জোড়া শালিকের সংসার পর্ব ১৭+১৮

#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৭

২৩.

__’আজ অফিস যাবেন?’

নির্ঝর সোফায় বসে ফাইল চেক করছিল।সে চোখ তুলে খেয়ার দিকে তাকাল।খেয়া বেড গুছিয়ে রাখছে।

আবার চোখ নামিয়ে ফাইল ঠিক করতে করতে বলল,

__’হুঁ!অনেক দিন হলো যাই না।আজ কনফার্ম যেতে হবে।’

খেয়া বেডে বসে বলল,

__’মাত্র দুদিন আগে সেলাই খোলা হয়েছে।একটু সাবধানে থাকবেন।’

__’ভাবছি তোমায় অফিসে নিয়ে যাবো।কোনো প্রয়োজন হলে বা হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়ি যদি?যাবে?’

খেয়া চিন্তিত হয়ে পড়লো।নির্ঝরের সাথে গেলে নির্ঝরের খেয়াল রাখতে পারতো।কিন্তু তাকে আজ মিতুর কলেজে যেতে হবে।গতকাল মিতুকে সে নতুন ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।আজ প্রথম ক্লাস।মিতু তো ভয় পাবে একা যেতে!বাচ্চা মেয়ে!

সে চিন্তিত গলায় বললো,

__’আজ তো মিতুর কলেজে প্রথম দিন।ওকে নিয়ে যেতে হবে।আপনি বরং একাই যান।কোনো সমস্যা হলে ফোন করবেন।’

নির্ঝরের মিতুর কথা মনে পড়লো।জমিলা খালার ছোট মেয়ে মিতু।পিচ্চি মেয়ে।কয়েক দিন হলো এ বাসায় এসেছে।ড্রয়িং রুমে একবার দেখেছে সে।

সে নিজেই অবশ্য খেয়াকে বলে তাকে কাছাকাছি এক কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে।বাচ্চা মানুষ।পড়তে থাকুক।

নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে যেতে যেতে বলল,

__’তুমি তাহলে আজ মিতুকে সাথে করে কলেজে দিয়ে আসো।কাল আমার সাথে অফিসে যাবে।’

খেয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানাল।নির্ঝর ওয়াশরুমে ঢুকতে নিতে আবার ঘুরে দাঁড়াল।খেয়া অবাক হয়ে বলল,

__’কিছু বলবেন?’

__’ইয়ে মানে……. ‘

__’কি?’

নির্ঝর কিছুক্ষণ মাথা চুলকালো।তারপর এগিয়ে এসে খেয়ার সামনে দাঁড়ালো।খেয়া পেছন দিকে একটু হেলে বলল,

__’ক-কি হলো আপনার আবার?কিছু বলবেন?’

নির্ঝর ঝপাৎ করে নিচু হয়ে খেয়ার বাম গালে চুমু দিল।খেয়া বিস্ফারিত নয়নে তার দিকে তাকাল।কিন্তু সে খেয়ার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো!

খেয়া কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় বেডে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো।স্বাভাবিক হতেই রুম থেকে বের হলো।

মিতু নিচের তলায় ড্রয়িং রুমের সাথে যে গেস্ট রুম আছে সেখানে থাকে।খেয়া তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

__’মিতু রেডি হয়েছো তুমি?’

খেয়ার কন্ঠ কানে যেতেই এক লাফে দরজা সরিয়ে এক কিশোরী মেয়ে এসে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়াল।নিঃসন্দেহে সুন্দরী একটা মেয়ে।কি সুন্দর চোখ দুটো!তবে মেয়েটার চোখ দুটো মায়াবী হলেও মুখে সবসময় এক ধরনের কাঠিন্যতা।

খেয়া মনে মনে ভাবলো,এই কাঠিন্যটুকু না থাকলে মিতুকে বেমানান লাগতো।এই কাঠিন্যের জন্যই তাকে আরো অপরূপ লাগে।

__’মিতু,কেমন আছো?’

মিতু নামের মেয়েটা টানা টানা চোখে চেয়ে বলল,

__’ভালো,আপা!’

__’রেডি হয়েছো?’

__’জ্বি।’

__’ব্যাগ গুছাও।আমি শাড়ি বদলে আসছি।’

মিতু মাথা নাড়লো।খেয়া তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিল।মিতু ছোটবেলা থেকে গ্রামে বড় হলেও তার কথাবার্তা একদম শুদ্ধ।গ্রাম্য টান নেই!

