জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ১৩+১৪

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৩

নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়ার হাতটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।একটুপর ধরা গলায় বললো,

__’আই লাভ ইউ খেয়াতরী।’

খেয়া চোখ তুলে নির্ঝরের দিকে তাকাল।তার বুকের ভেতর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করছে।অনেকটা স্রোতের মতো।তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে অন্য ভুবনে।যেখানে সে নতুন করে স্বপ্ন দেখবে।তার প্রতিটা স্বপ্নে শুধু নির্ঝর নামক মানুষটার আনাগোনা থাকবে।

তাদের ছোট্ট একটা সংসার হবে।জোড়া শালিকের মতো।একে অপরের মুখে খাবার তুলে দেবে।সংকটাপন্ন মুহূর্তে পাশে থাকবে একে অন্যের।

খেয়া গভীর আগ্রহে নির্ঝরের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই নির্ঝরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসলো।আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

সে নিজের হাতটা নির্ঝরের থেকে ছাড়িয়ে তার গায়ে চাদর টেনে দিল।হাতের স্যালাইন অর্ধেকের বেশি শেষ হয়ে গেছে।

মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করলো।ফোন রিসিভ করলো জমিলা খালা।

__’খালা,নুহা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

__’হ মা!চিন্তা কইরো না।ও আমারে অনেক পছন্দ করে।ছোডোবেলা থেইকা হাতে হাতে বড় করছি তো তাই।’

খেয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

__’খালা,কিছু খাইয়ে ঘুমিয়েছে তো?’

__’হ, খাইছে।বাবাজীর শরীল কেমন?’

__’জ্ঞান ফিরেছে।একটু সুস্থ এখন।আমরা আজ রাতে ফিরবো না।কাল সকালে রিলিজ নিয়ে ফিরবো।

__’ড্রাইভাররে দিয়া তোমাগো রাতের খাবার পাঠায় দিচ্ছি।সময় মতো খাইয়ো দুইজনে।’

__’ঠিক আছে খালা।এক বাটি স্যুপ পাঠিয়ে দিয়ো সাথে।ঘুমাও তোমরা। রাখলাম।’

খেয়া কল কেটে দিল।মোবাইলে সময় এখন রাত এগারোটা।সে হসপিটালের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।

|১৮|

গভীর রাতে পানির তৃষ্ণায় ঘুম ভাঙলো নির্ঝরের।চোখ খুলে প্রথমেই খেয়াকে খুঁজলো।খেয়া টুল টেনে বসে বেডে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো হাতে স্যালাইনের সুঁচ লাগানো নেই।সে অর্ধেকের মতো স্যালাইন দেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল।স্যালাইনটা যেহেতু শেষ,তার মানে রাত মোটামুটি বেশ হয়েছে।

দুহাতে ভর দিয়ে সে উঠে বসলো।মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে।সাথে গা টা ম্যাজ ম্যাজ করছে।জ্বর টর আসবে নাকি?তার জ্বর আসার আগে শরীর এমন ম্যাজ ম্যাজ করে।

খেয়া এলোমেলো চুলে, অবিন্যস্তভাবে শুয়ে আছে।নির্ঝরের বুকের ভেতর কষ্ট অনুভব করলো।খেয়াকে এ অবস্থায় দেখে তার খারাপ লাগছে।রাতের বেলা বাসায় চলে গেলেই খেয়া ঠিকঠাক মতো ঘুমাতে পারতো।ধুর!

নিজেই নিজেকে গালি দিতে দিতে গায়ের চাদরটা খেয়ার শরীরে জড়িয়ে দিল।মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো বাম হাতে কানে গুঁজে দিল।

তারপর সারা রুমে ঘড়ি খুঁজলো।চোখে পড়লে না।হসপিটালে ঘড়ি থাকার কথা।এ রুমে নেই কেন?

