#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৪তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
পাগল প্রায় হয়ে ফ্লাট থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক ছুটতে লাগে নায়িম। বাসন্তী জ্ঞান হারিয়েছে বহু আগেই। হুট করেই নিচতলার সিঁড়ির নিচ থেকে কারো মৃদু আর্তনাদের শব্দ শুনতে পায় সে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে৷
মাথা ঝুঁকিয়ে উঁকি দিতেই দমবন্ধ অনুভূতি হয় তার। রক্তাক্ত মুখশ্রীর অনিমেষের গায়ে গা এলিয়ে চোখ বুজে আছে চৈতালি। চৈতালির কোলের মাঝে রক্ত লাল দেহ নিয়ে শায়িত আছে ছোট্ট নাহিবা।
“নাহিবা? আমার প্রিন্সেস?” বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বলে নায়িম।
নায়িমের কণ্ঠ শুনে অদম্য আনন্দ নিয়ে চোখ তুলে তাকায়। বুক চিড়ে তপ্ত এক শ্বাস বেড়িয়ে আসে, কিছুটা দুঃখ সমাপ্তির আনন্দের, কিছুটা বিষাদের। তারপর জ্ঞানহীন চৈতালিকে নিয়ে কোনোরকম বাহিরে আসে সে।
নায়িম তখনো স্তব্ধ। রক্তাক্ত নাহিবার দর্শনে যে তার হৃদয়ে বিষক্রিয়া হচ্ছে। ধীর কণ্ঠে তাকে ডেকে উঠে অনিমেষ,
“নায়িম, নাহিবাকে কোলে নে! চৈতালিকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে।”
“আমার নাহিবা আর নেই তাই না?” কেমন যেন ঘোর লাগা গলায় বলে উঠে নায়িম। দুঃখের ঘোরই হয়তো।
“কী বলছিস এসব? আমাদের নাহিবা একদম ঠিক আছে। এত কথা বাদ দে, হাসপাতালে যেতে হবে।”
হুট করে মরুভূমির উত্তপ্ত রোদ্রে মৃত গোলাপটির মাঝে সতেজতা ফিরে এলে যেমন বোধ হয় তেমনই বোধ হলো নায়িমের। সে যেন সকল সক্ষমতা, বোধশক্তি ফিরে পেল। তাড়াতাড়ি নাহিবাকে কোলে তুলে নেয়। অনিমেষকে ধরে গাড়ির কাছে নিয়ে যেয়ে বসায়। তার কোলে নাহিবাকে দিয়ে আবার চৈতালিকে নিয়ে আসে। তারপর আবার ফ্ল্যাটে ফিরত যায় বাসন্তীকে নিতে।
একা একটা মানুষকে সামাল দিতে হচ্ছে তিনজনকে। সাহায্য করার কেউ নেই। একেই বলে অসহায়ত্ব।
হাসপাতালে নেওয়ার সাথে সাথেই চৈতালিকে এডমিট করা হয়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষয়ে তার অবস্থা শোচনীয়। বাসন্তী সুস্থ আছে, তবুও তাকে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। অনিমেষের তেমন বড় ক্ষতি নাহলেও মাথায় দুটো সেঁলাই পড়েছে।
নায়িম অনিমেষের পাশে বসে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“এসব কী করে হলো? আর নাহিবার গায়ে যদি কোনো ক্ষতই না হয়, এত রক্ত…?”