মিতুকে দেখলেই তার কিশোরী বয়সের কথা মনে পড়ে যায়।যদিও সে সময়টা সুখকর ছিল না।তবুও ভাবতে ভালো লাগে।কারণ স্মৃতি সবসময় সুন্দর হয়।

পরমুহূর্তে মনে হলো সত্যিই কি সব স্মৃতি সুন্দর হয়?বেদনার হয় না?জাহিদের সাথে কাটানো সময় গুলো কোন স্মৃতির মাঝে পড়ে?সুখের নাকি বেদনার?

সে চুপচাপ সিঁড়িতে পা রেখে উপরে উঠে গেল।

রুমে যেতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে মানুষটাই এমন।এই হাসি,এই কান্না।খুব দ্রুত মন খারাপ হয়,আবার দ্রুত মন ভালো হয়ে যায়।

বড় করে শ্বাস নিয়ে ওয়ারড্রব থেকে মেরুন রঙের শাড়ি বের করে ওয়াশরুমের দরজার উপর হাত রাখলো।

দরজা ভেতর থেকে লক করা।নির্ঝর এখনো বের হয়নি।হয়তো শাওয়ার নিচ্ছে।সে নির্ঝরকে ডাকতে নিয়ে লজ্জা পেয়ে সরে আসলো।তখন ঘড়ির দিকে নজর পড়লো।সময় নেই একদম!

সে লজ্জার মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট বানিয়ে একটু জোরে বলল,

__’আপনার আর কতক্ষণ লাগবে?’

নির্ঝর ভেতর থেকে জবাব দিল,

__’কেন?আমাকে মিস করছো?’

__’জ্বি।আমি চেঞ্জ করবো।’

__’কি চেঞ্জ করবে?’

খেয়া বিরক্ত হয়ে বলল,

__’আপনাকে!’

নির্ঝর হো হো করে হেসে উঠলো।

খেয়া আরেক বার ঘড়ির দিকে তাকাল।সময় বয়ে যাচ্ছে।লেট হয়ে যাবে তো!

সে ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে রুমেই শাড়ি চেঞ্জ করলো।

২৩.

মিতুর আজ কলেজে প্রথম দিন।সে আড়ষ্ট হয়ে টিফিন পিরিয়ডের আগের প্রতিটি ক্লাস করলো।তার বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক।এই বুঝি কোনো টিচার পড়া ধরলো বলে!

টিফিনের ঘন্টা পড়তেই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো যেন।সে ব্যাগ রেখে রুম থেকে বের হলো।

একাকী পুরো কলেজে হাঁটলো সে।সে মানুষটা বন্ধু বানাতে পারে না একদমই।এই যে টিফিনের আগের ক্লাসগুলো করার সময় তার পাশে বসা মেয়েটির নাম পর্যন্ত সে জানে না।মেয়েটি শুধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল,

__’তুমি কি নতুন?’

__’জ্বি!’

__’নাম কি তোমার?’

__’মিতু!’

ব্যস!এইটুকুই।তারও উচিত ছিল অন্তত মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করা।কিন্তু সে করেনি!সামান্য ভদ্রতাটুকু বজায় রাখারও ক্ষমতা তার নেই।

সে মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে পুরো কলেজটা একবার চোখ বুলালো।অনেক বড় কলেজ!অনার্স লেভেলের স্টুডেন্ট পর্যন্ত!

সব ছেলে মেয়ে গ্রুপ গ্রুপ।একমাত্র সেই হয়তো একা।হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে।৩৫ মিনিট টিফিন টাইমের মাত্র ৬ মিনিট পেরিয়ে গেছে।

সে হেঁটে মাঠের দক্ষিণের দিকের বটগাছটার নিচে বসলো।বসার জায়গাটা ইট,সিমেন্টের ঢালাই করে উঁচু করা।তাদের গ্রামের ইদগাহ মাঠেও এমন বিশাল বটগাছ ছিল!

মিতুর থেকে কয়েক হাত দূরে এক বয়ষ্ক লোক ঝালমুড়ি বিক্রি করছে।সে দশ টাকার কিনতে চাইলো।পরমুহূর্তে কি মনে হয়ে কিনলো না।

তার কাছে যে টাকা নেই, এমন না!খেয়া আপা আসার সময় তার হাতে অনেকগুলো নোট আর খুচরা টাকা গুঁজে দিয়েছে।সে গুণে দেখেনি কত টাকা!খেয়া নামক মানুষটাকে তার অনেক পছন্দ হয়েছে।তাকে ছোটবোনের মতো আদর করে।প্রতিদানে সে কি তাকে বড়বোনের মতো ভালোবাসতে পারবে?

