#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩০তম পর্ব||
– ঈপ্সিতা শিকদার
নায়িমের কথা শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকায় অনিমেষ তার দিকে। নায়িম ফাজ খান বলছে সে বাসন্তীকে ভালোবাসে। অবিশ্বাস্যকর!
“এই তুমি সত্যি বলেছিস তো যে তুই ভাবীকে ভালোবাসিস? না কি আমি ভুল শুনলাম?” আঙুল দিয়ে কান পরিষ্কার করার ভঙ্গিমায় প্রশ্ন করল সে।
“অনি মজা নিবি না তো। যা এইখান থেকে।” বলেই বালিশ ছুঁড়ে মারে অনিমেষের মুখের উপর।
তাতে অনিমেষের আর কী ক্ষতি হওয়ার? সে বরং নায়িমের হৃদয় পুড়িয়ে আরও নাটকীয়তার সহিত শব্দ করে হাসে।
নায়িম রক্তচক্ষু নিয়ে তার দিকে তাকায়। তা খেয়াল করেও না করার ভঙ্গিমায় হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় সে।
নায়িম ফোঁস করে এক শ্বাস ফেলে। সাদাটে বিছানায় আধশোয়া হয়েই জানালার বাহিরে দৃষ্টি স্থির করে সে। উজ্জ্বল রৌদ্র বাহিরে, গাছগুলো শীতের আগমনে পাতার খোলস ছাড়িয়েছে। হাড্ডিসার অবস্থা আর কী!
নায়িমের খুব করে ইচ্ছে করছে একটু বাহিরে যেয়ে হাঁটতে। ঐ যে জনমানবহীন স্থানে বেঞ্চিটি দেখা যাচ্ছে, সেখানে বসে প্রকৃতি উপভোগ করতে। কিন্তু সে অপারগ। অন্যের উপর নির্ভরশীল। এই বিষয়টাই খুব করে পোড়ায় যুবককে।
ছোট থেকেই আত্মনির্ভরশীল থেকেছে, তার আজ যা আছে সবই তার আপন কর্মের ফলস্বরূপ। এমন কী তার নিজের জন্মগত ভাবছে পাওয়া ক্ষমতা এবং সম্পত্তিও সে এমনি এমনি পায়নি। অর্জন করে নিতে হয়েছে। জীবনের কোনো পর্যায়ে তার মনে হয়নি কাউকে তার প্রয়োজন। অথচ, এখন প্রায় সবকিছুতেই কারো না কারো উপর নির্ভরশীল সে।
নায়িমের ভাবনা চিন্তার মাঝেই দরজা খুলে প্রবেশ করেন নায়িমের চাচা। দুই মাস হবে নায়িমের চাচা তাকে সিঙ্গাপুর থেকে কানাডাতে নিয়ে এসেছেন। কারণ সিঙ্গাপুরের যান্ত্রিক পরিবেশে নায়িমকে আরও যেন মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলছিল। এখানে শুধুমাত্র তার শারীরিক নয়, মানসিক চিকিৎসাও চলছে। নায়িমের চাচাতো ভাই নিজেই একজন মনোবিশেষজ্ঞ।
“এখন কেমন লাগছে নায়িম? সবকিছু ভালোভাবে চলছে তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো চাচ্চু। আমিই তো ঠিকঠাক চলি না, অচল মানুষ, সবকিছু আর কী!”
নিজের প্রতিই যেন তাচ্ছিল্য করল নায়িম। নায়িমের চাচা বুঝতে পারলেও ব্যাপারটা নিয়ে ঘাটলেন। বরং, আশ্বস্ত করলেন,
“ডাক্তার বললেন আগামী দুই মাসের মধ্যেই তুমি পুরোপুরি বিপদমুক্ত হয়ে যাবে। তার এক মাস আমার বাড়িতে বেডরেস্টে কাটিয়ে তুমি যেকোনো মুহূর্ত ঢাকা যেতে পারব।”
কথা শেষ করে নায়িমের দিকে তাকালেন। যুবকের মাঝে খাপছাড়া ভাব। আবারও মুখ খুললেন তিনি,
“যাকগে সেসব। কিছু বাংলাদেশী সাংবাদিক এসেছে তোমার ইন্টারভিউ দিতে। তুমি কি দিতে ইচ্ছুক?”
