রতীককে মারছে।”
একনিশ্বাসে কথা গুলো বলে থামলো তিতিয়া।সূর্য ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” সিয়াম কে?”
তিতিয়া হাত দিয়ে প্রতীকের কলার চেপে ধরা ছেলে টা কে দেখাতেই সূর্য পুতুলকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে সিয়ামের কলার ধরে সামনে নিয়ে ধরাম করে একটা ঘুষি দেয়।আকস্মিক ঘুষি খেয়ে ফ্লোরে বসে ভো ভো করা মাথা নিয়ে সামনে তাকাতেই ভয় পেয়ে যায় সিয়াম।ছ’ফুটের বেশি উচু একজন সুঠাম দেহী ছেলে তার সামনে নাক কান লাল করে ভয়ানক রেগে দাঁড়িয়ে আছে।সূর্য রেগে সিয়ামের কলার ধরে আবার দাঁড় করিয়ে দাঁত কিরমির করে বলল,
-” মেয়েদের বাজে কথা বলিস।” বলেই এলোপাতাড়ি থাপ্পড় লাগাই ছেলেটাকে।তারপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে হাতের উপর পা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” তোর সাহস হলো কী করে ওর হাত ধরার?” বলেই এলোপাতাড়ি লাথি দেয় সূর্য। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু খুজে ছেলেটাকে বাম হাত দিয়ে কলার টেনে তুলে পাশের টেবিলে ফেলে।সিয়াম কিছু বুঝে ওঠার আগেই সূর্য তার নাক টিপে মুখের মধ্যে সসের বোতলটা ঠেসে ধরে।কিছুক্ষণ পরে ছেড়ে দিতেই দু’হাতে গলা ধরে কাশতে কাশতে ফ্লোরে শুয়ে পড়ে সিয়াম।সূর্য আরো কিছু এলোপাতাড়ি লাথি দিতেই তৌফিক সাহেব দৌড়ে এসে সূর্যকে থামান।
-” সূর্য কাম ডাউন। আমি দেখছি ব্যাপারটা, তুমি প্রিয়ন্তিকা কে নিয়ে বাসায় যাও।ওর যা শাস্তি দেয়ার আমি দিব।”
তৌফিক সাহেবর কথায় সূর্য আর কিছু না বলে তিতিয়ার থেকে একহাতে পুতুলের ব্যাগ নিয়ে অন্যহাতে পুতুলের হাত ধরে হনহন করে বেরিয়ে যায়।আর পুতুল মাথা নিচু করে সূর্যের পিছু পিছু দৌড়ানি দিয়ে হাটছে।গাড়ির কাছে এসেই পুতুলকে সামনের সিটে বসিয়ে ব্যাক সিটে পুতুলের ব্যাগ রেখে দরজা টা ধড়াম করে লাথি দিয়ে বন্ধ করে সূর্য।
লাথির শব্দে কেঁপে উঠে পুতুল।ভয়ে তার কান্না পাচ্ছে।সূর্যকে এতো রাগতে সে কখনো দেখেনি।তাই ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে পুতুল।সূর্য ড্রাইভিং সিটে বসে রাগী কন্ঠে বলল,
-” সিট বেল্ট লাগাও।”
সূর্যের কথা শুনে পুতুলের কান্নারা কেমন গলায় দলা পাকিয়ে আসছে। সবসময় তো নিজেই সিট বেল্ট লাগিয়ে দেয় ভেবেই কান্না পাচ্ছে।মনে মনে নিজে সিট বেল্ট লাগাতে চাইলেও হাতটা কেমন অসাড় হয়ে রয়েছে, মনে হচ্ছে কিছুতেই হাতটা উঠাতে পারছে না।
-” কী হলো কথা কানে যাচ্ছে না? সিট বেল্ট লাগাও।”
এতক্ষণ কান্নারা দলা পাকিয়ে থাকলেও সূর্যের ধমকে মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কেঁদে দেয় পুতুল।পুতুলের কান্না দেখে সূর্য দিগুণ রেগে বলল,
-” কাঁদছো কেন?? এই কান্না থামাও নইলে কিন্তু খুন করে ফেলবো। কি বলছি কানে যাচ্ছে না, কান্না বন্ধ করো পুতুল। এই আমি কি বলছি?”