প্রথম দিকে ঢাকা আসার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।গ্রামেই ভালো ছিল সে।কিন্তু তার মা যে অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাকে মাসে মাসে টাকা পাঠাতো সেটা তাকে বড্ড পীড়া দিতো।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভালো করে পড়াশোনা করে মাকে ভালো রাখবে।অনেক ভালো রাখবে।

তার গভীর চিন্তার মাঝেই দেখলো কলেজ মাঠে দূর থেকে হাঁকতে হাঁকতে একটা মিছিল আসছে।খেয়া আপা তাকে বার বার বারণ করে দিয়েছে এসব মিছিলের মাঝে যেন না পড়ে।

সে বড় বড় করে পা ফেলে মাঠ ত্যাগ করতে নিল।কিন্তু পারলো না।তার আগে মিছিলের সামনে এসে পড়লো।সে ভয় পেয়ে এক দৌঁড়ে সরে আসতে নিতেই কারো দেহের সাথে বড়সড় ধাক্কা খেল।

সে পড়ে যেতে নিতে নিজেকে সামলে বসে পড়লো।চোখ বন্ধ করে কয়েক সেকেন্ড বড় বড় করে দম নিল।তারপর চোখ খুলে ডান পায়ের জুতার দিকে তাকাল।ছিঁড়ে গেছে।

কলেজের প্রথম দিন এতসব কাজ হলে যে কেউ ভয় পেয়ে যাবে তা মিতু জানে।তার জায়গা অন্য কোনো মেয়ে থাকলে কান্নাও করে দিতো।কিন্তু সে ছোটবেলা প্রচুর কেঁদেছে।বড় হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর কাঁদবে না সে!কাঁদবে না মানে নো ক্রাইং!

__’হেই পিচ্চি গার্ল?তুমি অখে?’

এমন অদ্ভুত কথা বলার ভঙ্গি দেখে মিতু চোখ তুলে তাকাল।তার সামনে ফর্সামতো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।বয়সে যে তার থেকে বেশ বড় তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।এর সাথেই ধাক্কাটা লেগেছে!

সে কিছু বলল না।আরেক নজর ছিঁড়ে যাওয়া জুতার দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ছিঁড়া জুতা পড়েই টিপে টিপে পা ফেলল ক্লাসের দিকে।

__’কি হলো?টক করছো না কেন?’

মিতু সামনের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো ছেলেটা তার পাশাপাশি আসছে।সে এবারও উত্তর দিল না।

ছেলেটা এবার অবাক হয়ে বলল,

__’তুমি মিউট হয়ে আছো কেন?’

মিতু কঠিন মুখে কিছু একটা বলতে নিয়েও থেমে গেল।সে মানুষটা বড্ড কঠিন।

__’তোমার নেইম কি?’

এবার সে দাঁড়িয়ে পড়লো।ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল,

__’মিতু!আমার নাম মিতু!’

ছেলেটা একগাল হেসে বলল,

__’বাহ!কি বিউটিফুল নাম।কোন ক্লাসে স্টাডি করো?’

__’কলেজে!প্রথম বর্ষ!মানবিক শাখায়।আর কিছু?’

__’ইয়েস!না মানে আ’ম রাহাত!রাহাত আহমেদ।আই থিঙ্ক, আই লাভ ইউ।’

মিতুর মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেল ছেলেটার কথা শুনে!
#জোড়া_শালিকের_সংসার
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_১৮

__’ইয়েস,না মানে আ’ম রাহাত।রাহাত আহমেদ।আই থিঙ্ক, আই লাভ ইউ!’

ছেলেটার কথা শুনে মিতুর মুখ অটোমেটিক্যালি হা হয়ে গেল।কিছুটা সময় ফ্যাল ফ্যাল করে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলো।

একটুপর সারা মুখে কাঠিন্য ঢেলে বলল,

__’অ্যাম আই জোক টু ইউ?’

__’আহা!রেগে যাচ্ছো কেন?ওকে!আমার সেনটেন্স সংশোধন করছি।আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ!লাইক এট ফার্স্ট সাইট মানে তোমাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেছে আমার।এখন ভালোবাসতে চাই!অনুমিত দিবে?’

