জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ১১+১২

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১১

|১৫|

বিকেল বেলা নুহাকে ঘুম পাড়িয়ে ছাদে উঠল খেয়া।দক্ষিণের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।এখান থেকে বাসায় প্রবেশের গেইট দেখা যায়।নির্ঝরের অফিস থেকে বাসায় আসার সময় হয়ে গেছে।সে বার বার গেইটের দিকে উঁকি দিল।

নির্ঝরের বাসাটি দুতলার।নতুন,ঝকঝকে চুনকাম করা।দেখেই বোঝা যায় কয়েক বছর ধরে তৈরি।

খেয়া আবার গেইটের দিকে নজর দিল।সে প্রায় প্রতিদিনই এই সময়টাতে ছাদে এসে দাঁড়ায়।গেইটের কাছে নির্ঝরের কালো গাড়ির হর্ণ বাজানো দেখলেই সে এক দৌঁড়ে নিচে যায়।মেইন ডোরের ছিটকিনির উপর হাত রেখে অপেক্ষা করে।কিন্তু খোলে না।

যখন নির্ঝর কলিং বেল চাপে তখন মনে মনে ১ থেকে ১২০ পর্যন্ত কাউন্ট করে।এই সময়টাতে সে বেশ এক্সাইটেড থাকে।তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ হয়।হার্টবিটও কেমন অগোছালো হয়ে যায়।

কিন্তু দরজা খুলে সে গম্ভীর হওয়ার ভান করে।নির্ঝরকে কিছুই বুঝতে দেয় না।

আগে সে এই কাজটি করতো না।আজ দিয়ে আটাশ দিন হলো সে এই কাজ করছে।নির্ঝরের সাথে তার বিয়ের সময়সীমা আজ ২৮(আটাশ) দিন।

নির্ঝর অফিস যাওয়ার পর সে রোজ নুহাকে স্কুলে দিয়ে আসে।দুপুরের দিকে নুহা একাই আসে ড্রাইভারের সাথে।মাঝে মাঝে সে নুহার স্কুলে গিয়ে তাকে চমকে দেয়।নুহাকে নিয়ে আশপাশে ঘুরে।নুহা কি যে খুশি হয়!

তবে বিয়ের পর থেকে সে সারাক্ষণ নির্ঝরের কেমন অভাববোধ করে।নির্ঝরের অফিসের সময়টুকু সে প্রতিটা মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকে কখন ফিরবে! কখন ফিরবে!

নির্ঝর বাসায় থাকলে সে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই নির্ঝরের সামনে চলাফেরা করে।কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে তার সাথে কি হয় তা শুধু সে জানে।কেন জানি আশপাশে নির্ঝরের অস্তিত্ব টের পেলেই তার হার্টবিট লাফাতে থাকে।

মাঝে মধ্যে যখন চোখে চোখ পড়ে যায় তখন তো কথাই নেই।তার সারামুখ, কান লাল হয়ে যায়।মনে হয় এক্ষুনি কিছু একটা করে ফেলি।নির্ঝরের থেকে লুকিয়ে বাঁচি।

কিন্তু কেন এমন হয়?তার জানা নেই!

গাড়ির হর্ণের শব্দে বাস্তবে ফেরে খেয়া।কালো রঙের গাড়ি গেইটের সামনে দেখা যাচ্ছে!

সে বাচ্চাদের মতো ভো দৌঁড়ে নিচে নামে।

খেয়া দরজা খুলতেই ক্লান্ত শরীরে ভেতরে ঢুকে নির্ঝর।খেয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন একটা হাসি দেয়।

প্রতিত্তরে খেয়াও মুচকি হাসে।

নির্ঝর নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।খেয়া পেছন থেকে বলে,

__’ডাইনিং এ হালকা জল খাবার দেয়া হয়েছে।ফ্রেশ হয়ে নিচে নামুন।’

নির্ঝর একটু ঘুরে খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’আজ একটু বেশি টায়ার্ড লাগছে।খাব না কিছু।’

