তবুও তোমায় ভালোবাসি পর্ব ১৫+১৬

#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৫

ডাক্তার দেখানো শেষে মাকে নিয়ে যখন হাসপাতাল থেকে বের হলাম তখন চোখ পড়ল আয়ানের দিকে। আয়ানকে দেখে কেন জানি না খুব অচেনা লাগছিল।কারণ মুখটা বেশ শুকিয়ে আছে। শরীরটাও মনে হচ্ছে ভেঙ্গে গিয়েছে। মুখের রেখায় ভালোই ফুটে উঠেছিল যে সে মানসিকভাবে সুখে নেই। তাহলে কী আরশির সাথে আয়ানের কিছু হয়েছে? নাকি আরশি আর আয়ান সুখে নেই? আজকে আয়ানকে এত বিমর্ষ লাগছে কেন? এর আগে যখন দেখেছিলাম তখন তো এমন লাগেনি। এলোমেলো প্রশ্নগুলো মনে আসতে লাগল। আর ওকে যতই দেখছিলাম ততই যেন এক মায়ায় পড়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম প্রথম ভালোবাসা কী সত্যিই ভুলা যায়? নাকি আমি এখনো আয়ানকে ভালোবাসি তাই আমার মধ্যে এমন তোলপাড় করা ঝড় বয়ে যায় যতবারই আয়ানকে দেখি ততবারই। নাহ এসব কী ভাবছি আমি। এভাবে দুর্বল হয়ে গেলে আমি আবার কষ্ট পাব। আয়ান ভালো থাকুক অথবা খারাপ এতে আমার কিছু আসে যায় না।

আমি আয়ানকে এড়িয়ে গিয়ে মাকে নিয়ে বাসায় আসলাম। বাসায় আসার পর কেন জানি না আয়ানের মুখের প্রতিচ্ছবিটায় বারবার চোখে ভাসছিল। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিলাম। নিজের অসুস্থতা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। মানসিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত করলাম এটা ভেবে যে, যা হবে ভালোর জন্য হবে।

এভাবেই কিছুদিন পার করলাম। এর মধ্যে জাহিন সাহেবের সাথে আমার সম্পর্কটাও আরও ভালো হতে লাগল। জাহিন সাহেবের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লাগার দিক হলো উনি সবসময় সবকিছু ইতিবাচক চোখে দেখেন। উনার কাছে জীবন মানেই ইতিবাচক কিছু ঘটবে। খারাপ বিষয়গুলোতেও উনি ভালো কিছু খুঁজে বের করেন।এজন্য জাহিন সাহেবের প্রতি কেন জানিনা একটা অদ্ভুত মায়া কাজ করে।

এসব ভাবতে ভাবতেই লক্ষ্য করলাম জাহিন সাহেব কল করেছে।আমি কলটা ধরে বললাম

– হ্যালো কী হয়েছে বলুন।

– আজকে একটু নীল শাড়ি পরে ছাদে আসতে পারবেন?

– কেন বলুন তো।

– আকাশটা আজকে বড্ড সুন্দর লাগছে। আকাশের সৌন্দর্যের সাথে আপনাকে মিশিয়ে দেখব কাকে বেশি সুন্দর লাগে।

– যদি আকাশকে সুন্দর লাগে তখন কী করবেন?

– তখন আপনাকে পাশে নিয়ে আকাশ দেখব।

– আর যদি আমাকে সুন্দর লাগে তখন কী করবেন?

– তখন আকাশকে সাক্ষী রেখে আপনাকে দেখব।

– ভালোই তো কথা দিয়ে মানুষকে গায়েল করতে শিখে গেছেন।

জাহিন সাহেব আমার কথা শোনে হালকা হেসে বলল

– মহারাণী জগতে কাউকে যদি গায়েল করতে হয় তাহলে সেটা কথা দ্বারায় করতে হয়। কথার গায়েল অন্তরে বিদে আর বাকিসব ধূসর বালি হয়ে অচেনা গন্তব্যে ছুটে চলে।

– আজকাল কী ডাক্তার হওয়ার পাশাপাশি কবিও হতে চাচ্ছেন নাকি?

– আপনি যদি বলেন তাহলে একদিন একটু কবি হলাম।

– হয়েছে আর কবি হতে হবে না।তাহলে রোগীরা আপনাকে পাগল ভেবে চলে যাবে ।

– তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। কিন্তু আমার আবদারটা কী রাখা যায় না?

– কোন আবদারটা?

