#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৫
২০.
সকালবেলা প্রচন্ড মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুম ভাঙলো নির্ঝরের।সেলাইয়ের জায়গাটা কেমন ব্যথা করছে।দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে চোখ খুলল সে।
মাথা কাত করে সে খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়া তার হাতের উপর মাথা রেখে এলোমেলো ভাবে শুয়ে আছে।তার শাড়ির আঁচল ঠিক নেই। নির্ঝর চোখ সরিয়ে নিল।
এ বাসায় আসার পর প্রথম দিকে খেয়া থ্রি পিস পড়তো।সে নিজেই কিনে দিয়েছিল।মাঝে মধ্যে অফিস থেকে ফিরে দেখতো খেয়া শাড়ি পড়ে বসে আছে।নির্ঝরের ভাবতে ভালো লাগতো যে খেয়া তার জন্যই শাড়ি পড়েছে!
তবে তার সাথে বিয়ের পর বেশিরভাগ সময় সে শাড়ি পড়ে।কদাচিৎ অন্য ড্রেস পড়ে।খেয়াকে শাড়িতে কেমন বউ বউ লাগে।তার বউ!
খেয়ার গায়ের উপর কম্বল টেনে সাবধানে উঠে পড়লো নির্ঝর।মাথা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে।মনে হচ্ছে, একমণি বস্তা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে!
অতি সন্তর্পণে পা ফেলে ওয়াশরুমে গেল সে।
ফ্রেশ হয়ে বের মুখ মুছতে মুছতে বের হলো।বেডের দিকে চোখ পড়তেই তার মাথা ব্যথার যন্ত্রণা ভুলে হাসি ফুটে উঠলো।খেয়া ল্যাং মেরে কম্বল নিচে ফেলে দিয়েছে।শুয়ে আছে উল্টোদিকে।
খেয়া যে বাচ্চাদের মতো করে ঘুমায় তা নির্ঝরের অজানা নয়।খেয়া এ বাসায় আসার পর সে প্রায় রাতেই গিয়ে লুকিয়ে একবার করে দেখে আসতো।গায়ে কম্বল টেনে ঠিক করে দিত।পুরোটাই খেয়ার অজান্তে!
নির্ঝর ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় পেছন ঘুরে একবার মাথার ক্ষতটা দেখলো।তার রোমান্সের বারোটা বাজানোর জন্য বিড়বিড় করে টেবিলটাকে গালিও দিল।
পুনরায় বেডে এসে খেয়ার পাশে শুয়ে পড়লো।খেয়ার হাতটা নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে তার দিকে কাত হয়ে তাকিয়ে রইলো।খেয়া একটু নড়েচড়ে আবার ঘুমের অতলে হারিয়ে গেল।
খেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে নির্ঝর তাদের প্রথম সাক্ষাতের দিনটি স্মরণ করলো।
প্রায় তিন বছর আগে এক শীতের সকালে সে খেয়াকে প্রথম দেখে।
সেদিন প্রচুর শীত ছিল।কুয়াশায় রাস্তাঘাট তেমন পরিষ্কার ছিল না। রাস্তার পাশে সে গাড়ি থামিয়ে ফোনে কথা বলছিল।
হঠাৎ করেই তার চোখ যায় অদূরে বেঞ্চে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে।মেয়েটা তার কাছে থেকে একদম কুয়াশাকন্যা মনে হয়।চারপাশে থেকে কুয়াশা যেন তাকে ঘিরে রেখেছে।
নিজের লাগামছাড়া কৌতূহলকে দমন করতে না পেরে সে গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায়।একটু কাছাকাছি হতেই সে বুঝতে পারে মেয়েটা নাক টেনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।
সে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে যায়।পুষ্প?পুষ্প এখানে কি করছে?পরমুহূর্তে একটু গভীর দৃষ্টি দিতেই বুঝতে পারে মেয়েটা শুধু পুষ্পর মতো দেখতে।পুষ্পর মুখে কোনো সারল্যতা ছিল না।সে কঠিন ছিল।সে কখনো কান্না করতো না।
কিন্তু এই মেয়েটার সারামুখে এক ধরনের সারল্যতা,বাচ্চামো ফুটে উঠেছে।কেমন মায়া কাড়া কান্নার ভঙ্গি।নির্ঝরের বুকের ভেতর ঝড় বইতে থাকে।অন্য রকম অনুভূতির জন্ম হয় যা এর আগে কখনো হয়নি।এমনকি পুষ্পকে দেখেও নয়।
সে মেয়েটার পাশে কয়েক হাত দূরে বেঞ্চে বসে পড়ে।তার বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।কাঁপুনি একটু কমতেই সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,
