টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৩৭

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৭তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নাহিদ কাঠের জীর্ণ চেয়ারে বসে ভয়ে কাঁপছে। সামনের মানুষটি যে ক্ষুব্ধ হয়ে পায়ে পা তুলে বসে।

নায়িম নিঃশ্চুপ হয়ে পর্যবেক্ষণ করছে এই যুবককে। আজ তার মেজাজ বেশ চটে। শুধুই রেগেই নেই সে, ঈর্ষান্বিতও। সদ্য যুবক এই চাপদাড়ি ওয়ালা ছেলের কাছে কেন যেন ছোটো ছোটো লাগছে নিজে নায়িমের। বয়স তো তার কম নয়, ত্রিশের গণ্ডি পেড়িয়েছে অনেক সময় এখন। নিশ্চয়ই বাসন্তীর কাছে তার সমবয়সী ছেলের মূল্যই বেশি হবে।

সকালে যখন বাসন্তীর পিছনে আঠার মতোন লেগে থাকতে আদেশ দেওয়া গুপ্তচর ভিডিও পাঠালো ছেলেটির সাথে বাসন্তীর রেস্টুরেন্টে বসে হাসাহাসির, সেই মুহূর্তেই ঢাকার বারিধারা থেকে তুলে খান বাড়িতে আনার নির্দেশ জারী করে সে। আবার দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ দেখেও অমর্ষিত হতে বাকি নেই তার। কত বড়ো সাহস এই ছেলের তার বসন্তকে দেখে মুচকি হাসে, পর্যবেক্ষণ করে।

আর থাকতে না পেরে নীরবতা ভাঙিয়ে নাহিদই প্রশ্ন করে,
“স্যার, আমি কি কোনো ভুল করেছি? আমাকে কেন তুলে আনা হয়েছে?”

“বাসন্তীকে কেমন লাগে তোমার?”

এমন বেমানান প্রশ্নে ঘাম ঝরে যায় যুবকের। নায়িম চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে তার দিকে।

“কী হলো উত্তর দিচ্ছো না কেন রাস্কেল!”

“খারাপ লাগে না স্যার। ভালোই তো ম্যাডাম। বুদ্ধিমতী, বুঝদার, দয়াশীল।”
কোনোরকম হেসে আমতা আমতা করে জবাব দেওয়ার প্রচেষ্টা নাহিদের।

নায়িম তৃপ্তি পায় না যেন চেয়ার থেকে উঠে, নিজ চেয়ারটাই লাথি মেরে ফেলে দেয় সে। নাহিদ বুঝলো প্রকৃত অর্থে আঘাতটা তার উদ্দেশ্যে ছিল।

“শোনো ছেলে, যা আমার তা অন্যকারো সামনে আসাও পছন্দ নয়। তাকে কেউ স্পর্শ করুক তো দূরে থাকে, মুগ্ধ চোখে দেখলেও সেই চোখ নষ্ট করতে আমার হাত কাঁপে না। বুঝলে তো?

আর আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং দামী রত্ন হলো বসন্ত। তার সাথে রেস্টুরেন্টে বসে কেউ হাসাহাসি করবে, চা, তান্দুরী খাবে… উহু, এ আমার সহ্যের বাইরে। ঐ মানুষটাকেই না আমি আগুনে ফেলে তান্দুরী বানাবো। তুমিই বলো ভালোবাসার মানুষের সাথে কাউকে সহ্য করা যায়?”

নাহিদের চেয়ারের দিকে ঝুঁকে অন্যদিকে তাকিয়ে ছটফটে ভঙ্গিমায় কথাটা বলে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে নাহিদের চোখে চোখ রাখে। তার ঠোঁটের কোণে অতি পরিচিত ক্রুর বাঁকা হাসি।

নাহিদ ভালোই বুঝলো নায়িমের ইঙ্গিতময় কথাবার্তা। তার বেহাল দশা, মূত্রত্যাগ করেনি সে সকাল থেকে। ভয়ে না ইজ্জতভ্রষ্ট হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে মাথা ঝাঁকায় সে।

নায়িম যুবকের মাথার চুলগুলো বা’হাতে এলোমেলো করতে করতে শুধায়,
“যাকগে সেসব, শুনলাম তোমার না কি ম্যানেজারের পোস্টে চাকরিটা করতে ভালো লাগছে না? তাহলে আগামীকাল থেকে আর চাকরিতে যাচ্ছো না, বাসায় থাকছো তাই না?”

