টিংটিংটুংটাং পর্ব -০৩

টিংটিংটুংটাং

৩.
শ্বাশুড়ি মা খাইয়ে চলে গেছেন অনেক্ষণ হলো। আমি চুপচাপ উদাস নয়নে বাহিরের দিকে চেয়ে আছি। আবহাওয়া আবারও খারাপ হচ্ছে। বিশাল জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, বড়সড় ঝড় আসবে। আকাশ ভালো নেই, মেঘ ভালো নেই, আমি ভালো নই। কোথা থেকে কালো ছায়ারা এসে আমাদেরও আঁধারে ঠেলে দিচ্ছে। আমার শরীরে তেমন একটা জ্বর নেই। কিন্তু দূর্বলতা রয়ে গেছে। ঘুমে আমি যেন তাকাতে পারছি না। আমি বাসায় যাবো ভাই! নিজের রুমে কম্বল মুড়ি দিয়ে একটু ঘুমাবো। এ জায়গাটা বড্ড অচেনা। আমার আপন না। এখানের কিচ্ছু আমার আপন না।
রঞ্জন দরজা ছেড়ে আমার পাশ ঘেঁষে বসলেন। ঝটপট কপাল, গলার তাপমাত্রা অনুমান করার চেষ্টা করে বললেন, “জ্বর তো নেই। শরীর দূর্বল লাগছে? ঘুমাবে?”

আমি ঘুমাতে চাই। খুব চাই। কিন্তু একটু পর বৌভাত। শ্বাশুড়ি মা বলে গেছেন কিছুক্ষণের মাঝেই পার্লারের মহিলা সাজাতে চলে আসবে। কিভাবে ঘুমাই? আমি মাথা নেড়ে বললাম, “ঠিক আছি। ঘুমাবো না।”
তারপর একটু থেমে বললাম, “আমার বোন কোথায়? ওকে এখানে আসার পর আর দেখিনি। একটু ডেকে দিবেন?”

“আচ্ছা।”

কথাটা বলেও রঞ্জন গেলেন না। বসে রইলেন। আমার দৃষ্টি আবারও জানালা পর্যন্ত গিয়েই থেমেছে। হাজার হাজার চিন্তায় আমি জল্পনা-কল্পনা কোষছিলাম। যখন বুঝলাম রঞ্জন এখনো যাননি, ফিরে তাকালাম। আমি আগেও বলেছি, রঞ্জনের মুখটা ভীষণ সুন্দর। এবার আরও একটা দিক খেয়াল করলাম, তার চোখদুটো কোনো মানুষকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা খুব বেশিই রাখে। কালো কুঁচকুঁচে চোখের মণি। যেন গভীর সমুদ্র। একটু বেখেয়ালি হলেই ডুবে তলিয়ে যাব। তারউপর লোকটা বোধহয় একটু সম্মোহনী দৃষ্টিতেই দেখছে আমাকে। স্নিগ্ধ, মুগ্ধ, তৃপ্ত চাহনি। আমি অস্বস্তিতে চোখ নামিয়ে নিলাম। রঞ্জন একটু ভারি গলায় বললেন, “তুমি আমাকে এত বেশি অপছন্দ করো কেন? আমি কি করেছি?”

দ্বিধাহীন অভিযোগ, কৌতূহল। আমি উত্তর দিতে পারলাম না। কিন্তু ঠিকই তার জন্য আমার মায়া হলো। এমন মায়া, যে মায়া আমাদের দুজনের কারো ভালোতেই আসবে না। এ মায়া কারো প্রয়োজন নেই।

বৌভাতে আমার যতটুকু ক্লান্ত লাগবে ভেবেছিলাম, ততটা আসলে লাগেনি। এ বাড়ির সবাই-ই একটু পাগলাটে ধরণের। তবে আচার ব্যবহার ভীষণ ভালো। শ্বশুড় বাবা তো মা ডাক ছাড়া কথাই শুরু করছিলেন না। কিন্তু ওই তিনঘণ্টার বৌভাত অনুষ্ঠানে হাজার বার লজ্জায় পরতে হয়েছে আমাকে। কারণটা অবশ্যই রঞ্জন। উনি স্থির থাকতে পারছিলেন না। কিংবা আমার থেকে দূরেও থাকতে পারছিলেন না। এই সেই ওযুহাতে আমার দিকে নজর রেখেছেন সারাটা সময়। শেষে যখন সবাই বিরক্ত হয়ে একপ্রকার তাড়িয়ে দিতে চাইলো, রঞ্জন লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ফটাফট বলে উঠলো, “ওর শরীর এখনো দূর্বল মা। এতক্ষণ অনুষ্ঠান করার কি আছে? ও যেয়ে ঘুমাক একটু।”

শ্বাশুড়ি মা এমন নয়নে চাইলেন তখন যেন ভস্ম করে দিবেন। কিন্তু পরে ঠিকই আমাকে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই মহিলাকে আমি বুঝতে পারি না। তিনি আসলে কি চান? আমাকে পছন্দ করেন নাকি অপছন্দ?

