#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫১
#আফনান_লারা
________
রাত শেষ হতে গিয়েও হচ্ছেনা।সব চেয়ে কষ্ট লাগে তখন যখন ঘুমের শান্তি গায়েব থাকে আর রাতটা হয় দীর্ঘ। ফারাজ ও মনে হয় ঘুমাচ্ছেনা।পায়ের আঙ্গুল নাড়ছে অনবরত।
খাটে হেলান দেয়া অবস্থায় পূর্ণতা এসব খেয়াল করছে।
বিছানায় ঠিকভাবে শুয়েও সে কেন ঘুমাচ্ছেনা তা ভাবে পূর্ণা।সে তো নাহয় জায়গার অভাবে ঘুমাতে পারছেনা।
আরও কিছুক্ষণ নিরব থাকার পর পূর্ণতা বললো,’কাল থেকে আমি আমার রুমে ঘুমাবো,এভাবে চিকন খাটে শোয়ার চাইতে আলাদা শোয়াই ভাল।আগে যেমন ছিলাম ভাল ছিলাম’
‘আর আপনার মনে হয় দাদাজান সহ বাড়ির আর বাদ বাকি সবাই এটা মেনে নেবে?’
‘না মানলে বড় খাট এনে দিক।আমার চোখে ঘুম এসে ভর্তি হয় আছে অথচ জায়গা অসুন্দরের কারণে ঘুমটাকে একটা নাম দিতে পারছিনা।আচ্ছা আপনি ঘুমান না কেন?’
‘আমি কারোর অশান্তি দেখে নিজে শান্তিতে ঘুমাতে পারি না’
পূর্ণতার কেন যেন এই কথা শুনে অনেক আনন্দ হলো।ফারাজের ওর প্রতি টান আছে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে সে গুটিশুটি দিয়ে শুয়ে পড়ে।ওকে হঠাৎ শুয়ে পড়তে দেখে ফারাজ অবাক হলো কিছুটা।
এতক্ষণ তো বসে বসে ঘ্যান ঘ্যান করছিল,হঠাৎ চিপায় ঘুমাতে রাজি হলোই বা কেন!’
———
আনাফ সবার সাথে বসেছে ডিনার করতে।
দাদাজান এক চামচ ডাল খাচ্ছেন আর আনাফকে একবার করে দেখছেন।মানিক সাহেব এখনও জানেন না আনাফ কদিন পর সারথিকে বিয়ে করবে।সারথি আনাফের পাশে বসেই খাচ্ছিল।খাবার খেতে খেতে মানিক সাহেব বললেন,’তা বাবা তুমি আর সারথি কতদিন থেকে বন্ধু?’
‘এই হলো এক মাসের বেশি’
‘সজীবের কথা জানো?’
‘হুম জানি’
‘ছেলে মেয়ে কখনও বন্ধু হতে পারেনা সেটা কি মানো?’
আনাফ মুচকি হাসলো।সারথি থ হয়ে বসে আছে।বাবা যে কোন টপিক থেকে কোন টপিকে টানচেন সেটা নিয়ে সে বেশ ভাল বুঝতে পারছে।
‘মানি। আমি তো বলছিনা আমি আর সারথি কেবলই বন্ধু’
‘তবে?’
এই কথার জবাব দিলেন দাদাজান।বাটির ডাল সবটুকু শেষ করে খালি বাটি মিসেস সোনালীর দিকে ধরে বললেন,’আনাফ তোমার মেয়ের হবু জামাই হয় মানিক।সে সারথিকে বিয়ে করবে’
মানিকের হাত থেকে রুটির টুকরাটা পড়ে গেলো।আশ্চর্য হয়ে তিনি অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন বেলায়েত হোসেনের দিকে।বেলায়েত হোসেন আবার বললেন,’তোমার কি মত?এর আগে তো জোর করে মেয়েকে একটা কাপুরুষের হাতে তুলে দিয়েছিলে।এবার মেয়েকে নিজের মতে কিছু করতে দাও অন্তত ‘
মানিক সাহেব কিছু না বলে উঠে চলে গেছেন।
আনাফ সব দেখেছে চুপচাপ।সারথির পাতের ভাত শেষ হচ্ছেনা শুরু থেকেই,সে হয়ত অনেক চিন্তা করছে বসে বসে।আনাফ তখন ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,’তোমার বাবা তোমার ভাইয়ের বিয়ে আটকাতে পারেনি,তোমার কি মনে হয় তোমার বিয়ে আটকাতে পারবে?’
‘আমি এই নিয়ে বাবার সাথে কথা বলবো’
বেলায়েত হোসেন আনাফকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’বাবা তুমি তোমার পরিবারের সাথে কথা বলবে আজকেই।এরপর কি হয় আমাদের জানাবে।পরিবারের অমতে করা বিয়ে বেশিদিন টিকে না’
আনাফ হাসলো।তার হাসিতে লুকিয়ে আছে বেলায়েত হোসেনের বলা কথাটার নেই কোনো গুরুত্ব।
‘দাদু ভাগ্য বলেও কিন্তু কিছু আছে।এই যে বললেন পরিবারের অমতে বিয়ে করলে বিয়ে বেশিদিন টিকেনা,সজীবের সাথে সারথির বিয়েটা কিন্তু সম্পূর্ণ পরিবারের দ্বারাই। তাহলে সেটা টিকলোনা কেন?সবসময় রীতি অনুুযায়ী সব হয়না দাদু।মাঝে মাঝে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হয়।সারথিকে আমি ভালবাসি,এটা সব চাইতে বড় কথা।আর টিকবে নাকি টিকবেনা সেটা নাহয় আমার উপরই থাকুক।কারণ আমি কিন্তু আমাদের সম্পর্কটার মজবুত খুঁটি।
বাবা মায়ের মতামত থাকবে আমার ধারণা।যদি না থাকে তবে তাদের মত আনতে যা করা লাগে আমি করবো।আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন দাদু। আচ্ছা আজ আমি আসি।ফোনে কথা হবে এরপরে’
দাদাজান ওকে থামতে বলে বললেন,’বাগানের দিকে গিয়ে বসো।তোমার সাথে আমার কথা আছে।আমি এই বেলায় গরম দুধ খাই।তুমিও আমার সাথে খেও’
এই বলে বেলায়েত হোসেন উঠে চলে গেছেন।আনাফ সারথির কানের কাছে আবারও ফিসফিস করে বললো’,যাই,ফোন দিব কিন্তু।রিসিভ করবা ঠিকমত’
এটা বলে আনাফ উঠে চলে গেলো বেলায়েত হোসেনের পিছু পিছু।
—–
আনাফ দাদাজানের সামনে বরাবর বসে আছে চুপচাপ।তাদের দুজনের সামনের টেবিলে ধোঁয়া ওঠা গরম দুধের গ্লাস।আনাফ এমনিতেও রাতে দুধ খেয়ে ঘুমায়।তাই দাদাজানের স্বাস্থ্য সচেতনতা দেখে সে খুশি হলো।দাদাজান কিছুই বলছেননা।অথচ যেভাবে ডেকেছিলেন যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু।আনাফ তো জানেনা দাদাজান ডাকার পর পনেরো/দশ মিনিট কোনো কথা বলেন না।
বেশ কিছুসময় পর গ্লাসের দুধটা শেষ করে তিনি বললেন,’যদি তোমার বাবা মা রাজি না হন কোনোমতেই, তবে কি করবে?শুধু এটার জবাব দাও’
‘যদি একেবারেই না মানে তবে আমার সামর্থ্য আছে সারথিকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকার’
‘মা বাবা এত কষ্ট করে মানুষ করলো তোমায়, সেটার কি দাম নেই?’
