“ঝরা পাতার দিনগুলো পর্ব -০৭,৮

গল্পঃ ঝরা পাতার দিনগুলো
হাবিব
পর্ব -০৭,৮
পাক্কা ৬ ঘন্টা ধরে আমি আর বাসার কাজের জন্যে রাখা খালা মিলে ভাইয়ার ঘর দুইটা পরিস্কার করছি। তার পরেও একটা ভোটকা গন্ধ নাকে লাগছে। আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন এই ছেলে এইটার ভেতর কিভাবে ছিলো এতোদিন!!! নাহ এতো বছর!!
বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমের প্রতিটা জিনিস নতুন করে সাজিয়েছি। সব কিছু নতুন করে শুরু করতে হবে তো। ইউটিউব দেখে দেখে অনেক প্ল্যান মাথায় কিলবিল করছে। কিন্তু রুম পরিস্কার করতে গিয়ে সব ভুলে গিয়েছি।
দুপুরে খাটাইশ সাব্বির বাদে সবাই মিলে একসাথে খেয়েছি। কতদিন পর!! আব্বুর মুখ থেকে হাসি যাচ্ছেই না!! আম্মু শুধু খাওয়া বাদ দিয়ে একটু পর পর আঁচল দিয়ে চোখ মুছেন। শেষ মেশ ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলছে, মা আমরা ওয়েট করছি তুমি একেবারে সব কান্না শেষ করো। খাওয়ার সময় তোমার নাকের ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ ভালো লাগছে না।
“মেহের”…ভাইয়ার চিৎকার শুনে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়তে পড়তে ভাইয়ার রুমে গেলাম।
-জি ভাইয়া কিছু বলবা?
খুব কনফিডেনটলি উত্তর দেয়ার ট্রাই করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো মেও মেও করে!!
রাগের জন্যে ভাইয়া কথা বলতেসে না। ইশারা দিয়ে মেহনাজ আপুর ছবি গুলো কোথায় জিজ্ঞেস করলো।
এই প্রশ্নটার জন্যেই ওয়েট করছিলাম।
-ছবি দিয়ে কি হবে?
-ছবি দিয়ে কি হবে মানে? তুই আমার পারমিশন ছাড়া সরিয়েছিস কেনো?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বললাম, সারা রুমে আপুর ছবি দিয়ে তুমি কাকে প্রুফ করতে চাও যে কতোটা ভালোবাসো তুমি আপুকে? বাইরের টানানো ছবি দিয়ে কি আসে যায়। এসব দিয়ে বাইরের মানুষকে বোঝানোর কি খুব দরকার বলো তো ভাইয়া। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষটা এমন এক জায়গায় থাকে যেখানে মানুষ কেনো দুনিয়ার কোনো কিছু তার প্রতি আমার ভালোবাসাকে ছুতেও পারবে না । যেখানে থাকার দরকার সেখানে থাকলেই তো হলো। যখন খুব বেশি মনে পরবে অন্ধকার রাতে বেলকনিতে গিয়ে চোখ বন্ধ করে তাকে ফিল করার চেষ্টা করবে, দেখবে সে তোমার সামনে এই চার ফ্রেমের ছবির থেকেও জীবন্ত হয়ে ধরা দিয়েছে। ভালোবাসার পূর্ণতা না পেলেই কি ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়? এতো সস্তা? ভালোবাসি এটা মুখেও বলতে হয়না, কানেও শুনতে হয় না, একজনের মনের টান আরেকজন ঠিকই বুঝতে পারে।
ভাইয়া মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আর কিছু না বলে রুমের বাইরে চলে এসে আগে বুকের মধ্যে একটা ফু দিলাম। আল্লাহ!!! যে ভয় পাইছিলাম। আমি তো ভালোই অভিনয় করতে পারি। সাব্বির ডিভোর্স দেয়ার পরে অভিনয়ে নাম লিখানোর আইডিয়াটা খারাপ না।
রুমের বেলকনিতে এসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কাউন্সিলিং সাইকোলজিতে মাস্টার্স করা ফ্রেন্ডকে ফোন দিলাম।
-দোস্ত আর এমন কিছু করতে বলিস না প্লিজ!! আর একটুর জন্যে কান্নাকাটি শুরু করে দেই নাই।
উৎস হাসতে হাসতে বললো, বান্ধবি এতোই সহজ যদি হতো তাহলে কি আর দুনিয়াতে মানুষ ডিপ্রেশনে সুইসাইড করতো? ভাইয়া যে আরও খারাপ কিছু করে নাই সেটাই বেশি।
-হুম। কিন্তু দোস্ত এইরকম ভয়াবহ কিছু করতে বলিস না প্লিজ। এইরকম বেশি ব্রিলিয়ান্ট গুলারই এইরকম হয়।
-তুই একবার ভাব যদি উনি পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করতো তাহলে কতদূর যেতে পারতো?? আমারা বুয়েটে পরিক্ষা দেয়ার চান্স পাই না আর এই লোক বুয়েটের এডমিশন টেষ্টে ফার্স্ট হয়েও পড়লো না।
-সবই প্রেম পিরিতির দোষ। আচ্ছা এরপর কি করবো বল।
আরও কিছু ইনস্ট্রাকশন নিয়ে ফোন রাখলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে ভিষণ চমকে উঠলাম!! সাব্বির কখন এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাইনি!! ভাগ্যিস রিশাদ ভাইয়া আসে নাই।
-কি ডিভোর্সের পরে কিভাবে সংসার করবি তার প্ল্যান করতেছিস?
