তমসার জল পর্ব -০১

” আচ্ছা! আপনাদের কাছে মানে ভদ্র সমাজের কাছে বিয়েটা কি?একটা মেয়েকে আজীবন যৌ*ন দাসী হিসেবে ব্যবহার করার বৈধ লাইসেন্স?”

জলের কথায় খানিকটা স্তব্ধ হয়ে যায় ইনস্পেকটর উপমা।ছয় বছরের ক্যারিয়ারে সে কখনো এমন অস্বাভাবিক আচরণের কোনো নারী খুনী দেখেনি।আসামীর কথাবার্তা,চালচলন, আচার-আচরণ সবই মাত্রাতিরিক্ত অস্বাভাবিক।এতদিন ধরে জিজ্ঞাসা বাদ করছে জলকে।একটা টু শব্দও যদি মুখ থেকে বের হয় আসামীর!রিমান্ডে কম মা-রধোর করা হয় নি!অন্য কোনো আসামী থাকলে এতদিনে নিশ্চিত প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে পালাতো।আসামীর একটাই কথা।যেভাবেই হোক আদালতে যেন তার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।যেখানে অন্যান্য আসামীরা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চেষ্টা করে সেখানে জল আদালতে সেচ্ছায় ফাঁ-সি চাচ্ছে!

” আপনি প্রশ্ন দ্বারা কি বুঝাতে চাচ্ছেন মিসেস বর্ষন?”

উপমার কথায় জল বড় বড় চোখ নিয়ে ঠোঁটে তর্জনী আঙুল দৃঢ় ভাবে ছুঁইয়ে বলে,,,

” শশশশ! শুধু জল।কোনো মিসেস অমক তমক না।”

” আচ্ছা জল।এখন বলুন আপনার হাজবেন্ডকে খুন করার কারণ কি?”

” এত কারণ জেনে কি হবে আপনাদের?আমি খুন করেছি।আমায় ফাঁ!সি দিন।”

উপমা বিরক্তি নিয়ে জলের দিকে তাকায়।

” আচ্ছা জল আপনার মধ্যে কি একটুও অনুতাপ নেই?আপনি নিজের স্বামীকে খুন করেছেন।যেখানে অন্যরা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সেখানে আপনি ফাঁসির জন্য পাগলামি করছেন!”

” দিন দুনিয়া দোযখ মনে হলে।আমার জায়গায় থাকলে আপনিও ফাঁ!সিই চাইতেন।”

তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে জল।উপমা বিরক্তির শেষ সীমানায় চলে গেছে।এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে জলকে কষিয়ে কয়েকটা থাপ্পড় দিতে।সত্য না বলে যাবি কোথায়?কিন্তু চড় থাপ্পড় এগুলো নেহাৎ দুধভাত মনে হবে জলের কাছে।মেয়েটা প্রচন্ড শক্ত।যেখানে উপমার হাতের একটা চড় খেলেই সব আসামীরা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে গড়গড় করে সব বলে দেয়।সেখানে জল ৭দিনের রিমান্ডেও টু শব্দ পর্যন্ত করেনি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে উপমা বলে,,,

” হাজবেন্ডকে খুন করে কি আপনি চ্যালচ্যালায় জান্নাতে যাবেন?”

ইন্সপেক্টর উপমার কথায় বেশ মজা পায় জল।রাগের মাথায় মানুষের মুখ থেকে কত কিছুই না বের হয়।ইন্সপেক্টর উপমার ধৈর্য আছে বলতে হবে।শুধু শুধু তো অল্প সময়ে ক্যারিয়ারে এত সাফল্য পান নি!জলের হাসি দেখে উপমা নিজেকে সংযত করে।মলিন কন্ঠে বলে,,,,

” সরি।”

জল দীর্ঘশ্বাস ফেলে।যে শ্বাসে মিশে আছে জলের দুঃখ কষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,

” ম্যাম জান্নাতে যাবো নাকি যাবো না সেটা আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন।তবে আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিলো আমার।”

” আপনার যখন মিস্টার বর্ষণের সাথে বনিবনা হবে না। বিয়ে করলেন কেন তাকে?বলেই দিতেন আপনার প্রেমিক আছে এবং তার সাথেই আপনি থাকতে চান।না হলে ডিভোর্স দিতেন।শুধু শুধু একটা নিরীহ মানুষকে মারলেন!”