‘মাসে মাসে যে চেক আমি তাদের হাতে দিই সেটা কখনওই বাদ যাবেনা।আমি সারথি দুজনেই তাদের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করবো’
——–
সারথি তার রুমে বসে আনাফের কথাই ভাবছিল।আনাফ গেছে কিনা সে তো জানেনা।যদি জানতো!!
আনাফ কি এক বার বলে যাবে!!
দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে সারথির ঘোর কাটে।পেছনে ফিরে বলে,’কে?’
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসেনা।সারথি দু কদম এগিয়ে আবার বলে,’আনাফ?’
‘ধুর!কি করে বুঝলা?’
‘আতরের গন্ধে’
‘আমি আর আতর লাগাবোই না।
চলে যাচ্ছি বলে বলতে এলাম।আবার কবে দেখা হবে কে জানে।”প্রেমের সম্পর্ক পরিবারকে জানালে দেখা করা লাটে ওঠে”
আনাফের এই কথা শুনে সারথির ভীষণ হাসি পেলো।হাসতে হাসতে বললো,’আচ্ছা আমি নাহয় বের হবো দেখা করতে’
‘সত্যি তাই?’
‘হ্যাঁ।আমার তো ধরা বাঁধা নেই।বের হতেই পারি’
‘তাহলে ভাল হলো।তবে আসি?’
‘আসেন’
আনাফ চলে গেলো হয়ত।সারথির নাকের কাছে আতরের গন্ধটা যেন খুব তীব্র হয়ে এসেছে।অথচ আনাফ বললো সে চলে যাচ্ছে।
সারথি সামনে হাত বাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে আনাফ সত্যি গেছে কিনা।সামনে আনাফ নেই,কিন্তু সেই আতরের গন্ধটা খুব মোটা করে পাচ্ছে সে।
এটা কি মনের ভুল নাকি সত্যি আনাফ ওর খুব কাছে।
সারথি শক্ত গলায় বললো,’আপনি যে যান নি আমি জানি।লুকোচুরির কারণ বলবেন?’
আনাফ সত্যি ছিল এখানে।সারথির ঠিক পেছনে।সারথি ধরে ফেলেছে বলে সে চুপিচুপি চলে গেছে আবার।
———
রাত গভীর হতেই ফারাজ টের পেলো তার পিঠের সাথে লেগে আছে পূর্ণতার মাথা।চুলে ঘঁষা লাগাচ্ছে যতবার ফারাজ নড়ছে ততবার ।
ছোটকাল থেকেই তাকে এই রুমটা দেয়া হয়েছে।সে কখনও কোনো কাজিনের সাথেও রাতে এক ঘরে ঘুমায়নি যার কারণে আজ পাশে অন্য একজনকে সে মেনে নিতে পারছেনা।ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছে তার কাছে।উদ্ভট প্রকৃতির মনে হয় সবকিছু।
সে মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো কিন্তু রুম অন্ধকারের দরুণ কিছুই দেখলোনা।তবে অনুভবে বুঝতে পারছে সে।
পূর্ণতা ঘুমের ঘোরে গড়াগড়ি করেনা কিন্তু আজ খাটের বেহাল দশার কারণে তার গড়াগড়ি এসে গেছে এমন ভাবে যে ফারাজ রীতিমত বিরক্ত। সে ফারাজের পিঠে নিজের মাথা ঘঁষেই চলেছে।শেষে ফারাজ উঠে বসে যাওয়ায় তার হুশ ফেরে।মাথা তুলে অসহায়ের মতন চেয়ে থাকে ফারাজের দিকে।
‘আপনি এমন বাচ্চামো শুরু করেছেন কেন পূর্ণতা?’
‘কি করেছি?ফিডারে করে দুধ খেয়েছি?বাচ্চার সাথে তুলনা করছেন কেন?’
‘ফিডারে করে দুধ খেলেও হতো।আপনি মাথা দিয়ে যে জ্বালাতন করছেন আমায়।নিজে তো ঘুমাচ্ছেন না, সাথে আমাকেও ঘুমাতে দিচ্ছেন না’
————–
লেভেন সকাল সকাল এসে হাজির।সে আজ সারাদিন সজীবের সাথে কাটাবে বলে ঠিক করেছে।এসে জানতে পারে সজীব কাল সমুদ্র দেখতে যেয়ে আর বাসায় ফেরেনি।সজীব যে কেবল মন খারাপ থাকলেই সমুদ্রের দিকে যায় এটা লেভেন জানে।
এখন তো ওদের দুজনের হাসিখুশি থাকার কথা।তবে সে কি কারণে কাল সমুদ্রে দেখতে গিয়ে আর আসলোনা।হাতের ব্যাগটা বিছানায় ফেলে লেভেন বিচের দিকে চলে আসে।এসে দেখে তোয়ালে বিছিয়ে সজীব শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে বালির উপর।
লেভেন ওর কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,’কি হয়েছে তোমার বলবে?’
