ঝিলের ওপারে পদ্মফুল পর্ব -১৯

#ঝিলের_ওপারে_পদ্মফুল
তন্বী ইসলাম -১৯

দিন পেরিয়ে গিয়ে রাত পেরোচ্ছে। শাপলার বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে দ্রুত গতিতে। আর মাত্র দু’দিন বাদেই শাপলার বিয়ে। বৃহস্পতিবার বিয়ে। আর বুধবার মানে আগামীকাল শ্রাবণের শেষ পরীক্ষা। যদিও অনেকেই বলেছিলেন বিয়েটা শুক্রবারে দেওয়ার জন্য। কিন্তু শুক্রবার আরহামের জন্ম বার তাই আরহামের মা বাবা ছেলের জন্মবারে ছেলের বিয়ে দিতে নারাজ। গ্রামের মানুষ, তাই নানা ধরনের কুসংস্কার তারা মনে পালন করে থাকেন এবং সে কুসংস্কারকে মনে ধারণ করে ভীত সন্তস্ত্র হয়ে থাকেন। তাদের ধারণা জন্মবারে ছেলের বিয়ে হলে সে বিয়ে কখনোই কল্যাণকর হবে না। ইতোমধ্যে স্কুল থেকে বোনের বিয়ে উপলক্ষে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে পদ্ম। যতই দিন এগুচ্ছে ততই বিয়ের আমেজ বাড়ছে। এখনো তেমন আত্মীয় স্বজনেরা আসেনি, শুধুমাত্র পদ্ম’র একটা ফুফু বাদে। এক গ্রাম বাদেই উনার বাড়ি। বাড়িতেও তেমন ঝোট ঝামেলা না থাকায় আগেবাগেই চলে এসেছেন তিনি। পদ্ম’ও বেশ আমেজে আছে। প্রতিদিন সকালে শ্রাবণ এক্সামে যাবার আগে ওর সাথে ফোনে কথা বলে যায়, আবার এক্সাম থেকে ফিরেও কথা বলে। মাঝেমধ্যে রাতেও বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে শ্রাবণ ভাইয়ের সাথে কথা বলে পদ্ম। এরপর বাকি সময়টুকু বোনের সাথে কাটায় সে। আজও তার ব্যাতিক্রম হয় নি। বেশ কিছুক্ষণ সময় শ্রাবণের সাথে কথা বলার পর ফোন রাখে সে। হল থেকে ফিরে আবারও কল দিবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফোনটা কেটে এক্সাম দিতে চলে যায় শ্রাবণ।

একে’তো বোনের দিয়ে, তার উপর আগামীকাল শ্রাবণ ভাইয়ের এক্সাম শেষ। সন্ধ্যের মধ্যেই সে বাড়ি চলে আসবে। মনের মধ্যে এক অজানা আনন্দের ঢেউ খেলা করছে তার। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঝিলের পাড়ের দিকে পা বাড়ায় পদ্ম। ওখানে যাবার পথে পদ্ম’র ফুফু হাবিবা খাতুন পদ্ম’কে ডেকে বলেন
“এ রে পদ্ম, যাস কই?
“ঝিলের পাড় যাই ফুফ।
“যখন তখন ঐখানে যাওয়া বন্ধ কর তো মাইয়া। এদিকে আয়, মেলা কাম পইরা রইছে। হাত লাগা।
পদ্ম জিভ বের করে ফুফুকে ভেঙ্গিয়ে বলে
“আমি পারমুনা।
পদ্ম ফুফুর দিকে তোয়াক্কা না করে চলে যায় ঝিলের পাড়ে। পেছন থেকে হাবিবা খাতুন আবারও হাঁক ছেড়ে বলেন
“মাইয়া মানুষের একটু লাগাম থাকা লাগে। তোর তো দেখি একটুও লাগাম নাই। এরপর তিনি আলেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন
“এখনও সময় আছে আলেয়া, মাইয়ার হাত পায়ে লাগাম লাগাও।
আলেয়া খানিক হাসলো। বললো
“কেমনে লাগাম লাগামু আপা, ধারা তো পাইছে জাতের।
“জাতের মানে? খানিক ভ্রু বাকালো হাবিবা।
হাবিবা আবারও মৃদু হেসে বললেন
“সবাই কয় মাইয়া নাকি ফুফু গো মতোন হইছে।