নির্ঝরকে দেখে খেয়ার কেমন জানি মনে হয়।সে বলে,

__’আপনি ঠিক আছেন?’

__’ঘুমাব!নুহাকে দেখছি না!’

__’নুহা ঘুমায়।’

__’অহ।’

বলে নির্ঝর উপরের দিকে হাঁটা ধরে।নিজের রুমে ঢুকে বেডের দিকে তাকায়।নুহা নেই।হয়তো খেয়ার রুমে ঘুমিয়েছে।

খেয়ার রুমটা এখনো আগের মতোই গোছালো।দিনের বেলা খেয়া বেশিরভাগ সময় নিজের রুমে থাকে।নুহাও তার রুমে ঘুমায়।শুধু রাতের বেলা নির্ঝরের রুমে সবাই ঘুমায়।

নির্ঝর সোফাতেই বেশি ঘুমায়।নুহা জেগে থাকলে মাঝে মাঝে তাদের পাশে ঘুমাতে হয়।

গায়ের স্যুটটা খুলে বিছানায় গা মেলে দেয় নির্ঝর।জুতা খোলার ভরটুকু ধরে রাখতে পারে না।এলোমেলো ভাবে শুয়ে পড়ে।

দরজার সামনে ট্রে হাতে খেয়া দাঁড়ায়।নক করবে কি না বুঝতে পারছে না।একবার নক না করেই ঢুকে দেখে নির্ঝর শাওয়ার নিয়ে গালি গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।একবার নয়,বেশ কয়েকবার!ব্যাপারটা খুবই লজ্জাজনক!

সে হালকা করে টোকা দেয়।কিন্তু নির্ঝর রেসপন্স করে না।

অগত্যা সে নিজেই উঁকি দিয়ে দেখে নির্ঝর শুয়ে আছে।সে ধীরপায়ে শব্দহীন ভাবে রুমে প্রবেশ করলো।

ট্রে টা সেন্টার টেবিলে রেখে বিছানার দিকে একটু এগিয়ে গেল।ডাকতে নিয়েই বুঝতে পারলো ঘুমিয়ে পড়েছে।ফ্রেশ হওয়া তো দূরের কথা পায়ের জুতো পর্যন্ত খুলেনি।পা দুটো জুতাসহ বিছানার বাইরে ঝুলিয়ে রেখেছে।

কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একটু একটু করে এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরের পায়ের কাছে বসলো সে।হাতটা বাড়িয়ে পরম যত্নে নির্ঝরের পায়ের জুতা খুলে দিল।পা দুটো বিছানায় সোজা করে রাখলো।

নির্ঝর একটু নড়ে আবার চুপ হয়ে গেল।খেয়া উঠে তার গায়ের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দিল।

তার মনে খটকা লাগছে।সে এ বাসায় আসার পর থেকেই দেখছে নির্ঝর অনেক গোছানো এবং পরিষ্কার একজন মানুষ।সে হঠাৎ আজ এমন?
এই অবেলায় ফ্রেশ না হয়েই শুয়ে পড়েছে?অসুস্থ নাকি?

সে নির্ঝরের দিকে একটু ঝুঁকে প্রথম বারের মতো নিজে থেকে তার কপালে ডান হাতটা রাখলো।কাছে থেকে বেশ মনোযোগ দিয়ে নির্ঝরের দিকে চেয়ে রইলো।

নির্ঝর যখন বাসায় থাকে না তখন সে তার চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। শুধু একটা অবয়ব মনে পড়ে।কিন্তু ঠিকই বহুদূর থেকে নির্ঝরের সামান্য অবয়ব দেখেই বুকের ভেতর তোলপাড় সৃষ্টি হয়।নির্ঝর আশপাশে থাকলেই সে আর নিজের মধ্যে থাকে না।

