টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ২৫

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৫তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
নিজেকে চৈতালির থেকে ছাড়িয়ে নেয় ফাহিম। তার চোখে-মুখে ক্ষোভের আবরণ, সাথে কিছুটা অস্পষ্ট বেদনা। ব্যাঙ্গাত্মক সুরে হেসে বলে,

“এখন কেন এসেছো আমার কাছে ফিরে? নিশ্চয়ই কারো থেকে খবর পেয়েছো আমার প্রমোশন হয়েছে। এখন আর আমি সামান্য ব্যাংক কর্মচারী নই, বরং ব্যাংকের জিএম। আমার মাইনে এখন সত্তর হাজার, কোম্পানির গাড়ি, ফ্ল্যাট সবই আমার আছে।

তোমার লোভটা আর গেল না, তাই না? একদিন মৌমাছির মতো অর্থ নামক মধুর খোঁজে একদিন এই পুরুষের কাছে, তো একদিন ঐ পুরুষের কাছে যাও। মানুষ হয়েও সাপের চেয়েও বেইমান তুমি চৈতালি!”

বিরতিহীন ভাবে অসুস্থ শরীরে এতগুলো কথা বলে হাঁপিয়ে উঠেছে ফাহিম। সেদিনের মেয়েটিও কেবিনে উপস্থিত সাহস দেওয়ার ভঙ্গিমায় কাঁধে হাত রাখে তার। কিছুটা শান্ত হয় ফাহিম।

চৈতালি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় ফাহিমের দিকে। ছেলেটা যে এতগুলো মানুষের সম্মুখে তাকে এসব বলতে পারে এমনটা চিন্তাও করেনি সে। শব্দ করে কেঁদে উঠে সে। তার ভাবনা হলো

– সে ভুল করেছে সত্যিই। কিন্তু অনুতপ্তও তো হয়েছে আজ, ভুল স্বীকার করছে। তবুও কেন ফাহিম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বা মিথ্যে অভিযোগে অভিযুক্ত করছে তাকে? ফাহিম না তাকে ভালোবাসে, তবে কেন বাহু মেলে আবদ্ধ করে নিচ্ছে না তাকে? কেন-ই বা এই মেয়েটা তার সাথে এতটা অধিকার বোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে?

তার নিজের ভাবনার বোঝাপড়া শেষ হতেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

“বিশ্বাস করো ফাহিম আমি কোনো লোভে পড়ে আসিনি। এমন কী আমি জানতামও না তুমি প্রমোশন পেয়েছো। আমি তো ক্ষমা চাচ্ছি, তবুও কেন ক্ষমা করছো না আমায়? আর এই মেয়েটা কে? ও এখানে কেন?”

“হাউ সিলি! তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছো? তোমাকে? যে মানুষটা আমাকে ছেড়ে হুট করেই নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, এতটা সময়ে আমি কোথায় বা কেমন আছি যার বিন্দুমাত্র আগ্রহ হয়নি, আমার অসহায় চেহারা আর বিধ্বস্ত কণ্ঠে যার মায়া জাগেনি, আমার মান-সম্মানের যেয়ে পরোয়া করেনি তাকে আমি বিশ্বাস করব? এও এখন সম্ভব। বাহ্!

আর কী বললে এই মেয়েটা কে? এই মেয়েটা সীমা। সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে আমাকে ভালোবাসে। অথচ, কখনো ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা তো চায়-ই নাই, আজ অবধি বিয়েও করেনি। আমার দুঃসময়ে এই মেয়েটা নিজের চাকরি হারিয়েও আমার পাশে থেকেছে। প্রতিমুহূর্ত আমাকে অনুপ্রেরণা জাগিয়েছে।

আমার মা বিছানায়, তার খেয়াল রাখা লাগে আমার অফিস আছে। আপুও রোজ রোজ আসতে পারে না। কখনো ভেবেছো বা ভেবেছিলে আমি এত সবকিছু কী করে একা হাতে সামলাই? না, তা ভাবোনি। তোমার তো টাকা জোগাড়ের চিন্তা করে, আরেকজনের স্বামীর টাকায় আরাম করেই সময় পাও না। এখন তুমিই বলো, আমার কাকে জীবনে রাখা উচিত? তোমাকে না কি এই মেয়েটিকে?”