“চৈতালির রক্ত। মেয়েটা তোর মেয়েকে বাঁচাতে নিজের জীবনে কুরবানি দিয়ে দিচ্ছিল।
তোরা যাওয়ার পর আমরাও ক্লিনিকে যাই বাবুকে টিকে দিতে। কিন্তু এসে দেখি সদর দরজা খোলা ফ্ল্যাটের। ভাবি হয়তো তোরা এসেছিস। কিন্তু ঢুকতেই দেখতে পাই একঝাঁক অজানা গুন্ডা টাইপের লোক। ভীতিগ্রস্ত হই৷ পালাতে চাই তার আগেই চার জন আমাকে ধরে ফেলে। একজন হকি স্টিক হাতে তোর মেয়ের দিকে এগুতে থাকে। চৈতালি ভয়ে স্থবির হয়ে গিয়েছিল।
চৈতালি নাহিবাকে নিজের কোলে আড়াল করে নিজে সেই আঘাত সয়। আবারও মারতে গেলে সেই আঘাতও ওর মাথায় পড়ে। আমাকে মারধর করে। অনেক কষ্টে পালাই ওদের নিয়ে। সুযোগ বুঝে দুজনকে ল্যাং মেরে ফেলে, বাকিদের ধাক্কা দিয়ে পালাই আমরা। কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না। কারণ গাড়ির চাবিও ঘরে। সিঁড়ির নিচেই লুকাই আমরা। ভাগ্যের জোরে আজ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলাম মনে হচ্ছে।”
নায়িমের মনে আরেক ভাবনার ঝড়। যেই মেয়েটাকে সে অপবিত্র নর্দমার কীট ভাবে, সেই মেয়ে-ই নিজের জীবনের পরোয়া না করে তার মেয়েকে বাঁচাল! নিজ মনেই এক দ্বন্দের সৃষ্টি হলো তার পবিত্রতা সম্পর্কিত আচ্ছনতা থেকে।
“স্ট্রেঞ্জ! এত কিছু হলো এপার্টমেন্টের একটা মানুষও এগিয়ে এল না।”
কথাটা বলেই কাউকে কল লাগায় নায়িম। কিছুক্ষণের কথোপকথনের পর তার মুখশ্রীতে কঠোর এক ভাব প্রতিফলিত হয়।
“কী হয়েছে?” প্রশ্নবোধক চাহনি অনিমেষের।
“আমাদের এপার্টমেন্ট আর এর দু’পাশের এপার্টমেন্টের প্রতিটি ফ্ল্যাটে না কি আজ কেউ একজন এসে ধানমণ্ডির পাশেই হওয়া চলমান কনসার্টের টিকেট দিয়ে গেছে ফ্রীতে, তাও হিসেব ছাড়া। এই সব সাদিকের কাজ!
সে-ই এগুলো প্ল্যানিং করে করেছে। আজ শুক্রবার, সবারই ছুটি, তার উপর পাশেই কনসার্ট; সুতরাং সবার যাওয়া নিশ্চিত। সব ভেবে-চিন্তেই এই প্ল্যান করেছে সে। ঐ কু** বাচ্চাকে তো আমি ছাড়ব না, এটা আমার ওয়াদা!”
___
নায়িম বাসন্তীর কেবিনে বসে। মাত্রই বাসন্তীর জ্ঞান ফিরেছে। মেয়েকে সুস্থ দেখে তার আনন্দ তো সীমানা ছাড়িয়ে গেল। হাজার খাণেক চুমু খেল কোমল তকে। নায়িমের কেন যেন ঈর্ষা বোধ হল। ভাবল,
– মায়েদের মমতার টান যদি এতটাই হয়৷ তবে গ
তার মা কি মা ছিল না?
ঠিক তখনই একঝাঁক রিপোর্টার নায়িমের লোকদের ঠেলে চেষ্টা করল কেবিনের দরজা খুলে প্রবেশ করার। ডাকাডাকি, চেঁচামেচি তো করেই যাচ্ছে। কিন্তু কথা হলো তারা জানল কীভাবে নায়িম এই হাসপাতালে। ঠিক তখনই মনে পড়ল, সে কোনোরকম ছদ্মবেশ ছাড়াই হাসপাতলে ঢুকেছে।
নায়িম না যাওয়া অবধি এরা শান্ত হবে না, সে তা জানে। বাসন্তীকে ওড়না নিতে ইশারা করে দরজা খুলে সামনে দাঁড়াল সে। কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নানা সাংবাদিক নানা ধরনের প্রশ্ন করতে লাগল। যদিও ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিষয়বস্তু একটাই।
কিন্তু একটি প্রশ্ন শুনেই তেঁতে উঠল বাসন্তী। তা হলো-
“এত বছর নিজের বিয়েকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখলেন কেন? মেয়েদের মন পেতে ও তাদের পাত্তা পেতেই কি এই ব্যবস্থা?”
