টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ২৩

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
“হ্যালো? হ্যালো? আপনি কলে আছেন ভাবী?”
ফোনের অপরপাশের মানুষটির কথায় ঘোর ভাঙে চৈতালীর। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে।

তার মানুষটি যে ভালো নেই। হ্যাঁ, তার ব্লক মারার চার দিনের মাথাতেই ফাহিমের এক্সিডেন্ট হয়। তারপর থেকে হাসপাতালের বাসিন্দা সে

“ফাহিম কেমন আছে? কোন হাসপাতালে ও?”

“ফাহিম তো সিটি হসপিটালে ভর্তি। কিন্তু আপনি তা জেনে… মানে আপনি তো ওকে ছেড়ে চলে গেছেন শুনেছি।”

বুক কেঁপে উঠল চৈতালির। সত্যিই মানুষটাকে যখন একা করে দিয়ে চলে এসেছেই সে। তবে তার কী হক আছে খোঁজ-খবর নেওয়ার!

স্তব্ধ গলায় সে “ধন্যবাদ” বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দেয়। আপন মনেই ভাবতে থাকে,

– এবার কেন খোঁজ খবর নিবি রে তুই? ছেলেটাকে কম তো পোড়ালি না। জানিস ছেলেটা তোর পাগল, তবুও তো একা করেই দিলি।

নিজেকে ধিক্কার জানাতে শুরু করে রমণী। তবে তাতে কী আর অতীত শুধরে যাবে? যেই বীজ রোপণ করেছে, সেই ফল তো পেতেই হবে।

অনেক ভেবে-চিন্তে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে সিটি হাসপাতাল যাবে ফাহিমকে দেখতে। ঐ মানুষটির সাক্ষাৎ পাওয়া না অবধি তার মনে শান্তি অনুভব হবে না। যদি এক পলকের দর্শন পায় তা-ই তীর্থযাত্রা।

পরনে থাকা শাড়িতেই পার্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে। কিন্তু হাসপাতালে ঢুকতেই আরেক ঝামেলা, রুম নাম্বার বা কয় তলাতে কিছুই তো তার জানা নেই।

রিসিপশনিস্ট একজন অহংকারী ও রূঢ়ভাষী নারী। তার কাছে জিজ্ঞেস করতেই কেমন যেন তেঁতে উঠে সে। বহু কষ্টে অনেক অনুরোধের দ্বারা ফাহিমের অবস্থান জানতে পারে।

বন্ধ লিফট বেয়ে উপরে উঠার সময় মনে অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে তার। কতদিন পর আজ স্বচক্ষে ফাহিমকে দেখবে! তার অনুভূতির স্থায়ীত্ব হয়তো খুব বেশি সময় থাকবে না।

কেবিনের সামনে আসতেই শুনতে পায় একজন অপরিচিত নারীর হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠ। চমকিত হয়। আড়াল হয়েই উঁকি দেয় কেবিনে। সাথে সাথেই যেন হৃদয়ের মধ্যিখানে হাজার খাণেক সুঁই এসে আঘাত করল। কী চিনচিনে বেদনা সে যে!

ফাহিমকে এক অচেনা নারী একটু একটু করে স্যুপ খায়িয়ে দিচ্ছি। তাদের হাস্যরসিক কথোপকথনে হাসি ছুটছে দুজনের মুখ থেকে। কিন্তু চৈতালির এত কষ্ট কেন? সে তো চলে গিয়েছিলই ফাহিমের প্রেমিক হৃদয় শূণ্য করে, তবে শূণ্য ঘর অন্য কেউ পূর্ণ করলে এত কেন লাগছে।

দুনিয়ার রীতি তো এটাই, কোনো স্থান বা পদবিই সারাজীবন শূণ্য থাকে না। শূণ্য হলে যে একসময় তা পূর্ণ হবেই। হোক তা মানুষের হৃদয়!