– একটু আগে যেটা করলাম। নীল শাড়ি পড়ে কী আসা যায় না?

আমি হালকা হেসে বললাম

– আচ্ছা আসতেছি।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। তারপর নীল শাড়িটা বের করলাম। নীল শাড়িটা বের করতে গিয়েই আলমিরার কোণে পড়ে থাকা ছোট দুটো ট্যাডিবিয়ার আমার সামনে এসে পড়ল। ট্যাডিবিয়ার দুটো দেখে আমার চোখটা ছলছল করছিল। কারণ আয়ানের দেওয়া প্রথম গিফট এটা ছিল। সব ফেলে দিলেও এটা ফেলে দিতে বেমালুম ভুলে গেছিলাম। আজকে হুট করে এটা সামনে পড়ায় বেশ খারাপ লাগছে। আয়ানের মুখটা যেন আবারও চোখে ভেসে আসলো। ভাবতে লাগলাম সত্যিই কী আমি আয়ানকে ভুলতে পেরেছি। নাকি সে আমার মনের মনিকোঠার একটা অংশে সবসময় বিরাজ করবে। সত্যিই প্রথম ভালোবাসা ভুলা যায় না। তবে আমি এখন ভালো আছি এটাই মুখ্য বিষয়। কাউকে তো ভুলা এত সহজ না তবে তার কথা মনে পড়লে যে আমার তেমন কষ্ট হয় না এটাই অনেক। ট্যাডিবিয়ারটা না ফেলে আলমিরার কোণে রেখে দিলাম। এর মধ্যেই জাহিন সাহেব পুনরায় কল দিল। আমি কলটা ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলেন

– চুল গুলো কিন্তু খোলা রেখে আসবেন।

চুলের কথা বলতেই বুকে মোচর দিল। মাথার তালু পুরো ফাঁকা। চুল তো আজকাল খোলা রাখতে ভুলেই গেছি। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম

– মাথায় চুল থাকলে তো খোলা রাখব। আমার মাথার তো সব চুলে পড়ে শেষ।

– যা আছে তাই খোলে আসুন।

– চেষ্টা করব।

বলেই কলটা কেটে দিলাম। চুলগুলো আঁচড়ে নিলাম। কাজল দিতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম চোখের নীচটা কালি পড়ে গেছে। চোখটা ভতরে চলে গেছে। গালগুলো ভেঙ্গে চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেছে। তবুও সাজলাম।তারপর শাড়িটা পড়লাম। আজকে অনেকদিন পর এভাবে সাজতেছি। যতবার সাজতেছিলাম ততবারই আয়ানের কথা মনে পড়ছিল। বরাবরেই আমার চোখে কাজল লেপ্টে যেত ঘামে। আর আয়ান হালকা হেসে বলত আমার পেত্নিটা হাজির হয়েছে। বলেই লেপ্টে যাওয়া কাজলটা ঠিক করে দিত। মাঝে মাঝে খুব বেশি সাজগোজ করলে বলত তোমাকে হালকা সাজেই বেশি ভালো লাগে। আয়ান খুব বোকাসোকা ছিল। ওকে নিয়ে যখন শপিং মলে গিয়ে কিছু পছন্দ করতে বলতাম ও সেটা করতে পারত না। সব ভার আমার উপর দিয়ে দিত। পছন্দের ব্যপারগুলোতে সে সবসময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগত। আমার বেলাও তার ব্যতিক্রম হয়নি হয়তো। এ মানুষটা কীভাবে ছয়টা বছর এভাবে অভিনয় করেছে মাথায় আসছিল না।আজকে কেন জানি না আয়ানের কথা বড্ড মনে পড়ছে। প্রতিটা পদক্ষেপে আয়ানকে অনুভব করছি। সত্যিই কী আমি তাকে ভুলতে পেরেছি।প্রশ্নটা যেন বারবার মনে বাজতে লাগল। তবুও নিজেকে সামলে নিলাম। এর মধ্যেই জাহিন সাহেবের কল আসলো। জাহিন সাহেবের কলটা আমাকে মনে করিয়ে দিল যে আমাকে ছাদে যেতে হবে। আমি কলটা না ধরেই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লাম। ছাদে যেতেই দেখলাম জাহিন সাহেব আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হালকা হেসে উনার পাশে দাঁড়াতে যাব এমন সময় লক্ষ্য করলাম আয়ান দাঁড়িয়ে আছে পাশের ছাদে। আয়ানকে দেখে একটু আনমনা হয়ে গেলাম। আজকে শুধু আয়ান একা এসেছে ছাদে। পাশে আরশি নেই। আয়ানের মুখটা যতই দেখছিলাম ততই যেন অজানা আশঙ্কা মনে বিরাজ করছে। অল্প কয়েকদিনে আয়ানের শরীরটা যেন ভেঙ্গে পড়েছে মনে হচ্ছে। আয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ানকে দেখে মনে হচ্ছিল আয়ান ভালো নেই। এর মধ্যেই আরশির আগমন ঘটল। আরশি আয়ানের দিকে কফির মগটা এগিয়ে দিল আয়ান সেটা নিয়ে আমার দিক থেকে চোখটা সরাল। পুরনো ভালোবাসাটা জেগে উঠার আগেই আমি আয়ানের থেকে চোখটা সরিয়ে জাহিন সাহেবের পাশে দাঁড়ালাম। জাহিন সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখলাম উনি তখনও আকাশ দেখায় ব্যস্ত। জাহিন সাহেব আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আমার দিকে তাকাল।আমাকে দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বললাম