তার মনে হয় সে নির্ঝরকে কোনোদিন কাছে থেকে ভালো করে দেখেইনি।লজ্জায় নির্ঝরের দিকে সে তাকাতে নিতে প্রতিবার চোখ সরিয়ে আনে।আজ সে দেখবে।নির্ঝরকে মন ভরে দেখবে।

খেয়া বেশ সময় নিয়ে নির্ঝরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর চোখ বন্ধ করে চেহারা মনে করার চেষ্টা করলো।কিন্তু স্পষ্ট না।নাক মোটা না সরু,ঠোঁট কেমন,ভ্রু জোড়া লাগানো কি না, কিছুই মনে পড়লো না।

সে কিছুটা বিরক্তি নিয়েই চোখ খুলে।তার ডান হাতটা এখনো নির্ঝরের কপালে রাখা।জ্বর নেই।

সে বাম হাত দিয়ে নির্ঝরের সারামুখে হালকা করে অতি সাবধানে আঁকিবুঁকি করলো।তারপর চোখ বন্ধ করে আবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো।এবার একটু স্পষ্ট।

সে খুশি হয়ে চোখ খুলল।নির্ঝরের কপালের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিতেই নির্ঝর একটানে তাকে বুকের উপর ফেলে জড়িয়ে রইলো।

খেয়া চমকে বড় বড় করে তাকাল।নির্ঝরের দু চোখ এখনো বন্ধ।ঘুমের ঘোরে এসব করছে নাকি?সে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য উসখুস করতে নির্ঝর দুহাতে আরো চেপে ধরলো তাকে।

খেয়া ভয় পেয়ে এবার আমতা আমতা করে বলল,

__’ছাড়ুন।’

নির্ঝর কোনো কথা বলল না।চোখও খুলল না।আরো জোরে চেপে ধরলো।

খেয়া ভয়ার্ত স্বরে বলল,

__’ছাড়ুন।প্লিজ।আমি শ্বাস নিতে পারছি না।’

নির্ঝর চোখ না খুলেই বলল,

__’এতক্ষণ কি করছিলে?’

__’ক-কিছু না।আমি তো মাত্র আপনার রুমে আসলাম।’

__’বেশ।তুমি যতক্ষণ না সত্যি বলছো ততক্ষণ ছাড়ছি না।’

__’ইয়ে মানে জ্বর মাপছিলাম।’

নির্ঝর এবার চোখ খুলে বলল,

__’কত ডিগ্রি দেখলে?’

নির্ঝরের চোখে চোখ পড়তেই খেয়া তোতলানো শুরু করলো।তার সারামুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট।ছি!সে নির্ঝরের এতটা কাছে?একেবারে তার বুকের উপর?

নির্ঝর খেয়ার অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো।তারপর চোখ বন্ধ করে বলল,

__’দেখেছো, আমি কি এমনিতেই চোখ বন্ধ করে আছি?আমি চোখ তুলে তাকালেই তোমার সব গুছিয়ে রাখা কথা গাট্টি বেঁধে পালিয়ে যায়।’

খেয়া নিচু স্বরে বলল,

__’আপনি কখন থেকে জেগে আছেন?নাকি পুরোটা সময় ঘুমানোর ভান ধরে ছিলেন?’

__’ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।কিন্তু ঘুমটা ভারী হওয়ার আগেই তুমি পায়ের জুতা খোলা শুরু করলে।এনিওয়েস,থ্যাঙ্কস!’

খেয়া নিজেকে আরেকবার ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,

__’ছাড়ুন তো এবার।আমি কিন্তু কেঁদে দিবো।’

নির্ঝর বিড়বিড় করে বলল,

“মন নিয়ে এতবেশী করো কেন খেলা?
বুঝতে পারো? কেমন লাগে প্রিয়জনের অবহেলা!’

