টক ঝাল মিষ্টি পর্ব -০৯

#টক_ঝাল_মিষ্টি (পর্ব ৯)
নুসরাত জাহান লিজা

লাবণ্য ফিরতে ফিরতে সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। নিশি বারবার এটা সেটা গল্প তুলছিল, বেরোতেই পাঁচটা বেজে গেছে। বৃষ্টির জন্য সিএনজি পেতেও দেরি হয়েছে। সবমিলিয়ে যা তা অবস্থা। যেদিন তাড়াহুড়া করতে চায় সেদিন প্রকৃতি ঐকমত্য প্রকাশ করে না, বরং বিরোধী পক্ষে চলে যায় বোধহয়। নইলে তখনই কেন সব এমন এলেবেলে হয়ে যায়! অনিকেতের অফিস পাঁচটায় শেষ হয়, বাসায় ছয়টার মধ্যে পৌঁছে। আজ বেচারা চাবিটাও নিয়ে যায়নি। খুব বেশিক্ষণ হয়তো অপেক্ষায় রাখতে হবে না অনিকেতকে। সিএনজিতে বসে এসব ভাবতে ভাবতে একবার কলও করল, লাভ হলো না, ফোন তখনো বন্ধ।

বাসার গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখল সিঁড়ির মুখে অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা লেগেছে মনে হলো, নাক মুছতে মুছতে নাকের ডগা লাল করে ফেলেছে, থমথমে মুখ।

“স্যরি, ফিরতে দেরি হয়ে গেল। তুমি কয়টায় এসেছ?” জিজ্ঞেস করল লাবণ্য।

“অনেকক্ষণ।” সবসময় যাই বলুক, অনিকেতের গলায় একটা ফূর্তি ভাব থাকে। পেছনে লাগলেও অন্যথা হয়নি কখনো। কিন্তু এখন সেটা অনুপস্থিত। লাবণ্য কথা না বাড়িয়ে পা চালাল, অনিকেত ধীর পায়ে পিছু নিল।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে অনিকেত বেশ কয়েকবার শব্দ করে হাঁচি দিয়েছে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই লাবণ্য শুনল,

“মাত্র দেড় ঘণ্টা বৃষ্টিতে ভিজিয়েছো, আরেকটু দেরি করতে তাহলে তোমার উদ্দেশ্য আরও ভালোমতো সফল হতো।”

“এভাবে কথা বলছো কেন? আমার আবার কীসের উদ্দেশ্য থাকবে?” লাবণ্য বুঝতে পারে না অনিকেত কীসের কথা বলছে।

অনিকেত কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসল, “বুঝতে পারছ না, তাই না? বেমালুম চেপে যাওয়াটাই ভালো, কী বলো? আমাকে যত বোকা ভাবো, আমি কিন্তু তত বোকা নই। তোমার কথায় আমি আর ভুলছি না।”

“অনিকেত, যা বলার স্পষ্ট করে বলো, এসব ঘোরানো প্যাঁচানো কথা আমার একদম সহ্য হয় না।”

অনিকেতের বলার ধরন লাবণ্যর পছন্দ হচ্ছে না। তবে বুঝতে পারে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বলে রেগে আছে। তাই নিজেই আবার বলল,

“আরে, আর বলো না, নিশি এমন করে ধরল যে আর না…”

“থাক, তোমার কাছে কোনো এক্সকিউজ চাইনি। এটা তো এখন তোমার রাজত্ব। আমি সামান্য চুনোপুঁটি মানুষ। তুমি যা করবে সব ঠিক, আমি যা-ই করি সেটা মহা ভুল। তোমার যা ইচ্ছে তুমি তাই করতে পারো। এই যে দয়া করে এতক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজিয়ে ফিরে এসে আমাকে আরও ভেজার হাত থেকে বাঁচালে, এরজন্যই তো আমার হাজারবার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তা এই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এখন কী সেবা করলে খুশি হবেন আপনি? আপনার আদেশ শিরোধার্য। বলুন, বলুন? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”

অনিকেত অত্যন্ত কঠিন গলায় কথাগুলো বলল, বলার সময় বেশ কয়েকবার পাশের অভিব্যক্তি বদলে গেল, কখনো ক্ষোভ, কখনো তাচ্ছিল্য তো কখনো ব্যঙ্গ। লাবণ্য হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। কিছুদিন আগেই না দু’জন বন্ধুত্ব করল! এই তবে বন্ধুত্বের নমুনা? একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করল না যে কোথায় গিয়েছিল, কেন দেরি হলো? নিজে নিজে সিদ্ধান্তে চলে গেল।

“তোমার মনে হচ্ছে আমি এটা ইচ্ছে করে করেছি?” ভাঙা গলায় বলল লাবণ্য, চোখে আহত দৃষ্টি।