‘কিছুই হয়নি’
‘এরকম তো ছিলেনা।তোমায় ছন্নছাড়া মানায়না সজীব’
‘আমি বেশ আছি’
‘না ঠিক নেই তুমি।সত্যি করে বলবে তুমি সারথিকে আমার চেয়ে বেশি ভালবাসো?’
‘নাহ।আমি কেবল তোমাকেই ভালবাসি’
‘তাহলে ওর জন্য তোমার মন পুড়ছে কেন?’
‘পোড়েনা।আমি ওসব ভাবছিনা’
‘তোমার সাথে থেকে থেকে এতগুলো বছরে আমি এটা জানতে পেরেছি তুমি কখন কাকে নিয়ে ভাবো।’
‘তুমি ভুল লেভেন’
লেভেন সজীবের বুকে মাথা রেখে নিজেও বালিতে গা এলিয়ে দিলো।সজীবের গায়ে বালি লেগে আছে।সেই বালিতে নিজের মুখটা বিছিয়ে সে সজীবের দিকে চেয়ে থাকে।সজীবের চোখ শুধুই রোদমাখা আকাশটার দিকে।সে আকাশের দিকে চেয়ে আছে ঠিক তবে সে অন্যকিছু ভাবছে বলেই আকাশটা দেখছে।
মানুষ আকাশকে দেখতে আকাশ দেখেনা।আকাশ দেখার নাম করে মানুষ নিজের সবচাইতে কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।মূলত আকাশকে পর্দা বানিয়ে সেই পর্দায় মানুষ অন্য ছবি দেখে।
সজীব সেটাই করছে।লেভেন সজীবের বুকে অনেকক্ষণ এপাশওপাশ করে উঠে গেলো।কিছু কিছু পুরুষ মানুষ এমন ভাবে তৈরি যে তারা যাকে একবার মন থেকে চায়,যার মায়ায় একবার পড়ে যায় এরপর যত সুন্দর,যত পারফেক্ট সামনে ঘোরাফেরা করুক না কেন তারা ঐ আগের সুন্দরটাকেই ভাবে,তাকেই চায়।তাদের জোর করে কিছু করানো যায়না।তারা যেটা ঠিক করে রাখে সেটাই করে।সজীব ঠিক সেই কাতারের পুরুষ।সে সারথিকে হয়ত পছন্দ করে যার কারণে এখন লেভেনের সাথে জড়িয়ে পড়ায় সে ওকে চেয়েও মন থেকে সরিয়ে নিতে পারছেনা।
লেভেন বালিতে বসে থেকে এক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ যাবত সজীবকে দেখছিল।
বিচের ঢেউের সাথে মিশে ঠাণ্ডা হাওয়া মিলিয়ে যে রোমান্টিক এপটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল সেই পরিবেশটাকে সজীব নেহাত উড়িয়ে দিচ্ছে। তার মনে প্রেম আসছেনা।
লেভেন সজীবের হাত একটা টান দিয়ে বললো,’চলো সাঁতরাবো’
‘ইচ্ছে করেনা’
‘করবে,এসো আমার সাথে’
‘মনের বিরুদ্ধে কিছু করলে তার ফলাফল কি জঘন্য হয় জানো লেভেন?’
‘আমার সাথে এমন কেন করছো সজীব?তুমি আসলে কি চাচ্ছো?
আমাদের বিয়ের কিন্তু খুব বেশি দেরি নেই।তুমি কি পিছু পা হতে চাও?’
‘লেভেন আমি একা থাকতে চাই।তুমি প্লিজ আজ থেকে তিনদিন পর আসবে?এই তিনদিনে আমি গুছিয়ে নেবো নিজেকে’
লেভেন চুপ করে উঠে চলে গেলো, আর একটিবার পেছনে ফিরে তাকায়নি।ও চলে যেতেই বালি থেকে উঠে সজীব পানির দিকে গেলো।
সমুদ্রে গা ভেজানো যায় মন ভাল থাকুক কিংবা খারাপ থাকুক।তবে সেটা একা একা।
পাশে কেউ থাকলো মন যেন ভরে না।একা একা সাঁতারে যে আনন্দ,সঙ্গীকে নিয়ে সাঁতারে সে আনন্দ অন্যরকম হলেও,আগের আনন্দটার কাছাকাছি কখনওই যেতে পারেনা।
পানিতে ডুব দিয়ে মাথা তুলে সজীব আবারও আকাশের দিকে তাকায়।
সারথি একদিন বলছিল,’জানেন!আমি জানি আকাশটা খুব আলোকিত।হয়ত দেখতে পাইনা তাও আমার ধারণা আকাশটা অনেক উজ্জ্বল রঙ দিয়ে গড়া।কারণ আমি মাথা তুলে আকাশ দেখলেই চোখের সামনের অন্ধকারটা যেন লাঘব হতে থাকে।অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থেকেও আমি আকাশের রঙটা খুঁজে পাইনা।’
সেই কথাটা মাথায় রেললাইনের মতন কেবল ঘুরছে।লেভেন ও তো কত কথা বলে।তবে লেভেনের কথা কেন মনে পড়েনা,কানে বাজেনা?”
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫২
#আফনান_লারা
________
সকাল সকাল পূর্ণতা এই দম আটকানো রুম থেকে বের হবার চেষ্টায় নেমেছে।
আফসোস দরজা এখনও বাইরে দিয়ে লাগানো।আনাফ যে কাল রাতে আটকে চলে গেছিলো বোধ হয় কেউ আর দেখতেও আসেনি।
পূর্ণতা দরজা নিয়ে অনেকক্ষণ যুদ্ধ শেষে ফারাজের কাছে এসে বললো,’এই যে মহারাজ!দরজা খোলার ব্যবস্থা করুন আর কত আপনার এই দম আটকানো রুমে আমায় ধরে রাখবেন?’