– কী দেখছেন?

– আকাশকে সাক্ষী রেখে আপনাকে। কারণ আকাশের থেকে বেশি সুন্দর আপনাকে লাগছে।

– আপনি বড্ড বেখেয়ালি। বেখায়ালি মনে অনেক কিছুই ভালো লাগে।

– যেমন?

– এই যে চোখের নীচে কালি পড়ে চোখ ভেতরে চলে গেল। গাল দুটো ভেঙ্গে ভেতরে চলে গেল। চুলগুলো পড়ে প্রায় শেষ। তবুও আপনার আমাকে ভালো লাগছে শোনে এ কথাটা বলা। আপনি একটা মোহে পড়ে আছেন। আর এ মোহ খুব বেশিদিন থাকবে না। মোহ আসেই সাময়িকের জন্য। আবার চলেও যায়। আমার প্রতি আপনার যেটা সেটা আপনার মোহ। আর সে মোহের কারণেই আমাকে আপনার সুন্দর লাগছে। চোখ থেকে যখন মোহের পর্দাটা চলে যাবে তখন আর আমাকে ভালো লাগবে না আপনার।

জাহিন সাহেব আমার কথায় মুচকি হাসলেন তারপর বললেন

– আমার তো মনে হয় কিছু ভালোবাসা আসে সাময়িকের জন্য। আবার সেটা চলেও যায়। তবে অবশিষ্ট যেটা থাকে সেটা মায়া। বলতে পারেন আমি আপনার মোহে না ময়ায় পড়েছি। আর মায়া ভালোবাসা হয়ে চিরকাল থেকে যায়।

জাহিন সাহেবের কথায় প্রতিউত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর বললাম

– ঐদিন তো অনুমতি ছাড়া ছবি তুলেছিলেন। আজকে অনুমতি দিলাম আজকে কয়েকটা ছবি তুলুন। সাজগোজ করে এসেছি ছবি না তুললে হবে নাকি।

জাহিন সাহেব হালকা হেসে আকাশ আর আমাকে মিলিয়ে কয়েকটা ছবি তুলল। এর মধ্যেই হুট করে মাথাটা বেশ ঘুরতে লাগল। বুঝতে পারছিলাম মাথা ব্যথাটা চড়াও দিয়ে উঠেছে আবার। মাথাটা বেশ ঘুরছে। ঝাপসা চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমার মাথায় ধরে থাকাটা দেখে মনে হচ্ছিল সে আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি ততক্ষণে ব্যথায় হালকা চেঁচিয়ে উঠলাম। জাহিন সাহেব বুঝতে পেরে আমাকে ধরল। আমি হাঁটার শক্তি পাচ্ছিলাম না।জাহিন সাহেব কিছু বুঝতে পারছিল না কী করবে। হুট করেই আমাকে কোলে তুলে নিল। আমি তখনও ঝাপসা চোখে আয়ানের দিকেই তাকালাম। আয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যে কী হলো জানি না। বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারিয়েছি। জ্ঞান ফেরার পর বুঝলাম আমি হাসপাতালে। অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে গেছিল হয়তো। মা পাশে বসে আছে। ক্লান্ত চোখ মায়ের। বুঝাই যাচ্ছে সারারাত মা জেগে ছিল। মাকে ধরে বললাম

– ভালো আছ তো মা?

মা আমার কথা শোনে কেঁদে দিয়ে বলল

– তোর ব্যথাটা কমেছে তো মা?