“ডিভোর্স?কত চেয়েছি হিসেব নেই।নিজের জন্মদাতা মা-বাবাকেও পাশে পাইনি।একটাই কথা তাদের মানিয়ে নে। মেনে নে।এই মানিয়ে নিতে নিতে মেনে নিতে নিতে আমি যে প্রতিদিন ম-রে যাচ্ছি সেদিকে কারও হুশই নেই।”

অট্টহাসিতে হেসে ওঠে জল।জানালাহীন চার দেয়ালের অন্ধকার কুঠুরিটার বাতাস কেঁপে ওঠে জলের হাসিতে।হাসতে হাসতে জল বলে,,,

” আর মানুষ? ও তো জানোয়ারের থেকেও অধম।না হলে দিনের পর দিন আমার সাথে এরকম করতে পারতো না। আমি কি শুধুই ওর বিয়ে করে কেনা যৌ!নদাসী?মানুষ নই আমি?যখন যা মন চায় তাই ই করবে আমার সাথে?”

” কি করতো উনি আপনার সাথে?”

জল শান্ত হয়ে যায়।চোখের কার্ণিশ বেয়ে নোনা পানি লোকাপের জীর্ণশীর্ণ কাঠের টেবিলটায় পরে।

ফ্লাশব্যাক…

সকাল হতেই মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙে জলের।আজ ছুটির দিন।কোথায় আরামে ঘুমাবে।তা আর হলো কই?সাত সকাল মা ঘুম থেকে টেনে তুললো।

” পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।তাড়াতাড়ি ওঠ।”

” তোমায় না বলছি আম্মু এখন বিয়ে করবো না।”

” অনার্সে পড়িস আর বলিস বিয়ে করবি না!ছেলে সরকারি চাকরি করে।”

জল মায়ের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে যায়।
বাবা মার একমাত্র মেয়ে জল।অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।বাবার ভীষণ আদরের।তাই মধ্যবিত্ত বাবা সাধ্যমতো মেয়ের আবদার মেটানোর চেষ্টা করেন।জলও বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে।চাপা স্বভাবের হওয়ায় বন্ধুবান্ধব খুব কমই আছে জলের।বাবাই তার বেস্ট ফ্রেন্ড। দেখতে সুন্দর হওয়ায় অনেকের কাছ থেকেই প্রেম-বিয়ের প্রস্তাব পেতো।কিন্তু বাবা কষ্ট পাবে ভেবে সেগুলোতে আগায় নি জল। জল দ্রুত গোসল করে বেরিয়ে আসে। নভেম্বরের শেষের দিক।হাল্কা হাল্কা ঠান্ডা পরেছে।জল রোদ পোহানোর জন্য ছাদে যায়।

যোহরের আজানের পরে সাদা মাইক্রোতে করে কিছু লোকজনকে বাসার ভেতর ঢুকতে দেখে জল।কালো রঙের ফর্মাল ড্রেস পরা একটি ছেলেকে দেখতে পায় জল।ছাদের রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকায় ছেলেটাও খুব সহজেই জলকে দেখতে পায়। প্রথম দেখায়ই ছেলেটার জলকে ভালো লেগে যায়।আর ভালো লাগায় স্বাভাবিক। হাল্কা পাতলা গড়নের লম্বা চুলের শ্যামরঙা,মুখে মিষ্টি হাসির মেয়েকে দেখে যে কোনো পুরুষেরই হৃদস্পন্দন বেড়ে যাবে।ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ নিচে দাঁড়িয়ে জলকে দেখে। জল লজ্জা পেয়ে ছেলেটার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে যায়। আদরের ভাইকে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বর্ষা এগিয়ে আসে।

” কিরে?দাঁড়িয়ে আছিস যে!”

” না,এমনি।”

” এমনি নাকি স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার খোঁজ পেয়েছো?”

” আপু তুইও না!”