সঙ্গে সঙ্গে মুখ খুলল নাহিদ,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি আর কোনো চাকরি-বাকরি করবো না। বাড়ি যেয়েই মধু মিয়াকে কল করে রিজাইন করবো।”

নায়িমের চোখে-মুখে তৃপ্তি। পাশের কালো পোশাকধারী তরুণ দুজনকে ইশারা করতেই নাহিদের হাত ধরে তারা কক্ষের বাহিরে চলে যায়।

পাশে দাঁড়িয়ে আপন ধ্যানে মুড়ি চাবাতে থাকা অনিমেষকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“দেখলি কেমন শায়েস্তা করলাম একে! আর কোনো ছেলে যাতে বাসন্তীর আশেপাশেও না আসে। স্পেশালি অল্পবয়স্ক ছেলে তো না-ই।”

“আরে ব্যাটা এত হিংসা করিস কেন? তাও আবার এদের সাথে! এগুলো তো তোর…”

“নখের যোগ্যও না, তাই তো? কাউকে ছোটো ভাবে দেখা ঠিক না, বিড়াল কখন বাঘ হয়ে যায় বলা যায় না।”

“আরে ব্যাটা বলতে তো দিবি। আমি কি কমন ডায়লগ দিব না। তাছাড়া তোর মতোন নখ অনেকের আছে। এগুলোর তোর পাদেরও যোগ্যতা নেই।”

“হোয়াট অনি! ইয়াক!”

“আরে সত্যিই তো বলসি। তোর পাদে যেই গন্ধ, তা আর সারা দুনিয়ার কারো পাদে নেই।”

“হ, তোর সামনে দিয়েছিলাম তো, আর তুই শুঁকেছিলি!” মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যায় নায়িম।

অনিমেষ মুড়ি চাবাতে চাবাতে বিড়বিড়ায়,
“শালা রে একদিনও রোস্ট করতে পারলাম না। ও-ই আমাকে রোস্ট করে দেয়।”

___

মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব হওয়ায় ঘুম থেকে হুড়মুড়িয়ে জেগে উঠে ফাহিম। তন্দ্রাভাব কাটতেই দেখতে পায় পূর্ণতা। কিছুটা বিব্রতভাব আসে তার মাঝে।

“পূর্ণ, তুমি এখানে এভাবে…?”

“জী, আমি এখানে, এভাবে। আমার ছোঁয়ায় বুঝি গা ঘিনঘিন হচ্ছে আজ আপনার? কারণ বুঝি আমি ধর্ষিতা, কারো ব্যবহার্য বলেই? কিন্তু এখানে আমার কী দোষ ছিল? আমি তো ইচ্ছে করে করিনি এসব। আপনিও তাড়িয়ে দিবেন আমায়?” ফুঁপিয়ে ফুঁপিতে নাকে-কানে লালচে আভা ছড়িয়ে কেঁদে উঠে রমণী।

সামলাতেই একটু এগিয়ে যেয়ে গাল মুছে দেয় ফাহিম। উদ্বিগ্নচিত্তে শুধায়,
“তুমি ভুল ভাবছো পূর্ণ। আমি এটা বুঝাইনি। না তোমাকে আমি তাড়াবো। তোমার দোষ নয় তা। এতটা কাছে তো কখনো আসেনি, তাই… এটা ঠিক নয়।”

“আপনি আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না ভালো। তবে কেন আপন করে নিচ্ছেন আমায়? বুঝেন না ভালোবাসী? এত অবুঝও কোনো পুরুষ হয় না যে নারীর ভালোবাসার আবেদন বুঝবে না।”

থমকে যায় ফাহিম। সত্যিই সে প্রতিবার বুঝেছিল পূর্ণতার আবেদন, ইশারা। তবে প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ছিল শুধুই না বুঝার ভান। কারণ কোথাও একটা বাধা। কীসের বাধা কে জানে? হয়তো অতীতের, প্রথম প্রেমের, সম্পর্কের টানে।

জাগতিক, দৈহিক, মানসিক চাহিদা ও নিঃসঙ্গতার কাছে হার মানা ক্লান্ত মস্তিষ্ক বারবার বলেছিল এ ইশারায় সাড়া দিতে। যুক্তি দেখিয়েছিল, ‘একা সারাটা যৌবন কাটানো খুব করুণ, তার চেয়ে মুশকিল নিঃসন্তান জীবন, আর সবচেয়ে কঠিন বার্ধক্যে একা কাটানো’। তবুও হৃদয়ের কোনো এক কোণ থেকে, গহীন থেকে বাঁধায় সে সাড়া দেয়নি। আজও পারলো না।

“পূর্ণ, নিজের ঘরে যাও। তোমার হুশ নেই উত্তেজনায়। পরে কথা হবে।”

“আমার জ্ঞান একদম ঠিক আছে। এত লুকোচুরি কেন ফাহিম? চৈতালি আপু তো চলে গেছেন। একবারও ফিরে তাকাননি, আমাকে কেন কাছে টেনে নিচ্ছেন না আপনি?”