ব্যথাটা তখনও হালকা ছিল তবুও মায়ের মনটা প্রশান্ত করতে বললাম

– হ্যাঁ কমেছে।

মা আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখটা মুছল। এর মধ্যেই ডাক্তার এসে আমাকে দেখে গেল।বুঝতে পারলাম রিপোর্টটা আগের চেয়েও খারাপ। তবুও মনটাকে শক্ত করলাম। জাহিন সাহেব আসলো খানিকক্ষণ পর। জাহিন সাহেবের মুখটাও মলিন। বুঝতে আর বাকি রইল না আমার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মলিন মুখের কোণে হালকা হাসি এনে বলল

– মহারাণীর কী অবস্থা?

আমি অভিমানী গলায় জবাব দিলাম

– মহারাণী হলাম কবে থেকে?

জাহিন সাহেব একটু জোরে হাসি দিয়ে বলল

– এতকিছু বুঝতে হবে না। আপনাকে রিলিজ দিয়েছে। এবার বাসায় যেতে পারবেন। এবার আস্তে করে উঠুন।

বলেই আমার হাতটা ধরে তুলল।
তারপর বাসায় আসলাম। বাসায় এসেও সারা শরীর কাঁপছিল। শরীরটা যেন নেতিয়ে পড়ছিল বারবার। সারাদিনেই মাথা ব্যথা করল। ব্যথাটা ইদানীং সারাক্ষণ থাকেই। ঔষধ খেলেও তেমন কমে না। সারাদিন পার করে সকালে জাহিন সাহেবের সাথে হাঁটতে বের হলাম। এর মধ্যেই আয়ান এসে সামনে দাঁড়াল।

(#তবুও ভালোবাসি তোমায়
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-১৬

এর মধ্যেই আয়ান এসে সামনে দাঁড়াল। আয়ানকে দেখেই আমার বুকের স্পন্দন উঠানামা করছিল জোর গতিতে। কেন জানি না হাত পা কাঁপছিল খুব। সকালের মৃদুমন্দ বাতাস তখন গায়ে লাগছিল। কেমন জানি এক অদ্ভুত অনুভূতি সেটা হয়তো মুখে প্রকাশ করার মতো না। আয়ান ঠিক আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে আছে। আমারও চোখ পড়ল এখন আয়ানের দিকে। হালকা চোখে তাকিয়ে আয়ানকে দেখেই চোখটা নীচে নামিয়ে ফেললাম। অচেনা এক দুর্বলতা যেন আমাকে আবার গ্রাস করছে। এমন সময় আয়ান বলে উঠল

– আয়রা…

আয়ানের ডাকে সাড়া দেওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। তবুও কেন জানি মুখ ফুটে বলে উঠলাম

– হ্যাঁ বলো।

আয়ান আমার দিকে তাকিয়ে উৎকন্ঠা গলায় বলল

– তোমার এ অবস্থা কেন? তোমার কী হয়েছে?

– কী অবস্থা আমার?

– চোখমুখ এমন হলো কী করে?

– পড়াশোনার চিন্তায়। রাত জেগে পড়ি তো তাই। কিন্তু আমার বিষয়ে তোমার এত কৌতুহল জাগল কেন?

– কৌতুহল জাগার কিছু নেই। গতকালকে দেখলাম মাথায় হাত দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলে ভাবলাম অসুস্থ কিনা।

– তুমি তো খুব ভালো করেই জানো ছোট বেলা থেকেই আমার মাইগ্রেনের সমস্যা। তাহলে এটা নতুন করে জিজ্ঞেস করার কী আছে?

– নাহ এমনি করলাম। কেন জিজ্ঞেস করতে পারি না কি?

– সে অধিকার তো তুমি কবেই হারিয়েছ।

– সে যায় বলো। তুমি ভালো আছ স্বাভাবিক আছ এটাই অনেক বড় পাওয়া।

আমি এবার অট্ট একটা হাসি দিয়ে বললাম

– আমি ভালো আছি এটা তোমার বড় পাওয়া? এত নাটক কীভাবে করো? আরশির সাথে বুঝি আর ভালো নেই? তাই আমার সাথে নাটক করতে এসেছ?

