ডেভিলের মিষ্টি অত্যাচার পর্ব -০৩

#ডেভিলের_মিষ্টি_অত্যাচার (৩)
#স্বপ্নীল_আজিম
ইফতেখার চৌধুরী বই নিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন। আজ তিনি অফিস কার্য থেকে ছুটি নিয়েছেন। শরীর নাকি বিশেষ ঠিক লাগছে না। এমন সময় আফসানা চৌধুরী এসে ক্ষোভ মেশানো কন্ঠে বললেন,
—-” তোমার মেয়ে কি পন করে রেখেছে যে আমার কোনো কথাই সে শুনবে না?”
—-” কেনো কি করলো আবার সে?” বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে প্রশ্ন করলেন ইফতেখার চৌধুরী।
—- ” ভার্সিটি থেকে সোজা বান্ধবীর বাসায় গেছে সে। দু’দিন নাকি সেখানেই থাকবে। অনুষ্ঠান নেই কারণ নেই…কোনো মানে আছে সেখানে থাকার? আবার নিজে কথা বলেনি বান্ধবীকে দিয়ে ফোন করিয়ে বলেছে।”
কিছুক্ষন থেমে আবার বলতে লাগলেন,
—-“কাল এতো করে বুঝালাম বিয়ের জন্য…কিছুতেই বুঝলোনা! কি খারাপ আছে ওই ছেলের? দেখতে একেবারে রাজপুত্র। উচ্চবিত্ত ভালো ফ্যামিলি। আর সেখানে তোমার মেয়ে “না” বলে বসে আছে। এখন নাকি বিয়ে করবে না। বলি মেয়ে যখন হয়েছে বিয়ে তো একদিন করতেই হবে নাকি? সেটা এখন হলে সমস্যাটা কি?”
ইফতেখার চৌধুরীর কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে আফসানা চৌধুরী গলার স্বর উঁচু করে বললেন,
—-” তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না আমি কি বলছি?”
—-” হ্যাঁ? কি বললে?” বই থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন ইফতেখার চৌধুরী। আফসানা চৌধুরী কিছুক্ষণ দাঁত চেপে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।

—“বাপ, ছেলে, মেয়ে সব হয়েছে এক ধাঁচের। আমার কথার কোনো দামই নেই এদের কাছে? এক কান দিয়ে শোনে তো আরেক কান দিয়ে বের করে দেয়। নয়তো শুনবেই না৷ থাকবো না আর এই সংসারে। চলে যাবো। তারপর দেখি কিভাবে চলে এদের।” রাগে বিলাপ বকতে বকতে চলে গেলেন আফসানা চৌধুরী।

ইফতেখার চৌধুরী কিছুক্ষণ তার যাওয়া দিকে তাকিয়ে থেকে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে ফের বইয়ে মুখ গুঁজলেন।
.
.
ঈশিকা একবার খাবার মুখে নিচ্ছে তো বদলে দুই বার জল খাচ্ছে। সাথে ঠোঁট চেপে সমানে শোসাচ্ছে। ঠোঁটের কাঁটা জায়গাগুলোতে জ্বলছে চিনচিন করে। খাওয়া শেষে টেবিলে প্লেট রাখতে রাখতে আমান বললো,
—-” এতো শোসাচ্ছো কেনো ঈশু? খাবার তো বেশি ঝাল ছিলো না।”
—-” ঠোঁট জ্বলছে তো।” কান্না কান্না মুখ করে।
তখন আমানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ফিচেল হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
—-” কেনো? কি হয়েছে ঠোঁটে আবার? কেউ কি আদর করেছে নাকি?”

এই মুহুর্তে ঈশিকার আমানের মাথা ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। কি অসভ্য ছেলে! নিজে আমার ঠোঁটের হাল বেহাল করে দিয়ে এখন আবার রসিকতা করা হচ্ছে? ঈশিকা নাক ফুলিয়ে দাঁত চেপে মনে মনে আমানকে ভয়ংকর কয়েকটা গাকি দিলো ।