মিতু ফু দিয়ে নিজের চোখের সামনের চুল গুলো সরিয়ে দিল।এ আবার কোন পাগলের পাল্লায় পড়লো?তাও আবার প্রথম দিন?

সে রাহাত নামক ছেলেটাকে টোটালি ইগনোর করে ক্লাসের দিকে পা বাড়াল।

২৪.

তিনটের দিকে খেয়া মিতুর কলেজে এসে পৌঁছাল।উদ্দেশ্য মিতুকে নিতে আসা।মিতুর নতুন ড্রাইভার চিনে গাড়িতে উঠে বাসায় যেতে একপু বেগ পেতে হবে।সেজন্য সে আসলো।

কিছুদিন গেলে হয়তো সে নিজে থেকে যেতে পারবে!

গাড়ি থেকে নামতেই বুঝতে পারলো কলেজ ছুটি হয়ে গেছে।ভীড় ভাট্টা একটু কমতেই গেটের দিকে এগিয়ে গেল সে।মিতুকে গেটের ডানপাশে দাঁড়াতে বলেছে।

গেটের ডানপাশে ভালো মতো চোখ পড়তেই খেয়া চমকে উঠলো।মিতুর পাশে সেদিনের ছেলেটা।রাহাত না কি যেন নাম?হ্যাঁ, রাহাতই!

রাহাত এখানে কি করছে?দেখো তো মনে হচ্ছে মিতুকে হাত নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।কিন্তু মিতু বোধ হয় পাত্তা দিচ্ছে না।

খেয়া ভেবে পাচ্ছে না কি করবে!এগিয়ে যাবে?এগিয়ে গেলেই তো রাহাত তাকে পুষ্প মনে করে এক গাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে মারবে!এখন উপায়?

সে উল্টো দিকে জোরে জোরে হেঁটে গাড়িতে গিয়ে বসলো।হ্যান্ড ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে মিতুকে ফোন দিল।গতকাল সে নিজেই মিতুকে একটা নতুন ফোন কিনে দিয়েছে।

ফোনে মিতুকে গেট থেকে একটু দূরে অবস্থানরত কালো গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে বললো।কয়েক মিনিটের মাথায় মিতু গাড়িতে এসে বসলো।

ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল।

__’মিতু!’

__’জ্বি আপা।’

__’ক্লাস কেমন লাগলো?’

__’ভালোও লাগেনি আবার খারাপও লাগেনি।’

__’ভালো লাগেনি কেন মিতু?’

__’বুঝতে পারিনি না আপা।’

__’অহ।কাল থেকে আরো মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করবে।কেমন?’

__’জ্বি!’

__’সারা দিন ক্লাস করেছো এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো!’

মিতু সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাদের মতো চোখ বন্ধ করে গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দিল।

খেয়া তাকে আর কোনো প্রশ্ন করলো না।সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।আজ আকাশ তেমন ঝকঝকে নয়।অনেকটা মেঘলা।আজ কি বৃষ্টি নামবে?কখন নামবে?কতদিন হলো ঝুম বৃষ্টিতে ভেজা হয় না!

একটুপর মাথা ঘুরিয়ে মিতুর দিকে তাকাল।মিতুর চোখ বন্ধ এখনো।সে মৃদু স্বরে বলল,

__’মিতু ঘুমিয়ে পড়েছো?’

মিতু তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে বলল,

__’না আপা!আমার গাড়িতে ঘুম আসে না।’

__’তাহলে শুধু শুধু চোখ বন্ধ করে থাকতে হবে না।চলো গল্প করি।আচ্ছা, গেটের বাইরে তোমার পাশে যে লম্বামতন একটা ছেলে দেখলাম,হাত নেড়ে নেড়ে কি যেন বলার চেষ্টা করছে তোমায়,চিনো ওকে?’

মিতুর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।সে সোজা হয়ে বসলো।খেয়া বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বলল,

__’মিতু,আমাকে ভয় পাচ্ছো কেন?তুমি আমার ছোটবোনের মতো।আমাকে ভয় কেন পাবে?হুহ?’

মিতুর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কি মিষ্টি হাসি!

