টক্সিক_রিলেশনশীপ পর্ব ৩৪

#টক্সিক_রিলেশনশীপ
||৩৪তম পর্ব||
-ঈপ্সিতা শিকদার
বাসন্তী সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খেতে বসেছে। সাহেরা বেগম তাকে নাস্তা দিয়ে টিভি নাহিবাকে নিয়ে টিভি খবর দেখতে বসেছেন। তাঁর বেশি সাউন্ডে টিভি দেখার স্বভাব। বাসন্তী ডাইনিং টেবিলে বসেও সব শুনতে পাচ্ছে। হুট করেই যা শুনতে পায় তাতে বুক ধ্বক করে উঠে তার।

খাবার রেখেই বড় বড় পা ফেলে বসার ঘরে উপস্থিত হয় সে। টিভিতে তখনো নিউসটি চলমান।

“ব্রেকিং নিউজ! ব্রেকিং নিউজ! সুখী দম্পতি বাসন্তী-নায়িমের সম্পর্কে ফাটল, আলাদা থাকছেন তারা। তবে কি ভাঙতে চলেছে তাদের সম্পর্ক?”

বাসন্তী ধপ করে সোফায় বসে পড়ে। সাহেরা বানু আড়চোখে বাসন্তীর দিকে তাকান। সান্ত্বনার সুরে বলেন,
“চিন্তা কোরো না বউমা। সব ঠিক হইয়া যাইবো।”

বাসন্তী প্রতিত্যুরে কিছু বলল না। গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখশ্রীতে কী একটা ভেবেই দ্রুতো পদচারণায় নিজ কামরায় চলে গেল।

যাওয়ার আগে সাহেরা বানুর উদ্দেশ্যে বলল,
“মনি, আকরাম কাকুকে বলবেন সবাইকে বলে দিতে আজ আমি আসবো না কোনো কাজে। ঘরেই থাকব। তাই বলে আমার অনুপস্থিতিতে যাতে কাজে কোনো গাফলতি নাহয়। আর আপনি কষ্ট করে নাহিবাকে খায়িয়ে-পড়িয়ে দিবেন।”

ঘরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল সে। সারা ঘরময় পায়চারি করে ক্লান্ত হয়ে বসলো। রমণী নিশ্চিত আজ তার দরবারে প্রণয়ের আগমন হবে। মানুষটা আসবেই আসবে আজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে। আনমনেই বিড়বিড়ালো,

“তুমি আসবে তোমার দাম্ভিকতা চূর্ণবিচূর্ণ হবে আমার চোখের সম্মুখের। তোমার প্রিয় জিনিসটি যে হারানোর পথে। তুমি হাত পাতবে আমার সামনে, আমি প্রতিশোধ পাবো। তবে তা কী শান্তি দিবে আমায়? পৈশাচিক শান্তি?”

ফোঁস বোধক শব্দ করে তপ্ত বায়ু বের হলো তার দেহ থেকে। সাথে বের হলো কিছুটা আশঙ্কা, হতাশা, কামনা।

“জানি না শান্তি পাব কি না। তবে তোমায় দেখতে হবে আজ এসে, তোমায় ছাড়াও তোমার বসন্তকুমারী অনেকটা ভালো আছে। অনেকটা! আজ আমি সাজবো। মনের মতোন সাজবো! তোমার নয়ন দুটোতে ভাসাতে হবে না আমার ভালো থাকার চিত্র!”

নিজের সাথে বোঝা-পড়ার শেষে আলমারিটা খুলে বাসন্তী। সবচেয়ে মনোরম দেখতে শাড়িটি বের করে গায়ে ধরে বড় আয়নাটিতে নিজের প্রতিবিম্বকে পর্যবেক্ষণ করে সে। বাসন্তী রঙের জামদানি শাড়ি সোনালি সুতোর কাজ করা। এই শাড়িটা গায়ে জড়াতেই যেন বাসন্তীর উজ্জ্বল শ্যামা গাটা চাঁদের মতোন চকচক করছে।

বাসন্তী সেই শাড়িই সুন্দর করে আটপৌরে পরে। দু’হাত ভর্তি বাসন্তী রঙা কাচের চুড়ি, কানে স্বর্ণের বড়ো ঝুমকো, গলায় চিকুন একটা চেইন, পায়ে স্বর্ণের পায়েল।। চুলগুলো বেশ কমনীয়তার সাথে আঁচড়িয়ে বাঁকা সিঁথি করে ফেলে রাখে। হৃদয় লোভানো বাঁকা চুলগুলো ছেয়ে রাখে পিঠ।