আমান জলের গ্লাস আর ঔষধ এনে ঈশিকার সামনে এনে বললো,
—-” গালি দেওয়া হয়ে গেলে এটা মুখে নাও।”
—-” খাবো না।” মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে।
—-” ঈশু জেদ করোনা…না খেলে পায়ের ব্যাথা বাড়বে।”
—-” বাড়ুক…আপনার এতো দরদ দেখাতে হবে না।”
—-” বা রে…আমার বউ আমি দরদ দেখাবো না তো কে দেখাবে? পাড়ার লোক নাকি?”
—-” কে আপনার বউ?! শুনুন…আপনি যদি ভেবে থাকেন এসব করলে বললে আমি আপনাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবো তাহলে ভুল ভাবছেন। আমি আপনাকে বিয়ে করছি না না না।” জোর গলায়।

আমান এবার হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো। ঈশিকা অবাক হয়ে রেগে বললো,
—- ” আশ্চর্য! এভাবে দানবের মতো হাসছেন কেনো?”
—- ” হাসবো না তো কি করব? কতবার আমাকে বিয়ে করবে বলোতো ঈশু? বিয়ে তো একবার হয়েই গিয়েছে।”
—-” মানে!!”
—-” মানে হলো এই তখন তুমি যে পেপার এ সাইন করেছো সেটা বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার ছিলো। আর এখন থেকে তুমি আমার বউ। বাচ্চা বউ। বুঝেছো ঈশু মনি?” হেসে বললো আমান।

ঈশিকা যেনো বিষ্ময়ে একেবারে বোবা বনে গেছে। হা করে তাকিয়ে আছে আমানের দিকে।
—-” আরে হা করেছো তো আর একটু বড় হা করো না। ঔষধটা মুখে টুপ করে পুরে দেই।” দুষ্টু হাসি মুখে বললো আমান।
এবার যেনো ফেটে পরলো ইশিকা।
—-“মানে কি! কিসের বিয়ে? আপনি আমাকে ভয় দেখিয়ে জোর করে সাইন করিয়েছেন। পড়তে নিলে পড়তেও দেননি। আমি মানিনা এই বিয়ে৷”
—-” না মেনে উপায় নেই। আইন মোতাবেক এখন তুমি আমার স্ত্রী। আর তা কাগজে কলমে প্রমাণিত।
—-“কিসের আইন? আমি…আমি পুলিশের কাছে যাবো। বলবো আপনি আম…উম্মম…

—-” আপনি….আপনি আবার আমাকে…
—-” কি? কি আমি তোমাকে?” ঈশিকার দিকে ঝুকে।
—-” আপনি কথায় কথায় এতো ঠেসে ধরে চুমু খান কেনো আমাকে?” চেঁচিয়ে।
—-” নইলে তো তোমার মুখ বন্ধ হয়না। আর আমার বউ কে আমি চেপে ধরে চুমু খাই আর যাই করি তাতে তোমার কি? এগুলো হলো দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার আদর বুঝলে?”

—” আর শোনো মিস উম না….মিসেস ঈশিকা…এটাই সত্যি যে তুমি এখন আমার স্ত্রী। আর তুমি তা না মানলেও কোনো সমস্যা নেই। আমার একার মানাই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। আর রইলো থানা পুলিশের কথা? সে তুমি যেতেই পারো…বরং গেলে এতে আমারই লাভ। আমিও বলবো এই মেয়ে আমার সাথে প্রেম করে আমাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে এখন আমাকে অস্বীকার করছে। আর সাক্ষী হিসেবে জাহিদ (পি.এ.) আর বাহাদুর তো ছিলোই সাইন করার সময়। আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই কিন্তু ওরা স্টেটমেন্ট দেবে । তোমার প্রমাণ ছাড়া কথা কিন্তু কেউ শুনবেও না বিশ্বাস ও করবে না। উলটে সারাজীবন আমার কাছে থাকতেই বাধ্য হবে। তাই এসব আজাইরা চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
—“এবার কথা বাদ দিয়ে চুপচাপ মেডিসিন টা খাও।” গম্ভীর ভাবে বললো আমান।

কান্না গলায় এসে দলা পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে ঈশিকার৷ বলার মতো ভাষা মুখে নেই। কি ভয়ংকর ছেলে! তুলে এনে অজান্তে বিয়েও করে ফেললো। আবার এখন আবার বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলে সব দোষ তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছে। অদ্ভুতভাবে সে ভয় ও পাচ্ছে কারণ তার কথা বিশ্বাস করানোর মতো যথার্থ প্রমাণ নেই তার কাছে। এখন সে নিরুপায়। পায়ের ব্যাথাটাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। তাই না পেরে মেডিসিন খেয়ে নিলো। আমান চোরা হেসে মনে মনে বললো, “ঔষধ কাজে দিয়েছে তাহলে।”