তারপর এক ঝটকায় তাকে তার পাশে শুইয়ে জড়িয়ে ধরলো।ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

__’আমি অনেক টায়ার্ড আজ।একটু ঘুমাতে চাই।ডোন্ট ডিস্টার্ব মি!প্লিজ!’

খেয়া চুপ হয়ে গেল।নির্ঝরের গরম নিঃশ্বার তার সারা মুখে এসে পড়ছে।তার কেমন জানি লাগছে!

|১৬|

সন্ধ্যার আযানের সময় নির্ঝরের ঘুম ভাঙলো। চোখ খুলে খেয়াকে নিজের এতটা কাছে দেখে চমকে উঠল।একটুপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

ইদানীং খেয়ার ছোট খাটো কেয়ার গুলো তার পৃথিবী এলোমেলো করে দেয়।খেয়ার আরো কাছে যেতে ইচ্ছে করে।এত কাছে যে চাইলেও যেন খেয়া নিজে আর দূরে সরে যেতে না পারে।

সে রোজ অফিস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে।কখন সে বাসায় যাবে।তার কলিজাদের দেখতে পাবে।কলিং বেল চাপার আগে তার বুকের ভেতর ধুকপুক করে।সে জানে দরজা খুললেই সে খেয়ার মুখ দেখতে পাবে।

এই যে রোজ জমিলা খালা থাকা সত্ত্বেও খেয়া নিজে দরজা খুলে দেয় এটাতে যে তার কি ভালো লাগে সেটা খেয়া জানে?

সে উঠে ওয়াশরুমে গেল।

ঘন্টা খানেক সময় নিয়ে শাওয়ার নিল নির্ঝর।তারপর ড্রেস পড়ে বের হয়ে আসলো।

রুমে ঢুকে দেখে বিছানা খালি।খেয়া নেই।রুমেও নেই।সে বেলকনিতে চেক করলো।নাহ!সেখানেও নেই।

হয়তো নিচে গেছে।নির্ঝর টাওয়ালটা বেলকনিতে মেলে দিয়ে রুমে আসলো।

মাথার চুল ঝেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।আয়নার উপর এক নজর তাকাতেই ধাড়াম করে দরজা খোলার শব্দ হলো।সে বেশ অবাক হয়ে পেছন ঘুরে তাকাল।

দরজার সামনে খেয়া দাঁড়িয়ে।সে রীতিমতো হাফাচ্ছে।নির্ঝর চোখের ইশারায় কিছু হয়েছে কি না জিজ্ঞেস করলো।

কিন্তু তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে খেয়া দিল এক দৌঁড়।

এক দৌঁড়ে এসেই এক লাফে নির্ঝরের গলা জড়িয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে ছিল।আচমকা হওয়ায় নির্ঝর টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়লো।টেবিলের কর্ণারে মাথা ঠুকে যেতেই সেই আর্তনাদ করে উঠলো।
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১২

খেয়া দৌঁড়ে এসেই এক লাফে নির্ঝরের গলা জড়িয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিল।আচমকা হওয়ায় নির্ঝর টাল সামলাতে না পেরে ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে যায়।টেবিলের কর্ণারে মাথা ঠুকে যেতেই সে চাপা আর্তনাদ করে উঠে।

বাম হাতে খেয়াকে আগলে ওভাবেই বসে থাকে নির্ঝর।ডান হাতটা পেছনে নিয়ে মাথার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান স্পর্শ করে।সঙ্গে সঙ্গে তার হাত ভিজে যায়।

হাতটা সামনে এনে মেলে ধরতেই টকটকে লাল রক্ত চোখে পড়ে।তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠে।সে দ্রুত দু চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নেয়।

সে দাঁতে দাঁত চেপে ব্যথা সহ্য করে।খেয়াকে জিজ্ঞেস করে,

__’কিছু কি হয়েছে?তুমি ঠিক আছো?’

খেয়ার যেন হুশ নেই।খুশিতে সর্বাঙ্গ ঝলমল করছে।সে একগাল হেসে বলল,

__’আপনি জানেন,আমাদের অনার্স ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েছে?আমি মাত্র আমার রেজাল্ট দেখলাম।আমি পাস করেছি নির্ঝর।সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে পাস করেছি।’

