টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ২৬

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||২৬তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
মানুষটিকে প্রবেশ করতে দেখে চমকিত মুখে দাঁড়িয়ে যায় সকলে। এ লোকটি আর কেউ নয়, দেশের সুনামধন্য রাজনৈতিক সংগঠন সাধারণ জনতা পার্টির সাময়িক প্রধান জমশেদ আলী। তাঁকে দেখে নায়িম নিজ চেয়ার ছেড়ে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় তাঁর দিকে।

“আঙ্কেল কেমন আছে? আপনার কোনো অসুবিধা হয়নি তো আসতে?”

“না, না, বাজান। তুমি থাকতে আমি খারাপ থাকমু না কি?”

“আসেন, আসেন। যেয়ে বসে এই ঝামেলা আগে শেষ করি।”

উভয়ে নিজেদের জন্য নির্ধারিত আসন গ্রহণ করতেই আবারও প্রশ্নের তীর ছুড়তে শুরু করলেন সাংবাদিকগণ। জমশেদ আলী রাগচটা মানুষ, রাগে দিয়ে বসলেন এক রামধমক। অতঃপর পিনপতন নীরবতা।

নায়িম হালকা ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে শুরু করল,

“আপনারা জমশেদ আলী আঙ্কেলকে তো চিনেনই? বনি মোস্তফা সাহেবের পর যিনি কি না বনি মোস্তফার নাতির অনুপস্থিতিতে সাধারণ জনতা পার্টি পরিচালনা করে আসছেন। তাঁর আমার সম্পর্কটা এই বনি মোস্তফা সাহেব দিয়েই। আমি হলাম বনি মোস্তফা সাহেবের একমাত্র নাতি। নায়িম ফাজ খান!”

কথাটি বলতেই কানাঘুঁষা শুরু হয়ে গেল সবার। নায়িম সেসবে ধ্যান না দিয়েই আবারও নিজ কথা শেষ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

“আপনারা আমাকে চিনেন আর.জে বা সিঙ্গার নায়িম হিসেবে। যা আমি নিজ যোগ্যতায় অর্জন করেছি। তবে জন্মগত ভাবে আমার যে অস্তিত্ব তা হলো, আমি বনি মোস্তফার একমাত্র কন্যা ও নিয়াজ খানের একমাত্র ছেলে। নিজের নিরাপত্তার জন্য এতকাল পরিচয় গোপণ করে থাকতে হয়েছে আমার। নিজের বিয়ে, স্ত্রী ও সন্তানকেও গোপণ করেছি একই উদ্দেশ্যে।

আসলে আমার নানা বনি মোস্তফার সৎ বোন বাতাসী মোস্তফার স্বামী-সন্তানের চোখ মোস্তফা বংশের সম্পত্তি ও পার্টির চেয়ারপার্সনের পদবীর দিকে। ঠিক এই জন্যই আমাকে নিজেকে ও নিজের স্ত্রী-সন্তানকে গোপণ করতে হয়েছে। কারণ চেয়ারপার্সন আমার নানাজান আমার সন্তানকে করে দিয়ে গেছেন, তার বড় হওয়া অবধি যার দায় আমার।

আর মোস্তফা বংশের সকল সহায়-সম্পত্তি আমার স্ত্রীর নামে। ফলে আমি আমার স্ত্রীকে শুধু ধর্মীয় ধারাতেই বিয়ে করেছি, আইনত নয়। যাতে তার উপর ঝুঁকি কম। কিন্তু তবুও… গতকাল আপনারা নিজেরাই হাসপাতালে যেয়ে দেখেছেন আমাদের অবস্থা। আমার দুধের বাচ্চাটাকে মেরে ফেলার জন্যই আমাদের অনুপস্থিতিতে আমার ধানমণ্ডির গোপণ ফ্ল্যাটে হামলা করে তারা।

আশা করি, এবার আপনারা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন।”

“কিন্তু স্যার তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেননি আপনারা?”

“তারা পলাতক। আপনাদের এ কারণেও ডেকেছি।” বলে কাউকে কী যেন ইশারা করে।

সাথে সাথেই নায়িম, অনিমেষ, বাসন্তী ও জমশেদ আলীর পিছনে ফেলে রাখা শুভ্র পর্দায় ভেসে উঠে সাদিক মিয়া ও শামসুর মিয়ার ছবি। সেই ছবিটির দিকে ঈঙ্গিত করেই জমশেদ আলী শুধায়,

“এই ছবির মানুষটিকে ওয়ান্টেড, ক্রিমিন্যাল হিসেবে প্রচার করুন আপনারা। এতে আমাদের সুবিধা হবে অপরাধীদের যোগ্য শাস্তি দিতে।”

এ বিষয়ে নানারকম প্রশ্ন করে সাংবাদিকেরা। নায়িম, অনিমেষ ও জমশেদ আলী ধৈর্য্য সহকারে উত্তর দেন।

তারপর ক্যামেরা ফোকাস করা হয় বাসন্তীর দিকে। রমণী প্রচণ্ড নার্ভাস, অনবরত হাত-পা কাঁপছে। অথচ, সেদিন কী বাঘিনীটাই না হয়েছিল! ঘটনাটি ভেবে সে-ই বাক্যহারা হয়ে পড়ে।

“ম্যাম, নায়িম স্যারের সাথে আপনার বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?”