বেড থেকে বেশ দূরে টেবিল। টেবিলের উপর প্লাস্টিকের জগে পানি রাখা।সাদা প্লাস্টিকের বাহির দিয়েই চকচকে পানি চোখে পড়ছে।নির্ঝরের তৃষ্ণা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

সমস্যা হলো এখন পানি পান করতে হলে তাকে হেঁটে টেবিল অবধি যেতে হবে।খেয়ার ঘুম যাতে না ভাঙে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

সে প্রায় শব্দহীন ভাবে বেড থেকে নেমে ফ্লোরে পা রাখতেই খেয়া ঝট করে মাথা তুলে তাকাল।দ্রুত নির্ঝরকে দুহাতে ধরে একদম পরিষ্কার স্বরে বলল,

__’আপনি বিছানা থেকে নামছেন কেন?’

নির্ঝর হকচকিয়ে গেল।সে চাচ্ছিল খেয়ার ঘুম নষ্ট না করতে।অথচ, সেটাই হলো।

সে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

__’তোমার কি ESP মানে Extra Sensory Perception বা সুপারন্যাচারাল পাওয়ার টাওয়ার আছে?এমন নিঃশব্দে উঠলাম তারপরও ঠিকই টের পেলে।’

__’আপনি কি ভেবেছিলেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি?’

__’ভাবাভাবির কি আছে!তুমি তো ঘুমিয়েই পড়েছিলে!তোমার চোখের সামনে আমি বেশ কয়েকবার হাত নাড়াচাড়া করে দেখেছি তুমি গভীর ঘুমে।’

খেয়া হাসলো।নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো তার দিকে।কি অমায়িক হাসি!

খেয়া নির্ঝরকে পুনরায় বেডে শুইয়ে বলল,

__’আমার চোখ জাস্ট একটু লেগে এসেছিল।সেজন্য বন্ধ করেছিলাম।কিন্তু মস্তিষ্ক একদম সচল ছিল।কিছু লাগবে আপনার?পানি খাবেন?’

__’হুঁ।’

খেয়া গ্লাসে পানি ঢেলে নির্ঝরের হাতে ধরিয়ে দিল।নির্ঝর এক চুমুক খেয়েই মুখটা বিকৃত করলো।বলল,

__’পানি কেমন জানি লাগছে।মানে স্বাদ পাচ্ছি না।’

__’ডাক্তার ডাকবো?’

__’এত রাতে ডাক্তার ডেকে কি হবে?তাছাড়া সব ডাক্তার এখন রেস্ট নিচ্ছে।ইমার্জেন্সি না হলে আসবে না।ডাকলে হয়তো বড়জোর নার্স পাওয়া যাবে।’

__’তাহলে কি কোনো নার্সকে ডাকবো?’

__’নার্স দিয়ে আমি কি করবো?আমার সেবা শুশ্রূষা করার জন্য আমার ওয়ান এন্ড অনলি বউ আছে।’

নির্ঝরের মুখে বউ ডাক শুনে খেয়া লজ্জিত মুখে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।

নির্ঝর ডান হাত বাড়িয়ে বলল,

__’হাত ধরো খেয়াতরী।’

খেয়াতরী!খেয়া মনে মনে দুবার উচ্চারণ করলো।কি সুন্দর নাম!নাকি নির্ঝর বলেছে বলে তার কাছে সুন্দর লাগছে?কোনটা?

__’কি হলো?হাত ধরতে বলেছি!’

__’ক-কেন?হাত ধরবো কেন হঠাৎ?’

__’গাধী,আমি ওয়াশরুমে যাবো।তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না আমি আরেক বার কোথাও পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাই।’

খেয়া ইতস্তত করে নির্ঝরের হাত ধরলো।নির্ঝর তাকে এক হাতে প্রায় জড়িয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল।খেয়ার আড়ালে সে মুচকি হাসলো।

সে যথেষ্ট সুস্থ এখন।তবুও কেন জানি খেয়াকে জ্বালাতে ভালো লাগছে।খেয়ার ছোট্ট ছোট্ট স্পর্শ গুলো পেতে মন চাইছে।সে নানান বাহানায় খেয়াকে কাছাকাছি চায়!

__’তুমিও ওয়াশরুমে ঢুকো।আমি একা বোধ হয় পারবো না।’

খেয়া বিস্ফারিত নয়নে বলল,

__’কি?’

__’হা হা।মজা করছিলাম।যাও!আমি একাই পারবো।’

নির্ঝর ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো।খেয়া সরে এসে বেডে পা তুলে বসলো।তার শীত শীত লাগছে।

মিনিট দশেক পর নির্ঝর বের হলো।দরজা খুলেই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।খেয়া তার দিকে কেমন জানি করে যেন তাকাল।তারপর এগিয়ে এসে নির্ঝরকে ধরে বেডে শোয়াল।