লাজুক কন্ঠে বলে বর্ষণ।বর্ষা হেসে দেয়।দুই ভাইবোন হাসতে হাসতে ভেতরে যায়।

বেশ ঘটা করেই পাত্রী দেখার আয়োজন করা হয়।জলের মা বিভিন্ন পদের সুস্বাদু খাবার রান্না করেন।পোলাও,গরুর মাংস ভুনা,রোস্ট,ডিমের কোরমা,মুড়িঘণ্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে ছিলো পায়েস,পুডিং,কাস্টার্ড।তিনটাই জলের বানানো।রান্নাবান্নায় অপরিপক্ক হলেও ভীনদেশীও ডেজার্ট আইটেম বেশ ভালোই বানাতে পারে জল।

জল বরাবরই ঘরকুনো মেয়ে।সহজে বের হয় না নিজের ঘর থেকে।পাত্রপক্ষ দেখতে আসায় লজ্জায় আরও জল রুম থেকে বেরোতে পারছে না।এদিকে ক্ষুধায় জলের পেটে ছুঁচো ডাকছে।সকালেও খাওয়া হয়নি জলের সেভাবে।কফি খেয়েই গোসলে চলে যায় জল।আর এসে দেখে বাসা ভর্তি মেহমান। কোনো রকমে ঘরে এসে ঘাপটি মেরে বসে জল। ব্যাগে ঘেটে দুটো বিস্কিটের প্যাকেট পায় জল।সেগুলো খেয়েই আপাতত পেটের ছুঁচোকে শান্ত করে। ঘরের পেছনের বারান্দা দিয়ে বিস্কিটের প্যাকেট ফালাতে গিয়ে পাশের বারান্দায় কালো রঙের ফর্মাল ড্রেস পরা যুবকটাকে দেখতে পায় জল।ছেলেটা ফোনে কথা বলছিলো।জলকে দেখে ছেলেটা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।ছেলেটার চাহনিতেই জলের অস্বস্তি লাগতে শুরু করে।কেমন যেন মানসিক রোগীদের মতো ছেলেটার চাহনি!জল একটুও দেরি না করে ঘরের ভেতর চলে যায়।

জলকে দেখে পাত্রপক্ষ জানায় যে তাদের জলকে পছন্দ হয়েছে।কিন্তু তারা পরোক্ষভাবে যৌতুক দাবি করে জলের বাবার কাছে।আচরণে মনে হলো ছেলের মা ইই সংসারের হর্তাকর্তা।ছেলের বাবা চুপচাপ বসে আছে।সে কোনো কথাই বলছে না।অথচ বাবারাই বাইরে গেলে মানুষ জনের সাথে কথা বলে!ছেলের মা মুচকী হেসে বলে,,,

” দেখেন ভাইসাহেব, আমাদের কোনো দাবি দাওয়া নেই।সংসার তো আপনার মেয়েরই হবে!টিভি,ফ্রিজ,খাট,আলমারি,সোফা,মেয়ের জামাইয়ের জন্য গাড়ি মানে আপনি মন থেকে আপনার মেয়েকে যা দেন আর কি!”

” মন থেকে আব্বু আমার জন্য দোয়া আশীর্বাদ দিলেই যথেষ্ট আন্টি।আপনাদের মতো এত জিনিস আমার আব্বুর কাছ থেকে চাওয়া নেই।আংকেলের কলিজা যেমন তার মেয়ে ঠিক তেমনই আমিও আমার বাবার কলিজা। আব্বু আপনাদের আব্বুর কলিজা মানে আমায় দিয়ে দিতে চাইছে সেখানে তারপরও আপনারা ভি-খারির মতো এত কিছু চাইতেছেন তাও ইনডায়রেক্টলি!”

জলের এ হেন কথায় মহিলা রাগে ক্ষোপে ফেটে ওঠেন।ছেলের হাত ধরে হিরহির করে টানটে টানতে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে যান।যাওয়ার সময় ছেলেটা জলের দিকে অদ্ভুত এক অসহায় দৃষ্টি নিয়ে থাকিয়ে থাকে।মা-ছেলের পেছন পেছন বাবা-মেয়েও বেরিয়ে যায়।

সেদিন জলের পরিবারের সঙ্গে খুব ঝামেলা হয়। কোনো মেয়ের পরিবারই সরকারি চাকরিজীবী ছেলে হাতছাড় করতে চায় না।থাকুক তাদের দাবি-দাওয়া!সাধ্য মতো জলের বাবা সেগুলো পূরণ করার চেষ্টা করবে।সেদিন রাতে জল অভিমান করে না খেয়েই ঘুমিয়ে যায়।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

[গল্পের প্রথম পর্ব পড়েই পুরো গল্পটাকে বিচার করবেন না😑ধন্যবাদ)

#তমসার_জল
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
।। সূচনা পর্ব।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here