“ডাকান তাদের। একটা সরাসরি ইন্টারভিউয়ের প্রয়োজন আছে। অনেক চ্যানেল ও পত্রিকাই বাসন্তীর উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।”
নায়িমের চাচা সাংবাদিকদের কেবিনে নিয়ে আসে। খুব বেশি মানুষ নয়, এক জন রিপোর্টার ও দুই জন ক্যামেরাম্যান। নায়িমের মুখখানা অসুস্থতায় ফ্যাকাসে হয়েছে ঠিকই, তবে আগের চেয়েও অধিক পরিপক্বতা এসেছে তার মাঝে। যা তাকে আরও সুদর্শন করে তুলেছে। মুখোভঙ্গিমায় সবসময়কার ন্যায়ই গম্ভীর, আর ঠোঁটের কোণে বাঁকা সেই হাসি।
“স্যার, সবার আগে আপনার থেকে জানতে চাই কেমন আছেন আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন মোটামোটি ভালো। অসুস্থতা থেকে অনেকটাই রিকোভার করেছি।”
“স্যার, আমরা শুনতে পাচ্ছি বাসন্তী ম্যাম না কি ইচ্ছে করে আপনাকে এখানে ফেলে রেখেছেন? যাতে উনি নিজে সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে পারেন।”
শব্দ করে হেসে দেয় নায়িম। কটাক্ষ করে বলে,
“যাদের থেকে এসব শুনছেন তাদের বলে দেন, আমার স্ত্রী আমার সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী, তাদের মতোন ছোটোলোক বা ফকিন্নি না। পুরো মোস্তফা এম্পায়ার তার নামে।”
আরও নানারকমের কথোপকথনের পর ইন্টারভিউ সমাপ্ত হয়।
___
রাত প্রায় দশটা, নাহিবা মেঝেতে বসে খেলছে, মুখ ব জাতীয় আওয়াজ করছে। আর বাসন্তী রুমের এক কোণে পড়ে থাকা রকিং চেয়ারা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণীতা উপন্যাস পড়ছে। চোখজোড়ায় এঁটে আছে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। পরিণীতা ও সমরেশ মজুমদারের সাতকাহন বইটি তাকে উপহার দিয়েছে চৈতালি। বলেছে,
“দুর্বল বোধ করলে এই বই দুটি পড়বে। শক্তি পাবে আবার অংশগ্রহণের যুদ্ধে।”
এমন সময় দরজায় নক করে কেউ। বাসন্তী বইয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির করেই বলে, “কাম ইন।”
চৈতালি নিজের মোবাইলটা দু’হাতে শ্যুট করার মতোই ধরে ঘরে প্রবেশ করে। তার মুখশ্রীতে চাপা হাসি। বাসন্তী আড়চোখে তাকায় সেদিকে। মনে মনে বলে,
“নিশ্চিত নায়িমের কল।”
হলোও তাই চৈতালি এগিয়ে এসে বসল মেঝেতে নাহিবার সাথে। বাবাকে দেখাল তার রাজকন্যাকে। এই এক বছরে আজ প্রথম বিনয়ী কণ্ঠে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“প্রিন্সেস, আমার প্রাণপাখি কেমন আছো? বাবাকে মিস করেছো?”
নাহিবা কী বুঝল কে জানে? সকলের বোধগম্যতার বাইরে যেয়ে কত রকম যে শব্দ উচ্চারণ করল সে!