—-” গুড গার্ল!” বলে হেসে আমান এঁটো প্লেট নিচে রাখতে চলে গেলো। প্লেট রেখে এসে দেখলো ঈশিকা খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে।

—-” এই…এই কি করছো? পায়ে চাপ ফেলছো কেনো! আবার ব্লিডিং হবে তো।”
দৌড়ে এসে ঈশিকাকে ধরে।
—-” গোসল করব আমি। অসহ্য লাগছে।” বিরক্তি নিয়ে বললো ঈশিকা।
—-” একদম না…পায়ের ব্যান্ডেজ ভেজানো যাবে না। আর অবেলা হয়ে গেছে। এখন গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যাবে। হাত মুখ ধুয়ে চেঞ্জ করো। দাঁড়াও…”

ঈশিকাকে কোলে তুলে বাথরুমে বসিয়ে কাবার্ড থেকে
নিজের একটা টি শার্ট আর একটা ট্রাউজার আনলো আমান। তারপর ঈশিকার হাত মুখ ধুয়িয়ে মুছিয়ে দিয়ে টি শার্ট আর ট্রাউজারটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
—-” নাও…চেঞ্জ করো।”
—-” এগুলো কার?”
—-” কার আবার…আমার।”
—-” আমি আপনার জামা পরবো?” ভ্রু কুচকে।
—-” তাছাড়া কি পরবে? এখানে তোমার জামা পাবে কিভাবে? আর আমার জামা পরলে কি সমস্যা? রেসিস্ট নাকি তুমি!?” ভ্রু কুচকে বললো আমান।

ঈশিকা কিছুক্ষন আমানের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে তারপর হাত থেকে টি শার্ট আর ট্রাউজারটা নিয়ে নরম গলায় বললো,
—-” বাইরে যান।”
—” কেনো? আমি তো এখন তোমার হাসবেন্ড ই। আমার সামনে চেঞ্জ করতে লজ্জা কিসের? ট্রাস্ট মি! আমি কিন্তু একটুও লজ্জা পাবো না।” দুষ্টু হেসে চোখ মেরে বললো আমান।

উত্তরে ঈশিকা আগুন চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলে আমান তড়িঘড়ি করে বললো,
—-” আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি…।” বলে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে এলো।
.
ঈশিকা জানালার ধারে চেয়ার এ বসে পরন্ত বিকেল দেখতে ব্যস্ত। সাথে আছে মনে একরাশ এলোমেলো ভাবনা৷ জীবন সত্যি বৈচিত্রময়। কখন যে কোন চিত্র দেখিয়ে দেয় তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। প্রথমে বিয়ের ব্যাপারটা মেনে নিতে কঠিন লাগলেও এখন সেরকম কিছু মনে হচ্ছেনা। অদ্ভুতভাবে বিয়েটা আর আমানকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে তার।

আমান ঈশিকাকে ঘুমানোর জন্য শুইয়ে দিয়ে বাগানে গেছিলো হাঁটতে। আসলে মূলত সিগারেট খেতে৷ ঘরে খেলে ঈশিকার সমস্যা হবে ভেবে বাইরে চলে আসে। সেখানে বাগানের মালির সাথে কথা বলে বেশ কিছুক্ষন পরে রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে ঈশিকা জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে এক ধ্যান এ। আমান গিয়ে ঈশিকাকে পেছন থেকে নিচু হয়ে জড়িয়ে ধরে। ঈশিকা প্রথমে চমকে গেলেও বুঝতে পারে ব্যক্তিটি কে। আমান ঈশিকার কাধে থুতনি ঠেকিয়ে বলে,
—-” ঘুমাওনি? কি ভাবছো এতো?”
—-” কিছুনা।” মলিন গলায় বলে ঈশিকা।
—-” মন খারাপ?”
ঈশিকা উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
—-” আপনি তখন আমাকে রেসিস্ট বললেন কেনো?”