– আরশির সাথে কেমন আছি সেটা তোমার শোনার দরকার নেই। পরিচিত ছিলে তাই খুঁজ নিতে এসেছিলাম এর বাইরে কিছু ভেব না। ভালো থেকো।

– তোমাকে ভালো থাকতে বলতে হবে না।আমি আমার জায়গায় খুব ভালো আছি।রাস্তা ছাড়ো যেতে হবে।

আয়ান আমার কথায় পথটা ছেড়ে দিল।আমি জাহিন সাহেবকে নিয়ে সামনের দিকে এগুলাম। আয়ানের সাথে এটুকু কথায় যেন মনের ভেতরটায় উত্তাল করা জলোচ্ছাস বয়ে যাচ্ছে। সে জলোচ্ছাসটা যেন পুরনো সব অস্পষ্ট স্মৃতি গুলো আঁচড়ে ফেলছে। এর মধ্যেই জাহিন সাহেব মৃদু সুরে বললেন

– মুখটা মলিন করে আছেন কেন?

আমি আমার কন্ঠটা নীচু করে বললাম

– কোথায়? আমি তো ঠিকেই আছি।

– আপনার চেহারা বলছে আপনি ঠিক নেই। আপনার ভেতরে কোনোকিছু হচ্ছে যেটা চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।

জাহিন সাহেবের কথাটা এড়িয়ে গিয়ে আমি বললাম

– আমার ভেতরে কিছুই হচ্ছে না আমি ঠিক আছি।

আমার কথা শোনে জাহিন সাহেব এবার চুপ। এর মধ্যেই শান্ত সকালটাও বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। চারদিকে বাস ট্রাকের হর্ণ বাজছে। টঙ দোকানগুলো বেশ ব্যস্ত সকালের খাবার বানানোতে। এ ব্যস্ততা যেন হাতছানি দিয়ে বলছে বসায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। প্রতিদিন জাহিন সাহেবের বাসায় যাওয়ার তাড়া থাকলেও আজকে জাহিন সাহেব বাসায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে না। তাই আমিই জাহিন সাহেবকে বললাম

– বাসায় যাবেন না? আপনার আজকে হাসপাতালে ডিউটি নেই?

– আজকে আমার ডিউটি নেই। আজকে ফ্রি আছি বলতে পারেন।

– বাহ ভালো তো।

– চলুন সামনে এগিয়ে এক কাপ চা খাওয়া যাক।

আমি জাহিন সাহেবের প্রস্তাবে দ্বিমত না করে সামনে এগুতে লাগলাম।চায়ের দোকানটার সামনে এসে বুকটা আবারও মোচর দিল। অনেকদিন যাবত এ জায়গায় আসি না। আগে প্রতিনিয়ত সময় পেলে এ জায়গায় চলে আসতাম আয়ানের সাথে। আমি আর আয়ান বসে চা খেতাম। আজ যেন সব অস্পষ্ট স্মৃতি। জাহিন সাহেব ঠিক সে জায়গাটায় বসলো যেখানে আয়ান বসত। ভালোবাসা ভুলা যায় না তবে ভালোবাসার শূন্য জায়গাটা এভাবেই অন্য একটা মানুষ দিয়ে পূরন হয়ে যায়। আমি জাহিন সাহেবের পাশে বসলাম। চায়ের দোকানের মামা আমাকে আর জাহিন সাহেবকে দেখে একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। যেখানে দীর্ঘ ছয় বছর আমি আর আয়ান হুট হাট এসে চা খেতাম সেখানে জাহিন সাহেবকে দেখে মামা হয়তো কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। মামা একবার আমার দিকে আরেকবার জাহিন সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে। আমি মামার বিব্রতকর অবস্থা দেখে বললাম

– মামা কিছু বলবেন?

মামা হাসি মুখে বলল

– না মা কিছু বলব না।কী চা দিব বলো। তোমার তো লেবু চা পছন্দ তাই না।

আমি মৃদু হাসলাম। মামা এখনো মনে রেখেছে যে আমার লেবু চা পছন্দ। আমি মামাকে হাসির ফিনিক তুলে বললাম

– হ্যাঁ মামা লেবু চা দেন।

পাশ থেকে জাহিন সাহেব বলে উঠল

– মামা আমাকে আদা চা দিয়েন।

মামা হাসতে হাসতে চা বানাতে লাগলো। চা বানানো শেষে চা টা এগিয়ে দিল। আমি চা টা নিয়ে চায়ে চুমুক দিতেই জাহিন সাহেব বলে উঠল

– আপনি হয়তো আয়ানকে এখনো ভুলতে পারেন নি তাই না?

– প্রথম ভালোবাসা কী ভুলা যায় বলুন?