“ম্যাম, আপনাদের কি লাভ না কি এরেঞ্জ ম্যারেজ?”

“নায়িম স্যার বাংলাদেশের প্রায় মেয়েদের স্বপ্নপুরুষ, বিষয়টিকে কীভাবে নেন আপনি? আর স্বামী হিসেবে কেমনই বা লাগে তাকে আপনার?”

এমন নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে সাংবাদিকগণ। বাসন্তী উত্তর দিবে আর কী? বরং, লজ্জায় লাল হয়ে পড়ছে তার উজ্জ্বল শ্যামা মুখশ্রী নিকাবের আড়ালে।

“ইয়ে মানে আমি এত উত্তর… শুধু এটুকুই বলব উনি স্বামী হিসেবে কেমন তা প্রশ্ন নয়, আমি তাকে ভালোবাসি। এটাই হয়তো আমার কাছে সবচেয়ে বড়।” চোখ বন্ধ করে এটুকু বলেই স্থান ত্যাগ করে সে।

নায়িম তার যাওয়ার দিকে অদ্ভুৎ দৃষ্টিতে তাকায়। সাংবাদিকেরা তার চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে হতভম্ব। অনিমেষ নানা কথার দ্বারা সামলে নেয় তাদের।

___

ফাহিমের হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিনটি আজ। সীমা সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল। সীমার হবু বর আমল সহায়তায় ফাহিম পিছনের দুই সিটে আরাম করে বসল।

তাকে ঠিকঠাক করে আমল সীমার পাশে তথা চালকের আসনে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। হুট করে সীমা শুধায়,

“চৈতালিকে এমন মিথ্যে বলে কাজটা তুমি ঠিক করোনি ফাহিম। মেয়েটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়াই যায়।”

ফাহিম উদাসীন হয়ে জানালার বাহিরে তাকিয়ে থাকে। বস্তুত, কিছুদিন আগেই সীমার বিয়ে ঠিক হয়েছে ব্যাংকের সিইওর একমাত্র ছেলে আমলের সাথে। আমল অফিসে এসে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে এই নারীর। আমল সীমার একতরফা ভালোবাসা সম্পর্কেও জ্ঞাত, তবে তার মতে এটা বড় কোনো বিষয় নয়।

সীমা এঙ্গেজমেন্টের এক মুহূর্ত আগেও তাকে কল করে কেঁদেছে। ফাহিম চাইলেই পারত সঙ্গীহীন, অনির্দিষ্ট এই জীবনে সীমাকে জুড়ে দিতে। সে তা করেনি, তাকে বুঝিয়েছে রাজি হতে। কারণ এজন্য নয় যে বর্তমানেও সে চৈতালি ছাড়া কাউকে নিয়ে ভাবতে চায় না। বরং, সীমার যোগ্য তার নিজেকে মনে হয় না।

“তুই জানিস ও আমায় কতটা হার্ট করেছে? এই প্রথম নয় এসব। আমার আগের বস যে কি না প্রায় পঞ্চাশ উর্ধ্ব ছিলেন, উনার সাথে ও আমার সামনে বসে ফ্লার্ট করেছে। কারণ কী? উনার টাকা। একজন পুরুষের জন্য এটা কতটা অপমানকর বুঝিস? তাও আমি সহ্য করে নিয়েছি, বুঝিয়েছি। কিন্তু কী হত? কয়েকদিন ঠিক, তারপর আবার সুযোগসন্ধানী।

প্রতিটা মুহূর্ত আমাকে ও যেই মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে না? আমার জায়গায় অন্যকোনো ছেলে থাকলে এতদিনে আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। আমার সন্তান…”
সম্পন্ন করতে পারে না সে। গলা ভেঙে আসছে। তবুও আজ সে বলবে। আর পারছে না মনের ফুটন্ত বিষজল মনেই আটকে রাখতে।

“বিয়ের পর থেকে আমাকে না জানিয়ে আমার প্রতিটা সন্তান পেটে আসা মাত্রই সে মেরে ফেলেছে। তারপরও আমি মেনে নিয়েছি। আমার সামনে আমার অসুস্থ মাটাকে এমন আপত্তিকর ভাষায় গালি-গালাজ করত, যে আমি তোকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বিনিময়ে ধমক বৈকি কিছুই করিনি আমি।

