#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -১৮
শুক্রবার হওয়ায় বেশ দেরি করেই ঘুম থেকে উঠলো পদ্ম। হাই তুলতে তুলতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখলো পাশে তার বড় বোন শাপলা নেই। হয়তো আগেই উঠে গেছে। শাপলা কখনোই বেলা করে উঠে না। ভোর থাকতেই উঠে পরে। সে ছুটির দিন হোক কিংবা অন্য কিছু। ব্রাশটা হাতে নিয়ে উঠোনের দিকে বেরিয়ে পরলো পদ্ম। উঠোনের এক কোনে একটা মাটির চুলা পাতা অনেক আগে থেকেই। সেখানে সচরাচর রান্না হয় না। বেশিরভাগ সময় রান্নাঘরের ভেতরেই রান্না চাপান তিনি। যেহেতু সামনে মেয়ের বিয়ে, আর সে উপলক্ষে রান্নাবান্নাটা আগের তুলনায় বেশি হবে সেজন্য চুলাটা মাটি দিয়ে ভালো করে লেপে দিচ্ছেন আলেয়া। শাপলাকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেলো না। পদ্ম ব্রাশ করতে করতে এগুতে লাগলো ঝিলের পাড়ের দিকে। কাছাকাছি যেতেই কারো ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ কানে এলোর পদ্ম’র। কে কথা বলছে একটু ভালো করে কান খাড়া করতেই বুঝতে পারলো এটা তার বোন শাপলার কন্ঠস্বর। ‘আপা কার সাথে কথা বলে? মনে মনে ভাবলো পদ্ম।
বেশ স্বাভাবিকভাবেই সে এগিয়ে গেলো জলপাই গাছের নিচের সে মাচাটার কাছে। মাচার উপর বসে থেকেই শাপলা কথা ফোনে বলছে। পদ্ম’র উপস্থিতি এখনো পর্যন্ত সে টের পায় নি। পদ্ম শাপলার কাছে গিয়ে শাপলার কাঁধে হাত রাখতেই কিছুটা ধরফরিয়ে উঠলো শাপলা। পদ্ম’কে দেখতে পেয়ে যেনো হাফ ছেড়ে বাচলো সে। বুকে সামান্য থুতু ছিটিয়ে বললো
“ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি আমায়।
পদ্ম ভ্রু কুচকে বললো
“কি এমন করলাম যে এতটা ভয় পাইলি?
শাপলা ফোনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
“সে তুই বুঝবিনা।
“কার সাথে কথা বলছিলি?
শাপলা ক্ষীণ হেসে তাকালো বোনের দিকে। ধীর গলায় বললো
“বলছিলাম কারো সাথে।
“হবু দুলাভাই? কথাটা বলে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে শাপলার দিকে তাকিয়ে রইলো পদ্ম। শাপা হেসে পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে বললো
“হুম।
পদ্ম মাচার উপর গিয়ে বসলে শাপলা তার দিকে তাকিয়ে বললো
“আচ্ছা পদ্ম, আমার বিয়ে হয়ে গেলে তুই খুশি হবি?
“অনেক খুশি হবো। কেন তুই খুশি হবি না?
শাপলা হেসে বললো
“আমি খুশি না হলে কি আর বিয়েতে রাজি হতাম নাকি!
“তা ঠিক।
“আমাকে ছাড়া তোর খারাপ লাগবে না রে পদ্ম?
“তুইও যে আমাকে একা ফেলে বিয়ে করছিস, বরের বাড়ি গিয়ে আমার জন্য তোর খারাপ লাগবে না?
“তখন তো আমার পাশে স্বামী থাকবে। কিন্তু তুই তো একা হয়ে যাবি।
“তখন আমিও একটা স্বামী বানিয়ে নেবো। হেসে হেসে বললো পদ্ম।।
শাপলা চক্ষু দুটো বড় করে বললো
“তুই কি করে বানাবি?
“শ্রাবণ ভাইকে বিয়ে করে নেবো।।
আবারও হাসলো পদ্ম। তার সাথে সাথে হেসে উঠলো শাপলাও। এর মাঝে শাপলার হাতে থাকা ফোনটা ভাইব্রেট দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে কেউ তাকে স্বরণ করছে। কিন্তু শাপলা বার বার ফোনের তাকিয়ে নাম্বারটা দেখছে আর কেটে দিচ্ছে। পদ্ম সেটা খেয়াল করে বললো
“কে ফোন দেয়?
“তোর হবু দুলাভাই।
“আরহাম ভাই? উৎসাহ নিয়ে বললো পদ্ম।
শাপলা নিরবে হেসে বললো
“কে জানে কি ভাই। শুধু জানি তোর হবু দুলাভাই।
“ধরছিস না কেন?
“পার্সোনাল কথা বলব। তোর সামনে কেন বলবো শুনি? তুই চলে যাবার পর কথা বলবো।
“বারে, এখনই আমি তোর কাছে পর হয়ে গেলাম?
