টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৩৩

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৩তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
ধূমিত চায়ে ঠোঁট ছোঁয়ায় বাসন্তী। সাথে সাথেই কুয়াসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তার চোখে এঁটে থাকা চশমা। চশমা খোলে ফেলে রমণী। শব্দ করে এক শ্বাস ফেলে। শীতল বাতাসে কর্পূরের মতোন হারিয়ে যায় হতাশা মিশানো সেই তপ্ত শ্বাস। কত ভালোই না হতো যদি কষ্ট বা বেদনাময় অতীতের সঙ্গ এভাবে ছাড়ানো যেতো!

আনমনেই বিড়াবিড়ায় বাসন্তী,
“তুমি ভালোবাসোনি ক্যানো জিজ্ঞেস করব না আমি কভু, তোমার বিরহে, তৃষ্ণাতেই তো নিজেকে পেয়েছি। আমার দেহ থেকে নিঃসৃত প্রতিটি তপ্ত শ্বাসে আজও তোমার নাম লিখা, তবে গৃহীত শ্বাসের কোথাও তুমি নেই। কখনোই নেই।”

আজ প্রায় দুই মাস হলো বাসন্তী মোস্তফা বাড়িতে। এই দুই মাস সে নিজের মতো থেকেছে। না, চার দেওয়ালে বন্দী হয়ে থাকেনি সে। তার এখন বহু কাজ। সত্তরটি শিশুর দায়িত্ব তার কাঁধে এখন, দায়িত্ব নিয়েছে গ্রামের চালচুলোহীন বা স্বামীহীনা নারীদের ও বেকার যুবকদের।

নায়িম আসার প্রায় অনেক দিন আগে এই মোস্তফা ভবনকেই ছোট্ট একটা এনজিওতে পরিণত করেছে সে। অফিস স্বরূপ ব্যবহার করেছে মোস্তফা বাড়ির শালিস ঘরটি। এই বাড়ির পাশে দুই কামরার ঘর তুলে তাতে নানা দরকারী সরঞ্জামাদি এনে তৈরি হয়েছে কারখানা। শহরে একটা শোরুমও খুলেছে সে এসবের ন্যায্য মূল্য পেতে।

তার প্রচেষ্টার পুরোটাই দেশের গরীব, অসহায়, বেকার নারী, পুরুষ ও শিশুদের জন্য করা। এই এনজিওতে পেশাগত লোকদের দ্বারা হস্তশিল্প যেমন শখের হাড়ি সহ নানা ধরনের মৃৎশিল্প, নকশিকাঁথা, বেতের বা পাটের বিভিন্ন শৌখিন ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, বাটিক প্রিন্টের কাজ, হাতের সেলাই ইত্যাদি শিখানো হচ্ছে।

নিপীড়িত নারী ও বেকার পুরুষদের অধিকাংশ গ্রামের হওয়ায় তারা আগে থেকেই এই কাজে অভ্যস্ত। পেশাদার শিল্পীদের সহযোগিতায় আরও নিপুণহাতে কাজ করছে তার। বাসন্তীর শহরে খোলা শোরুমটাও ইতিমধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছে।

এতসব কাজের মাঝে কোথায় যেন ভাটা পড়ে যায় অতীত। চাপা পড়ে যায় সেই আবেগ ও কষ্টগুলো। হ্যাঁ, মুক্তির স্বাদ পেয়েছে বাসন্তী। মানুষের থেকে তো মুক্তি পাওয়া যায়, মানুষের তৈরি কারগার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
তবে অনুভূতির কারাগার? অনুভূতি হলো আস্ত অজগর এক সাপের ন্যায়। প্যাঁচিয়ে ধরে থাকে সর্বক্ষণ। অনুভূতির কারাগারে মুক্তি নামক শব্দটি নেই।
এই অনুভূতির কারাগারেই বন্দী বাসন্তী।

“দেখো, দেখো, ছোট বউমা। তোমার এইটুকুনি মেমসাহেব আমারে খামচিয়ে করলো দেখো।”
বলতে বলতেই ঘরে ঢুকলেন সাহেরা বানু।

আঁচলে মুখ চেপে হাসছেন সাহেরা বানু। তিনি হলেন মোস্তফা বাড়ির কেয়ারটেকার মধু মিয়ার স্ত্রী। বর্তমানে তিনি এবং তাঁর স্বামী উভয়ে বাচ্চাদের দেখাশোনার দায়িত্বও সমান তালে পালন করছেন।