– সেটা তো আমি বলতে পারব না। এর আগে পড়াশোনার চাপে কাউকে ভালোবাসার সুযোগ পায় নি। আপনিই নাহয় বিষয়টা বলুন।

– এটা ঠিক আয়ানকে আমি ভুলতে পারিনি। একটা সম্পর্ক ছিল তার কতগুলো স্মৃতি আছে, মায়ায় জড়ানো কতগুলো মুহুর্ত আছে। সেগুলো কী হুট করে ভুলা সম্ভব? কখনও না। তবে সময় মানুষকে সেসব স্মৃতিগুলো সইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দেয়। এই যেমন আগে আয়ানকে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগত। ওর সাথে কথা না হলে মনে হত মরে যাব। ওকে ছাড়া অন্যকিছু চিন্তা করতে পারতাম না। তবে এখন সেটা হয় না। সময় সব ঠিকেই স্বাভাবিক করে দিয়েছে। এখন আয়ানকে দেখলে কিছু মায়ার মুহুর্ত মনে হলেও সেটা আগের মতো বেদনাদয়ক হয় না।

– আয়ানেকে পাওয়ার ইচ্ছা জাগে না? আয়ান যদি দ্বিতীয়বার ফিরে আসে তাকে গ্রহণ করবেন?

আমি হালকা হেসে বললাম

– ধরুন আপনার মুখে থুথু আছে আপনি সেটা যেকোনো সময় গিলতে পারবেন। তবে থুথুটা ফেলে দিলে কী সেটা তুলে গিলতে পারবেন?

– অবশ্যই না।

– আমার আর আয়ানের সম্পর্ক টাও ঠিক এরকম। যখন আমার সাথে ওর সম্পর্ক ছিল তখন হাজারটা তিক্ত কথা বললেও গিলে নিয়ে সহ্য করতাম। তবে এখন আয়ান যে পর্যায়ে এসেছে আমি চাইলেও তাকে আমার জীবনে গ্রহণ করতে পারবো না। বিষয়টা অনেকটা ফেলে দেওয়া থুথুর মতোই।

জাহিন সাহেব আমার কথা শোনে চায়ে চুমুক দিয়ে বলল

– আপনি কী আয়ানকে এখনো ভালোবাসেন?

আমি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম

– ভালোবাসি না বললে ভুল হবে। আবার ভালোবাসি বললেও ভুল হবে। বলতে পারেন এক অস্পষ্ট স্মৃতির মায়ায় জড়িয়ে আছি। আর স্মৃতি কখনো ভুলা যায় না, মুছা যায় না। স্মৃতিগুলো সুখের হওয়া সত্ত্বেও মনের গহীনে কালো অধ্যায় হয়েই বিরাজ করে।

জাহিন সাহেব এবার আমার কথায় নিশ্চুপ। চা টা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম। হুট করে বলে উঠল

– আপনার হাতে কী সময় আছে?

– কেন বলুন তো?

– একটু দরকার ছিল।

আমি হালকা হেসে বললাম

– আমার তো সময়ের অভাব নেই অনেক সময় আছে। কী দরকার বলুন।

– এক জায়গায় নিয়ে যাব।

– কোথায়?

– গেলেই বুঝতে পারবেন।

বলেই একটা রিকশা ভাড়া করলো। আমিও আর কিছু না ভেবেই উনার সাথে যেতে রাজি হলাম। স্নিগ্ধ সকালের হালকা বাতাস তখন শরীরে এসে শিহরণ তুলছিল। এর মধ্যে হালকা হালকা বৃষ্টি কণাও পরছিল। বেশ ভালোই লাগছে এভাবে ঘুরতে। আমি চোখটা বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এর মধ্যেই জাহিন সাহেব বলল

– গন্তব্যে চলে এসেছি।

আমি চোখটা খোলে অবাক হয়ে বললাম

– এত তাড়াতাড়ি?

উনি হালকা হেসে বললেন

– পাক্কা আধা ঘন্টা আপনি চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তবুও বলছেন তাড়াতাড়ি চলে এসেছি?

জাহিন সাহেবের কথায় বেশ অবাক হলাম। মনে হচ্ছিল আমি তো এ মাত্রই চোখটা বন্ধ করেছিলাম। কিছুটা লজ্জাও পেলাম। লজ্জা মাখা মুখে বললাম

– আচ্ছা… রিকশা থেকে নামছি । একটু অপেক্ষা করুন।

বলেই রিকশা থেকে নামার সাথে সাথেই….

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here