শাপলা হেসে বললো
“পর হতে যাবি কেন। সবটাই পরিস্থিতি বাধ্য করে।
দু’বোনের টুকটাক কথার মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে আলেয়ার কন্ঠস্বর ভেসে এলো। তিনি উচ্চস্বরে বলে উঠলেন
“কই রে পদ্ম, নবাবজাদির মতো এতো বেলা কইরা উঠলি। এখন আবার ব্রাশ হাতে নিয়া যে গেলি আর কোনো খোঁজ খবর নাই। আইজ কি তোর খাওন দাওন লাগবো না?
“আইতেছি আম্মা। ক্ষীন বিষন্ন গলায় বললো পদ্ম। শাপলা বোনের মলিন চেহারা দেখে বললো
“হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আয় পদ্ম। এসে শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে কথা বলিস।।
শ্রাবণ ভাইয়ের নামটা শুনেই হঠাৎ মনটা নেচে উঠলো পদ্ম’র। উত্তেজনা নিয়ে বলে উঠলো
“শ্রাবণ ভাই!
“হুম শ্রাবণ ভাই। কল করেছিলো কিছুক্ষণ আগে। তুই ঘুমিয়ে ছিলি তাই ডাকিনি। বলেছে ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে মিস কল দেবার জন্য।
“আমি এখনই খাইয়া আইতেছি আপা। একপ্রকার লাফাতে লাফাতে ঝিলের পাড় ছেড়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো পদ্ম। পদ্ম’র আনন্দ দেখলে শাপলার নিজেরও বেশ খুশি লাগে। মেয়েটা এতো বড় হয়ে গেলো, এখনো বাচ্চাদের মতো লাফায়, বাচ্চাদের মতো কথা বলে। এ-সব ভালোই লাগে শাপলার কাছে।
ভাবতে ভাবতে ফোনটা আবারও বেজে উঠলো। নাম্বারটাতে বেশ ভালো করে চোখ বুলিয়ে রিসিভ করলো শাপলা। স্বাভাবিকভাবেই বললো
“আসসালামু আলাইকুম।
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।
“ফোন ধরছিলে না কেন এতোক্ষণ?
“ছোটবোন ছিলো তাই৷
“সে’তো দেখতেই পাচ্ছিলাম। তাই বলে আমার ফোন তুমি ধরবে না?
“আপনি দেখতে পাচ্ছিলেন মানে? অবাক হয়ে বললো শাপলা। এরপর চোখ ফেরালো ঝিলের ওপাড়ের বাড়িটার পেছন দিকে। একটা কালো রঙ এর টি শার্ট আর সাদা কালো মিক্স থ্রি কোয়ার্টার পরে একহাতে ফোন কানে দিয়ে শাপলার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। ফর্সা রঙ এর ছেলেটিকে এই বেশে দেখতে বেশ দারুন লাগছিলো যদিও, তবুও সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো শাপলা। ভারী গলায় বললো
“আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
“তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে?
দৃষ্টি স্থির রেখে আগের মতো স্বাভাবিক গলাতেই শাপলা বললো
“একটুও না। বাড়িটা আপনার, বাড়ির পেছনটাও আপনার। সেখানে যখন তখন দাঁড়ানোর অধিকার আপনার আছে। আমি শুধু জানতে চাইছিলাম এই যা।
ওপাশ থেকে আরহামের মিষ্টি গলায় হাসির শব্দ শোনা গেলো। শাপলা শুনে গেলো সে হাসিটা, তবে হাসির প্রতিউত্তরে কোনো রকম রেসপন্স সে করলো না। আরহাম নিজেই এবার বললো
“আমি আমার হবু বউকে দেখার আশাতেই এখানে এসেছিলাম। আর অনেক্ষন যাবৎ দেখেও যাচ্ছি।
“অনেক্ষন যাবৎ? খানিক চমকে বলে উঠলো শাপলা।
“হুম। কিন্তু তোমাকে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে দেখছিলাম। কার সাথে কথা বলছিলে তুমি?
“জানাটা কি খুবই প্রয়োজন?
“না। শুধু জানতে চেয়েছি এই যা।
“আমার বান্ধবীকে চিনেন?
“হুম। সবসময় যার সাথে কলেজে যাতায়াত করো যেই মেয়েটার সাথে তার কথাই তো বলছো?
“আপনি চিনেন তাকে?
“খুব।
“ওহ৷
“ওর সাথে কথা বলছিলে?
“নাহ। আমার অন্য এক বান্ধবীর সাথে। মলিন হাসলো শাপলা৷ সে হাসিতে সায় দিয়ে আরহাম বললো
“তোমার হাসিটা বড্ড মিষ্টি।
“আমি জানি সেটা।
“একটা কথা বলবে শাপলা?
“কি কথা?
“এ বিয়েটায় তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
“আপত্তি থাকলে কি বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন?
“এভাবে কেন বলছো। আমি জাস্ট জানতে চাইছি।
“বিয়ে ঠিক হবার পর এইসব জানতে চাওয়ার কি কোনো মানে আছে?