বাসন্তীর ঘোর ভাঙে। হালকা হেসে এগিয়ে যায় সাহেরা বানুর দিকে। নাহিবাকে কোলে তুলে নিয়ে। আলতো হাতে গাল ছুঁয় তার।

কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“এমন জল্লাদপনা করে না কি মা? তোমার দাদুন হয় না? এমন করলে কিন্তু পিট্টু দিব তোমাকে আম্মো।”

“বপ!” চোখ রাঙিয়ে চেঁচিয়ে উঠে নাহিবা।

নাহিবার এমন আচারণে অবাক হয়নি বাসন্তী, না হয়েছেন সাহেরা বানু। মেয়েটা বড্ড দস্যু হয়েছে, একে মারবে, ওকে মারবে। বিপরীতে কিছু বললে বা বকা দিলেই ‘বপ’ তথা ধমক দিতে ভুলে না। তবে আজকাল খুব বেশি একটা শব্দ উচ্চারণ করে নাহিবা। তা হলো ‘বাবা’। যা শ্রবণগত হতেই আরও পোড়ন বাড়ে বাসন্তীর।

___

ফাহিম অফিস থেকে এসে জানতে পায় আর পনেরো দিন পরই পূর্ণতা কানাডার ফ্লাইট। বিষয়টা জানতে পারার পর থেকেই বুকটা ভার ভার লাগছে তার। মনে হচ্ছে তার অতি প্রিয় কী যেন হারিয়ে যেতে চলেছে। এ এক অন্যরকম যন্ত্রণা।

আনমনেই ভাবে সে,
– এমনটা তো শুধু চৈতালির জন্য বোধ হতো। এখন পূর্ণের যাওয়ার কথা শুনার পর থেকেই… তবে কি শূণ্য হৃদয়ে পূর্ণতাকে নিয়ে কোনো অনুভূতির জন্ম হলো?

তার প্রশ্নের উত্তর বহু খোঁজ করেও জানতে পারল না। ঘাম সিক্ত শার্ট নিয়েই বসে থাকল বিছানায়। একটু বাদেই বেডরুম থেকে হাসাহাসির শব্দ শুনতে পায়। ধীর পায়ে ঘরের দরজা খুলে দাঁড়ায় সে।

দেখতে পায় পূর্ণতা তার মা ও খালার সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। কথার মাঝেই পূর্ণতা ও তার খালা শব্দ করে হেসে উঠছে। তার শয্যাশায়ী মাটাও নীরবে হাসছি। এ হাসি দেখা যায় না, চোখের ভাষায় প্রকাশিত হয়।

ইদানীংকালে ফাহিম খেয়াল করেছে তার ইটের নীরব, নিস্তব্ধ দালানটা হুট করেই যেন প্রাণোচ্ছল ও কলরবমূখর বাসা হয়ে উঠেছে। এখন মনে হয় এখানে একটি পরিবার থাকে।

এই সব পরিবর্তনের পিছনে পূর্ণতারই হাত তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। মেয়েটাই এমন সারা ঘর সবসময় মাতিয়ে রাখে। এমন কী ফাহিমকে নিজের কথার জালে ফাঁসিয়ে অতীতের ক্ষতগুলো ভুলিয়ে রাখে।

ফাহিম আপন মনেই বিড়বিড়ায়,
“পূর্ণতাকে ভালোবাসতে কিংবা চৈতালির জায়গা দিতে পেরেছি কি না জানি না। কিন্তু পূর্ণতার জন্য একটা ভালো লাগা বা মায়া তো তৈরি হয়েই গেছে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো তাকে আমার প্রয়োজন। আমার ইটের দালানকে শান্তির নীড় বানাতে তাকে প্রয়োজন।”

ফাহিম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে পূর্ণতার সম্মুখে একটা প্রস্তাব সে রাখবেই। রাজি হোক কিংবা না হোক সেটা পূর্ণতার বিষয়। তবে যুবকের মনে পাকাপোক্ত এক আশা আছে যে মেয়েটা তাকে ফিরাবে না। অন্ততঃ পক্ষে এই মানুষগুলোর জন্য তো না-ই।

___

নায়িম এক মনে লেপটপে ডুবে আছে। অনেক কাজ জমে আছে তার। বাসন্তী সব সামলে নিলেও ব্যবসার হিসাব ও অন্যান্য বিষয় সহ ও বড় বড় প্রজেক্টগুলো নিয়োজিত লোকদের ভরসাতেই চলেছে গোটা বছর।

কারণ একদম অনভিজ্ঞ ও স্বল্পশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত বাসন্তী, চৈতালির পক্ষে এই কাজে ধরা সম্ভব হয়নি। নায়িম আসার পর থেকেই অবিশ্রাম ভাবে কাজে উঠে-পড়ে লেগে আছে।

অনিমেষ গোল গোল চোখে বন্ধুর কাজ-কারবার খেয়াল করে। সে ভেবেছিল বাসন্তীর বাড়ি ছাড়ায় নায়িম জ্বলে-পুড়ে ছাড়খাড় হবে, চার দেওয়ালে বন্দী হবে, ডিপ্রেশনে তলাবে। মানে দেবদাশের দশা হবে আর কী!