__’আর কিছু লাগবে আপনার?এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করুন।ডাক্তার রাত জাগতে বারণ করেছেন।’

__’তোমার ডাক্তার আর কি কি বলেছে?মাই গড!আগে বলো তো,এই ডাক্তার ইয়াং নাকি ওল্ডম্যান?’

__’কি সব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন?আপনার মাথা কি সত্যি সত্যি গেছে?’

__’কই যাবে?কতদূর যাবে?মাথা তো ঘুরেফিরে তোমার নামটাই জপ করবে।’

খেয়া কিছু না বলে টুলে বসলো।নির্ঝর নিজের কপালের ব্যান্ডেজকৃত অংশে একটু হাত ছুঁইয়ে বলল,

__’খেয়া আমার জ্বর আসছে মে বি।তোমার হাতটা দাও তো।একটু চেক করো।’

__’আমার হাতকে কি থার্মোমিটার মনে হয়?’

__’এর আগে তো থার্মোমিটার হিসেবে ব্যবহার করেছিলে।তাহলে আজ দোষ কোথায়?আচ্ছা যাও,আমি চোখ বন্ধ করছি।’

নির্ঝর চোখ বন্ধ করলো।খেয়া হাত বাড়িয়ে কপালের ব্যান্ডেজ স্পর্শ করলো।সম্পূর্ণ কপালই ব্যান্ডেজ করা।

নির্ঝর খপ করে খেয়ার হাত ধরে নিজের গলা স্পর্শ করাল।বলল,

__’পুরো কপালই তো ব্যান্ডেজ করা।বুঝবে কিভাবে যে গায়ের তাপমাত্রা বেড়েছে কি না?’

নির্ঝরের স্পর্শে খেয়া কেঁপে উঠলো।দ্রুত হাত সরিয়ে বলল,

__’জ-জ্বর নেই তো।’

__’জ্বর আছে।তুমি বুঝতে পারছো না।ভেতরে ভেতরে জ্বর বইছে।আমার চাদরে শীত যাচ্ছে না।তোমায় জড়িয়ে ঘুমাতে হবে।’

খেয়া ছিটকে একটু পেছনে সরে গেল।তোতলানো স্বরে বলল,

__’কি-কি বলছেন?এটা হসপিটাল, ভুলে গেছেন?’

নির্ঝর দুহাতের তালু ঘষে একটু তাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাল।পরক্ষণে দুহাতে গরম ফু দিয়ে বলল,

__’একদম ভুলিনি।আমি এই মুহূর্তে তোমায় জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই।হসপিটালে তোমার যদি সমস্যা হয় তাহলে এক্ষুনি বাসায় যাবো।’

__’এখন কয়টা বাজে আপনার ধারণা আছে?’

__’নাহ,নেই।বলো কয়টা বাজে?যতটাই বাজুক, আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরবো মানে ধরবো।শুধু ধরবো না সাথে নিয়ে ঘুমাবো।’

__’ছি!এখন রাত তিনটের বেশি বাজে।আপনি ঘুমান তো।আমি আপনার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছি।’

__’তুমি বুঝতে কেন পারছো না আমার জ্বর এসেছে।প্রচন্ড শীত লাগছে।’

__’ব্যথা থেকে জ্বর আসবে।ডাক্তার বলেছে।আপনি কিছু খেয়ে মেডিসিন খান।’

__’কিছু খাব না,মেডিসিনও খাবো না।’

__’একদম পাগলামি করবেন না।চোখ বন্ধ করুন।’

নির্ঝর এক লাফে বেড থেকে উঠে খেয়াকে এক টানে বেডে বসাল। পেছন থেকে জড়িয়ে তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিল।খেয়া চমকে উঠলেও নির্ঝরের শরীরের উত্তাপ টের পেল।সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।এখন উপায়?
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৪

নির্ঝর এক লাফে বেড থেকে উঠে খেয়াকে এক টানে বেডে বসালো।পেছন থেকে জড়িয়ে তার ঘাঁড়ে মুখ গুঁজে দিল।খেয়া চমকে উঠলেও নির্ঝরের শরীরের উত্তাপ টের পেল।সত্যি সত্যি জ্বর এসেছে।এখন উপায়?