“এই ব্যাডা! কী বললি তুই আমার জামাইকে?” তার বিষাক্ত কণ্ঠ শুনতেই সকল ক্যামেরা নায়িমকে ছেড়ে তার উপর ফোকাসে করল।
“আমার স্বামীর এত মাইয়া লাগে না, হ্যাঁ? বাংলাদেশের কত মেয়ে নায়িমের পাত্তা পেতে চায়। কিন্তু ও কখনো এই আমাকে ছাড়া কোনো মেয়ের দিকে সেই দৃষ্টিতে তাকায় না। সেটা আমি ওর স্ত্রী বাসন্তী কোন কাঠগড়ায় বলবেন, সেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলতে রাজি।
হ্যাঁ, ও আপনাদের থেকে, দর্শকদের থেকে আমাদের কথা লুকিয়েছে। কিন্তু তার কারণ আপনারা নিজের সম্মুখেই দেখতে পাচ্ছেন। এই বিষয়টা জানাজানি হতেই আমার মেয়ের জীবনে কথা এসেছে। আমরা হাসপাতালে। ঐ যে আমার বোন, নায়িমের প্রিয় বন্ধু অনিমেষ মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে এসেছে।
না জেনে আমার স্বামীর উপর কোনো কালিমা লাগাবেন না। আপনারা নায়িমকে ভালোবাসা দিয়েছেন, এই জায়গায় পৌঁছিয়েছেন, আপনাদের অধিকার আছে জানার। কিন্তু তাই বলে এসব আমি সহ্য করতে পারব না!”
নায়িম ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে বাসন্তীকে। যেই মেয়েটা কারো সামনে কথা বলতে অবধি দ্বিধাবোধ করে, নিজের পক্ষও কোনোদিন ঠিকঠাক রাখতে পারে না, সেই মানুষটি তার জন্য এতগুলো অচেনা লোকের সামনে আওয়াজ তুলল। আবার, মেয়েটা তো চাইলেও পারত তার করা অত্যাচারের কথা ফাঁস করতে। তাও করেনি। এতটা ভালোও বুঝি বাসা যায়?
আজকের ঘটনাগুলো নায়িমকে খুব করে ভাবাচ্ছে। খুব করে! তার চিন্তাধারাকে, মানসিকতা রীতিমত লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে।
“স্যার, ম্যাম যে বলছে তা কি সত্য? কে আপনাদের শত্রু যাদের জন্য আপনারা হাসপাতালে?”
“হ-হ্যাঁ?” ভাবনার সুতো কাটে নায়িমের। নিজেকে সামলে শুধায়,
“দেখুন, এখন আমার পরিবারের অবস্থাই শোচনীয়। ইন্টারভিউয়ের মন-মানসিকতা নেই। খুব শিঘ্রই আমি একটা কনফারেন্স ডাকব, সেখানেই বিস্তারিত জানবেন। এখন আপনারা হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট না করে, চলে যাবেন। এর কারণে অন্যান্য রোগীদেরও সমস্যা হচ্ছে।”
সাংবাদিকগণ বিদায় হতেই নায়িমের ফোন বেজে উঠে। সেই খবরের লিংক পাঠানো প্রাইভেট নাম্বারটিই। ক্রূর হেসে কল রিসিভ করে সে।
“কেমন লাগল মামার কামাল ভাগিনা?”