নায়িমের কণ্ঠস্বর বাসন্তীর কানে পৌঁছাতেউ বুক কেঁপে উঠল তার। কিন্তু তার ভালোবাসা যে তিক্ততার বেড়াজালে বন্দী। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সেদিকে চোখ রাখল না।
তবুও তার অবচেতন প্রণয়িনী মন বারবার যেন সেদিকেই ধ্যান দিচ্ছে। বইটির কাহিনীতেও আর মন বসছে না তার। দেখতে মন চাচ্ছে প্রিয়তমকে। কতকাল ধরে দর্শন নেই যুবকের।
এদিকে নায়িম খাণিক মুহূর্ত দর্শন পেয়েছিল বাসন্তীর। অবাক হলো সে। মেয়েটা যুবতী হয়েছে বহু আগেই। তবুও তার মাঝে কৈশোর ও অপরিপক্বতা স্পষ্ট ছিল সবসময়। আজ চশমা চোখে বই পড়ার দৃশ্যে যেন একদম পরিপক্ব ও পরিণীতা লাগছে।
বাসন্তী অবচেতন মনেই আজ অদ্ভুৎ সব কাণ্ড করল। গুছানা বিছানা আবারও গুছালো, কারণ বিছানার দিকটা থেকে ফোনের স্ক্রিন সোজাসুজি দেখা যায়। আলমারির ভাজ করা কাপড়গুলো বের করে আবার গুছিয়ে রাখল। এতে ক্যামেরায় একটু তাকেও দেখা যাবে। তবে কি বাসন্তীর হৃদয় তার চেতনার আড়ালেই চাচ্ছে অপ্রিয় প্রিয়তমের দর্শন পেতে, নিজের দর্শন দিতে।
চৈতালি বাসন্তীর কাজ-কারবার খেয়াল করে মুখ টিপে হাসে। আনমনেই বিড়বিড়ায়,
“ভালোবাসা হলো বেলি ফুলের সুভাষের মতোন। তাকে তিক্ততার বেড়াজালে আটক বা আড়াল করে রাখা যায় না। ঠিকই একসময় বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পরিবেশে প্রকাশিত হবে।”
নায়িম কল কাটে। বাসন্তীরও চেতনা ফিরে। নিজের উপরই ভড়কে যায়। মনে মনে নিজেকেই বকতে শুরু করে।
“তোর মধ্য কি একটুও আত্মসম্মান নেই বাসন্তী? আর কত বেহায়া হবি এই হৃদয়হীন মানুষের ভালোবাসা পেতে? আরে ঐ লোকটার হৃদয়ই নেই, তবে তুই জায়গা করবি কীভাবে?”
____
নায়িম কপালে হাত দিয়ে গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রী নিয়ে শুয়ে আছে। তার চোখজোড়া বন্ধ।
অনিমেষ বিরক্তির ভঙ্গিমায় বলে,
“তুই এতটা স্বাভাবিক কীভাবে? দেখছিস ভাবীর তোর প্রতি কতটা রাগ জমেছে? তুই একটা বছর ধরে অসুস্থ একবার তোর খোঁজ নেওয়া তো দূরে থাক, আমি জানাতে গেলেও কল কেটে দিয়েছি। কতটা তিক্ততা জমেছে ভেবেছিস!”
“আমিও তো কম করিনি মেয়েটার সাথে। তিক্ততা জমার ছিলই, জমেছে। কারো জন্য এত কিছু করার পরও যদি কারো থেকে ভালোবাসা, প্রাধান্য না পাওয়া যায়, তবে তিক্ততা কেন ঘৃণাও জমবে।” কণ্ঠস্বর শান্ত ও অত্যন্ত গম্ভীর নায়িমের।
“তুই রিয়েলাইজ করেছিস, অনুতপ্ত এটা খুবই ভালো। কিন্তু ভাবীকে কী করে মানাবি? তার শুধু ভালোবাসা নয় বিশ্বাসও ভেঙে দিয়েছিস তুই।”
নায়িম কোনো উত্তর দেয় না। নায়িমকে নিশ্চুপ দেখে অনিমেষ ধীর পায়ে কেবিন ত্যাগ করে।
নায়িম নিজ ভাবনায় ডুব দেয়। আনমনেই ভাবে,
– সত্যিই কি তার কাছে বাসন্তীর মূল্য বেশি ছিল? বাসন্তীকে বাঁচাতে কি সে খ্যাতি, ক্ষমতা ও সম্পত্তি হাত ছাড়া করত?