আমান বুঝলো…কথাটা ঈশিকার ইগোতে লেগেছে। মেয়েটা সব কথাই খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নেয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমান বললো,
—” তো কি? রেসিস্ট হওয়া কি খারাপ কিছু নাকি? আমি তো মনে করি এতে এলিগেন্স এর ব্যাপার আছে।
—” কিন্তু আমি মোটেও এমন না। আমি কাউকে নিচু চোখে দেখি না। সবাইকেই সমান চোখে দেখি।” পেছন ঘুরে আমানের দিকে তাকিয়ে বললো ঈশিকা।
আমান হেসে বললো,
—” আচ্ছা বাবা ঠিকাছে। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছে।তার জন্য আমি খুব খুব সরি!”

ঈশিকা কিছু না বলে অভিমানী মুখ করে অন্য দিকে মুখ ঘোরালো। আমান এবার হাত দিয়ে কান দুটো ধরে বললো,
—-“ঈশু…এইযে কান ধরে বললাম সরি। আর কখনো এমন বলবো না। এইবার আর মন খারাপ করে থেকোনা প্লিজ লক্ষী।”

আমানের কান ধরা দেখে ঈশিকার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এলো। মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে বললো,
—-” হুম সরি এক্সেপ্ট করতে পারি…তবে একটা শর্তে। ”
—” কি শর্ত বলো? যা বলবে তাই মঞ্জুর।”
—” কান ধরে পঞ্চাশ বার উঠবস করতে হবে।”
—-” কি!! পঞ্চাশবার!! বেশি হয়ে গেলো না? একটু কম করা যায়না? প্লিজ লক্ষীটা ..” করুন মুখ করে বললো আমান।
—-” উমম..আচ্ছা ঠিকাছে। উনপঞ্চাশ বার। এর একটুও কম হবে না। গুনবো কিন্তু আমি।” জোর গলায়।

আমান নিরুপায় হয়ে উঠবস করা শুরু করলো। এতবড় ছেলেকে এভাবে কান ধরে উঠবস করতে দেখে ঈশিকা আর হাসি আটকে রাখতে পারলো না। একবার গুনেই হা হা করে হাসতে লাগলো।
ঈশিকার হাসি দেখে আমানের মুখেও প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। যাক মন খারাপ কেটেছে।

এরপর আমান হুট করে এগিয়ে গিয়ে ঈশিকার গালে চুমু খেলো। এহেন আচমকা ঘটনায় চমকে গিয়ে ঈশিকার হাসি থেমে গেলো৷ ফের রাগের ভঙ্গিতে বললো,
—-” এই এই একদম চিটিং না। ধান্দাবাজ লোক। যান যান… আবার শুরু করুন।”

আমান কিছু না বলে আবারো হুট করে ঈশিকার ঠোঁটের উপর চুমু খেলো।
—” ইশ! ছিঃ আপনি সিগারেট খেয়েছেন? গন্ধ বেরিয়েছে। নেশাখোর লোক!” নাক মুখ কুচকে বললো ঈশিকা।

আমান অবাকের চুড়ান্ত পর্যায়। সামান্য একটা সিগারেটের জন্য এই মেয়ে তাকে ডিরেক্ট নেশাখোরের তকমা লাগিয়ে দিলো।

—” কি বললে! আমি নেশাখোর?!” অবাক হয়ে।
—” হ্যাঁ নেশাখোর। সিগারেট খান, মদ খান, গাঁজা খান। নেশাখোর লোক একটা।😒
কিছুক্ষন পর আবার বললো,
—” দেখি সরুন… আমার ঘুম পেয়েছে ঘুমাবো৷” বলেই উঠে আস্তে আস্তে বিছানায় গেলো ঘুমোবার জন্য৷