ফারাজ ঘুম ঘুম চোখে পূর্ণতার দিকে চেয়ে বললো,’নিজের রুম রেখে আমার রুমে কি করেন আপনি?’
‘কাল বিকালে যে ঘটা করে বিয়ে করে নিলেন আমায়,তা কি ভুলে গেছেন?আবার মনে করিয়ে দিতে হবে?’
‘বিয়ে?কিসের বিয়ে?কার বিয়ে?’
পূর্ণতা টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে,তাতে হাত চুবিয়ে পানির ছিঁটা দিলো।ফারাজ এবার হলো বিরক্ত। তার আসলেই মনে নেই কাল তার বিয়ে হয়েছে।ভাবছে সবাটাই বোধ হয় একটা স্বপ্ন ছিল।
পানির ছিঁটা খেয়ে বিরক্তি নিয়ে ফারাজ বলে ‘পূর্ণতা, আপনি কিন্তু যেচে আমায় বিরক্ত করছেন।ফল ভাল হবেনা’
পূর্ণতার মেজাজ গেছে খারাপ হয়ে।বিয়ের পরেরদিন যদি স্বামী বলে সে বিয়ে করে নাই তবে মেজাজ খারাপ হবারই কথা।গ্লাসে আর যতটা পানি বাকি ছিল সবটা সে ঢেলে দিলো ফারাজের মুখে।
ফারাজ উঠে বসে পাঞ্জাবি দিয়ে মুখ মুছে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে বোকার মতন।পূর্ণতা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,’কি?চিনছেন আমায়?বিয়ে করা বউ হই আপনার’
‘তার মানে ওটা স্বপ্ন ছিল না?’
‘স্বপ্নে কি দেখছেন জানিনা,তবে বিয়েটা বাস্তবেই হয়েছিল’
ফারাজ মুখ গোমড়া করে ফেললো হঠাৎ।চুপচাপ বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধাক্কানো শুরু করে দিলো।তার তো মেলাতেও যেতে হবে।কি করে ভুলে গেলো!
দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে মতিন এসে দরজা খুলে দিছে। ফারাজ বের হয়েই রাগ করে বললো,’দরজা যে বন্ধ, দেখোনি?’
‘নাহ তো।বাসর ঘরে তো নতুন জামাই দরজার ছিটকিনি লাগায়।বাড়ির কাজের লোক কেন দরজা লাগাতে যাবে?’
‘তুমি দরজা লাগাও নাই বুঝলাম। যখন দেখলে দরজা বাইরে দিয়ে লাগানো তখন খুলে দিতে পারলানা?’
মতিন জিভে কামড় দিয়ে কান ধরে বললো,’তওবা তওবা ভাই!!আমি ক্যান দরজা খুলুম??বাসর ঘরের দরজা শুধু নতুন জামাইরাই খোলে’
‘উফ!!!যাও তো সামনে থেকে’
মতিন ফারাজের পেছনে পূর্ণতাকে উঁকি দিয়ে দেখে ফিক করে হেসে চলে গেলো।
পূর্ণতা ওমনি ফারাজকে সরিয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেছে।
———-
আনাফ তার বাবার সাথে সকালের নাস্তা করতে বসেছে আজ।বাবা কাল রাত ১টার সময় বাসায় ফিরেছেন।তাদের দেখা হলো সকালে।মা ও বসেছেন পাশে।বুয়া এসে এসে খাবার দিয়ে যাচ্ছে।বাবাকে মা শুধু বলেছিল আনাফ জরুরি কথা বলবে তার বাবার সাথে। এর বাইরে তিনি সারথিকে নিয়ে কিছু বলেননি।
বাবা ব্রেড মুখে পুরে আনাফের দিকে চেয়ে বললেন ‘আগের চেয়ে মোটা হয়েছো।ভাল!!হসপিটাল কেমন চলে?রুগী আগের মতন ৪০/৫০ নাকি ৬০এ উঠেছে?’
‘নাহ।আগের মতই’
‘কত করে বললাম বিদেশে চলে যাও।নাহ!তুমি নিজে যেটা ভাল মনে করো সবসময় সেটাই করে এসেছো!এখন কিসের আবার জরুরি কথা বলবে?তোমার নাকি কোনো মেয়েকেই পছন্দ হয়না।একজনের এক দোষ খুঁজে বের করো।বয়স যে পার হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখো?’
আনাফ ঢোক গিললো তাও মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারলোনা।বাবা এখনও ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।তিনি আবারও বললেন কি বলার কথা ছিল ওর সেটা যেন বলে ফেলে। তিনি এক জায়গায় যাবেন হাতে সময় কম।
‘বাবা আমি একজনকে পছন্দ করেছি’
‘ভাল সংবাদ।কতটা শিক্ষিত? ‘
‘ গ্র্যাজুয়েট’
‘ভাল।বংশ কেমন?’
‘খুব ভাল’
‘মেয়ের বাবা কি চাকরি করে?’
আনাফ বাবার মুখের দিকে চেয়ে আছে। এর জবাব দেয়ার আগে একটা কথা বলা জরুরি।বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে আসলে পাত্রের পরিবার মেয়ের বাবার চাকরির খোঁজ কেন নেয়?তারা কি মেয়ের বাবার টাকায় চলার কথা ভাবে?’
‘কি হলো জবাব দাও’
‘রড-সিমেন্টের ব্যবসা করেন’
‘আনাফ তুমি কি ঠাট্টা করছো আমার সাথে?আমি আমার ডাক্তার ছেলের জন্য এমন এমন পরিবার ও রিজেক্ট করেছি যেখানে মেয়ে নিজে ডাক্তার কিন্তু মেয়ের বাবা ডাক্তার না বলে।আর সেখানে তুমি ব্যবসায়ীর বেকার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও?’
‘বাবা আমি মেয়ের কিংবা মেয়ের বাবার চাকরির টাকা দিয়ে কি করবো?’
‘কি করবা!কিছু করবানা।বিয়ের পর যে শ্বশুর বাড়ি যাবা টেবিল সাজাই খাবার না দিলে মানসম্মান থাকবে আমার??’