সাজের সাথে খুব একটা সখ্যতা গড়েনি বাসন্তীর ছোটো থেকেই। সে আশ্রিতা মানুষ একটু সকলের ব্যবহার শেষে পরিত্যাক্ত স্নো-পাউডার তার কপালে জুটলেই ঢেরাসই। তবে আজ রমণী সাজতেও বসেছে। মুখশ্রীতে লাগাচ্ছে বিবি ক্রিম, দামী কম্পেক্ট পাউডার ও ব্লাশ। মৃদু গোলাপি অধর রাঙিয়ে নিয়েছে কালচে লাল লিপস্টিকে। সবকিছু শেষে ভাসা ভাসা চোখজোড়াকে হরিণীর ন্যায় টানাটানা করার প্রচেষ্টায় যত্ন করে কাজল লাগাতে ভুল করে না।

নমনীয়তা, যত্নের সাথে অত্যন্ত পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে সাজানোর পর শুধু কয়েকমুহূর্ত নিজের প্রতিবিম্বকে দেখেই যায় রমণী। মুখে আজ সেই কোমল স্নিগ্ধতা নেই, আজে আছে সূর্যের তেজ। কাউকে জ্বালানো-পোড়ানোর আকাঙ্ক্ষা।

___

ফাহিম গতকাল সারাটা রাত্রি ভেবেছে পূর্ণতাকে নিয়ে। নিজের ভাবনা বদলে ফেলেছে সে। তার মনে হয়েছে সে যেমন সীমার যোগ্য ছিল না, তেমন পূর্ণতারও যোগ্য নয়। মেয়েটা সুন্দরী, যুবতী, অবিবাহিত। সে তার চেয়েও আরও ভালো কাউকে পাওয়ার অধিকার রাখে। তার চেয়েও বড় কথা গতকাল রাতে চৈতালির স্মৃতিকথা তাকে পুড়িয়েছে।

গোটা রাত নির্ঘুম কাটানোয় ভোরের দিকে চোখ লেগে গেছে ফাহিমের। হুট করেই সে আভাস পায় তার মুখশ্রীতে বিন্দু বিন্দু পানিরছিটে পড়ছে।

তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখ হালকা মেলে দেখতে পায় একজন শাড়ি পরা রমণী তার দিকে ঝুঁকে আছে। শাড়িটি আর কারো নয়, চৈতালির, যা সে কাল সারারাত জড়িয়ে ছিল। রমণীর মুখশ্রীর অনেকটাই ঢেকে আছে অর্ধসিক্ত চুলে, আর চুলের পানিই তার মুখে পড়েছে হয়তো।

তন্দ্রাবেশে ফাহিম ভাবে, চৈতালিই এসেছে। জড়িয়ে ধরে মেয়েটিকে। মেয়েটিও আপন মায়ায় আবদ্ধ করে নেয় তাকে। সাথে সাথেই চমকে উঠে চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে।

প্রেয়সীর স্পর্শ চিনে না, এমন প্রেমিক হয়তো দুনিয়াতে নেই।

ফাহিমও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোঁয়ার সাথেই বুঝতে পেরেই এই দেহ তার অপরিচিত, ভীষণ রকমের অপরিচিত। চোখ ভালোভাবে খুলেই দেখতে পায়। এটা পূর্ণতা, চৈতালি নয়।

“সরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”

পূর্ণতার নত দৃষ্টি। চেহারা লজ্জায় আচ্ছন্ন। মুখে মুচকি হাসি। সে বলল,
“না বুঝতে পেরেই বোধহয় ভালো করেছো।”

“সরি?”

“কিছু না। ঐ যে চা এনেছি, পান করো। তোমার পছন্দের লুচি, আলুর দম করেছি। ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করতে চলে আসো।”

উঠে চলে যেতে নেয় পূর্ণতা। ফাহিম ডাক দেয়,

“পূর্ণ?”