আমান একেবারে আহাম্মক বনে গেছে। হা করে তাকিয়ে আছে ঈশিকার দিকে৷ সিগারেটটা সে মাঝেমাঝে খায় রেগুলার না৷ ড্রিংক ও কোনো বিশেষ কারণ ছাড়া করেনা৷ কিন্তু গাঁজা!!! এই মেয়ের দৌলতে আর কি কি শুনতে হয় আল্লাহ মালুম!!
.
.
_________________________________________________সন্ধ্যা বেলায় রাজিয়া বেগম চা এনে আরমান আহমেদ এর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—-” ছেলের খবর জানলে?”
—-” হুম। জাহিদ বললো সে নাকি ব্রেকে আছে। দু’দিন পর্যন্ত। বাড়ি আসবে না।” চা এর কাপে চুমুক দিয়ে বললো আরমান আহমেদ।
—” কোথায় গেছে?”
—” তা কিছু বলেনি।”
—-” তো ফোন বন্ধ রাখার কি প্রয়োজন? এই ছেলের মতি গতি আমি বুঝিনা বাপু। হুটহাটই এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার মানে কি।”
কিছুক্ষন থেমে আবার বললেন,
—-” ওরা কি একেবারেই না করে দিয়েছে বিয়েতে?”
—-” ফ্যামিলির সবারই সম্মতি আছে। শুধু মেয়েটা রাজি না।”

রাজিয়া বেগম এর মনে ক্ষোভ জমলো। তার একমাত্র অমন গুনবান সুদর্শন ছেলের জন্য যেখানে কিনা অগণিত সুন্দরী পাত্রীর বাবারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে এই মেয়ে কিনা তাকে প্রত্যাখ্যান করে!?

আবার ছেলের উপরেও রাগ হলো ভীষন। ওই মেয়ে ছাড়া নাকি সে বিয়ে করবে না। তা সাফ জানিয়ে দিয়েছে৷ কি এমন দেখেছে ওই মেয়েতে যে ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে?! এখন আবারও নিরুদ্দেশ হয়েছে৷ নেহাতই ছেলেটাকে প্রানের থেকেও বেশি ভালোবাসে৷ একেবারে যক্ষের ধন তার। তাই কিছু বলতে পারেনা৷

চাপা রাগ আর ক্ষোভ মেশানো একটা শ্বাস ছাড়লো রাজিয়া বেগম।
.
.
.
রাত প্রায় নয়টা। চাদর মুড়ি দিয়ে একদম গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে ঈশিকা। সেই যে সন্ধ্যার আগে ঘুমিয়েছে আর উঠার নাম নেই। ব্লান্ট কাট চুলগুলো মুখের ওপর এলোমেলো হয়ে পরে আছে। সামান্য কিছু চুল ঠোঁটের ভাজের এক পাশে গিয়ে মিশেছে। ফোলা ঠোঁট জোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে।

আমান ট্রেতে করে খাবার নিয়ে এসে ঈশিকার পাশে বসে আছে। এক ধ্যান এ চেয়ে আছে ঈশিকার দিকে। ঘুমন্ত অবস্থায় কি নিষ্পাপ লাগছে মেয়েটাকে। এই এক মুখখানার দিকে তাকিয়ে বোধ হয় হাজার জনম পার করে দিতে পারে সে।

—-” ঈশু ওঠো…খেয়ে আবার ঘুমাও।”
—-” উম…”
—” কি উম? ওঠো….খাবার খেয়ে আবার মেডিসিন খেতে হবে। ঈশু…ওঠো না লক্ষীটা…”
—-” উফ! কি শুরু করেছেন আপনি? শান্তিতে কি একটু ঘুমাতেও দেবেন না নাকি? বিরক্তি নিয়ে উঠে বললো ঈশিকা।
—-” সন্ধ্যার আগে থেকে ঘুমিয়েই তো যাচ্ছো। আর কতো ঘুমাতে হয়? এবার খাবে এসো…”
—-” খাবোনা আমি…ঘুমাবো এখন। যান তো।” বলে যেই শুতে নেবে ওমনি আমান গম্ভীর সুরে বললো,
—-” বারবার এমন খাবার নিয়ে ঝামেলা করা আমার কিন্তু ভালো লাগছে না। এবার পিটানি কিন্তু একটাও মাটিতে পরবে না।”

ব্যস! কাজ হয়ে গেলো। এই ছেলের যে রাগ…কথা না শুনলে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গেও দিতে পারে। শেষমেশ নামের আগে “ল্যাংড়া” শব্দ জুড়ে যাবে! ঈশিকা চুপচাপ সোজা হয়ে বসলো। আমান মুখ টিপে হেসে ঈশিকাকে খাইয়ে দিতে লাগলো সাথে নিজেও খাচ্ছে।