হাবিবা কিছু বলতে গিয়েও আর বললো না। মুখ’টা তার দেখার মতো হয়েছে।
হাবিবা খারাপ চরিত্রের মানুষ নন। তবে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরাফেরা করা তার চিরকালের অভ্যাস।

ঝিলের পাড়ে গিয়ে দেখলো শাপলা এক দৃষ্টিতে ও বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে, যে বাড়িটায় তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। পদ্ম’ও সেদিকে তাকালো। এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মাচার কাছে গিয়ে শাপলার পাশে বসলো। ওদিকে তাকিয়ে থেকে চিন্তিত গলায় বললো
“ঐ বাড়িতে কি দেখোস এমনে? দুলাভাই তো নাই ঐখানে?
বোনের কথার ফিরে তাকালো শাপলা। এরপর আবারও ও বাড়ির পেছন দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো
“যদি একবার দেখা পাই।
পদ্ম এবার দুষ্টুমি করে হেসে বললো
“বাহ! প্রেম একবারে মাখোমাখো।
বোনের কথায় আবারও হাসলো শাপলা। তবে এবার আর জবাব দিলো না কোনো।

এক দিন পেরিয়েই শাপলার বিয়ে। বিয়ের বাজার সদাই এখনো কিছু করা হয় নি। যেহেতু আলেয়ার স্বামী কিংবা ছেলে কেউই নেই তাই ভরসা শুধু সেলিম আর তার বাবা। শ্রাবণ বাড়ি থাকলে কাজে কর্মে খুব সাহায্য করতো। তবুও ছেলেটা বাড়ি ফিরে যতটুকু সম্ভব করবে। হাবিবা’র সাথে এইসব কথা চলছিলো আলেয়ার। সেলিমের বাবা কোনো একটা কাজে বাজারে গেছে। ফিরে এলেই তার সাথে বাজারের ব্যাপারে আলাপ করবে আলেয়া। হাবিবা হাতে হাতে কাজ করছে। আসমা’ও নিজের ঘরের কাজ সামলে যতটুকু পারছে পদ্ম’দের কাজে হাত লাগাচ্ছে। কাজের ফাঁকে একসময় শাপলাকে দেখতে গেলো আসমা।
“কি’গো বিয়ার কণে, কি করা হইতাছে?
কথাটা বলতে বলতে ঘরে ঢুকলেন আসমা। খাটের উপর শুয়ে আছে শাপলা। দেখে মনে হলো আসমার কথা শাপলার কান অব্দি গিয়ে পৌঁছুয় নি। সে খুব মনোযোগ সহকারে মোবাইলে কি করছে। দেখে মনে হচ্ছে মোবাইলে কিছু টাইপ করছে সে।

আসমা মৃদু হেসে বললো
“আমাগো হবু দুলাভাই এর সাথে কি মেসেজে কথা কও নাকি শাপলা?
আসমা’র কথাটা কানে যেতেই খুবই স্বাভাবিক ভাবে উঠে বসলো শাপলা। মৃদু হেসে বললো
“বসেন ভাবি।
খাটের এক কোনায় এসে বসলো আসমা। শাপলার নজর তখনও ফোনের দিকে। আসমা শাপলার পেটে হাতের আঙ্গুল দিয়ে সামান্য খোঁচা দিয়ে বললো
“এখনো বিয়াসাধি হইলো না, তার মধ্যেই এতো কিছু।
শাপলা ফোনে টাইপিং করতে করতেই বললো
“কি এতোকিছু ভাবী?
“এই যে, দুলাভাই এর লগে মেসেজে এতো কথা।
“তোমারে কে কইছে আমি মেসেজ করতাছি?
আসমা হেসে বললো
“আমারে বোকা ভাইবো না ননদি। একটু আধটু আমিও বুঝি।
শাপলা হাসলো। এবার ফোনটা হাত থেকে রেখে বললো
“সে নাহয় বুঝলাম। কিন্তু আপনার দুলাভাই এর সাথেই মেসেজ করতাছি এই কথা আপনারে কে কইলো? অন্যকেউও তো হইতে পারে।
“হো শুনছি শুনছি। এইসব অন্যকেউ টা যে কোথাও নাই সেইটা আমরা সবাই জানি। এইসময় মনের মইধ্যে আরহাম দুলাভাই ছাড়া আর কেউ কইত্তে আইবে শুনি। ভ্রু বাকালেন আসমা।
শাপলা হাসলো। আসমা আবারও ফিসফিস করে বললো
“কি ননদী? কথা তো আমার দুলাভাই এর সাথেই হইতাছে তাই না?
শাপলা এবার লাজুক হাসি হেসে বললো
“হুম।