__’আপনি কি কোনো কারণে আপসেট?’
মেয়েটা উত্তর দেয় না।একপলক তার দিকে চেয়ে আবারও কান্নায় মনোযোগ দেয়।
__’আপনি কি হারিয়ে গেছেন?ঢাকাতে নতুন?আমি কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
মেয়েটা এবারো কোনো উত্তর দেয় না।নির্ঝরের এবার বেশ রাগ হয়।আজব তো!কথা কেন বলছে না?এভাবে রাস্তায় কেউ কান্না করে?
সে একটু রেগে বলে উঠলো,
__’এই শর্টি, কথা বলছো না কেন?প্রশ্ন করছি কানে যাচ্ছে না?তুলে এক আছাড় দিবো!নাম কি?’
মেয়েটা একটু চমকে উঠলো তার কথায়। পরক্ষনে অবাক হয়ে বলল,
__’আপনি আমার উপর চিল্লাচ্ছেন কেন?’
__’কথা বলতে পারো না?কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছো না কেন?’
__’আপনার প্রশ্নের উত্তর দিবো কেন?’
__’আমি প্রশ্ন করেছি তাই!’
__’কি?আপনাকে চিনি আমি?’
__’নাহ।তবে আজ থেকে চিনবে!আমি নির্ঝর,নির্ঝর জুবায়ের।তোমার নাম কি শর্টি?’
__’আমার নাম আপনাকে বলবো কেন?আর আমাকে শর্টি শর্টি করছেন কেন?’
__’তুমি আমান চেয়ে অনেক শর্ট তাই!’
__’খবরদার আমাকে ওসব বলবেন না।আমি কিন্তু লোক জড়ো করবো।’
নির্ঝর রাগ কমানোর জন্য আশপাশে তাকাল।ফের খেয়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো খেয়ার সারা শরীরে কেমন শিশির জমেছে।মাথার চুলে ফোটা ফোটা শিশির বিন্দু।
সে মনে মনে খেয়াকে শিশিরকন্যা নাম দিল!
নিজেকে সামলে বলল,
__’কিছু কথা আছে যেগুলো পরিচিত দের কখনো বলা যায় না।কিন্তু অপরিচিতদের অকপটে বলা যায়।তোমার যদি এমন কোনো কথা থাকে তাহলে আমাকে বলতে পারো।আমি বেস্ট শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করবো।এতে করে তোমার কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।এই দেখো,আমাদের মন খারাপ হলেই আমরা চাই কেউ একজন পাশে এসে বসুক,কাঁধে হাত রাখুক।কেউ একজন হাতটা ধরে বলুক “কি হয়েছে? আমায় বলো!”
জানি তাকে বললে সে সান্ত্বনা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না।তবুও মনের প্রশান্তির জন্য, মনটাকে হালকা করার জন্য কাউকে বলা প্রয়োজন।তুমি কান্না থামিয়ে আমায় কিছু বলতে পারো।’
__’আমার নাম খেয়া!’
নির্ঝর হাসিমুখে তার দিকে তাকায়।খেয়া!খেয়াতরী!সে মনে মনে নামটা কয়েক বার আওড়ায়!
কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
__’তারপর?নামের আগে পড়ে কিছু নেই? ‘
খেয়া বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
__’না নেই!ছোটবেলা অতবড় নাম লিখতে পারবো না বলে মাদ্রাসায় শুধু খেয়া নাম দিয়েছিল।পরে আর পরিবর্তন করা হয়নি।’
__’নাম কে রেখেছে?’
খেয়া উত্তর দেয় না।
এভাবেই তার খেয়ার সাথে পরিচয়।এরপর মাঝে মাঝে ভাগ্যের ফেরে দেখা হতো।যত কৌতূহল জন্মে তত একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করতে থাকে।একে অপরকে জানতে থাকে।নিজের অরুভূতি গোপন রেখে একটা সময় তারা বন্ধুমানুষ হয়ে যায়।
একটা সময় মেয়েটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়।সে নানান অজুহাতে তার সাথে দেখা করতে থাকে!