নির্ঝরের ব্যথাতুর মুখে হাসি ফুটে উঠে।সাথে বুকের ভেতর প্রশান্তির ঢেউ বয়ে যায়।আজ প্রথম খেয়া তাকে শুধু নির্ঝর,অনলি নির্ঝর বলে ডেকেছে।

সে কিছু বলতে নেয়।কিন্তু খেয়াকে জড়িয়ে রাখা তার হাতটা বার বার ঢিলে হয়ে আসতে চায়।সে ছাড়ে না।জোর করে আবার শক্ত করে ধরে।খেয়া নিজে থেকে এই প্রথমবার তাকে জড়িয়ে ধরেছে।তার কাছে এসেছে। সে কি করে তাকে দূরে ঢেলে দেবে?

সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

__’তোমার রেজাল্টে আমি অনেক খুশি হয়েছি।তুমি খুশি হয়েছো তো?’

__’ও মা!খুশি হবো না কেন!আমি প্রচুর খুশি হয়েছি।ইচ্ছে হচ্ছে মাইক দিয়ে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিই যে আমি পাস করেছি।আপনি তো জানেনই আমি কি অবস্থার মধ্যে পরীক্ষা দিয়েছি।’

__’তুমি চাইলে আমি মাইক ভাড়া করে সারা পৃথিবীকে জানাতে পারি।’

__’ডোন্ট ট্রাই টু বি ফানি!’

নির্ঝর কিছু বলতে চায়।কিন্তু পারে না।তার হাত দুটো ঢিলে হয়ে আসে।বিড়বিড় করে বলে,

__’খেয়াতরী, আমাকে ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিয়ে যাও।আমার মাথা ফেটে গেছে।’

খেয়া চমকায়।নির্ঝরের অস্পষ্ট কথায় এতক্ষণে তার হুশ ফেরে যেন।সে সরে আসতে নিতেই নির্ঝর রক্তমাখা হাত দিয়ে তার হাত চেপে ধরে।

সে হাতের দিকে চেয়ে ভয়ার্ত গলায় বলে,

__’রক্ত?আপনার হাতে ব্লাড কোথা থেকে আসলো?’

নির্ঝর আর কিছু বলতে পারে না।খেয়ার গায়ের উপর ঢলে পড়ে।সে নির্ঝরকে ধরে ফেলে।

নির্ঝরকে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে বলে,

__’কি হয়েছে আপনার?কথা বলুন।প্লিজ কিছু বলুন।’

কিন্তু সে রেসপন্স করে না।দ্রুত নির্ঝরের মাথার পেছনের দিকে নজর দেয়।তার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে।মাথার ব্যাক সাইড থেকে চুল বেয়ে রক্ত ঝরছে।

ভয়ে খেয়া হাউমাউ করে কেঁদে দেয়।নিজের শাড়ির আঁচল চেপে ধরে আঘাতের জায়গায়।তারপর চিৎকার করে সবাইকে ডাকে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে ড্রাইভার চাচার সাহায্যে নির্ঝরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়!

|১৭|

হসপিটালের বারান্দায় ৫০২ নাম্বার কেবিনের সামনে খেয়া পায়চারি করছে।তার শাড়ি একদম এলোমেলো হয়ে গেছে।সাথে মলিন মুখ।

একটুপর নার্সকে বলে সে নির্ঝরের কেবিনে প্রবেশ করলো।নির্ঝরকে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে।ঘন্টা খানেক পর জ্ঞান ফেরার কথা!

সে এগিয়ে গিয়ে নির্ঝরের বাম পাশের টুল টেনে বসলো।নির্ঝরের মাথায় ব্যান্ডেজ করা।মুখটা কেমন ফ্যাকাসে,পান্ডুর মতো হয়ে গেছে। বেশি ব্লাড বের হয়েছে!