কোন উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই হাত ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে আবার মুখোমুখি দাড় করালো আমাকে। হাতে খুব জোড়ে মোচড় দিলো!! ব্যথায় চোখে পানি চলে আসছে।
কোন সাউন্ড না করে ব্যথা দাতে দাত চেপে সহ্য করলাম।
-খুব ভাব বাড়ছে তোর তাই না? কথার উত্তর দিস না কেনো? এমন বেইজ্জতি করবো জীবনে কারোর সামনে চোখ তুলে কথা বলতে পারবি না।
-আচ্ছা বলে হাত ছাড়িয়ে চলে গেলাম রুম থেকে।
হাত বরফ দিয়ে ঘসছি। রক্ত জমে কালচে লাল হয়ে গিয়েছে। সাব্বির জানে না যে কাউকে উত্তর দেয়ার জন্যে সবসময় মুখে দিতে হয় না। কোন কিছু না বলে চুপ করে ইগ্নোর করাটা যে কতো বড় অসস্তির ব্যাপার সেটা মনে করে মনে মনে হাসছি।
ইশ আমার লাইফটাও যদি কেউ এসে রিশাদ ভাইয়ার মতো চ্যাঞ্জ করে দিত।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-কি হইছে মেহের?
আম্মুর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলাম। চিন্তা করতে করতে খেয়ালই ছিলো না আম্মা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
-কিছু না আম্মা। গরম পানি পরেছে হাতে। কফি বানাইতে গিয়েছিলাম।
-ইশ দেখছো!! একদম তো কালচে হয়ে গিয়েছে। আয় আমার সাথে বলতে বলতে আমাদের রুমে আমাকে টেনে নিয়ে এলো।
আম্মুর মতো ভালোবাসা পেয়ে কান্না আসতেসে খুব। দাত মুখ খিচে খুব কস্টে চেপে রাখছি।
-সাব্বির দেখতো ওর হাতটা। গরম পানি পড়ে কি অবস্থা হয়েছে। খালি সারাদিন এটা ওটা করে বেরায়। একটুও বসে থাকতে পারে না মেয়েটা।
সাব্বির আমার হাতটা দেখে কিছুই বললো না।
কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর চোখে মুখে আমার থেকে বেশি কস্টের ছাপ আর আকুলতা।
হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগানোর সময় এমন আলতো করে টাচ করছে যেনো ব্যথাটা সেই পাচ্ছে।
হ্লারপুত ব্যথা দেয়ার সময় মনে ছিলো না তোর? মনে মনে আরও কয়েকটা কঠিন গালি দিলাম।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও মনে হলো এরকম সাইলেন্ট ভালোবাসার স্ফুরণের জন্যে আমি হাতে আরও ব্যথা পেতে রাজি আছি!!!
আজকে সন্ধ্যায় সাব্বিরও বাসায়। এমনিতে ও বাসায় থাকে না। সেটা আমি আসার জন্যেই নাকি কে জানে। দুইভাইয়ের মধ্যে আগুন আর ঘি এর সম্পর্ক। আগুনে যেমন ঘি ঢাললে ধপ করে জ্বলে উঠে তেমনি একজন আরেকজন কে দেখলে ধপ করে জ্বলে উঠে। আমার মাথায় ঢুকে না কোনো আহামরি কারণ ছাড়া এইরকম হবার কারণটা কি হতে পারে।
একটা রিস্ক নেয়াই যায়। আতপ চালের ছোট ছোট পিঠা আর চিতল পিঠা বানালাম সাথে চ্যাপা শুটকি ভর্তা ,সরিষা ভর্তা আর গরুর মাংসের ঝোল।
নাস্তা বানিয়ে সবাইকে ডাকলাম খেতে আসার জন্যে। কারণ এই বাসায় এখনো অব্দি সবাই একসাথে খেতে বসিনি একবারও। সাব্বির রিশাদ ভাইয়াকে দেখলে আর খেতে আসে না আর রিশাদ ভাইয়া সাব্বিরকে দেখলে।
যথারীতি দুজন দুজনকে দেখে টেবিলে বসে নি। সাব্বির আগে এসে বসছিলো। তারপর রিশাদ ভাইয়াকে টেবিলে বসতে দেখে চলে গিয়েছে। আবার সাব্বির কে উঠতে দেখে রিশাদ ভাইয়া যেয়ে রুমে চলে গিয়েছে । এখন দুজনেই রুমে যেয়ে বসে আছে। কি স্যাক্রিফাইস দুজনের!!!!
অগত্যা যার যার রুমে খাবার দিয়ে আসলাম। ইচ্ছে করছিলো শুধু চা দিয়ে আসি। বদমাইশ গুলো। আমি এতো কস্ট করে এক বিকেল ধরে এইগুলো বানাইছি কি রুমে বসে খাওয়ার জন্যে। খাওয়ার সময় তো কম খায় নাই কেউই। আমার ভাগের গুলোও দিয়ে আসছি। টেবিলে বসে খেলে কি হতো। যত্তসব ফাউল পোলাপাইন।
ঈদের আগের দিন আব্বু কোরবানির জন্যে গরু কিনতে যাওয়ার প্ল্যান করতেছে। কিন্তু আব্বুর শরীরটা তেমন ভালো না। বয়স্ক মানুষ। দুই ভাইকে পাঠানোর বললাম। আম্মু আব্বু দুজনেই মানা করে দিলো। কারণ যারা খাবার টেবিলেই একসাথে বসে না তারা আর যাই হোক একসাথে কিছুই করবে না।
শেষমেশ আব্বুই গেলো আর অনেক ভুজুং ভাজুং দিয়ে রিশাদ ভাইয়াকে সাথে পাঠালাম। প্রিথিবীতে আসলে বেঁচে থাকার জন্যে যে অনেক বেশি কিছুর দরকার হয় না সেটা আব্বুকে দেখে আবার উপলব্ধি করলাম। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যতখন দেখা যায় দেখলাম বয়স্ক মানুষটা বার বার পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছতেছেন আর এক হাত ছেলের কাধে রেখে হাটছিলেন।
ঈদের দিন সকালে রিশাদ ভাইয়াকে পাঞ্জাবি পরা হাস্যোজ্জলভাবে আব্বুর সাথে কথা বলতে দেখে নিজের বাবা মা ভাইবোন ছাড়া প্রথম ঈদ করার কস্ট ভুলে গেলাম।মনে হলো অনেক দিন পর শান্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছি। রিশাদ ভাইয়া গত চারবছর যাবত কোনদিন এক একরাকাত নামাজও পরে নি। সেই ছেলে আজকে কি সুন্দর করে নামাজে যাওয়ার জন্যে রেডি!! আবার আব্বুকে তাড়া দিচ্ছে!!! নিচে বসে আব্বুর পায়জামা ভাজ করে দেয়ার দৃশ্যটা দেখে চোখে পানি আটকানোটা কস্টই হয়ে গেলো। পাশে তাকাতেই দেখলাম বেচারি আম্মু আচলে মুখ চেপে কান্না লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে!! আর সাব্বির রুমের বাইরে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহারে কি সুন্দর দৃশ্য!!! এই জীবনে আর কোনো আফসোস নেই আমার। সাব্বির ডিভোর্স দিয়ে দিবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে ভীষণ!! অবশেষে এই সংসারের মায়ায় পরে গেলাম।
দুই ছেলেকে দুপাশে নিয়ে একরকম পাঞ্জাবি পড়ে ঈদের নামাজে যাচ্ছে আব্বু। আর হাউ মাউ করে আম্মু আমাকে ধরে কাঁদছে!! আহারে!! আহারে!!