খেয়া ডান হাতটা নির্ঝরের গায়ের উপর দিতেই তার ভাবনার রেশ কাটলো!
২১.
দুপুর বেলা নুহার স্কুলের সামনে গাড়ি থেকে নামলো খেয়া।আজ নুহা স্কুলে আসার সময় বায়না ধরেছে সে যেন নিতে আসে।
অগত্যা নির্ঝরকে দুপুরের মেডিসিন খাইয়ে, তাকে ঘুমাতে বলে সে এসেছে।
খেয়া ধীর পায়ে হেঁটে স্কুলের ভেতর প্রবেশ করলো।গেটের উত্তর দিকে গার্ডিয়ানের বসার জায়গায় গিয়ে বসলো।
নুহাকে নিতে যখনই আসে সেই এই জায়গাটাতেই বসে!আশপাশে প্রচুর গার্ডিয়ান এসে জড়ো হয়েছে।তার পাশে বসা নুহার ক্লাসমেট ছিনহার মাকে দেখে সে কুশল বিনিময় করলো।এর আগেও তাদের কথা হয়েছে।
প্রথম যেদিন ছিনহার মা তাকে আর নির্ঝরকে একসাথে দেখে সেদিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,
__’আপনারাই তো পিচ্চি মানুষ।আপনাদের আবার এতবড় মেয়ে আছে? বিশ্বাস হতে চায় না।নিশ্চয়ই বাল্যবিবাহ ছিল।’
খেয়া সেদিন হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়েছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যে স্কুল ছুটির ঘন্টা পড়লো।খেয়া যতবার এই ছুটির ঘন্টা শোনে ততবার কেমন নস্টালজিক হয়ে যায়!
তার ভাবনার মাঝে নুহা ছুটে এসে তার কোলে বসলো।খেয়া তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
__’আজকের ক্লাস কেমন লেগেছে?’
নুহা হাসিমুখে বলল,
__’ভালো মা!বাবাই কেমন আছে? ‘
__’একটু সুস্থ!বাবাই, তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।চলো!’
একটু থেমে খেয়া বলে,
__’নুহা,স্কুলে কিন্তু কারো সাথে মারামারি করবে না।কেউ মারলে আমাকে বলবে বা টিচারকে বলবে।’
নুহা মুখ ফুলিয়ে বলল,
__’মা,আমার ক্লাসের পাজি ছেলে দিশান আছে না?ক্লাসে ও আমাকে টিকটিকি বলে ক্ষেপায়।আমি নাকি টিকটিকির মতো চিকন।তুমি বলো মা,আমি কি টিকটিকির মতো দেখতে?’
নুহার মুখ ফোলানো দেখে খেয়ার হাসি পায়।ছোটবেলায় কেউ কিছু বললে সেও এভাবে মুখ ফুলিয়ে থাকতো।এটা অবশ্য সত্যি যে নুহা যত বড় হচ্ছে তত চিকন হয়ে যাচ্ছে।সে ভেবে রাখলো নির্ঝর সুস্থ হলেই নুহাকে ডাক্তার দেখাবে।
নিজেকে সামলে সে বলে,
__’মোটেই না মা!তুমি তো কি সুন্দর।কি বিউটিফুল আমার মেয়েটা!আমি দিশানকে বকে দিবো।চলো, আজ বাসায় যাই।’
নুহার হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে গেটের কাছে পৌঁছাতেই পেছন থেকে এক পিচ্চি কন্ঠ ভেসে আসে।সে খিলখিল করে হাসছে আর বার বার বলছে,
__’এই টিকটিকি!টিকটিকি?’
নুহা বেশ রেগে যায়।খেয়া দাঁড়িয়ে পড়ে।নুহা এর আগেও বেশ কয়েকবার তাকে দিশানের দুষ্টুমির কথা বলেছে।আজ তার গার্ডিয়ানকে বলা প্রয়োজন।
সে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে হাস্যোজ্জ্বল এক বাচ্চাকে আবিষ্কার করে যে কিনা নির্ঝরের সমবয়সী এক ছেলের হাত ধরে আছে।