“যতো যাই হোক, চৈতালি এখনও আমার স্ত্রী। আমি বিবাহিত তা এতটাও ভুলো না। ওর থেকে দূরে থাকলেও তালাক দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই।”

“কবুল করলাম, ফাহিম।”

“তুমি বুঝছো না কেন পূর্ণ? আমাকে বিয়ে করা মানে ধ্বংস বৈকী কিছুই না। কারণ আমি চিনি আমাকে, চৈতালি যতই ভুল করুক, চক্ষুর সম্মুখে ওর আকুতি দেখলে সারা দুনিয়া ছেড়েও আমি ওর দিকেই অগ্রসর হবো। তখন মেনে নিতে পারবে?”

“কবুল।”

“আমি তোমাকে ভালোবাসি না। চৈতালির জায়গা তুমি কখনোই পাবে না।”

“কবুল। তবুও আমাকে সহধর্মিণীর জায়গা দিন। সতীনের সংসার, অবহেলার সংসার করতেও আমার অভিযোগ নেই। সবশেষে নাহয় আমাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যই বিয়ে করুন। আমি বেহায়া হয়েছি ফাহিম, নিজের রূপ, গুণ, কাজ সব দিয়ে আপনাকে চেয়েছি। চৈতালি আপুর আকুতি দেখে ভালোবাসা জাগলে, আমার আকুতি দেখে কি করুণাও জাগে না?”

“ঘরে যাও, পূর্ণ। আমি রেগে যাচ্ছি।”

ধমকের সুর ফাহিমের। পূর্ণতা কেঁপে উঠে মুখে ওড়না চেপে চাপা ক্রন্দনের সহিত স্থান ত্যাগ করে।

ফাহিম ফোঁস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে। তার মন, মস্তিষ্ক দুটোরই শোচনীয় দশা। কোথায় যাবে বা কী করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। হুট করেই ফোনটা হাতে নিয়ে কল করে চৈতালির নম্বরে। তার স্বস্তির জায়গাটি যে এই নারীটিই ছিল, আছেও হয়তো।

চৈতালি বসে বসে সাদিয়া খান সুবাসিনীর সূর্যতামসী পড়ছিল। কল আসায় বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে নেয় সে। স্ক্রিনে ভেসে উঠা নাম পড়তেই দমবন্ধ অনুভূতি হয় তার, হাত-পা কম্পিত হচ্ছে সমান তালে। কলটা কাঁপা হাতেই কেটে দেয়।

“কলটা কাটলেন কেন, চৈতি? হয়তো ফিরে পেতে চলেছিলেন ভালোবাসা।” অনিমেষ জিজ্ঞেস করে উঠে। সে সদ্যই ঘরে ঢুকেছিল।

“এখন সম্পর্কটা ফিরে পেলেও আগের সম্মানটা পাব না। প্রিয় মানুষটার চোখে দেখবো না আর নিজের জন্য বিশ্বাস। ঝগড়াতে হয়তো রাগের মাথায় অজান্তেই খোঁটা দিয়ে আমার হৃদয় ভঙ্গ করে বসবেই।

জানেন তো, পরের কথা সহ্য করার ক্ষমতা থাকে, আপন মানুষের না। কিছু ক্ষেত্রে দূরত্বই ভালো। ভালোবাসাটা তাও ভালো থাকে। অনেক তো মলিন হলো আর কত?”

চৈতালি লাগোয়া ওয়াশরুমে চলে গেল। অনিমেষ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওয়াশরুমের দরজার দিকে।

এদিকে ফাহিম কল কেটে দিয়েছে বুঝতে পেরে কষ্টে, রাগে বৃষ্টি নামিয়েই ফেলল আজ নয়নযুগল থেকে। রিনরিনে গলায় বলল,
“বিরহ তো আমি দিয়েছিলাম, অভিমান এবার আমার পাওনা ছিল। ভাঙানোর চেষ্টা অবধি করোন। ভুল করার অধিকারের সাথে, অভিমানটাও বুঝি তোমার?”

___

বাসন্তী ঢাকা এসেছে মধু মিয়ার সাথে। গতকালই রিজাইন করেবে বলেছে নাহিদ মধু মিয়াকে। কাল পর্যন্ত হিসাবটা বুঝে নিতেই আসা রমণীর। যদিও যুবকের হুট করে চাকরি ছাড়ার বিষয়টি তার বোধগম্য হলো না।

সব হিসাব বুঝে খাতা নিয়ে আপাদত সেলসম্যানের ভরসায় শো-রুমটি রেখে বের হয় সে। গাড়ির দরজা খুলতেই দেখতে পায় চন্দ্রমল্লিকার সমাহার, একটি চিরকুটও সাথে। তবে কি নব দিওয়ানা এলো বাসন্তীর?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here