‘টেবিল সাজাই খাবার তো একজন ব্যবসায়ী শ্বশুর ও দিতে পারে’
‘কথা সেটা নয়।আমি চাই পুরা বংশ যেন ডাক্তার হয়’
‘বাবা আমি এই মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেলেছি।তার সহায় সম্পত্তি আমার দেখার প্রয়োজন নেই’
‘মেয়ের বাড়ি কি টিনের নাকি কোনোরকমে ইট লাগাইছে?’
‘বাবা এমন করে কেন বলছো?আমি তো জানতাম তুমি সৎ চিন্তাভাবনা করো সবসময়’
‘বেস্টের জন্য বেস্ট খোঁজা কি অপরাধ?’
‘বেস্টের জন্য বেস্টই মিলেছে, সব বেস্ট কোটিপতি হয়না বাবা’
আনাফের বাবা চুপচাপ উঠে চলে গেছেন।আনাফ তার মায়ের দিকে তাকালো।উনি চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন।এদের রাজি করাতে কত কাঠখড় যে পোড়াতে হবে!!
বাবা তার রুমে বসে প্রোটিন ড্রিংকস খেতে খেতে বললেন,’আমার বন্ধু মিজানের একটা মেয়ে আছে।নাম ফাইজা।তুমি যে হাসপাতালে বসো ও সেই হাসপাতালে আগামী মাস থেকে বসবে।আমি চাই তুমি তার সাথে একটা ক্যাজুয়েল ডেটে যাও।মিজানের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে।সে তার মেয়েকে তোমার ব্যাপারে সব বলেছে।দুইজন আলাদা কথা বলে দেখো কেমন লাগে। ‘
আনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’বাবা আমি বিয়ে করলে সারথিকেই করবো’
‘ভুলে যাও।তুমি ইন্টারের ছেলে না যে জেদ ধরে সেটা নিয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাবে।যথেষ্ট বয়স হয়েছে।এসব ছেলেমানুষি বাদ দিয়ে কোনটা করলে ভবিষ্যতে লাভ হবে সেটা ভাবো’
———
সারথি তার ফোন খুঁজে আনাফের নাম্বার ডায়াল করলো। মুখস্থ করে রেখেছিল। রিং হয়ে কাটা গেলো কল।আনাফ ধরেনি।
সারথি জানে আনাফ খুব সকালে ওঠে।তাহলে কেন ধরেনি কল!
দ্বিতীয়বার কল দেয়নি আর সে।
আনাফ সেসময় হসপিটালে ছিল।সিরিয়াস রোগী আসায় বাবার সাথে তর্ক বাদ দিয়ে ছুটে এসেছিল হসপিটালে।
অপারেশনের কাজ শেষ করে ফোন খুঁজে দেখে সারথির মিসড কল।আনাফের খারাপ লাগলো ভীষণ।সারথির কল দেখে তার সবচাইতে বেশি খুশি হবার কথা কিন্তু আজ কেন যেন সেই খুশি ভাবটা আর আসেনি।
তাও সারথিকে সে কলব্যাক করলো। সারথি ফোন নিয়েই বসে ছিল।
আনাফের কল এসেছে শুনে সে রিসিভ করলো সাথে সাথে।
‘কল ধরেননি যে?’
‘ও.টিতে ছিলাম’
‘ওহ। আপনার বাবার সাথে কথা বলেছেন? ‘
‘নাহ।পরে বলবো’
‘এখনও বললেন না?’
‘ভাল সময় দেখে বলবো।বাবার মেজাজ এক সময় এক রকম থাকে’
‘আচ্ছা।সকালে কিছু খেয়েছেন?’
‘নাহ।সময় পাইনি,এখানে ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো’
‘মে আই কাম ইন, আনাফ স্যার?’
একটা মেয়েলি কণ্ঠ শুনে আনাফ মাথা তুলে তাকায়।তার কেবিনের দরজার কিণারায় দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। মুখে মিষ্টি হাসি।আনাফ চিনতে পারলোনা তাও বললো আসতে।সারথি ও শুনেছে কণ্ঠটা।
মেয়েটা ভেতরে ঢুকে চেয়ার টান দিয়ে বসতে বসতে বললো,’আমাকে রুগী ভেবে আপনার অফিসের লোক সিরিয়ালে বসিয়ে দিচ্ছিল, জানেন?’
‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না’
‘কানে ধরা ফোনটা টেবিলে রাখুন,পরিচয় দিচ্ছি’
এই কথা বলে মেয়েটা হাতের ব্যাগ টেবিলে রেখে ওড়না ঠিক করে চুলগুলোকে পিঠের দিকে নিয়ে গেলো।সারথি নিজ থেকেই বলে উঠলো পরে কল দেবে।এই বলে সে কলটা কেটে দেয়।
‘আমি ফাইজা মোস্তফা,হয়ত নামটা শুনেছেন’
‘ওহ। মিজান আঙ্কেলের মেয়ে?’
‘জ্বী’
‘কেমন আছেন?’
‘ফাইন!হসপিটালে বসেই ডেট কন্টিনিউ করবো নাকি আশেপাশের কফি শপে যাওয়া যায়?’
‘ওকে।চলুন’
আনাফ নিজের এপ্রোনটা খুলে বের হলো।ফাইজা ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললো,’এই হাসপাতালে আমি আগামী মাস থেকে আসবো’
‘অগ্রীম অভিনন্দন ‘
‘আচ্ছা এটা কি সব জায়গায় এক রকম?হাসবেন্ড ওয়াইফের মাঝে একজন কম কথা বলে আর একজন অনেক বেশি!’
‘হতে পারে।’
‘আমি অনেক কথা বলি,আর আপনি হয়ত কথাই বলেন না তেমন’
আনাফ তার কার আনলক করে ফাইজাকে দরজা খুলে দিতে দিতে বললো,’ভুল।আমি প্রচুর কথা বলি।নির্ভর করে মানুষটা আমার পরিচিত নাকি অপরিচিত সেটার উপর’
ফাইজা মুচকি হেসে গাড়ীতে বসলো।আনাফ ড্রাইভিং সিটে বসে বললো,’কোথায় যাবেন বলুন’
‘উত্তরাতে একটা নতুন করে কফি শপ হয়েছে।ট্রাস্ট মি!এত ভাল কফি ওরা বানায়,আমি জাস্ট ফ্যান হয়ে গেছি’
‘আমি কলিগদের সাথে সেদিন গিয়েছিলাম।আমার একেবারে ভাল লাগেনি।আপনার আর আমার টেস্ট মিললোনা’
‘ভেরি ব্যাড!’