অতঃপর ভঙ্গিত হৃদয় নিয়ে বেরিয়ে আসে সে হাসপাতাল থেকে। ফাহিমের চোখের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার মাঝে আর বেঁচে নেই।

___

অরবিন্দ ভট্টাচার্যের বাসা থেকে বের হতেই নায়িমের আরেকটা গানের পরিচালকের কল আসে। নায়িমের মাথায় যেন বাজ পড়ে এই প্রজেক্টের কথা ভুলেই বসেছিল সে। লোকটার প্রজেক্ট এতদিন বাজিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।

“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি অনেক বেশি দুঃখিত। প্রজেক্টটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিলাম।”

“হুম, আমিও তাই-ই ভেবেছি। নাহলে তোমার মতোন ছেলের এতটা ইনডিসিপ্লিন, আনপ্রোফেশনাল বিহেভ কীভাবে সম্ভব! যাই হোক, তুমি কি এখন ঢাকায়?”

“হ্যাঁ, স্যার। কেন বলেন তো?”

“গ্রেট! শুনো স্টুডিও রেডি আছে। গানটা আজই রেকর্ড করে ফেলি, শুটিং পড়ে করব নে। তাহলে নির্ধারিত রিলিজ ডেটের মধ্যে হয়তো কমপ্লিট করা সম্ভব।”

“কিন্তু কোনো প্র‍্যাকটিস ছাড়া আমি কী করে…?”

“আরে ছেলে তুমি হলে কি না ন্যাচরাল। একদম জন্মগতভাবে পাওয়া প্রতিভা তোমার। কিচ্ছু হবে না, তুমি পারবে। এসে পড়ো।”

উপায়হীন হয়ে রাজি হয় নায়িম। সেখান থেকেই উবার দিয়ে সোজা যায় স্টুডিওতে।

কিন্তু কাজ করার সময় কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল তার। মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিচ্ছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খোঁজে সে, সন্দেহ করার মতো কাউকেই পায় না৷

“আরে নায়িম, মন কই তোমার? আজকের মধ্যে রেকর্ডিং শেষ করতে হবে। কাজে মনোযোগ দাও রে বাবা।”

পরিচালক সাহেবের তাগাদা দেওয়ায় আর নিজের মনের অস্বস্তিতে ধ্যান দেয় না সে। কাজে মনোযোগ দেয়। এই সামান্য অসতর্কতাই কী ঝড় বয়ে আনবে তার জীবনে!

___

কেটে গেছে বেশ কিছুদিন, নাহিবাও একটু বড় হয়েছে৷ নায়িমকে বেশ ভালোই চিনে সে, দেখলেই মিটিমিটি হাসে। নায়িমও প্রতিনিয়ত চিকিৎসা নিয়ে যাচ্ছে অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে। বাসন্তীও এখন আগের নীরব বালিকা নেই, রায় বাঘিনী হয়েছে৷ যদিও নায়িমের সম্মুখে তার এই সাহস ধরে রাখা খুবই কঠিন।

আজকে দুপুরেও নায়িমকে নিয়ে অরবিন্দ ভট্টাচার্যের কাছে। সেই কখন থেকে বাসন্তী তাকে তৈরি হতে বলছে, কিন্তু যুবক তার কথা একদম উপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই খামখেয়ালিপনা দেখে রীতিমতন রেগে উঠছো বাসন্তী।

“কী অবস্থা! তুমি এখনো রেডি হওনি কেন? যাও, শাওয়ারে যাও।”

নায়িম একবার গম্ভীর চাহনিতে তাকে দেখে আবারও টিভিতে মনোযোগ। কে জানে কী বুঝে এতে বাবার কোলে শুয়ে থাকা নাহিবা, চওড়া হাসি ফুটে উঠে তার মুখশ্রীতে।

বাসন্তী রেগে টিভির মেইন সুইচ বন্ধ করে দেয়। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

“তুমি কি যাবা না কি যাবা না? আমার তোমাকে সারাদিন যাও, যাও বলার সময় নাই। সিঙ্কে যেয়ে দেখো কত থালাবাসন জমে আছে।”

“আজ নাহিবার টিকা আছে। ওকে টিকা দিতে নিয়ে যেতে হবে আমি কোনো অরবিন্দ-মরবিন্দের কাছে যাচ্ছি না।”

বাসন্তীর মনে পড়ে যে আজ সত্যিই নাহিবাকে টিকাদানের তারিখ। বাসন্তী ভাবুক হয়ে পড়ে।

– হ্যাঁ রে বাসন্তী, বাবুর তো আজ টিকার তারিখ। কিন্তু অরবিন্দ বাবুও তো কাল ইন্ডিয়া যাচ্ছে প্রায় সপ্তাহ খাণেকের জন্য। নায়িমের সেখানাও যাওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

“দেখেন, আপনার ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা আজ জরুরি। কিন্তু বাবুর ডাক্তার…?”

