ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর পর্ব ১৬

#ছুয়ে_দেখো_আমার_শহর
#লেখিকা_হৃদিতা_আহমেদ

পর্ব-১৬

ভীষণ রকমের মন খারাপ আর অস্থিরতা নিয়ে বাসায় বসে আছে পুতুল। বড় আম্মুকে বলে আজ কলেজ অফ দিয়েছে।কিন্তু স্টুপিড কেপ্টেনটা কলেজ যাবে না শুনে এক প্রকার যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিল।অবশ্য যুদ্ধ তো করবেই আমি না গেলে তো তিতিয়ার সাথে ঢলে ঢলে গল্প করতে পারবেনা।অসভ্য কোথাকার।আবার ঢং করে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করেছেন।ভেবেই রাগে গা কিরমির করছে পুতুলের।পুতুল যে ওই বেয়াদব তিতয়াকে এতবার বললো কেপ্টেনের গার্ল ফ্রেন্ড আছে তারপরও নির্লজ্জ মেয়েটা কেপ্টেনের পিছু ছাড়ে না।নির্লজ্জ একটা।ধুর যা পারে করুক আমার কী ভেবেই ধপ করে ডিভানে শুয়ে পড়ে পুতুল।

সেই ভোরে ঘুম ভেঙে আর ঘুমোই নি পুতুল।ডিভানে বেশ কিছুক্ষণ উলটা পালটা হয়ে শুয়ে থেকেও ঘুম না আসায় উঠে বেডে শুয়ে পড়ে।বেডে শোয়ার আধাঘন্টা পরে অনেক চেষ্টায় ঘুম নামে চোখে।এদিকে মিসেস মধুমিতা পুতুলকে লাঞ্চের জন্য ডাকতে এসে দেখে বেঘোরে ঘুমচ্ছে।সকালে মাথাব্যথা ছিল তাই কলেজ যায়নি, সেই ভেবে আর না ডেকে ফিরে আসেন।স্বপ্নাকে পুতুল উঠলে খেতে দেওয়ার কথা বলেন।খানিকক্ষণ পরে রেডি হয়ে বেরিয়ে যান ছন্দর স্কুলের উদ্দেশ্য।আজ ছন্দের ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি আছে, ছন্দকে নিয়ে একবারে সেখানেই যাবেন।

প্রায় চারটা নাগাদ পুতুলের ঘুম ভাঙলো।সময় দেখে অবাক হয়ে গেল,সে প্রায় ছয় সাত ঘন্টা ঘুমিয়েছে! বেশি ঘুমোনোর ফলে মাথাটা ভারী হয়ে আছে। এদিকে পেটও চুঁইচুঁই করে খুধার কথা জানান দিচ্ছে।তাই ফটাফট উঠেই আগে গোসল করে হেলেদুলে ডাইনিং এ আসে।লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছিল স্বপ্না,পুতুলকে দেখেই তাড়াতাড়ি উঠে আসে।পুতুলকে দেখে ব্যস্ত হয়ে খাবার সার্ভ করা শুরু করে স্বপ্না।পুতুল চেয়ারে বসে বলল,
-” স্বপ্না আপু, বড় আম্মু কই?”
-” বড় মা ছোট আপমনির স্কুলে গেছে, ছোট আপামনির বান্ধবীর জন্মদিন আছে একবারে সেখানে যাবি কইছে।আপনি ঘুমাই ছিলেন তাই নিয়ে যাইতে পারিনি।”
-” ওহ ”
পুতুলের একা একা খেতে মোটেও ভালো লাগে না।তাই স্বপ্নার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” স্বপ্না আপু, আমার না একলা খেতে ভালো লাগছে না তুমি বরং এক কাজ করো তুমিও কিছু খাবার নাও আমরা দুজন টিভি দেখতে দেখতে খাবো।”
স্বপ্না দুপুরেই খেয়েছে তারপরও পুতুলের অনুরোধ রাখতে হালকা কিছু খাবার নিয়ে পুতুলের সাথে টিভির সামনে গিয়ে বসে।খাওয়া শেষে পুতুল নিজের রুমে এসে মাম্মাকে ফোন করে।কিন্তু যন্ত্র- মানবী টা বার বার একই কথা শুনাচ্ছে।এবার পুতুলের কান্না পাচ্ছে।

মা ফোন করে জানিয়েছেন পুতুল বাড়িতে একা আছে তাদের আসতে দেরি হবে,এদিকে বাবাও কাজে শহরের বাইরে গেছে।তাই সূর্য তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু সমাবেশ থেকে দ্রুত প্রস্থান করেছে উদ্দেশ্য বাড়িতে যাওয়া তার প্রেয়সীকে পাহারা দেয়া।বাড়িতে ঢুকে সোজা সিড়ি বেয়ে ডান দিকে গিয়ে তিন নম্বর রুমে উঁকি দেয় সূর্য।কিন্তু বেচারা হতাশ তার প্রেয়সী রুমে নেই।স্বপ্নার থেকে জানতে পারে তিনি প্রকৃতি বিলাস করতে বাগানে গেছেন।পুতুল আর টুকটুকি প্রায়ই গোধূলি লগ্নে বাগানের দোলনায় বসে সময় কাটায়।তাই কথা না বাড়িয়ে স্বপ্নাকে একটা ধোঁয়া ওঠা কফির অর্ডার দিয়ে নিজের রুমে চলে যায় সূর্য।