রঞ্জন মা’রা’ত্বক গিটার বাজাতে পারেন। গানের গলাও অসম্ভব সুন্দর। এ ব্যাপারটা আমি জেনেছি অনেক পরে। রঞ্জন খুব করে চাইলেও তার সাথে আমার সম্পর্কটা ১মাসের মাথাতেও স্বাভাবিক হচ্ছিল না। আমার অনিহার কারণেই। তিনি সকাল সকাল আমার সাথে উঠছেন। সময় পেলে আমাকে রান্নায় সাহায্য করছেন। সাহায্য বলতে আকামই করছেন বেশি। ওইদিন তো একটা দামি প্লেট ভেঙ্গে দিলেন। আমিও অতকিছু বলিনা। করুক না যা ইচ্ছে। আমি সম্পর্কটাকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। তার কলেজে যাওয়ার সময় জামাকাপড় এগিয়ে দেই। মাঝে মাঝে উনি দুপুরে খেতে চলে আসেন। তখন টুকটাক কথা হয়। বিকেলে কলেজ ছুটির পর কাজ না থাকলে ঘুরতে নিয়ে যান। এরপর তার সাথে আমার দেখা হয় একদম রাত্রে, ঘুমানোর সময়। ঘুমানোর আগে এক ঘণ্টা গুণেগুণে রঞ্জনকে দিতে হয়। এটা দিতে আমি বাধ্য। রঞ্জন সারাদিনের জমানো কথা, কি কি করলেন সব কিছু একদম গুছিয়ে গুছিয়ে বর্ণনা করেন আমাকে। আমি বুঝি, মানুষটা আমাকে নিজের সাথে ফ্রি করার চেষ্টা করছে, মিশতে চাইছে। আমিও একধাপ আগানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ঠিকই ঘুমাতে গেলে তার আর আমার মাঝে একটা কোলবালিশ রয়ে যায়। আমি জড়তায় সরাই না। আর সে ভাবেন, হয়তো আমি এখনো মানিয়ে নিতে পারিনি।

দিনটা রবিবার।
রঞ্জন কলেজ থেকে অনেকটা দেড়ি করেই ফিরলেন। রাত দশটা তখন। বন্ধুদের সাথে একটু লেকের পারে বসেছিলেন নাকি! আমি প্রতিদিনের মতো একগ্লাস ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত এগিয়ে দিলাম। বিনিময়ে হাসলেন একগাল। কি সুন্দর হাসি! আমাকে বললেন, “আজ খুব ক্লান্ত বুঝলে? তুমি তো আমার দিকে তাকাওই না। তোমার বিরহে শুকিয়ে হাড্ডি বের হয়ে যাচ্ছে, সে দিকেও খেয়াল রাখছো না।”

আমি একপলক তাকালাম মাত্র। আজকে বাস্তবিকই তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কিন্তু মোটেও সেটা আমার বিরহে না। ফাজিল লোকটার হাড্ডি কোন দিক দিয়ে বের হলো সেটাও নজরে আসছে না। এ লোক সকালেও হাট্টাকাট্টা ছিল। আমি আলমারি থেকে টি-শার্ট, ট্রাউজার বের করে দিতেই সে আমার দিকে চোখ টিপ মারলো। আমার কিন্তু চমকানোর কথা। কিন্তু আমি চমকাইনি। রঞ্জনের মাথার তার যে ছিঁড়া, সে আমি বিয়ের দিন থেকেই জানি। সুতরাং এতসব চমকানো, টমকানো আমার দ্বারা হচ্ছে না।

গোসল সেরে রঞ্জন আবারও তার স্টাইলে চলে আসলেন। কিসের বিরহ! কিসের ক্লান্তি! বয়স কমে পঁচিশ বছরের যুবক মনে হচ্ছে। আমি বেশিক্ষণ তাকালাম না। আমার বুক কাঁপে। ভয় লাগে ওই লোকের দিকে তাকাতে। চুপচাপ বেলকনির মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পরলাম। রঞ্জন নিচ থেকে একেবারে খাবার খেয়ে এলেন। হাতে গিটার। দক্ষ হাতে গিটারে টিংটিংটুংটাং শব্দ করতে করতে আচমকা বললেন, “আজকে কলেজের একটা মেয়ে এসেছিল, আমাকে প্রপোজ করেছে।”

আমি সময় পেলেই আকাশ দেখি। এটা আমার ছোটোকালের অভ্যাস। আকাশ দেখতে দেখতে বললাম, “ভালো তো।”

“মেয়েটা তোমার মতো না।”

“এটাও ভালো।”

রঞ্জন আমার দিকে একপলক তাকালেন, “তোমার মতো না বলতে, তোমাকে দেখলে যেমন আমার ভদ্র বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, ওই মেয়েকে দেখলে তেমন করেই আমার অভদ্রদের মতো ধাক্কা দিতে ইচ্ছে করে।”

অস্বীকার করতে পারবো না, রঞ্জনের এই সহজ সহজ স্বীকারোক্তিগুলো আমার ভালো লাগে। শুধালাম, “মেয়েটা প্রপোজ করার পর কি বললেন?”

“বলেছি আমার একটা পাগল বউ আছে। সে আমার অপেক্ষা করছে।”

রঞ্জন এতক্ষণ গিটারের দিকে ঢুবে ছিলেন। হঠাৎ করে গিটারের সুর পাল্টালেন। পুরোনো একটা গানের সুর। আমার চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “বলো তুলি, তুমি কি প্রতিদিন আমার আসার অপেক্ষা করো না?”

_________________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here