বলেই একহাতে পুতুলের হাত শক্ত করে ধরে কাছে নিয়ে আসে।আর অন্যহাতে পুতুলের গাল ধরে বলল,
-” কথায় কথায় শুধু কাঁদতে পারো আর কিছু পারো না? ওই বাস্টার্ড টা যখন হাত ধরেছিল থাপ্পড় দিতে পারো নি? বাজে কথা শুনে চুপচাপ থাকতে কেন? পায়ের জুতা খুলে গালে বারি লাগাতে পারোনি? তা পারবে কেন, তুমি তো শুধু কাঁদতেই পারো।”
বলে ধাক্কা দিয়ে সিটে ফেলে দেয় পুতুলকে।সূর্যের কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া হলো কিনা বোঝা গেল না পুতুল একইভাবে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকলো। সূর্য আরো রেগে বলল,
-“এই কান্না থামাতে বলেছি না আমি? কি বলছি শুনতে পাওনি? পুতুল আমার রাগ উঠিও না। কান্না থামাও বলছি।”
বলে হাত দিয়ে স্টিয়ারিং এ জোরে বাড়ি দেয় সূর্য।পুতুল ভয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা করে।কিন্তু কান্নার শব্দ বন্ধ হলেও হেঁচকি আর কান্নার দমক মিলিয়ে অদ্ভুত শব্দ তৈরি হলো।
সূর্য কিছুক্ষণ পুতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে ঝট করে পুতুলকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে নিয়ে ফট করে পুতুলকে দু’হাতে বুকের সাথে জাপটে ধরে।
#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ
পর্ব-১৮
অনেকক্ষণ হলো অর্ক মিসেস প্রীতির সামনে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে।মিসেস প্রীতি চোখ ছোট ছোট করে বলল,
-” অর্ক কোনো সমস্যা? কিছু কি হয়েছে?”
অর্ক জোর পূর্বক হেসে বলল,
-” খালামনি, সিডনি ইউনিভার্সিটি থেকে আমার এপ্লিকেশন টা গ্রান্ট করেছে।ওরা নেক্সট মান্থ থেকে আমাকে জয়েন্ট লেকচারার হিসেবে জয়েন করার কথা জানিয়েছে।”
-” সে তো খুব ভালো কথা, এতে এরকম মুখ ভোতা করে আছিস কেন?”
অর্ক আমতা আমতা করে বলল,
-” খালামনি তুমি যদি রাজি থাকো আমি তোমাকে আর পুতুলকে আমার সাথে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চাই।”
মিসেস প্রীতি একটু বিস্মিত হয়ে বললেন,
-” আমাকে আর পুতুলকে? কীভাবে? ”
অর্ক মাথা নিচু করে অপরাধী ভাব নিয়ে বলল,
-” খালামনি, আসলে….. আসলে আমি পুতুলকে বিয়ে করতে চাই।”
মিসেস প্রীতি বেশ অবাক হয়ে বললেন,
-” বিয়ে!! কিন্তু,,,,,”
কথা শেষ হবার আগেই অর্ক মিসেস প্রীতির হাত ধরে বলল,
-” খালামনি, আমি জানি তুমি কি বলবে।আমি ওকে ভীষণ ভালবাসি খালামনি।আই প্রমিজ ওকে কখনো কষ্ট পেতে দেব না, ওকে ভীষণ যত্নে রাখবো আর ওর স্বপ্নগুলো সব আমি পূরণ করবো খালামনি। তুমি রাজি থাকলে পুতুলের আঠারো পূর্ণ হলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই।প্লিজ খালামনি তুমি না করো না।”
মিসেস প্রীতি বেশ চিন্তিত হয়ে বললেন,
-” আমি এখুনি কিচ্ছু বলতে পারছি না, আমাকে একটু ভাবতে দে।তাছাড়া পুতুলের সাথে কথা না বলে আমি কিছুই বলতে পারবো না।”
-“পুতুলকে এখুনি কিচ্ছু বলতে হবে না, ওর ফাইনাল এক্সাম শেষ হলে বলো।আমি জাস্ট সিডনি যাওয়ার আগে তোমাকে জানালাম যাতে ওর ফাইনাল শেষে তোমাদের কে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।”