“প্লিজ ফাহিম…” মাঝপথেই ফাহিমের হাতের ইশারায় থেমে যায় তার কথা।

“তোমাকে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিশ্বাস হলো আয়নার মতো একবার ভাঙলে জোড়া লাগানো যায় না।”

চৈতালি চাপা কান্নার সাথে অসুস্থ দেহ নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিয়ে পড়ে যেতে নেয়। বাসন্তী যেয়ে তাকে ধরে সামলে নেয়। নায়িম ও অনিমেষও বিরস মুখে সেখান থেকে প্রস্থান করতে অগ্রসর হয়।

মানুষ কখনো অন্যকে অন্যের অবস্থান থেকে বিচার করে না। বরং, নিজের অবস্থান থেকে অন্যের অবস্থান যতটুকু দেখা যায়, ততটুকুতেই বিচার করে।

চৈতালির সাথেও তেমনটাই হয়েছে। তার অবস্থান থেকে সে অনুতপ্ত, ক্ষমার যোগ্যও হয়তো। তবে ফাহিমের অবস্থান থেকে সে চৈতালিকে যা দেখে তা হলো সে সুযোগসন্ধানী ও অর্থলোভী।

___

বাসন্তী, নায়িম ও চৈতালি বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ধানমন্ডির এপার্টমেন্টে নয়, গুলশানের ডুপ্লেক্স বাসাতেই এখন থেকে থাকবে তারা। নায়িম পেশাদার বডিগার্ড সহ নিজের লোকদের আনিয়েছে নিরাপত্তার জন্য। অনিমেষও অনিমেষের মা-বাবাকে নিয়ে এখানেই আসছে থাকতে সাদিল মিয়াকে ধরা অবধি।

প্রায় রাত,
সবাই যার যার ঘরে। নায়িম ডিভানে আদশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কী যেন করছো, কানে তার এয়ার বার্ডস্, কারো সাথে কথাতেও ব্যস্ত। বাসন্তী ভেজা কাপড় দিয়ে নাহিবার গা মুছিয়ে দিচ্ছে।

হুট করেই বাসন্তী খেয়াল করে নায়িম এয়ার বার্ডস্ খুলে রেখে মাথায় হাত দিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিমায় বসে আছে। বাসন্তী নাহিবাকে বিছানার মাঝ বরাবর বালিশ দিয়ে ঘেরাও করে শুয়িয়ে স্বামীর কাছে যায়।

আলতো হাতে জড়িয়ে কপোলে চুমু খেয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,

“ভালোবাসি প্রিয়তম। আমার ভালোবাসায় সিক্ত করে দুশ্চিন্তাগুলো দূর করতে চাই তোমার। সেই সুযোগ দিবে কি একবার?”

নায়িম নির্নিমেষ দৃষ্টিতে নিজের বসন্তকুমারীকে দেখে। ধীর গতিতে মুখশ্রীটা এগিয়ে নেয় রমণীর দিকে। তাদের রোমান্টিকতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে একজন কান্নার অদম্য আওয়াজে পরিবেশ ভারী করতে শুরু করে।

ছুটে যেয়ে নায়িম কোলে তুলে নেয় মেয়েকে। এমন একটা ভাব মেয়ে তার ব্যথা পেয়েছে। আর বাবা কোলে নিতেই মেয়েও একদম শান্ত শিশু। একটু ঈর্ষাই অনুভব করে বাসন্তী, তবে এ ঈর্ষা বহু সুখের ঈর্ষা। যা একজন স্ত্রী বনাম মা-ই অনুভব করতে পারবে।

“আলালের দুলালি যেন একদম!” হেসে বিদ্রূপাত্মক সুরে বিড়বিড়ায় বাসন্তী।

নাহিবাকে পায়ে শুয়িয়ে দোল দিতে দিতে ফোনে ফেসবুকে স্ক্রল করতে শুরু করে। আর যা দেখতে পায় তাতে মাথায় দরদর করে আগুন জ্বলে উঠে।

অধিকাংশ তরুণ ও উঠতি বয়সই ছেলেরা বাসন্তীর নায়িমকে সাপোর্ট করার ক্লিপটি পোস্ট করছে আর হৃদয় জ্বালানো সব ক্যাপশন লিখেছে, লিখছে। এই যেমন একজন লিখেছে আমার ক্রাশ, তো আরেকজন লিখেছে এমন বউ চাই, আবার কেউ লিখেছে আমার হবু বউ।

নায়িম রাগান্বিত হয়ে আপন মনেই বিড়বিড়াচ্ছে,

“এই মেয়েটাকে কে বলেছিল এতসব কথা বলতে ক্যামেরার সামনে? যত্তসব আজাইরা এটেনশন পাওয়ার ফন্দী!”

___

কেটে গেছে প্রায় কয়েকদিন। আজ নায়িম প্রেস কনফারেন্স ডাকিয়েছে। বাসন্তী, নায়িম ও অনিমেষ সেখানে বসে। কালো বোরখা পরা বাসন্তীকে দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে যায় সম্মানে৷ সকল সাংবাদিক তাকে একে একে প্রশ্নবিদ্ধ করতে শুরু করে তাকে।

“আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। একটু অপেক্ষা করুন।”

তার কথা শেষ হতেই অজানা একজন প্রবেশ করে সভাই। যাকে দেখে থমকে যায় সকলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here