ফ্রেশ হয়ে বের হতেই টি-টেবিলে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটা নজরে পড়ে সূর্যর।মুখ মুছতে মুছতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ঘড়ির কাঁটা ছয়টা ছুঁইছুঁই করছে। ডান হাতে কফির পেয়ালাটা হাতে নিয়ে চুমুক দিতে দিতেই বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় সূর্য।বাগানের উত্তর দিকে দোলনায় সাদা স্কার্টের সাথে একটা লেমন কালারের টপস পড়ে মাথা টা হাঁটুতে গুঁজে বসে আছে পুতুল।সূর্য কফিটা পুতুলকে দেখতে দেখতে শেষ করে।কিন্তু এতক্ষণে পুতুলকে একবারও মাথা উঠাতে না দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সূর্য।পুতুল কি দোলনায় বসে ঘুমিয়ে গেছে? ভেবেই রুমে এসে ব্লু থ্রিকোয়াটার এর উপর দ্রুত স্কাই কালারের টিশার্ট টা চাপিয়ে রওনা দেয় বাগানের দিকে।

মিসেস শীথি লাগাতার পুতুলকে ফোন করে যাচ্ছে।কিন্তু মেয়েটা তার ফোনটা রিসিভই করছে না।নিজের বোকামির জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে মিসেস শীথির।প্রীতিকে ফ্লোরে সেন্সলেস অবস্থায় দেখার পরে মাথা ঠিক নেই মিসেস শীথির।স্বামীর সাথে বোনকে হসপিটালে নিয়ে আসার পরে অর্ককে জানানোর জন্য কল করেন তিনি।দু-তিন বার কল দেবার সাথে সাথে ফোনের রিংটোন বাজায় না দেখেই হন্তদন্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে কেঁদে ছেলেকে তার খালামনির অসুস্থার কথা জানান।কিন্তু পরক্ষণেই পুতুলের কন্ঠ শুনে হতভম্ব হয়ে যান।পুতুলের কান্নাকাটির তোড়ে সব বলে দেন।সব শুনে হঠাৎ কিছু না বলেই কলটা কেটে দেয়।কিন্তু মেয়েটা আর ফোনও তুলছে না দেখে তার অস্থিরতা বেড়ে যায়।এদিকে বোনটাও কথা বলার অবস্থায় নেই যে তাকে দিয়ে পুতুলকে সান্ত্বনা দিবেন।সবকিছু ভীষণ এলোমেলো লাগছে, ঠিক তখনই অর্ক ছুটে এসে মায়ের সামনে দাড়ায়।

সূর্য দোলনার কাছে আসতেই কান্নার আওয়াজ শুনে অবাক হয়ে যায়।পুতুল কাঁদছ! কিন্তু কেন! আর কিছু না ভেবেই দ্রুত পুতুলের সামনে এসে দাঁড়ায়।পুতুল এতটাই মনোযোগ দিয়ে কাঁদতে ব্যস্ত যে সে বুঝতেই পারেনি কেউ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।ঘোর ভাঙে মাথায় কারো স্পর্শ আর ব্যস্ত গলার ডাক শুনে।
-“পুতুল!এই পুতুল! কী হয়েছে?এখানে বসে কাঁদছো কেন?”
ফোলা চোখ-মুখ নিয়ে ঝাপসা চোখে সামনে তাকিয়ে সূর্যকে দেখেই তার কোমড় পেচিয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করে পুতুল।পুতুলের কাজে বিস্মিত হয়ে ভাবছে মেয়েটা এতো কাঁদছে কেন?সূর্য পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
-” কী হয়েছে পুতুল? কাঁদছো কেন? বলো আমাকে।”
পুতুল সূর্যের পেটে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
-” আমি মাম্মার কাছে যাব কেপ্টেন, আমার মাম্মাকে চায়, এখুনি চায়।” বলেই ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
পুতুলের বাচ্চাদের মতো কথা শুনে সূর্যের কেমন হাসি পাচ্ছে।এতো বড় একটা মেয়ে তার কাছে বাচ্চাদের মতো মাম্মাকে চাচ্ছে ভেবেই ঠোঁটের কোণে হাসির আভা ফুটে ওঠে।কিন্তু পুতুলের কথা শুনে নিমেষেই আভাটা নিভে যায়।
-” মাম্মার কিছু হলে আমি মরে যাব, একদম মরে যাব।প্লিজ আমাকে মাম্মার কাছে নিয়ে চলুন।আমি মাম্মার কাছে যাব।” বলে সূর্যকে আরো জাপটে ধরে কাঁদতে শুরু করে পুতুল।
সূর্য ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না,পুতুল হঠাৎ ছোট মায়ের জন্য এতটা ডেস্পারেট হয়ে গেল কেন? তবে কি ছোট মায়ের আবার কিছু হয়েছে? ভেবেই ফট করে পুতুলের হাত ছাড়িয়ে হাটু ভেঙে পুতুলের সামনে বসে।দু’হাতে পুতুলের মুখটা ধরে চোখের পানি মুছে বলল,
-“কি হয়েছে আগে বলো আমাকে।এতো কাঁদছ কেন? ছোট মায়ের কি কিছু হয়েছে?”
সূর্যের কথায় পুতুল দিগুণ কেঁদে মাম্মার অসুস্থতার কথা জানায়।সব শুনে সূর্য কি করবে বুঝতে পারছে না। বাবাও নেই যে কোনকিছু করবে এদিকে পুতুল একভাবে কাঁদছে।