“রেগে যাচ্ছো?
“মোটেও না।
“বলো না তুমি রাজি আছো কিনা?
শাপলা লম্বা করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এরপর দৃষ্টি ফেরালো ঝিলের ওপাশের বাড়িটার পেছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা আরহামের দিকে। সে খুবই উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঠিক যেনো চাতক পাখির মতো। শাপলার দৃষ্টি আরহামের দিকে স্থির রেখেই স্বাভাবিক গলায় বললো
“রাজি না হলে বিয়েটা ঠিক হলো কি করে৷ আমাকে যারা দেখতে এসেছিলো তাদের কে জিজ্ঞাসা করবেন, আমাকে দেখে তাদের মনে এমন কোনো সন্দেহ হয়েছে কিনা যেটাতে বুঝা যায় আমি এ বিয়েতে রাজি না।
আরহাম হেসে বললো
“থ্যাংক শাপলা। আর হ্যাঁ, কারো কাছ থেকে আমার যাচাই করার প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, তোমার কথাকেও বিশ্বাস করি।
বিনিময়ে মৃদু হাসলো শাপলা।
সকালের নাস্তা খেয়ে দেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো পদ্ম। আলেয়ার চুলা ঠিক করা শেষ হয়ে গেছে আরো অনেক আগেই। তিনি এখন মেয়ের বিয়ে নিয়ে বড়’জা জুবেদার সাথে কিসব কথা বলছেন। প্রথমবার তিনি মেয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। তেমন আয়োজন না করলেও উৎসাহের কোনো কমতি নেই তার মাঝে। শ্রাবণদের উঠানের এক কোনায় সেলিমের বউ আসমাকে দেখা গেলো মাটি নিয়ে তা পানি দিয়ে গুলাচ্ছে। এতো মাটি দিয়ে কি করবেন তিনি? জানার আগ্রহ থেকে পদ্ম এগিয়ে গেলো আসমার কাছে। প্রশ্ন করলো
“এই মাটি দিয়া কি করবেন ভাবী?
“সামনেই না শাপলার বিয়ে। বিয়েতে তো অনেক কাজকর্ম থাকবে। ঘরটাকে আগেবাগেই লেপে পুছে ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে হবে তো নাকি।
“এতো বড় ঘর আপনে একা লেপবেন ভাবী? বিস্ময়ে বললো পদ্ম।
আসমা হেসে বললো
“দু’জন পামু কই ননদী।।
পদ্ম আবারও খানিক বিস্ময় নিয়ে বললো
“আপনার ওতো বেশি দিন হয় নাই বিয়ার। এতো তারাতাড়িই এতো কঠিন কাজ চাচী আপনেরে কেন দিলো ভাবী?
পদ্ম’র কথায় আবারও হাসলো আসমা। বললো
“আগে তোমার বিয়ে হোক ননদী। তখন ঠিকই সব বুঝবা।
“এতো বুঝার কাম নাই আমার। ঠোঁট উল্টিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো পদ্ম। জুবেদা আর আলেয়া এখনো গুটুর গুটুর করে কি সব কথা বলেই যাচ্ছে। সেলিম আরো একটা ঝাপিতে করে এক ঝাপি মাটি এনে রাখলো আসমার কাছে। যেনো রান্নাঘরটাও লেপা হয়ে যায়। আসমা এতো এতো মাটি দেখে বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে নিজের বরকে বললো
“একদিনে থাকার ঘর, পাকের ঘর সব কি লেপে শেষ করা যাবে?
সেলিম হেসে বললো
“আস্তে আস্তে করো বউ। সেই তো তোমারই করা লাগবে। কথা না বাড়িয়ে দরকার হলে দুইদিনে করো।
আসমা আর কোনো কথা বাড়ালো না।।
ঝিলের কাছে গিয়ে শাপলাকে গম্ভীর মুখে বসে থাকতে দেখলো পদ্ম। অবাক হয়ে বললো
“তুই এখনো এইখানে বইয়া রইছোস আপা?
“তো কি করমু?
“না কিছু করার জন্য কই না। অনেক্ষন ধইরা বইসা আছিস তো, তাই কইলাম।।
শাপলা হেসে পদ্ম’র হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললো
“এই নে ফোন। তোর শ্রাবণ ভাইরে ফোন দিয়া কথা বল।
এক পা বাড়াতে গিয়েও শাপলা থেমেও গেলো। পদ্ম’র দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
“আর ক’দিন বাদেই তো আমার বিয়ে। তাই নিজের বাড়ির চারপাশটা বেশি সময় ধরে দেখছি রে পদ্ম।
মোবাইলটা পদ্ম’র হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুতপায়ে বাড়ির ভেতর পা বাড়ালো শাপলা।। এই প্রথমবারের মতো নিজের বোনকে অস্বাভাবিক মনে হলো পদ্ম’র কাছে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো তার বোনের চলে যাবার দিকে।
চলবে…..