—” আর খাবোনা।”
—” আর একটু?”
—” না প্লিজ!”
আমান আর জোড় করলো না। এরপর যেই ট্রে থেকে দুধের গ্লাস উঠিয়ে ঈশিকার দিকে তাকালো। ঈশিকা ওমনি দুই হাত দিয়ে নাক মুখ চেপে এপাশ ওপাশ মাথা নাড়িয়ে “না” ইশারা করলো। আমান শক্ত ভাবে বললো,
—-” একটা কথাও চলবে না। চুপচাপ পুরোটা খাবে।”
—” না প্লিজ! দুধের গন্ধ ভালো লাগে না আমার। বমি আসে।” মুখ চেপে ধরেই কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো ঈশিকা।
—” আসবে না। নাক চেপে ধরে এক চুমুক দেবে। নাও।” বলেই গ্লাস টা এগিয়ে দিলো।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ চেপে ধরেই পিছিয়ে গেলো ঈশিকা।
—” হুম বুঝেছি…আবার কিসি থ্যারাপিটা দিতে হবে। তাতে অবশ্য আমারই ভালো। তবে এইবার আর এক ঘন্টার নিচে ছাড়ছিনা।” পৈচাশিক হাসি হেসে বললো আমান।

আমানের কথা শুনে ঈশিকার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এক ঘন্টা! এতো দম আটকে মারার পায়তারা করছে এই ছেলে! এরপর যেই আমান এগিয়ে আসতে নিলো ওমনি মুখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে তড়িঘড়ি করে বললো,
—-” না না…খাবো তো…দিন।”
—-” গুড গার্ল!” মুচকি হেসে।

ঈশিকা নাক চেপে ধরে কোনোমতে গ্লাস টা খালি করলো। সাথে মনে মনে আমানকে বকে তুলোধুনো করলো। তারপর আমান জল খাইয়ে একটা পেইন কিলার খাইয়ে দিলো। ঈশিকা আমানকে মুখ ভেংচি দিয়ে ধপ করে আবার চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরলো। আমান হেসে ট্রে টা নিচে রাখতে চলে গেলো।

আমান ঘরে এসে যেই ঈশিকার পাশে শুয়ে ঈশিকাকে জড়িয়ে ধরলো। ওমনি ঈশিকা চোখ খুলে বিচলিত ভঙ্গিতে বললো,
—-” এই এই। আপনি এখানে শুচ্ছেন কেনো?”
—” তো কোথায় শুবো?” অবাক হয়ে।
—-” এতো বড় বাড়ি…একটাই ঘর নাকি? আমি একা ছাড়া ঘুমাতে পারি না। যান অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমান।”
—-” এ্যাহ! বললেই হলো নাকি? এখন আর একা ঘুমানো যাবে না। অভ্যাস পাল্টাও। আর আজকে তো আমাদের বাসর রাত। বাসর রাতে কি বর বউ আলাদা থাকে নাকি?”
—” নিকুচি করেছে আপনার বাসর রাতের! আপনি যাবেন?
নাকি আমি উঠে চলে যাবো?” রেগে বললো ঈশিকা।

আমান কিছু একটা ভেবে তারপর দুম করে ঈশিকার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
—” ওক্কে সুইটহার্ট! তোমার যেতে হবে না। আমিই যাচ্ছি। তুমি বরং একা ঘরে শুয়ে শান্তিতে ভুতের সাথে বাসর করো কেমন?” মিষ্টি হেসে।

এবার ঈশিকার সব ঘুম কর্পূরের মতো উবে গেলো। বড় বড় চোখ করে বললো,
—-“ভু ভু..ভুত!!”
—-” হুম। এই এলাকায় ভীষন উপদ্রব এদের। সবার বাড়ি বাড়ি প্রতি রাতে হানা দেয়। আর নতুন মানুষ পেলে তো কথাই নেই। সাথে করে নিয়ে যায় ওদের রাজ্যে। তারপর কাঁচা মাছ খাইয়ে ডামাডোল বাজিয়ে ঘুঙুর পরিয়ে নাচায়। আর কথা না শুনলেই ঘাড় মটকে দেয়।”