__’আপা,ছেলেটার নাম রাহাত।আজ টিফিন পিরিয়ডে প্রথম পরিচয়।আমি অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করিনি।নিজে থেকে সব বলেছে।’

খেয়া বলল,

__’অহ।আর কিছু জানো তার ব্যাপারে?মানে পড়াশোনা করে এখনো?’

__’জ্বি আপা।আমাদের কলেজেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারে।কিন্তু তিন বছর ধরে নাকি ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছে, পাস করতে পারছে না এখনো।থার্ড ইয়ারেও নাকি দুবছর ছিল।তার বড় ভাই নাকি অনেক ক্ষমতাশালী। সেজন্য তাকে এখনো কলেজ থেকে বের করে দেয়নি।নইলে বহু আগেই বের করে দিতো।’

বলেই মিতু বাচ্চাদের মতো হাসতে লাগলো।নিজে থেকে হাসি থামিয়ে বলল,

__’জানো, আপা!ছেলেটা বলে সে নাকি নিজে থেকে ইচ্ছেকৃত ভাবে ফেল করে।পাস করলেই বড় ভাইয়ের সাথে তার বাবার বিজনেসের হাল ধরতে হবে!কিন্তু তার কাজ একদম ভালো লাগে না।সেজন্য পাস করছে না।’

__’এমন মানুষও হয়?’

__’জ্বি আপা!আরো অনেক অদ্ভুত কথা বলেছে আপা।অন্য কেউ হলে আমি হাসতে হাসতে শেষ হয়ে যেতাম।কিন্তু তার সামনে হাসিনি!মানুষটা সত্যি অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং!’

মিতু আবারও খিলখিল করে হেসে উঠলো।খেয়া একটু ভয় পেল।বাচ্চা মেয়ে।এ বয়সী মেয়েদের আবেগ বেশি।ফানি কিছু শুনলেই তার উপর দূর্বল হয়ে পড়ে।কিন্তু বাস্তবতা যে তার উল্টো!

মিতুর হাসি থামতেই সে বলল,

__’মিতু,দূর থেকে যে কারো লাইফ পর্যবেক্ষণ করলেই তাকে ইন্টারেস্টিং মনে হবে।কিন্তু তার সাথে যখন তুমি দিনের পর দিন থাকবে, তার ব্যাপারে জমানো সব কৌতূহল যখন শেষ হয়ে যাবে,তাকে কাছে থেকে জানতে পারবে তখন তাকে মোটেই ইন্টারেস্টিং মনে হবে না।অনেকটা বিরক্তিকর মনে হবে!ইন্টারেস্টিং বিষয়টা অনেকটা দূরত্বের উপর ডিপেন্ড করে।তাই তুমি কারো দু চার লাইন ফানি কথা শুনে তার প্রতি দূর্বল হবে না।দেখা গেল,মানুষটা বাস্তব জীবনে টোটালি অন্যরকম।কি বুঝতে পেরেছো?’

মিতু মাথা নেড়ে বলল,

__’জ্বি আপা!’

খেয়া হাত বাড়িয়ে মিতুর হাতটা ধরে চুপচাপ বসে রইলো।বাকি রাস্তাটুকু আর কেউ কথা বললো না।

২৫.

সন্ধ্যা হতে না হতেই বৃষ্টি শুরু হলো।তাও আবার যেমন তেমন বৃষ্টি নয়।ক্যাটস এন্ড ডগ অর্থাৎ মুষলধারে বৃষ্টি যাকে বলে!

খেয়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাইরের মেইন গেটের দিকে উঁকি দিল বার বার।নির্ঝর সেই সকালে অফিসে গিয়েছে।এখোনি ফিরেনি!অসুস্থ মানুষ।যদি কিছু হয়ে থাকে?

দুপুর বেলা খেয়া তাকে একটা এসএমএসও করেছিল।লাঞ্চ শেষ করে মেডিসিন খেয়েছে কি না সেটা জিজ্ঞেস করেছিল।কিন্তু নির্ঝর কোনো উত্তর দেয়নি।সেটা নিয়ে খেয়ার বুকের ভেতর সূক্ষ্ম অভিমান সৃষ্টি হয়েছে!

কয়েক মিনিট বেলকনিতে দাঁড়িয়েই একদম কাকভেজা হয়ে গেল খেয়া।তার শরীর কাঁপছে শীতে!হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে বেলকনির শক্ত গ্রিল ধরে চোখ বন্ধ করে আছে।একটুপর পর বৃষ্টির ফোঁটার সাথে সাথে ঝড়ো হাওয়া এসে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে।

তবুও সে সরে আসলো না।সময়ের সাথে সাথে যেন তার অভিমান বৃষ্টির ফোঁটার মতোই বাঁড়তে লাগলো।সে আজ সরবে না এখান থেকে।যতক্ষণ না নির্ঝর আসবে, সে সরনে না!কিছুতেই না!