আনাফ আর কিছু বললোনা।দু কথায় সে ফাইজাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো তারা একজন আরেকজনের জন্য রাইট না।কিন্তু ফাইজা যেন বুঝতেছেই না!
কফি শপে আসার পর সে আরও ফ্রি হয়ে গেলো।বকবক করেই চলেছে।একটা সময় আনাফ বললো,’আপনি কি এমন আরও ডেটে গিয়েছিলেন? ‘
‘অবশ্যই।পাঁচ মাস ধরে বাবা পাত্র খুঁজছেন।মোট ছয়জনের মতন ছেলের সাথে আমার এমন করে দেখা হয়েছে ‘
‘সবাই কি ডাক্তার?’
‘ডাক্তার তো ডাক্তারই বিয়ে করবে, তাই না?’
‘আমি কিন্তু এই চিন্তাভাবনা রাখিনা।আমি একটা সাধারণ মেয়েকেও আমার পছন্দের কাতারে রাখি’
‘বাট আমার কাছে ডাক্তারই ভাল লাগে।কারণ একজন ডাক্তারই আমার পেইন বুঝবে।আমি যে জব করবো সেটাকে সে বুঝবে।অন্য পেশার হাসবেন্ড বুঝবেনা।এটা আমার মতামত ‘
‘তো আমার আগে যাদের দেখেছেন তাদের ভাল লাগেনি কেন?’
——–
পূর্ণতা তার রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে।মিসেস সায়না ফারাজকে দেখলেন বাগানে হেঁটে হেঁটে বই পড়ছে।তাই তিনি ফারাজের রুমে গিয়ে পূর্নাকে খুঁজে আসলেন কিন্তু পেলেননা।মেয়েটা গেলো কই?
পরে আন্দাজ করে এসে দেখেন পূর্ণতার রুমের দরজা বন্ধ ভেতর থেকে।
‘পূর্ণতা?শুনছো?তুমি কি করো তোমার রুমে??পূর্ণতা?’
পূর্ণতা বালিশ দিয়ে মাথা ঢেকে অন্যপাশ হয়ে শুয়ে পড়েছে।মিসেস সায়নাকে ডাকাডাকি করতে দেখেছেন দাদাজান।কাছে এসে কাহিনী কি জানতে চাইলেন তিনি।
চলবে♥#ডাকপাড়ি
#পর্ব_৫৩
#আফনান_লারা
________
ফারাজ বই পড়া শেষ করে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই দেখে দাদাজান আর আজিজ দাদু ওর দিকে তাকিয়ে আছেন সোফায় বসে।বিশেষত তাদের চাহনি বলে দিচ্ছে ফারাজ তাদের আশার বাইরের কিছু একটা করেছে যার কারণে তারা এমন করে ওকে দেখছে।তবে সেটা কি হতে পারে?তাদের কথামত সে তো বিয়েটা করেই নিয়েছে তবে তাদের অগ্নি চাহনিতে চাওয়ার মানে আর কি?
ফারাজ হাতের বইটা ঝুলিয়ে ধরে সোজা হেঁটে উপরের তলার দিকে চলে যাচ্ছিল ওমনি দাদাজান তার নাম ধরে ডাকলেন।
ফারাজ থেমে যায়।চোখ বন্ধ করে আরও একবার ভাবে কি ভুল সে করে থাকতে পারে।ভাবতে ভাবতে দাদাজানের কাছে এসে দাঁড়ায় ফারাজ।দাদাজান মুখটা গোমড়া রেখে বললেন,’কাল রাতে তোমরা আলাদা রুমে থেকেছিলে?’
‘না তো।এক রুমেই ছিলাম।আনাফ ভাই বাইরে দিয়ে দরজা লাগিয়ে রেখেছিল।সেই দরজা মতিনকে দিয়ে সকাল সকাল খুলিয়েছিলাম আমি।’
‘তাহলে পূর্ণতা তার রুমে কেন?’
‘আমি কি করে জানবো?’
‘তুমি ছাড়া আর কে জানবে?আমরা জানবো?সে তোমার কি হয়?’
‘বউ’
‘তাহলে তুমি জানবে না তো কি রাস্তার ওপাশের দোকানদার জানবে?বউয়ের ভাললাগা,খারাপ লাগা সব যেন তোমায় জিজ্ঞেস করলে জানতে পারি এরপর থেকে।বিয়ে করেছো তার মানে এই না যে সব শেষ।বরং বিয়ে থেকেই সব শুরু। আমি তোমার উপর আশাবাদী। আশা রাখি তুমি পূর্ণতাকে অনেক খুশি রাখবে ‘
ফারাজ মাথা নাড়িয়ে চলে যাচ্ছিল,দাদাজান আবারও ওকে থামতে বলে বললেন,’সোজা পূর্ণতার কাছে যাও।কথা বলো ওর সাথে।আর তোমাদের নাকি রুমের খাটটা ছোট?
ছোট হবারই কথা।তুমি যখন ক্লাস সেভেনে উঠেছিলে তখন এই খাটটা আমি চাঁদপুর থেকে আনিয়েছিলাম।খাঁস সেগুন কাঠের খাট।কে জানতো চোখের পলকে এতগুলা বছর কেটে যাবে।এখন তোমার বউ এসেছে ঘরে।সিঙ্গেল খাটে তো নতুন বউ শোবেনা।আমি অর্ডার দিয়ে দিছি।কদিনের মধ্যেই এসে যাবে, ততদিন তুমি পূর্ণতার রুমে থাকবে ওর সাথে’
ফারাজ মাথা নাড়িয়ে হেঁটে চলে গেলো।আজিজ খান বেলায়েত হোসেনকে বললেন,’একটা কথা বলবো বেলু??তোর নাতিটা একেবারে সেকেলে।রষকষ কিছুই নাই।শুরু থেকে দেখতেছি।ব্যাকডেটেড ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি’
‘ও এমনই।ছোট ঠেকেই ভবঘুরে।ওর মাথার ভেতর কি চলে তা কেউ জানেনা।সারাদিন ভাবে,সেটা আবার আঁকে।কে জানতো ওর এই ভাবনা একদিন টাকা পয়সা আনবে ঘরে।এত ভাবতে গিয়ে নিজেকে একটা বেরসিক মানুষ তৈরি করে নিয়েছে।কবে যে ঠিক হবে কে জানে!!’