কিছুক্ষন বাদে আম্মু ধাতস্থ হতেই দুটো হাত ধরে খুব মিনতি ভরা গলায় বললাম
-আমার বোনের উপর আর অভিশাপ রাইখেন না আম্মা। আমার বোনটাও অনেক কস্টে আছে। দুলাভাই অনেক ভালো। কিন্তু শশুরবাড়ির লোকেরা তো বুঝতে চাই না। এতোদিন ধরে বাচ্চা হচ্ছে না সবাই আপুকেই দোষ দিচ্ছে। কিন্তু আপু ভাইয়ার কোন প্রব্লেম নাই ডাক্তার বলছে। তার পরেও হচ্ছে না। সবাই বলে আমার বোনের জন্যে রিশাদ ভাইয়ার এই অবস্থা হইছে। বিশ্বাস করেন আম্মা আমার বোন এইরকম না।
-তোর বোনের উপর আমার কোনো রাগ নাইরে। ভুল তো আমারি ছিলো। ঐ দিন ছেলের কথা চিন্তা করলে আজকে এই দিনের জন্যে এতোদিন অপেক্ষা করতে হতো না।
-জানেন আম্মা আমার আব্বু অনেক কস্ট পেয়েছিল আপনার কথায়। বার বার শুধু একটা কথায় বলতো ঝিনুক এইটা করতে পারলো? তার জন্যে যত বার আপনি বিয়ের প্রস্তাব দিতেন আমার জন্যে আব্বু মানা করতো আর বলতো এর পরের বার ঝিনুক এমন কথা বললে আমি সহ্য করতে পারবো না। তার পরেও আপনাকে কিছু বলতেন না যদি আপনি কস্ট পান এই ভেবে।
– ভাইজানরে অনেক কস্ট দিছি রে মেহের, অনেক কস্ট দিসি। এইটা যদি আগে বুঝতে পারতাম তাও হইতো। তোর ছোট ফুপির কথায় কতো কথা বলছি ভাইজানরে।
-জানেন আম্মা ছোট ভাইয়ার সাথে যখন আমি ঝগড়াঝাটি করে ওর হাতে মাইর খেতাম তখন আব্বা একটা কাহিনী বার বার বলতো, তোরা জানিস আমি ঝিনুকরে কতো আদর করতাম? একবার ঝিনুকের কলেরা হলো। আর আমার তখন ইন্টার টেস্ট পরিক্ষা চলে। সব পরিক্ষা তে পাশ মার্কস তুলে আমি বাসায় চলে আসতাম। সারাদিন ওরে কোলে নিয়ে বসে থাকতাম। আর তোরা কি করিস?
এটা বলে থামতেই আম্মু আবার হাউ মাউ করে কান্না শুরু করলো।
তুমি যদি পারো একবার মেহনাজ আপুর সাথে একটু কথা বইলো।আমরা ভাইবোনরা তো চাইলেও সবাই সবার কাছে যাইতে পারি। কতো কথা বলতে পারি। বেচারি লন্ডন থেকে কিছু বলতেও পারে না। ফোনে কি আর এতো কথা বলা যায়, বলো। জানো, আম্মু মারা যাওয়ার পর সব রিলেটিভরা কেমন জানি হয়ে গেছে। ছোট ফুপি ফোন করেই মেজো ভাইয়াকে আমার বিয়ের কথা বলতো। মামা তো নাই। খালারাও কেউ খোজ খবর নেয় না। আমাদের টাকা পয়সার দরকার এমন তো না। একটু মনে সাহস দেয়াটাও অনেক কিছু।
সারাদিন অনেক খাটাখাটুনির পর রাতে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পরলাম। এতো ক্লান্ত লাগছে। আম্মুর কথা মনে পরছে ভীষণ। ঈদের সময় বাড়িতে থাকতেও সব কাজ আমারি করতে হতো।আমার ২ভাবি কোনো কাজই করতো না।মেজোটা সারাদিন ছেলের পিছন ঘুরঘুর করতো। আর বড়টা নিজের বাড়িতে মেহমান হয়ে যেতো। রাত হতে হতে মাইগ্রেনের ব্যথাটা অনেক বেড়ে যেতো। তখন আম্মু খুব আলতো করে মাথায় বিলি কেটে দিতো। আমি আরাম করে ঘুমিয়ে যেতাম। আজকেও অনেক মাথা ব্যথা। কিন্তু কেউ নেই। ভাবতেই কান্না চলে আসছে।
গভীর ঘুমে যাওয়ার আগেই মনে পরলো আমাকে তো ফ্লোরে ঘুমাতে হবে। উফ্, এতো আলসেমি লাগছে। কি হয় ফ্লোরে না ঘুমালে। আজব পোলা একটা। আমি কি তোকে কিছু করবো নাকি। কোনরকম চোখ একটু খুলে ফ্লোরে এসে ধপাস করে শুয়ে পরলাম। কিন্তু সেই সাথে মাথায় ব্যথাও পেলাম অনেক। ফ্লোর তো আর বিছানার মতো নরম না। যার জন্য মাইগ্রেনের ব্যথা কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো।
উঠে ব্যাগ থেকে মেডিসিন বের করে খাওয়ার আগেই দেখলাম সাব্বির এসে আমাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে বেসিনে মাথায় অনেক্ষন পানি দিলো। তারপরে চুল মুছে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পরতে বললো। আজব ব্যাপার!!!আমার জন্যে এতো দরদ!!