গোধূলি লগ্ন শেষ হয়ে এক মুঠো অন্ধকার ছেয়ে গেছে পৃথিবীতে।ক্লান্ত পাখিগুলো অনেক আগেই ডানা ঝাপটিয়ে তাদের নীড়ে ফিরে গেছে।বাগানের ডান দিকে কৃত্রিম আলো গুলো জ্বলে উঠেছে।সেই আলোরই কিছু অংশ এসে পড়ছে দোলনাতে।পুতুল অনেক আগেই সূর্যের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে।আর সূর্য পুতুলকে একহাতে জড়িয়ে ধরে দোলনায় বসে তার ঘুমন্ত পুতুলকে দেখছে।এই মেয়েটা যে তার অস্তিত্বে কতটা মিশে গেছে এখন বুঝতে পারছে সে।এই যে মেয়েটা কাঁদলে তার বুকটা ব্যাথায় টনটন করে,তাও যে সে ব্যাথা নয় ভীষণ রকমের গভীর ব্যাথা।হঠাৎ ফোনের ভাইব্রেশনে ধ্যান ভাঙে সূর্যর, এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচে ঘাসের উপর পুতুলের ফোন টা দেখতে পায়।একটু ঝুকে বাম হাত বাড়িয়ে ফোন টা হাতে তুলে নেয় সূর্য। স্ক্রিনে ভাইয়া নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে সূর্য।

ছয়-সাত বার কল আসায় সূর্য কিছু একটা ভেবে বেশ ইতস্তত হয়ে ফোন টা রিসিভ করতেই একটা ব্যস্ত পুরুষ কন্ঠ শুনতে পায়।
-” পুতুলসোনা, খালামনি একদম ঠিক আছে তুই একদম কাঁদিস না।খালামনি তো এখন ঘুমচ্ছে, খালামনি জাগলেই তোর সাথে কথা বলিয়ে দেব সোনা।তুই একদম টেনশন করিস….।”
-” সরি ”
অর্ক আর কিছু বলবে তার আগেই একটা ছেলে কন্ঠ শুনে হতভম্ব হয়ে নিজের ফোন টা হাতে নিয়ে নাম্বার টা চেক করে।নাম্বার টা ঠিক আছে দেখে আবারও ফোন টা কানে লাগায়।
সূর্য বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-” সরি,আসলে পুতুল ঘুমচ্ছে।অনেক বার কল আসায় মনে হলো খুব দরকারী কল এসেছে তাই রিসিভ করেছি।ও ঘুম থেকে উঠলে আমি জানিয়ে দেব।”
একনিশ্বাসে কথা গুলো বলল সূর্য।তারপর আবারও ছেলেটাকে কিছু বলতে না দিয়ে বলল,
-” ছোট মা আই মিন পুতুলের মাম্মা কেমন আছেন?”
অর্কর থেকে সব খবর নিয়ে ফোন টা রেখে দেয় সূর্য।তারপর সাবধানে পুতুলকে কোলে তুলে বাড়ির ভেতরে এগিয়ে যায় সূর্য।

অন্যদিকে ফোনের দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে অর্ক।কেমন যেন একটা অসহ্য অস্থিরতা কাজ করছে তার, ছেলে টা যে পুতুলের কাজিন বেশ বুঝতে পেরেছে।কিন্তু তারপরও অস্থিরতা টা কাটছে না।কেমন একটা পুতুলকে হারানোর ভয় মনের কোণে উঁকি দিচ্ছে।ভাবনার পতন ঘটে কারো স্পর্শে, তাকিয়ে দেখে মা তার পাশে দাড়িয়ে আছে।
-” কিরে পুতুলের সাথে কথা হলো?”
-” নাহ,তোমার পুতুল কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে,তবে তার একটা কাজিনের সাথে কথা হয়েছে।”
-“ওহ” বলে চুপচাপ ছেলের পাশে বসে পড়েন মিসেস শীথি।

চলবে
দুঃখিত 😔।ঈদের আগ পর্যন্ত একটু অনিয়ম হবে।আসলে ব্যস্ত, ভীষণ ব্যস্ত।আমি চেষ্টা করবো যতটা পারি নিয়মিত দেয়ার।সরি এগেইন😞

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here