জোনাকিরা জ্বলে নিভে পর্ব -০৩

#জোনাকিরা_জ্বলে_নিভে (পর্ব -তিন)
#লেখিকা #রেহানা_পুতুল
তোর মুখে ফুফু ডাক শুনতে চাইনা। তোর মতো মাইয়া জন্মানোর আগেই মরা উচিত ছিল। অন্যের গয়না শাড়ি দিয়া তোর কাম নাই। তারা তাদের এগুলো সব ফেরত চাইছে। যা তোর শরীরে ছিল। গয়না, শাড়ি, জুতা, সব আইনা দে। রোষপূর্ণ কন্ঠে কাজলের দিকে চেয়ে বলল তার ফুফু আয়রা।

উরমি আশ্চর্য হয়ে গেল কাজলের ফুফুর কথা শুনে। ভাবল কি আর হলো কি। তার বিশ্বাস ছিল কাজলকে তার পরিবারের লোকজন নিয়ে যেত আসল। এত বছরের মায়ার সূতো কি চাইলেই এক কাহিনীকে কেন্দ্র করে ছিঁড়ে ফেলা যায়।

কাজল কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলনা। দ্রুত পায়ে ঘরে গিয়ে জরিনার সাহায্যে একটি ব্যাগ যোগাড় করে নিল। সবকিছু ব্যাগে পুরে নিল। এসে তার ফুফুর হাতে দিল। এবং বলল,
ফুফু ভাঙা পা নিয়ে এত কষ্ট করে এতদূর আপনার না আসলেও হতো। যেখানে আপনি দ্বিতীয়জন ছাড়া রুম থেকেই বের হতে পারেন না। সেখানে কিভাবে অন্যগ্রামে চলে এলেন। তাই অবাক হলাম। আপনি ছাড়া অন্য কেউ আসলে কি আমি এগুলো দিতাম না? আপনারা না আসলেও এগুলো আমি পাঠিয়ে দিতাম।

অকারণে অন্যের জিনিস ভোগ করে আনন্দ লাভ করার কোন অভিলাষ নেই আমার। এই চিনলেন এত বছর ধরে আমাকে? লোভ যদি আমার মাঝে থাকতোই তাহলে আজ আমি আপনাদের পছন্দের পাত্রের বাড়িতেই থাকতাম। যদিও বিয়েটা আমি ভাঙ্গিনি।

চুপ কর হারামজাদি। ন্যাকামি করতে হবেনা। তুই না বললে কার এত ঠ্যাকা পড়ছে অন্যের বাড়ির মাইয়ার বিয়া ভাঙ্গানোর? এসব তোরই কারসাজি। দুই টাকা কামানোর মুরোদ নাই। আবার নীতির বুলি আওড়াস আমার কাছে। ছোট মুখে অত বড় কথা মানায়না বুঝলি। সব ভেস্তে দিলি তুই।হুহ!

একদমে বিষপূর্ণ কন্ঠে কথাগুলো বলল কাজলের ফুফু আয়রা। বলেই জিনিসগুলো হাতে নিয়েই গটগট পায়ে উঠান ছাড়ল তারা দুজন।

জরিনা উঠান ঝাড়ু দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে খরগোশের মতো কান খাড়া করে এতক্ষন এদের তেতো বাক্য বিনিময় শ্রবণ করলো। তারা চলে গেলে কাজল ও উরমির সামনে এসে দাঁড়ালো। ধুম করে হাতের ঝাড়ু মাটিতে ফেলে দিল।

নাক চোখ কুঁচকে বাড়াবাড়ি রকমের ক্ষোভ ঝেড়ে বলল,
আপা আপনি আর জীবনেও ওই বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাইখবেন না। দরকার হইলে আমাদের বাড়িত গিয়া থাকবেন।

জরিনা…

শুভ্রের ভরাট কন্ঠ শুনেই জরিনা হকচকিয়ে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার পানে চাইল একবার। ঝাড়ু হাতে তুলে নিয়ে চলে গেল তার অন্য কাজে। শুভ্র এতক্ষন তার রুমের খাটে থেকেই জানালার ফাঁক গলিয়ে সব দেখল ও শুনল। কাজল ,উরমিও শুভ্রকে এক পলক দেখেই স্থান পরিবর্তন করলো।

উরমি কাজলের হাত ধরে বলল,
জরিনার কথায় তুমি কিছু মনে করোনা আপু। ও ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাড়িতে কাজ করে। তাই সবকিছুতেই অধিকার ফলানোকে সে নিজের কর্তব্য মনে করে।

কাজল চাপা হাসি হেসে দিল। উরমি ঘরে গিয়ে তার মাকে উঠানে ঘটে যাওয়া বিষয়টি জানাল।

জেসমিন বেগম বললেন,
ভালো হয়েছে ফেরত দিয়েছে। পরের বাড়ির এসব সাথে রাখার মানেই হয়না।