দুপুরে খেয়েদেয়ে একটা লম্বা ঘুম দিয়েছিলো পদ্ম। এতো মজার ঘুমটা হঠাৎ শাপলার ডাকে ভেঙ্গে গেলো। শাপলা পদ্ম’কে বার বার হাতে ঠেলছে। ঘুম ঘুম চোখে বিরক্তিভরা গলায় পদ্ম শাপলাকে উদ্দেশ্য করে বললো
“ডাকিস কেন আপা? একটু ঘুমাইতে দে।
“শ্রাবণ ভাই ফোন করছে।
এক লাফে উঠে বসলো পদ্ম। চোখদুটো টেনে টেনে খুলে রাখার চেষ্টা করতে করতে বললো
“কে ফোন দিছে?
“শ্রাবণ ভাই।
পদ্ম’র ঘুম এবার পুরোপুরি উধাও হয়ে গেলো। শাপলার হাতে থাকা ফোনটা চিলের মতো থাবা দিয়ে নিয়ে এক লাফে বিছানা ছেড়ে নামলো পদ্ম। ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে শাপলার উদ্দেশ্য তিক্ত গলায় বললো
“আরো আগে ডাকলি না কেন আপা?
“আরো আগে তো শ্রাবণ ভাই কল করে নাই। তুই ফোন নিয়া যাস কই?
“ঝিলের পাড়।

_________
“পদ্মফুল’
“হু?
“কি করিস?
“করি না কিছু।
“আগে কি করছিলি?
“কিছুই না।
“শাপলা যে বললো ঘুমিয়েছিলি।
পদ্ম এবার মুখ বাকালো। বললো
“বলছেই যখন আর তুমিও যেহেতু জানো তাইলে জিগাও কেন?
“ইচ্ছা।
পদ্ম আবারও শব্দ করে মুখ বাকালো। ওপাশ থেকে শ্রাবণের মৃদু গলায় হাসির আওয়াজ ভেসে আসলো। পদ্ম বেশ আবেশে উপভোগ করলো সে হাসিটা। কিছুটা সময়ের জন্য যেনো ঘোরের মধ্যে চলে গেলো সে। ঘোর কাটলো আবারও শ্রাবণের ডাকে।
“পদ্মফুল ‘
“কিহ!
“ভালোবাসি রে, বড্ড ভালোবাসি।
হঠাৎ পদ্ম’র সারা শরীর জুরে এক শীতল ধারা বয়ে গেলো। সে শীতল ধারায় শরীর আর মন দুটোই যেনো বার বার শিহতির হচ্ছে। পদ্ম বললো
“আমিও।
আবারও মৃদু হাসলো শ্রাবণ। বললো
“ভালোবাসিস?
“জানো না তুমি?
“তাইলে একটাবারও নিজ থেকে ফোন দেস না কেন?
“আমার কি ফোন আছে নাকি। করুণ গলায় বললো পদ্ম।
শ্রাবণ বললো
“আগামীকাল আসছি বাড়িতে।
“জানি তো।
“তোর জন্য একটা ফোন কিনেছি। নিয়ে আসবো কাল।
পদ্ম অবাক হয়ে বললো
“সত্যিই?
“বিশ্বাস হচ্ছে না আমার কথা?
পদ্ম একটু ঢং করে বললো
“নাহ।
“নাম্বারটা দিকে তাকিয়ে দেখ। এটা তোর ফোনের নাম্বার।
পদ্ম এবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো। একটা অপরিচিত নাম্বার এটা। শ্রাবণ ভাইয়ের নাম্বার তো এটা নয়। পদ্ম অবাক হয়ে বললো
“সত্যিই তুমি আমার লাইগা ফোন কিনছো?
শ্রাবণ মুচকি হেসে বললো
“হুম।
“কেন?
“যেনো তোর সাথে পার্সোনাল ভাবে কথা বলতে পারি। এখন তো শাপলা সুযোগ করে দেয় কথা বলার জন্য। কিন্তু ওর বিয়ে হয়ে গেলে ফোন থাকবে তো চাচীর কাছে। তখন কি আর যখন তখন কথা বলতে পারবো নাকি। ইচ্ছে করলেও আমি আমার পদ্মফুলের সাথে কথা বলতে পারবো না।
পদ্ম হাসলো। মনে মনে খুশিও হলো পদ্ম। পরক্ষণে মনে হলো শ্রাবণ ভাই তো চাকরি করে না। তাহলে ফোন কিনার জন্য এতো টাকা পেলো কই সে?