ঈশিকার ভয় পাওয়ার বস্তুরগুলোর তালিকার মধ্যে প্রথম বস্তুটি হলো এই ভুত। ছোটবেলায় জুজু বুড়ি, মামদো ভুত, মেছো ভুত, পেটকা ভুত সব ভুতেরই গল্প শোনাতো তার দাদী। এখন বড় হয়ে হরর ফিল্মগুলো দেখে ভয়টা দ্বিগুণ বেড়েছে।
মনে মনে বললো, “আল্লাহ! এই কোন জায়গায় আমাকে আনলো এই ছেলে! বাইরে মেয়েধরা তো ভেতরে ভুত!!! এবার নির্ঘাত সে মরে যাবে।”

—” ঠিকাছে…আমি যাচ্ছি তাহলে। হ্যাভ আ নাইস ড্রিম উইথ ভুতস!” বলে আমান উঠে যেতে নিলে ঈশিকা আতংকভাবে “নাআ” বলে আমানের টি শার্ট টেনে ধরে।
—” কি হলো? এই তো তাড়াতে চাইছিলে। আবার না কেনো? ” এক ভ্রু উঁচু করে।
—” না মানে বলছিলাম যে… এতো বড় বিছানা থাকতে অন্য ঘরে থাকার দরকার কি? এখানেই থাকুন না। আমার একটুও সমস্যা হবে না সত্যি।” মেকি হেসে।

আমানের ভ্রু উঁচিয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে ঈশিকা এবার অনুরোধের গলায় বললো,
—” প্লিজ থাকুন না।”

যাক কাজ হয়েছে! আমান হেসে ঈশিকাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়ে শুয়ে পরলো। ঈশিকাও একেবারে আমানের সাথে লেগে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে রইলো।
বাসর না হোক… ভুতের ভয়ে জড়িয়ে ধরে তো আছে। নাই মামার থেকে কানা মামাই ঢের ভালো।
.
.
.
.
মাঝরাতে কারো ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমানের। দেখে ঈশিকা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর কাঁপছে।

—-” ঈশু..এইইই ঈশু? কাঁদছো কেনো? এই কি হয়েছে লক্ষীটা!? খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?”
কান্না কিছুতেই থামছে না। ঈশিকা জড়ানো গলায় বলে,
—-” ওওওরা আমমমাকে নিয়ে গেল্লো…আয়ামিইইই যাযাবো নাআআ….”
—-“কে নিয়ে যাবে? কিছু হবেনা…আমি আছি তো… এই মেয়ে স্বাভাবিক হও। ঈশু…ভয় পাচ্ছি কিন্তু আমি এবার।”
একেবারে হেচকি উঠে গেছে কান্নার তোড়ে। আমান দিশাহারা হয়ে বললো,
—” এই জল খাবে? আচ্ছা একটু ছাড়ো জল দিচ্ছি আমি।” বলে যেই ঈশিকাকে ছাড়াতে যাবে ওমনি “না…না” বলে কান্না দিগুণ করে আমানকে খামচে ধরলো ঈশিকা।
আমান উপায় না পেয়ে ঈশিকাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো।

এভাবে অনেকক্ষন পর শান্ত হয়ে কান্নার তোড় কমলো। এখন আমানের টি শার্ট খামচে ধরে বুকের সাথে একেবারে লেগে ঘুমিয়ে আছে ঈশিকা।

আমান বুঝলো নিশ্চয়ই খারাপ কোনো স্বপ্ন দেখেছে মেয়েটা। এসব ভুত প্রেতের গল্প বলা ঠিক হয়নি। এমনি যে ভীতু…আবার না বললেও তো জেদ করে অন্য ঘরে চলে যেতো। তখন কেমন হতো ব্যাপারখানা? কই এখন সে বাসর করবে তা না। জড়িয়ে ধরে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে। মেয়েটাকে জান দিয়ে ভালোবাসে বলে জোড় করে কিছু করতে চায় না। অনেক কষ্টে সামলাচ্ছে নিজেকে সে।

আমান বিড়বিড় করে বললো, —-” খুব তাড়াতাড়িই তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাবো ঈশু। তারপর আর কোনো তালবাহানাই শুনবো না। কোনো বাধাই মানবো না। এক্কেবারে পুরোপুরি নিজের করে নেবো।”
বলেই ঈশিকাকে শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরে কপালের পাশে চুমু খেলো।
.
.
.
চলবে……???????

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here