“মনে না হবার তো কোনো কারণ নেই। তুমি প্রথম থেকেই আমার দুর্বলতা খুঁজে বের করে তাতে আঘাত করেছ, জেতার জন্য, আমাকে কোনঠাসা করার জন্য। এটা তো নতুন কিছু নয়।”

“অনিকেত, সেটা আগের কথা। এখন তো আমরা সেসব পেরিয়ে এসেছি, তুমি এখনো ওসব পুষে রেখেছো? তখন তুমিও আমার পেছনে লেগেছো। কই আমি তো কিছু মনে প্যাঁচিয়ে রাখিনি।” মনের জোর খাটিয়ে কথাগুলো বলতে পারল। কেমন যেন গলায় আটকে আসছে কথারা।

“আমিও তাই ভেবেছিলাম। কী বোকা আমি বলো? ভাগ্যিস শাহেদ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে যে তুমি সময়মতো ঠিকই ছোবল দেবে। তাই আগেভাগেই বুঝতে পারলাম।” এখনো হাঁচি-কাশি অব্যহত আছে অনিকেতের।

“শাহেদ কে?” জিজ্ঞাসু দৃষ্টি লাবণ্যর।

“সেটা জেনে কী করবে?”

“যা-ই করি, শাহেদ কে সেটা আগে বলো।”

“আমার বন্ধু প্লাস কলিগ।”

“সে কি আমাকে চেনে? সামনা-সামনি দেখেছে কখনো?”

“সামনা-সামনি না চিনলেও আমার মুখে সে সবকিছুই শুনেছে তোমার সম্পর্কে।”

এবার লাবণ্যর সত্যিকারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি কি খালি সাইজে বড় হয়েছো? বুদ্ধি নাই মাথায়? এত বড় মগজটা একটু খাটাও, হাঁটুতে বুদ্ধি নিয়ে ঘুরলেই মানুষকে ম্যাচ্যিয়ুর্ড বলা যায় না। ইউ আর সাচ এন ইমম্যাচ্যিয়ুর্ড অনিকেত। যেখানে বছরের পর বছর একসাথে থেকে মানুষ চেনা যায় না, সেখানে যে আমাকে কোনোদিন দেখেনি পর্যন্ত তার কথায় আমাকে জাজ করতে এসেছ? এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে কিনা আমি জানি না। তুমি আমাকে এই কয়দিনে একটুও চিনতে পারোনি?”

অনিকেত যেন আজ অস্ত্র নিয়ে তৈরি, অনবরত বুলেট-বৃষ্টি চলছে, বলল,
“চিনেছি বলেই তো মিলিয়ে নিতে পারলাম। মাঝখানে কনফিউজড ছিলাম, এখন আর সেটা নেই। তোমাকে হাড়েমজ্জায় চিনেছি আমি। তুমি আমার ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চড়াও হয়েছো। যবে থেকে তোমার সাথে দেখা হয়েছে তবে থেকে আমার জীবনের সব স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে। আমি ইচ্ছেমতো কিছুই করতে পারি না, সারাক্ষণ মনে হয় আমি একটা জেলখানার সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। সারাক্ষণ নিরাপত্তারক্ষীর দৃষ্টি আমার উপর, কখন কী ভুল করব, আর তারজন্য পানিশমেন্ট পাব। আমি এমন জীবন চাই না। আমি একটু প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিতে চাই। নিজের মতো বাঁচতে চাই৷ কিন্তু তোমার জন্য কিছুই হচ্ছে না।”

লাবণ্য রীতিমতো যুদ্ধ করে চোখের মধ্যেই পানি আটকে রেখেছে গড়িয়ে পড়া থেকে। কোনোরকমে বলল,

“এটা যদি তোমার শেষকথা হয় তবে আমি কাল চলে যাচ্ছি। তুমি যা ইচ্ছে হয় কোরো। মুক্ত হও বা চিড়িয়াখানায় থাকো, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমি দেখতে আসছি না। এটাই চাইছো?”

“তুমি কী করবে সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। আমি তো বলতে পারন না।” নির্বিকার চিত্তে কথাটা বলল অনিকেত।

“খুব ভালো। তুমি থাকো তোমার স্বাধীনতা নিয়ে। আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করতে আসব না।”

কথাটা বলেই লাবণ্য রুমে চলে গেল, অনিকেতের রুমে নয়। দরজা বন্ধ করে ভেঙে পড়ল। যেখানে সম্পর্কের মধ্যে কোনো সহনশীলতা নেই, সমঝোতা নেই সেটাকে কি আদৌ সম্পর্ক বলে! যে লোকটার বাস্তব জগতের সাথে তেমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই, অন্যের কথায় নিজের সিদ্ধান্ত নেয়, এমন অপরিপক্ক ছেলের সাথে থাকতে গেলে প্রতিনিয়ত এমনই হবার কথা! সে তো পাগলাটে, অগোছালো ছেলেটার জীবনটা গুছিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেই জীবনে নিজের একটা অস্তিত্ব স্থাপন করতে চেয়েছিল। প্রথমদিকে কঠোর ছিল সঙ্গত কারণেই, অনিকেতও তো তাই ছিল। তবে তীর কেন শুধু ওর দিকেই? আত্মসম্মানের সাথে আপোষ করা যায় না! তবে তো ওরই অস্তিত্ব থাকবে না!