প্রশ্নটা মাথায় উদয় হতেই পদ্ম বললো
“তুমি টাকা পাইলা কই শ্রাবণ ভাই?
“কিসের টাকা?
“ফোন কেনার টাকা। তুমি তো ঐখানে লেখাপড়া করো, চাকরি তো করো না। তাইলে ফোন কিনলা কেমনে?
শ্রাবণ ক্ষীণ হেসে বললো
“তুই জেনে কি করবি?
“কও না শ্রাবণ ভাই। পদ্ম’র কন্ঠে স্পষ্ট অনুনয়ের স্বর৷ কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর শ্রাবণ বললো
“আমার হাত খরচ থেকে একটু একটু করে জমিয়েছি পদ্মফুল। অনেক দিন লেগেছে একটা ফোনের টাকা হতে।
পদ্ম’র মনটা হঠাৎ ই খারাপ হয়ে গেলো। তার শ্রাবণ ভাই তারই জন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে খরচের টাকাগুলো দিয়ে তার জন্য ফোন কিনেছে। এ টাকাগুলো দিয়ে হয়তো সে আরামসে অনেকদিন শহরের মাটিতে থাকতে পারতো। খুব কান্না পাচ্ছে এবার। ইচ্ছে করছে বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে কান্না করুক।

“পদ্মফুল ‘
“হু! মলিন গলায় উত্তর দিলো পদ্ম।
“কথা বলছিস না কেন?
“শ্রাবণ ভাই’
“কিহ
পদ্ম’র গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ততক্ষণে। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে গেছে। এই বুঝি ফেঁটে চৌচির হয়ে যাবে। পদ্ম তার জিব দিয়ে ঠোঁটটাকে ভিজিয়ে নিলো। ওপাশ থেকে ক্ষীণ গলায় শ্রাবণ বললো
“কিছু বলছিস না যে পদ্মফুল।
পদ্ম এবার মনে সাহস যুগিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে পুরো মুখমন্ডল খিঁচে বললো
“আই লাভ ইউ শ্রাবণ ভাই। আই লাভ ইউ।
কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো শ্রাবণ। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তার পদ্মফুল বাস্তবেই তাকে এই কথাটা বলছে। শ্রাবণ নিজের কানকে বিশ্বাস করানোর জন্য হাতে সামান্য চিমটি কাটলো। নাহ সে স্বপ্নে নয়, বাস্তবেই বিচরণ করছে।।

সন্ধ্যার আগ নাগাদ বাজার থেকে ফিরলো সেলিমের বাবা। সেলিমও সাথেই আছে। তাদের দু জনেরই চোখমুখে চিন্তার ছাপ। কপালে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট। জুবেদা ব্যাপারটা খেয়াল করে আলাদা করে স্বামীকে ডেকে সাইডে নিলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন
“আপনেরে এমন চিন্তিত দেখা যায় কেন? কোনো সমস্যা হইছে সেলিমের বাপ?
“আলেয়া, হাবিবা ওরা কই সব?
“ঘরে। কাম করতাছে।
“ওগোরে ডাক।
“কি হইছে আমারে কন।
সেলিমের বাবা হঠাৎ চোখমুখ শক্ত করে কড়া গলায় ধমকানোর সুরে বললেন
“কইলাম না ওগোরে ডাকতে। বেশি কথা কস কেন? তারাতাড়ি ডাইকা আন সবাইরে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here