“হ্যাঁ, বলো।”

“এই শাড়ি কোথায় পেলে তুমি? এই শাড়ি তো…”

“চৈতালির, তাই তো? সে যেহেতু আগলে রাখেনি তার জিনিসপত্র, অন্যকেউ নিলে ক্ষতি কী? তাছাড়া তোমার বেডে রাখা ছিল আমি পরে নিয়েছি।”

“আর তুমি এত সকাল সকাল আমার ঘরে ঢুকলে কী করে? আজ তো ফজর নামাজ পরতেও আমি উঠিনি, দরজাও খুলিনি।”

“আমি তো প্রতিদিন ফজরের এক-দু ঘণ্টা আগেই তোমার ঘরে আসি। নাহলে তোমার কি মনে হয় কারো অযত্নে ফেলে যাওয়া নেতিয়ে পড়া ফুলগুলো একা একাই প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে?”

“হোয়াট! বাট কীভাবে?”

“আন্টির থেকে স্পেয়ার কি নিয়েছি বহু আগেই। আচ্ছা, শুনেন জনাব চুলোয় তেল বসিয়ে এসেছি। বহু কাজ আমার, আপনার ইনভেস্টিগেশন অংশগ্রহণ করার সময় আমার নেই। সংসার সামলাতে হয়।”

বলে সে মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল। ফাহিম গোলগোল চোখে রমণীর যাওয়া দেখলো। পূর্ণতার ধাঁধাময় কথাবার্তা, তার চাল-চলন দিনদিন আরও যেন অদ্ভুৎ হয়ে উঠছে।

___

নায়িম আপেলে এক কামড় বসাতেই অনিমেষ এসে ত্রাসিত মুখে বলে,
“দোস্ত তুই নিউস দেখেছিস? কীসব আজগুবি কথাবার্তা লিখছে তোকে আর ভাবীকে নিয়ে!”

“হুম, দেখেছি।” খাপছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দেয় নায়িম।

“তো চল ভাবীর কাছে। তোর ইমেজ তো একদম ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে সাংবাদিকরা। এমন হলে তুই তো আর…”

“কী হবে খুব বেশি হলে? আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আর মিউজিক ক্যারিয়ার ধুলোয় মিশে যাবে? ইট’স ওকে। যখন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলাম তখন এগুলোর জন্য বাঁচতে মন চায়নি।

বাঁচতে মন চেয়েছে প্রেয়সীর সাথে বার্ধক্য দেখতে। বসন্তকে আর একবার হলেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো। এই সম্পত্তি, ক্ষমতা আমায় টানেনি তখন টেনেছে সম্পর্ক, ভালোবাসার মায়া। এগুলো ধ্বংসে হলে হোক, আমি হলেও হলাম, আমার ধ্বংসেই নাহয় বসন্ত প্রাচুর্য পাক।”

গাম্ভীর্যপূর্ণ গলায় কথাগুলো বলে শব্দ করে এক শ্বাস ফেল নায়িম। সেই উষ্ণ নিঃশ্বাসে কিছু একটা ছিল যা অনিমেষকেও নিশ্চুপ করে দেয়। গভীর আকুতি, অপ্রকাশিত ভালোবাসা ও বেদনা, আরও কী কী যেন।

“এতোই যখন ভালোবাসিস। যাস না কেন ভাবীর দোয়ারে? মানাস না কেন তাকে?”

“জানিস আমি যখন মরবো ভেবে ফেলেছি। তখন আরও একটা বিষয় আমাকে পোড়াচ্ছিল, আমি মরলে আমার বসন্ত আর নাহিবাকে আগলে রাখবে কে? নাহিবা তো ছোট্ট, আর বসন্ত হলো অবুঝ চড়ুই পাখির মতোন।

আমার চারধারে শত্রু। ভদ্র সমাজ, আঁধার সমাজ দুই জায়গাতেই ক্ষমতাধর হওয়ায় আমি সবার চোখের কাটা। কখন মরি ঠিক নেই। এই মুহূর্ত বেঁচে আছি, পরমুহূর্তেই মরে যেতে পারি। আমার মৃত্যু নিশ্চিত হলে বসন্ত-নাহিবাকে থেকে সব ছিনিয়ে নিতে ভুল করবে না তারা।

বসন্তকে তাই আমি ছাড়াই নিজের নাম কামাতে হবে, শক্ত পাহাড়ের ন্যায় হতে হবে। যাকে টক্কর দেওয়ার সাহসও কারো হবে না। এর সূচনা হয়েই গিয়েছে। বসন্ত নিজের এনজিও খুলেছে, কারখানা খুলেছে, শহরে একটা শোরুমও খুলেছে।