একটা ব্যথা বুকে টনটন করে উঠে, এই ছেলেটার সাথে থাকতে থাকতে কখন তার অবোধ্য প্রতিকৃতির প্রতিই মায়া পড়ে গেছে কে জানে! মায়া বড্ড কঠিন জিনিস, এই মায়া সে এই জীবনে কাটাবে কী করে! বুকে টনটনে ব্যথা বেড়েই চলছে ক্রমশ!

***
রাতে একজনের চোখেও ঘুম কুমার ভর করল না। এপাশ-ওপাশ করে কাটিয়ে দিল। অনিকেতের একবার মনে হলো, এসব বলেছে, খুব ভালো করেছে। এখন আর ওকে ঘাটাতে আসবে না। আরও আগে বলেনি কেন সেটা নিয়ে আফসোস হলো। তাহলে আগেই এই ঝুঁটঝামেলা থেকে মুক্তি মিলতো।

পরক্ষণেই মনে হলো যা হয়েছে, একদম ঠিক হয়নি। এভাবে না বললেও হতো। একটা দ্বিধা মনে কাঁটা হয়ে খোঁচাতে থাকল। কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে বেঠিক সেটাই বুঝতে পারল না! ভাবলো সকালবেলা একবার স্যরি বলে ঝামেলা মিটিয়ে নেবে। এই সিদ্ধান্ত যখন নিতে পারল, তখন প্রায় ভোর, ভোরের দিকে চোখ ভরে ঘুম এলো। তাই সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো না।

লাবণ্যর ডাকে যখন ঘুম বিদায় নিল, তখন প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই৷ রাতে ঠান্ডার জন্য উঠে হিসটাসিন খেয়ে ঘুমিয়েছিল বলে এই অবস্থা। এখনো মাথা ভার ভার লাগছে। কোনোরকমে চোখ খুলে দেখল লাবণ্য তৈরি হয়ে এসেছে।

ঘুম ঘুম গলায় জিজ্ঞেস করল, “কোথাও বেরোবে?”

“আমি আমাদের বাসায় চলে যাচ্ছি, একেবারে। তুমি উঠে দরজা লাগাও।”

অনিকেতের আচমকাই গতকাল সন্ধ্যার খণ্ড প্রলয়ের কথা মনে পড়ল। হৃদপিণ্ডটা যেন ধ্বক করে উঠল সহসা। পড়িমরি করে উঠে বসল। রাগের মাথায় কী না কী বলেছে, তাই ধরে সত্যি সত্যি চলে যেতে হবে!

“সত্যি সত্যি চলে যাবে?”

“তোমার তো স্বাধীনতা প্রয়োজন। আমি স্যরি অনিকেত, তোমার জীবনে অযাচিতভাবে অনুপ্রবেশ করেছিলাম বোধহয়। তোমার ফ্রিডম নিয়ে খুব খুব ভালো থেকো। আসি।” অভিমানী সুর লাবণ্যর গলায়।

অনিকেতের ইচ্ছে করল বলতে, “থেকে যাও।”

কিন্তু মুখে এলো না, এভাবে বলতে সে অভ্যস্ত নয়। বরং বলল, “আমি তোমাকে বাসস্ট্যান্ডে দিয়ে আসি?”

“লাগবে না। পরে কখনো সবকিছু নিয়ে যাব। এখন একা যাচ্ছি বলে তেমন কিছু নেইনি। তুমি তো আমাকে আর বন্ধু ভাবো না যে সাহায্য চাইব।”

অনিকেত আর কিছু বলতে পারল না, মাথাটা খুব ব্যথা করছে। সেভাবেই ছন্নছাড়ার মতো গেট পর্যন্ত এলো। লাবণ্য সিএনজিতে বসতেই সেটা ছেড়ে দিল। যতক্ষণ সিএনজিটা দৃষ্টিসীমার মধ্যে রইল ততক্ষণ সে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে!

লাবণ্য মাথা বের করে একবার পেছনে তাকিয়েছিল, অনিকেত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, ঝাপসা দৃষ্টিতে তাই দেখল। পাজর ভেঙে কষ্টগুলো বেরিয়ে আসতে চাইছে, একটা হতে হতে না হওয়া ভালোবাসার টান এমন প্রবল হয়! কী যে প্রগাঢ় টান! কষ্টটাও তো প্রগাঢ়, এক পৃথিবী অভিমান সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে লাবণ্য!
…………
(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here