খেয়া কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
__’শুনছেন? আপনি কি দিশানের বাবা?’
ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়ে ছিল।আশপাশে কিছু একটা খুঁজছে।খেয়ার দিকে না তাকিয়েই বলল,
__’আমাকে কি অত বুড়ো মনে হয়?এতবড় একটা ছেলের বাপ আমি?’
খেয়া বলল,
__’আপনি যেই হন,আপনার বাচ্চাকে বারণ করে দিবেন আমার মেয়েকে যেন না জ্বালায়।উল্টোপাল্টা নামে যেন না ডাকে।’
ছেলেটা অন্য দিকে তাকিয়েই বলল,
__’বললাম তো আমি ওর বাপ না।বাচ্চা আসবে কোথেকে?আমি ওর কাকু।’
দিশান হঠাৎ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,
__’মিথ্যে কেন বলছো বাবা?তুমিই তো আমার বাপ!আন্টি ইনিই আমার বাবা।ইনিই আমাকে বলেছে চিকন মেয়েদের টিকটিকি বলে ডাকতে হয়।’
ছেলেটা এবার বিরক্ত হয়ে দিশানের দিকে তাকায়।।দিশানের হাত চেপে বলল,
__’সবসময় দুষ্টুমি না?এক চড়ে দাঁত ফেলে দিবো বেয়াদব?কে তোর বাবা?’
খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
__’স্যরি, আসলে এত দু……….’
পরমুহূর্তে খেয়ার দিকে ভালো করে চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে বলল,
__’পুষ্প তুমি?’
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৬
__’পুষ্প তুমি?’
খেয়া চমকায়!এই ছেলেটা আবার কে?পুষ্পর পরিচিত কেউ?
ছেলেটা নিজে থেকে একরাশ অবাকত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে,
__’কি হলো কথা বলছো না যে?তুমি বেঁচে আছো?এটা কিভাবে সম্ভব?নির্ঝর আমাকে এতবড় মিথ্যে কথা কেন বলবে?’
খেয়া উত্তর দেয় না।কি বলবে সে?
সে দ্রুতপায়ে পেছন ঘুরে হেঁটে আসতে নিতেই ছেলেটা পেছন থেকে বলে,
__চলে যাচ্ছো যে?আমায় চিনতে পারছো না?আমি রাহাত!’
খেয়া পেছন ঘুরে তাকায় না।তাকানোর যথোপযুক্ত কোনো কারণও নেই।কারন এ জীবনে সে রাহাত নামের কাউকে চিনে না!
যত দ্রুত সম্ভব নুহার হাত ধরে হেঁটে গাড়িতে উঠে।পেছনের সিটে বসে বড় করে শ্বাস নেয়।ড্রাইভার গাড়ি ছাড়ার আগে সে জানালার কাচ দিয়ে আরেক বার তাকায়।
রাহাত নামের ছেলেটা দিশানের হাত ধরে চিন্তিত মুখে গেটের বাইরে বের হয়েছে!সে চোখ সরিয়ে নেয়!
গাড়ি চলছে আপনমনে।অন্যান্য দিন খেয়া সারা পথ নুহার সাথে প্রচুর কথা বলে।কিন্তু আজ সে বড্ড চুপচাপ।আজ কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
মনের গহীনে তলিয়ে দেখলো যে সেখানে চিন্তার বীজ রোপন হয়েছে।সে সত্যিই চিন্তিত!রাহাত নামের ছেলেটা নতুন ঝড় নিয়ে আসবে না তো তার জীবনে?
__’মা,দিশানের কাকু তোমায় পুষ্প বললো কেন?’
নুহার প্রশ্নে খেয়া চমকে তার দিকে তাকাল।নুহা অধীর আগ্রহে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে উত্তরের আশা করছে।কি উত্তর দেবে তাকে?
সে অপ্রস্তুত হেসে বলল,
__’তুমি দিশানের কাকুকে চিনো?’
__’হুঁ!চিনি তো।বাবাই এর আগে একবার তার সাথে কথা বলেছে।’
খেয়া ভাবে নির্ঝর রাহাত নামের ছেলেটাকে চিনে কিভাবে?তবে কি রাহাতের সাথে পুষ্পর কোনো সম্পর্ক ছিল?কি সম্পর্ক ছিল পুষ্পর সাথে তার?