সকালে সবাইর নাস্তা খাওয়া শেষ হওয়ার পরে, শুভ তার মাকে বলল,
মা তুমি মেয়েটিকে ডাক দিয়ে সব জেনে নাও। ওর সব না জেনে কোন ডিসিশন নিতে পারছিনা ওকে নিয়ে। পাশ থেকে রুবানাও উচ্ছ্বাস নিয়ে সহমত প্রকাশ করলো। হ্যাঁ ভাবি শুভ্র ঠিকই বলছে।

জেসমিন বেগম রুবানার কথার ইঙ্গিত ধরতে পারলেন। দেরী করলেন না আর। মুহুর্তেই কাজলকে ডেকে আনলেন তার রুমে। একটা খিলি পান সাজিয়ে মুখে পুরে দিলেন। শুভ্র চলে গেল কাজল বিব্রত হবে ভেবে। বাকি সবাই রয়েছে।

নিদিষ্ট একটা বয়সের মেয়েরা নিদিষ্ট একটা বয়সের ছেলের সামনে ভালো কথা বলতেও সংকোচবোধ করে। কুঁচকে যায় গায়ে লবন পড়া চিনে ঝোঁকের মতো। শুভ্রের অনুপস্থিতি কাজলকে বেশ স্বস্তি দিল।

থম মেরে রইলো কাজল। জোরে উপরের দিকে টেনে নিঃস্বাস ছাড়লো। সবাই উৎসুক হয়ে তার দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। যদিও সবার কাছেই স্পষ্ট। কাজলের জীবনের ঘটনা অপ্রীতিকর, নিরানন্দ ও বেদনাময়।

” আমি এ গ্রাম বা এ বাড়ির মেয়ে নই। এটা আমার ফুফু আজ সকালে যে আসল, উনার শশুর বাড়ি। আমার আব্বা মারা যায় আমার নয় বছর বয়সে। আমরা দুই ভাইবোন। আমি বড়। ভাই ছোট। ও এখন আম্মুর কাছেই আছে। আব্বা মারা যাওয়ার দুই বছর পরেই নানা নানি আম্মুকে নিয়ে যায়। তখন আমার বয়স এগারো। সবাই উনাদের প্রলুব্ধ করেছে। বলেছিল আম্মু যেহেতু সুন্দর। বয়স অল্প। ভালো প্রস্তাব ও পেয়েছে। তাই যেন বিয়ে দিয়ে দেয়।
সে লোক বিপত্নীক ছিল। কথা ছিল আমাদের দুই ভাইবোন সহ উনি আম্মুকে বিয়ে করবে। উনি কথা রেখেছে। আমিও আম্মুর নতুন শশুরবাড়িতে নতুন পরিবেশে বাস করতে লাগলাম। তার দুই বছর পর যখন আমি আরেকটু বড় হলাম অর্থাৎ আমার বয়স তেরো হলো।
তখন উনার আগের ঘরের একটি ছেলে ছিল। আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। তাকে বারবার বলা সত্বেও আমাকে আপন বোনের নজরে দেখতনা। সুযোগ পেলেই আমার গায়ে বিশ্রীভাবে হাত লাগাতো। আবার হুমকি দিত আমাকে। বলতো, তুই আমার আব্বুর কাছে আমাকে খারাপ বানালে তোর আম্মুকেও আমি শান্তি দিবনা। নানাভাবে অশান্তিময় করব তার জীবন। তোর আম্মুর চেয়েও আমার আব্বুর বড় দূর্বলতা আমি। আমার ভালো থাকার জন্যই আব্বু বিয়ে করেছে। মনে রাখিস।

আমি আম্মুকে সব খুলে বললাম। এবং বললাম আমি সেই বাড়িতে আর থাকবনা। অন্য কোথাও থাকব। তখন আম্মু খুব অসহায়বোধ করতে লাগল। আয়রা ফুফুদের বাড়ি ছাড়া আম্মুর কাছে আর কোথাও নিরাপদ মনে হলোনা আমার জন্য। আয়রা ফুফুও প্রথম আপত্তি করল আমাকে রাখতে। পরে রাজী হলো।

আম্মু তার নতুন স্বামীর কাছে সুবিধানুযায়ী কিছু বলে আমার প্রসংগ তুলে রাজী করালো । উনি আর বাধা দিলনা।

শুরু হলো চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমার ফুফুর বাড়িতে জীবন যাপন। এখন আমার বয়স আঠারো চলতেছে। কলেজে পড়ি। প্রথম বর্ষে। আম্মু আর নানারা মিলে আমার পড়াশোনা ও জামাকাপড়ের খরচ বহন করতো। ফুফুদের বাড়িতে থাকা খাওয়া চলতো। তার বিনিময়ে উনাদের ঘরের অনেক কাজ করতাম আর ছোট ফুফাতো বোনকে কোলেপিঠে রাখতাম। অবশ্য এসব আমি মনের আনন্দেই করতাম। মানুষ নিজের সংসারেওতো মাকে ঘরের কাজে হেল্প করে।