-পরশু একটা ফ্রেন্ড আসবে বাসায়। ডিভোর্সের ব্যাপারে আমরা তার সাথেই কথা বলবো। আর আজকে আমি পাশের রুমে ঘুমাচ্ছি। তুই বিছানাতে ঘুমা।
বলেই রুম থেকে চলে গেলো।
বাহ আমাকে সেবা যত্ন করে আবার আমাকেই উপহার দিয়ে গেলো!! কোন ঈদে এতো ভালো গিফট কখনো পাইনি।
ঈদের পরের দিন সকালে নাস্তা বানিয়ে সবাইকে ডাকছি খাওয়ার জন্য আর একটা ট্রেতে খাবার রেডি করছি। কে যে স্যাক্রিফাইস করবে তার তো ঠিক নাই। রান্নাঘর থেকে এসে দেখি সাব্বির আর রিশাদ একসাথে টেবিলে বসে আছে। বাহ আজকে কারোরই স্যাক্রিফাইস করার মুড নাই দেখি!!
আম্মু আব্বু এদের দুজনকে একসাথে দেখে খাওয়া বাদ দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। যাক একসাথে টেবিলে খেতে তো বসছে।
সকাল ১১টা করে আবার রিতু আপু আসছে মেয়ে আর হাসবেন্ড কে নিয়ে। কি খুশি সবাই। ইশ আমাদের বাসায়ও প্রতি ঈদে এমন হতো। ভাইয়ারা সবাই গ্রামে ঈদ করতে চলে আসতো।
বরাবরের মতো এইবারও নিশ্চয়ই বড়ো আপু আর সেজো আপু ঈদের দিন বিকেলে চলে আসছে।
রাতে রিতু আপুরা খাওয়া দাওয়া করে চলে গেলো।
“কালকে তুই আর সাব্বির যেয়ে তোদের বাড়ি থেকে ঘুরে আয়। আর পরেরদিন রিশাদ যেয়ে তোদেরকে নিয়ে আসবে। এর পরের দিন তো চলেই যাবি তুই। কালকে না গেলে কখন যাবি আর” আম্মুর এমন কথায় খুশিতে গতরাতের ওর ফ্রেন্ড আসার কথা ভুলে গিয়েছি।
রাতে সাব্বিরও এই নিয়ে কিছু বলেনি। সারা রাত খুশিতে ঘুমও হয়নি ঠিকমতো। খুব ভোরে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে রেডি হলাম। সাব্বিরের কোনো খবরই নেই। জেগে আছে ঠিকই। ইচ্ছে করে এমন করছে। এতো রাগ উঠতেছে ওর উপর।
-কারো যেতে ইচ্ছে না করলে রাস্তা পর্যন্ত দিয়ে আসলেই হবে।আমি যেতে পারবো একা একা।
অনেকটা রাগের স্বরেই বললাম।
একটু পর মাঝ রাস্তায় এসে সত্যি সত্যি গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো!!!
এতো কস্ট হচ্ছিলো। সাথে খুব বেশি টাকাও নেই। কাটায় কাটায় ৪০০ টাকা আছে। সবাই মনে হয় ভুলেই গিয়েছে যে আমিও একটা মানুষ আর আমারও টাকার দরকার হতে পারে। যাই হোক এইবার গিয়ে মেজোভাই থেকে টাকা নিবো। কারোর তো অন্তত জানা উচিত কি হচ্ছে আমার জীবনে। টাকা সেইফ করার জন্য লোকাল বাসে করে গুলিস্তান পর্যন্ত আসলাম। ঈদ উপলক্ষে বাস ভাড়াও বেশি।
গুলিস্তান থেকে বাসে উঠলাম। আরও দুইবার গাড়ি চ্যাঞ্জ করতে হবে। আল্লাহ আল্লাহ করছি যেনো টাকার জন্যে কোনোখানে বেইজ্জতি হতে না হয়।
ইশ বাড়িতে কতো পিচ্চিগুলো আছে। কারোও জন্যে কিছু নিতে পারলাম না। নাহ এইবার বাড়ি যেয়ে সবাইকে সব কিছু খুলে বলবো। আর কতো সহ্য করবো। আমার কি ঠেকা পরছে। হাবিজাবি চিন্তা করতে করতে বড়ভাবি কে একটা ফোন কর‍তে ভুলেই গিয়েছিলাম। আরে ধুর আমি তো একাই যাচ্ছি। ফোন না করলেই কি হবে।
রিকশা থেকে নেমে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পুকুরপাড় হয়ে ঢুকলাম। কেমন শান্ত মনে হচ্ছে বাড়িটা। এইরকম লাগছে কেনো। মানুষ জন কই সব?
তিনটা ঘরের দুটোই বন্ধ দেখছি। সবাই একটা ঘরে কি করছে ভাবতে ভাবতে এসে দেখি দরজায় বিশাল সাইজের একটা তালা ঝুলছে!!!
এতোটা কস্ট মনে হয় আব্বু যেদিন মারা গিয়েছিল সেদিনও পাইনি। নিজের মাথার উপর ছাদ হারানোর কস্ট এতোটা বেশি হয় জানলে কখনো বিয়েই করতাম না।
কাঁপা কাঁপা হাতে বড় ভাবিকে ফোন করলাম
-ভাবি কি অবস্থা।
-এইতো ভালো মেহের। তোমার কি অবস্থা।
-ভালো। কোথায় আছো এখন।
-এইতো বাবার বাড়িতে চলে আসছি। তুমি চিটাগং যাবে কবে?