__’নুহা!তুমি দিশানের কাকুকে কি বলে ডাকো?’
__’কেন?আঙ্কেল বলে ডাকতে বলেছে বাবাই।কিন্তু তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।আজ তো আমার দিকে তাকায়নি!’
__’অহ।এখন তুমি আমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো।কেমন?’
নুহা মুখ ফুলিয়ে বলে,
__’আগে তুমি বলো,দিশানের কাকু তোমায় পুষ্প কেন বললো?’
নুহার জিদ সম্পর্কে খেয়া অবগত।সে এর উত্তর না শুনে কিছুতেই ছাড়বে না।সে হাসার চেষ্টা করলো।
হেসেই বলল,
__’উনি মনে হয় আমাকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলেছে।ওনার পরিচিত কারো চেহারা হয়তো ঠিক আমার মতো!বাদ দাও তো!ঘুমাও।’
খেয়া জোর করে নুহার মাথা তার মাথা তার কোলে রাখে।নুহা মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে।
সে নুহার দিকে তাকায়।নুহার চেহারা ভারী মিষ্টি।দেখলেই বোঝা যায় নুহার মা-বাবা অনেক বেশি সুন্দর ছিল।
খেয়া নির্ঝরের বাসায় পা রাখার পরপরই কেন জানি মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলে।তার ছোটবেলা থেকে বাচ্চা-কাচ্চা অনেক প্রিয় ছিল।ইয়াতিম খানার ছোট বাচ্চাদের সে অনেক আদর করতো!
নুহাকে পেয়েই সে জাহিদের কষ্টটা ভুলতে পারে সহজে।প্রথম দিন নির্ঝরের বাসায় আসার পর সে ভেবে রেখেছিল পরের দিন মহিলা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করবে।কিন্তু সে পারেনি!
কিছুদিন যেতেই সে একপ্রকার নুহার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ে।রোজ রাতে নুহাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমানো যেন তার অভ্যাস হয়ে যায়।পিচ্চিটাকে ভীষণ আপন মনে হয়।অনেক ভালো বাসে তাকে!নুহাকে সে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেবে না।
খেয়ার চোখ ভরে উঠে। গভীর মমতায় নুহার মাথায় হাত বুলায়!
২২.
রাতের বেলা ডাইনিং এ খেতে বসে খেয়া উসখুস করে।বার বার নির্ঝরকে রাহাতের কথা বলতে নিয়েও পারে না।আবারও বাঁধা পড়ে।
আজ দুদিন হলো সে নির্ঝরকে রাহাতের কথা জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে।কিন্তু করতে পারেনি।
নির্ঝরের অসুস্থতার মাঝে তাকে নতুন করে টেনশনে ফেলতে চাচ্ছে না সে।সে ঠিক করে রেখেছে নির্ঝর আর একটু সুস্থ হলেই জিজ্ঞেস করবে।
আজ তিনদিন পর নির্ঝর নিচে নেমেছে।নিজে থেকেই ডাইনিং এ খাওয়ার বায়না ধরেছে।খেয়া না করেনি।
খেয়া নুহাকে শেষ লোকমা দিয়ে নিজে খাওয়ার জন্য প্লেটে খাবার নেয়।নুহার খাওয়া শেষ হতেই সে এক দৌঁড়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় গিয়ে বসে।টিভিতে তার কার্টুন দেখার সময় হয়ে গেছে!
খাওয়ার মাঝে নির্ঝর জমিলা খালার দিকে চেয়ে বলল,
__’খালা,কিছু বলবেন?’
জমিলা চমকে উঠে।তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।ছোটবেলা থেকেই সামান্য অবাক হলে তার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়।
সে আমতা আমতা করে বলে,
__’গ্রামের বাড়িতে আমার বড় একটা মাইয়া আছে।ওর থাকনের কোনো জায়গা নাই।এতদিন মামুর বাড়ি থাকতো।তারা আর রাখবো না।বলতেছিলাম কি,যদি তোমরা রাজি থাকো তয় ওরে এইহানে লই আসি।হারাডা দিন টুকটাক কাজ করবো আর রাতের বেলা আমার কাছে থাকবো।’
বলে জমিলা ভয়ে ভয়ে তাকায়।নির্ঝর কিছু বলার আগেই খেয়া ঝটপট বলে,
__’খালা তুমি কালকেই ওকে এখানে নিয়ে আসো।কোনো চিন্তা নেই।’
পরমুহূর্তে নির্ঝরের কথা মনে পড়ায় সে নির্ঝরের দিকে তাকায়।এটা তো নির্ঝরের বাড়ি।সে সিদ্ধান্ত নিচ্ছের কেন?