আমার বিশ্বাস আমার প্রেয়সীর আলাদা নাম তৈরি হতে দেরি নেই। তারপর মরলেও শান্তি। মনে সাহস থাকবে আমার স্ত্রী-সন্তান ভেসে যাবে না বন্যার জলে।”

কথাগুলো বলার সময় অনুভূতিহীন নায়িমেরও কেন যেন গলা কেঁপে উঠে? প্রিয়জনের মায়া বুঝি এতই ভয়ংকর! কে জানে? নিজের আবেগ লুকাতে গম্ভীর মুখে তাড়াতাড়ি অনিমেষ থেকে দূরে চলে যায় নায়িম। আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ তার কর্ম নয়।

অনিমেষ ম্লান হেসে বন্ধুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড়ায়,
“তুই সত্যিই অদ্ভুৎ নায়িম। বড়োই অদ্ভুৎ। কীসের এত কৃপণতা তোর ভালোবাসা প্রকাশে? একজন নারী যে অধীর অপেক্ষায় থাকে তোর একটু ভালোবাসা বোধ করতে, তা কেন তুই বুঝিস না?”

___

সন্ধ্যা পেড়িয়ে গভীর রাত নেমেছে, নিঝুম রাত! কী নিথর রাত! না আছে কোনো কোলাহল, না কোনো ভীড়, না কোনো আলো-ছায়ার খেলা।

এত শান্তির মাঝেও বাসন্তী মনে শান্তি নেই। আছে রাশি রাশি উত্তেজনা, অবিরাম অস্থিরতা। কারণ নায়িম যে আসেনি। তবে একজন এসেছে খান বাড়ি থেকে। সে হলো চৈতালি।

বাসন্তী ভেবেছিল চৈতালিকে হয়তো নায়িমই পাঠিয়েছে নিজের কথা মানাতে। কিন্তু পরে জানলো চৈতালি কাউকে না বলেই এসে পড়েছে। এমন কী সে বাসন্তী-নায়িম সম্পর্কিত ছাপানো খবরের বিষয়ও প্রথম জেনেছে বাসন্তীর মুখ থেকেই।

বর্তমানে আশাহত বাসন্তী। ভাবলো,
– নায়িমের জীবনে আগে যা একটু মূল্য ছিল, কিন্তু এখন কি একটুও মূল্য নেই তার? যুবক কেন তার সামনে আসলো না ক্ষমার আবেদন নিয়ে? সে কেন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে পারল না? কেন তাকে জানাতে পারলো না যে সে তাকে ছাড়াই ভালো আছে?

রাতের আঁধার বাড়তেই বাসন্তী সব হিসাব-নিকাশের অবসান ঘটালো। নিজেকে বুঝাতে মনে মনেই বলল,
“আজ সুযোগ আসেনি তো কী হয়েছে? কোনো দিন তো সামনে আসবে। তখন বুঝিয়ে দিব আমি বেশ।আছি তাকে ছাড়াই।”

তখনই কাঁধে হাত রাখলো কেউ। চমকে উঠে পিছনে ঘুরলো বাসন্তী। চৈতালি মুচকি হাসির সহিত দাঁড়িয়ে আছে।

“কেমন আছো?”

“এই তো আছি। দেখতেই তো পাচ্ছে, সাজগজ, অলঙ্কার, কাজ-কারবার সবকিছু নিয়ে খারাপ নেই তো।”

“সত্যিই তো। ভালোবাসা ছাড়া ভালো থাকা যায়?”

বাসন্তী মুখশ্রীতে অমলিন চওড়া এক হাসি এঁকে নিয়ে বলল,
“প্রেম, ভালোবাসার বাহিরেও অনেক কিছু আছে জীবনে, পৃথিবীতে। ভালোবাসাময় জীবন হয়তো একটু কাঁটাময় মাধুর্যপূর্ণ, কিন্তু প্রেমহীন জীবনটা বিরস হলেও মন্দ নয়।”

চলবে…
জানি না সিজন পরিবর্তন না কীসের জন্য তবে বাসার সবাই যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আম্মু তো রাত থেকেই সিক, ভোরের দিকে ব্যথা আরও বেড়ে যায়। কারোই ঘুম হয়নি আজ এজন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here