-চলে যাবো ভাবি। মেজো ভাইয়া কই? আর আপুরা আসেনি এইবার বাড়িতে? ছোট ভাইয়া কই?
-তোমার মেজো ভাইয়া তো ঈদের আগের দিন এসে ঈদেরদিন বিকেলেই চলে গিয়েছে শশুরবাড়ি। আর আপুরা কেউ আসেনি এইবার। অনেক করে বলছিলাম আসতে।
-ভাবি ছোট ভাইয়া কই?
-ওরে তো বলছিলাম আমার সাথে চলে আসতে। ছেলে মানুষ কই খাবে। ওতো বললো বড় আপুর বাসায় চলে যাবে।
-ও আচ্ছা। ঠিক আছে ভালো থাইকো।
আমি আর বলিনি আমি এসেছি বাড়িতে এসেছি।
ধপাস করে দরজার সামনে বারান্দায় বসে পড়লাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। দোষ তো আমারি। আমি তো কাউকে ফোন দিয়ে আসিনি। ঈদের দিন ছাড়া কারো সাথে কোন যোগাযোগও হয়নি।
হঠাৎ একটা কথা মনে পরতেই বারান্দায় শেষ পিলারটার উপরের দিকে একটা খাজে খুজতে যেয়েই ঘরের চাবিটা পেয়ে গেলাম। চাবিটা হাতে নিয়েই বারান্দায় বসে কান্নায় লুটিয়ে পড়লাম। আম্মু সবসময় এইখানে আমাদের ছোট দুই ভাইবোনের জন্যে চাবি রেখে যেতো। আমি আর ছোট ভাইয়া হঠাৎ হঠাৎ এসে আম্মু আব্বুকে সারপ্রাইজ দিতাম। আমি আসতাম চিটাগং থেকে আর ও আসতো ঢাকা থেকে।
আজকে চাবিটা ঠিকই আছে কিন্তু কোন মানুষজন নেই। আর এই ঘর ছাড়া আমার এখন যাওয়ার কোন জায়গাও নেই। দুনিয়াতে এতো অসহায় নিজেকে কখনো মনে হয়নি।
কি করবো ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলাম। আম্মু আর আব্বুর জামা কাপড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরলাম বিছানায় যেখানে আম্মু আর আব্বু থাকতো।
কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি টেরই পাইনি। উঠে দেখি বিকেল হয়ে গিয়েছে। বাড়ির এরিয়া বিশাল আর বাউন্ডারি থাকায় আশেপাশের মানুষ এখনো টের পায়নি যে আমি এসেছি। অনেক খুজে বিস্কুট ছাড়া খাওয়ার কিছু পেলাম না। সন্ধ্যা করে আব্বু আর আম্মুর কবরের মাঝখানে গিয়ে শুয়ে পরলাম। আমার সবথেকে শান্তির জায়গাটা এমন জায়গায় যেখানে সাধারণত মানুষ আসা যাওয়া করে না। সব মানুষ কবরস্থানকে ভয় পায়। কিন্তু আমার জন্যে এর থেকে শান্তির জায়গা আর নেই।
কতো হাসি কান্নার কথা বললাম আম্মু আব্বুর সাথে!!!! আমার কস্ট বোঝার জন্য মনে হয় এরা বাদে কেউ নেই!! দায়িত্ব পালন করলেই সব কি শেষ হয়ে যায়??
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর এই দেশে থাকবো না। খুব তারাতাড়ি এই দেশ ছেড়ে চলে যাবো। যেখানে সব প্রিয় মানুষগুলোই আমাকে ফেলে চলে গিয়েছে সেখানে থেকে কস্ট পাওয়ার কোন দরকার নেই।
চলবে
গল্পঃ ঝরা পাতার দিন গুলো
।।
পর্ব -০৮
অনেক রাত অব্দি কবরের পাশে শুয়ে ছিলাম। আহা!! কি যে শান্তি লাগছিলো !! রাতে এসে আম্মু আব্বুর খাটে শুয়ে পড়লাম। চোখে একফোটা ঘুমও নেই। চা খেতে ইচ্ছে করছে খুব। চা অনেক পছন্দ বলে আগে আমার জন্যে সবসময় আব্বু চা, গুড়ো দুধ নিয়ে এসে রাখতো। ভাবতেই ভিতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
অনেক খেটেখুটে একমগ চা বানিয়ে নিয়ে বাইরে এলাম।বাইরে কি সুন্দর বাতাস আর মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে চাঁদের আলো উপচে পড়ছে !!!!! ওহ আজকে তো ভরা পূর্ণিমা!!
এই মুহুর্তে সবার আগে সাব্বিরকে পাশে পাওয়ার অাকাঙ্ক্ষায় নিজেই হেসে উঠলাম। ইশ আমার ঠিক কোথায় ওর জায়গাটা ওকে যদি দেখাতে পারতাম!!
ছোট থাকতে এমন ভরা জোছনায় আব্বু আম্মু আমাদের ভাইবোনদেরকে নিয়ে উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে গল্প বলতো।কতোরাত এমন উঠোনেই ঘুমিয়ে পরেছি!! মনে হচ্ছে চোখের সামনে ভাসছে সবকিছু।
আজকে বাড়িঘর সব আছে, শুধু মানুষগুলোই নেই। আর আমি সেই বিশাল বাড়িতে একা একা সেই উঠানে মাদুর পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছি!!