পুতুল বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে।সূর্য ড্রাইভ করতে করতে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” এভাবে বোকা বোকা চাহনি দিয়ে আমার দিকে তাকাবে না।তোমার এই বোকা চাহনি দেখলে আমার পৃথিবীর ভয়ানক চুমুটা খেতে ইচ্ছে করে।”
সূর্যের কথায় পুতুল ফট করে সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকায়।লজ্জায় পুতুলের গাল গুলো লালচে হয়ে গেছে।মনে মনে ভীষণ ভাবে এক দফা লজ্জা পেয়ে আড়চোখে সূর্যকে একবার দেখে নিল।কিছুক্ষণ আগের কথা ভেবেই দ্রুত চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে থাকে পুতুল।
তখন সূর্য পুতুলকে হঠাৎ জাপটে ধরায় কান্নার গতি বেড়ে গেলেও সূর্যের কথা শুনে কান্নারা উধাও হয়ে উপস্থিত হয়েছিল একরাশ বিস্ময়।
তখন সূর্য তাকে জাপটে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল,
-” তুমি শুধু আমার সামনে কাদবে পিচ্চি, আর কারো সামনে কাদবে না।পৃথিবীর আর কারো অধিকার নেই তোমার কান্না দেখার।তুমি চাও বা না চাও তোমার কান্না দেখার একমাত্র অধিকার আমার, শুধুমাত্র আমার বুঝলে।”
বলে কানের পাশে আলতো করে চুমু দেয় সূর্য।
সূর্যের স্পর্শে সম্পূর্ণ এক অচেনা অনুভূতিতে ছেয়ে যায় পুতুলের শরীর।সে তার সস লাগা হাত দিয়েই সূর্যের সাদা টিশার্ট টা খামচে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলে।সূর্য কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠে,
-“তুমি এতো কেন পিচ্চি বলতো? সবকিছুতে এতো ভয় পাও কেন বলতো? তুমি আমার পুতুল, তোমাকে অনেক স্ট্রং হতে হবে, এসব ছোট ছোট ব্যাপারে একদম ভয় পাবে না। আমিতো সবসময় তোমাকে প্রটেক্ট করার জন্য থাকবো না তাইনা? তাই নিজেকে নিজে প্রটেক্ট করবে, একদম ভয় পাবে না।প্লিজ গ্রো আপ পুতুল। ”
বলে সূর্য পুতুলকে ছেড়ে তার বন্ধ চোখের পানি মুছে দিয়ে তার দুচোখের পাতায় চুমু একে দেয়। সূর্যের এরকম উষ্ণ পরশে পুতুলের অনুভূতিরা শিরশির করে তাকে এক অন্যরকম ভালো লাগার কথা জানান দিচ্ছে, কেমন ভালবাসা ভালবাসা অনুভূতি।ভাবতেই সে আরো জোরে চোখ চেপে বন্ধ করে নেয়।
সূর্য পুতুলের অবস্থা দেখে মৃদু হেসে ওকে ওর সিটে বসিয়ে দিয়ে টিশার্ট খামচে ধরা হাত দুটো নিয়ে আবারও টুপ করে চুমু দিয়ে বলেছিল,
-” তুমি এতো বোকা কেন বলোতো! যার বাবা আর্মির একজন দুঃসাহসী কেপ্টেন ছিলো আর শ্বশুর একজন নামকরা মেজর, সে কিনা এতো ভীতু ব্যাপার টা আসলেই হতাশাজনক।”
বলে একটা বড় নিশ্বাস নেয় সূর্য। সূর্যের কথা শুনে পুতুল ফট করে চোখ খুলে বিস্ময় ভর্তি চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
-” শ্ শ্বশুর? ”
সূর্য পুতুলের সিট বেল্ট লাগিয়ে দিতে দিতে উত্তর দেয়,
-” হুম শ্বশুর, সিনিয়র মেজর মি. মাহবুব জামান খান তোমার ওয়ান এন্ড অনলি শ্বশুর মশাই, বুঝলে?” বলে পুতুলের নাক টিপে গাড়ি স্টার্ট দেয় সূর্য।
পুতুল দ্বিগুন বিস্মিত হয়ে বলল,
-” মানে?”