ভিতর থেকে উত্তর আসে, ‘না’। বস্তুত, সত্য তো এটাই সেই মুহূর্ত বাসন্তী প্রাধান্য তার নিকট অনেকটাই কম ছিল নিজের কষ্টে অর্জিত ক্ষমতা ও সম্পত্তির চেয়ে।
চিনচিনে ব্যথা অনুভব নায়িমের। মনে মনে বলে,
“এমন কী যদি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে না যেতাম, এই বিরহবেদনা না ভোগ করতাম তবে কোনোদিনও বসন্তকে ভালোবাসা হতো না। মৃত্যুমুখে এসে বারবার বাঁচতে চেয়েছি, আল্লাহর কাছে জীবন চেয়েছি। তবে তা অর্থ-সম্পদ ভোগ করতে নয়। বরং, বসন্তের সাথে আর কটা মুহূর্ত বাঁচার আশায়। একসাথে জান্নাত পাওয়ার কর্ম করার আশায়। একসাথে বার্ধক্যে নুয়ে পড়ার আশায়। তখন বোধ করেছি আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া, কামনা, আশা, স্বপ্ন হলো বাসন্তী৷ সে ছাড়া আমি আত্মা বিহীন লাশের ন্যায়।
এই উপলব্ধিও খুব বেশি সময় টিকত না, যদি এই অসুস্থতা না আমায় বিরহ ভোগ করাতো। যদি খুব তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠতাম কিংবা বসন্ত চোখের সম্মুখে থাকত, তবে কখনো তাকে ভালোবাসাও হতো না। তাকে না পেয়ে আমি প্রতিটা সময় তাকে মনে করেছি, অনুভব করার চেষ্টা করেছি। এই অনুভবের চেষ্টা কবে যে ভালোবাসার রঙ হয় হৃদয়ে আচ্ছন্ন হলো কে জানে!”
চিন্তা করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে নায়িম নিজেই। সে শুধু জানে সে ভালোবাসে বাসন্তীকে। তার লোমে লোমে সেই উপলব্ধি, সেই ভালোবাসার সাধনা। এই প্রথম ভালোবাসার যন্ত্রণাময় শান্তি অনুভব করছে সে। সেই বেদনাময় তৃপ্তিতে তার গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে ফুটে উঠে প্রশান্তিকর হাসি।
ভালোবাসাটা হলো উপলব্ধির বিষয়। আপনি ততক্ষণ কাউকে ভালোবাসেননি যতক্ষণ তা বোধ করেননি।
যেই মুহূর্তে উপলব্ধি হয়েছে সেই মুহূর্ত থেকেই বোধ করবেন ভালোবাসার যন্ত্রণা, সুখ, উত্তেজনা সবকিছু। নায়িমের ক্ষেত্রেও তা হয়েছে। এতটা বছর একসাথে থেকেও ভালোবাসার রেশমাত্রও তাকে ছুঁতে পারেনি। অথচ, যেই ভালোবাসলো ভালোবাসার সকল আবেগ-অনুভূতি তাকে ছুঁয়ে দিল।
আজকাল তাই নায়িম প্রায়শয়ই ভেবে উঠে,
“পৃথিবীর সকল প্রেমিক ভালোবেসে বিরহ পায়। আমি বিরহে তোমায় ভালোবেসেছি প্রিয়তমা।”
চলবে…