কি হতো যদি সাব্বির আমার সাথে আসতো এইখানে? ও যদি এইমুহূর্তে এখানে চলে আসতো আমার জন্য!! ইশ!! ওর বাকি জীবনের আমার প্রতি করা সব অনুচিত কাজ গুলো মাফ করে দিতাম।
কিন্তু এটাতো আর গল্প নয়। অবশ্য গল্প না সেটাও বলা যাবে না। নিজের জীবনের গল্প। যার গল্পের পরবর্তি পর্ব শুধু উপরওয়ালাই জানেন।
ওর আমার সাথে এমন আচরণের কোন মানেই খুজে পাচ্ছি না। এমন তো না যে ও আমাকে পছন্দ করতো না। ওর জন্যই উল্টো আমি কতো কথা শুনেছি। কতোবার আমাদের বাসায় বিয়ের প্রপোজাল নিয়ে এসেছে ফুপি। কিন্তু আব্বু আর আম্মু বার বার মানা করে দিতো।
আবার সেই আমার সাথে রাগ দেখাচ্ছে। তাহলে কি সেদিনের আমার প্রতি ওর দেখানো ভালোবাসা শুধুই বয়সের দোষ ছিলো?
কিন্তু ওর প্রতি আমার ফিলিংসটা তো অল্প বয়সের বাতাস ছিলো না। সেই অনুভূতিগুলো এখনো সাব্বিরকে দেখলে মাথাচারা দিয়ে উঠতে চায় কিন্তু ওতো আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে!!!
নিস্তব্ধ রাতের ব্যঘাত ঘটিয়ে ফোনটা তীব্রস্বরে বেজে উঠায় চমকে উঠলাম ভীষণ!! উফফ, এখন শোয়া থেকে উঠে যেয়ে ঘর থেকে ফোন নিয়ে আসতে হবে। বিরক্তিকর ব্যাপার একটা।
একবার রিং হয়ে থেমে আবার বাজতে শুরু করেছে। নাহ এবার যেতেই হবে। নাহলে আশেপাশের মানুষ যদি চলে আসে? তখন আরেক অসস্তিকর মুহুর্ত তৈরি হবে।
ফয়সাল ফোন করেছে!!!!!!!
ধরবো কি ধরবো না ভাবতে ভাবতে আবার কেটে গেলো। আবার বাজতে শুরু করলো।
-আসসালামু আলাইকুম স্যার। কোনো দরকার স্যার?
কোনো উত্তর নেই। এমন সম্মোধন হয়তো আমার থেকে আশা করেনি তাই বোধহয় কথা বলতে ভুলে গিয়েছে।
এই ছেলেটার লজ্জাশরম আসোলেই নাই। না হলে কোন মুখ নিয়ে আমাকে আবার ফোন দেয়।
-ভালো আছো জান?
-স্যরি স্যার? কি বললেন শুনতে পাইনি।
-জান, স্যরি বলার মুখ আমার নেই। কি বলবো বুঝতে পারছি না।
-স্যার আপনি ভুল করে আমাকে কল করেছেন। আমি বিবাহিত।
-তোর যে ডিভোর্স হয়ে যাবে আমি জানি মেহের। তোরে তো আগেই বলছি, তুই যদি আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করিস তাহলে তোর ১বছরের মাথায় ডিভোর্স হবে তারপর তোকে আমি বিয়ে করবো, বলি নাই তোরে?
-ও তাহলে সব নষ্টের মূলে তুই। কুত্তার বাচ্চা,খা** মা*।
সব শেষ করেও তোর শান্তি হয়না তাই না? এখন আবার অশান্তি করতে আসছিস। দেখ আমার বাপও নাই মাও নাই। আর কোনো ঝামেলা করিস না তুই প্লিজ।
-তোর বাপ মা নাই তো কি হয়ছে, আমি আছি না। তোর ভাইরা যে কেমন সেটাও জানি। নাহলে এতো কিছুর পরেও কিভাবে তোকে সাব্বিরের সাথে বিয়ে দেয়। তোর বিয়ে সব প্রব্লেম সলভ করে দিবো। কয়টা দিন সময় দে আমাকে।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। ওকে এখন কোনো কিছু বলেই বুঝানো যাবে না। নিজে যা বুঝে তাই ওর কাছে ঠিক। যেটার কারণে ওর সাথে ঝগড়া করতাম আর ব্রেকাপ। লাস্ট ব্রেকাপটাও এই কারণেই হয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
-আমার উপর তোর অনেক রাগ তাই না বাবু? তুই যে কিছুই বলবি না আমাকে সেটাও আমি জানি। তোর কোনো কিছু না বলে শাস্তি দেয়াটা যে আরও ভয়ংকর। সবসময় একটা অসস্তির মধ্যে থাকাটা অনেক বেশি কস্টের।
শান্ত কন্ঠে বললাম তুমি আমার সাথে কেন এটা করেছ সে ব্যাপারে আমি কিছুই বলবো না ফয়সাল। তুমি চলে গিয়ে কার সবথেকে বেশি ক্ষতি হয়েছে সেটা সময়ই বলে দেবে। আগে তো কল না ধরলে বাসায় বলে দেয়ার ভয় দেখাতে। কত রকমের মেন্টাল টর্চার করতে আমাকে। এখন ওসব করে লাভ নেই। তোমার কথা বাসার সবাই জানে। আর যেহেতু ডিভোর্স হয়েই যাবে সো শশুরবাড়িতে বলেও লাভ নেই। সাব্বিরকে কি বলেছ সেটা তুমিই ভালো জানো। আরও বলতে মন চাইলে বলিও। ভার্সিটির টিচার হয়েছো, ভালো করে সেদিকে মন দাও। এমন কিছু করোনা যেনো তোমার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পরে যায়। আমার কিন্তু এখন হারানোর কিছুই নেই। মাথায় রেখো কথাগুলো। আর কখনো আমাকে ফোন করবে না তুমি।
বায় বলেই ফোনটা অফ করে দিলাম।
কারণ আমি জানি এই ছেলে সারারাত ফোন দেতেই থাকবে। একটা নাম্বার ব্লক করলে আর একটা থেকে।
একবার তো হলে থাকতে ৮৯টা নাম্বার থেকে কল করেছিলো!!!!!