——-
ফারাজ পূর্ণতার কাছে না গিয়ে নিজের রুমে এসে বইটা রেখে মেলায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।গায়ের পাঞ্জাবিটা বদলে অন্য পাঞ্জাবি পরে এসে বোতাম লাগাতে লাগাতে তার চোখ গেলো সাজানো বাসরের দিকে।একটা মিনিটের জন্য ও সে কাল বাসর ঘরটা দেখেনি।
সে মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র নতুন বর যে বাসর ঘরে বাসরঘরের ফুল না দেখে পরেরদিন দেখে।
ফুলে হাত ছুঁয়ে ফারাজ হাসলো।এই বাসর ঘর নিয়ে তার অনেক অনেক প্ল্যান ছিল।সব প্রতিমাকে ঘিরে।কে জানতো পাশা এভাবে উল্টে যাবে?একেবারে মন থেকেই উঠে গেছে এই বাসর ঘর।
‘যার কারণে বাসর ঘর যে এত সুন্দর করে কাল সাজানো হয়েছিল সেটা জানলামই না আমি!’
পূর্ণতার হাতে হলুদ রঙের একটা শাড়ী ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছেন মিসেস সায়না।শাড়ীটা পরে নিচে পিঠা বানাতে আসতেও বলে গেছেন।
পূর্ণতা শাড়ীটা পরে যেমন আদেশ তেমন মতন নিচে চলে আসে।ফারাজকে কোথাও দেখলোনা।না দেখলেই ভাল।দেখলেই মেজাজ গরম হবে।কালকের সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করেছিল সে।রাগ এখনও ঠিকমত ঝাড়তে পারেনি পূর্ণতা।
———
ওয়েটার মেনুকার্ড দিয়ে যাবার পর আনাফ সেটা ফাইজার দিকে ঠেলে ধরে।মনে মনে ভাবছে কি করে ফাইজাকে কষ্ট না দিয়ে মানা করে দেয়া যায়।যখন সে এটা ভাবছিল তখন সে ফাইজার দিকেই তাকিয়ে ছিল।ফাইজা লজ্জা পেলো তাতে।
“সুদর্শন পুরুষেরা সাধারণত কোনো কারণ ছাড়া নারীদের দিকে তাকান না।”
এখন যখন তাকিয়ে আছে এর মানে কি হতে পারে তাই ভাবছিল ফাইজা।আনাফকে ছবিতে দেখেই পছন্দ করেছিল সে।এখন বাস্তবে দেখা হয়ে ভালোলাগাটা বেড়ে গেলো অনেক।ফাইজা মুচকি হাসছে দেখে আনাফ বললো,’নিন।কি খাবেন অর্ডার করুন’
‘কফি খেতেই তো আসলাম’
আনাফ কফির অর্ডার দিয়ে ফোন বের করলো।সারথি আর কল দেয়নি।ফোনটা সে আবার পকেট ঢোকাতেই ফাইজা বললো,’আমায় আপনার কেমন লেগেছে?’
আনাফ বড় করে দম নিয়ে বললো,’দেখুন ফাইজা ম্যাম,আপনি নিঃসন্দেহে একজন পারফেক্ট নারী।বিউটি উইথ ব্রেইন।যেকোনো পুরুষই আপনার মতন সহধর্মিনী চাইবে।সুন্দরী,শিক্ষিত,পেশায় ডাক্তার।আর কি চাই!!
কিন্তু আমি এসব কিছুই চাইনা।আমি সবসময় সবার থেকে আলাদা ভাবি।আমার ভাবনা ছিল আমি হিসেবের বাইরে বেরিয়ে কাজ করবো।বিয়ের ক্ষেত্রেও তাই।আমি এমন একজনকে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছি যে পেশায় ডাক্তার না,বরং সে কোনো চাকরিই করেনা। সে অতি সাধারণ।তার পরেও আমি তার কথাবার্তাতে,চালচলনে অসাধারণত্ব দেখেছি।আমি বিয়ে করলে তাকেই করবো, বাবাকে এটা বলার পরেও বাবা জোরপূর্বক আমাকে আজ এখানে পাঠিয়েছেন।আমি কথাটা এতদূর আগাতে চাইনি।যদি ভুল কিছু করে থাকি মাফ করে দেবেন।আপনাকে কষ্ট দেয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না’
ফাইজা মুচকি হাসলো।ওয়েটার কফি দিয়ে যাবার পর মগটা নিজের দিকে টেনে বললো,’এজ এ ফ্রেন্ড ডেটটা হোক।সমস্যা তো নেই তাতে তাইনা?’
‘একদম’
‘আমারও হয়ত আপনার মতন ভাবা উচিত।চাহিদা কমিয়ে সাধারণের দিকে চোখ বুলালেই আমি অসাধারণ কাউকে পেয়ে যাবো’
আনাফ মাথা নাড়ালো।ফাইজা কফিতে চুমুক দিয়ে বললো,’একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’
‘হুম’
‘ও কি আমার চাইতে বেশি সুন্দরী? ‘
আনাফ নিজের কফিটা শেষ করে হাসলো।তারপর হাসিটাকে দমিয়ে বললো,’হ্যাঁ।অনেক বেশি সুন্দরী ‘
‘এটাই কি সেই কারণ যে ডাক্তার বিয়ে না করে সাধারণ একটা মেয়েকে বিয়ে করার?’
‘ধরুন আপনি একটা ছেলের প্রেমে পড়লেন।ছেলেটা খুব সুন্দর।পরে জানতে পারলেন সে বিবাহিত। তখন আপনি কি করবেন?’