চৈতালি মাঝ থেকেই উত্তর দিয়ে বসে,

“আমি নিয়ে যাব নে।”

“তাহলে তো হলোই, বাবুকে টিকা দিতে চৈতালি আপু নিয়ে যাবে। আপনি আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন।”

নায়িমের চোখ-মুখ কুঁচকে যায় রাগে, বিরক্তিতে। চৈতালি তার দৃষ্টিতে একটি অপবিত্র নোংরা কীটের থেকে কম কিছু না। নিজের মেয়েকে সর্বক্ষণই নিজ কোলে রাখে চৈতালির থেকে দূরে। যাতে এই তরুণীর অপবিত্র দেহের পরশ নাহিবার গায়ে না লাগে।

আগের থেকে রাগ তার তুলনামূলক কমলেও পবিত্রতা নিয়ে অবসেশনে খাদ পড়েনি এখনো। যদিও হিংস্রও এখন খুব কমই হয় সে।

“না, দরকার নেই। আমার মেয়েকে আমিই টিকা দিতে নিয়ে যাব।”

অনিমেষ হয়তো বুঝতে পারল বন্ধুর মনোভাবটি। তাই সে আত্মস্থ করে বলল,

“আরে সমস্যা নেই, তুই যা। আমি আছি তো এখানে।”

অনিমেষের অনেক বোঝানোর পর নায়িম এই প্রস্তাবে রাজি হয়। বাসন্তী ও অনিমেষ তৈরি হয়ে উত্তরার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।

___

নায়িম ও বাসন্তী এপার্টমেন্টের নিজ ফ্ল্যাটের ফ্লোরে পা রাখতেই দেখতে পায় এপার্টমেন্টটি কেমন সর্বস্বান্ত। একটু এগিয়ে যেতেই দেখে তাদের ফ্ল্যাটের দরজা খুলা। জানা ভয়ে বুক কেঁপে এই দম্পতির।

বড় বড় পা ফেলে ফ্ল্যাটে ঢুকে দুজন। এ কী অবস্থা ফ্ল্যাটের! পুরো ফ্ল্যাটে যেন টর্নেডো বয়ে গেছে, এমন ভাবে তছনছ হয়ে আছে সবকিছু। নায়িম তো নিজেকে শক্ত রেখে বাসন্তীর যেন পাগল হওয়ার দশা।

“নায়িম, আমার মেয়ে কই?” বলতে বলতেই পাগলের মতোন দুই শোয়ার ঘর সহ পুরো ফ্ল্যাটে খুঁজতে শুরু করে চৈতালি, অনিমেষ ও তাদের কলিজা নাহিবাকে।

কোথাও এই তিনজন মানুষের ছায়া অবধি নেই। যেন এক দমকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে তিন জন জ্যান্ত মানব।

“আমার মেয়ে!” ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বাসন্তী।

ঠিক তখন নায়িমের ফোনে টুং শব্দ বেজে উঠে। একটা খবরের লিংক। ক্লিক করতেই মাথায় যেন আরেক দফা আকাশ ভেঙে পড়ে।

“গায়ক নায়িম বিবাহিত, লিক হয়েছে তার বিয়ের ছবি এবং ফুটেজ।” এই শিরনামে ভরে আছে প্রতিটি নিউস চ্যানেল।

কী করবে এবার নায়িম? এতগুলো বিপদ একসাথে কীভাবে সামলাবে সে? নায়িমের বাস্তবতা কি এবার লোক চক্ষুর সম্মুখে এসেই পড়বে?

চলবে…
সরি সরি গতকাল রাতে একটার বেশি বেজে গিয়েছিল শেষ করতে। তাই আর দেইনি। আবার উঠলামও মাত্র। পরবর্তী পর্ব আজকে রাতে আসবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here