খেয়ার অপরাধীর মতো ফেস দেখে নির্ঝরের হাসি পায়।সে মুচকি হেসে বলে,
__’খালা,আপনাকে আগেই বলেছি,আপনার মেয়েকে নিয়ে আসুন।কোনো সমস্যা নেই।খেয়া ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবে।’
খেয়া সাহস পেয়ে বলল,
__’খালা, আপনার মেয়ে কোন ক্লাসে পড়ে?’
__’অত সতো বুঝি না।কলেজে উঠবো মনে হয়।’
__’নাম কি ওর?’
__’মিতু।’
__’বাহ!কি মিষ্টি নাম।’
নুহাকে ঘুম পাড়িয়ে খেয়া নির্ঝরের দিকে তাকালো।নির্ঝর রুম দিয়ে পায়চারি করছে।হেঁটে এ মাথা থেকে ও মাথা যাচ্ছে।রাতের বেলা সেই ডিনার শেষ হতে না হতেই সে এমন শুরু করেছে।
খেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
__’এভাবে হাঁটাহাঁটি করছেন কেন?কয় বার বারণ করবো?’
নির্ঝর হাঁটা থামিয়ে সোফায় বসলো।সত্যি সত্যি ক্লান্ত হয়ে গেছে সে।
সামান্য হেসে বলল,
__’হাঁটাহাঁটি বাদ দিলাম।এখন বসে আছি। খুশি?’
__’না,খুশি না।এবার শুয়ে পড়ুন।অনেক রাত হয়েছে।ডাক্তার রাত জাগতে,হাঁটাহাঁটি, নড়াচড়া করতে বারণ করেছেন।’
__সো হোয়াট?ডাক্তারদের কাজই হচ্ছে এক গাদা কাজে বাধ সাধা।ওসব মানলে মানবজীবন চলবে কিভাবে?’
খেয়া কপাল কুঁচকে বলল,
__’আপনি এবার শুয়ে পড়বেন কি না সেটা বলুন।শেষ বারের মতো বলছি।’
খেয়ার অধিকারবোধ নির্ঝরের প্রচুর ভালো লাগলো।সে কিছু পিঞ্চ কথা বলতে নিয়েও বললো না।
মুচকি হেসে বলল,
__’যদি একটা গান শোনাও তাহলে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।’
খেয়া অবাক হয়ে বলল,
__’আমি গান পারি?আপনি বললেই হলো?’
__’যেমন খুশি তেমন সাজো এর মতো যেমন পারো তেমন গাও।’
__’পারবো না আমি।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।ইচ্ছে হলে শুয়ে পড়বেন।’
খেয়া সত্যি সত্যি শুয়ে পড়লো।গায়ে গলা পর্যন্ত চাদর টেনে নুহার দিকে ঘুরে চোখ বন্ধ করলো।
নির্ঝর কিছুক্ষণ সোফাতে বোকার মতো বসে রইলো।অতঃপর ক্ষীপ্রপায়ে এসে নুহার বাম পাশে কোল বালিশ রাখলো।নিজে খেয়ার পাশে শুয়ে ডান হাতটা খেয়ার গায়ের উপর রাখলো।
খেয়া চমকে একটু ঘোরার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।নির্ঝর পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।
সে নির্ঝরের হাত সরানোর চেষ্টা চালিয়ে বলল,
__’কি করছেন?নুহার পাশে গিয়ে ঘুমান।’
নির্ঝর ঘুমাতুর কন্ঠে বলল,
__’নুহা ঘুমের ঘোড়ে মাথায় ব্যথা দিয়ে ফেলতে পারে।তখন আবার হসপিটালে যেতে হবে।আর হসপিটালে ফিনাইলের গন্ধ।ঘুমাও তো!’
খেয়া আর কিছু বলল না।সে চোখ বন্ধ করে নির্ঝরের স্পর্শটুকু অনুভব করার চেষ্টা করলো।
নির্ঝর বিড়বিড় করে বলল,
__’শুভরাত্রি খেয়াতরী!’
(চলবে)