‘প্রেম শেষ করে চলে আসবো’
‘কিন্তু আমি পারি নাই।কারণ আমি প্রেমে পড়ি নাই।আমি ভালবেসেছি।এখন যদি সেই মেয়েটির মুখে মেছতার দাগও বাসা বাঁধে তাও আমি তারে ছাড়তে পারবোনা।কারণ আমি প্রেম করিনি,আমি ভালোবেসেছি”
ফাইজা মুগ্ধ চোখে আনাফকে দেখতে লাগলো।এই টাইপের একটা ছেলে যদি তার কপালে থাকতো তার জীবনটা কত সুন্দর হতো।যে মেয়েটা আনাফকে পাবে সে সত্যিই অনেক লাকি
——-
সজীব বিচ থেকে ফিরে যে শুয়েছিল তার আর কোনো খবর নেই।ওর কথা মতন লেভেন ওকে কল দেয়নি আর।
ঘুম থেকে সে উঠতোনা কিন্তু কাজের লোকেরা ওকে এমন করে ঘুমাতে দেখে ভয় পেয়ে বাধ্য হয়ে ওকে জাগিয়ে তোলে।ঘুম ছেড়ে উঠে সজীব পুরা উন্মাদের মতন করছিল।ওর শরীর এত খারাপ ছিল যে কাজের লোকেরা লেভেনকে কল করে।কিন্তু সজীবের সাথে রাগ করে লেভেন তার ফোন বন্ধ রেখেছিল।এবার তারা সজীবের বাবার নাম্বারে কল করলো।তিনি রিসিভ করলেন।তারা সজীবে শরীরের ব্যাপারে সব জানালো ওনাকে।
শেষে চিন্তিত হয়ে তিনি কাজ ফেলে মালেশিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেছেন।
সজীবের হুশ তেমন ছিল না। বাবা মালেশিয়ার পাশের একটা দেশেই ছিলেন।তাই আসতে তার সময় লাগেনি বেশি।তিনি দ্রুত সজীবকে হাসপাতালে নিয়ে যান।ওখানের ডাক্তার জানায় সজীব অতিমাত্রায় ড্রিংকস করায় তার এই অবস্থা হয়েছে।বাবা রাগ দেখালেন শুরুতে।সজীব কিছুই বলছেনা।সে কেবল চুপ করে বাবার দিকে চেয়ে আছে বেডে শুয়ে।
বাবা নার্স ডাক্তার চলে যাবার পর ধমকের সুরে বললেন,’আমার সাথে আগামীকাল সকালে বাংলাদেশ ফিরবে।দু পরিবার বসে যে সিদ্ধান্ত হবে সেটাতেই শেষ হবে।আমি আর কিছু শুনতে চাইনা।বিদেশী মেয়েটার সাথে থেকে থেকে নিজের কি হাল করেছো তা তো দেখতেই পারছি।’
———
পূর্ণতা অন্যদিকে ফিরে বসে বসে পিঠা বানাচ্ছিল।যে শাড়ীটা মিসেস সায়না দিয়ে গেছিলেন ওকে সেটা ওনারই শাড়ী ছিল।ফারাজ রেডি হয়ে রান্নাঘরে এসে বললো,’কাকি জলদি করে নাস্তা দাও।আমার একটা কাজে যেতে হবে।’
পূর্ণতা অমনি চমকে পেছনে ফিরে দেখে ফারাজ হাতের ঘড়ি পরছে দাঁড়িয়ে।
‘আমি আপনার কাকি?’
পূর্ণতার কণ্ঠ শুনে ফারাজ মাথা তুলে চেয়ে দেখে তার সামনে পূর্ণতা বসা।
‘আমি ভাবলাম সায়না কাকি’
‘আমার বডি তার মতন?’
‘এই শাড়ীটা কাকির তো।আপনি কি করেন এখানে?’
‘বিয়ের পরেরদিন সকাল সকাল পিঠা বানাতে হয়।নতুন বউ কিনা।
সয়ং বর নতুন বউ না মানলেও পরিবার তো মানে।তাই পিঠা বানাচ্ছি’
‘আমি আপনাকে মানি না,কে বললো?’
পূর্ণতা আর কিছু না বলে পিঠার প্লেট ফারাজের হাতে ধরিয়ে চলে গেছে।
ফারাজ তখন বললো,’বউ মানেই প্যারা’
মতিন কথাটা শুনে জবাবে বলে,’তাহলে কি আমি বানুকে বিয়ে করতাম না?সে কি আমায় প্যারা দেবে?’
‘আমি কি জানি!’
‘আপনি তো কইলেন বউ মানে প্যারা’
‘সবার বউ এক নাকি!দিলে দিতেও পারে,আবার কম ও দিতে পারে।তবে দিবে এটা সিওর’
———-
সারথি ফোন হাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছিল।আনাফের একটা কলের অপেক্ষায় তার সময় চলছে।হঠাৎ ফোন বেজে ওঠায় ব্যস্ত হয়ে রিসিভ করে সে।
কলটা আনাফেরই ছিল।ফাইজাকে বিদায় দিয়ে হসপিটালে ফিরতে ফিরতে সারথিকে ফোন করে সে।
‘কি করছেন ম্যাডাম?’
‘কিছুই না।আচ্ছা তখন কে এসেছিল?’
‘আমার কলিগ’
‘মেয়ে?’
‘হুম’
‘ভালো।’
‘তাকে চিরজীবনের জন্য বিদায় দিলাম।আর কখনও এক অফিসে আসবেনা’
‘আরও ভাল।সকালের নাস্তা করে নিন।বেলা হতে চললো’
‘বাবার সাথে কথা বলে তারপর।অতি চিন্তায় গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারিনা আমি’
‘সাবধানে গাড়ী চালাবেন,আপনি গাড়ী চালানোর সময় কাজ করেন সবসময়।এটা ঠিক না’
‘হারানোর ভয় হয়?ভেবোনা। আমি মরার পর আমার ভালবাসা তোমায় দুনিয়ায় থাকতে দেবেনা।ঘুরেফিরে আমার কাছেই নিয়ে আনবে’
চলবে♥