উত্তরে সূর্য পুতুলের দিকে ভ্রু কুঁচকে একবার তাকিয়ে বলল,
-“ইউ নো হোয়াট আই ওয়ান্ট টু সে, তুমি এতোটাও বোকা নও পুতুল।নাকি তুমি বাবাকে সন্দেহ করছো?বাই চান্স তুমি এটা ভাবছো না তো যে আমি ছাড়াও বাবার আর কোনো ছেলে আছে?
তাহলে আগেই বলে রাখি বাবা- মায়ের লাভ ম্যারেজ আর আমিই তাদের একমাত্র ছেলে বুঝলে।”
বলে মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করতে থাকে।
এরকম ইডিয়ট, স্টুপিড মানুষ দ্বারাই এমন প্রপোজ করা সম্ভব। এটাকে কী কোনভাবে প্রপোজ বলা যায়!! নাকি বিয়ে ঠিক করে শ্বশুর বাড়ি পরিচিতি পর্ব বলে!! নাকি হুমকি বলা যায়!! কথা গুলো ভেবেই পুতুল হতভম্ব হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল।
সূর্যের কথা আর কাজে পুতুলের বার বারই মনে হতো সূর্য তাকে ভালবাসে, ভীষণ ভালবাসে।কিন্তু সেটা কি তার ছোট বাবার মেয়ে হিসেবে নাকি অন্য হিসেবে সেটা বুঝে উঠতে পারতো না পুতুল। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে হতেই পুতুল অদ্ভুত স্নিগ্ধ চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই উঁচু নাকওয়ালা ভয়ংকর সুন্দর চোখের ছেলেটা তাকে ভালবাসে,ভীষণ ভালবাসে।
ভাবনার সুতা তিরতির করে ছিড়ে সূর্য।পুতুলের কপালে আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে বলল,
-” আমার মুখে কী নতুন কোন গ্রহ-নক্ষত্র দেখা দিয়েছে যে নাসার গবেষকের মতো তাকিয়ে আছো?”
সূর্যের কথায় পুতুল রেগে ভ্রু কুঁচকে সূর্যের দিকে তাকায়। সূর্য হালকা হেসে পুতুলের সিট বেল্ট খুলে দিয়ে বলল,
-” গবেষণা শেষ হলে দয়া করে ভিতরে যেয়ে সসি-পুতুল থেকে নরমাল পুতুল হয়ে নিন প্রিন্সেস ঘুম কাঁদুনি। ”
সূর্যের কথায় পুতুল সামনে তাকাতেই বুঝতে পারে তারা পৌঁছে গেছে। তাই আর কিছু না বলে লক্ষি মেয়ের মতো ভেতরে চলে যায় পুতুল।
সূর্য গাড়ি পার্ক করে হেলেদুলে লিভিং রুমে এসে ধুপ করে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।মিসেস মধুমিতা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে সূর্যর ঘনকালো শক্ত চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” অবাক,বাচ্চাদের মতো টিশার্টে এসব কী ভরিয়েছিস বলতো?”
-” মা ওই…..”
টিভির ব্রেকিং নিউজ দেখে তাড়াক করে উঠে বসে সূর্য।রিমোট নিয়ে সাউন্ড বাড়াতেই সুস্পষ্ট উচ্চারণ করে একটা পুরুষ কন্ঠে শুনতে পায়,
“বিগত দুদিন যাবত বাংলাদেশের দুজন বিখ্যাত সাংবাদিক নিখোঁজ।”
নিউজ টা শোনার সাথে সাথেই সূর্যের ফোন টা বিপ বিপ শব্দে বেজে উঠে।ফট করে উঠে দাড়িয়ে ফোন টা রিসিভ করেই স্যালুট দেয় সূর্য।অপর পাশের থেকে কি বললো শোনা গেল না।উত্তরে সূর্য দুবার ” ইয়েস স্যার” বলে ফোন টা রেখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” মা, আই হ্যাভ টু গো রাইট নাউ। ”
-” তুই না বললি দুই মাসের ছুটি তাহ,,,,,,”
সূর্য সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,
-” মা এখন কিছু বলতে পারবো না, এসে বলবো।” বলেই হুড় পাড় করে নিজের রুমে চলে যায়।মিসেস মধুমিতা স্থির চোখে কিছুক্ষণ ছেলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ফোঁত করে একটা নিশ্বাস নেন।
চলবে
চলবে