খেয়া নির্ঝরের হাতের উপর হাত রেখে বলল,

__’আপনার সত্যি সত্যি জ্বর আসছে।কিছু একটা খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।আমায় ছাড়ুন।’

নির্ঝর উল্টো তাকে শক্ত করে জড়িয়ে বলল,

__’আমি বাসায় যাব।হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

__’আচ্ছা পাগল মানুষ তো আপনি!মানুষ অসুস্থ হলে হসপিটালে যায় নাকি হসপিটাল থেকে উল্টো বাসায় যায়?আমায় ছাড়ুন।আপনার মাথায় পানি ঢালতে হবে।’

__’কিহ?আমায় মেরে ফেলানোর ধান্দা?মাথায় পানি ঢালবে মানে?’

খেয়া জিভ টেনে বলল,

__’স্যরি।মনে ছিল না।কিছু একটা তো করতে হবে।আমায় ছাড়ুন।’

নির্ঝর এবার বাচ্চাদের মতো বলল,

__’কিচ্ছু করবো না আমি।বাসায় না গেলে তোমায় ছাড়বো না।’

__’আগে মেডিসিনটা তো খান।তারপর দেখি কি করা যায়?’

__’বাসায় গিয়ে গরম গরম স্যুপ খেয়ে মেডিসিন খাব।তার আগে নয়!’

খেয়া বিপদে পড়ে গেল।তার গলা ছেড়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।একে নিয়ে এখন কি করবে?হসপিটালের অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাবে এখন?একবার চেষ্টা করবে কি?

__’আপনি শুয়ে পড়ুন।আমি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করছি।দেখি ইমার্জেন্সি কার পাওয়া যায় কি না।কিন্তু বাসায় গিয়ে যদি জ্বর বেড়ে যায় তখন?’

নির্ঝর ছাড়া ছাড়া ভাবে বলল,

__’বাড়বে না।তুমি বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করো।ড্রাইভারকে রাতে এখানে থাকতে বলোনি কেন?’

__’আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন।সেজন্য ভাবলাম কাল সকালে যাব।এখন ছাড়ুন তো!’

খেয়া একপ্রকার জোর করে নির্ঝরকে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিল।চাদর টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে রুমের বাইরে এলো।

নির্ঝরের কেবিনের পাশেরটাতে এক বয়স্ক মহিলা এডমিট হয়েছে।তার পাশে সারাক্ষণ একটা ফর্সামতো নার্স বসে আছে।

নার্সটার অল্প বয়স।দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবেমাত্র পড়ালেখা শেষ করেছে।তবে ধৈর্য্য আছে বোঝা যাচ্ছে।অসুস্থ মহিলাটি একটু পর পর খুকখুক করে কাশছে।কিন্তু তাকে বিন্দুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না।

খেয়া নার্স মেয়েটার উপর কৃতজ্ঞতা অনুভব করলো।

সে দরজার উপর মৃদু শব্দ করে নার্সটার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।নার্সটার চোখে চোখ পড়তেই সে ইশারায় বাইরে বের হতে বলল।

বাইরে আসতেই খেয়া তাকে টেনে নির্ঝরের রুমে নিয়ে গেল।নির্ঝর চোখ বন্ধ করে আছে।খেয়া নার্সকে বলল,

__’দেখুন তো!মনে হয় জ্বর এসেছে।’

খেয়ার কন্ঠ কানে যেতেই নির্ঝর চোখ খুলল।তার দু চোখ অতিরিক্ত লাল হয়ে গেছে।নার্স মেয়েটা শরীরের তাপমাত্রা চেকের জন্য হাত বাড়িয়ে নির্ঝরের গাল স্পর্শ করতে নিতেই নির্ঝর ঝট করে মাথা সরিয়ে নিল।

নার্স মেয়েটা বেশ অবাক হয়ে তাকাল।নির্ঝর খেয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,

__’স্যরি!আমায় স্পর্শ করবেন না।অন্য মানুষের স্পর্শ আমার ভালো লাগে না।আমার সেবা করার জন্য বউ আছে।’

নার্স মেয়েটার সাথে সাথে খেয়াও চমকাল।জ্বরের ঘোরে এসব বলছে নাকি?খেয়া নির্ঝরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,

__’কিসব বলছেন?কিসের স্পর্শ?উনি ডাক্তার।’

__’তো?আমি মহিলা ডাক্তার দেখাব না।উনাকে রুমের বাইরে যেতে বলো।আর কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ড্রাইভার এসে যাচ্ছে।সব ফরমালিটিজ পূরণ করে বাসায় যাব।’