কিন্তু তাকে অবাক করে নায়িম তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বরং, তার আচারণ স্বাভাবিক ও গম্ভীর৷ চেহারায় গাম্ভীর্যপূর্ণ, বেদনার ব মাত্রও নেই তাতে।

হ্যাঁ, যেদিন বাসন্তী চলে গিয়েছিল সেদিন খাণিক ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রমণীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর কাজে ডুবে যায়। দুটো মাস যে কেটে গিয়েছে, তার মধ্যে একবারও বাসন্তী বা নাহিবার নাম সুদ্ধ উচ্চারণ করেনি নায়িম।

অনিমেষ আজ বেশ বিরক্তই হয়ে উঠে নায়িমের প্রতি। সেদিনই তো বলেছিল ভালোবাসি, আর এখন এতটা অনুভূতিহীন আচারণ।

“তুই কি ভুলে গিয়েছিস ভাবী রাগ করে চলে গেছে? তোর মধ্যে সামান্যতম খারাপ লাগা আছে এ নিয়ে? মানে সিরিয়াসলি এতটা ইনসেন্সেটিভ মানুষ কীভাবে হয়!”

তার কটাক্ষ-বানেও নায়িমের ধ্যান ভঙ্গ হয় না। চোখ জোড়া লেপটপে স্থির রেখে সে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,
“তো কী করব? দরজা আটকিয়ে ঘরে বসে বসে কাঁদব না কি সারা জীবন ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে রাখা মদ-সিগারেটকে আপন করে নিব? কিন্তু এতে কি বসন্ত ফিরে আসবে? তা হবে না, তবে আমার ব্যবসা আরও ডুববে বটে।”

“ভালোবাসা আদায় করে নিতে হয়। বাসন্তী ভাবীকে বুঝা তুই তাকে ভালোবাসিস। ক্ষমা চা বারবার, কাছে টেনে নে, বারবার কর্মে, কথায় সবকিছুতে বুঝা ভালোবাসি। তবেই তো প্রাপ্তির থলি পূর্ণ হবে, ভালোবাসা আদায় হবে।”

“যেই ভালোবাসা অলরেডেই আমার, তা আমি কী আদায় করব? বাসন্তী আমাকে আজও ভালোবাসা। কিন্তু আঘাত করেছি আমি তার হৃদয়ে। যার জন্য তিক্ততায় আবৃত সে আজ।

জীবন, বয়স, সময় কোনো কিছুতেই থেমে থাকে না। সময় সব ক্ষতই পূরণ করে, শুধু সময়কে একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন।
দেহের ক্ষততে সঙ্গে সঙ্গে মলম দেওয়া লাগে, কিন্তু মনের ক্ষতকে আগে শুকাতে দিতে হয়।

আমিও তাই দিচ্ছি। এখন ক্ষমার মলম লাগালে তা নিছক অভিনয় ছাড়া বসন্তের নিকট কিছুই লাগবে না।”

অনিমেষ রিনরিনে গলায় শুধায়,
“শালায় চালাক আছে। কিন্তু দেখবো নে এই চালাকি কত দিন ভাবীর মান-অভিমানের সামনে?”

___

রাতের বেলা, নায়িম বিছানায় বসে টিভিতে নিউস ছেড়ে মোবাইলে দেখছে। হুট করেই সে শুনতে পায় রিপোর্টার চড়া গলায় বলছে,
“আলাদা বসবাস করছে আদর্শ দম্পতি নায়িম-বাসন্তী, তবে কি ডিভোর্স হতে চলেছে তাদের?”

নায়িমের মাথায় হাত। মিডিয়াতে বাসন্তী ও তার সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার কথা লিক হলে ইমেজ নষ্ট হতে দেরি লাগবে না। তবে এখন কী করবে সে? তাকে কী তার অপরাধী চেহারা নিয়েই উপস্থিত হতে হবে বাসন্তীর সম্মুখে? যদি তাই-ই হয় তবে বাসন্তী কি গ্রহণ করবে তার আবেদন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here