খেয়া হাত বাড়িয়ে নির্ঝরের বাম হাতটা ধরলো।ডান হাতে স্যালাইন লাগানো।

নিজেকে কেন জানি তার অপরাধী মনে হচ্ছে।তার জন্যই নির্ঝর আজ হসপিটালাইজড্।ছি!সে কেমনে এমন কাজ করলো?এমন করে নির্ঝরকে জড়িয়ে ধরলো যে সে সরাসরি মাথায় আঘাত পেল?একদম হসপিটালে এডমিট হতে হলো?

খেয়া ঝরঝর করে কেঁদে দিল।কথায় আছে না,যত হাসি কত কান্না! নিজের রেজাল্ট শুনে যতটা না খুশি হয়েছিল,নির্ঝর অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার সমান তো দূরে থাক,তার তিনগুণ বেশি কষ্ট হচ্ছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর খেয়ার হাতের ভাঁজে থাকা নির্ঝরের হাতটা নড়ে উঠলো।খেয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে নির্ঝরের দিকে তাকাল।

কয়েক সেকেন্ড পর নির্ঝর চোখ খুলল।চোখ খুলেই খেয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।বিনিময়ে খেয়া কান্না সজল চোখে একটু হাসার চেষ্টা করলো।

ঝটপট বলল,

__’এখন কেমন লাগছে?আপনি ঠিক আছেন?’

নির্ঝর মুচকি হাসলো।হেসেই হালকা করে বলল,

__’হুঁ!’

খেয়া এই প্রথম লক্ষ্য করলো নির্ঝর হাসলে তার চোখও হাসে।সে হাসলে তার চোখও কি হাসে?একদিন আয়নাতে পরখ করতে হবে।তবে নির্ঝরের হাসির মতো তার হাসিও কি সুন্দর?নির্ঝরের হাস্যোজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি এত অপরূপ কেন?

এসব কি ভাবছে সে?তড়িৎ গতিতে নির্ঝরের হাতটা ছাড়িয়ে একটু পিছিয়ে বসলো। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ থেকে নির্ঝরের থেকে একটু দূরে থাকবে।নাহ!একটু নয়,যথেষ্ট দূরে থাকবে।

নির্ঝর বাম হাতটা দিয়ে নিজের মাথাসহ কপালের ব্যান্ডেজ স্পর্শ করলো।চোখের মণি ঘুরিয়ে একটু দেখারও চেষ্টা করলো।কিন্তু দেখতে পারলো না।

পরমুহূর্তে খেয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’নুহা কোথায়?এখানে এসেছিল?’