নার্সটা হয়তো বেশ অপমানিত বোধ করলো।তাছাড়া এ বয়সী মেয়েদের অভিমান একটু বেশি থাকে।খেয়া তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

__’দুঃখীত।জ্বরের ঘোরে বলছে এসব।কিছু মনে করবেন না।’

নির্ঝর বেশ কড়াভাবে বলল,

__’আমি আপাতত কোনো ঘোর টোরে নেই খেয়া।বেশ সুস্থ মস্তিষ্কে আছি।দেখো,ড্রাইভার এসে গেছে বোধ হয়।একটু আগে আমি ফোন করে তাকে আসতে বলেছি।’

নির্ঝরকে মনে মনে গালি দিতে দিতে খেয়া নার্সকে সাথে নিয়ে বাইরে বের হলো।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তাদের ড্রাইভার লতিফ চাচা এসে দাঁড়াল।

লতিফ চাচার চোখ মুখ ফোলা ফোলা।হয়তো কাঁচা ঘুম ভেঙে ড্রাইভ করে এসেছে। যদিও হসপিটাল বাসা থেকে বেশি দূরে নয়!তবুও এত রাতে মানুষটাকে জ্বালানোর জন্য খেয়ার কষ্ট হলো।

১৯.

খেয়া স্যুপ বানিয়ে নির্ঝরের রুমে গেল।নির্ঝরের গায়ের তাপমাত্রা আগের থেকে বেশ বেড়ে গেছে।একটু আগে মাপা হয়েছে।১০৪ ডিগ্রি প্রায়!

ফজরের আযানের সময় হয়ে গেছে।তার নিজের মাথাটাও কেমন ভার ভার লাগছে।মনে হচ্ছে অসুস্থ হয়ে পড়বে এক্ষুণি।একটু ঘুমাতে হবে।

নির্ঝরের গায়ে দুটো কম্বল পেঁচিয়ে দেয়া হয়েছে।তবুও একটু পর পর কেঁপে উঠছে।খেয়া তার পাশে বসলো।

__’শুনছেন?একটু উঠুন।’

নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়া তার গা থেকে কম্বল সরিয়ে দিল।নির্ঝর লাল লাল চোখ মেলে তাকাল।

সে অতি সাবধানে নির্ঝরকে উঠিয়ে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে বসাল।তারপর চামচে স্যুপ নিয়ে মুখের সামনে ধরলো।নির্ঝর এক চামচ খেয়েই খেয়ার হাত থেকে স্যুপের বাটি নিয়ে বলল,

__’অসুস্থ হয়ে সত্যিই মাথার কোনো ঠিক নেই।তুমি তো সেই ওই রাতে খেয়েছো।আর কিছু খাওয়া হয়নি।কিছু একটা খাও।’

__’খিদে নেই আমার। আপনি খান তো!’

__’তুমি খাবে না?’

__’না বললাম তো।’

__’ঠিক আছে।আমিও খাবো না।’

__’আমি কিন্তু রেগে যাবো এখন।চুপচাপ খান তো।’

__’ঠিক আছে।তুমি খেয়েই রাগ করো।’

খেয়া হতাশ হয়ে নির্ঝরের হাতের বাটি থেকেই কয়েক চামচ খেল।সত্যি সত্যি তার একটু ক্ষুধা লেগেছিল।কিন্তু খাওয়ার মুড ছিল না।চামচটা স্যুপের বাটিতে দিয়ে বলল,

__’এবার খুশি তো?বাকিটুকু তাড়াতাড়ি শেষ করুন।’

নির্ঝর মুচকি হেসে পুরো বাটি ধরে এক চুমুকে সব শেষ করলো।খেয়া ট্যাবলেট খুলে খাইয়ে ওয়াশরুমে গেল।

টাওয়াল ভিজিয়ে এনে নির্ঝরের সামনে ধরে বলল,

__’হাত পা একটু মুছে ফেলুন।ভালো লাগবে।’

__’আমি পারবো না।চাইলে তুমি মুছে দিতে পারো।না হলে বাদ দাও।’

খেয়া মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে নির্ঝরের হাত পা মুছতে লাগলো।নির্ঝর তার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

খেয়া বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,

__’হাসবেন না তো!বিরক্ত লাগছে।’

নির্ঝর হেসেই বলল,

__’তোমাকে বিরক্ত করতে কি যে ভালো লাগছে!

“তুমি বড় অবুঝ,
কেন তুমি হীনা রঙহীন পৃথিবীকে মনে করো সবুজ?”