কিন্তু সমস্যা হলো আজ এক বছর ধরে নানা স্থান থেকে আমার বিয়ের জন্য প্রস্তাব আসছে। ফুফুর সংসারের কর্তৃত্ব উনার হাতেই। উনার কোথাও পছন্দ হলে আমাকে ফোর্স করতে থাকে। কিন্তু আমি বলছি পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব। ঠিক তখনি মারদোর শুরু করে আর গালিগালাজ শুরু করতো। যা অব্যাহত রয়েছে শেষের এ বিয়ে পর্যন্ত। এখানে ফুফুর অনেক বেশী পছন্দ হয়ে গিয়েছে। উনার মেয়ে বড় থাকলে মেয়েকেও এখানে বিয়ে দিত। এটা উনি নিজ মুখে উনি স্বীকার ও করেছে। আমি রাজী হচ্ছিনা বলে তার আগের রাতে কয়েকবার মেরেছে। ”

একটু পানি খাব। গলা শুকিয়ে গেছে বলেই কাজল থেমে গেল।

এই জরিনা এক গ্লাস পানি এনে দে।

জরিনা বড় এক গ্লাস পানি এনে দিলে কাজল হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা ধরলো। গলা তুলে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিল কাজল। একটু জিরিয়ে নিল।

তোমার কি কোন ছেলেকে পছন্দ আছে বা সম্পর্ক আছে? জিজ্ঞেস করলো রুবানা।

না আন্টি এসবের কিছুই না। বিশ্বাস করুন শুভ্র ভাইয়াকে এর আগে আমি কোনদিন দেখিওনি। নাম ও এখানে এসে জানলাম। বরং আমি নিজেই বিস্মিত। কে উনাকে ফোন দিয়ে বিয়ে ভাঙ্গালো।

জেসমিন বেগম হায় হুতাশের সুরে বললেন,বুঝলাম কাহিনী। কিন্তু তুমি এখন কোথায় যাবে কি করবে ভেবেছ কিছু? ধরো এখানে না হয় তুমি আমাদের অতিথি হয়ে রইলে কিছুদিন। কিন্তু এর বেশীতো আর সম্ভব নয়।

তাতো অবশ্যই আন্টি। দেখি একটা পথ খুঁজে বেরতো করতেই হবে। এই বলে উদাস গলায় সহমত পোষণ করলো কাজল।

উরমি দূত হয়ে তৎক্ষনাৎ শুভ্রকে গিয়ে কাজলের বলা কথাগুলো এ টু জেড় জানাল।

_________
হ্যালো বড় ভাই আপনার কথানুযায়ী কাজতো করেছি। আমি সাকসেস। কাজলের বিয়ে ভাঙ্গাতে পেরেছি।

থ্যাংকস আ লট ছোট ভাই। আমি দেশে আসতে তোর জন্য একটা গিফট নিয়ে আসব অবশ্যই। আচ্ছা তোর কোন সমস্যা হয়নিতো?

একদম না। সব যথাসময়ে ঠিকঠাক ভাবেই হয়েছে।

জেসমিন বেগমের ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে ছেলের কুশলাদি জানলেন। এবং কাজলের বিষয়ে বিস্তারিত জানালেন।
ছেলেও কিছু পরামর্শ দিলেন মাকে কাজলের ব্যপারে।

জেসমিন বেগম উঠে গিয়ে শুভ্রকে বললেন,
হ্যাঁরে বাবা শোন,
অভ্র কল দিয়েছে। ও বলল মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করো ,
ওর বয়স আঠারো হয়ে গেলে আমরা ওর জন্য পাত্র ঠিক করলে ও রাজী হবে কিনা।

শুভ্র তার ভ্রুযুগল ভাঁজ করে বলল,
ওরে বাব্বাহ। আমার ছোট ভাই দেখি আমার চেয়েও মহান। হাজী সলিমুল্লাহ কোথাকার। কয় কোটি ইনকাম করে ফেলছে ও এমন কথা বলে যে। আমাদের এতটা জনদরদী হওয়ার দরকার নেই মা।

ঠিকই বলছিস তুই বাবা। আজাইরা কথা যত্তসব।

শভ্র শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছে,
কাজলের ভাষ্যনুযায়ী এমন কেউই নেই তার বিয়েতে বাগড়া দেওয়ার। তাহলে আমাকে যেই ছেলে ফোন দিল। সে কেন দিল। এটা জানতেই হবে। বিষয়টা মামুলি নয়। সিরিয়াসলি। এখানে বাল্য বিয়েটাকে গৌণ মনে হচ্ছে। মূখ্য নয়। এক কাজ করি সেই ছেলেকে ফোন দিই। উমমম! না আগে কাজলের সাথে পার্সোনালি আমি একটু আলাপ করি। কোন কথাইতো হলনা আমার মেয়েটির সাথে।

চলবে ঃ ৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here