তারপর বিরক্ত হয়ে ফোন অফ করে রাখতেই হলের পিছনে থাকা খালি জায়গায় এসে আমাদের রুম বরাবর নিচে দাঁড়িয়ে গান গাইতো!!
আর আজ!!!
ওর বাসা থেকে আমাকে কি বলেছে সেটা নিয়ে কোনো কস্ট আমার নেই। আমি ওকে না জানিয়ে বিয়ে করলে কি হবে পরিনামে সেটা খুব ভালো করেই জানতাম। সেখানে ওর পুরো উল্টো আচরণ দেখে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি যে ফয়সাল জানতো যে আমার বিয়ে হয়ে যাবে।
অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়া যাবে না।
সারারাত উঠোনে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। ভোরের দিকে সূর্য উঠার একটু আগে বাড়ির বাইরের উঠানে গেলাম। তারপরে সামনে বিশাল এরিয়া নিয়ে নিচু জমি শুরু। প্রথম দিককার জমিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হচ্ছে আর পরের গুলোতে ধান। এমনি ভোরে এসব খেতের আইল দিয়ে হেটে হেটে ছোটোবেলায় মক্তবে যেতাম কুরআন পড়া শিখতে। কতো মজার ছিলো আমার লাইফটা। আর এখন!!!
খালি পায়ে কি শান্তি লাগছে হাটতে!!! বুক ভরে ঠান্ডা বাতাস নেয়ার আনন্দটাই অন্যরকম! রাতের ডিসিশনটা নেয়ার পর খুব হালকা লাগছে। এতো সুন্দর সকাল অনেকদিন পর উপভোগ করলাম। হয়তো আর উপভোগ করার সময় পাবো না তাই।
কারণ গতকালকে রাতে আম্মুর আম্মুর কবরের মাঝখানে থাকাকালীন সময়ে আমার ফোনে একটা মেইল এসেছে অস্ট্রেলিয়ার নামকরা এক বিশ্বব্বিদ্যালয়ের
একুয়াকালচার ইন্সটিটিউটের এক বিখ্যাত প্রফেসর থেকে। আমার পাঠানো সুপারভাইজার ম্যামের রেফারেন্স সহ একটা রিসার্চ প্রপোজাল তার খুব পছন্দ হয়েছে এবং তিনি আমাকে তিন সেমিস্টারের মাস্টার্স ফুল স্কলারশিপ সহ অফার করেছেন!!!! এবং চাইলে আমি পরবর্তীতে পিএচডিও করতে পারি!!! মা বাবার থেকে এর থেকে বড় দোয়া আর কি হতে পারে।
আর একটু রিশাদ ভাইয়াকে আসতে মানা করে দিয়েছি। সাব্বিরের ঘটনা আবার বাড়ির কাহিনি এইগুলো ফুপিরা জানলে অশান্তি হবে শুধু শুধু । সাব্বির যদি বাসায় না যায় তাহলে কোথায় গেলো ও!! কি লাইফ আমার!!! ইনশাআল্লাহ, খুব শিগ্রই এসব থেকে মুক্তি পাবো!!
কেউ দেখে ফেলার আগেই বাড়ির পিছন দিয়ে বের হয়ে গেলাম। গন্তব্য প্রিমার বাসা। একমাত্র এই একটা জায়গায় আছে যেখানে আমি বিনা সংকোচে যেতে পারি।
দরজা খুলে অানটি আমাকে দেখে জরিয়ে ধরে সেকি কান্না!!! আর বিলাপ করে কতো কিছু বলছেন!! ইশ পুরো মায়ের মতো করে আদর করছেন উনি।।
-আমার বাড়িতে যখন খুশি তখন আইবা আম্মু। আইজকা থেকে এইটা তোমারও বাড়ি। জামাইকে শশুর শাশুড়ী নাই বলে মন খারাপ করতে মানা করবা। জামাইকে নিয়ে এইখানে আসবা। আজকে এইখানে আসছো, থাকবা আর কালকে জামাইকে আইসা নিয়ে যাইতে বলবা, ঠিক আছে আম্মু?
আমি স্মিত হেসে মাথা ঝাকিয়ে আচ্ছা বললাম।
-আম্মু তুমি কি খাইবা বলো আমারে। কত শুকাই গেছো তুমি জানো সেইটা? চেহারাটা কেমন কালো হয়ে গেছে। গতকালকে সারাদিন কিছু খাও নাই তাই না আম্মু? চোখের নিচে কালি কেনো পড়ছে আম্মু? রাতে ঘুমায়তে পারো না শান্তিতে তাই না?
এই ভদ্রমহিলা আর কিছুখন থাকলে আমি হাউ মাউ করে কান্না শুরু করে দিবো। আম্মু মারা যাওয়ার পর এই প্রথম কেউ এইভাবে আমার খোজ খবর নিলো!!!!
উনি রান্না ঘরে যেতেই প্রিমাকে দরজা আটকাতে বললাম। সিগারেট ধরালাম একটা। আমাকে সিগারেট ধরাতে দেখেই প্রিমা বুঝে গেলো আমার লাইফে আবার সিরিয়াস কিছু হয়েছে। তিনটা সিগারেট খাওয়ার পর চার নাম্বারটা ধরাতেই অানটি দরজায় নক করলেই নাস্তা করার জন্য। নাস্তা করে রুমে এসে প্রিমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরলাম।
-কি হয়েছে মেহের বলবি না আমাকে?
-জানিস প্রিমা, আমি তখন ক্লাস ফোরে প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। মেহনাজ আপু সবে এসএসসি পরীক্ষা দিলো। মুবাশশিরা আপু কলেজে আর মিরা আপুর বিয়ে হয়ে একটা বাচ্চাও হয়ে গিয়েছে। বড় ভাইয়া নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। মেজো ভাইয়া জাহাঙ্গীরগর বিশ্বব্বিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে পড়ে। আর ছোট ভাইয়া গ্রামের হাই স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়তো। কি সুন্দর ছিলো আমাদের ফ্যামিলি!!!! খুব বেশি টাকা পয়সা আমাদের ছিলো না হয়তো। কিন্তু কোনো কিছুর অভাব ছিলো না।কেমন করে জানি সব ভাইবোন আমরা সব সিচুয়েশনে মানিয়ে নিতে পারতাম।
বাবা নিজেও একজন স্কুল শিক্ষক তাই তার খুব ইচ্ছে যেমন করেই হোক সবাইকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। কিন্তু জানিস, এই চিন্তাটায় মনে হয় আমাদের জন্যে কাল হলো!!