__’জ্বি।এখানে থাকতে চেয়েছিল।অনেক বুঝিয়ে জমিলা খালার সাথে বাসায় পাঠিয়েছি।’

__’ভালো করেছো!’

তারপর কিছুক্ষণ দুজন চুপচাপ রইলো।খেয়া নিজে থেকে বলল,

__’রাত বেড়ে যাচ্ছে।আজকের রাতটা এখানেই থাকবেন নাকি বাসায় যাবেন?ডাক্তার কিন্তু ফুল রেস্টে থাকতে বলেছেন।’

নির্ঝর একটু হেসে বলল,

__’তুমি তো খুব সাংঘাতিক মেয়ে।প্রথম বার নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেই হসপিটালে ভর্তি করলে।’

খেয়া কেঁদে দিল।কান্না করতে করতে বলল,

__’স্যরি!রেজাল্ট শুনে নিজের মধ্যে ছিলাম না।অনেক বেশি খুশি হয়েছিলাম।সেজন্য হুট করে……’

__’তোমার মনে হয়েছিল সারা বাংলাদেশে তুমি একাই পাস করেছো নাকি?’

__’একদম টিজ করবেন না।’

বলে খেয়া আরো জোরে কান্না শুরু করলো।নির্ঝর ছোট্ট করে ধমক দিয়ে বলল,

__’কান্না করছো কেন?কথায় কথায় কাঁদতে বারণ করেছি না?অল্পতে এই পানি নামক পদার্থটা বের করে কি শান্তি পাও বলোতো?’

খেয়া চোখের জল মুছে বলল,

__’চোখের পানি কোনো সাধারণ পানি নয়।উইলিয়াম ফ্রে নামক এক ব্যক্তি এই চোখের পানি নিয়ে ১৫ বছর গবেষণা করেছেন।তিনি বলেছেন, চোখের পানি কোনো সাধারণ পানি নয়।এটি পানি,শ্লেষ্মা,তেল ও ইলেকট্রোলাইটের জটিল মিশ্রণ।

শুধু পানি হলে এটি ঘর্ষণের ফলে চোখ জ্বালাপোড়া করতো।শীতকালে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে হলে জমে বরফ হয়ে যেত।কিন্তু তা হয় না।বুঝতে পেরেছেন?জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুধু আপনি জানেন!আমিও কিছু কিছু জানি।’

নির্ঝর হো হো করে হেসে উঠলো।তার হাসির শব্দে বারান্দার জানালা দিয়ে দু একজন উঁকি দিয়ে চলেও গেল।

খেয়া তাকে বলল,

__’এত জোরে হাসবেন না।ব্যথা বেড়ে যাবে।’

__’মাথার আঘাতটা কি গুরুতর খেয়া?’

__’হুঁ।অতটা গুরুতর না হলেও একদম হালকা নয়।ড্রেসিং টেবিলের কোণা অনেক খানি ঢুকে গর্ত হয়ে গেছে।বেশি সেলাই লাগেনি।তিনটে সেলাই দিতে হয়েছে।কিন্তু একটু গভীর।’

__’আবার যেন মেন্টার না হয়ে যাই!’

__’দুঃখীত।ভেরি স্যরি!’

নির্ঝর হাসতে হাসতে বলল,

__’বাদ দাও তো।তোমার প্রথম হাগটা স্মরণীয় করে রাখার জন্য ধন্যবাদ।’

খেয়া মাথা নিচু করলো।হঠাৎ নির্ঝর হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে বলল,

__’কাছে আসো!’

__’কি?’

__’বলছি কাছে এসে বসো।অত দূরে কেন বসেছো?’

__’আমি এখানেই ভালো আছি।আপনিও ভালো থাকবেন।কাছে গেলেই আবার কোথাও ব্যথা দিয়ে ফেলতে পারি।’

নির্ঝর নিজের বাম হাতটা বুকের বাঁ পাশে রেখে বলল,

__’আমার থেকে অত দূরে বসে আছো তাতে যে এখানে ব্যথা করছে, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সেটা কেন বুঝতে পারছো না?শুধু বাহ্যিক ব্যথাটা কেন দেখতে পাও?’

খেয়া লজ্জায় মাথা নিচু করলো।তার হার্টবিট্ আবার বেড়ে গেছে।এর শব্দ নির্ঝরের কান অবধি যদি যায়?ছি!

সে শাড়ির আঁচল টেনে ঢেকে বসলো।নির্ঝর এবার কিছুটা হুকুমের সুরে বলল,

__’কাছে আসো!’

খেয়ার সারা শরীর কাঁপছে।কাঁপা কাঁপা হাতে টুল টেনে বসতে নিতেই নির্ঝর এক হাতে টেনে তাকে বেডে বসাল।খেয়ার ডান হাতটা মুখের কাছে নিয়ে হালকা করে ঠোঁট ছোঁয়াল।

খেয়া চমকে বলল,

__’ক-কি করছেন?’

নির্ঝর উত্তর দিল না।খেয়ার হাতটা বুকে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলো।একটু পর ধরা গলায় বলল,

__’আই লাভ ইউ খেয়াতরী।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here