নির্ঝর অফিস থেকে ফিরলো একদম ভিজে একাকার হয়ে।গাড়িতে আজ ছাতা ছিল না।পার্কিং এরিয়া থেকে মেইন দরজা পর্যন্ত আসতেই একদম ভিজে গেল।

মাথার চুল ঝাড়া দিয়ে কলিং বেলে চাপ দিল।একবার কলিং বেলে চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল।নির্ঝর অধীর আগ্রহ নিয়ে সামনে তাকাল।প্রতিদিনের মতো খেয়াকে এক্সপেক্ট করেছিল।কিন্তু তার সামনে খেয়া নেই।মিতু দাঁড়িয়ে আছে।

সে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,

__’মিতু, কি খবর?’

মিতু মাথা নিচু করে বলল,

__’ভালো।’

__’নুহাকে দেখছি না।’

__’নুহা মায়ের সাথে তার রুমে।গল্প করে।আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন দাভাই।আমি নুহাকে নিয়ে এখন পড়তে বসবো।চিন্তা করবেন না।’

__’হুঁ!’

নির্ঝর সিঁড়িতে পা রাখার পরও আড়চোখে সারা ড্রয়িং রুমে চোখ বুলালো।খেয়াকে দেখতে পেল না।খেয়া রুমে?

রুমে ঢুকেই খেয়াকে খুঁজলো।রুম একদম খালি।খেয়া নেই।রুমের দক্ষিণ দিকের জানালাও খোলা।বৃষ্টির ছিঁটায় অর্ধেক রুম ভিজে গেছে প্রায়।নির্ঝর কাচ টেনে জানালা বন্ধ করলো।

ওয়াশরুমে উঁকি দিয়ে দেখলো খেয়া সেখানেও নেই।নিজের অজান্তে তার বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো।খেয়া কই?

সে এক দৌঁড়ে বেলকনির কাচ ঠেলে দেখলো খেয়া নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কাচ খোলার শব্দেও পেছন ঘুরে তাকাল না।

নির্ঝর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে খেয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠলো।খেয়ার শরীর একদম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে।সে খেয়াকে একটানে তার দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো না।খেয়া শূন্য দৃষ্টিতে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে।

নির্ঝর ভ্রু কুঁচকে বলল,

__’এই খেয়া?কি হয়েছে?এখানে কখন এসে দাঁড়িয়েছো?শরীর তো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে।রুমে চলো!’

খেয়া চোখ বন্ধ করলো।কিন্তু একচুল নড়লো না।

নির্ঝর তার হাত দুটো গ্রিল থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।পারলো না।

এবার রেগে গিয়ে এক টানে খেয়াকে নিজের দিকে ঘোরাল।তার নিজেরও হাত পা থরথর করে কাঁপছে শীতে।বৃষ্টির ফোঁটা যে এতটা শীতল হতে পারে তার জানা ছিল না।

নির্ঝর কাঁপা কাঁপা হাতে ভেজা পাপড়ি মেলে নরম গলায় বললো,

__’খেয়াতরী, এমন করছো কেন?কি হয়েছে আমায় বলো!’

খেয়া ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা চালিয়ে গেল।নির্ঝরের যেন হঠাৎ মনে পড়লো।সে অপরাধীদের মতো বলল,

__’স্যরি!খুবই দুঃখীত।এবারের মতো মাফ করে দাও।সারাদিন তোমার খোঁজ নিতে পারিনি।নুহার খোঁজ নিতে পারিনি।আসলে অনেকদিন পর অফিসে গিয়েছিলাম।সেজন্য প্রচুর ব্যস্ত ছিলাম।দুপুরে তুমি যখন মেসেজ দিয়েছিলে তখন মিটিংয়ে ছিলাম।গাড়িতে উঠার পর ফোন হাতে নিয়ে তোমার মেসেজ দেখেছি।আর এমন হবে না।সত্যি বলছি!এবারের মতো ক্ষমা করো।এক্সট্রেমলি স্যরি!এই কান ধরছি।’

নির্ঝর সত্যি সত্যি দুকানে হাত রাখলো।খেয়া এক পলক তার চোখের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কেঁদে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়লো।নির্ঝর এবারো পড়ে যেতে নিয়ে সামলে নিল।খেয়াকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করলো।

কয়েক মিনিট পর নির্ঝরকে জড়িয়ে রাখা খেয়ার হাতদুটো ঢিলে হয়ে আসতেই নির্ঝর চমকে উঠলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here