“শিয়াল কূটনা শুধু আড়াল থেকেই একটু-আধটু ক্ষতি করেই ভাবে সে জিতে গেছে। অথচ, সিংহ সামনের থেকে আক্রমণ করে বাঁচার সুযোগ অবধি দেয় না। এটাই রাজা আর হারামির মধ্যে পার্থক্য। ঠিক যেমনটা আমি খান সম্রাজ্যের সম্রাট ও আপনি হারামি চাকরের মধ্যে পার্থক্য।”
তেঁতে উঠেন সাদিক মিয়া।
“ভাগিনা, বেশি বাড় বাইড়ো না। তুমি যেই ইস্কুলে মাত্র ঢুকসো, আমি তার শিক্ষক।”
“আরে শকুনি মামা মাত্র ঢুকলে কী হয়েছে? পুরো স্কুল আর গোদিটাই তো আমার। কাউন্ট করা শুরু করে দেন। আপনার ধ্বংস অতি নিকটে।”
কথাটুকু বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দেয় সে। বাসন্তী তখনো বেডে বসে রাগে ফুঁসছে।
বাঙালি নারীর এক অবিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো তারা নিজে স্বামীকে ধুঁয়ে ফেলেও অন্যকারো মুখ থেকে তার বিরুদ্ধে একটা কথাও সহ্য করতে পারে না।
বাসন্তীও নিশ্চয়ই এর ব্যতিক্রম নয়। নায়িমের মুখে কেন যেন আলতো হাসি ফুটে ইঠে। কাঁধে স্পর্শ পায় কারো। তাকিয়ে দেখে অনিমেষ।
“তোর মেয়ের গায়ে আঘাত লেগেছে ভেবে তোর দমবন্ধ হয়ে আসছিল, তাই না রে? তাহলে এটা কী করে ভুলে যাস তোর স্ত্রী বাসন্তীও কারো মেয়ে? এমন কী পৃথিবীর প্রতিটি মেয়েই কারো না কারো রাজকন্যা! মেয়েটা কিন্তু কত কিছুই করতে পারত তোর বিরুদ্ধে এখন। কিন্তু দেখ তোকে ভালোবেসে দিব্যি তোর দোষ লুকিয়ে গুন গেয়ে গেছে।”
___
পরদিন, চৈতালি অনেকটাই সুস্থ। জ্ঞান ফিরেছে ঘণ্টা খাণেক আগে। খবর তাকে দেখতে ছুটে এসেছে সবাই। বাসন্তী তার হাত জোড়া ধরে দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে কেঁদে ফেলে।
“তোমাকে কোন ভাষায় যে ধন্যবাদ দিব জানা নেই। আমার মেয়ের জীবন তুমি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাঁচিয়েছো। এতটা পরের জন্য কে করে আজকাল!”
“পর বোলো না বাসন্তী। নাহিবা তোমায় মাতৃত্বের স্বাদ দিলে, আমায় আভাস দিয়েছে৷ সেই শিশুকে আমি বাঁচাব না। ধন্যবাদ দিয়ে আমার অনুভূতিগুলোকে ছোট করবে না প্লিজ।”
বেশ কষ্ট হলেও এতগুলো কথা বলেই দম ফেলল চৈতালি। নায়িমের কাছে এই কথাগুলো শুনা বিস্ময় বৈকি কিছুই নয়।
এদিকে চৈতালির মনে চলছে অন্য পরিকল্পনা। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার আগ মুহূর্তে সে যাকে স্মরণ করেছে, সে হলো তার জীবনের প্রথম পুরুষ ফাহিম। সে বোধ করেছে প্রিয় মানুষকে আর কোনোদিন দেখতে পারবে না, এই ভাবনাটি কত ভয়ংকর। তার ছুটে চলে যাতে মন হচ্ছে ঐ অতি সামান্য পয়সার অধিকারী পুরুষটির। অথচ, একসময় এই পুরুষটিকেই দূর দূর করে জীবন থেকে বের করে দিয়েছিল সে।
এই নিষিদ্ধ আবেদনটি করেই ফেলল সে সকলের সামনে। নায়িম পূরণ না করে পারল না। জার্নি করা চৈতালির জন্য একটু কষ্টসাধ্য বা অনুচিত হলেও তাকে গাড়ি করে নিয়ে গেল ফাহিমের ভর্তি হওয়া হাসপাতাল।
ফাহিমকে দেখে কম্পিত দেহ নিয়েই তাকে দৌড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরল চৈতালি।
“আমাকে ক্ষমা করো প্রিয়। আবারো জায়গা দাও না তোমার বুকের নিরাপদ স্থানে?”
এতটা কষ্ট পাওয়ার পর কী ক্ষমা সম্ভব! ফাহিম করবে তো তাকে ক্ষমা? ক্ষমা আর ভালোবাসা উভয়ই যে মুখে বললেই হয় না। মনকে মানতে হয়।
নায়িমের চিন্তাধারাও কি পরিবর্তন হবে এবার? কারণ ডিজঅর্ডারের তো চিকিৎসা হয়, কিন্তু চিন্তাধারা ও মানসিকতায় ত্রুটি এর সংশোধন হয় শুধু নিজ বোধ থেকেই।
চলবে…
টাইপোগ্রাফিঃ @jannatul ferdouse