কেন জানিস? পুরুষ হলেও ভালোবেসেছিলাম কিছু বাঙালি নারীর মতো আত্মসম্মান হাওয়ায় মিশিয়ে। এজন্য মানুষ আমায় বউয়ের গোলাম, মা**। আমার বোন, বোনের জামাই পর্যন্ত আমার আড়ালে এসব বলত, বলে। আমার হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইত তখন! কিন্তু ঐ যে ছোটবেলায় আব্বা বলেছিল, পুরুষ হয়ে জন্মাইসোস, কিন্তু কাঁদলে হবি কাপুরুষ।

আমি ওর জন্য কী করি নাই? ওর কাপড়-চোপড় সুদ্ধ ধুয়ে দিসে, সকাল নয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ওভার টাইম করে আবার বাড়িতে যেয়ে রান্না করসি, ও বলতে পারবে না ওর এঁটো থালাটা ও আমার অসুস্থতা বাদে কোনোদিন ধুইসে। সবকিছুতে মানিয়ে নিয়ে চলছিলাম তো আমি।

কিন্তু ও কী করল? আমার এত ধৈর্য্যের ফলস্বরূপ আমাকে ছেড়ে গেল আমার স্ত্রী। নিছক টাকার জন্য দিনের পর দিন একটা পরপুরুষের সাথে থেকেছে। শুধু এটাই নয় অফিসের কাজে বনানী যাওয়ায় আমি নিজ চোখে দেখেছি ও কীসব কাপড় পরে প্রডিউসারের অফিসে ঢুকেছিল! বিশ্বাস কর ঐদিন এমন অনুভূতি হচ্ছিল যেন আমার সারা দেহে কেউ এসিড ফালিয়েছে।

যদি ও কারো থেকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসা পেয়ে চলে যেতো তাহলেও আমার অভিযোগ থাকত না। নিজেকেই দোষতাম বটে। তবে নিছক টাকার জন্য এমন পতিতা সাজা আমি মেনে নিতে পারিনি।”

ক্লান্ত হয়ে উঠে ফাহিম। তৃষ্ণা পাচ্ছে তার। চোখ উঠিয়ে দেখে সীমা তার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লুকিং গ্লাসে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আমলের থমথমে চাহনি। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। পুনরায় মুখ খুলে।

“তারপর তো এক্সিডেন্টই করলাম। মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে একটা কথাই মনে হয়েছে, কারো ভালোবাসা, সঙ্গ পেতে যদি এত সব কষ্ট সহ্য করা লাগে, তাহলে কি সে সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য! অথবা তার ভালোবাসা আসলেই আমার এত দরকার যে এতটা বেহায়া হয়েছি আমি! মন নীরবতা পালন করল। মস্তিষ্ক জবাব দিল, না। সেদিন থেকে মনে ঘৃণা নয় তিক্ততার এক শক্ত দেওয়াল গড়ে নিয়েছি আমি। এই টক্সিক রিলেশনশীপ থেকে হৃদয় মুক্তি নিয়েছে সেদিনই।”

সীমা পানির বোতলটি এগিয়ে দিল তার দিকে। পানির দিকে তাকিয়ে ভাবল,

– তার জীবনটাও পানির মতোই রঙহীন ছিল, আছে। ভার্সিটিতে পড়াকালীন বাবা মারা যায়, বড় বোন তখন পরের বাড়ির আমানত। মাকে সামলে নিয়েছে সে একা হাতে। এমন কী তার অসুস্থতাও। এই রঙহীন জীবনকে চৈতালি নামক রমণীর রঙে রাঙাতে চেয়েছিল। অথচ, মেয়েটি রঙের বদলে নিয়ে আসলো একঝাঁক নীল রঙা বিষ৷ তার চেয়ে বরং এই রঙহীন জীবনই তার ভালো, রঙহীন পানির মতোই মূল্যবান এবং আর দশটা পুরুষের মতো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন।

___

প্রায় মাস খাণেক কেটে গিয়েছে। অনিমেষ তার বাবা-মাকে নিরাপত্তার জন্য নিজের ভারতীয় আত্মীয়দের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছে। আজ নায়িম নিজ পরিবার ও চৈতালি, অনিমেষ সহ নিজের পিতৃভূমিতে চলে যাচ্ছে। একবারে স্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে, নিজের হক এবং অধিকার টুকু নেওয়ার উদ্দেশ্যে। যদি সে জানত এই পদক্ষেপই ঝড় বয়ে আনবে তাদের জীবনে।

চলবে…

আগামীকাল গল্প দিতে পারব না কি শিউর নয়। অনেক অ্যাসাইনমেন্ট বাকি। তারপরও আপনাদের ভালো রেসপন্স বা আগ্রহ দেখলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করব দেওয়ার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here