আব্বু ছোট ফুপি আর মেজো ফুপির কথা খুব শুনতেন। আপুরা যখন একটু বড় হলো ফুপিরা যখনই বাড়ি আসতো বার বার শুধু মুবাশশিরা আর মেহনাজ আপুর বিয়ের কথা বলতো। বলতো গ্রামের মেয়ে এতো পড়ে কি হবে। তারাতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও, আরো কতকিছু বলতো। মজার ব্যাপার কি জানিস, এই দুই ফুপিকে নিয়ে আব্বু আম্মুকে বিয়ে করে অন্য জায়গায় থাকতো শুধু উনাদের পড়াশোনা করানোর জন্য।
আমার সব ভাইবোনরাই অনেক ফরসা। শুধু আমার গায়ের রঙটাই শ্যামলা। এমনকি ছোট ভাইয়াও আমার থেকে ফরসা।
সব থেকে সুন্দরি ছিলো মুবাশশিরা আর মেহনাজ আপু। গ্রামের কতো ছেলে চিঠি পাঠাতো আপুদের। কিন্তু ওরা কেউ সেগুলো গোনায়ও ধরতো না।
ছোট ফুপি আব্বুকে অনেক হাবিজাবি বুঝিয়ে মুবাশশিরা আপুর থেকে বয়সে সতেরো বছর বড় এক বিদেশি লোকের সাথে বিয়ে দিলো।
ঠিক এর দুই মাসের মাথায় তেমন কোনো কারণ ছাড়াই আপুর ডিভোর্স করিয়ে দিলো। ব্যস, আমার সবথেকে রুপে গুনে গুনবতি বোনটার কপালে কলংকের দাগ লেগে গেলো।
এরপর আবার আপু পড়াশোনা শুরু করলো। কলেজের রেকর্ড করা রেজাল্ট টা এখনো মুবাশশিরা আপুর দখলে।
রিশাদ ভাইয়া ছিলো মেহনাজ আপু থেকে চার বছরের বড়। সেই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। মেজো ফুপির সেকি গর্ব ছেলেকে নিয়ে। তার ছেলে এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে থার্ড হয়েছে,নটরডেমে পড়ছে,শিউর বুয়েটে চান্স পাবে।
মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে জোর করে সাব্বিরের কাছে আমাকে পড়তে বসাতো। গ্রামের মেয়ে কি না। একটু পড়ালে পরিক্ষায় যদি পাশ করতে পারি!! কিন্তু পড়ানোর সময় সাব্বিরের বেশিরভাগ কথায় আমার মাথার উপর দিয়ে যেতো। কেমন জানি অস্থির অস্থির লাগতো।
পাশের বাড়ির এক ফ্রেন্ডকে বলতেই বললো আমি নাকি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। এবং এখন যদি এই কথা না বলি তাহলে আর ভালোবাসা হবে না। এই ভালোবাসা মানে কি সেটাই তখন জানতাম না আমি!!!
পরের দিন ঐ ফ্রেন্ডের জোরাজুরিতে সাব্বিরকে পুকুরপাড়ে ডেকে নিয়ে এসে বললাম
-“ভাইয়া তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”
-“কি কথা?”
-“তোমাকে দেখলেই বুকের ভেতর কেমন কেমন জানি করে”
একসাথে অনেকগুলো কথা বলে থামলাম কিছুক্ষন। অন্য সময় হলে হয়তো প্রিমা বলতো, তুই তো ছোট থেকেই এমন ছিলি। কুত্তি একটা। এর জন্যই তো তোর কোনো বোন প্রেম করে নাই আর তুই প্রেমের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে আছিস!
ওর কোল থেকে মাথা উঠিয়ে রকিং চেয়ারটায় বসে একটা সিগারেট ধরালাম।
আবার বলতে শুরু করলাম।
এরপর সাব্বির সবার সামনে অনেক বেইজ্জতি করলো আমাকে। কি বলেছি সেটা না বলে নাকি দয়া দেখিয়েছিলো সেদিন!!
আব্বু কি মারটাই না মারলো আমাকে!! ভিষণ জেদ চেপে গিয়েছিলো। পরের বার পুরো উপজেলায় প্রথম হয়ে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। আর ছোট ফুপি কি বলেছিলো জানিস? বলেছিলো গ্রামের স্কুলতো তাই বৃত্তি পাওয়া খুব সহজ।
মেহনাজ আপু তখন কলেজে ভর্তি হলো। আর রিশাদ ভাইয়ার আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া বেড়ে গেলো। বিষয়টা নিয়ে প্রথমে কেউ মাথা না ঘামালেও যখন রোজার ঈদে সবাইকে ড্রেস কিনে দিলো তখন আম্মু খুব টেনশনে পরে গেলো।
আম্মু খুব ভদ্রভাবে ভাইয়াকে বুঝিয়ে বললো যেনো এই বাড়িতে আর না আসে। কিন্তু ভাইয়া কারো কথায় শুনতো না।
মেজো ফুপি ব্যাপারটা জানতো না সেটা না, কিন্তু উনি সবটাই আমাদের উপর চাপিয়ে দিতো আর আম্মুকে কথা শুনাতো।
এতো কিছুর মাঝেও যখন ভাইয়া বুয়েটে ভর্তি পরিক্ষায় প্রথম হলো তখন ফুপির কথা বলার লিমিটা টাও ক্রস হয়ে গেলো।
দিন দিন রিশাদ ভাইয়ার এই বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তেই থাকলো।
চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here