বলো, লাইন দুটো কেমন?জ্বরের কারণে মাথায় শুধু কবিতার লাইন ঘুরছে।’

খেয়া কিছু বলল না।মুখ দিয়ে বিরক্তি ভাব প্রকাশ করলেও সত্যি বলতে তার নিজেরও ভালো লাগছে নির্ঝরের সেবা করতে পেরে।ইদানীং নির্ঝরের কাছাকাছি থাকলে তারও প্রচুর ভালো লাগে।কিন্তু সে নির্ঝরকে বুঝতে দিতে চায় না।নির্ঝর যদি তাকে বেহায়া ভাবে?

নির্ঝরকে পুনরায় শুইয়ে দিয়ে তার গায়ে ঠিকঠাক কম্বল টেনে দিল খেয়া।ওয়াশরুমে ঢুকে বেশ সময় নিয়ে হাতে মুখে পানি দিল।এখন একটু ফ্রেস লাগছে!

বেলকনি থেকে টাওয়াল নিয়ে হাত মুখ মুছে সে রুমে আসলো।নির্ঝরের দিকে তাকাল।আপাতত তারা রুমে দুজনই আছে।নুহা পাশের রুমে খালার সাথে ঘুমায়।

রুমের লাইট অন রেখেই এগিয়ে এসে বেডে বসলো খেয়া।নির্ঝর কম্বল পেঁচিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে।মাথা৷ আঘাতটা পেছনের ডান সাইডে!

সে একটা বালিশ হাতে উঠে সোফায় গিয়ে বসলো।সোফাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।পরমুহূর্তে কি মনে হয়ে নির্ঝরের ডান পাশে শুয়ে পড়লো।যদি কোনো প্রয়োজন পড়ে?

কয়েক মিনিট এপাশ ওপাশ করে সে নির্ঝরের মুখের এক সাইড থেকে কম্বল সরালো।কিছুক্ষণ আগে মেডিসিন খাওয়ানো হয়েছে।জ্বর কমেছে কিনা চেক করতে চাইলো।

সে সাবধানে নির্ঝরের গালে হাত রাখলো।তাপমাত্রা তো একটুও কমেনি।বরঞ্চ সময়ের সাথে আনুপাতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে যেন!

খেয়া ভীত চোখে তার দিকে তাকাল।সঙ্গে সঙ্গে নির্ঝর চোখ খুলে কাত হয়ে তার দিকে তাকাল।তার রক্তলাল চোখের চাহনি দেখে খেয়া সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ড নিরবে দুজন চেয়ে রইলো একে অপরের দিকে।তারপর ঝট করে নির্ঝর এক ধাক্কায় খেয়াকে নিজের পাশে শুইয়ে তার পেটের উপর হাত রাখলো।

তার গরম নিঃশ্বাস মুখে পড়তেই খেয়া ভীত কন্ঠে বলল,

__’ক-কি করছেন?দূরে যান।সরে যান একটু।’

নির্ঝরের যেন হুশ নেই।সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে খেয়ার কাঁপা কাঁপা ঠোঁটের দিকে।

খেয়া বুঝতে পেরে ভয়ার্ত গলায় বললো,

__’আপনার জ্বর বেড়ে গেছে।আমায় ছাড়ুন।প্লিজ।সরে যান।’

খেয়ার কোন কথাই নির্ঝরের কানে ঢুকলো না।সে মুখটা নিচু করে খেয়ার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।কয়েক সেকেন্ড লাগলো খেয়ার বুঝতে।পরক্ষণেই সে দুহাতে ঢেলে নির্ঝরকে সরিয়ে দিয়ে কেঁদে দিল।

নির্ঝর পুনরায় তাকে জড়িয়ে তার উপর নিজের সম্পূর্ণ ভর ছেড়ে দিল।বিড়বিড় করে বলল,

__’স্যরি!স-স্যরি।’

খেয়া অনেক চেষ্টা করেও নির্ঝরের মৈনাক পর্বতের মতো শরীরটাকে একচুল নিজের থেকে সরাতে পারলো না।সে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো।একটা সময় কান্না থামিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

নির্ঝরের শরীরের সব তাপ যেন তার শরীরে স্থানান্তর হয়েছে।তারও কেমন জানি লাগছে।তারও কি জ্বর আসবে?নাকি অলরেডি এসেছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here